সাদা-কালো
তাকিয়ে থাকাকেই প্রার্থনার ভঙ্গি করে নিয়েছি। জানালার বাইরে চিরচেনা দিনগুলি; গোধূলি ঘনছাই—
বোবা ও বধির হতে হতে সহসা যার দেখা মিলেছিল, সে তো জলে, ধীর তমসায় মুছে যাওয়া আমারই প্রতিবিম্ব। আঁধারে কালো কালো গাছ, প্রতিবিম্বহীন, উদ্বাহু – আমাকে টেনেছিল ঐকতানে! এখন, মৃদু শীতে, আমি যা-কিছু ছেড়েছুড়ে আর যা-কিছুর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি পা, উভয়ই দেখি মোহময়—
বহুবর্ণিল বসন্ত চলেই আসছে—ফুল ও পাতার সম্মিলন দিয়ে নগ্ন ডালপালার অতুল বিন্যাসকে আড়াল করবে।
২.
আঁতকে উঠেছি বারবার; ছিল এক
তিমিঙ্গিল হাঙর
ধড়ের থেকে যার মাথার গতি বেশি!
মনে পড়ে,
থেকে থেকে নিঃসীম কুয়াশায়
আমার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া
আর বাকিটা সময়
ক্লান্ত হয়ে যাওয়া
সামান্য আশ্রয় খুঁজে খুঁজে
মনে পড়ে,
আলোর বেগে ধেয়ে আসা মাথা
শব্দের বেগে ধেয়ে আসা ধড়।
৩.
নিজেকে দেখেছি অকারণ কান্নায়- সবই ধূসর-সাদা, ধূসর-কালো, ছাই—
ছিলাম বিরল রক্তযূথের কেউ,
মুমূর্ষুতা ও বলিষ্ঠতার দিকে তাকিয়ে
দেওয়া-নেওয়া থেকে সমান দূরে
তবু অনেক কিছু এনেছি আর ধেয়ে আসে অনেক রং
ধূসর দিনগুলি থেকে; মিশে যায় এপারের দিনে!
নিজেকে কিছুটা আনন্দিত, নৃত্যোন্মুখ দেখে আমারই ভালো লাগছে।
মিরর-মেইজ
বসন্তের এই মেঘলা সকালবেলা—
বৃষ্টি পড়ছে ভোর থেকে টিপ টিপ;
ঠাণ্ডা বাতাস ডালে ডালে করে খেলা—
সিঁড়ির গোড়ায় কম্পিত টিউলিপ।
তোমার মতন অতটা ব্যস্ত কই!
বসে থাকি ঘরে, বাইরে বৃষ্টি ঝরে—
নিজেকে থামাবো তত সক্ষম নই;
ব্যস্ত লোককে ফেলেছি আতান্তরে।
বৃষ্টির ফোঁটা তোমার ও-মুখটাকে
আয়নার মতো ধরে নিয়ে ঝরে যায়;
বাইরে দাঁড়ালে কে আর শান্ত থাকে—
মিরর-মেইজে ওই মুখ ঝলকায়।
ভেবে দেখো তুমি, পড়ে গেছি আমি ফেরে—
সামর্থ্য কই তোমাকে এড়িয়ে চলি;
আজকের দিনে হুহু করে এসে ভেড়ে
বহুবর্ণিল কাঙ্ক্ষিত দিনগুলি।
হতে কি পারে না দু’জনের মাখামাখি?
