নিজেকে সেই সাপুড়ের মত মনে হয়, যে নাকি প্রতিদিন ক্ষুদ্র একফোঁটা করে সাপের বিষ খেতে খেতে পরে গ্লাস ভর্তি করে খেতো, এবং তার কিস্যু হতো না। কফির তিতকুটে স্বাদের মত বিস্মরণ দশাও কি গা সয়ে যাচ্ছে মাজেদুলের?
—’আই এম এ ফ্রিডম ফাইটার’
হুইলচেয়ারে বসিয়ে তাকে বারান্দায় আনলে কথাগুলো এভাবে শুরু করবেন সেটা মনে মনে ভেবেছেন মাজেদুল হক।
সকালে এসে প্রথম তাকে ইন্স্যুলিন দেয় সোফিয়া। তারপর নাস্তা খাইয়ে, কফি শেষ হলে ওষুধ খাইয়ে, তার দরকারি সবকিছু হাতের কাছে তৈরি রেখে, আবার ঘরে এনে তার ছুটি। এর মধ্যেই মাজেদুলের পাশের চেয়ারটায় বসে একটু ব্রেক নেয়।
—’উই অল আর ফ্রিদম ফাইতার মিষ্টার হাক। ফাইতিং ফর দ্য ফ্রিদম অফ আওয়ার সৌল’—নিয়মিত গীর্জায় যাওয়া সোফিয়া মাজেদুলের শীর্ণ উরুতে ইন্স্যুলিনের সুঁই বেঁধাতে বেঁধাতে নির্বিকার উত্তর দেয়। ওর মুখের কাটা বড়, হাসলে দুই পাটির ঝকঝকে দাঁত দেখা যায়। মাথাভর্তি অজস্র বেনী একটা রাবারব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। হাইতি’র সঙ্গে কুইবেক প্রদেশের ভাষার মিল তাকে এখানে আসার পরই তার পছন্দের চাকুরী জুটিয়ে দিয়েছে।
মাজেদুলের শারিরীক অবস্থা এবং তার পুত্র অনীকের ব্যস্ততা বিবেচনা করে সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগ এই মেয়েটিকে প্রতি সকালে এক ঘণ্টার জন্য বাসায় পাঠায়। কাজ চালানোর মতন ইংরেজী জানা মেয়েটির যত্নময় স্বভাব ভালো লাগে, আড়ষ্টতা কাটিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে মাজেদুলের।
জামা কাপড় পরে চুল আঁচড়ানো হয়ে গেলে প্রতিদিনই সোফিয়াকে নিজের গল্পটা বলতে ইচ্ছে করে। মাজেদুল বলবেন, আর মেয়েটা গালে হাত দিয়ে শুনবে। শুনতে শুনতে কোথাও অবাক হলে কিংবা দুঃখবোধ করলে ওর চোখে চোয়ালে সে চিহ্ন ফুটে উঠবে। আরেকটা ক্ষুদ্র ইচ্ছেও বুদ্বুদের মতো মাথায় আসে মাজেদুলের, ভাবেন যে এই মেয়েটি তার কথাগুলো অন্য কাউকে বলবে, এভাবে মুখ থেকে মুখে মিশে গিয়ে স্মৃতির অনন্তধারা তৈরি হবে। মাজেদুল জানেন, এ শুধুই দিবাস্বপ্ন। তার তো এমন কল্পনার বয়স নেই। তবে স্বপ্নরা কবেই-বা বয়স বিবেচনা করে আসে!
