তার কবিতা প’ড়ে আমার মনে হয় আমার নিজের কবিতা, যা আমি লিখে ফেলবার আগেই এই নচ্ছার কোনো টেলিপ্যাথিক তেলেসমাতিতে জেনে ফেলে, পেড়ে ফেলেছে
১.
ব্রাত্যর গতিবিধি আতঙ্কজনক,
কখন কী ক’রে বসে ঠিক নাই;
আমি তাই তার থেনে সাত হাত দূরে কানা বক—
নিরাপদে, সর্বদাই।
সে-ই অবশ্য তুলেছিল (খামাখাই?)
অতর্কিতে বিতর্কিত প্রসঙ্গটা,
অমনি— গাধার পাল, অসামান্য ঘটা
ক’রে, ঘাঁটতে লেগে গেল তত্ত্ব আর তথ্যের ডাঁই।
ব্রাত্যরে ঘাঁটায়ো না, ভাই,
কাম্ড়ে দিতে পারে,
এমন সব্যসাচীর সম্মুখে দাঁড়াই
অত মাথা নাহি মম ঘাড়ে।
কাউরে শ্বাসরোধ ক’রে মারার শ্রেষ্ঠ উপায় কী? না, তারে একখানা আধুনিক বাংলা কবিতার বই আদ্যোপান্ত পড়তে বাধ্য করো। নরহত্যার জন্য এর চেয়ে সহজ, নিশ্চিত, ও শৈল্পিক পদ্ধতি আর নাই। এক গেলাস শুকনা বালি গিলিয়ে দেবার যে ফল, এক্ষেত্রেও তা-ই হবে— আর আবার ময়না তদন্তেও কিছুই সাব্যস্ত হবে না, মুর্দার ব্রেইন স্ক্যান ক’রেও বোঝা যাবে না, কী হয়েছিল; ব্রেইনে— কিছুই পাওয়া যাবে না। কীভাবে, কবের থেকে, কবিতা এরূপ জৈব মারণাস্ত্র হ’য়ে উঠল, তা ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়। এ বিষয়ে জ্ঞানালোকপাত করবার জন্য আমি আচার্য সলিমুল্লাহ্ খান প্রমুখেরে আহ্বান জানাই, এবং ইত্যবসরে আমার নিজের, কবিতা না পড়ার কারণ নিয়ে দু’চার বাক্য বলি। প্রথম, এবং প্রধান, কারণ হ’ল, খুদখুশি না করবার ইচ্ছা। অপরাপর গৌণ কারণের উল্লেখ, অতএব, বাহুল্য।
কিন্তু বাংলা কবিতা চিরকালই কিছু শুকনা বালি-তো ছিল না? বালি একেবারেই যে না ছিল তা নয়, তয় তার ফাঁকে ফাঁকে পানি, পলি, গাছ-গাছড়া, জন্তু-জানোয়ার, এবং অসংখ্য পরিন্দা ভি ছিল, যারা কলকাকলি করত, এবং কখনও বা বেমক্কা কারুকারুর ব্রহ্মতালুতে…। বস্তুতঃ গত শতকের পঞ্চম কি ষষ্ঠ দশক পর্যন্তও, বালির এতাদৃক্ দাপট অন্ততঃ আমার নজরে তেমন আসে নাই। ষাটে কাঠের গুঁড়ার কিছু আধিক্য হয়েছিল বটে। কিন্তু কাঠ, দুষ্পাচ্য হ’লেও, একেবারে অডিকম্পোজনীয় নয়, এবং তার উদ্গীরণ বা প্রশ্বসনে হাঁফানি যদিচ প্রায় অবশ্যম্ভাবী, পঞ্চত্বপ্রাপ্তির সম্ভাবনা মামুলি। সেই কাঠকে, মাঝে মধ্যে, গলাধঃকরণের উপযোগী ক’রে দেবার মতো দু’চারটা পয়স্বিনীও, যেমন আল মাহমুদ, তখন পাওয়া যেত বৈকি।
সত্তরে, যুদ্ধকালীন এলএমজি এসএমজি কার্বাইনের গুলিতে ধরণি ধূলিসাৎ। আমরা জিহ্বা পাকস্থলীতে বুঝতে পারলাম “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়” কথাটার মানে কী। জগতের যাবতীয় ক্ষুধা— যথা অন্নক্ষুধা, চিন্তাক্ষুধা, শিল্পক্ষুধা (নট টু মেনশন যৌনক্ষুধা)— একযোগে আমাদের আক্রমণ ক’রে, বাঙালি মনের সুধার ভাঁড়ারকে একেবারে উজাড় ক’রে দিয়ে চ’লে গেল। আর ঐ যে গেল, আর-তো এল না ফিরে! অতঃপর বালি, শুধু ধুধু বালি।
অগত্যা আমরা এক সাহারা শহরে, এক মৃতের নগরে করি বাস। হেথা ফুল নাই, পাতা নাই, পাখি নাই, পাখির বিষ্ঠাতক নাই, নাই হাসি, নাই কান্না, নাই রাগ, ঠাট্টাতামাশা— নাই ভাষা। আছে খালি বীজগণিতের অগণিত ভুল ফর্মুলা। ভুলভাল ভাষায় কৌতুক করা হ’লে তা আরও কৌতূহলোদ্দীপক প্রায়শঃ যদিচ হয়, সেরূপ ভাষায় বৈজ্ঞানিক তথ্য পরিবেষণ করলে তা হয় অপস্মারজনক। এবং বাংলাদেশে প্রকৃত বিজ্ঞানীর ঘাটতি থাকায়, এবং কবিরা তাদের শূন্যস্থানপূরণে প্রচেষ্ট হওয়ায়, গতিক গয়ঙ্গচ্ছ। এহেন গর্গন বদন মিস্টার/মিসাস মেলাপ্রপে আমাদের কাব্যাঙ্গন, আমাদের শাহ্বাগ, আজ পরিকীর্ণ। এদেরকে দেখলেই পাথর হ’য়ে যাওয়া লাগে, কবিতা পড়া-তো দূরের বিষয়। মাত্র ক’একজন সংশপ্তক, হাস্যমুখে এই অদৃষ্টেরে পরিহাসে কৃপাণপাণি হয়েছেন সাম্প্রতিককালে, ব্রাত্য রাইসু তাঁদিগের অন্যতম।
‘এবার থামো মেঘ, কিছুটা নেমে এসে
বিরহ যমুনার
ছাপিয়ে কূল
ব্যাখ্যা করো এই কাষ্ঠবরষার
পেছনে কী ঘটনা
বদ্ধমূল’
আমাদের কবিতায় হিউমার-এর একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল— এমনকি তিরিশ পর্যন্ত। তিরিশেই অবশ্য ব্যাপক হারে অসবুজায়ন শুরু হয়— বাংলা কবিতার ‘জঙ্গল’গুলির পরিষ্করণ আরম্ভ হয়, এবং কাঠের গুঁড়া মিশে যেতে লাগে বাংলার জলে স্থলে সর্বজায়গায়। তবু জীবনানন্দর কিছু মস্করা— যদিও বড়ই কঠিন কিসিমের— আমরা কভি কভি ল’ভে আসছিলাম। অমিয়বাবুর ঈষৎ বাঁকা হাসিও যে একেবারেই অপ্রাপ্ত হতে থাকছিল (‘আধুনিক’ হিন্দির ঢঙে বললাম) তা-ও না। আর তার আগে? না, আমি সেরেফ গুপ্তকবি বা কবিগুণাকরের কথাই কইছি না। বরং, এবং বিশেষতঃ বরং, তথাকথিত ‘সিরিয়াস’ লোকেদের লেখা-ই যাচাই করতে আহ্বান জানাচ্ছি আপনাদের, যথা মধু, যথা হেম— রবি বা দেবু (দেবেন্দ্রনাথ সেন) বা দ্বিজু (ডি এল রায়) বা সত্য (দত্ত) বা নজু (ইসলাম) -দের কথা বাদই দিলাম, বাদই দিলাম খোদ চর্যাপদ থেকে শুরু ক’রে আমাদের (তথাকথিত) মধ্যযুগীয়, এবং (আবারও তথাকথিত) লোকসাহিত্যের গোটা ঐতিহ্যকে। (১)
কিন্তু কালে এই হিউমার হ’য়ে যেতে থাকল উইট, এবং উইট কনসিট (হায়, ইংরেজি ছাড়া আমরা কিছুই বোঝাতে ও বুঝতে পারি না রে আর! যদি বলতে পারতাম ‘রস’, হ’য়ে যেতে ধরল ‘কষ’, এবং বুঝতে পারতাম যে বোঝাতে পারা যাচ্ছে তাতে, কী ভালোই না হ’ত!)। তিরিশিদের হস্তে ঐসা শান পড়ল বেচারার উপর যে তা একেবারে সূক্ষ্মশরীরী হ’য়ে গেল, চোখে দেখা আর যায় না, কেবল ধ’রে নে’য়া লাগে।
হাসি এবং কান্না, দু’টা জিনিসই যেহেতু একাধারে অভব্যতা, মেয়েলিপনা, ও মানসিক দৌর্বল্যের উপসর্গ, এসবের হাত হ’তে এই কেঁদো, হেসো, ভেতো বাঙালিজাতিকে উদ্ধার করতে হবে না? নৈলে স্বদেশি তারা লড়বে কী ক’রে? তাছাড়া, আর্ট্-তো ফর আর্ট’স্ সেইক, হাসিকান্না’জ্ সেইক-তো নয়। একটা ওয়্যর্ক্ অব আর্ট্ দেখে বা শুনে তোমার ব্রেইনে (‘হৃদয়ে’ কথাটা লেখা যাবে না, কেননা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ‘হৃদয়’ একটা রক্তসঞ্চালন যন্ত্র মাত্র) আর্টের জন্ম (বা মৃত্যু) হবে, মুখে হাসি কি চোখে কান্নার নয়। এলিয়েনেশন, নেগেটিভ ক্যাপাবিলিটি, ফর্মালিজম ইত্যাদি কত কী’র সঙ্গে বোঝাপড়া তোমাকে করতে হবে, এবং তা করতে গিয়ে হাসিকান্নার অবকাশ কই? তুমি-তো তেমন নাদান নও! কাজেই আমরা ভীষণভাবে ‘পুরুষ’, ‘ভব্য’, ‘আর্টিস্ট্’, ও (সর্বোপরি) ‘অবাঙালি’ হ’য়ে উঠলাম। আমরা আমাদের অ্যানিমাকে বধ ক’রে, অ্যানিমাস-এর একচ্ছত্রতার প্রতিষ্ঠা করলাম (আমাদের মধ্যে যাঁরা জৈবিকভাবে নারী শ্রেণির, তাঁরাও তা-ই করলেন, হায়!)।
এরপর চল্লিশ পঞ্চাশ ষাট সত্তর— কত আন্দোলন যে হ’ল! ব্রিটিশ খেদাও, ইসলামবাদী (নাকি ইসলামাবাদী?), ভাষা আন্দোলন, নকশালবাড়ি সর্বহারা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, ইত্যাদি ইত্যাদি, এবং এই সকল আন্দোলনেরই পুরোধার ভূমিকায় গরীয়ান্ থাকলেন আমাদের তত্তত্কালীন কবিরা— কিন্তু আমাদের বাঙালিয়ানা, মেয়েলিপনা, আমাদের হাসিকান্না, এবং সর্বোপরি (এবার বন্ধনীর বাইরেই) “হৃদয়” কে ফিরিয়ে আনবার আন্দোলন আর হ’ল না। এমন হ’তে পারে যে যে মুখোশ আমাদিগের মুখে সেলাই ক’রে দিয়েছিলেন আধুনিকেরা তা খুলতে আমাদের নারাজির কারণ হ’ল এই যে, মুখোশের তলায় মুখানি গ’লে প’চে এতদিনে হয়েছে গায়েব (অর অল বাট গায়েব, হুইচ ইজ ইভেন ওয়্যর্স্)। রাইসুর এই মুখোশ খশানোর অভিযান, তাই— আতঙ্কজনক।
‘[…] বসে রবো বাঘেরই কারণে
দূরে দূরে
বাঘ কি তা বুঝতে পারবে?
নাকি ভুল বুঝবে আমাকে? বাঘ
বুঝবে আমাকে?’
রাইসুর কবিতা ল’য়ে উচ্চবাচ্য করা নানাভাবে আমার জন্য বিপজ্জনক। প্রথমতঃ সে আমার পরম আপনজন— মনের ভুলে তারে নাখোশ ক’রে দিয়ে এই স্বজনহীন জীবনে সম্পূর্ণ খামোশ হ’য়ে যাবার আশঙ্কাটা সমূলক। দ্বিতীয়তঃ সে হয় বহু মানুষের সংরাগ, এবং বহুতরর বিরাগভাজন। কাজেই, আমি ভালো, মন্দ যা কিছুই লিখি, বহু মানুষের কোপদৃষ্টিকে আমার গায়ে প’ড়ে মাথা পেতে নিতে হবে। কী গেরো! কিন্তু না-ই বা লিখি কেমনে? কিন্তু লিখিই বা কীরূপে? লজ্জা লাগে যে! মনে হয় নিজের কবিতা নিয়ে লিখছি। ও হ্যাঁ— এইটাই, তার কবিতার বিষয়ে কহতব্য আমার সবচেয়ে জরুরি কথা। তার কবিতা প’ড়ে আমার মনে হয় আমার নিজের কবিতা, যা আমি লিখে ফেলবার আগেই এই নচ্ছার কোনো টেলিপ্যাথিক তেলেসমাতিতে জেনে ফেলে, পেড়ে ফেলেছে।
আশির শেষাশেষি তার কবিতার সনে মোলাকাত। গাণ্ডীব পত্রিকায়? কী যেন ছিল কবিতাগুলা? মনসা? গঙ্গা? ভালোমতো যা মনে আছে তা হ’ল, টানা গদ্যের মতো ক’রে অক্ষরবৃত্তে গাঁথা এক দুর্বার শব্দস্রোত— যাদের শেষতক পৌঁছাতে পৌঁছাতে শ্বাস উঠে যায় (আলোচ্য বইতে কবিতাগুলা আছে, প’ড়ে দেখতে আজ্ঞা হয়)। এদের মধ্যে পশ্চিমা (অরে! পশ্চিমা মানে পশ্চিমবঙ্গীয়) প্রভাব কিছু আছিল মনে হয়েছিল। আমাদের পাশ্চাত্ত্য দাদাদিগের ভিতরে যাঁরা উল্লিখিততর, তাঁদের কারুকারুর রচনায় এরূপ নিরবচ্ছিন্ন শব্দের ফ্লোটিলা হামেশা দেখা গেছে, এবং সেসব, রীতিমতো ‘অ ইন্স্পায়ারিং’। কবিতার সামনে ‘অ’ চোখে থ হ’য়ে অধিকক্ষণ দাঁড়ালে হাঁফ ধরে— আর ঈদৃশ ক’একখানা কবিতা রচার পর রাইসুরও তা-ই ধ’রে থেকে থাকবে ব’লেই বোধ হয় পরে সে আরও একটু ফাঁকযুক্ত, বাঁকযুক্ত, হাওয়া খেলানো কবিতার দিকেই গেল শেষমেশ। আর এমন হাওয়াই সে খেলাল যেমন আর খেলানো হয়-নি বাংলার কাব্যাকাশে— ‘আমি দখিন হাওয়াই আমি দখিন হাওয়াই।’
এমন তবু নয় যে তার কবিতা ঢিলাঢালা (বঙ্গের অগণ্য স্বয়ঙ্ক্রিয় অকবির মতো, মগজের সহিত একেবারে সম্পর্করহিতভাবে, মুখ দিয়ে যা কিছুই বেরুল তা-ই ছাপা হ’য়ে গেল, যদ্ভাবিতু তদ্ভবতু), বরং, ব্যক্তিগত পরিচয়সূত্রে জানি, কী বিপুল অধ্যবসায়, অধ্যেষণা আছে তার ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের পিছনে (বস্তুতঃ তার কবিতা আঁকার ও ছবি লেখার মধ্যে এই একটি কুটুম্বিতা আছে যে প্রতিটি শব্দকে মনে হয় যেন একটি রেখা, এবং ভাইসি ভার্সা)। কাজেই, এই যে ফাঁক, বাঁক, ও হাওয়া হাওয়াই, এর প্রত্যেকটাই সর্জিত, এবং শৈল্পিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। মায়ের পেটের থেনে বাচ্চার সুরুৎ ক’রে বেরিয়ে পড়াকে অপরের কাছে যত স্বতঃসঙ্ঘটিত ব্যাপার মনে হয়, খোদ মায়ের কাছে সেরূপ মনে হয় না নিশ্চয়, কেননা সে-ই খালি জানে যে নয় মাস ধ’রে কী কঠোর তপস্যা, স্বপ্ন, ও কষ্টের ফসল ঐ ফেরেস্তামুখো খুদে শয়তানটি। এমনই প্রযত্নের ধন রাইসুর এক-এক শব্দ। তার মানে এ অবশ্য নয় যে তার সব সন্তানেরই অঙ্গসংস্থান ত্রুটিমুক্ত। কিন্তু সেই বিকলাঙ্গ বাচ্চাগুলিরও পিছনে নয়মাসের নয় দিন কম কৃচ্ছ্র বিনিয়োজিত হয় নাই, কেবল কপালদোষেই…। (২)
রাইসুকে প্রায় চোখের সামনে কবিতা খোদাই করতে দেখে, জানেন, আমার এক বোধের উদয় হয়েছে— যে, ‘ফলেন পরিচীয়তে’ অন্ততঃ কবিতার ক্ষেত্রে পুরাপুরি সত্য নয়। কবিতা দেখে বরং তার রচনাপ্রক্রিয়া তথা রচয়িতার পরিচয় যত কম মালুম হয় তত বেহ্তর। বড় বড় চিত্রীদের চিত্র যেমন হামেশা আতশিকাচ দিয়ে দেখা লাগে, তাঁদের স্ট্রোক এর ধরন ধরতে, বড় কবিদেরও কবিতায় রচনাশ্রম এইমতো প্রায় অদৃশ্য হ’য়ে থাকে। রচনা যদি হ’য়ে পড়ে কবির ধস্তাধস্তির নথি, তাতে, তা তে আমরা একজন শ্রান্ত, ঘর্মাক্ত, অজীর্ণক্লিষ্ট কবির মুখচ্ছবি দেখতে পাই বটে, কিন্তু সুন্দরীতমা, মরালবাহনা কাব্যসরস্বতী সেখান থেকে অন্তর্ধান করেন। কিন্তু এই যে রচনাশ্রমকে রচনার থেকে নাই ক’রে দে’য়া, এটা, সাধ করলেই হবার নয়, এর জন্য বহুবহু বর্ষার সাধনার দরকার। রাইসুর সম্পূর্ণ সিদ্ধি এখনই এসে গেছে তা বলব না (বরং উল্টাটাই বলব, সিদ্ধি তার এখনও আসে-নি, তাই জন্যেই এই রচনা), কিন্তু সাধনা সে ক’রে চলেছে, নিরন্তর— এবং সেটাই আসল কথা। মা ফলেষু কদাচন।
উঁহু, বাচালতা অনেক হয়েছে, এবার কবিতায় নাক গলানো যাক।
‘তুমি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাকে রেখে, পাশ কেটে সরে যাও— ঘোরানো সিঁড়ির দিকে— যাহা কিছু দীর্ঘ— অব্যাখ্যাত— প্রশ্নচিহ্ন আকারে উঠেছে …’
বিদ্রূপ নয়, রাইসুর কবিতার মূল সুর রসিকতার— এবং এটি নানা পথে নানা মতে ঘ’টে থাকে: এই রসিকতার মূলে যে রস, তা উদ্ভট রস, যার জোগান সে দেয় একপ্রকার সুসমঞ্জস অসামঞ্জস্যের বয়ানে। এই বয়ান তৈরি হয় পরিবেষণার নানা উপচারে: ছন্দে, বাক্যগঠন ও শব্দচয়নে, অনুকরণ-অনুরণন-প্রতিকরণ-প্রতিসরণে— ঘটে, সর্বোপরি, চিন্তাপ্রক্রিয়ার অপরিচিতিকরণে (রুশ ফর্মালিস্টেরা ‘অস্ত্রানানি’ না-কি কী জানি কয় এরে?)। আমি এবে একে একে ইহাদের কিছু আন্দাজা দেব।
রাইসু, ছন্দের এই কারা ভাঙতে উদ্যত হয়েছে। অক্ষর, মাত্রা, স্বর, গদ্যের মেলামেশা আরম্ভ হয়েছে তার কবিতায়
২.
