মাহমুদুল হক : গদ্যের জাদু কোথায় | আবু হেনা মোস্তফা এনাম

এসব উপন্যাস সম্পূর্ণার্থে কাহিনিরিক্ত নয় বটে, কিন্তু তা এখানে নিতান্তই গৌণ, যা বিদ্যমান তাও অনেকক্ষেত্রে ঘনসন্নিবদ্ধ নয়; বরং কাহিনির ধারাবর্ণনার পরিবর্তে তিনি উন্মেষিত ঘটনা পূর্ণ করে তুলেছেন ভাষার সূক্ষ্মতায়, সুকোমল আত্মমগ্ন সংলাপে।


উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতা শিথানের পাশে জমে ছিল। প্রায় সাতাশ বছরের দীর্ঘ অশ্রুচুম্বনময় মন্থর সময়, নক্ষত্রদীপ জ্বেলে ঝরে পড়েছে অশেষ শিশিরফুল। ভিজিয়ে দিয়েছে অলক্ষ্যে গল্পের স্নায়ুরক্ত আর মজ্জার ভাস্কর্য। সেইসব নীরবতা, নিস্তব্ধতা আর গুমরানো যন্ত্রণায় দগ্ধ উৎকণ্ঠার সুতোও তিনি পেঁচিয়ে রেখেছিলেন নিজেরই নির্লিপ্ত, নৈর্ব্যক্তিক ও নিঃসঙ্গ শরীরে। বারবার তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, কী এক অনির্ণেয় অভিমানে তিনি স্বনির্মিত গদ্যের হিরকখচিত পৃথিবী থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন। কেমন ছিল তাঁর গদ্যের রক্তগুঁড়ো, সম্প্রসারিত স্বেদ আর শব্দভাস্কর্য?

 

দুই

কথাসাহিত্যের ভাষা প্রসঙ্গে মাহমুদুল হক ছিলেন সতর্ক, রুচিশীল, নিরীক্ষাপ্রবণ। তাঁর গদ্যে শব্দপুঞ্জ ধ্বনিময় ও স্তরবহুল, সেসবের বিন্যাস ও সংক্রামের মধ্য দিয়ে ব্যঞ্জনাবিকীর্ণ হয় বহুমাত্রিক অর্থদ্যোতনা। বাক্যের অন্তর্স্রোতে থাকে স্মৃতি, স্বপ্ন, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও কল্পনার অনুষঙ্গ। ফলে বাক্যসমূহ কেবল সংবাদ পরিবেশক থাকে না, রূপান্তর ঘটে শিল্পে। প্রথাগত কাহিনি বলবার ঝোঁক এড়িয়ে নির্মিত হয় গল্পের কাঠামো। প্রধান হয়ে ওঠে গদ্যের জাদু।

Contemporary French Literature গ্রন্থে হেনরি পিয়ের ফরাসি ‘নুভো রমাঁ’বা নব্য-উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন-সেখানে কাহিনি নয়, প্রধান হয়ে উঠেছে ভাষার সূক্ষ্ম কারুকাজ, বাক্য বিন্যাসের অপ্রথাগত নিরালম্ব রীতি। ‘নুভো রমাঁ’র নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নাতালি সারোৎ, আল্যাঁ রবগ্রিয়ে, মিশেল ব্যুতর এবং ক্লোদ সিমঁ। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রচল উপন্যাসরীতি পরিত্যাগসংকল্পে রূপান্তর করেন কাহিনির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণ ও প্রথাগত স্যাঁতসেঁতে আবেগ; বিকল্পে গৃহীত হয় অনুভূতি, মুগ্ধতা এবং মৃত্যুর তলদেশের প্রবল তরঙ্গ, কাহিনির পরিবর্তে ঘটনার উন্মেষ, চিত্রকল্পময় গদ্যে রচিত এক দীর্ঘ কবিতা; যার শব্দতরঙ্গে ক্রমশ পরিস্ফুট আশ্চর্য বোধ। কাহিনি বর্জন করে তাঁরা অগ্রসর হলো ভাষার দিকে, এমনকি চরিত্র রূপেও ভাষার নির্মাণ, কথার দৃশ্যমঞ্চ-ফলে নব্য-উপন্যাস হয়ে ওঠে বিমূর্ত একটি শিল্প। যেটি মূলত বহির্বিশ্ব থেকে আন্তর্চেতনা উন্মোচনের বিদ্রোহ।

মাহমুদুল হকের [১৯৪১-২০০৮] কয়েকটি উপন্যাসে-বিশেষত অনুর পাঠশালা [রচনাকাল ১৯৬৭], জীবন আমার বোন [১৯৭২] এবং অনেকাংশে মাটির জাহাজ [১৯৭৭] ও খেলাঘর [১৯৭৮]-উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যে তাঁর সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার সংরাগরঞ্জিত। এসব উপন্যাস সম্পূর্ণার্থে কাহিনিরিক্ত নয় বটে, কিন্তু তা এখানে নিতান্তই গৌণ, যা বিদ্যমান তাও অনেকক্ষেত্রে ঘনসন্নিবদ্ধ নয়; বরং কাহিনির ধারাবর্ণনার পরিবর্তে তিনি উন্মেষিত ঘটনা পূর্ণ করে তুলেছেন ভাষার সূক্ষ্মতায়, সুকোমল আত্মমগ্ন সংলাপে। অবশ্য মাহমুদুল হকের প্রায় সমগ্র কথাসাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে এ বিবেচনা অত্যুক্তি নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি কি ফরাসি নব্য-উপন্যাস রচনারীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন?