আড়াল না হয় না রাখলে তুমি অত—
গাছেদের ডাল হাওয়ায় দুলছে দেখি
সম্মতি আর অসম্মতির মতো।
প্রাণায়াম রিপ্রাইজ
চোখ বন্ধ করো, মুখ উপরে তোলো
ভাবো নীলে নাক ঠেকেছে- নীলের গন্ধ নাও; তোমার ফুসফুস ভরে যাচ্ছে ঐশ্বর্যময় নীলে। আহা! শান্ত-গভীর আকাশ, তাপহীন সূর্যের আলো, তোমার চারপাশে হাওয়ায় অগণন স্বয়ম্ভূ পালক, সাদা পালক, আলোমাখা, আলোমাখা! তোমার উদার নিশ্বাস আর প্রসারিত দুই হাত- নিজ কণ্ঠের প্রতি আগ্রহী হও- গান শোনো গান, স্বরচিত, সর্বোপরি নিজের কণ্ঠস্বর শোনো।—এ ভীষণ কার্যকর।—এ হলো এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি শীতল সম্পর্কের মাঝখানে। মনে করো ফাঁকা মাঠ; সন্তর্পণে সবুজে ছেয়ে গেল। কোমল-উড্ডীন-ধাবমান সবুজ, তোমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে রসালো সবুজ, অমল-উজ্জ্বল অন্তর্দৃষ্টি স্বচ্ছ করা সবুজ! —
নিশ্বাস নাও গভীর ভাবে এবং নিশ্বাস ছাড়ো
নিশ্বাস নাও নিশ্বাস ছাড়ো
নিশ্বাস নাও নিশ্বাস ছাড়ো
গভীর নিশ্বাস নিতে থাকো ধীরে ধীরে। প্রতিটি নিশ্বাস বহুবর্ণিল প্রশান্তিকে ভিতরে টানছে— প্রতিটি নিশ্বাস তোমার অবসন্ন মাংসপেশীতে পৌঁছে দিচ্ছে সঙ্গীত। বলো, ‘প্রশান্তি, আমি তোমার অধিকার রাখি, আমার ভালো লাগছে এইসব অনুভূতি।’
দ্যাখো, বনের প্রান্তে এক ঘোরানো সিঁড়ি, শীর্ষ যার অভ্রভেদী। সিঁড়ির শীর্ষে তুমি। নিচে ফুলেল স্বস্তি; ধীরে ধীরে নামতে হবে। পা দাও পারস্য-গোলাপি ধাপে, দ্যাখো সে তোমার স্পর্শে সবুজ। পা বাড়াও; পা দাও গাঢ় বেগুনি ধাপে, দ্যাখো সেও সবুজ। প্রতিটি পদক্ষেপ তোমাকে প্রশান্তির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে—প্রতিটি পদক্ষেপ প্রশান্তির দিকে, প্রতিবার টেনে নেয়া নিঃশ্বাস গাঢ় থেকে গাঢ়তর সুগন্ধের দিকে। কত আরামদায়ক, কত নিরাপদ এই নেমে যাওয়া! জীবন এক হিরণ্ময় প্রজাপতি হয়ে ঘুরছে তোমার চতুর্দিকে। সামান্য দূরে ভেজা বালুপ্রাঙ্গণ ডাকছে তোমাকে।
তাকিয়ে দ্যাখো, সূর্য ডুবছে ধীরে ধীরে সূর্য-ডোবা দ্যাখো—এ হলো প্রশান্তির জন্য এক শান্তিপূর্ণ কৌশল। বিড়বিড় করে বলো, ‘সহজ হবো, আমি সহজ হবো, বহুব্যক্তিত্বময়তার সংকট দূর হোক, খাক হতে চাওয়া এক অসুস্থতা, অসুস্থতা দূর হোক।’ নিশ্বাস নাও, নিশ্বাস ছাড়ো- প্রতিবার ছেড়ে দেয়া নিশ্বাসের সাথে শেষ ক্লান্তিটুকু বেরিয়ে যাচ্ছে…
খয়েরি-সাদা; সুফিনৃত্যের ভঙ্গিতে হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে ঝরে পড়া ফুলের মতো করে প্রশান্তি নামছে তোমার অন্তরে। নির্জন বেলাভূমিতে পাতার আসন পাতা—তুমি বসে আছো—মুখে দূর-অস্তাচলের আলো, মুখে লেগে আছে হাসি।