ছন্দ
তে তীণি তে তীণি তীণি হো ভিন্না৻
ভণই কাহ্ন ভব পরিচ্ছিন্নাৼ
বাংলা ছন্দের তিন বৃত্তেরই আদি জননী এই পদ্ধড়ি বা পাদাকুলক। চার-চারেক্কে ষোল মাত্রার এই ছন্দের শেষের দুই মাত্রা কালে খোয়া যায়, বাংলায় দীর্ঘস্বরের অনুপস্থিতির কারণে প্রধানতঃ। মাঝখানের দমটা, বা সেজ্যুরা, অবশ্য বজায় থাকে। ছন্দটা হয় চার + চার // চার + দুই, একুনে আট ছয় = চৌদ্দ। কিন্তু এই আট ছয় অক্ষরগণনার নয়, মাত্রার, যার সঙ্গে সম্পর্ক সময়ের— তালের— লয়ের— সর্বোপরি, ওজনের। (ইংরেজি কবিতাও, গোড়ায়, ছিল এমনই ওজন নির্ভর। অ্যাংলো স্যাক্সন কবিতায় সিলেবলের সঙ্খ্যা নয়, বরং সেজ্যুরার আগে পিছের সামগ্রিক ওজন ছিল ছন্দোমিতির নিরিখ— জেআরআর টলকিন-এর এ বাবদে একটা তুখোড় লেখা আছে, নাম মনে নাই। সেজ্যুরার আগে থাকত পূর্ণপদ, যার তাল রাখত কমপক্ষে দু’টি অনুপ্রাসিত, প্রস্বরিত অক্ষর, বা অ্যালিটারেটিভ সিলেবল; ও পরে, সাধারণতঃ, একটি। ওজন প্রধান ছিল আদিম ভারতীয় মাত্রাবৃত্তও, যার প্রয়োগ আছে বেদে (এবং নানা প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ছন্দে)— বৈদিক ছন্দে, আরও মনে রাখতে হবে, প্রস্বরতার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই, গানের, কানের, ভূমিকা হ্রাস পায় সংস্কৃত পর্বে, ছন্দের স্থিতিস্থাপকতা একেবারে নষ্ট হ’য়ে যায় তখন।) এই চারকে বলা যায় “পর্ব” (ক), আর একটা পর্বের জায়গায় চার-এর কম মাত্রা থাকলে, তাকে “উপপর্ব” (খ), পর্বের দ্বিগুণকে “পদ” (গ) বা পূর্ণপদ, আর পূর্ণপদের স্থলে আট মাত্রার কম থাকলে তাকে “অপূর্ণপদ” (ঘ)। চরণ, পঙ্ক্তি, শ্লোক আবার অন্য ব্যাপার। সচরাচর একটা লাইনে যতটা থাকে তা-ই এক চরণ, তবে এটা সদাসত্য নয়, একটা চরণ একাধিক লাইনে প্রায়শঃ গড়িয়ে যায়। টাইপসেটিং এর ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় যে চরণের শেষে থাকে একটা হার্ড রিটার্ন্, আর চরণ একাধিক লাইনে গড়ালে, প্রত্যেকটি অপূর্ণ চরণের শেষে পড়ে একেকটা সফ্ট্ রিটার্ন্। যা হোক, প্রাচীন বাংলা (এবং সংস্কৃত) কবিতায় দাঁড়ি (। ) দিয়ে চরণকে চিহ্নিত করা হ’ত। দুই চরণে হ’ত এক পঙ্ক্তি, পঙ্ক্তি নির্দিষ্ট হ’ত দুই দাঁড়িতে। বাংলা ছন্দ ছিল, অ্যাব ইনিশিও, পঙ্ক্তিমূলক। দুই পঙ্ক্তিতে এক শ্লোক (কাজেই এক শ্লোকে চার চরণ)— যা সংস্কৃত কবিতার ভিত্তি। নীচের পঙ্ক্তিগুলা এবার দেখুন:
১. ছোট দেহের নাই রে কৈতর কী করে তার খোপে।
যে নারীরো সোয়ামি নাই রে কী করে তার রূপে ॥
২. বিদ্যাপতি কহ কাঞ্চনগোরী।
সো মরকততনু তোঁহে কিয়ে ছোড়ি ॥
৩. আটপণে আধসের কিনিয়াছি চিনি।
অন্য লোকে ভুয়া দেয় ভাগ্যে আমি চিনি ॥
এগুলা স্ক্যান করলে দেখা যাবে যে একই ছাঁচে তারা গড়া, যদিও আধুনিক ছন্দোবিচারে তারা যথাক্রমে স্বর, মাত্রা, ও অক্ষরবৃত্ত। এগুলি এইভাবে সাজানো: ক ক (গ) // ক খ (ঘ)— (২ নং উদাহরণের “গোরী” ও “ছোড়ি” কে দুই মাত্রা ধ’রে নিয়ে বলছি, যদিও, আদতে, এরা চার মাত্রা)। এই ছিল প্রাথমিক চাল (পাঁচালি), এবং প্রথমাবধি সকল বাংলা কবিতাই গীত হ’ত ব’লে, যেখানে একটা পূর্ণ ক থাকবার কথা (অর্থাৎ চার মাত্রা) সেখানে চারের কিছু বেশকম হ’লে গায়কেরা একটু টেনে বা দ্রুত গেয়ে তাকে “চার সম” ক’রে নিত। একই কথা প্রযোজ্য গ-এর ক্ষেত্রেও। এই টানাপড়েনের সুবিধা কবিরা সানন্দে নিত, এবং প্রাচীন বাংলা কবিতায়, বিশেষতঃ পদাবলিতে, যে বিষমমাত্রিক পদ দেখি, যাকে পরে “শুদ্ধ” ক’রে মাত্রাবৃত্ত করলেন রবীন্দ্রনাথ, তার ইতিহাস এই। অক্ষরবৃত্ত প্রধানতঃ কাহিনি কাব্যের বাহন হওয়ায়, এক্ষেত্রে কবিরা এই বিশেষ লাইসেন্স্টির ব্যবহার কমিয়ে দিতে থাকে (কেননা, কাহিনি কাব্যগুলি ঠিক “গীত” হ’ত না, একপ্রকারের “সুরেলা আবৃত্তি” হ’ত তাদের), কমিয়ে দিতে দিতে অক্ষরবৃত্ত বানিয়ে ফেলতে থাকে, এবং কবিকঙ্কণ পর্যন্তও বিষমমাত্রিক পদ (গ) যদিও হামেশাই মেলে, ভারতচন্দ্রে তা বেমালুম গায়েব হয়।
কিন্তু যে পরিমাণ মাত্রাবৈষম্য অক্ষরবৃত্তের চরিত্রহনন করে না, তার প্রয়োগে, মাঝেসাঝে, পয়ারের একগুঁয়ে একঘেয়েমির হাত থেকে রেহাই মেলে। ইংরেজি কবিতায়, বড় কবিদেরও রচনায়— বড় কবিদের রচনাতেই বেশি— দেখতে পাই, হামেহাল, ধরা যাক, একটা আয়াম্বিক চরণে একটা ট্রোকি কি স্পন্ডি কি অ্যানাপেস্ট্-কে ঘাপটি মেরে থাকতে। (৩) বরং যারা এবংবিধ মিশ্রণকে বিষবৎ পরিহার ক’রে চলেন, তারাই আখেরে হ’ন উপহসিত, অপঠিত। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করি, মধুসূদনের কাব্য সমালোচনায় জনৈক সাহিত্যবেত্তা (নাম মনে নাই, দীননাথ বা প্রমথ বিশী বা সুকুমার সেন হ’তে পারেন, না-ও হ’তে পারেন) বলেছিলেন যে বীরাঙ্গনা কাব্যে এসে মধু’র ছন্দ মধুর হয়েছিল, মেঘনাদ পর্যন্ত তাঁর ছন্দ ছিল নড়বড়ে, কেননা তদবধি তিনি “বেজোড়ে বেজোড়ে গাঁথো, জোড়ে গাঁথো জোড়”, এই নিয়ম সর্বথা মেনে চলেন-নি; “তিন দুই তিন” ধরনের পদ তখন পর্যন্ত তাঁর কাব্যে বিস্তর মেলে। জনাব সাহিত্যবেত্তার এই ফয়সালা, আমাদের আরও অনেক সাহিত্যবিদের অনেক মন্তব্যেরই মতো, হাস্যোদ্রেকী।
পদ ও উপপদের নানা বিন্যাস আস্তে আস্তে শুরু হয়। এসব যে ঢের পরেকার কথা তা অবশ্য নয়। চর্যাপদ থেকেই, বলতেকি, এর লাগাতার নজির মেলে। তবে সেসব প্রধানতঃ গানে, এবং প্রধানতঃ মাত্রামূলক ছন্দে। অক্ষরবৃত্তে এইসব নিরীক্ষা আরও পরের ব্যাপার (অক্ষরবৃত্ত নিজেই কিনা পরের ব্যাপার), এবং এসবের মূলে, আবার, উপর্যুক্ত মাত্রাচ্ছন্দের গানের ভূমিকা ছিল। কের্মে কের্মে ছয় ছয় আট, আট আট ছয় বা আট আট দশ (আট + দুই) -এর ত্রিপদী (লাচাড়ি) ছাড়াও, দশাক্ষর একাবলি, চৌপদী, পঞ্চপদী, ললিত, ইত্যাদি নানা ছন্দের উদ্ভব হয়, এর সবগুলিরই বিশুদ্ধি দেন ভারতচন্দ্র, কোনোকোনোটির জনকও খোদ তিনিই। এসবকে তবু পদবিন্যাসই বলতে হয়, ঠিক চরণবিন্যাস বা স্তবক (স্ট্যান্জা) বলা চলে না। মধুসূদনই প্রথম, পশ্চিমী অর্থে স্তবকের জন্ম দেন বাংলায়। একদিকে যেমন সনেট, অন্যদিকে নানারূপ ছোট ছোট স্তবক নিয়ে খেলেছেন তিনি ব্রজাঙ্গনা কাব্যে। তবে রাইসুর কবিতায়, এই অর্থে স্তবকের ব্যবহার নাই। সে বড়জোর ত্রিপদী করেছে।
আট ছয়ের বাঁধন ছড়ায়, গানে, এমনিতেই হরদম অমানিত হ’য়ে আসছিল, বিশেষতঃ মাত্রা ও স্বরবৃত্তে। পরে অক্ষরবৃত্তেও চৌদ্দর কমবেশি চরণ দেখা দিতে লাগল (আগের প্যারায় ত্রিপদী, একাবলি প্রভৃতির কথা বলেছি), আঠারো, বাইশ বা আরও বেশি অক্ষরের মহাপয়ারের উদ্ভব হ’ল— চৌদ্দ অক্ষরী পয়ার চরণের মাঝখানকার ভারসাম্য রক্ষাকারী সেজ্যুরা স্থানচ্যুত হ’ল ক্রমে— কখনও ভেঙে টুকরা হ’য়ে গিয়ে একই চরণের একাধিক জায়গায়, কিছু দুর্বলভাবে, ছড়িয়ে গেল, কখনও বা নির্বাসিত হ’ল একেবারে। আমাদের যত ছন্দোবৈচিত্র্য, তার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে এই সেজ্যুরাকে নিয়ে খেলা করা। (৪)
বিষম চরণদৈর্ঘ্যের কবিতা, যাকে পরে “মুক্তক” বা “গৈরিশ” ছন্দ বলা হয়েছে, তা কিন্তু গিরিশচন্দ্রের ঢের ঢের আগেই বাংলায় প্রবেশ করেছিল— বাংলায় ইংরেজ আগমনেরও ঢের ঢের ঢের আগে, চর্যাপদ থেকেই, বলতেকি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এর প্রয়োগ-তো ভূরিভূরি। অবশ্য পয়ারের প্লাবনে বাংলা কবিতার এই সম্ভাবনাটা ডুবে ছিল অনেকদিন। পরে, উনিশ শতকে, এ আবার মাথা উঁচোয়— উঁহু, গিরিশ ঘোষের নাটকে নয়, মধুসূদনেরই কবিতায় (তাঁর গদা ও সদা প্রভৃতি শিশুতোষ কবিতা পশ্য)।
আমাদের পুরাতন কবিতায় দেখি অক্ষরবৃত্ত ও স্বরবৃত্তকে গা জড়াজড়ি ক’রে থাকতে পয়ারের বাঁধনে (পয়ার ও অক্ষরবৃত্ত সমার্থক শব্দ নয়; প্রতি দু’ চরণে মিলযুক্ত, আট ছয়ের যে চাল, তাকেই বলা উচিত পয়ার, তা সে যে ছন্দেই হোক), দেখি মুকুন্দরাম পর্যন্ত তাবৎ বাংলা কাব্যে, দেখি মৈমনসিংহ গীতিকায়। আবার মাত্রা ও অক্ষরবৃত্তের মেলামেশা পরিলক্ষণীয় গানে, পদাবলিতে, যেখানে কিনা মাত্রা ও ওজন অনেকটাই নির্ভর করত সুর, তাল, গায়নভঙ্গির ‘পরে। ধীরে ধীরে এই ছন্দঃপিণ্ডের ভিতর থেকে অক্ষরবৃত্তকে তার বর্তমান গাণিতিক রূপে ছেঁকে বের করা হয়, ভারতচন্দ্রে এই মিশন সম্পূর্ণ হয়। মাত্রাচ্ছন্দ প্রায় নির্বাসিতই হ’য়ে যায়, আর স্বরবৃত্ত ছড়া-য় ও লোকগানে (থুড়ি, “জাতীয়” গানে, পার সলিমুল্লাহ্ খান) (৫) শুধু টিঁকে থাকে, টিঁকে থাকতে থাকে, তার আদিম বিশুদ্ধতা— বা এখনকার দৃষ্টিতে, অশুদ্ধতা— রক্ষা ক’রে ক’রে।
রবীন্দ্রনাথ মাত্রা ও স্বরবৃত্তকে উদ্ধার করলেন এই অপাঙ্ক্তেয়তার অন্ধকার থেকে। কিন্তু তিনি নিজে করলেন কী? না, ভারতচন্দ্র অক্ষরবৃত্তকে যা করেছিলেন, তা-ই তিনি করলেন মাত্রা ও স্বরবৃত্তকে। এসবকে তিনি সংস্কৃত বানিয়ে দিলেন। এদের ইলাস্টিসিটি একেবারে নষ্ট হ’য়ে গেল। ছন্দে মুক্তির বদলে, ছন্দের দাসত্ব কায়েম হ’ল। কবির ইচ্ছার বাহন আর রইল না ছন্দ, হ’য়ে পড়ল তার কারাগার। রাইসু, ছন্দের এই কারা ভাঙতে উদ্যত হয়েছে। অক্ষর, মাত্রা, স্বর, গদ্যের মেলামেশা আরম্ভ হয়েছে তার কবিতায় (প্রসঙ্গতঃ, রবীন্দ্রনাথ নিজে কিছু গানে এমনকিছু কাজ করেছিলেন— শঙ্খ ঘোষের ছন্দের বারান্দা দেখুন— কিন্তু আফসোস, কবিতায় তিনি এই মিলমিশকে বিলকুল সেঁধাতে দিলেন না, এমনকি গদ্যেও যখন লিখলেন কবিতা, তখনও প্রায় সর্বদা, নেহাত আটপৌরে “চলিত” ভাষাকেই ব্যবহার ক’রে গেলেন)।
অক্ষরবৃত্তেই সবচেয়ে সাবলীল রাইসু, এবং এই বৃত্তেই সে উপরিকথিত অস্ত্রানানির প্রয়োগ সর্বাধিক করেছে। মাত্রা ও স্বরবৃত্তে লেখা বেশকিছু কবিতা বা কবিতাংশও আছে এ পুস্তকে, এবং সেসবও, রাইসুর মাইডাস ছোঁয়ায়, জাত খুইয়ে অন্যকিছু হ’য়ে ব’সে আছে। আর গদ্যচ্ছন্দের কথা আলাদা ক’রে কওয়াই যাবে না— তার গদ্যের সঙ্গে অক্ষরবৃত্তের (এবং মাঝে মাঝে অন্যান্য বৃত্তেরও) এমন এক মিতালি আছে যে গদ্যে লেখা কবিতাকে অক্ষরবৃত্তরূপে পড়া যায় (এবং ভাইসি ভার্সা)। মাসুদ খানের অক্ষরবৃত্ত/গদ্য সম্পর্কে প্রায় একই কথা বলা যায়, তবে খানের অক্ষরবৃত্তে লেখা কবিতা পড়লে মনে হয় গদ্য, রাইসুর গদ্য পড়লে মনে হয় অক্ষরবৃত্ত— মানে, প্রথমোক্তের আন্তরিক ঝোঁকটা গদ্যের দিকে, পরোক্তের পদ্যের।
এই যে ছন্দের অস্ত্রানানি, তা ঘটে প্রধানতঃ দুই প্রকারে: এক. কোনো একটি নির্দিষ্ট ছন্দের কাঠামোয় আঁটে না, এমন কথাকেও রাইসু সেখানে ঢুকিয়ে দেয় এমন চাপলিসে যে পাঠকেরা সেটা খেয়ালই করেন না; এবং দুই. এর উল্টাটা— অর্থাৎ সঠিক ছন্দে লেখা হওয়া সত্ত্বেও পাঠকের কানে লাগে, মনে হয় কী জানি গোলমাল আছে, কিন্তু স্ক্যান করবার পর দেখা যায় নাই। এই দুই রারা আহ্বিস্ কে রাইসু ঘায়েল করে একটিমাত্র ব্রহ্মাস্ত্রে, আর তা হ’ল তার ছন্দের কান। আমাদের কবিতার ছন্দে আজকাল কানের ভূমিকা একেবারে লোপ পেয়ে গিয়ে চক্ষুর চক্রবর্তিত্ব কায়েম হ’য়ে গেছে (“পড়া” কথাটার অর্থই-তো গেছে বদ্লে— পড়া মানে “বলা” নয় আর, “দেখা”)। মাসুদ খান ও ব্রাত্য রাইসু (এবং পশ্চিম বাংলার আরও অনেকে, আরও অনেক আগে থেকে— যদিও খানিক ভিন্নভাবে) আমাদের কান ধ’রে টানাটানি আরম্ভ করেছেন। অনভ্যাসে পয়লা পয়লা ব্যথা লাগবে অনেকেরই, কিন্তু খানিক স’য়ে এলে বোঝা যাবে কী দুর্ভোগ থেকে এই কর্ণবিমর্দকেরা আমাদের বাঁচাতে চাইছেন। কবিতার ছন্দ যে ধ্বনিমূলক, ধ্বনিচিহ্নমূলক নয়— অঙ্গুলিমেয় নয়, অন্তঃকরণমেয় (নাকি অন্তঃকর্ণমেয়?); মানে, কবিতা যে আদতে শ্রাব্য শিল্প, দৃশ্য শিল্প নয়, তা তাঁরা আবার আমাদের মনে (বা কানে) পড়িয়ে দিতে চাইছেন। আমরা-কি কর্ণপাত করব না তাঁদের আহ্বানে?
রাইসু এই যে দুই বিপরীত অস্ত্রানানি ঘটায় তার ছন্দে, এটা সম্ভব হয়, তার, প্রতিটা বৃত্তের নিজস্ব চলনের ধরনগুলার সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকবার কারণে। এই জ্ঞানের ফলে, প্রথমতঃ, সে জানে একেকটা ছন্দঃপর্ব ঠিক কতটা ব্যভিচার সইতে পারে, এবং তাকে মাত্র সেটুকু সইয়ে, তার প্রথম ধরনের অস্ত্রানানি সে ঘটায়— এবং পাঠকের কানও, কাজেই, পীড়িত হয় না। আঙুলের উপর নির্ভর করলে এটা তার পক্ষে সম্ভব হ’ত না। দ্বিতীয়তঃ, আবার, এই জ্ঞানটা থাকবার ফলেই, চোখের মাপকে ঠিক রেখেও, ছন্দের চলনকে বদ্লে দিতে সে পারে, ফলে, পাঠকের কান একটা হেঁচকি তুলে বলে, এই রে! কিন্তু চক্ষু মহাশয় তার কোনো সমর্থন দেয় না।
অধিক বাক্যক্ষয় না ক’রে উদাহরণে যাই:
‘মাসুদ খান ভেবে বললেন, কোথায় এলেম ভাই মরতে’
উপরের চরণটি পড়তে আমাদের কান কোনো আপত্তি করে না, কেননা, শব্দান্তিক রুদ্ধাক্ষরের ঐকমাত্রিক ব্যবহার আমাদের ঐতিহ্যে আছে:
১. শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিটকাল।
২. বেহুলা বলে শ্বশুর তুমি দেবতা সমান৻
অভাগিনী বেহুলার কথা কর অবধানৼ
আমাদের চোখ অবশ্য কটমট তাকায়। চোখের মানভঞ্জন হ’তে পারত, যদি আমরা এভাবে লিখতাম: “মাসুক্ষান ভেবে বল্লে, কোথায় এলেম ভাই মরতে” এখন আপনি ভেবে, এবং ব’লে, দেখুন যে “মাসুদ খান ভেবে বললেন” এবং “মাসুক্ষান ভেবে বল্লে”, এ দুইয়ের ওজনের ইতরবিশেষ কতটা।
এবার উপর্যুদ্ধৃত ২ নং উদাহরণের দ্বিতীয় চরণটিকে নিন, এবং স্ক্যান করবার চেষ্টা করুন। আমরা যারা পুথিপাঠ কখনও শুনেছি, যারা পুথিপাঠকের “সুর” এর সঙ্গে পরিচিত, তাদের কানে এই লাইনটিও হোঁচট খাবে না, আমরা জানব যে একাধিকভাবে এটি বিশুদ্ধ পয়ারের মাপে পড়া যাবে: “(অ)ভাগিনী বেহুলা(র) কথা কর অবধান।” বা “অভাগিনী বে(হ্)উলা(র) কথা কর অবধান।” প্রথমটিতে দু’ধরনের সঙ্কোচন ঘটেছে, প্রথমতঃ, “অভাগিনী” র “ভা” এর উপরে আত্যন্তিক জোর (প্রস্বর) পড়বার ফলে, তার আগের “অ” প্রায় লুপ্ত হয়েছে, এবং “বেহুলার” এর শব্দান্তিক “লার” এক মাত্রা হ’য়ে গেছে, অর্থাৎ “বেহুলা” ও “বেহুলার” তুল্যমূল্য হ’য়ে গেছে। দ্বিতীয়টিতে, “হ”, যা কিনা একটি অর্ধব্যঞ্জনমাত্র (বা আশ্রয়দাতা স্বরের প্রস্বরিত রূপ— মনে করুন যে আমরা এখনও “ইহা”/ “নিয়া” মিল দিই কবিতায়), “উ” এর ভিতর প্রায় গুলে গিয়ে, পূর্বাক্ষরের “এ” এর সঙ্গে মিশে, একটা যৌগিক স্বর (ডিফথং) গঠন করেছে, এবং অক্ষরবৃত্তের নিজস্ব নিয়মেই, শব্দের শেষে না থাকলে, রুদ্ধাক্ষর ও যৌগিকস্বরান্ত অক্ষর (অক্ষর = সিলেবল, বর্ণ নয়) যেহেতু এক মাত্রা হয়, এখানে তা-ই হয়েছে, মানে “বেহু” (“বেউ”, “বৌ” এর মতন) হয়েছে এক মাত্রা, এবং শব্দান্তিক “লার” ও হয়েছে এক মাত্রা, একুনে “বেহুলার” = দুই মাত্রা। প্রাচীন কবিতায়, খেয়াল করবেন, পাঠক, যে, এইরূপ লাইসেন্স্ সেজ্যুরার পূর্ববর্তী পূর্ণপদেই প্রধানতঃ নে’য়া হ’ত। অষ্টাক্ষর পূর্ণপদ, ষড়ক্ষর অপূর্ণপদের থেকে বেশি ঘাতসহ-তো স্বাস্থ্যগত কারণেই। রাইসুর কবিতা থেকে আরও দৃষ্টান্ত:
‘পরস্পরে বচসা করে, ফলে বারো মাস
অসৃজনশীলতা তাকে ভারাক্রান্ত করে
আবু হোসেন শাহরিয়ার ছাড়া
লতাগুল্ম ছাড়িয়ে কেবল / গভীরে ধায়’
শেষ উদাহরণটিতে, “গভীরে ধায়” এর সঙ্গে তুলনা করুন “গভীরতা”।
এর উল্টা ধরনের (অর্থাৎ, দ্বিতীয় প্রকারের অস্ত্রানানির) উদাহরণ এখন:
‘খান সাহেবও সূর্য দেখলো
আমরা যাই ততক্ষণে, খান সাহেব’
উপরের লাইন দু’টিকে আমাদের চোখ সহজেই অক্ষরবৃত্ত ব’লে পড়তে (দেখতে) পারে: “খান্সাহেবো সূর্য দেক্লো”, “আম্রা যাই ততক্ষণে, খান্সাহেব”। কিন্তু আমাদের কান কীভাবে পড়তে এদের চাচ্ছে?: “খান সাহেবও / সূর্য দেখলো //”— স্বরবৃত্ত; “আমরা যাই / ততক্ষণে, / খান সাহেব //”— পাঁচ মাত্রা/স্বরবৃত্ত। অর্থাৎ, অক্ষরবৃত্তের নিয়মকে লঙ্ঘন না-ক’রেও, এই চরণ-দু’টিতে স্বর ও মাত্রাবৃত্তের চলন আরোপিত হয়েছে।
অন্যান্য বৃত্তের কিছু নমুনা এবার উদ্ধার করা যাক:
১. বর্ষামঙ্গল
পুরো কবিতাটিই উপপর্বে তৈরি। চরণের প্রথমে একটা দুই মাত্রা উপপর্ব, ও পরে তিন বা চার মাত্রা (তিন মাত্রার শেষ অক্ষর, বা দল, মুক্ত, চার মাত্রার, রুদ্ধ)। এটিকে ফরিদ কবির “দুই মাত্রার” ছন্দ বলতেন। তাঁর কবিতায়ই আমি প্রথম দেখেছি।
২. ‘অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা বিষয়ে মাঠকর্মীদের উদ্বেগ
আমাদের এই / অস্তিত্বের /
কী অর্থ হয়, / ভেবে / ৪/৫ জন /
সার্তর
নিয়ে বসেছেন / দুপুরবেলার / পাড়াগাঁয়…/
যথেষ্ট ঘাস।/ গরু চড়িতেছে। (ংরপ) / গরুদেরও
অস্- / তিত্ব /
হয়ে ওঠে।/ যদি কার্যের /
মাধ্যমে কোনো / তাত্পর্যের / সন্ধান /
পাওয়া যায় যদি / পাওয়া গিয়ে থাকে /
এই আশা আশা- / ভঙ্গে /
দুলছেন / পাঁচ চারজন /
আটঘাট মাঠ- / কর্মী /
যাঁরা / উপর্যুপরি / মার্ক্সিস্ট। আর /
এনজিও থেকে / প্রেরিত।/’
চরণের শেষে ছাড়া অন্যত্রত্য উপপর্বগুলিকে নিম্নরেখাঙ্কিত করলাম। লক্ষ করুন, তৃতীয় চরণে “সার্তর” এর সঙ্গে চতুর্থ চরণাদ্য “নিয়ে” একটা পর্ব (ক) তৈরি করছে, এই “নিয়ে”-ই আবার পরে “বসেছেন” এরও সাথে আরেকটা পর্বে জুড়েছে! পর্ব ভেঙে দু’টি চরণে চ’লে গেছে চরণ ৫/৬ এর “গরুদের অস্ ”। আর গোটা কবিতাটাকেই দেখুন, কেমন গদ্যেও পড়া যায়!