ফরাসি ‘নুভো রমাঁ’বা নব্য-উপন্যাস পর্বের সূচনাকাল ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল। এই পাঁচ বছরে, এবং পরবর্তীকালেও তার ধারাবাহিকতা ছিল, ‘নুভো রমাঁ’সম্পর্কিত অ্যালাঁ রবগ্রিয়ে ও অন্যান্যদের প্রাথমিক রচনাসমূহ প্রকাশিত হতে থাকে। উল্লিখিত লেখাপত্র প্রাপ্তি ষাটের দশকের বাংলাদেশে জটিল এবং সময়সাপেক্ষ ছিল। তবে ‘নুভো রমাঁ’সম্পর্কে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম প্রবন্ধের যে তথ্য আমাদের অজ্ঞতা সত্ত্বেও কৌতূহল নিবৃত্ত করেছে তা হল, নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত ‘এক্ষণ’ পত্রিকার শারদীয়, ১৯৭৩, সংখ্যায় লোকনাথ ভট্টাচার্যের ‘বস্তুপ্রেমিক ফরাসী ‘নব’উপন্যাস’প্রবন্ধটি। এ সংক্রান্ত পরবর্তী প্রবন্ধ অরুণ মিত্রের ‘বর্তমান ফরাসী উপন্যাস : পটভূমি ও প্রবণতা’; যেটির প্রকাশকাল ১৯৭৮। যদি ধরেই নেয়া হয় যে, মাহমুদুল হক ১৯৬৭ সালে প্রথম উপন্যাস রচনার পূর্বে ফরাসি ‘নুভো রমাঁ’রচনাসমূহ সম্পর্কে অবগত ছিলেন, অথচ অনুর পাঠশালা এবং অপরাপর উপন্যাসে [গল্পসমূহেও] ভাষার বৈচিত্র্য-প্রকৌশল কতটাই তাঁর সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার আত্মনিবেদন, সে-অনুভূতির স্তরবহুল তল ও আয়তনিক পরিসর অনুসন্ধান করা যেতে পারে।

 

তিন

মাহমুদুল হকের প্রতিটি উপন্যাস এবং প্রতিনিধিত্বশীল গল্পেই প্রায় লক্ষণীয় বিষয়ের সঙ্গে ভাষার সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয়। এজন্য শব্দ নির্বাচন এবং পদবিন্যাসের শৃঙ্খলা অনেকাংশেই রূপান্তর করেছেন তিনি। এই ক্রিয়া কখনো দীর্ঘফেনিল, কখনো হ্রস্ব বাক্যের মিছিলে অবিরাম গতিময়, উজ্জ্বলিত। এসব নির্বাচিত শব্দ এবং বাক্যবিন্যাসে চরিত্রের মনোব্যাকরণ, নিসর্গ ও বস্তুবিশ্বের আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে সঞ্চারিত প্রাণতরঙ্গ। সৈয়দ শামসুল হক মাহমুদুল হকের গদ্যের চমৎকারিত্ব বিশ্লেষণসূত্রে লক্ষ করেছেন জ্যামিতিক বিন্যাস। যেমন :

হীরার মতো জ্বলজ্বল ক’রে জ্বলছিলো নীলাভাবী। খোকা হাবার মতো ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়ে থাকে। দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে নীলাভাবীর দু’চোখ দিয়ে। মাঝখানে দু’টি বিন্দুর মতো দু’জনকে বসিয়ে অকারণ আনন্দে চারটি দেয়াল যেন হাত ধরাধরি করে শিশুর মতো নেচে নেচে ঘুরপাক খাচ্ছে; দেয়ালগুলো এখন জর্জিয়ান। লেসের কাজে মোড়া টিপয়ের ছাউনি দুলছে, দুলছে ফুলদানি, দুলছে স্বাস্থ্যোজ্বল রজনীগন্ধাগুচ্ছ, ট্রানজিস্টার যেন বনবিড়াল, খাড়া করে মৃদু মৃদু নাড়ছে এরিয়েললেজ; এতো হাওয়া আসে কোথা থেকে, সমুদ্রের খুব কাছে তারা, কিংবা একটা জাহাজের ভিতর, হাওয়ায় মাছের ফিশফিশানি, হাওয়ার গভীরে গোপনে সুগোল শূন্যতাবোধ ওজনহীন এক চাঁদের মতো অবিরাম সাঁতার কাটছে। [জীবন আমার বোন]

‘অনুচ্ছেদটিতে মোট পাঁচটি বাক্য। প্রথম তিনটি বাক্য প্রায় এক মাপের, চতুর্থ বাক্যটি প্রথম তিনটি বাক্যের যোগফলের প্রায় সমান জায়গা নিচ্ছে, আর পঞ্চম বাক্যটি দ্বিগুণ জায়গা নিচ্ছে চতুর্থ বাক্যটির। যেন চোখে দেখতে পেলাম-তিনটি এক মাপের সরল রেখা একের নিচে আর, তার নিচে দীর্ঘতর একটি রেখা, আর সবশেষে দীর্ঘতম রেখাটি।… প্রথম তিনটি বাক্য অকম্পিত। চতুর্থ বাক্যের শেষ অংশে ‘দেয়ালগুলো এখন জর্জিয়ান’ বলতে গিয়ে এই প্রথম মৃদু একটি দোল। তারপর, চঞ্চম বাক্যে এসে অনবরত দোল, ছোট ছোট দোল; সবশেষে ‘হাওয়ার গভীরে গোপন সুগোল শূন্যতাবোধ ওজনহীন এক চাঁদের মতো অবিরাম সাঁতার কাটছে’আমাদের দাঁড় করিয়ে দিল এক স্থির কিনারায়। স্থির, কিন্তু এখনো কি আমরা অনুভব করছি না আমাদের শ্রুতির ভেতরে সদ্য অতীত সেই দোলা? এবং রক্তের ভেতরে অভিজ্ঞতার একটি বিচ্ছুরণ?… অনুচ্ছেদের প্রথম তিনটি বাক্যে আছে সাদা তথ্য, মুখোমুখি দুটি চরিত্র সম্পর্কে।… কিন্তু এরপরই… লেখক আমাদের টেনে নিয়ে গেছেন আমাদেরই পরাচৈতন্যের ভেতর এবং পঞ্চম বাক্যে এসে তিনি আমাদের স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ও কল্পনা নিয়ে জাদুকরের মতো দুহাতে লোফালুফি করেছেন-।’