দ্যাখো দ্যাখো, তোমার সারাটা দিন নতুন সম্মিলনে: নীল আর সবুজ তোমার আত্নার স্বচ্ছতার সাথে এক অমর্ত্য অনুপাতে একাকার হয়ে যাচ্ছে, অ্যাকোয়ামেরিন! অ্যাকোয়ামেরিন! প্রশান্ত জলরাশি; তুমি জলের উপর মগ্ন— ডুবে যেতে না যেতেই সূর্য উঠে এসেছে; অনুভব করো তাকে— প্রশস্ততাকে ধরে প্রশান্তির দিকে, প্রশান্তিকে ধরে মহাশান্তির দিকে, তুমি মহাশান্তির দিকে তুমি…
ধীরে ধীরে চোখ মেলো,ধীরে ধীরে খোলো চোখ।
নীলফামারী
সবুজ তামাক-ক্ষেতের পিছে বাঁশঝাড়, তার পিছে সূর্য ওঠে। যদি আগাও আরও উত্তরে, তাহলেই তো নীলফামারী। তুমি দেখবে ঐ জেলা শহরে ঢুকে, তুমি অবাক হবে, যদি বাসে করে যেতে যেতে প্রতিটি জেলার মানুষের আচরণ পরখ করতে থাকো, মনোযোগ দিয়ে। দেখবে ধীর থেকে ধীরতর হচ্ছে মানুষগুলি—এবং নীলফামারী, সব থেকে ধীর মানুষদের জেলা, এক কালে ছিল মহকুমা; দেখবে সবাই এলোমেলো, জবুথবু, সময়জ্ঞানহীন। যদি আরও আগাও, ডোমার হয়ে চিলাহাটী— এত আঁকাবাঁকা রাস্তা পৃথিবীর কোনো সমতলে খুঁজে পাবে না। এরাই বানিয়েছে, কারণ এরা সময়জ্ঞানহীন, জবুথবু, কাচা তামাক-পাতার মতো বাতাসে স্থির, বিড়ির মুথা আর সিগারেটের তুলা ছ্যাবড়া করে ফ্যালে, সুপারি গাছে লতিয়ে ওঠা পানের মতো উচ্ছ্বাসে; এরা ক্রমাগত চাবায় পান, মজায় কাচা সুপারি মাটিতে পুঁতে। এদের ভাষাও তেমন; এরা প্রতি মুহূর্তে ভাষাকে নাচাতে, ঘোরাতে, পেঁচাতে আর চাবাতে ভালোবাসে অভিব্যক্তির পর অভিব্যক্তি এঁকে।
ঈশায়ী ২০১৬
দিনমান অন্ধকার, দিনমান হাওয়ার শাসানি—
ক্যাথ্রিনের চাকা যেন সারাটা আকাশ—খালি ঘোরে,
বিদ্যুৎ চাবুক হয়ে আকাশে আকাশে আছড়ে পড়ে।
দিনমান হাহাকার, দিনমান ছায়ার গোঙানি।
ঝড়-ঝাপ্টা দিনরাত, গুমোট গুমোট ভাব ফাঁকে—
চলে যাচ্ছে দিনগুলি, চলমান নীতির প্রভাবে
বিশাল ঝাঁকুনি লাগে দ্যাখো গড় আয়ুর হিসাবে;
লাশের ওপরে বসে মৃত্যু ভাবে ‘মৃত্যু’ বলে কাকে!
জগতে এমন কালে জেগে ওঠে নীরব চিৎকার
নিয়ত দু’কানে বিষ বাণের মতোই এসে পড়ে।
হাত-পা সে কিছু নয়, গড়া হলো মগজ-পাহাড়
পাহাড় পর্ব্বত হবে, অস্ত্রের যোগান শুধু বাড়ে।
চাতালে টায়ার-সুইং একা দোলে প্রবল বাতাসে।
চাতালে টায়ার-সুইং একা দোলে প্রবল বাতাসে।
কবি পরিচিতি
![]()
জন্ম: ০২ অক্টোবর, ১৯৮৩ ইং, নীলফামারি। বর্তমান নিবাস: নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
পেশা: ফিন্যান্সিয়াল এনালিস্ট।
প্রকাশিত কবিতার বই:
কাঠঠোকরার ঘরদোর(২০১৫, চৈতন্য), ধুপছায়াকাল (২০১৮, মেঘ), গোধূলির প্যানোরামা (২০২০, বৈভব), অচির অরোরা (২০২৩, বাতিঘর)।
সম্পাদনা: ওয়েবম্যাগ ‘নকটার্ন’ (যৌথ)।
যোগাযোগ: imran831002@gmail.com, +16096061184