৩. ঠাক্কুরমঙ্গল
সাট আটজন / সরলা এবং / টরল রাবিন্- / ড্রিক /
সঙ্গে / শিল্পাঞ্জি এক- / জন /
টিনি / টবলা বাজাচ্- / ছেন /
ডূরে গুরু / বড্ডো লঘু- / চিট্টের /
নবীনা কিশো- / রীর /
টাল লয় কি / ছন্ডে কিংবা /
আনন্ডে অস্- / ঠির॥ /
এক ধরনের খোলামেলা স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্তের ইশারা আছে ইতিউতি (যথা “সরলা এবং”)।
৪. খাল কাটার নান্দনিক গুরুত্ব
আমরা ঠিক / খালের পাড়েই / দাঁড়িয়ে আছি।/
কুমীর দেখবো।/ দিন যাচ্ছে।/
রাত জাগছি।/ বাঘ দেখলাম / এর মধ্যে।/
দাঁত মাজছেন।/ লেজ নাড়ছেন।/ লেজের নিচে /
পাড়ার যত / ভূতত্ত্ববিজ্- / ঞানী।/
আমরা সব / বখাটে ছেলে।/ ক্ষমতাসীনের /
খুঁচরোখাচরা।/ কিম্ভূতকিমা- / কার।/ তাদের দিকে /
ভালবাসার / হাসি হাসচি।/ তারা /
গম্ভীর মুখে / নেতার দিকে / তাকিয়ে আছেন।/ নেতা
দেখছেন / কুমারী ও বাঘ।/ নিজেদের প্রয়ো- / জনে /
ছোটখাটো এক / জঙ্গল গেড়ে /
ফেলেছে এ দঙ্- / গলে।/ আর /
খাল ভরে গেছে / অগণতান্ত্রিক / তাহা তাহা শৈ- / বালে।/
স্বরবৃত্তের বুকে দেখুন ছয় মাত্রা কেমন হরিহর হয়ে আছে (উপপর্ব ছাড়া নিম্নরেখাঙ্কিত পর্বগুলি স্বরবৃত্তের নয়, পুরাপুরিই ছয় মাত্রার, “অগণতান্ত্রিক” আবার, একেবারে সাত মাত্রা)। দেখুন, নবম চরণান্তিক “নেতা” কেমন পরের চরণের “দেখছেন” এর সঙ্গে একটা পর্ব গঠন করছে। তাছাড়া, উপপর্বের চরণমধ্যস্থ প্রয়োগ দেখুন (সপ্তম চরণে “কার”, আবার দ্বাদশ চরণে পর পর দু’টি, “গলে” ও “আর”)। একই রকমের ব্যাপার লক্ষণীয় শাস্ত্রীয় আচরণের বিপরীতের আমাদের উত্কণ্ঠা, ও বড় মাপের ছোট কবিতা/ছোট মাপের বড় কবিতা-র দ্বিতীয় ও পঞ্চম অংশেও। জয় গোস্বামীর ছায়া অবলম্বনে কবিতায়ও স্বর ও মাত্রাবৃত্তের মেলামেশা পশ্য।
৫. আপনাদের গর্জন
এটি বিশুদ্ধ স্বরবৃত্ত। পঞ্চম চরণের শুরুতে উপপর্ব “তাদের” লক্ষণীয়।
৬. বিফ বার্গার
তারা বসে বিফ / বার্গার
খাচ- / ছিল / আর পা দোলাচ্- / ছিল /
বিগ বাইটের /
টেবিলের নিচে / আর টেবিলের /
উপরে / বার্গার
দুল- / ছিল /
এবার, একটু অন্যভাবে সাজাই:
তারা বসে বিফ / বার্গার খাচ- / ছিল /
আর পা দোলাচ- / ছিল /
বিগ বাইটের / টেবিলের নিচে /
আর টেবিলের / উপরে /
বার্গার দুল- / ছিল /
৭. মেঘদূতম্
কবিতাটি বুদ্ধদেব বসু প্রদর্শিত মন্দাক্রান্তা ছন্দের বাঙালি করণ। মন্দাক্রান্তা মূলে ৮,৭,৭,৫ মাত্রার, ও যথাক্রমে ৪,৬,৪,৩ অক্ষরের (গগগগ, লললললগ, গলগগ, লগগ— গ = গুরু, ল = লঘু) ছন্দ (“কশ্চিত্কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ”), যাকে হুবহু প্রতিসর্জন করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, তাঁর যক্ষের নিবেদন কবিতায় (রুদ্ধাক্ষরকে গুরু ও মুক্তাক্ষরকে লঘু ধ’রে নিয়ে), যথা, “পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল, কই গো, কই মেঘ, উদয় হও!’ আমি নিজে এই পন্থায় একটা কবিতা লিখেছিলাম একদা: “উত্তুঙ্গোদ্বেল উদীচী অবাচীর মধ্যে নিঃস্তর আমার দেশ” ইত্যাদি। বুদ্ধদেব বসু মেঘদূতের অনুবাদ করতে গিয়ে, গুরুলঘুর ক্রমকে গুরুত্ব না দিয়ে, তিনটি সাত মাত্রার পর্ব, ও একটা তিন থেকে সাত মাত্রার উপপর্ব দিয়ে এর অনুরণন এনেছিলেন বাংলায়— “জনেক যক্ষের কর্মে অবহেলা ঘটল বলে, শাপ দিলেন প্রভু।” রাইসু এই শেষোক্ত ছন্দেই গেঁথেছে তাঁর মেঘদূতম, ব্যতিক্রম শুধু এই যে, শেষের উপপর্বটি তার ক্ষেত্রে সর্বদাই পাঁচ মাত্রার, ও অন্ত্যানুপ্রাসিত। এই ছন্দ নিয়ে নানাভাবে খেলেছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সমাচার দর্পণ কাব্যে। সৌম্য দাশগুপ্তর চর্যাগীতিকা-ও একটা উল্লেখযোগ্য কাজ, এক্ষেত্রে। এই দু’জনেই, বুদ্ধদেবের চেয়ে একহাত এগিয়ে গেছেন, তিন চারের গতানুগতিকতাকে প্রায়শঃ উল্লঙ্ঘন ক’রে। রঞ্জন হামেশা প্রথম পর্বে আট মাত্রা ইস্তামাল করেছেন, তা-ও আবার প্রায়শঃ মূল মন্দাক্রান্তার চতুর্গুরু। অল্টার্নেট রাইমও ব্যবহার করেছেন ইতিউতি। …এমনিতে সাত মাত্রার ছন্দ বিষয়ে আমার বক্তব্য এই যে সাত মাত্রার ছন্দ আসলে চার মাত্রার ছন্দ, যাতে প্রতিটি পর্বের আগে একটা তিন মাত্রার উপপর্ব থাকে। এক ধরনের সাত মাত্রার স্বরবৃত্তও আছে এই অর্থে, যে ছন্দে নজরুলের লিচুচোর কবিতাটা লেখা।
৮. জ্ঞানের অর্থ
ত্রয়োদশ চরণে চরণমধ্যস্থ উপপর্ব “কিবা”, যা কিনা আবার আগের চরণের অন্তস্থিত “নিবা” র সঙ্গে রাইম করছে, অপিচ অন্তঃস্থ মিল “ঝরঝরে নিজে”/ “মোর ঘরে নিজে” দ্রষ্টব্য।
৯. আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি
কবিতাটি আগাগোড়া অতিসরল, অতিতরল (একটাও যুক্তাক্ষর নাই এতে) ছয় মাত্রায় লেখা। কিন্তু কবিতার একেবারে পয়লা পর্বটিতে আছে পাঁচ মাত্রা: “মেঘেলা দিনে”। কানে কিন্তু লাগছে না। কেন? কেননা, প্রথমতঃ, পর্বটি পাঁচ পাঁচটি মুক্তাক্ষরে লেখা ব’লে, এবং দ্বিতীয়তঃ, “মেঘেলা” র সঙ্গে “একেলা” র অন্তঃস্থ মিল।
জানি, কেউ কেউ কইবেন যে রাইসুর ছন্দের দোষকে গুণ বলে চালাবার দুশ্চেষ্টা আমি করেছি উপরে। আমিও এমনই হয়তো বলতাম, রচনাটা, ধরা যাক, সৈয়দ তারিকের লেখা হ’লে। কিন্তু দোষগুণের বিচারটা মুলতবি রেখে যদি, যে সম্ভাবনাসমূহ অঙ্কুর মেলতে চাইছে তার কবিতার ছন্দে, তাদেরকে নজরবন্দি করা যায়, তবে বাংলা ছন্দের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতির কিছু কার্যকরী ধারণা নোতুন কবিসকলের মনে উপজিতে পারে বা। অন্ততঃ তারা যদি আঙুল গোনা বন্ধ করতে পারেন, এবং চোখের চেয়ে কানকে ঈষদধিক রেয়াত করেন-তো কবিতা পাঠকদের প্রতি আখেরে কিছু সুবিচার করা হ’তে পারবে ব’লে অধমের উমেদ হয়।
শব্দগুলিতে রাইসু ইচ্ছাকৃতভাবে (খাঁটি বা মেকি) “ঘটি” বা “রাবীন্দ্রিক” উচ্চারণ আমদানি করেছে, এবং একধরনের হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে। তাকে অভিনন্দন। এযাবৎ আমাদের “বাঙাল” উচ্চারণ নিয়ে ওঁয়ারা হাসাহাসি করতেন, এবে আমরা করব তাদের উচ্চারণ নিয়ে। শোধবোধ।
৩.
কথা
বাক্যগঠন, শব্দচয়ন, ইত্যাদি, তথা চিন্তার অপরিচিতীকরণ— এই সবকিছুকে আমি “কথা” এই উপশিরোনামে পুরেছি। আসুন দেখি রাইসুর কথার ফের বা রকমফেরের কিছু নমুনা:
ক. শব্দ:
এলেম ; দাঁড়ালেম ; বিকেশ / নিকেশ ; হাসচি
শব্দগুলিতে রাইসু ইচ্ছাকৃতভাবে (খাঁটি বা মেকি) “ঘটি” বা “রাবীন্দ্রিক” উচ্চারণ আমদানি করেছে, এবং একধরনের হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে। তাকে অভিনন্দন। এযাবৎ আমাদের “বাঙাল” উচ্চারণ নিয়ে ওঁয়ারা হাসাহাসি করতেন, এবে আমরা করব তাদের উচ্চারণ নিয়ে। শোধবোধ।
কিনে (=ক্রয় করে) ; চিনে ; বইসা ; নিয়া ; থিকা (=থেকে) ; কইয়া ; শুইয়া ; লাম্বা / লাম্পা (=লম্বা) ; আইজকা ; করতাছে
উপরের বিপরীত। পুব বাংলার, বিশেষতঃ ঢাকার, কথ্য ভাষা থেকে নে’য়া। এর উদ্দেশ্য অবশ্য এক নয়।
মমসাথ ; আজি ; রচি যাবো (উনিশ শতকী ঢঙে) ; বরিষন ; মম পোড়া অঙ্গ জরজর ; বিদরে ; আমা দ্বারা
প্রাচীন বা “কাব্যিক” ব’লে বু.ব. বর্জিত শব্দ বা ফ্রেস।
গোলো চক্ষু ; লেজোঅগ্রে ; ব্যাকুলও ; আধেকও ; বঙ্গেরও ; কার্বনেরও ; প্রেমেরও
বাংলা গান ও কবিতা পাঠকালে আমরা হামেশা হলন্ত শব্দের ও-কারান্ত উচ্চারণ করি, তাই নিয়ে রাইসুর মশকরা। (৬)
প্যারেছে ; ওড়ে ওড়ে যাও কই
প্রথমটি রাইসুর একটা ফাজলামি— ওর একটা গল্পে আছে “কখেন” (কখন)। দ্বিতীয় হরকতটি আজকালীন বাংলাদেশি সাহিত্যে বিশেষতঃ রাইফ। অনেকেই এইরকম লেখেন, রাইসু তাঁদের কান ধ’রে টান দিল এখানে। (৭) অসমাপিকা “উড়িয়া” স্থলে চলিত বাংলায় “উড়ে”, এবং অকর্মক সমাপিকা “উড়ে” স্থলে চলিত বাংলায় “ওড়ে” প্রচলিত। কিন্তু বাঙাল লেখকদের রচনায় প্রায়ই এই ক্রমটা উল্টে যায়। রাইসু এই কবিতাটি লেখার ঢের আগেই এ নিয়ে আমার সঙ্গে তার কিছু বাতচিত হয়েছিল মনে আছে।
জাজ্জ্বল্য (জাজ্জ্বল্যমান থেকে ব্যাক ফর্মেশন)
ভ্রমাগত (ক্রমাগত-র আদলে)
শুরুত্ব (গুরুত্ব-র আদলে)
কীবা-ই (কীই বা স্থলে)
ডাহা ডাহা / কাঁহা কাঁহা / তাহা তাহা (ইয়া ইয়া, তা’বড় তা’বড়, এইরূপ অর্থে)
রবীন্দ্রনাথন (রবীন্দ্রনাথের কবিতার আবৃত্তি বা গান)
বেড়িয়া ঘুরাই ( = ঘুরিয়া বেড়াই; পরের লাইনেই রাইসু আবার তা ব’লেও দেয়)
ইত্যাদি, আবার:
কৌতূহলহীনভরে ; (তোমার নেই বুঝি) অন্যথায় ; তথৈবচ (ছিটকে পড়ছি) ; (দিন বড়ো) তাত্ক্ষণিক যায়
এইসকল শব্দে তার কারিকুরি লক্ষণীয়। সাধারণতঃ আমরা এই শব্দগুলির জায়গায় ব্যবহার করতাম: “অকৌতূহলভরে” (বা “কৌতূহলহীনতাভরে”), “অন্যথা”, “ইতস্ততঃ”, ও “তাত্ক্ষণিকভাবে”। কিন্তু নীচের শব্দগুলিকে আমি অন্ততঃ খাতির করতে পারলাম না:
নৈসর্গ (“নিসর্গ” হ’লেই চলত)
আনতবজ্রা (মানে কী এর? রাইসু-কি “আনতব্রজা”, অর্থাৎ মাথা নিচু ক’রে হাঁটতে থাকা নারী অর্থে প্রয়োগ করেছে?)
পৃথুলা শরীর (“শরীর” স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ নয়, কাজেই তার বিশেষণ “পৃথুলা” হ’তে পারে না, হ’তে পারে যে সে আসলে বলতে চাচ্ছে “পৃথুলার শরীর”, বা “পৃথুলশরীরিণী”)
শাশ্রুকথন (ঠিক বানান “সাশ্রুকথন”)
মুষিক (“মূষিক”, এটি অবশ্য মনে হয় মুদ্রাকরপ্রমাদ)
ভক্তে প্রণিপাত (রাইসু সম্ভবতঃ “ভক্তের প্রণিপাত” বা “ভক্তিতে/ভক্তির দ্বারা/ভক্তিসহ প্রণিপাত” এইরকম কোনো অর্থে প্রয়োগ করেছে, কিন্তু প্রয়োগ শুদ্ধ হয় নাই, “ভক্তে” শব্দটি “এ” বিভক্তির দ্বারা, হয় অধিকরণবাচী, নয়-তো কর্ম বা সম্প্রদানবাচী, অর্থাৎ, এর অর্থ, “ভক্ততে”, মানে ভক্ত নামক বিষয়টাতে, বা “ভক্তকে”, প্রণিপাত) (৮)
উদ্ভটসংশয়লিপ্তঅত্যন্তগুরুর পুচ্ছে (বঙ্কিমচন্দ্র স্টাইলে রাইসু একটা বিশাল শব্দ বানাতে গেছে এখানে, হয়তো তাঁকেই কটাক্ষ করতে, কিন্তু, এরূপ শব্দ তৈয়ার করতে গেলে সমাসের যে জ্ঞান থাকা লাগে, তার অভাবে এ শব্দটি খানিকটা উদ্ভট হয়েছে; উদ্ভটসংশয়লিপ্ত ঠিক আছে, কিন্তু তার সঙ্গে অত্যন্তগুরু যেতে চাইছে না)। (৯)
ইদানীন্তনীন কবিতায় শব্দশ্লেষ বা “পান” এর ব্যবহারে রাইসুর সমকক্ষ কেউ আছে ব’লে আমার মনে হয় না। শ্লেষ ওর রচনার পরতে পরতে।
খ. অলঙ্কার
কাব্যং গ্রাহ্যমলঙ্কারাৎ। রাইসুর কবিতায় অলঙ্কারের ব্যবহার লক্ষ করা যাক।
তার কবিতায় শুদ্ধ অনুপ্রাসের পরিমাণ আহামরি বেশি না হ’লেও, এখানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উল্লেখের পক্ষে বেধড়ক পরিশ্রমসাপেক্ষ ব’লে বিরত থাকছি। ক’একটি বরং মিল জাতীয় অনুপ্রাসের উল্লেখ করি:
আস্তাবলের ছাপ / আগাপাশতলায়, গলায় (ছেক; “আগাপাশতলা” কিন্তু শুদ্ধ নয়, শব্দটা আসলে “আগাপাছতলা”, বা তার মৌখিক রূপ “আগাপাস্তলা”)
ভেসে উঠছে চারিধারে, বারিধারা ভেসে যাচ্ছে
এক জঙ্গল গেড়ে ফেলেছে এ দঙ্গলে
নব বরিষন… তব সিলিকন (সর্বানুপ্রাস)
ভাসছে নিথর শতক, হাসছে বর্তমান (আদ্যানুপ্রাস)
সহিতমরণে… রহিতজীবনে (সর্বানুপ্রাস)
পরিবেশবাদী কবিতায়… পরাবেশবাদী প্রতিভায় (ফ্রেস দু’টি যথাক্রমে কবিতার প্রথম ও একাদশ চরণে আছে— এক ধরনের দূরবিলম্বিত মিল)
রহিতে পারি না ঘরে, সহিতে পারি না (এমন মিল অনেক)
টাকা আরো টানি। টাকা টেনে আনি। টাকা এনে দেই। (অন্তঃস্থ মিল; অ্যানাফরা)।
ইদানীন্তনীন কবিতায় শব্দশ্লেষ বা “পান” এর ব্যবহারে রাইসুর সমকক্ষ কেউ আছে ব’লে আমার মনে হয় না। শ্লেষ ওর রচনার পরতে পরতে। ক’একটা নমুনা:
রাজি কি গরগররাজি (এটি ঠিক যথার্থ শব্দশ্লেষ নয়, পান-ই বরং)
বারিধারা ভেসে যাচ্ছে (১. জলস্রোত, ২. বারিধারা নামক স্থানবিশেষ)
বামন চাঁদের তরে বাড়িয়ে ব্যাকুল হাত ধরেছে তাড়কা (“তাড়কা” তে একাধারে “তারকা” অর্থাৎ “স্টার”, যা এই কবিতার বিষয়, এবং “তাড়কা রাক্ষসী”— এই কবিতায় উল্লিখিত তার বান্ধবীকে তা-ই বলছে নাকি সে!)