জীবন আমার বোন উপন্যাস থেকে আরো একটি দৃষ্টান্ত :

এতদিন তার চোখে যা ছিল সামান্য মানুষ, এখন তা সংগঠিত অবিচ্ছিন্ন মিছিলে। খোকা শিউরে উঠলো, এতদিন তার কাছে যা ছিল দয়িতা যামিনী মদিরার মতো তিন অক্ষরের হালকা পালকে মোড়া পাখির মতো নিছক একটি রোগা শব্দ, এখন তা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়ছে শহরময়, জনতা!

দুটি পূর্ণ বাক্য উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটিতে। প্রথমটি সাত এবং পাঁচটি শব্দের দুটি খণ্ডবাক্যের সংমিশ্রণে একটি মিশ্রবাক্য। দ্বিতীয় বাক্যটি চারটি খণ্ডবাক্যের সমাহার-পর্যায়ক্রমে তিন, কুড়ি, সাত ও একটি শব্দের উন্মেষ। প্রথম বাক্যে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে, তথ্যটি হল ‘মিছিল’। শেষ বাক্যের দ্বিতীয় খণ্ডবাক্যে অবিরাম শব্দের বিচ্ছুরণ-যেটি মিছিলে সমাগত অজস্র মানুষের সংকেত; খোকার অভিজ্ঞতায় যে মানুষ কেবল প্রেমের থরথর আবেগে বিহ্বল, পাখির পালকের মতো ভরহীন এবং উড়ে চলার আনন্দে উদ্বেল। অথবা ‘দয়িতা যামিনী মদিরার মতো’ অর্থ কি রাত্রির গভীরে দয়িতার হৃদয়ে জাগ্রত মাদকতাময় প্রেম যে বিমূর্ত উপলব্ধি সঞ্চার করতে পারে-যে উপলব্ধিকে ‘হালকা পালকে মোড়া পাখির মতো নিছক একটি রোগা শব্দে’র বাস্তব একরাশ উপমানের সাহায্যে করে তোলা হয়েছে ইন্দ্রিয়সংবেদী! অতঃপর তৃতীয় খণ্ডবাক্যে পাঠকের সংবেদনা মোচড় দেয় অত্যন্ত আকস্মিকভাবে। এখানে সমাগত মানুষ পুঞ্জিভূত ক্ষোভে বিস্ফারিত এবং চতুর্থ খণ্ডবাক্য- ‘জনতা’; একটি শব্দ, একটি সুপ্তিমগ্ন গ্রেনেড-উত্তপ্ত, উত্তেজিত, বিস্ফরোন্মুখ।

এ রকম চমৎকার বাক্যের সুশোভন বিন্যাস মাহমুদুল হকের উপন্যাসে অপ্রতুল নয়। এসব বাক্যে সংস্থাপিত শব্দপুঞ্জ আঁখিতারায় প্রতিফলিত করে ইন্দ্রিয়ানুষঙ্গজড়িত চৈতন্যের অনুরণন; সম্প্রসারিত করে সময়ের অনিবার্য সত্তা ও সৌগন্ধ। এসব শব্দরাশি কখনো নিসর্গগমনের মধ্য দিয়ে উপস্থিত হয় মনুষ্যলোকে, ইতিহাসের ভিতর থেকে উঠে আসে সাম্প্রতিকতায়, স্বপ্নের ইন্দ্রজাল ছিন্ন করে রচিত হয় চিত্রকল্পের আশ্চর্য ভুবন। ফলে ওই ভাষা কেবল একটি সময়ের সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদন হয়ে ওঠে না, বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত হয় ‘অনন্ত সম্ভাবনা ও সম্ভাব্যতার’দিগন্তপথে। এরূপ কতিপয় দৃষ্টান্ত :

বাড়ি থেকে পালানো কতো আনন্দের, অনু বারবার রোমাঞ্চিত হয়েছে। বনে-পাহাড়ে, পদ্মার নির্জন কোনো কলাগাছ ঘেরা চরে, জেলেদের ছোট্টো কোনো গ্রামে-যার চারপাশে কেবল থৈথৈ পানি-পালালে এইসব জায়গাতেই যাবে। তা না হলে এমন কোথাও যেখানে সকলে চিৎকার করে কথা বলে, ঘাসের বিছানায় ঘুমায়, যেখানে আঠারো কিংবা উনিশটা রাক্ষুসে হাঁ-র মতো ঘর নেই, বিশাল উঁচু ছাদ নেই, যেখানে বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম, হু হু হু হু বাতাস বয়ে যায়। মা যদি চিৎকার করে বলে ‘অ-নু-বে-শি-দূ-র-যে-ও-না-আ-আ-আ’তাহলে সে চিৎকার শাঁ-শাঁ আকাশের দিকে ছুটে যাবে, ধরবে বিদ্যুৎ, তারপর সেই বিদ্যুৎ চাবুকের মতো হাতে নিয়ে সপাং সপাং মারবে আর পোষ-মানা লোমশ সিংহের মতো বনরাজিঘেরা গ্রাম কেশর নেড়ে নেড়ে খেলা দেখাবে, থেকে থেকে উঠবে গর্জন- [অনুর পাঠশালা]