সবচেয়ে ভালো হতো যদি অনীককে বলা যেতো, কিন্তু ছেলেটা ভারী মা ন্যাওটা। মা ইহজগতে না থাকলেও অন্য আরেক নারীর প্রসঙ্গ মাজেদুলের মুখ থেকে শোনা তার জন্য সুখকর হবে না। কাজেই তাকে যা বলার ভেবেচিন্তে বলেছেন মাজেদুল। পিতা এগারো নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল একথা সে বন্ধুদের আড্ডায় দেশে থাকতেই গর্ব করে বলতো। এখন তো আরো বেশী বলে। দূরদেশে থাকার কারণে বাড়তি দেশপ্রেম।
কিন্তু প্রায়ই যে সোফিয়াকে সুফিয়া বলে ডেকে ফেলেন, একথাটা যত কৌতুকপূর্ণ শোনাক না কেন তা পুত্রকে বলেন না মাজেদুল। অনীক যে অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটি করবে তার উত্তর দিতে যাওয়ার জটিলতা এখন আর পোহাতে চান না।
সোফিয়া তার নামের উচ্চারণ হেসে শুধরে দেয়। —’নো, মিস্টার হাক। মাই নেইম ইজ সোফিয়া। এস ও পি এইচ আই এ’। কথা প্রসঙ্গে নিজের বয়সও বলে দিল একদিন। চৌত্রিশ। ওর কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হয় এখুনি কেঁদেকেটে চোখ মুছে সামলে নিয়েছে। মুখে হাসি অথচ কণ্ঠ কান্নাময়। কেন যেন মনে হচ্ছে সুফিয়ার গলার স্বরেও এমন হাসি কান্নার সমন্বয় ছিল।
সোফিয়া আর সুফিয়ার মতো সহজ একটা নামের পার্থক্য মনে থাকছে না দেখে নিজের ওপর বিরক্ত হন মাজেদুল। তার তো আরো বড় ঘটনা মনে করে করে রাখতে হবে। স্মরণশক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকছে না কেন? ভুলে যাওয়া কথা কি মস্তিস্কের গহীন কোনো স্তরে থেকে যায়? মস্তিস্ক টের না পেলেও মন তা টের পায়!
কাকে জিজ্ঞেস করা যায় এসব প্রশ্ন? অনীকের সঙ্গে দেখা হয় রাতের বেলা। সব দিন হয়ও না। মাজেদুল ঘুমিয়ে থাকলে ডাকে না। ওকে জিজ্ঞেস করলে প্রশ্ন বোঝার আগে এবং উত্তর খোঁজার আগে ডাক্তারকে ফোন করে বসবে। সেই ডাক্তার তারপর আরেকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রেফার করবে। ডাক্তারের কাছে যাওয়া অনেক ঝক্কি। অনীককে ছুটি নিতে হয়, তা না হলে ভলান্টিয়ার ড্রাইভারদের অফিসে ফোন করে হুইল চেয়ার ঠেলে ওঠানো যায় এমন গাড়ির রিকুইজিশন দিতে ওদের সঙ্গে মাজেদুলের সাত ডিজিটের ফাইল নাম্বারটা দিতে হয়। সোফিয়া তার নির্ধারিত সময়ের আগে এসে মাজেদুলকে তৈরি হতে সাহায্য করে। ওর বাড়তি সময়ের জন্য মাজেদুলের সোশ্যাল ওয়ার্কার-এর সঙ্গে দেনদরবার করতে হয় আগে থেকে। এখন কি আর এমন মিলিটারি ডিসিপ্লিন ভালো লাগে? যত্তসব ঝামেলা।
আর জিজ্ঞেস করা যায় সাইমন গোমেজকে, তবে সে তার মতো ভুজুংভাজুং দিয়ে যা নয় তাই করে ব্যাখ্যা করবে। সে ব্যাখ্যায় তাৎক্ষণিক হাসাহাসি হবে, কিন্তু মাজেদুলের প্রশ্নের সুরাহা হবে না। তারচেয়ে, থাক। কাউকেই বলবেন না।
ডায়নিং টেবিলে তার সকালের খাবার সাজিয়ে দিয়েছে সোফিয়া। স্ক্র্যাম্বল্ড এগ। ডিম, দুধ আর মাখন দিয়ে এর প্রস্তুত-প্রণালী দেখলে মুখ গোজ করে রাখেন মাজেদুল। বেশি করে পেয়াঁজ-কাঁচামরিচ দিয়ে মাঝারি আঁচে ভাজা মামলেট দিয়ে রুটি বা পরটা যে খায়নি তার জীবন ষোলআনাই মাটি—বলতে গিয়ে মুখ খুলে আবার বুজিয়ে ফেলেন মাজেদুল। আফসোস, সেই মজাদার স্বাদ এই মেয়েটা জানবে না।
সুফিয়ার তৈরি এমন মামলেটের সঙ্গে লাল পেঁয়াজ পোড়া মরিচের ভর্তা দিয়ে মুচমুচে ঘিয়ে ভাজা পরটা একবার খেয়েছিলেন মাজেদুল, তখন থেকেই এ তার প্রিয় খাবারের তালিকায়। চারদিক শ্বাসরুদ্ধ করা অমন দুঃসময়েও তড়িঘড়ি বানিয়ে টেবিলে দিয়ে মৃদু স্বরে বলেছে—‘বাইরে কখন খাওয়া জুটবে কে জানে’।