সুনীল গাঙের ছায়ায় (১. নীল নদী, ২. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়— এতে শব্দশ্লেষ ও অর্থশ্লেষ জড়াজড়ি ক’রে আছে)
চতুর পার্শ্বস্থ লোকজন (এটিও পান গোত্রের; তুলনা করুন জীবনানন্দর “চতুর আনন”; পান এর স্বার্থে “চতুর্পার্শ্বস্থ” কে মেনে নিলেও, ঠিক বানান “চতুষ্পার্শ্বস্থ”)
অসহশিক্ষিকাবৃন্দ (এইটা মোক্ষম। মাঝে মাঝে খুব সাদাসিধা শব্দেও নঞ্ আরোপ করলে কী হয় দেখুন; যদি বলা হ’ত “শিক্ষিকাবৃন্দ, যারা সহযোগী নয়” তাতে এক ফল, কিন্তু “অসহশিক্ষিকাবৃন্দ” তে ফল বা ফলহীনতা আরেক। অপিচ, “অসহ” শব্দটির, “অসহযোগী” ছাড়াও, “অসহনীয়” এইরূপ মানেও হয় বটে)
গুরু ও চণ্ডালী নিয়ে (এটিও পান, এমন আরও আছে, যথা “গণ ও তান্ত্রিক”, “কার্য ও কারণ”, ইত্যাদি)
সাগরের তীরে গিয়ে বই কিনে (“সাগর” নামে একটা বইদোকান আছে বেইলি রোডে; পান ও আয়রনি)।
যমকের ব্যবহারেও রাইসু সিদ্ধহাত। দেখুন:
গুটিসুটি প’ড়ে থাকা গুটি খাই
জীবনের অর্থ খুঁজিতেছে, তাকে অর্থ দাও (১. তাত্পর্য, ২. পাত্তি)
ট্রেন যাচ্ছে যাচ্ছেতাই নিসর্গ কাঁপিয়ে
ভেঙে পড়ব ভুজে ভুজে; ভূ—যে
তালে তালে বা যেন কোথায় বাজে
এখানেই শেষ নয়। আরও নানা অলঙ্কারে সুশোভিতা তার কাব্যভারতী:
প্রাণ যমুনা; বেটে (sic) দুই ভাই যারা / ধানের পালক; নক্ষত্ররিকশায়; (১০) বিরহ যমুনা (রূপক)
হায় জ্যামিতির অভিভাবক; হায় সাধারণীকরণ; নিয়ে যাক ঊর্ধ্বতনে, সরকারি গাধার খাঁচায়; কাষ্ঠবরষা (অতিশয়োক্তি)
পুরাকাল থেকে তেরছা ক্রুদ্ধ বজ্রপাত / হয় বলে মনে হয় (উত্প্রেক্ষা / ভ্রান্তিমান্)
আমরা বিগতকাল আমরা গোধূলি; আঁখির তারায় রামধনু (অতিশয়োক্তি / প্রতীয়মানোত্প্রেক্ষা)
তবু কেন বৃষ্টি হয়, তবু, / এই তবু জীবনানন্দর তবু নয়;/ এই তবু আমাদের উষ্মার প্রকাশ; তার কথা কী লিখিব। ‘কী লিখিব’ এই বাক্য জিজ্ঞাসা নয়, হায় হুতাশ (অপহ্নুতি)
তিনি কুপিত হলেন— / ফলে আমাদের নদীগুলি বক্র ও গম্ভীর (অসঙ্গতি)
আমরা রাত্রিতে আশ্রয় আমরা / শ্রাবণে উদ্ধার, আমরা একদিন দুইদিন যদি বৃষ্টি হলো (অ্যানাফরা; তৃতীয় “আমরা” নিরর্থক, তাল দেবার জন্য ব্যবহৃত; প্রায় একইভাবে প্রযুক্ত হয়েছে উপবন এক্সপ্রেস কবিতায় “দোলাচল” শব্দটি, ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গত করতে)
চটপটি খায় লোকে, বার্গার খায় লোকে, আইসক্রিম খায় লোকে (এপিফরা / অ্যাসিনডেটন)
কোথা থেকে আসে এই নোংরা জল, পলিব্যাগ / গভীর জলের মাছ, জন্মনিরোধক… রাশি রাশি নথিপত্র, নূহের জাহাজ / ভরা সাহায্যবহর / […] সউদি শেখ […] / বর্জ্যের কাফেলা (অ্যাসিনডেটন)
ভিন্ন কোনো, অন্য কোনো, আর কোনো / গরিষ্ঠ কিছুই নাই, কোনো (এপিস্ট্রফি; শেষ “কোনো” টি বিশেষতঃ লক্ষণীয়)
কেঁপে উঠছে মার্চ মাস, আর তার পৃথুলা শরীর (“যুগ্ম” বা জ্যুগ্মা’র নমুনা, মনে করুন অ্যালেগ্জান্ডার পোপ এর: “অ্যান্ড্ স্টেইন হ্যর অনার অ্যান্ড্ হ্যর ন্যু ব্রোকেইড”)
চাকুমাকু; টাডাশ (অনোমেটপিয়া)
কুণ্ঠিত অম্বরে (হাইপালাগি বা ট্রান্স্ফার্ড্ এপিথেট এর নমুনা)
শিল্পাঞ্জি (পোর্টম্যান্টো শব্দ: শিল্প+শিম্পাঞ্জি— আমি গোড়ায় এরে মিস্প্রিন্ট্ ভেবেছিলাম, পরে রাইসু জানাল যে তা নয়)
অর্থ দাও, কীর্তি দাও, সচ্ছলতা দাও, / বিপন্ন বিস্ময় দাও / একদিন জোর করে বৃষ্টিতে ভেজাও (ব্যাথস বা অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স্)
একটি বিশেষ ধরনের অলঙ্কারের কথা আলাদা বলতে হয়। এটি মোটামুটি: অবস্তুতে বস্তুত্ব, বা অব্যক্তিতে ব্যক্তিত্বের আরোপ (এবং ভাইসি ভার্সা)। পশ্চিমে এবম্প্রকারের প্রয়োগকে “প্যাথেটিক ফ্যালেসি”, “অ্যান্থ্রপমর্ফিজম”, “প্যর্সনিফিকেশন”, ইত্যাদি নানা নামে ডাকা হয়। আমাদের “সমাসোক্তি” অলঙ্কারও খানিকটা এই গোছের। নীচে নমুনা:
হীনম্মন্য ছাতিমের গাছ
ঢাউস ঢাউস সব জুতো পরে বর্ষা টর্ষা মাড়িয়ে যাচ্ছিল
বর্ষাগণ আসছিল ফিরে ফিরে / হন্তদন্ত হয়ে
উতল হাওয়া ডাক দিয়েছেন বাইরে
আমাদের মার্চ মাসে আলো ফেলো
কেঁপে উঠছে মার্চ মাস
আইছেন প্রেমগণে
ফলে আমাদের নদীগুলি বক্র ও গম্ভীর
স্বতই ঘটনা তাই সদাই ঘটছেন
ঐ মাথা নিচু লেজ উঁচু করে / ঢুকছেন খান মহাশয়
ষড়যন্ত্রকারী জল
[…] খুলে ফেলছেন /অধুনালুপ্ত কথ্যরীতির সমস্ত গিঁট
বাঘ […] দাঁত মাজছেন (অতিশয়োক্তি?)
একটা কথা। রাইসু যে জেনে বুঝে এইসব অলঙ্কারের প্রয়োগ করেছে তা কিন্তু মনে হয় না। তেমন হওয়া উচিতও নয় মনে হয়, কেননা, ভাষার আগে যেমন ব্যাকরণ নয়, তেমনই, কবিতার আগে অলঙ্কারশাস্ত্র নয়।
গ. দু’ নলা বাক্য
এর উদাহরণ কম হ’লেও, উল্লেখযোগ্য মনে হ’ল এ কারণে যে এতে রাইসু বাংলা ভাষার এক সম্পূর্ণ নূতন সম্ভাবনার উন্মোচন ঘটিয়েছে। নীচের নমুনাগুলায় দেখা যাবে যে নিম্নরেখাঙ্কিত অংশগুলি তাদের আগে পাছে দুইটি আলাদা বাক্যে সামান্য (কমন) থেকে, এক অদ্ভুত উপায়ে বাক্যদু’টিকে জুড়ে দিচ্ছে:
কৃষকের ছেলে / মাছ ধরছে খালের পানিতে / এসে বাতাস লেগেছে (বাক্য দু’টি যথাক্রমে, ক. কৃষকের ছেলে মাছ ধরছে খালের পানিতে, ও খ. খালের পানিতে এসে বাতাস লেগেছে; এইরূপ সর্বত্র)
যাই কদম্বেরও ডাল / বড় আহ্বানিছে
আজি বরষা বিমুখ / যত আগত যৌবনা / ছুঁড়ে ফেলা অধিক সঙ্গত
এই প্রেম ডাকে কি আমাকে আজ ভোরবেলা / সূর্য দেখি
ঘ. ইডিয়লেক্ট্
এইটিই রাইসুকে সবচেয়ে আলাদা ক’রে চেনায়: রাইসুর একান্ত, নিজস্ব, বাচনভঙ্গি। এর আগে যত উদাহরণ দিয়েছি, তারও অধিকাংশ এর অন্তর্ভূত। বাক্য বা পদের প্রচলিত গঠনকে ভেঙে রাইসু তাদের থেকে সাধারণ বাচ্যার্থের অধিক কিছু আদায়ে সতততত্পর— এই হাইপারবেটনের প্রবণতা তার লেখার ছত্রে ছত্রে। অবধান করুণ:
যাবো যমুনা (“যাবো যমুনায়”; কিন্তু অধিকরণে শূন্য বিভক্তি খুব বিরলও নয়, যথা, “ঢাকা যাব”, “বাড়ি যাচ্ছি”, ইত্যাদি)
আমরা রাত্রিতে আশ্রয় আমরা / শ্রাবণে উদ্ধার (আশ্রয় / উদ্ধার পাই, বা আশ্রিত / উদ্ধৃত হই)
আজি দিন বড়ো বৃষ্টি নাই (যেন ইংরেজি “দিস ডে” এর তরজমা)
তিনি নদীকূলে পুনর্জন্ম, নদীকূলে বাস (পুনর্জন্ম লাভ করেছেন, বাস করেন / করেছেন)
তাঁকে বলো ন্যারেটিভ (যেমন, “তাকে বলো গল্প”) (১১)
দিন বড়ো তাত্ক্ষণিক যায় (তাত্ক্ষণিকভাবে যায়, এই “ভাবে” র হাত থেকে বাংলাকে উদ্ধারের কথা আমিও ভাবি)
আজ মন তোমার কথাই (মন = কথা)
তাদের হাসির শব্দে আমরা আনন্দ (আনন্দিত; তুলনা করুন: “আমরা খুশি”)
ভেবে খুশি খুশি তিনি লাগছেন (তার লাগছে)
আমাকে কি ভালো লাগছো
ছুঁড়ে দাও সুবিশালে (সুবিশালতায়; যেমন “অসীমে”)
সকলেই জাগরণ (জাগ্রত, বা জাগ্রত হ’ল)
খাকি দারোয়ান খেলি (তুলনীয়— “চোর-পুলিস খেলি”)
হাতি ঘোড়া চাঁদ মারি (“হাতি ঘোড়া মারি” র সঙ্গে “চাঁদমারি” র সঙ্কর)
কেন এমন হয় যে তার কোনো গৃহ নয় (“কোনো গৃহ তার নয়” বা “তার কোনো গৃহ নেই” বা দুইই, একসাথে)
মন নাচে না ময়ূর আমাদের (ময়ূর হ’য়ে; রূপকাতিশয়োক্তি?) (১২)
আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার সহজ নয়, সরলতা নয় (বিশেষণকে গুণবাচী বিশেষ্য দিয়ে বদল) (১৩)
যা মেঘলা তা তো / তেমন চাতুর্য নয় (উপরের মন্তব্য দ্রষ্টব্য)
তিনি মাসুদুজ্জামান, দুই বাংলা কবিতার (তুলনীয়: “দুই হাঁড়ি ভাতের”) (১৪)
গরুদেরও / অস্তিত্ব / হয়ে ওঠে (গরুরাও অস্তিমান্ হ’য়ে ওঠে)
যার স্তন তিন (তিনটি; সঙ্খ্যাবাচক বিশেষণ পরে বসলে সচরাচর টা/টি প্রভৃতি আমরা লাগাই, রাইসু লাগায় না)
বৃষ্টির সংশ্রব নেই, প্রকাশনা নেই
অর্থনীতির ছাত্রী বসে আছে / এ কা কি নী (অক্ষরগুলার মধ্যে ফাঁক দিয়ে আরও একাকিনী বানিয়ে দিল তাকে রাইসু)
তাহা না যদি ঘটিছে তবে সকলই স্থবির
শ্রবণে ঘটিছে নীরবতা
তার বৃক্ষ / তার মেঘ / তার পাণ্ডুরোগিণীরা / পরস্পর সন্দেহে বঙ্কিম (এখানে একটু দ্ব্যর্থকতা তৈরি হয়েছে, “পরস্পর সন্দেহে বঙ্কিম”-কি পাণ্ডুরোগিণীরা, নাকি বৃক্ষ ও মেঘও?)
সামনে খোলা মদের বোতল (খালি)
দূরে দূরে বইসা থাকছে (“ব’সে থেকেছে” / “ব’সে আছে”)
লিখে যাচ্ছি সে কবিতা যে কবিতা যা লিখেছে তা লিখেছে আমার বাবারা তার বাবার বাবারা (টটোলজি; “তার” স্থলে “তাদের” হওয়া ব্যাকরণসম্মত হ’ত, ছন্দের সমস্যা হ’ত অবশ্য)
আমি বলি / এই এই বই ভালো / তারা কিনে সেই সেই বই (টটোলজি)
আরও কত ডট ডট খায়?
সিলিকাবেলায় (বালুকাবেলায় না ব’লে সিলিকাবেলায় লিখছে সে, কারণ, যাঁর উদ্দেশে লিখছে, তিনি “সিলিকন চিপসের কবি” মাসুদ খান)
আমরা তাতে সরাসরি দুই তিন ধরেন এই যে তিনি তার মৃত্যু কিন্তু তা না কিন্তু ঠিক হলো নাই আর নখ! (প্রথমতঃ টটোলজি; “তিনি” শব্দে সম্ভবতঃ শ্লেষ— তিনি / তিনই; এবং “তা না” র পরের বাক্যাংশটি জাক্স্টাপজিশন; যতিচিহ্ন দ্রষ্টব্য) (১৫)
তুমি কোন কোথায় কি করতে থাকছো
পেয়ারা গাছে পেয়ারা গাছের পাতা ঝরে রে (“পেয়ারা গাছে” এক অর্থে নিরর্থক, তাল হিসাবে ব্যবহৃত; আরেক অর্থে সার্থক, মানে বলা হচ্ছে যে পেয়ারা গাছেই পেয়ারা গাছের পাতা ঝরে, এবং এই অর্থে নিরর্থক, যে নিরর্থকতা ইচ্ছাকৃত, কাজেই সার্থক)
এই যে এখন আমরা যা কিছুই বসে থাকছি
তাহা শুধুমাত্র ডিঙি নৌকা / ডিঙির অধিক তাতে কিছু নেই / তুমি কিছু নও (জাকস্টাপজিশন)
আমি যদি কত দীক্ষা গ্রহণ করেছি
যা কিছু লিখিত শব্দ: সকলেই জ্ঞানপাপী (জাকস্টাপজিশন; অ্যাম্বিগুয়িটি— লিখিত শব্দেরা জ্ঞানপাপী?)
তারা বাজিছে সঙ্গীত (শুদ্ধ “বাজিতেছে”, ণিজন্ত “বাজাইছে”, একই খাপে; কাজেই, “সঙ্গীত” = ১. সঙ্গীত হ’য়ে, ২. সঙ্গীত কে)
কী তারা জানে বা তবু ঘটনা সমস্ত
কেমন যে ভালো লাগে উতল হাওয়ার / আন্দোলন টের পাওয়া যায় (জাক্স্টাপজিশন)
আমাদের শ্রাব্য তার নুয়ে পড়া স্তন। দীর্ঘ এবং কিছুটা বিনীত। বিনীত ও গদ্য। (মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন)
হাড়ে হাড়ে গর্ভবতী
হাসতে হাসতে খুলে পড়ছিলেন
থাকবে নাকি / থাকাথাকি করবে নাকি
গাহ বাদলের / ধারা মমসাথ
কারা যেন গেয়ে যাচ্ছে আষাঢ় শ্রাবণ
শুষকো থাক্তে চাই
ঠাক্কুরমঙ্গল; আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি (প্রথমটিতে ত বর্গকে ট বর্গে, এবং দ্বিতীয়ে মহাপ্রাণ ধ্বনি অল্পপ্রাণ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়েছে, ফলে পূর্বোক্তে বিদেশির মুখে বাংলা, ও পরোক্তে পূর্ববঙ্গীয় মৌখিক উচ্চারণের অনুকার; কিন্তু আসলে উভয়ই একপ্রকারের বালক্রীড়া; আগের উদাহরণটিও তা-ই)
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ। একের নিজস্ব বাগ্ভঙ্গি অপরে ব্যবহার করলে তা আর ইডিয়লেক্ট্ রহে না, হয়ে পড়ে এপিং— হনূকরণ, এবং তদ্দ্বারা আর যা হোক সাহিত্যসৃষ্টি হয় না, বরং, এতে, যার হনূকার হচ্ছে, যে করছে, যে পড়ছে, এবং যে ছাপছে— এই কোনো পক্ষেরই লোকসান ছাড়া লাভ হয় না কোনো। রাইসুর কবিতার বেশকিছুসঙ্খ্যক হনূকর্তার দেখা পেয়েছি ব’লেই বলতে হ’ল এসব। (১৬) আরও মনে রাখতে হবে যে, এই যে স্বাভাবিক, ব্যাকরণসম্মত বাক্য বা পদগঠনের বিপর্যয়, এসব করা হয়েছে নোতুন অর্থব্যঞ্জনার তাগিদে— অর্থাৎ কনস্ট্রাকশিয়ো অ্যাড সেন্সাম— অনর্থকভাবে নয়। প্রত্যুত, একজন জাতকবির হাতে যা অভিনূতন সৃষ্টি, একজন নবিসের হাতে তা-ই হামেশা অনাসৃষ্টি। নবিসেরা প্রায়ই হয় নকল নবিস— এ একটা সমস্যা। এ বাবদে কবি ইয়েটস, যাঁকে এইরূপ হনূকরণের শিকার হ’তে হয়েছিল আজীবন, একখানা পদ্য লিখেছিলেন। অধমের অনুবাদে, নীচে তা বিজ্ঞাপিত হ’ল:
তুমি বলো, যেহেতু প্রায়শঃ আমি করেছি অন্যের
কবিতা বা গানে মুগ্ধ প্রশংসা, রাজনৈতিক ঢের
হবে নাকি তা-ই করা এদের প্রতিও; কিন্তু কোনো
কুকুর গেয়েছে নিজ উকুনের তারিফ কখনও?