মায়ের পেটের ভেতরও আমরা দ হয়ে থাকি, অথচ কি আশ্চর্য দ দিয়ে কি সব দারুণ শব্দ তৈরি হয়-দর্প দণ্ড দংশন দগ্ধ দস্যু…

একটা উন্মত্ত ঘোড়া ফোঁশ ফোঁশ করে চলেছে সমানে; ভয়ঙ্কর স্ফীত তার নাসারন্ধ্র। অগ্নিগোলকের মতো সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি তীব্র দ, মুহূর্তের মধ্যে যে দ জন্ম দিয়েছে অপর একটি দ-এর; এবং এই দ থেকে বেরিয়ে এসেছে দু’টি দ-যাদের প্রত্যেকে স্বতন্ত্রভাবে একটি করে দ ছুঁড়ে দিচ্ছে, অর্থাৎ দ-এর অক্ষৌহিণী অভিযান প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে, দ-দ-দদ-দদ-দদদ-দদদদ-দদদদদ-দদদদদদদদদ—–দ-এর নির্দয় অন্ধকারে ক্রমাগত তলিয়ে যেতে থাকে ইদ্রিস। [নিরাপদ তন্দ্রা]

 

বন্ধনমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় অনুর জাগর ও উন্মুখ আকাঙ্ক্ষা পরাচৈতন্যিক চিত্রকল্প প্রথম উদ্ধৃতির পদবিন্যাসে। প্রথম ও দ্বিতীয় বাক্য পরস্পর দ্বিগুণ এবং পরবর্তী বাক্য দুটি অনেক খণ্ডবাক্যের অবিরাম প্রবাহে বাতাস ও বিদ্যুতের চিত্রকল্পে ইথারীয় শব্দতরঙ্গের বিজ্ঞান ব্যক্তির মনোজাগতিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াময় অনুভূতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতেও কল্পনা ও পরাচৈতন্যের অবরুদ্ধ আবেগ ও অনুভূতিচক্র তিনটি বাক্যের মধ্যে সম্প্রসারিত পরমাণুচক্রের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসূত্রে। প্রথম বাক্যে তথ্য, দ্বিতীয় বাক্যে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির আতঙ্কিত অস্তিত্বের চিত্রকল্পময় উন্মোচন এবং শেষ বাক্যে—যেটি প্রথম দুটি বাক্যের সমষ্টির দ্বিগুন প্রলম্বিত-ব্যক্তির নিষ্পেষিত, শঙ্কিত, উন্মূলিত, উদ্বিগ্ন, অসহায় অস্তিত্বজিজ্ঞাসা মাতৃগর্ভে মানবশিশুর কুণ্ডলায়িত দ-আকৃতির বিচ্ছুরণে পারমানবিক বিস্ফোরণ সংঘঠনের গাণিতিক প্রয়াসকে রূপান্তরিত ও স্ফুলিঙ্গায়িত মানবিক অভিজ্ঞতায়।

বিজ্ঞানের বস্তু-অভিজ্ঞতা ও সাহিত্যজ্ঞানের এই মিথষ্ক্রিয় পদবিন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যে গদ্যভাষার শক্তি ও সম্ভাবনা বিস্তৃত হয়েছে। চতুষ্পার্শ্বে দৃশ্যমান বস্তুজগতের নিস্তব্ধতাকে রূপময় করে তুলবার জন্য মাহমুদুল হকের ভাষা চিত্রকল্পময় এবং আধুনিক নন্দনতত্ত্বের পরিচর্যাসঞ্চারী।


মাহমুদুল হকের গদ্যে সাংগীতিক বৈশিষ্ট্যের প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে, বিষয়টি বিস্তৃত করা প্রয়োজন। সংগীত সুর, তাল, ছন্দ, অলংকারের সমন্বয়; শাস্ত্রে যাকে বলা হয়েছে সংগীতের ‘ধ্বনিরূপ’। গদ্যের গঠন-উপাদান আক্ষরিক অর্থে এই ধ্বনিরূপের সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে বস্তুসমগ্রতা সৃষ্টি করে না।