ঙ. প্রতিবিম্ব
রাইসুর লেখার ইতিউতি অপরের রচনার অনুসর্জন, প্রতিসর্জন, উল্লিখন, ইত্যাদি দেখা যায়। আমি নিজেও বেশ উল্লিখনপ্রবণ (ছিলাম), তবে আমার লেখায় উল্লিখন বেশিরভাগ সময় সরাসরি উল্লিখনের চেহারাতেই থাকে, আর রাইসুর ক্ষেত্রে তা লেখার সঙ্গে ওতপ্রোত হ’য়ে যায়। নীচে তালিকা:
কোথায় মেঘের পরে মেঘ / জমেছে (রবীন্দ্রনাথের গান থেকে)
কী যেন বাঁশির ডাকে জগতের প্রেমে, বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয় (এটি উল্লিখন নয়, রবীন্দ্রনাথের বাচনভঙ্গির অনুসর্জন) (১৭)
সহসা সন্ত্রস্ত হয় (তুলনা করুন: “সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো”)
অর্থ দাও, কীর্তি দাও, সচ্ছলতা দাও, / বিপন্ন বিস্ময় দাও (জীবনানন্দ দাশের আট বছর আগের একদিন থেকে)
ছ শো গজ বর্ষা (তুলনীয়, জীবনানন্দর, “এক মাইল শান্তিকল্যাণ”)
ভেসে উঠছে চারিধারে, বারিধারা ভেসে যাচ্ছে (তুলনীয়: “হেরো বারিধারে কাঁদে চারিধার”, ঝুলন, রবীন্দ্রনাথ)
বসে আছি এ কদম্বকূলে (এটি, আমার ধারণা, বাংলা গানবিশেষ, “নির্জন যমুনাকূলে বসিয়া কদম্বতলে / বাজায় বাঁশি বন্ধু শ্যামরায়” থেকে এসেছে; এখানে একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারের উল্লেখ করছি— আমাদের বন্ধু হাসানুল বান্না এই গানটিকে প্যারোডি করতেন এইভাবে: “নির্জন যমুনা জলে বসিয়া কদম্বতলে / বাজায় বাঁশি বন্ধু সামুরাই”; জলে যে কদম্বগাছ, তার নীচে ব’সে, নিজে না-ডুবে গিয়ে, বাঁশি বাজানো তো “সামুরাই” এর পক্ষেই শুধু সম্ভব! রাইসু, আমার সন্দেহ নাই, বান্না ভাইয়ের মুখে এই গান শুনেছে; তার লেখায় “কদম্বতলে” স্থলে “কদম্বকূলে” বিশেষ দ্রষ্টব্য) (১৮)
নিজের কথাই / ভাবছে যে যার নৌকায় (টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট্ ল্যান্ড্-এর পঞ্চম সর্গ “ওয়াট দ্য থান্ডার সেড” থেকে এসেছে সম্ভবতঃ, মূলে আছে: “চাবির চিন্তা করছি আমরা, সবাই যে যার গারদে…” ইত্যাদি [মদীয় অনুবাদ]; পরের স্তবকে নৌকারও কথা আছে)
মহাকাশে কুড়িগ্রাম (মাসুদ খান বিরচিত কুড়িগ্রাম কবিতায় কুড়িগ্রামের, ভূপৃষ্ঠ থেকে আলগা হ’য়ে গিয়ে নক্ষত্রলোকে যাত্রার কথা আছে)
আমার আনন্দ (প্রায় একই ভঙ্গিতে আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম বহুকাল আগে: “আমার আনন্দ নাও / এই চোখ / এই সূক্ষ্ম দেখার বিকাশ…” ইত্যাদি [উদ্বোধন], এই কবিতাটিতে-কি তার ছায়া আছে? রাইসুকে জিগেশ করতে হবে)
বাহুল্যকথন (কেন যেন মনে হ’ল, খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রণীত একটা কবিতা: “একবার বাহুল্যকে সাদরে ডেকেছিলাম…” ইত্যাদির সঙ্গে যোগাযোগ আছে এই কবিতাটির) (১৯)
তুমি জ্ঞান দাও […] বাঁচো / তথাপি সদাই পদতলে আমি, তুমি উপরেই আছো! (স্মরণ করুন রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমি-র “তুমি, মহারাজ, সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!”)
তুমি মেঘ / উঁচুতে উঁচুতে (বু.ব. অনূদিত বোদলেরের “আমি ভালবাসি মেঘ / ঐ উঁচুতে ঐ উঁচুতে” থেকে)
সঘন গহন বর্ষা (রবীন্দ্রনাথের গান: “সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা”)
একবার দেখি ক্ষণেকের তরে / আর তো দিলো না দেখা (আব্বাসউদ্দিন গীত— জসিমুদ্দিন প্রণীত?— “নদীর কূল নাই” গানের “আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি, আবার দেখি নাই রে” স্মরণ করুন, মহাশয়!)
আর আমার জন্যেই এলো এই গান, জলের উপরে ভেসে ভেসে ( দ্য ওয়েস্ট্ ল্যান্ড্ কাব্যের সাজ্জাদ শরিফ কৃত অনুবাদ থেকে সরাসরি উদ্ধার)
চরণ মানে কিন্তু বাক্য নয়। অর্থাৎ বাংলার এই একান্ত আপন দাঁড়ি মহাশয় ছিলেন আসলে ছন্দোযতি বা তালযতির চিহ্ন, অর্থযতি বা ভাবযতির নয়
চ. যতিচিহ্ন
যতিচিহ্নের ব্যবহারেও রাইসু, যথারীতি, অযথারীতি। বিশেষভাবে বলতে হয় দাঁড়ির কথা। কিন্তু তার আগে বলা যাক যতিচিহ্নহীনতার কথা। অনেক অনেক কবিতায়, বাক্যের শেষেও কোনো চিহ্ন না দিয়েই সে আরেকটা বাক্য শুরু ক’রে দেয়। উপরে তার কিছু নমুনা আছে (এদেরকেই, প্রধানতঃ, “জাকস্টাপজিশন” বলেছি আমি)। এরকম করবার ফলে দু’ এক জায়গায় অ্যাম্বিগুয়িটি বা অর্থানচ্ছতা বা দ্ব্যর্থকতার জন্ম হয়েছে। এদের ক’একটাকে, ইচ্ছাকৃত ব’লে, মাফ করা যায়, ক’একটির উদ্বাহু প্রশংসা করতে হয়, কিন্তু ক’একটির জন্যে তাকে ভর্ত্সনাও করা লাগে (যথা: “মৃত্যু কিন্তু তা না কিন্তু ঠিক হলো নাই আর নখ!” বা “মানুষ হয়ো না গুরু ভক্তে প্রণিপাত শিক্ষা ঘোড়ায় দৌড়ায়”)। প্রকৃত অ্যাম্বিগুয়িটি কদাপি ক্ষমার যোগ্য নয়। (২০) (হায়! এখনকার কবিদের লেখায় অ্যাম্বিগুয়িটি একটা নর্ম্-এ পরিণত হয়েছে। ভাবদৃষ্টে মনে হয় যে অচিরেই “যা অ্যাম্বিগ্যুয়াস নয়, তা কবিতা নয়” এই আইন পাস হ’য়ে যাবে।)
এইখানে দাঁড়ি দাও।
বাংলার আদি ও অকৃত্রিম যতিচিহ্ন এই দাঁড়ি। আগেই উল্লেখ করেছি যে বাংলা কবিতার “চরণ” নির্দিষ্ট হ’ত দাঁড়ির দ্বারা। চরণ মানে কিন্তু বাক্য নয়। অর্থাৎ বাংলার এই একান্ত আপন দাঁড়ি মহাশয় ছিলেন আসলে ছন্দোযতি বা তালযতির চিহ্ন, অর্থযতি বা ভাবযতির নয়:
প্রথমে প্রণাম করি এক করতার।
যেই প্রভু জীব দানে স্থাপিলা সংসার॥
উপরে দেখুন যে “করতার” -এর পর দাঁড়ি থাকলেও, বাক্য সেখানে শেষ হয়-নি, হয়েছে “সংসার”-এ। কাজেই, “করতার”-এর পরে যে দাঁড়ি, তার সঙ্গে বাক্যের কোনো সম্পর্ক নাই। ইংরেজ আগমনের আগে ভাবযতি, বলতেকি, একেবারেই অজ্ঞাত ছিল বাঙালির কাছে। প্রাগিঙ্গরাজি বাঙ্গালা গদ্যের যতেক নমুনা দেখা যায়, তা গদ্য ব’লে, তার চরণনির্দিষ্টি অসম্ভব ও অপ্রয়োজনীয় ব’লে, তা সবে দেখি প্রায় নিরঙ্কুশ যতিচিহ্নহীনতা। মধুসূদনের “অমিত্রাক্ষর” ছন্দ, কাজেই, (যেমন বলা হ’য়ে থাকে) বাক্যকে একাধিক চরণে (বা পঙ্ক্তিতে) গড়িয়ে দেবার (বা “এনজ্যাম্মেন্ট্”-এর) সূচনা করে-নি। জিনিসটা আগাগোড়াই বাংলায় ছিল। মধুকবি যা করেছিলেন তা হ’ল, ছন্দোযতিকে তুলে দিয়ে ভাবযতির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি, এবং চরণান্তিক মিল কে দূর তফাত ক’রে পদ্যকে গদ্যের কিছু কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন— বাঙালির কবিতাপাঠের (বা -শ্রবণের) অভ্যাসকে একটা বেদম ঝাঁকি দিয়ে। ছন্দোযতি (প্রায়) অন্তর্ধান করল। দাঁড়ি বসতে লাগল বাক্যের শেষে, এবং তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল, একে একে, কমা, সেমিকোলন, কোলন, প্রশ্ন ও বিস্ময় চিহ্ন, অ্যাপস্ট্রফি, ড্যাশ, কোলন ড্যাশ, ইত্যাদি ইত্যাদি (বন্ধনী চিহ্ন, ইটালিক, বোল্ড্, এগুলি আরও আরও পরের ঘটনা, যদিও, এগুলিও, যতিচিহ্নেরই পর্যায়ভূত শেষপর্যন্ত)। কমা ছাড়া, অন্য চিহ্নগুলির ব্যবহার অবশ্য রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত (তিনি সমেত) তেমন বেশি ছিল না। বিদ্যাসাগরি গদ্যে আমরা কমা র যে অপূর্ব ব্যবহার দেখেছি (যা একাধারে দমযতি ও বাক্যাংশযতি ও ভাবযতিরূপে কাজ করেছে) তা কালক্রমে উবে গিয়ে, কমা ও, দাঁড়ির মতো, ডাহা ভাবযতিতে পর্যবসিত হয়েছে।
তিরিশিদের হাতেই সকল বিদেশি যতিচিহ্নের বেলাগাম ব্যবহার আরম্ভ হয়, তাদের নানারূপ সৃষ্টিশীল প্রয়োগেরও সূত্রপাত হয় তখন— প্রধানতঃ জীবনানন্দর হাতে। বিশেষতঃ, “ড্যাশ” চিহ্নটির বহুমাত্রিক ব্যবহার তার কবিতায় সুপ্রতুল, যে বাবদে তাঁর গুরু ছিলেন সম্ভবতঃ এমিলি ডিকিনসন ও ডব্ল্যু বি ইয়েটস। কালে আবার— আবারও বিদেশি প্রভাবে, যেমন ই ই কামিংজ্ প্রমুখের প্ররোচনায়— সম্পূর্ণ যতিচিহ্নহীন (এবং বেমক্কা যতিকণ্টকিত) কবিতাও এসে যায়। এবং শেষমেশ ছন্দোযতিকে ফিরিয়ে আনবার একটা প্রবণতাও সাম্প্রতিককালে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
রাইসু, যতিচিহ্নের মুখ্যতঃ তিন প্রকারের প্রয়োগ ঘটিয়েছে তার কবিতায়: ক. (প্রায়) সম্পূর্ণ যতিচিহ্নহীনতা, যথা, বর্ষামঙ্গল, কুহু, দাবা, মনসা, বর্ষামঙ্গল (দ্বিতীয় পাঠ), যদিবা বসন্ত দিন, অস্তিত্বের/প্রস্থত্বের ক্রমাগত সম্প্রসারণে আমার মন কেমন করতাছে, হোমসার্ভিস ভালবাসা, ঠাক্কুরমঙ্গল, মেঘদূতম, আপনাদের গর্জন, বিফ বার্গার, উপবন এক্সপ্রেস, হরিণসুক্ত [-সূক্ত], নখরযাত্রী, দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে, অসতীদাহ, এই নদীতীর শুধু আমাদের, ইত্যাদি— এদের কোনোকোনোটির এক্কেবারে শেষে দাঁড়ি আছে; খ. আংশিক যতিচিহ্নহীনতা— উপরের আর নীচের উদাহরণগুলি ব্যতীত প্রায় সকল কবিতা এই গোছের; গ. ঐকযতিকতা, মানে এক বা দু’টি মাত্র যতিচিহ্নের উপর ভর ক’রে থাকা কবিতা— অধিকাংশে শুধু দাঁড়ি, বা প্রায় শুধু ড্যাশ, দু’ এক ক্ষেত্রে দাঁড়ি ও ড্যাশ, যথা, যদি এই গ্রামবাংলা (ড্যাশ), স্তন (প্রধানতঃ দাঁড়ি ও ড্যাশ), নন্দনতাত্ত্বিক পদচারণা (দাঁড়ি), ছাগল (দাঁড়ি ড্যাশ), ড. (দাঁড়ি ড্যাশ), বুদ্ধিজীবীদের কথা খুব শুনতে ইচ্ছা করতেছে (দাঁড়ি ড্যাশ), খাল কাটার নান্দনিক গুরুত্ব (দাঁড়ি), বাঁকা জল সোজা হচ্ছে (দাঁড়ি), হাঁদাগঙ্গারাম (অংশতঃ প্রধানতঃ দাঁড়ি), বাচ্চা মেয়ের জন্যে প্রেম (প্রধানতঃ দাঁড়ি), ভগ্নাংশের গান (দাঁড়ি ড্যাশ), ইত্যাদি।
দাঁড়ি রাইসুর হাতে কেমন একটা ওয়াইল্ড্ কার্ডে পরিণত হয়েছে দেখাবার জন্য একটা কবিতাকে দাওয়াত করা যাক:
কিন্তু হাত ধরাধরি করে আমরা। বিকেলবেলায়। হাঁটবো এবং হাঁটবো। এবং এবং বলবো বারবার। অনর্থক হাত ধরাধরি করবো। বলবো, অনর্থক বিকেলবেলায়। যাবো তাঁর কাছে। নন্দনতত্ত্বের কথা শুনবো। মনোযোগ দেবো না একদম। বলবো, ও তাহলে আপনি তাহলে। কলা ও কৈবল্যবাদী। একথা বলবেন তো! আমরা ভেবে বসে আছি। যাক, চা বলুন। বলুন যা বলছিলেন। নন্দনতত্ত্বের কথা। লালরঙ। আমরা সব মনোযোগ। দিচ্ছিলাম লাল রঙে। বইপত্রে। খাতাপত্র। গুছিয়ে রাখছেন যারা— লাল রঙ, ভদ্রমহিলারা। যারা তিন বোন। যথেষ্ট বৃশ্চিক। […]
নিম্নরেখাঙ্কিত অংশগুলি আবার পড়ুন, এবং দেখুন যে দাঁড়িগুলি বাক্য বা পদ (ক্লস) বা এমনকি দম কেও চিহ্নিত করছে না। করছে কাকে তাহলে? আলাদা আলাদা চিহ্নায়কগুলিকে, তাদেরকে বিশেষভাবে দেখতে বাধ্য করছে। একটা গিয়ারে কিয়ৎক্ষণ চলার পর গিয়ার বদলানোর মতো ব্যাপার এ নয়। এ হ’ল পথের মাঝে একটু পর পর স্পিড ব্রেকার বসিয়ে গিয়ে যাত্রীকে ঘন ঘন থামতে বাধ্য করা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে যেমন— ভাবখানা এমন যেন বলা হচ্ছে: মুসাফির, বারংবার স্মরণ করো কোথা দিয়ে যাচ্ছ! ঐ যে রোকেয়া হল, ঐ যে টিএসসি, ঐ যে হাকিমের চায়ের দোকান, ঐ যে “দোরা” কাউয়া!)। এবং, এই দাঁড়িগুলি, সূচিত করছে, নিজেদেরকেও! (খেয়াল করুন আমার করা বাঁকা হরফ ধারী অংশগুলিকে।) আমরা স্মরণ করব এমিলি ডিকিনসনের হাতে “ড্যাশ” চিহ্নটির আশ্চর্য ব্যবহার:
ওয়ান লিটল বোট— ও’রস্পেন্ট্ উইদ গেয়লজ্—
রিট্রিম্ড্ ইট্’স্ ম্যাস্ট্— রিডেক্ট্ ইট্’স্ সেয়লজ্—
অ্যান্ড্ শট— ইগজল্ট্যান্ট্ অন!
যেন প্যানোরামিক একটা ছবিকে ছোট ছোট অংশে কেটে কেটে পর পর সাজিয়ে দে’য়া হয়েছে। রাইসুর কবিতাটিতে “বিকেলবেলায়” গোটা ছবিটার তেমনি একটা অংশ (এবং নিজগুণে একটা আলাদা ছবি), “হাঁটবো, এবং হাঁটবো” তথৈবচ। যতিচিহ্নগুলি আবার যেন খণ্ডচিত্রগুলির ফ্রেম, যাদের নিজেদেরও গায়ে নানা প্রায় অদৃশ্য, অতীব সূক্ষ্ম কারিকুরি আছে।
পুনশ্চ সতর্কীকরণ: অনভিজ্ঞেরা খবরদার এসব পরীক্ষা করবেন না, অনর্থ (যে কোনো অর্থে) হ’তে পারে।
আমরা “মৈথুন” লিখলে তা যদি অশ্লীল না হয়, তার সাদা বাংলা রূপ “চোদাচুদি” কেন হবে? মানে, কনসেপ্ট্টা অশ্লীল, নাকি কোন্ শব্দে তাকে বলা হচ্ছে, তা? আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে একটা রেওয়াজ আছে শারীরবৃত্তিক শব্দগুলিকে হয় সংস্কৃত নয় ইংরেজিতে বলার, যেন সংস্কৃতের ধুতি বা ইংরেজির পাঁত্লুন পরিয়ে দে’য়া হ’ল ধারণাগুলিকে
ছ. অশ্লীলতা
এইবার ন’ড়েচ’ড়ে বসা লাগে, হে হে। রাইসুর এই বইটা নিয়ে লেখা, এবং অন্যদের বই নিয়ে লেখা নানা লেখায়, একাধিক লেখকের হাতে তার সম্বন্ধে প্রধান যে অভিযোগ আমার চোখে পড়েছে তা অশ্লীলতা সঙ্ক্রান্ত। বাঙালি জাতির সবচেয়ে প্রগতিশীল অংশের ভিতরে ভিক্টরিয় রুচিবোধের প্রত্যাবর্তন ঘটছে দেখে আমি আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেজায় আশাবাদী হ’য়ে উঠেছি। তা কূটাভাস যাক, কিন্তু একটু বাজিয়ে দেখি তবে এই অভিযোগ রাইসুর কবিতায় প্রমাণিত হয় কিনা, এবং হ’লে কীভাবে হয়। কাজেই আমি তন্নতন্ন চিরুনি চালাই করলাম তার বইটাকে এবং পেলাম তিনটি শব্দ বা পদ:
চোদাচুদি
বোকাচোদা
গোয়া মারে
উপরের শব্দ বা ফ্রেসগুলারে আমি নিজে অশ্লীল মনে করি না, কেন, একটু পরেই বলব, কিন্তু যদি মনে করতামও, তবু আমাকে (এবং, পাঠক, আপনাকে) স্বীকার করতেই হ’ত যে এর চেয়ে ঢের বেশিসঙ্খ্যক “অশ্লীল” কথা আজকালকার ভূরিভূরি বইয়ে, বা বইয়ের যে কোনো একটা পরিচ্ছেদে, বা এমনকি একটামাত্র পৃষ্ঠাতেও, পাওয়া যায়। তবে ইহাও সত্য যে একটা “গুণবাচক” দোষ কে সঙ্খ্যালঘুত্বের অজুহাতে খণ্ডন করা যায় না। খুন একটা করলেও খুনি, এক লাখ করলেও তাই। মানে, উপরের কথাগুলি যদি সত্যই অশ্লীল হয়, এবং অশ্লীলতা যদি সাহিত্যের একটা প্রধান দোষ হয়, রাইসুকে অবশ্যই নাকে খৎ দিতে হবে (খত্নাও করিয়ে দে’য়া যেতে পারত, আগেই না হ’য়ে গিয়ে থাকলে)।
কিন্তু শব্দগুলি-কি অশ্লীল আদপেই? আমরা “মৈথুন” লিখলে তা যদি অশ্লীল না হয়, তার সাদা বাংলা রূপ “চোদাচুদি” কেন হবে? মানে, কনসেপ্ট্টা অশ্লীল, নাকি কোন্ শব্দে তাকে বলা হচ্ছে, তা? আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে একটা রেওয়াজ আছে শারীরবৃত্তিক শব্দগুলিকে হয় সংস্কৃত নয় ইংরেজিতে বলার, যেন সংস্কৃতের ধুতি বা ইংরেজির পাঁত্লুন পরিয়ে দে’য়া হ’ল ধারণাগুলিকে, এবং তারা ভদ্রসমাজে মেশামেশি করবার ছাড়পত্র পেল তাতে। অহহ! আজিকালি কোনো ইংরেজ লেখক “ফাকিং” কথাটার খানে “কপ্যুলেশন” লিখবেন কিনা জানি না, কিন্তু বাঙালি লেখকেরা তা-ই করেন, “মৈথুন” এও মন না মানলে “কপ্যুলেশন” এর দিকে মেলা করেন প্রায়, হায়! শামসুর রাহমান কী এক লেখায় বলেছিলেন (হাল্কা মনে আছে— এবং উক্তিটি সম্ভবতঃ ছিল ধার করা) যে পুরাপুরি নগ্ন নারী অশ্লীল নয়, কিন্তু তাকে এক জোড়া হাইহিল জুতা পরিয়ে দিলে তা অশ্লীল। হ্যাঁ, তেমনই, সাদা বাংলায় এসব কথা কইলে তা অশ্লীল না, সংস্কৃতের সুতা (বা ছুতা) পরালে তা অশ্লীল। “এসব” অবশ্য আদৌ বলা উচিত কিনা তা আরেক ব্যাপার। আমি-তো বলব, বলবার দরকার থাকলে অবশ্যই বলা উচিত, না থাকলে, তাকে সংস্কৃত বা আরবিতে বললেও, তা, অশ্লীল না হ’লেও, ইনকংগ্রুয়াস, এবং সেই কারণেই খারিজ যোগ্য। আমার নিজের, হলিউডি ছবিতে নগ্ন শয্যাদৃশ্য দেখে তাকে অশ্লীল মনে হয় না, কিন্তু বলিউডি ফিলিমে, সম্পূর্ণ নগ্ন হ’তে না পারার ক্ষোভে, নামমাত্র কাপড়ে— তা-ও প্রায়শঃ সিক্তাবস্থায়— নায়িকাদের কুন্দননর্তন, তড়কা ও আহাজারি যখন দেখি, কেমন শরম লেগে পড়ে। রাইসু ব্যবহৃত উপর্যুদ্ধৃত শব্দগুলি অশ্লীল— এমন রায় দিতে আমি অক্ষম, কাজেকাজেই। তাছাড়া, শ্লীলতা অশ্লীলতা তথা রুচিবোধ অনেকটাই ব্যক্তিগত ব্যাপার, ব্যক্তির নিজস্ব পরিবর্ধন, পারিবারিক, সামাজিক, বা ধর্মীয় মূল্যবোধের দ্বারা মুখ্যাংশে নিয়ন্ত্রিত— এর কোনো সর্বমান্য পরিমাপক নাই, এবং সর্বমান্য কোনো বিধানও এ ব্যাপারে জারি করা যায় না তাই। তবে দোরা কাউয়া কবিতায় “গোয়া মারে” লাইনটা না থাকলে যে কবিতার খুব লোকসান হ’ত, বা থাকাতেই যে ভারি নাফা হয়েছে, তা আমার মনে হয় নাই। (২১) ফলে তার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ আছে, তবে তা অশ্লীলতার নয়, অসংসৃষ্টি বা ইনকংগ্রুয়িটির। (২২) আরও একটা নালিশও এই কবিতাটার ব্যাপারে আমার আছে, তবে সেটা গোপন ক’রে গেলাম। (২৩)
৪.