ব্যক্তির অস্তিত্বজিজ্ঞাসার বিবিধ পরিপ্রেক্ষিত এবং চরিত্রের অন্তর্বাস্তবতা ব্যাখ্যাসূত্রে মাহমুদুল হক এক্সপ্রেশনিস্ট, কখনো ইম্প্রেশনিস্ট, অথবা সুররিয়ালিস্ট। এক্সপ্রেশনিজমে মূলত ব্যক্তিমানুষের আবেগ, উপলব্ধি, প্রেমানুভূতি অথবা আতঙ্কিতসত্তার অভিব্যক্তি প্রকাশে বহির্বাস্তবতার বিকৃত বিকলাঙ্গ প্রকাশ; রং ও বস্তুর আবেগময়, কার্যকারণহীন, স্থানকালপরিপ্রেক্ষিতবিচ্ছিন্ন রূপান্তরপ্রণালি উন্মোচন করে ইম্প্রেশনিজমের দিগন্ত এবং ছন্দহীন, বিশৃঙ্খল, নীতিবোধহীন স্বপ্নব্যাকরণময় চৈতন্যের জগতে বাস্তবতা-অতিক্রমী কল্পলোক সুররিয়ালিজমে প্রতিভাত। ব্যক্তিঅস্তিত্ব আতঙ্কিত, ভীতসন্ত্রস্ত; নিসর্গদৃশ্য বাস্তবতা-ধূসরিত, অস্বাভাবিক ও বিকৃত। ব্যক্তির আতঙ্কশিহরিত দুঃস্বপ্ন [অনুর পাঠশালা, নিরাপদ তন্দ্রা]; নিরস্তিত্ব হওয়ার শঙ্কা, বেদনা, মনস্তাপ [জীবন আমার বোন, খেলাঘর, কালো বরফ, অশরীরী] পরিচর্যায় মাহমুদুল হকের গদ্যভাষা চিত্রকল্পময়, প্রতীকাশ্রয়ী ও সাংগীতিক। অনুর দুঃস্বপ্ন প্রকৃত অর্থে প্রতিনিয়ত তার ভীতিবিহ্বল মনোব্যাকরণের চিত্রকল্প; অন্যদিকে জীবন আমার বোন উপন্যাসের সংলাপপ্রবাহে খোকা চরিত্রের অস্বাভাবিক রূপান্তর প্রতীকাশ্রয়ী; কালো বরফে নৈঃশব্দ্য, দৃশ্যময় ও দৃশ্যাতীত-এমনকি রাত্রি-নির্বস্তুক অস্তিত্বে মোমের মতো গলে পড়বার বস্তুগুণ আরোপ এবং ব্যক্তিমানুষের শরীরী রূপান্তরক্রিয়ায় মাহমুদুল হক একই সঙ্গে সুররিয়ালিজম এবং এক্সপ্রেশনিজমের সমন্বয়ে রচিত আশ্চর্য রূপালেখ্য।

নিরাপদ তন্দ্রায় কাঞ্চনের আতঙ্কগ্রস্ত ভীতিবিহ্বলতা ও অস্তিত্ব শঙ্কটাপন্ন হয়ে ওঠার পরিচর্যায় গল্পকথকের প্রেক্ষণবিন্দু থেকে বিন্যস্ত নিসর্গ, বস্তুজগৎ ও ব্যক্তির অনুভূতিপুঞ্জের যে রূপান্তর তা প্রকৃতপক্ষে উল্লম্ফনধর্মী, অস্বাভাবিক, কার্যকারণসূত্রহীন ও স্তরবহুল। কাঞ্চনের এই অস্তিত্বজিজ্ঞাসা ও যন্ত্রণাময় রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা রূপায়ণসূত্রে মাহমুদুল হক একই সঙ্গে ইম্প্রেশনিস্ট, এক্সপ্রেশনিস্ট এবং পরাবাস্তববাদী চিত্রাত্মক ও চিত্রকল্পময় গদ্যভাষা পরিচর্যায় সংহত ও গীতিময়।

ব্যক্তির মনোসমীক্ষণজাত [psycho-analytical] বিচিত্রানুভূতিময় দৃশ্যেন্দ্রিয়গত চঞ্চল চিত্রকল্প সুররিয়ালিস্টিক ফর্ম-বিন্যাসের অনুরূপ মাহমুদুল হকের ‘নেই’ ধ্বনির বিমূর্ততার সঙ্গে চরিত্রের প্রগাঢ় আকাঙ্ক্ষার সংযোগ যেমন প্রজ্ঞাময়, আবার ব্যক্তিচৈতন্যের সংরাগমিশ্রিত রং ও বস্তুর আবেগায়িত রূপান্তরপ্রণালি উন্মোচন করে ইম্প্রেশনিজমের দিগন্ত। চিত্রশিল্পের এই আধুনিক মতবাদ, ধ্রুপদী সংগীত-জ্ঞান, জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত ও কৃষ্টির সমন্বয়, লোকায়ত জীবন ও সংস্কৃতি, নাগরিক জীবনের বিবমিষা, বিজ্ঞান-বোধ এবং এ সমস্তের সঙ্গে প্রকৃতি ও মানুষের মানবিক জীবনের আখ্যান তাঁর গদ্যভাষায় ব্যঞ্জনাময় হয়ে নির্মাণ করেছে আধুনিক শিল্পের মিথষ্ক্রিয়া। কয়েকটি দৃষ্টান্ত :

মাথার ওপর কালো চাদরে মোড়া প্রকাণ্ড এক আকাশ যেন থমকে আছে। সামান্য একটু কথা কাটাকাটি বৈ তো নয়, -কাঞ্চনের ভাবখানা ঠিক এমনিই। অন্ধকার গায়ে জড়িয়ে তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো ফাঁকা জায়গাটা ধীরে ধীরে পার হলো সে। তার মাথার ভেতর শূন্য হয়ে গিয়েছিলো। কি গুমোট আবহাওয়া! গাছপালা থমকানো! শরীরটা যেন একটা ঝিঁঝিপোকা; ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ করে ডাকছে। যেন জাগরণ থেকে তুলট তন্দ্রার ভেতর, তন্দ্রা থেকে নিদারুণ নিদ্রার ভেতর, নিদ্রা থেকে অলীক স্বপ্নের ভেতর, স্তরে স্তরে অনুপ্রবেশ করে চলেছে নিপুণভাবে, নির্ভার দেহে।…

ঝরঝরিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছে। গায়ে রক্ত কাঞ্চনের। কিছুটা পাগলের মতো, কিছুটা মাতালের মতো, কিছুটা অভিশপ্তের মতো, ঠায় দাঁড়িয়ে গাল পাড়ছে রক্তকাঞ্চন; আর ধীরে ধীরে রক্তের একটি ধারা উঠোনের অপর প্রান্তের দিকে এঁকেবেঁকে গড়িয়ে চলেছে, যেন অলক্ষ্যে আবছা উঠোনটায় লাল পাড় বুনে দিচ্ছে কেউ। মানুষের শরীরে তাহলে এতো রক্ত-এই অভিজ্ঞতাটুকু সকলের মাথার খুলির ফোকরে একটা ঠান্ডা-হিম ঠান্ডা-হিম হিলহিলে সাপ হয়ে ঢুকে কুণ্ডলী পাকাতে থাকে প্রথমবার। আ-মা-র-হা-ত, এক সময় ডুকরে কেঁদে উঠে কাঞ্চন মাটির ওপর বসে পড়ে, আর হিরনের কোঁচড় থেকে চড়াৎ করে উঠোনে লাফিয়ে পড়া একটা মাছের মতো সেই বিচ্ছিন্ন হাতটায় পাঁচটা আঙুল একটার পর একটা নড়তে থাকে মাকড়সা হয়ে, পাঁচটা আঙুল হার্মোনি যন্ত্রের মতো বাজাচ্ছে সন্ধ্যার ওপরে শোয়ানো উঠোনটাকে। গমকে গমকে দুলে উঠছে কান্না, আ-মা-র-হা-ত-আ-মা-র-হা-ত  আ-মা-র-হা-ত- [নিরাপদ তন্দ্রা]

আন্দাজ তার ঠিকই। দূরে নদী। ধাতব পাতের মতো মাঝে-মাঝে চকচক করে উঠছে, দু’ভাগে ঘিরে ফেলেছে অন্ধকারকে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, কেবল ঝিল্লিরব। ঝিল্লিরব ছাড়া কোনো দৃশ্য নেই। ঝিল্লিরব ছাড়া কোনো বেদনা নেই। ঝিল্লিরব ছাড়া কোনো স্মৃতি নেই। কোনো স্মৃতি নেই, স্মৃতির বেদনা নেই, বেদনার হাড় নেই, বেদনার মাংস নেই, ঝিল্লিরব ঝিল্লিরব-ঝিল্লিরব ঝিল্লিরব- [অশরীরী]

নতুন করে শুরু হয় তার ছোটা। কেবলই মনে হতে থাকে ময়নার বুকের ওপর দিয়ে সে ছুটে চলেছে, মড়মড় করে ভেঙে যাচ্ছে ময়নার বুকের সব কচি হাড়, কালাচান্দ মরে গেছে, লালমিয়া ঘুমিয়ে গেছে চিরতরে; আকাশ নেই, বাতাস নেই, মানুষ নেই, কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই, জন-মনিষ্যিহীন এক নিথর নিস্পন্দ পৃথিবী, বিকট এক হা, বিকট এক গহ্বর, পৃথিবীতে কোনোদিন কোনো মানুষ ছিল না, এখনো নেই নেই নেই নেই, কালাচান্দ নেই ময়না নেই নেই নেই নেই, কোথাও কিছু নেই, কোথাও কিছু নেই, ধুলো নেই, মাটি নেই, কাদা নেই নেই, কিছু নেই, দুঃখ নেই, বিষ নেই, নেই মরণ, নেই নেই নেই, কেউ নেই, কিছু নেই… [বনফুল, অগ্রন্থিত গল্প]

 

মাহমুদুল হকের গদ্যে সাংগীতিক বৈশিষ্ট্যের প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে, বিষয়টি বিস্তৃত করা প্রয়োজন। সংগীত সুর, তাল, ছন্দ, অলংকারের সমন্বয়; শাস্ত্রে যাকে বলা হয়েছে সংগীতের ‘ধ্বনিরূপ’। গদ্যের গঠন-উপাদান আক্ষরিক অর্থে এই ধ্বনিরূপের সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে বস্তুসমগ্রতা সৃষ্টি করে না। কিন্তু গদ্যে শব্দবিন্যাসের কৌশল গতিময়তার স্পন্দন সূচিত করে, বাক্যে পদসজ্জার যে ধ্বনিসাম্য তা সংগীতের অন্তরস্থিত অনুভূতি [মিউজিক্যাল আইডিয়াস] ও আবেগসমূহের স্বরূপ উন্মোচন করে; জাগরিত ও সম্প্রসারিত করে ইন্দ্রিয়। গদ্যের পদবিন্যাসে সংগীতের সুর থাকে না, থাকে পদস্পন্দ, পদের প্রবহমানতা এবং পদসজ্জা-দক্ষতার উত্থানপতন। তাছাড়া গদ্য মাত্রা গণনা করে রচিত হয় না, এমন প্রচেষ্টা কেউ করেছেন বলে জানা নেই আমাদের। তাছাড়া, এমন মাত্রাজ্ঞানসম্পন্ন কাঠামোবদ্ধ গদ্যে প্রবহমানতা থাকে কি? প্রাণ থাকে তার? তদুপরি ‘সুরচিত গদ্যমাত্রেরই একটা ছন্দপ্রবাহ থাকে। তার ধ্বনির উত্থান-পতনে, তার যতির হ্রস্বদীর্ঘতায়, তার শব্দ ব্যবহারের সুমিত বলয়ে- তৈরি হয় এই ছন্দ। এর কোনো পূর্বনির্দিষ্ট নিরূপিত ধরন নেই। একেই বলা যায় গদ্যের ছন্দ।’ [শঙ্খ ষোষ]। ছন্দপ্রবাহই মাহমুদুল হকের গদ্যের সংগীতময় ‘ধ্বনিরূপ’। এই সাংগীতিক ছন্দপ্রবাহে তাঁর গদ্য স্বতন্ত্র পরিচয়সমৃদ্ধ। যেমন:

হৈরব হাহা ক’রে হাসতে থাকে; তার হাসির গায়ে ঝলমল করে পালপার্বণ, ঝাড়লণ্ঠন আর মৃদঙ্গের শব্দ, সন্ধ্যারতি।… ‘বাজো মৃদঙ্গ, বাজো-’ হৈরবের মনে একটা ভ্রাম্যমানলহরী পালকের মতো ভেসে বেড়ায়, ‘মৃদঙ্গ তুমি মৃদঙ্গ তুমি মৃদঙ্গ তুমি বাজো, তুমি বাজো, তুমি বাজো তুমি মৃদঙ্গ তুমি বাজো, আরো বাজো-’ [হৈরব ও ভৈরব, প্রতিদিন একটি রুমাল]

সারা বারান্দায় আন্নার পায়ের ছাপ। ইচ্ছে হয় ওর ওপর গাল পেতে শুয়ে থাকি। সবকিছু ফাঁকা মনে হয়। ঝোড়ো বাতাস শূন্য কোঠায় হাহাকার করে। মনে হয় প্রতিটি গাছ সজল চোখে বিধ্বস্ত বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। [খেলাঘর]

উদ্ধৃতি দুটির পদবিন্যাসের শৃঙ্খলার মধ্যে, আমরা যে ধ্বনিস্পন্দের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছি, তার তরঙ্গ লক্ষণীয়। এরূপ দৃষ্টান্ত মাহমুদুল হকের সমগ্র কথাসাহিত্যে দুর্লভ নয়, পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ফিরে ফিরে এসেছে এমন স্বরের ছন্দপ্রবাহ।

তাঁর গদ্যে, পঙক্তিতে পঙক্তিতে উপমান, উপমেয়, বিশেষণ পদ অনুভূতিতে সূচিত করে কাব্যিক সূষমা। কবিতায় যেমন কবির মনন ও অভিজ্ঞতা, বোধি ও অন্তর্প্রেরণা চৈতন্যের স্পন্দিত কোনো বিন্দুতে সংহত ও রূপময় হয়ে ওঠে; গদ্যে লেখকের সংহত চৈতন্য অকস্মাৎ ওই সংহতিময় বস্তুসমগ্রতা থেকে ক্রমশ সম্প্রসারিত হয়। ফলে কবিতার অনিবার্য করণকৌশল গদ্যে শিথিল, শাখাপ্রশাখায়-পুষ্পপল্লবে চেতনা-বিস্তৃত ও উন্মুক্ত। কবিতার ভাব ও চৈতন্য যেখানে অন্তর্মুখী, সেখানে গদ্যের উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষা অন্তর্মুখীনতা থেকে উদ্ঘাটন করে বহির্বিশ্বপ্রকৃতি। ফলে ভাষার অন্তর্লীন কাব্যানুষঙ্গ গদ্যকে করে তোলে সম্প্রসারণক্ষম।


বাক্যে বাগধারা অথবা নিজস্ব নবসৃষ্ট শব্দপুঞ্জের দ্যুতিময় সৌন্দর্য তাঁর গদ্যের স্বাতন্ত্র্য। কেবল স্বাতন্ত্র্যই নয়, বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি স্তরবহুল ও সর্বজ্ঞবিস্তারের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধি যে কতটা ব্যাপক হতে পারে-গদ্যে বাগধারা ও নবসৃষ্ট শব্দপুঞ্জ ব্যবহার সেটিকেই করে তোলে মূর্ত ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য।


একটি বাক্যেই কখনো কখনো একাধিক উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষার অবিরল উপস্থাপনাও মাহমুদুল হকের গদ্যকে দান করেছে ভিন্ন দ্যুতিময়তা। ব্যবহৃত বিশষণরাশি অনেকাংশেই একাধিক ইন্দ্রিয়াবেগ পরস্পর গ্রন্থিযুক্ত এবং চিত্রকল্পপ্রবাহে সুগঠিত। ফলে তাঁর গদ্যে আন্দোলিত হয়ে ওঠে কবিতার নান্দনিকতা। ফলে তাঁর ভাষা অনিবার্য ও তির্যক তাৎপর্যে গতিশীল ও গীতময় গদ্যে রূপান্তরিত। ফলে কাব্যানুষঙ্গিক পদবিন্যাস সত্ত্বেও তাঁর ভাষা চিত্রকল্পময় গদ্যের অনন্য শৈলী।

কি সুন্দর এই (ঝাঞ্ঝাঝরঝরঝাঁপতালঝিঁঝিট্ঝিঁঝিট্) বৃষ্টি! কি অদ্ভুত এই বৃষ্টি! কি সীমাহীন!

বৃষ্টি! বৃষ্টি!

বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি!

ফুঁসে উঠছে হাওয়া, কখনো গলায় ঘুঙুর বাঁধা বাছুরের মতো, কখনো কুঁদুলে ষাঁড়ের মতো শিঙ উঁচিয়ে; কখনো রণোন্মত্ত সিংহের  মতো, দুর্দান্ত দস্যুর মতো কখনো। [অনুর পাঠশালা]

তার বুকের ভেতর খাঁ-খাঁ করে, বনেবাদাড়ে, বাসক আর মাদারের গন্ধের ভেতর, স্মৃতির ভেতর, আমের শুকনো মুকুলের মতো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে টুলটুল। টুলটুল যেন বিশাল নদীতে ছেড়ে দেওয়া শানবাঁধানো তিরতিরে পুকুরের একরত্তি হালকা পাতলা একটা মৌরলা মাছ। [কালো মাফলার, নির্বাচিত গল্প]