আমাদের নৃত্যকলা শিল্পগীত সাহিত্যদর্শন
যে যার নিজের ইচ্ছা বাপের ইচ্ছায়
বিকশিত হতে থাকে; বিকাশের নিয়ম রয়েছে—
তাই, বিকশিত হই আমরা নিয়মিতভাবে।
এতক্ষণে পাঠককে ঠাহর পাইয়ে দে’য়া লাগে যে এযাবৎ যা কিছু কথিত হ’ল তা রাইসুর কবিতার আলোচনা নয়। খাতা কলম (বা/এবং পিসি কীবোর্ড্ ) ছাড়া আর যা যা সরঞ্জাম নিয়ে সে কবিতা লিখতে বসে, তারই ক’একটার কথা বলা হ’ল কেবল। ইট-সুরকি-সিমেন্ট-বালি-আরসিসি দিয়ে যেমন সংসদ্ ভবনকে বিচার করা যায় না, তেমনই, কবিতায় ব্যবহৃত উপমা অনুপ্রাসের ফিরিস্তি দিয়ে কবিতার সৌন্দর্যের উপলব্ধি হয় না। আমাদের সংস্কৃত গুরুরা বলেন যে কবিতার “রস” তৈরি হয় সহৃদয় পাঠকের মনে— পাঠক সহৃদয় যদি হ’ন, আর কবিতা হয় রসোত্তীর্ণ, তবে আর ব্যাখ্যাভাষ্যের কোনো দরকার নাই। পক্ষান্তরে, পাঠক যদি সহৃদয় না হ’ন, বা কবিতা না হয় রসোত্তীর্ণ, কোনো আলোচনাই ঐ পাঠকের মনে ঐ কবিতাটির পাঠে রসের সঞ্চার করতে পারবে না। অতএব— কবিতার আলোচনা, পাঠকের জন্য, অদরকারি এবং অবান্তর। কবিতার রসবস্তুর বা সৌন্দর্যতত্ত্বের আলোচনাই, আদৌ, অসম্ভব তাছাড়া— কেননা, ও-জিনিসটা অনির্বচনীয়। অনির্বচনীয়কে নির্বচনীয় ভাষায় ধারণ করা যায় না। আমাদের যাবতীয় “ঈশ্বরতত্ত্ব” তেকারণেই, আসলে, “মহামানবতত্ত্ব”, মানুষের ভাষা ঈশ্বরকে ধারণ করতে কখনও সক্ষম হ’তে পারে না যেহেতু। বন্ধু সাজ্জাদ শরিফের কাছে শোনা এক গল্প বলি। মনসুর হাল্লাজ নাকি আল্লাহ্তা’লাকে এই সওয়াল করেছিলেন— “হে খোদা, তুমি-কি এমন একখানা প্রস্তরখণ্ড সৃষ্টি করতে পারো, যা তুমি নিজেই উত্তোলন করতে পারবে না?” এখন আল্লাহ্ যদি মানুষ হতেন, মানুষের ভাষা ও যুক্তির দ্বারা সংবদ্ধ হতেন, তাঁর কারবার ফতে হ’য়ে যেত এ প্রশ্নে। কেননা, এর উত্তর যদি তিনি “হাঁ” দিতেন, তাহলে, তিনি পাথর তুলতে পারেন না, এইটা প্রমাণিত হ’ত, অর্থাৎ তিনি “সর্বশক্তিমান্”, এইটা অপ্রমাণিত হ’ত। আবার, উত্তরটি যদি হ’ত “না”, তবে, তিনি যে সকলকিছুই সৃষ্টি করতে সক্ষম, তা অপ্রমাণিত হ’ত। কিন্তু পরওয়ারদিগার-কি ইনসানের ভাষিক সীমাবদ্ধতায় পা দেবার মানুষ (থুড়ি)?
কবিতার সৌন্দর্যসরস্বতীও, তেমনই, সমালোচকের গদ্যের কাঠগড়ায় দাঁড়াবার বস্তুটি ন’ন। তিনি (কবিতা ) প্রেমিকের আত্মায় ছায়া ফেলেন শুধু। প্রত্যুত, অন্য কেউ আমাকে ক’য়ে দেবে কেন আমাকে কারুর প্রেমে পড়তে হবে, তারপর আমি তার প্রেমে পড়ব, এমনটি-তো এই দিনদুনিয়ায় দস্তুর নয়— সমালোচকেরা, তাছাড়া, নবি-তো নয়। “কবিতার আলোচনা অসম্ভব” না মেনে এযাবৎ মেলা কাব্যালোচনা হয়েছে (বা হয় নাই)। তা সব হয়েছে, হয়, গদ্যে লেখা, কোনো কবিতার “ছায়া অবলম্বনে” আলাদা, নোতুন, কবিতা; নচেৎ, মগাখিচুড়ি। কবিতার মালমসলা নিয়ে অবশ্য কথাচালাচালি হ’তে পারে— কবিদের নিজেদের ভিতরে— পাঠকদের তা না শুনলেও চলে— এইরকম রুশ প্রকরণবাদীরা বলেন, এবং তত্পরবর্তী কাঠামোবাদীরাও হরেদরে তা-ই করেছেন; তবে প্রকরণবাদীদের মতো সাদা চোখে কবিতাকে দেখার বদলে তাঁরা নানা রঙের রোদচশমা প’রে প’রে কবিতাকে দেখে দেখেছেন কোন্ চশমায় কীরূপ দেখায়। অর্থাৎ দৃশ্যের চেয়ে দর্শন তাদের কাছে বড় হয়েছে। এই দ্বিতীয় পন্থাটি আমার মনঃপূত নয়, ব’লে রাখা ভালো। কোনো শিল্পকর্মের উপরে কোনো তত্ত্ব বা ধ্রুবকের আরোপকে আমি অনর্থক ব’লেই গম্যি করি অদ্যাবধি।
যা হোক, বলা গেল (মহাকায়ক্লেশে) যে রাইসুর কবিতার আলোচনা এ রচনাটি নয়। তবে যা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলাম, মানে রাইসুর রসিকতা, (২৪) তা আমার খাসলতের কারণে মাঝগাঙে ডুবে যাওয়ায়, এখন আবার প্ল্যানচেট ক’রে ডাকবার চেষ্টা করছি।
[… ] এখনও অনেক
অনেক সমস্যা আছে, যার
সমাধান তো বহু বহু দূরের ঘটনা, নেহায়েৎ সমস্যা বলেই
প্রতিভাত হয় নি এখনও।
কিন্তু এই যে নানা সমস্যা, নানা সঙ্কট আমাদের ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অস্তিত্বের কোনায় কাঞ্চিতে হরবক্ত বুদ্বুদিয়ে উঠছে, রাইসুর মনোজগতে তারা কীরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে?
ট্রেনের জানলায়— দেখা যাচ্ছে
মধ্যবিত্ত— জর্জরিত মধ্যবিত্ত
চিপস খাচ্ছে— চিপস খাচ্ছে— চিপস খাচ্ছে— আর
দেখে নিচ্ছে গ্রামবাংলা— আজিও বর্ষার
এই যে জর্জরিত মধ্যবিত্ত— কারা এরা? এরা রাইসুরই আপন সমাজ। যে সমাজে তার জন্ম ও পরিবৃদ্ধি হয়েছে— ফলে, এর ক্ষুদ্রতায় যতটা খক্ষহস্ত হ’তে সে পারত, হয়তো ততটা ঠিক পারে না সে, বরং তাকে নিয়ে একটু— ভালবাসামেশানো— হাসিঠাট্টা করে মাত্র, যে ঠাট্টার একটা অংশ আবার, তার জ্ঞাতসারেই, বুমেরাং হ’য়ে তার নিজেরও শিরে এসে পড়ে, এবং নীচের অংশটির কতটা ব্যঙ্গ আর কতটা আত্মগ্লানি বোঝা যায় না:
কিছু যার নাই, শুধু শিক্ষা— তারে ধরো মারো
আস্তাবলের ছাপ
আগাপাশতলায়, গলায়
বেঁধে দাও উচ্চকণ্ঠ জাহাজ বিদ্যার; নিয়ে চলে যাক
ঊর্ধ্বতনে, সরকারি গাধার খাঁচায়।
এই নিরঙ্কুশ নিয়মতান্ত্রিক ভবিতব্যের ভিতরেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি তবু হয়, যে বৃষ্টি, বলা বাহুল্য, মধ্যবিত্তের পছন্দের নয়, কেননা:
[…] ভিজতে ভিজতে আমরা ক্রমশ
প্রকাশিত হতে থাকি
আমাদের মধ্যে কোনো আড়াল থাকে না
এই আড়ালহীনতা, এই “প্রাইভেট স্পেস” এর অভাব, যা ঘটতে পারে বৃষ্টিতে (বা রাইসুর লেখায়), তার বাড়া সাজা মধ্যবিত্তের আর কী হ’তে পারে?
আড়ালবিহীন হয়ে কিভাবে বাঁচবো আমরা
আমাদের ব্যক্তিগত জীবন রয়েছে
[…] ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমরা কথা বলতে একদম
পছন্দ করি না
এই আড়াল, এই “ব্যক্তিগততা”-রই-তো নাম মধ্যবিত্ত সমাজ। অথচ কত যে ঠুনকো তা! এক পশলা বর্ষা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, পারে কোনো রিকশাওয়ালার খিস্তি, পারে এক দমকা হাসি, মেরিলিন মনরোর গাউন প্রান্তকে হঠাৎ উড়িয়ে দেবার মতো। এই হাসি রাইসু হাসে, এবং তার সমাজের সঙ্গে নিজেকেও হামেশা ভাসিয়ে দেয়:
আমরা গরিষ্ঠ জনগণ
অনাহারে অর্ধাহারে ভেসে যেতে চাই মেঘ
তোমার মতন
সমস্যা শুধু এই যে:
ভাসার ব্যাপারে হায়, আমাদের কিছুমাত্র
নিয়ন্ত্রণ নেই
অতএব:
আমাদের দিনগুলি বৃথা যায় বহিয়া পবনে …
এই মধ্যবিত্ত সমাজের যাঁরা নিয়ামক শক্তি, সেই “বুদ্ধিজীবী”রা রাইসুর হাস্যোদ্রেক করে, তবে এঁদেরও প্রতি রাইসু ব্লেইক বা ইয়েটস বা জীবনানন্দের মতো নির্মম হ’তে পারে না, মানে উষ্মা নয়, বরং উষ্ণতা দেখি তার, এঁদের প্রতি করা কৌতুকে। আসুন তুলনা করা যাক:
পরিবাদ ক’রে যাও, ভলতের, রুসো,
পরিবাদ ক’রে যাও, যদিও বৃথাই;
ওড়াও কুলোর ধুলো প্রতিকূল বাতাসে, যা ফের
উড়ে পড়ে তোমাদেরই বেয়াড়া মাথায়।
(উইলিয়াম ব্লেইক, দ্য স্কর্ফাজ্, আমার অনুবাদ)
সকলেই ঘোঁট পাকায় হোথায়; কাশিতে ছিটায় কালি;
জুতায় মাড়ায় অভিন্ন গালিচা তো;
সকলেই ভাবে সবারই ভাবনা, সব মুখে একই বুলি,
সকলেই চেনে তাকে, যে তাদের পড়শিরও পরিচিত।
প্রভু, কোন্ টীকা হবে নিঃসৃত এদের শ্রীমুখ থেকে
এদেরই কাতুল্লুসেরেও ঐ পথে হেঁটে যেতে দেখে?
(ডব্ল্যু বি ইয়েটস, দ্য স্কর্লাজ্, আমার অনুবাদ)
বুঝিলাম, সে তো কবি নয়, সে যে আরূঢ় ভণিতা
(জীবনানন্দ দাশ, সমারূঢ়)
[ভারি বুদ্ধিজীবীরা] [… ] কোথাও কিচ্ছুটি হলে
আগে আগে ভাগে। রাগে—
যেখানে সম্ভব রাগ। তা না হলে
ঝামেলা এড়িয়ে চলে। নিরাপদ দূরত্ব থেকে
সঠিক বিবৃতি ছাড়ে— লক্ষ্যবস্তু বাদ দিয়ে আশেপাশে লাগে
(রাইসু, বুদ্ধিজীবীদের কথা খুব শুনতে ইচ্ছা করতেছে)
তিনি এক বাক্যে— যাহা অতি দীর্ঘবাক্য— বুঝিয়ে বলবেন সব
তোমরা সব মন দিয়ে
শুনো। কোনো আলতুফালতু প্রশ্নটশ্ন
জিজ্ঞাসা কোরো না। তিনি ডিসটার্বড্ হবেন। তাঁকে
বলো— হে ডক্টর
(ড.)
তুমি জ্ঞান দাও— ধার করা ধ্যান, ধার দিয়া দিয়া বাঁচো
তথাপি সদাই পদতলে আমি, তুমি উপরেই আছো!
(জ্ঞানের অর্থ)
দ্বিতীয় যে শ্রেণির মানুষ রাইসুর মুস্কুরানির লক্ষ্য তাঁরা হচ্ছেন যাঁরা “কলা ও কৈবল্যবাদী”, যাঁরা “নন্দনতত্ত্বের কথা বলে” আর “লঘুবাক্য শুনতেই পারে না”। এঁরা, না বললে চলে যে, উপর্যুক্ত বুদ্ধিজীবীদেরই তালতো ভাই, কেউ কেউ নিজেরাই একাধারে বুদ্ধিজিহ্বী ও কালচারী। এঁরা ঝাঁকে ঝাঁকে বেইলি রোড, রমনা বটমূল, শাহ্বাগ, (কখনও বা একেবারে কফিহাউস, রবীন্দ্রসদন) প্রভৃতি স্থানকে অলঙ্কৃত করেন, পোশাকে শান্তিনিকেতন ও উচ্চারণে শান্তিপুরের আভাস দেবার প্রয়াস পান, মঞ্চে কবিতা মিউমিউ করেন:
তারা— অর্থাৎ আমরা যারা, উই ড্যু কালচার। এবং নাটক দেখি ঘন ঘন। এবং আমরা বেশ আবৃত্তি করি। […] যা অবস্থা কালচারের। নিজেই দেখছেন। সব গোঁড়া। নিচু মন। নিম্নমুখী। আমাদের— দেখতেই পারে না।
(নন্দনতাত্ত্বিক পদচারণা,— আমার আফসোস এই যে রাইসু এই নামে আঁকা ছবিটা দেয়-নি কবিতাটির সাথে। পরের এডিশনে, রাইসু, ছবিটা অবশ্যই দিবা।)
এবং এঁদের সহচরী গোপিনীরা, যাঁরা নিম নারীবাদী, সোনার পিত্তলমূর্তি:
লালরঙ। আমরা সব মনোযোগ। দিচ্ছিলাম লাল রঙে। বইপত্রে। খাতাপত্র। গুছিয়ে রাখছেন যারা— লাল রঙ, ভদ্রমহিলারা। যারা তিন বোন। যথেষ্ট বৃশ্চিক।
(নন্দনতাত্ত্বিক পদচারণা)
সাট আটজন সরলা এবং টরল রাবীন্ড্রিক
সঙ্গে শিল্পাঞ্জি একজন
টিনি টবলা বাজাচ্ছেন
(ঠাক্কুরমঙ্গল)
তার উচ্চমার্গআপ্লুত তিনবোন—
নুয়ে পড়ছেন ভক্তিতে
(ব্রাহ্মণ)
হায়, স্টাররা আমাকে চিনে!
সেই ভালো লাগাতে আমি বেড়িয়া ঘুরাই
[…] এই যে বিকেলবেলা, আমি যাই
নাটকসরণী […]
সাগরের তীরে গিয়ে বই কিনে […]
(স্টাররা আমাকে চিনে)
তাদের হাসির শব্দে— আমরা আনন্দ। তার গৃহমধ্যে তিনবোন। চমত্কার দাঁত ঝকঝকে। অই দাঁত নরভক্ত। কবিতা লিখছেন। প্রিয় অই দাঁত রক্ষা করো। কবিতা লিখছেন।
(ভগ্নাংশের গান)
মাঠকর্মীরাও, বিশেষতঃ যাঁরা কিনা আবার “উপর্যুপরি মার্ক্সিস্ট্” এবং “এনজিও থেকে প্রেরিত” (ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় যারা হুহুঙ্কৃত মার্ক্সিস্ট্, যারা আমলাতন্ত্র বিরোধী, যারা এনজিও সমূহকে পুঁজিবাদের দোসর ব’লে, সামাজিক বিপ্লব নিবর্তক ব’লে বড় বড় বুলি ছাড়ে, তাদের একটা বড় অংশই, পাস দে’য়া মাত্রই, হয় এনজিও নয় সরকারি চাকুরিতে ঢুকে প’ড়ে চোখ উল্টিয়ে ফেলে), যাঁরা কিনা আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, আর এখনও পুরা বুদ্ধিজীবী হ’য়ে পড়তে পারে-নি, রাইসুর মশকরার লক্ষ্য হয়:
[…] যদি কার্যের
মাধ্যমে কোনো তাত্পর্যের সন্ধান
পাওয়া যায় যদি পাওয়া গিয়ে থাকে
এই আশা আশাভঙ্গে
দুলছেন পাঁচ চারজন
আটঘাট মাঠকর্মী
(অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা বিষয়ে মাঠকর্মীদের উদ্বেগ)
আহা আমাদের নব্য কর্মযোগীরা!
আমরা সব বখাটে ছেলে। ক্ষমতাসীনের
খুঁচরোখাচরা। কিম্ভূতকিমাকার। তাদের দিকে
ভালোবাসার হাসি হাসচি।
(খাল কাটার নান্দনিক গুরুত্ব)
আছেন নানারূপ নারীরা— নারীবাদিনী, বয়োভার স্তনসমস্যা পীড়িতা, শিক্ষয়িত্রী, পড়ুয়া, নেহায়েত স্কুলবালিকা, কত কত:
বাৎসল্যবিহীন যারা, লক্ষ করো, কীভাবে ব্যক্ত হয়ে উঠছে বাহুল্য; ওই ব্যক্তি হয়ে ওঠে স্তন— নারীবাদিনীর, ছুঁড়ে ফেলা ছিন্ন স্তন ফুঁসে উঠছে স্বীকৃতিসংক্রান্ত। তাকে দাও অধিকার— বিন্যস্ত হবার; তাকে শিশুদের হাত থেকে রক্ষা করা হোক!
(স্তন)
[…] অর্থনীতির ছাত্রী বসে আছে
এ কা কি নী
জীবনের অর্থ খুঁজিতেছে
(এই দেশে বৃষ্টি হয়)
আমাদের শ্রাব্য তার নুয়ে পড়া স্তন। দীর্ঘ এবং কিছুটা বিনীত। বিনীত ও গদ্য। […] তার অনুনাসিক উচ্চারণের দিকে চোখ ফেরানো যাক।
(আমাদের মার্চ মাস)
অসহশিক্ষিকাবৃন্দ ঢুকে পড়ে স্নায়ুপথে
কালো চশমা হাতে
শাদা চোখ ডুবে যায় যৌনধারাপাতে।
(শিক্ষা)
প্রত্যেক ছাত্রীই জানে স্থূলতা সঙ্কট নয়
ঘোড়াভাব সম্মানিত অশ্ববিদ্যালয়ে
নাচের মাস্টার নাচে চার হাতে উস্কানিমূলক ছাত্রী
অসম্ভব ডুগডুগি বাজায়।
(ছাত্রী)
দুই হাতে সংখ্যাগুরু অন্ত্যজ শ্রেণীতে হায় মহিলা শিক্ষক
হাড়ে হাড়ে গর্ভবতী শয়নবিলাসী
(গুরু)
তারপর, ধরা যাক লালচুল ভদ্রমহিলার কথা। যার কাছে— তার চুল অদ্ভুত সুন্দর— এ কথা বলতেই আহ্লাদে আটখান তিনি— হাসতে হাসতে খুলে পড়ছিলেন…।
(ভগ্নাংশের গান)
অপিচ পশ্য বাচ্চা মেয়ের জন্যে প্রেম (“দুনিয়া যে কত অদ্ভুত জায়গা! এইখানে বাচ্চা মেয়ে নিয়া কথা বলা বড়রা একদম পছন্দ করে না”)।
আরও নানা ভাবাভাবের কবিতার আকর রাইসুর এই বইটি। কোনোরূপ ব্যাজবিহীন লিরিকও, এমনকি, একেবারে অপ্রাপ্তব্য নয় বইটাতে, যথা: কুহু, যদিবা বসন্তদিন, দখিন হাওয়া, নভেম্বর, আমার আনন্দ, নেহায়েৎ ঘাসফুলের প্রতি, ইত্যাদি। আছে প্রায় ইমেজিস্ট্ / সিম্বলিস্ট্ ঘরানার কবিতা (বিফ বার্গার, হরিণসূক্ত)। কিছু কবিতায় দেখতে পাই পশ্চিমবঙ্গীয় কতিপয় বড় কবি’র (যথা উত্পলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, অনন্য রায়, রণজিৎ দাশ, মৃদুল দাশগুপ্ত, জয় গোস্বামী বা অনিন্দ্য রায়ের) আহাল্কা প্রচ্ছায়া— শিক্ষা, জ্যামিতিবন্দনা, সনদ, বাক্যবন্দনা (২ ও ১), ছাত্রী, গুরু, ভগ্নাংশের গান, ইত্যাদি। আবার প্রতীক ও রূপকের (অ্যালেগরি অর্থে) অসামান্য ব্যবহারে, কোনো কোনো কবিতা ছাপিয়ে ওঠে তাদের প্রাথমিক রসিকতার সুর— বাঘ, হাঁদাগঙ্গারাম, এবং, সর্বোপরি, ছাগল এই শ্রেণির। ছাগল, বস্তুতঃ, আমার বিবেচনায়, শুধু এই বইটিরই সর্বোত্তম কবিতা নয়, গত পঞ্চাশ বছরে লেখা শ্রেষ্ঠ দশটি কবিতার ভিতরে ঠাঁই পাবার যোগ্য (আমি বাংলাদেশের কথাই বলছি শুধু, ভাই)। (২৫) ছাগল-কি ফের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রতীকায়ন? নাকি (এই বৃত্তের) কবি’র? আর, রাইসুর এই হাহাকার আমাদেরও আত্মায় জাগে— “সেইসব ছাগলেরা আজ কোথায়, যারা নিজেদের দড়ি নিজেরাই খেয়ে ফেলেছিলো।” কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টার দৃশ্যতঃ কোনো সুফল ফলে-নি, তাই বোধ হয় কবিতা শেষ হয় ব্যাজোক্তিতে— “হায় ব্যা, হায় অব্যক্ত সম্প্রদায়।”
তো, খানিকটা-তো বলা হ’ল কী-কী আছে তার কবিতায়। কিন্তু কী-কী নাই, তা-ও-তো ভাবা যায়। ধরা যাক, আমাদের বয়সী সাজ্জাদ শরিফ বা সৈয়দ তারিক বা কিছু কম বয়সী বদরে মুনীরের ছন্দঃস্বাচ্ছন্দ্য রাইসুর নাই (অবশ্য ছন্দেও “কিছু বিশেষ ধরনের” অর্জন রাইসুর, এঁদের প্রত্যেকের চেয়েই বেশি আছে, “ছন্দ” দ্রষ্টব্য)। মাসুদ খানের (বা অংশতঃ আমার) শব্দপ্রীতি (যা আকছার প্রায় ভ্যর্বোম্যানিয়ার পর্যায়ে চ’লে যায়) রাইসুর তেমন নাই। অসীমকুমার দাসের মহাজাগতিকতায় রাইসু (স্বেচ্ছা- [?]) বঞ্চিত। বিষ্ণু বিশ্বাসের সংরক্ত মৃত্যুচেতনা ও তার প্রায় সুরিয়ালিস্ট্ অভিব্যক্তি রাইসুতে একেবারেই দুর্লভ। অনতিলভ্য, তার কবিতায়, মাসুদ খান, ফরিদ কবির, বা অংশতঃ রিফাত চৌধুরীর নোতুন জুতার মতো চকচকে, নিটোল ইমেজ। কিন্তু, এক-এক জনের এক-একটা আলাদা অর্জনের সঙ্গে কারুর কবিতার সামগ্রিক তুলনায় তার কবিতার সরসতা-কি নীরসতার প্রতিপাদন নিশ্চয়ই হয় না। বরং আমি-তো বলব যে একটা বিষয়ে অন্ততঃ, তার লব্ধি উপর্যুক্ত কবিদের তুলনায় বেশি বৈ কম নয়: রাইসু একালের সেই দুর্লভ কবিদের অন্যতম, যার কবিতায় কবি’র নাম না থাকলেও ব’লে দে’য়া যায় এটা তারই কবিতা। এই সুস্পষ্ট, নিজস্ব কণ্ঠস্বর এই সময়ে-তো একটা অভাবনীয় ব্যাপার। একালে, মানে, এই উত্তর আধুনিকতার কালে (ভাই হে, পোস্ট্ মডার্নিজম অর্থে বলছি, যুক্তবঙ্গীয় উত্তরাধুনিকতা অর্থে নয়, মারবেন না, দোহাই), যখন সাহিত্য গণশিল্পে (বা শিল্পহীনতায়) পর্যবসিত হ’য়ে পড়ছে ক্রমশঃ, কবিরা আলাদাভাবে আর চিহ্নিতব্য থাকছে না, হ’য়ে পড়ছে একটা গোটা দঙ্গলের এক-একটা অংশ— একেকটা “ধারা” দিয়ে যাদেরকে চিহ্নিত করা লাগে। (২৬) মাসুদ খান কথিত এই “বৈশ্যদের কালে”, এই মিডিয়কারের দৌরাত্ম্যের যুগে, এতবড় পাপ রাইসু সাহস করল কী ক’রে— ভাবতে টাসকি লাগে। আর তারপরেও (এবং আগেও) রাইসুর কবিতার জনপ্রিয়তাও আছে! আবার সেই জনপ্রিয়তাও তথাকথিত ছড়াকারদের (২৭) জনপ্রিয়তা নয়! রাইসুর হাতে, আশা করতে খায়েশ হয়, শুদ্ধ মার্গের কবিতা আবার খানিকটা পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করলেও করতে পারতে পারে— বেঁচে যেতেও পেরে যেতে পারে নিঃসীম অবলুপ্তির সমূহ সম্ভাবনার থেকে।
কিন্তু, তারপরেও, এতকিছু বলার পরেও, বলতে হয় (যা রাইসুকে মুখে অনেকবার আমি বলেছি), যে, যে অর্থে কীটসের ওড টু আ নাইটিংগেইল, কোলরিজের কুবলা খান, রবীন্দ্রনাথের বলাকা, বা জীবনানন্দের হাওয়ার রাত আমার কাছে কবিতা, সেই অর্থে রাইসুর কোনো কবিতা (বা, অনুমতি দিলে বলতে পারি যে গত চল্লিশ পঞ্চাশ বছরে লেখা কোনো কবিতা, মাসুদ খানও এর বাইরে ন’ন, আমি নিজেও নই, বলা বাহুল্য) কবিতা নয়। তেমন কবিতা একখানা লিখিত হবার সম্ভাবনা হয়তো ছিল বিষ্ণু বিশ্বাসের হাতেই শুধু। তো, এইরূপ কবিতাকে, যা ঠিক কবিতা নয়, কিন্তু অতীব সুখপাঠ্য, সুন্দর রচনা, তাসবকে অন্য কোনো নাম দে’য়া যায় কিনা আমি শুধিয়েছিলাম রাইসুকেই, প্রস্তাব রেখেছিলাম, “চারুবচন” বা “কারুকথন” জাতীয় কিছুর। (২৮) কিন্তু সে তা নাকচ ক’রে দিল, আর আমিও ভাবলাম মন্দ কী। জীবন বাবুই-তো বলেছেন “কবিতা অনেক রকম।” সেই অনেকের একটি এই (রাইসুর), আরেকটি ঐ (খানের), আরেকটি সেই (সত্যেন দত্তের), ইত্যাদি।
তথাকথিত আধুনিকতার বিরোধিতা করতে গিয়ে, বা আধুনিকতার নঞর্থক দিক্গুলার প্রতিবিধান করতে গিয়ে যে সকল “সদর্থক” বিষয়কে লালনের কথা নানাভাবে বলা হচ্ছে, সে সব বিষয়ে কথা বলবার অধিকার কার কতটুকু আছে কে জানে।
৫.
ছেড়ে দাও রোগা ঘোড়া পর্যুদস্ত বিদ্বান সমাজে—
কিন্তু রাইসুকে এত যে ভালবাসি, তা মুখ্যতঃ তার সংস্কারশূন্যতার জন্য। প্রকট ও ছদ্ম মৌলবাদের এই যুগে, মানবাত্মার জাহিলিয়ার কালে, নিজেকে এইভাবে পরকীয় ও স্বকীয় সংস্কারের থেকে, এসময়ের প্রধানতম মহামারী সায়োলিজমের থেকে, মুক্ত রাখতে পারা একটা বিরাট্ কৃতিত্ব।
কত যে রেলা আজ চারিদিকে! পণ্ডিতদের একটা অংশ লেগেছেন “আধুনিকতা” র বিরুদ্ধে, যে আধুনিকতার অস্তিত্ব আবার, তাঁদেরই মতে, আর নাই। ওয়াহ্! আরেকদল ট্যাটা বর্শা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ঔপনিবেশিক মনোভাবের বিরুদ্ধে। এরও অস্তিত্ব যে আর আছে, অন্ততঃ সাহিত্যে, তা-ও প্রমাণসাপেক্ষ। সংস্কৃতের বিরুদ্ধে লেগেছেন অনেকে, যে ভাষা কিনা, অনেককাল মৃত— তাকে সরাসরি ধরতে না পেরে এখন বাংলায় ব্যবহৃত তত্সম শব্দের “গোয়া মারা” চলছে। সেই বাঘ আর জল খেকো হরিণশাবকের গল্পের পুনরাবৃত্তি। সংস্কৃত শব্দ বাংলায় থাকলেই তা আর বাংলা নয়, ভূরিভূরি আরবি ফারসি শব্দে অবশ্য কোনো দোষ নাই। কিন্তু বাদ দিলে কি সকলকেই দে’য়া লাগে না? এবং দিলে, মানে, বিশেষতঃ, সংস্কৃত ও ফারসিকে বিদায় করলে, বাংলা ভাষায় যে ক’টি শব্দ অবশিষ্ট থাকবে, তা দিয়ে দু’একটা হিংটিংছট মন্ত্র বানানো হয়তো যাবে, কিন্তু একটা বাজারের ফর্দও হবে না, সাহিত্য দূরে থাক। আর, এত গেল গেল র কারণটাই বা কী তা-ও বোঝা যায় না। মোগল, ইংরেজ, পাকিস্তানিরা এত-এত শতকেও বাঙালিকে ফারসি, ইংরেজি বা উর্দু বলাতে পারে-নি যখন, তখন খোদ বাঙালিদেরই একটা (নিরস্তিত্ব?) ভগ্নাংশ যে কোনোদিন তাদেরকে সংস্কৃত কি আরবি বলাতে পারবে তা মনে করতে পারার কোনো হেতু কি আছে?
আবার এমন কথাও উঠছে যে, ধরা যাক, জসীমউদদীন অনেক বড় লেখক (যেন কেউ তা অস্বীকার করছিল আগে), কেন? কেননা, তিনি “খাঁটি” বাংলা ভাষায় লেখেন। ভালো কথা। কিন্তু ক’একটা প্রশ্ন থাকে যে:
১. খাঁটি বাংলায় লেখাটাই যদি বড় লেখকের নিরিখ হয়, এবং রবীন্দ্রনাথ যেহেতু জসীমউদদীনের অর্থে খাঁটি বাংলায় লেখেন-নি, তাহলে কি বলা উচিত নয় যে জসীমউদদীন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় লেখক? সেইটা সরাসরি বলবার সত্সাহস দেখানো হোক।
২. খাঁটি বাংলা কী জিনিস? বাঙালিরা যে ভাষায় কথা বলে, সেটা? কিন্তু বাঙালির কথা বলার ভাষা কি এক? বাঁকুড়া, বীরভূম, নদিয়া, ঢাকা, বরিশাল, নোয়াখালি, সিলেট, চাটগাঁ, এদের কার কারটা বেশি খাঁটি বাংলা? আর এ-তো অনেক মোটা দাগে বলা হ’ল। আমার এই ঢাকা জেলাতেই, মহকুমা পর্যায়ে-তো বটেই, এমনকি থানা পর্যায়েও, বুলি ভেদ-তো কম নয়। তারপরও আছে সামাজিক, ধর্মীয়, ইত্যাদি নানা কারণে ভাষাভেদ, যা প্রায় প্রতিটা গ্রামেই আছে, ঘরে ঘরে (খোদ আমার বাপ ও আমি হুবহু এক ভাষায় কথা কই না— অন্যে পরে কা কথা) । অত্যধিক চুল না চিরেও (বা “…” না ছিঁড়েও), বলতেই হবে যে খাঁটি বাংলা হয় সোনার পাথরবাটি, নয়তো, নিদেনপক্ষে, ক’এক হাজার।
৩. জসীমউদদীনের বাংলার সাথে রবীন্দ্রনাথের বাংলার পার্থক্য আসলে কতটুকু? রবীন্দ্রনাথ কতটা “সংস্কৃত” লেখক আর জসীমউদদীন কতটা “বাঙাল”? তাছাড়া, স্রেফ কপালদোষে বা -গুণে একজন ফরিদপুর একজন কলকাতা জন্মেছিলেন, একজন মুসলমান ও একজন ব্রাহ্ম পরিবারে, এবং নিজ-নিজ পরিবার ও প্রতিবেশ থেকে মুখের ভাষার গরিষ্ঠাংশ, ও কলমের ভাষার কিয়দংশ, পেয়েছিলেন (বাকিটা এসেছিল তাদের ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন, ও অন্যান্য আরও নানা সূত্রের থেকে)। এই-তো ব্যাপার। বরং রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখকজীবনের একটা পর্যায়ে তাঁর কলমের ভাষাকে মুখের ভাষার অনেকটা কাছাকাছি নিয়ে গেছিলেন, জসীমউদদীন কদাপি তা করেন-নি। এখন যদি বলা হয় রবীন্দ্রনাথের মুখের ভাষা তক অ খাঁটি, কেননা তা কলকাতার ভাষা, তবে জিজ্ঞাসিব, বানিয়াচঙের কি শ্রীনগরের ভাষা খাঁটি বাংলা হ’লে কলকাতা কি ঢাকার ভাষা খাঁটি বাংলা হ’তে পারবে না, এটা কোন্ শাস্ত্রের বিধান?
৪. সর্বোপরি, জসীমউদদীনকে বড় লেখক প্রতিপন্ন করতে হ’লে, তাঁকে রবীন্দ্রনাথের সাথে তুলনা করতে কেন হবে? বিশেষতঃ, অতিকায়ক্লেষে খুঁজে পাওয়া (বা “স্বপ্নে পাওয়া”) এমন একটাকিছু বৈশিষ্ট্যের নিরিখে যা হয়তো রবীন্দ্রনাথে নাই, জসীমে আছে? এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী যেমন অনেককাল আগে থেকে নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের উপরে ঠাঁই দেবার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে আসছেন, এমনসব হাস্যকর কথা বলে, যে, নজরুল অনেক বেশি “রাজনীতি সচেতন” ছিলেন, ইত্যাদি। নজরুলের ব্যাপারে একটা সমস্যা অবশ্য ছিল এই যে তিনি মুসলমান হ’লেও পশ্চিম বাংলায় জন্মেছিলেন। জসীমের সেই সমস্যা নাই। তাঁর বাঙালি মুসলিম জাতীয়ত্ব নিষ্কণ্টক।
অপিচ, তথাকথিত আধুনিকতার বিরোধিতা করতে গিয়ে, বা আধুনিকতার নঞর্থক দিক্গুলার প্রতিবিধান করতে গিয়ে যে সকল “সদর্থক” বিষয়কে লালনের কথা নানাভাবে বলা হচ্ছে, সে সব বিষয়ে কথা বলবার অধিকার কার কতটুকু আছে কে জানে। সমন্বয়বাদী উদার লোকধর্ম বলুন, বা একটা জাতির মানসেতিহাসের সঙ্গে একাত্মতা বলুন— এসব-তো আকাশ থেকে পড়ে না। চাইলেই লালনের সঙ্গে গলা মেলানো যায় না। তাঁর অনুকার করা মাত্র যায়— যা কিনা আধুনিকতার নেতিবাদের চেয়ে বড় বেশি কম নেতিবাচক নয়। কে কী বলছে, কোন্ অবস্থান থেকে বলছে, এই সবকিছুই বুঝে দেখা দরকার। আর জোর ক’রে ইতিহাসের গতিকে রোধ করা যায় না। ছেলেবেলা গাঁয়ে গেলে মাঝিদের গলায় দেশি গান (ভাটিয়ালি হোক আর যা-ই হোক) শুনতে পাওয়া যেত, এখন যায় না, বড়জোর ফিলিমের গান শোনা যায়। আর মাঝিরাও-তো লোপ পেতে বসেছে। এসে গেছে শ্যালো এনজিন চালিত বোট, তার অট্টনাদের ভিতর থেকে ভাটিয়ালি-তো দূর, হার্ড মেটাল রকও শুনতে পাওয়া যাবে না। তাই ব’লে আপনি আমি কি চাইলেই এইসব বোটগুলোকে ডুবিয়ে দিয়ে আবার কেরায়া নাও, গয়না নাও ভাসিয়ে দিতে পারব ধলেশ্বরী ইছামতি কর্ণফুলি তিস্তায়? বা, পারলেও, তা করা কি ঠিক হবে?
ফরহাদ মজহারের এ কথা আমি হৃদয়ঙ্গম করেছি যে একটা জাতিকে বুঝতে হ’লে লোকধর্মের ভিতর দিয়ে যাওয়া ভিন্ন উপায় নাই। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এই লোকধর্মকে আহত ক’রে ক’রে এমন একটা কোণঠাসা মণ্ডাবস্থার মধ্যে নিয়ে গেছে যে এখন দুধ আর পানিকে আর আলাদা করা মুশকিল। আমাদের “তাহা তাহা” চিন্তাবিদ্গণ আমাদের কত কথা বলেছেন, আমরা তাঁদের নানা বাতচিত থেকে এক-একটা ধারণা মনের মধ্যে তৈয়ার ক’রে নিয়েছি— পরে আবার দেখি কি, এমনকি তাঁদেরও তিমি ভাগ শেষপর্যন্ত বায়াসের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন-নি কখনও, এবং তার আলোকেই আমাদের দেশ-জাতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। মানে, তাঁদের মন্তব্যও সেলেক্টিভ ট্রুথ, তথা খণ্ডিত সত্য, তথা অনেকাংশে অসত্য। আমি নিজে বৃহত্তর লোকসমাজের অংশভাক্ নই। আমার পরিবৃদ্ধি শহরে, তদুপরি একটা (তথাকথিত?) সঙ্খ্যালঘু পরিবারে। আমি আজ বৃহত্তর সমাজের অংশ হিসাবে নিজেকে দাবি ক’রে, সেই সমাজের প্রাণের গান গাইবার চেষ্টা করলে তা তাত্ক্ষণিক বাহ্বা কিছু পেলেও পেতে পারে, কিন্তু তার কোনো স্থায়ী আবেদন থাকবে না— বিশেষতঃ সেই বৃহত্তর লোকসমাজে। আমার চেয়ে ঢের বড় বড় কবি তাদের মধ্যে আছে। কেউই লালন কি হাসন কি রাধারমণ কি জালালুদ্দিন থুয়ে আমার পল্লির গানের আধখেঁচড়া অনুকার শুনতে আসবে না। ফলে আমি যা আসলে সৎ ভাবে করতে পারি তা হ’ল, নিজস্ব অবস্থানে থেকে, এবং তারই নিরিখে, আমার গলায় যে গান স্বাভাবিকভাবে আসে, তা-ই গেয়ে যাওয়া। রাইসুও ঠিক এই কাজটিই ক’রে চলেছে। কোনোরূপ ভড়ং, কোনোরূপ খামখা আহামরিমরির ধার না ধেরে, তার নিজের ভাষায় (নিজের ভাষা বলতে তার মুখের ভাষা নয়, কোনো লেখকেরই নিজের ভাষা তার ঘরে বলা ভাষা না, এ তার অধীত ভাষা— যে কোনো অর্থেই), লিখে যাচ্ছে, চারপাশের নানা হল্লায় কান না দিয়ে, বা মাঝে মাঝে কান দিয়েও।
শুধু সাহিত্যজ্ঞরা নয় অবশ্য, সকল প্রকার জ্ঞ রাই, হালফিল নিজ-নিজ বায়াস-কে থিয়রাইজ করবার চেষ্টা পাচ্ছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য মহৎ হ’তেও পারে কভু কভু, কিন্তু পন্থা কভি সৎ নয়। আর “এন্ড্ জাস্টিফাইজ দ্য মীন্জ্” হ’ল জনাব মাকিয়াভেলির কথা। তাঁর (এবং হবজ ও মেটারনিকের?) কথা অনুযায়ী এ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাস রচিত হ’য়ে আসছে। এখন হৃদয় ও জ্ঞানবৃত্তির সকল ক্ষেত্রেই রাইসুর লাহান ভার্গবদের এগিয়ে আসতে হবে— মানবজাতির ইতিহাসের পুনর্লিখন আরম্ভ হওয়া দরকার, পত্রপাঠ, নইলে সামনে কানাগলি— ব্ল্যাক হোল। (২৯)
(১)
রাইসু: লোকসাহিত্য বলতে আমরা কী বুঝবো? কোনটা লোক সাহিত্য আর কোনটা অলোক সাহিত্য? আমি মনে করি লোক অলোক সব সাহিত্যই সাহিত্য। পর্ব বিভাগে আমরা লোক সাহিত্য বেছে নেবো কেন? তথাকথিত বইলা-তো আসলে তথায় যা কথিত হইছিল তা আমরা বহালই রাখি। আর ঐতিহ্য বলতে কিছু নাই। সকলই বর্তমান। আপনে নিজেরে সাম্প্রতিক ভাবলে ঐতিহ্যের প্রশ্ন আসে। সাহিত্যের আওতা-তো খালি সাম্প্রতিকে না। যাদুঘরের কর্মচারীরা আর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকেরা যেভাবে টেক্সট-এর বিচার করবে সাহিত্যিকদের বিচার তা থিকা আলাদা। প্রাচীনতম সাহিত্যিকও তার সাহিত্য দিয়া আপনের লগে প্রতিযোগিতায়/উপস্থাপনায় হাজির। কালের প্রশ্ন কইরা তাদের আমরা গরহাজির করতে পারি না। ধরা যাক লোকসাহিত্য যদি এতিহ্যের বিষয় হয় তাইলে তার রচয়িতারা যা রচনা করছেন তা কি আমরা একটা প্রত্নতাত্ত্বিক/ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসাবে পড়তেছি না। যদি তা সেইভাবে পড়ি তখন আমরা সাহিত্য হিসাবে তার আবেদন অগ্রাহ্য কইরা পড়ি। ধরা যাক ১০০ বছর পড়ে আমগো সাহিত্য লোকে লোকসাহিত্য হিসাবে পড়তেছে। বলতেছে ঐতিহ্য। আমি তা চাই না। আমরা নিজের ক্ষেত্রে যা চাই না তা অন্যদের ক্ষেত্রেও করতে পারি না।
সুব্রত: আহা, “তথাকথিত” শব্দটা-তো সেইজন্যই লেখা। শব্দটার আভিধানিক অর্থ যা-ই হোক, এখন তার মানে হয় যে এইরূপ যদিও বলা হইছে, এইরূপ বলা হওয়া ঠিক হয় নাই। আর “ঐতিহ্য”-ও ঐ অর্থে ব্যবহার করি নাই, বরং “ধারা” কিসিমের কোনো অর্থে ব্যবহার করছি। প্রত্ন বিষয় রূপে সাহিত্য পড়া নিশ্চয়ই গর্হিত অপরাধ। আমি একমত তোমার সাথে। কাল ব্যাপারটারে একেবারে বাদ দিয়া দেখতে পারলে সর্বকালীন সাহিত্যের একটা কমন প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়, যেখানে কাহ্নপা, চণ্ডীদাস, আলাওল, মাইকেল, রাইসু সবারেই সমদৃষ্টিতে দেখা যায়। হক কথা। কিন্তু আরেকভাবে দেখলে দ্যাখো, লেখার রচনাকালেরে পুরা বাদ দিয়া লেখা বিচার করতে গেলে, লেখার প্রতি কিছু অবিচার হওনের সম্ভাবনাও হয়।
(২)
রাইসু: অদরকারী।
সুব্রত: মানলাম।
(৩)
রাইসু: এই জিনিসটার আরেকটু বাংলা পরিচয় দরকার।
সুব্রত: এগুলা ইংরেজি কবিতার একেক ধরনের পর্বের নাম, যেমন, আয়াম্ব মানে একটা “নিষ্প্রস্বর” (আন্স্ট্রেস্ট্) সিলেবলের পর একটা “প্রস্বরিত” (স্ট্রেস্ট্) সিলেবল, ট্রোকি এর উল্টা, স্পন্ডি তে পর পর দুইটা প্রস্বরিত অক্ষর, অ্যানাপেস্ট্ এ দুইটা নিষ্প্রস্বরের পর একটা প্রস্বরিত, এইরকম। বাংলা পরিচয় কেমনে দেই?