গদ্যে পদবিন্যাসের এই প্রকৌশল-যা প্রকৃতপক্ষে কবিতার গীতল অনুভূতি রূপেই বাক্যস্থিত-আমাদের চৈতন্য ও বোধ, অনুভূতি ও আবেগ, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা সম্প্রসারিত করে; ফলে বাংলা কথাসাহিত্যের গদ্যভাষার সম্প্রসারণক্ষমতা বিস্তৃত হয়ে ওঠে। লক্ষণীয়, প্রথম পর্যায়ের উপন্যাস-গল্পে কাব্যানুষঙ্গিক গদ্য রচনার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত প্রবল। অনুর পাঠশালা উপন্যাস-অন্তর্গত অনুরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। পরবর্তী উপন্যাস-গল্পসমূহে ক্রমশ এই প্রবণতা সংকুচিত, কিন্তু তার পরিবর্তে বিশেষণ প্রয়োগে ঘটনা ও প্রসঙ্গের অনুপুঙ্খ বিবরণ বিস্তৃত হয়েছে। তাঁর বাক্যে কোনো পদের স্থানচ্যুতি ঘটলে ভাষার সামঞ্জস্য ও সংযোগবিচ্ছিন্নতা প্রবল হয়ে ওঠে। [কখনো কখনো তাঁর যতিচিহ্নের ব্যবহার সম্পর্কেও এ কথা গ্রাহ্য]। তাঁর বাক্যের বিশেষণ এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে, তা নতুন একটি চিত্রকল্প নির্মাণের আধার। এমনকি কখনো কখনো এসব বাক্য সম্পূর্ণার্থে ক্রিয়াপদ বিলুপ্ত, যেখানে বিশেষ্য-বিশেষণ-সর্বনাম পদই প্রধান। এমন বিশেষায়িত বাক্যের প্রচুর দৃষ্টান্ত মাহমুদুল হকের গল্প-উপন্যাসে সহজলভ্য। প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণরীতিকে অস্বীকার করে পদবিন্যাসের এই বৈচিত্র্য বাংলা গদ্যের ধারণক্ষমতা ও সীমান্ত বিস্তৃত করেছে।

বাক্যে বাগধারা অথবা নিজস্ব নবসৃষ্ট শব্দপুঞ্জের দ্যুতিময় সৌন্দর্য তাঁর গদ্যের স্বাতন্ত্র্য। কেবল স্বাতন্ত্র্যই নয়, বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি স্তরবহুল ও সর্বজ্ঞবিস্তারের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধি যে কতটা ব্যাপক হতে পারে-গদ্যে বাগধারা ও নবসৃষ্ট শব্দপুঞ্জ ব্যবহার সেটিকেই করে তোলে মূর্ত ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। কেননা এসব শব্দ আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়কে প্রগাঢ় সংরাগ, অনুভবসংবেদনময় ও মূর্ত করে তোলে চকিত চিত্রকল্পের অবভাসে। এছাড়াও তাঁর কথাসাহিত্যে রয়েছে সুপ্রচুর শব্দদ্বৈত, অনুকার শব্দ, স্থানিক নাম শব্দ, আঞ্চলিক শব্দের তরঙ্গবলয়।

মাহমুদুল হক অত্যন্ত সচেতন অভিনিবেশে একটি রুচিশীল সাহিত্যিক গদ্য নির্মাণে অন্বেষী হয়েছিলেন, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে গদ্যের এই নতুন অন্বেষণ সূচিত হয়েছিল চল্লিশের দশকের শেষ প্রান্তে। তিনি বাংলা গদ্যভাষার সেই অন্বেষাতে সংযোজন করেন নতুন সৃজনশীলতা। যে গদ্য নিছক কলাকৈবল্যবাদের বিচ্ছিন্নতাসন্ধানী চোরাবালিতে পথভ্রান্ত নয়, বরং শিল্পের ভেতর দিয়ে নতুন রাষ্ট্রের নতুন সৃষ্টিক্ষমপ্রাজ্ঞ চিত্রকল্পময় সাহিত্যভাষা নির্মাণে বৈপ্লবিক ও তীব্র অহংচৈতন্যসঞ্চারী। এভাবেই, তিনি স্বতন্ত্র এবং বাঙালি জাতির অন্তর্নিহিত স্নিগ্ধতা, শক্তি ও সম্ভাবনময় সৃষ্টিশীল ভাষার সোনালি শস্যের উৎপাদক।

 



আবু হেনা মোস্তফা এনাম

২৪ ডিসেম্বর ১৯৭২-এ জন্ম। মেহেরপুর শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করেছেন।
গল্পগ্রন্থ : ক্রুশকাঠের খণ্ডচিত্র অথবা অভাবিত শিল্পপ্রণালী [২০০৫], নির্জন প্রতিধ্বনিগণ [২০১০], প্রাণেশ্বরের নিরুদ্দেশ ও কতিপয় গল্প [২০১০], জোনাকিবাবুই [২০১৮], গোলাপ নির্মাণের গণিত [২০২৪]
উপন্যাস : ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো [২০১৪]
প্রবন্ধগ্রন্থ : মোহাম্মদ সাদিকের কবিতা : নিরন্তর নিজেকে খোঁজা [২০২০], মাহমুদুল হক : সৃষ্টি ও শিল্প [২০২১]।
জীবনীগ্রন্থ : কথাশিল্পী মাহমুদুল হক [২০১৬]
সম্পাদনা : মাহমুদুল হকের অগ্রন্থিত গল্প [২০১০], মাহমুদুল হক রচনাবলি [৪ খণ্ড, ২০২০-২০২২]

শেয়ার