(৪)
রাইসু: সেজ্যুরা কি তা আরো স্পষ্ট করা ভালো।
সুব্রত: সেজ্যুরা (বা সিঝুরা) হইল একটা কবিতার চরণের মধ্যবর্তী সবচেয়ে স্পষ্ট দম। তবলার তালের লগে মিলাইলে সবচেয়ে ভালো বোঝা যায়: ধর, দাদরার “ধা ধি না // না তিন না”। এই যে ধা ধি না র পরে ফাঁক, এইটাই সেজ্যুরা। তেমনি, “আমাদের ছোটনদী // চলে বাঁকে বাঁকে”।
(৫)
রাইসু: এই অংশ বাদ দিতে পারেন। তবে লোকগান দিয়ে কী গান বোঝাচ্ছেন স্পষ্ট করা ভালো।
সুব্রত: ঠিক, বাদ দে’য়া যায়। না দিলেই বা কী অবশ্য। লোকগান বলতে আমি কিছুই বোঝাই নাই। অন্যেরা যাসবেরে লোকগান বলে, এবং বললে, অন্য আরও অনেকে বুঝতে পারে কী বলা হইতেছে, তা বিষয়েই বলছি। কিন্তু এই নামে ঐ বস্তুগুলিরে ডাকা যে ঠিক না তাও আবার কেউ কেউ বলেন, সেইজন্যেই সলিমুল্লাহ্ খানের উল্লেখ। আমার ব্যক্তিগতভাবে এইসব নামায়নে কোনো আগ্রহ নাই।
(৬)
রাইসু: ঠিক মশকরা অর্থে ব্যবহার করি নাই। আমার মনে হয় ও-কারান্ত উচ্চারণে ভাবগত পরিবর্তন ঘটে। অনেক সময় তা শব্দের প্রয়োজনীয় অর্থান্তর ঘটায়।
সুব্রত: বুঝতে পারলাম। অবশ্য একটু ভাসা ভাসা। ভাবগত পরিবর্তনের ধরনটা কী? তুমি বোধ হয় অতিসূক্ষ্ম ব্যঞ্জনার, মানে নুয়ান্স্ এর কথা কইতেছ, যেটা আসে শব্দের ব্যুত্পত্তি থিকা না, বরং শব্দের উচ্চারণ থিকা? অপিচ, এইরকমভাবে বলার ফলে এইরকমভাবে যেসবকালে কবিতা গান বলা হইত, সেইসব কালের সাথেও খানিক দিললাগি, খানিক কুটম্বিতা করা হয় মনে হয়, না?
(৭)
রাইসু: তা দিতে চাই নাই। আমি এটাকে ভুল মনে করি না। আঞ্চলিকতা প্রসূত শব্দ উচ্চারণের এই রূপ আমি অনুমোদন করি। বরং এ থেকে রুচিবানরা যে হাসি হাসেন তা সমালোচনা করেই সীরিয়াস ভাবের কবিতায় এ ধরনের শব্দ প্রয়োগ করেছি। “মেগ” শব্দের প্রয়োগও একই ইচ্ছা থেকে হয়েছে। শব্দের রুচিসম্মত শুদ্ধ রূপ রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক অবস্থার ফলাফল। তাকে সর্বমান্য ভাবার কোনো কারণ নাই।
সুব্রত: কিন্তু রাইসু, মেগ (বা “ম্যাগ”) আমাগো দেশে সত্যসত্যই বলা হয়, উড়িয়া স্থলে “ওড়ে” কোথাও “বলা” হয় না (উইড়া, উইড়ে, উড়ি বা এমনকি, যেমন বরিশালে, উড়গিয়া-ও চলে)। কাজেই, এইটা গ্রাম্য প্রয়োগ নয়, শহুরে অর্ধশিক্ষিত প্রয়োগমাত্র।
(৮)
রাইসু: ভক্তকে প্রণিপাত অর্থেই বুঝেয়েছি।
সুব্রত: আমি তা বুঝতে পারি নাই। আর এই বুঝতে না পারার দায় খানিকটা তোমারও। তুমি বুঝাইতে পারো নাই।
(৯)
রাইসু: তা ঠিক।
(১০)
রাইসু: নক্ষত্ররিকশা শব্দটা আবদুল মান্নান সৈয়দের। তাঁর পরাবাস্তবতাকে শ্লেষ করে লেখা। এই শব্দ উল্লেখের মারফতে আসলে তাঁকেই বোঝাতে চাইছিলাম।
সুব্রত: নোটেড।
(১১)
রাইসু: আমি চাইছি তাঁরেই, মাসুদুজ্জামানরেই, ন্যারেটিভ সম্বোধন করতে।
সুব্রত: খাইছে। কিন্তু কেন তাঁকে “ন্যারেটিভ” ডাকা?
(১২)
রাইসু: ‘মন নাচে না ময়ূর’ সম্ভবত এই বাক্য অমিয়ভূষণের, আমি ব্যবহার করছিলাম। ঠিক মনে নাই।
সুব্রত: নোটেড।
(১৩)
রাইসু: এই জিনিস শক্তি চট্টোপাধ্যায়ে অনেক আছে। ঐখান থিকাই নেওয়া।
সুব্রত: তাই নাকি? খেয়াল করি নাই-তো!
(১৪)
রাইসু: দুই + বাংলা কবিতার।
সুব্রত: আরেকটু ব্যাখ্যা কইরা কও। বুঝলাম না।
(১৫)
রাইসু: আমি এই কবিতাটায় চাইছি ব্যাকরণ না মাইনা বাক্য লিখলে অর্থের কী রূপান্তর ঘটে তা দেখতে।
সুব্রত: নিশ্চয়ই। তা-তো বুঝছিই। কিন্তু কী দেখলা?
(১৬)
রাইসু: আমার মনে হয় এইভাবে না বলাই ভালো।
সুব্রত: বললেই বা কী? কেউ-তো আর গায়ে পইড়া স্বীকার করবো না যে হেয় তোমার হনূকরণ করে। আমিও-তো আর আঙ্গুল দেখাইয়া কইতেছি না।
(১৭)
রাইসু: না এইটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা থিকা লওয়া। কবিতার নাম ভুইলা গেছি। স্তন-ও হইতে পারে।
সুব্রত: ঠিক ঠিক! আমারও একটু একটু মনে আসতে নিছে।
(১৮)
রাইসু: না আমি বান্না ভাইয়ের কাছ থিকা এই গান শুনি নাই! আমি যমুনাকূলেরেই কদম্বকূল দিয়া বোঝাইতে চাইছি। প্রেম বিষয়ক কবিতা, সুতরাং কদম্বকূল আসছে। এই কবিতায় শ্রীকৃষ্ণের বহুগামিতার জয়গান গাওয়া হইয়াছে।
সুব্রত: লেখকের অগোচরে লেখা কত কী করতে পারে দ্যাখো! একবার তার হাত থিকা বাইর হইয়া পাঠকের হাতে গেলে গা, লেখা যে কত খেল দেখায় লেখকরা বেশিরভাগ সময় জানতেই পায় না। আমার বরাতে তুমি একটা নমুনা পাইলা।
(১৯)
রাইসু: যোগাযোগ নাই। খোন্দকার যা করছেন সেইটা বিনয়ে আকছার আছে।
সুব্রত: হইতেই পারে যে তুমি হয়তো আশরাফ স্যরের কবিতাটা পড়ই নাই। কিন্তু আমি যেহেতু পড়ছিলাম, এবং অনেকদিন আগে, কাজেই ঠিক ঠিক মনে নাই, একটা রেশমাত্র আছে, আমারে তোমার কবিতা আবার একটা খেল দেখাইল।
(২০)
রাইসু: ক্ষমা কে করবে, সুব্রত দা? এই বাক্যগুলি নিশ্চয়ই কিছু একটা বোঝায়। আমাদের সব চিন্তা সব ভাবনা সব সময় “প্রকৃত” বাক্যের রূপ ধরে আগায় না। প্রথম বাক্যটিকে যদি যতিচিহ্নহীন কয়েকটি বাক্য ধরে নেন, এবং পর পর পড়ে যান, তাইলে নিশ্চয়ই একটা অর্থ ইঙ্গিত করে।
সুব্রত: ক্ষমা তুমিই করবা না, অর্থাৎ লেখক নিজেই করবে না। পাঠক অভিযোগ করবে লেখকের কাছে, আমি যেমন করতেছি, বলতেছি যে, রাইসু, আমি বুঝি নাই, তুমি তখন চিন্তা করবা যে পাঠক যদি একেবারেই না বোঝে, অথচ লেখক হিসাবে আমি বুঝতেছি, তা হইলে হয় পাঠকের বোঝায়, বা আমার লেখায়, কিছু সমস্যা আছে। এইটা-তো ঠিকই যে চিন্তা সবসময় গোছানো বাক্য হ’য়ে মাথায় আসে না। কিন্তু পরে যখন সেই চিন্তায় আমরা অন্য কাউরে চিন্তিত করতে চাই, আমরা কিছু গোছগাছ-তো করিই। পাঠকের উপর-তো সরাসরি চিন্তাটা নাজেল হয় না, তাই লেখকের কাছে তার সব লেখাই যত সুস্পষ্ট অর্থ বহন করে, পাঠকের কাছে তা করে না। তাই জন্যেই লেখকেরে কসরত কইরা মাঝেমাঝে নিজের লেখার সত্যিকারের পাঠক হইতে হয়, অন্য মানুষের লেখা মনে কইরা নিজের লেখা পড়তে হয়। নিজের লেখার থিকা নিজের এই যে দূরত্ব তৈরির যোগ্যতা, এইটাই সম্ভবতঃ কীটসের নেগেটিভ ক্যাপাবিলিটি। আর এইটা না থাকলে নিজের লেখা যাচাই করাই-তো সম্ভব না।
(২১)
রাইসু: গোয়া মারে শব্দবন্ধ না থাকলে সেইটা-তো অন্য আরেকটা কবিতা হইতো। যে শব্দ যে ভাবে আছে সেই ভাবে আছে বলেই সেইটা সেই কবিতা।
সুব্রত: বটে। কিন্তু এই কবিতাটা সেই আরেকটা কবিতা হইলে হয়তো আরেকটু ভালো লাগত।
(২২)
রাইসু: ইনকংগ্রুয়িটি কী মাল তা-তো জানা গেল না। ব্যাখ্যা করলে ভালো।
সুব্রত: খাপছাড়ামি। বেশি ব্যাখ্যার কিছু নাই।
(২৩)
রাইসু: হা হা নালিশটা করলেই ভালো! এই মর্মে ওই কবিতাটার উদ্ধৃতি দিলে কবিতাটাও রক্ষা পাবে। পুরা কবিতাটা আছে না আপনের কাছে। প্রান্তের একটা সংখ্যায় আছিল। অন্যের কবিতার কারণে আমার কবিতা লেখা হইলে আমি তা গোপন করতে চাই না। লেখার প্রেরণা-তো প্রায়ই অন্যের লেখা।
সুব্রত: “ঐ” কবিতাটা এইভাবে “রক্ষা” করার কোনো দরকার আছে কিনা কে জানে। কিন্তু তার লগে তোমার কবিতার যে সম্পর্ক সেইটা ঠিক “প্রেরণা” র না, মিমিক্রি র। এবং তোমার দেখাদেখি আরও দুই একজনও এই কাম করছে।
(২৪)
রাইসু: এই থিকা পাঠক আমার কবিতা = রসিকতা; এই রকম সহজ সমীকরণ করবে পরে। যে ব্যাপারে মাসুদ ভাই বা সাজ্জাদ ভাইও বলেন যে আমার কবিতার এই রকম সহজ সাধারণীকরণ হইতে পারে। আপনের কলম থিকা এই কথা বাইর হইলে অন্যদের পক্ষে তখন আমার কবিতা মানেই রসিকতা এমন ভাবা সহজ হবে। এইটা হইলো যেমন ধরা যাক জীবনানন্দের কবিতাকে কেউ যদি বলে জীবনানন্দের বিষণ্নতা তাকে যেমন সংক্ষিপ্ত করা হয় তেমন। অবশ্য আপনি যা লিখবেন তা নিয়া আমার আপত্তি করাও ঠিক না।
সুব্রত: পাঠক তা বুঝলে অবশ্য দুঃখের ব্যাপার হবে। তোমার কবিতা রসিকতাসর্বস্ব তা আমি বলতে মোটেই চাই নাই। বরং, তোমার কবিতার একটা প্রধান দিক্, রসিকতা, নিয়া দুই চার কথা বলতে শুরু কইরা অন্যদিকে গেছিলাম গা, সেইটা এইখানে বলছি।
(২৫)
রাইসু: অদরকারি বইলা মনে হয়। আমরা-তো ধরেন শ্রেষ্ঠ-অশ্রেষ্ঠ বিচার করি না।
সুব্রত: কেন করব না? আশ্চর্য! আমি-তো ফতোয়া জারি কইরা বলতেছি না যে ”এই কথা সর্বমানবে, সর্বকালে প্রযোজ্য, কেননা আমি বললাম”। আমি শুধু বললাম যে “এ-ই আমি মনে করি”।
(২৬)
রাইসু: উত্তরাধুনিকরা বরং গণশিল্পের বিরুদ্ধে। তারা প্রান্তীয় শিল্পচর্চা, তারা মূলত মূলধারা বিরোধী। গণশিল্পের পক্ষে তারা নয়।
সুব্রত: এহে! আবারও মিস কম্যুনিকেশন হইছে। গণশিল্প বলতে যা বলতে চাইছি তার লগে “মূলধারা” র কোনো সম্পর্ক নাই। সুলতান বা নন্দলালের ছবি গণশিল্প না, কিন্তু যারা সিনেমার প্ল্যাকার্ড আঁকে তারা গণশিল্পী। সুলতানের ছবি দেখলে, মোটামুটি ছবি দেইখা অভ্যস্ত যারা, তারা বুঝতে পারে এইটা কার আঁকা, বা তা না বুঝলেও, বোঝে যে এইটা বিশেষ একজন শিল্পীর আঁকা। প্ল্যাকার্ড দেইখা তা বোঝে না। তোমার লেখা পইড়া আমি তেমনি বুঝি এইটা রাইসুর, বা ধরো বিনয় মজুমদারের কবিতা যদি বেনামে ছাপাইত, তবু হয়তো ধইরা ফালাইতাম, কিন্তু আজকালকার দশজন কবির কবিতা নাম ছাড়া যদি পড়ি, আমি মনে করুম একজনই কবি র, বা অকবি র, লেখা। আর তুমি “মূলধারা” র কথা-ই বা কইতেছ কেন? মূলধারা আবার কী? আজকাল-তো বরং বলা হইতেছে যে ইংরেজিশিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির সাহিত্য হইল পরগাছা, যা কিছু ঘটছে, তা ঘটছে গেরামে, তখন আবার হেই পরগাছার মূল ধইরা টানাটানি কেন? বরং গেরামের লেখাই যেহেতু মূলধারা, যদি ধইরা নেই যে তেমন কিছু আছেই, এবং উত্তর আধুনিকেগো গেরাম পিরিতি যেহেতু ইংরেজি সংস্কৃত কবিদের চেয়ে বেশিই, তারাই-তো অধিক মূলধারাবাদী!
(২৭)
রাইসু: আমার বৌ ছড়া লিখে। আপনের এই লাইন দেখলে দিবো নে! ছড়াকাররা খারাপ কী? খারাপ যত লেখে কবিরাই। ছড়াকাররা অত খারাপ লেখতে পারে না।
সুব্রত: সারছে! হেরে দেখায়ো না এই লেখা। আমি অবশ্য ছড়াকারগো হেয় করতে চাই নাই। কিন্তু একজন ছড়াকারের জনপ্রিয়তা যে কারণে হয়, একজন কবিতাকারের জনপ্রিয়তা-তো সেই কারণে হয় না। – শেষ কথাটায় দ্ব্যর্থকতা আছে, খেয়াল করো।
(২৮)
রাইসু: বাদ দিতে পারেন। কবিতার যে পবিত্রীকরণ বা মহৎকরণ তা থিকা কবিতার অন্য রূপের সন্ধান আমরা করতে চাই। এখন তারে যদি আপনেরা কবিতার বর্গের বাইরে রাখতে চান, তাইলে উপরের সব আলোচনাই অন্তত আপনার ভূমিকার কথাগুলি শেষতক নিষ্ফল হইয়া দাঁড়ায়।
সুব্রত: পবিত্রীকরণ বা মহত্করণে যে “করণ” আছে তার আমিও বিরুদ্ধে। কিন্তু জগতে পবিত্র বা মহৎ কিছু নাই, অন্ততঃ এই ব্যক্তিগত আমার জন্য নাই, তাও আমি মানি না।
(২৯)
রাইসু: সুব্রত দা, এই পর্বটা নিয়া আলাদা লেখা লেখার জন্য বিশেষ অনুরোধ করি। প্রথমত আপনের এই পর্ব নিয়া বিস্তর ভিন্ন মতের অবকাশ আছে। অন্য রচনাকর্ম হিসেবে এইটা ছাপা হইলে তার লৈখিক বিরোধিতাও করা যায়।
সুব্রত: বিস্তর ভিন্ন মত প্রকাশ করা হউক।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ
জন্ম : ঢাকায়, ১৯৬৫ সনে। ১৯৯৫ থেকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাস।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: তনুমধ্যা (১৯৯০), পুলিপোলাও (২০০৩), কবিতাসংগ্রহ (২০০৬), ঝালিয়া (২০০৯), মর্নিং গ্লোরি (২০১০), ভেরোনিকার রুমাল (২০১১), হাওয়া-হরিণের চাঁদমারি (২০১১), আমাকে ধারণ করো অগ্নিপুচ্ছ মেঘ (২০১২), Ragatime (২০১৬), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৮), ইশকনামা (২০১৯), দশ মহাবিদ্যা (২০২০), ছুরিতে ঠিকরানো আঁধিয়ার (২০২০), ডাকা ঢাকে (২০২১)।
গদ্যগ্রন্থ: কালকেতু ও ফুল্লরা (উপন্যাস ২০০২, পুনঃ ২০১৯), মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল (গল্প ২০০৪, পুনঃ ২০১৯), চণ্ডীদাস দ্যাখে যুগ যুগ (প্রবন্ধ, প্রকাশিতব্য)।
অনুবাদ: অন্তউড়ি (চর্যাপদের পদ্য-রূপান্তর, ১৯৮৯, পুনঃ ২০২৩), নির্বাচিত ইয়েটস (ডব্ল্যু বি ইয়েটসের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ, ১৯৯৬) এলিয়টের প’ড়ো জমি (টি এস এলিয়টের ‘দ্য লাভ সং অব জে. অ্যালফ্রেড প্রুফ্রক’ এবং ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর অনুবাদ, ১৯৯৮) কবিতা ডাউন আন্ডার (নির্বাচিত অস্ট্রেলিয় কবিতার অনুবাদ, অংকুর সাহা ও সৌম্য দাশগুপ্ত-র সাথে, ২০১০), স্বর্ণদ্বীপিতা (বিশ্ব-কবিতার অনুবাদ ২০১১)।
সম্পাদনা: প্রসূন (যৌথ), অগ্রবীজ (যৌথ)।