মাজেদুল মুখ তুলে ওর ভেজা চোখের পাতা দেখেছেন, সে কথা মনে আছে। সুফিয়া কি খেতে বসেছিল তাদের সঙ্গে? মনে পড়ছে না কেন? একটু পরেই তো তারা যুদ্ধকালের টনটনে দুঃশ্চিন্তা আর আতংকের মধ্যে ঢাকা শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। শহীদ ভাইয়ের ছেলেমেয়ে দুটো মুখ করুণ করে দাঁড়িয়েছিল।
মন আর মস্তিষ্ক কি আলাদা? মন যে চোখের পলকে কোথায় কোথায় পৌঁছে যায়, সেকি মস্তিষ্ক সিগন্যাল দেয়ার আগে, না কি পরে? এসব শিশুতোষ প্রশ্নের সুরাহা তার আর করা হলো না। সারাজীবন তো ঐ মনের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলেন।
সোফিয়া আপন মনে রুটিতে মাখন লাগাচ্ছে। ক্যান খুলে কুচি করে কাটা পিচফল বাটিতে ঢেলে দিয়েছে। সবশেষে কফি। এই বস্তু শুরুতে মাজেদুলের দুই চোখের বিষ ছিল। চুমুক দিলে মুখ তেতো করে ফেলতেন। এখন নিজেকে সেই সাপুড়ের মত মনে হয়, যে না কি প্রতিদিন ক্ষুদ্র একফোঁটা করে সাপের বিষ খেতে খেতে পরে গ্লাস ভর্তি করে খেতো, এবং তার কিস্যু হতো না। কফির তিতকুটে স্বাদের মতো বিস্মরণ দশাও কি গা সয়ে যাচ্ছে মাজেদুলের? কফিতে চুমুক দিয়ে মাজেদুল আবার ভাবেন- আজকে গল্পটা শুরু করে দিলে হয়। বারান্দার ঝুলন্ত টবে পিটুনিয়াদের বাহারি রঙ এদিক-সেদিক বেয়াড়া হয়ে দুলছে। মন শান্ত করা হাওয়া দিচ্ছে সকাল। এমন একটা দিনে সোফিয়াকে বলা যায়— ‘বসো মেয়ে। আমার গল্পটা বলি’।
কিন্তু সেটা যে নানা কারণে সম্ভব না, মাজেদুল তা জানেন। মেয়েটা বাংলা জানে না। আর মাজেদুলের ফাইলে ভাষা সংক্রান্ত তথ্যের জায়গায় প্রথমে তার মাতৃভাষা। দ্বিতীয় খোপে – ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি। ফরাসির প্রশ্নই আসে না। কোনো জরুরি প্রয়োজনে দোভাষী লাগবে, এমত টীকা লেখা আছে। আর অনীকের নম্বর ছাড়াও আছে সাইমন গোমেজের ফোন নম্বর।
মাজেদুলকে যখন অনীক স্পন্সর করে ক্যানাডার মন্ট্রিয়ালে নিয়ে এলো তখন একটা সুযোগ ছিল ফরাসি ভাষাটা শিখে ফেলার। ক্যানাডার প্রতিটি প্রদেশ নবাগতদের জন্য ভাষা শেখার সুবিধা রাখে। যেদিন এলেন, এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসার মাজেদুলকে একটা প্যামফ্লেট হাতে ধরিয়ে বলেছিল— ‘মহাশয়, আপনি বিনামূল্যে ভাষা শিক্ষা করিতে পারিবেন। ভাষাটি শিখিলে আপনার উপকার হইবে’।
ছেলেও উৎসাহ দিলো। মেট্রো স্টেশনের সামনেই ভাষা শেখার স্কুল। গরমকালে হেঁটে যাওয়া যাবে। শীতকালে পাতাল রেলে পনেরো মিনিট। চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে রাস্তা পার হলেই বিল্ডিংটা। মাজেদুল খুশি মনে ভর্তি হয়ে গেলেন। সন্ধ্যেবেলার ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী পনেরো জনের বেশিরভাগই বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত। কারো বাবা-মা, কারো শ্বশুর, কেউ বা অকৃতদার। ক্লাসে একটা সমমনা ভাব আনার জন্য এই বন্দোবস্ত কি না কে জানে! কিন্তু পরে দেখলেন যে আসলে সন্ধ্যেবেলার কোর্সে ছাত্র-ছাত্রী কম। নতুন আসা লোকজন তা যে দেশেরই হোক না কেন, ধৈর্য ধরে সব লেভেল শেষ করার উপায় কি সবার আছে? ভাষাকোর্সের মাসিক ভাতার তুলনায় যে কোনো সাধারণ কাজে ঢুকে গেলে চোখ বন্ধ করে তিনগুণ ডলার হাতে আসে। তরুণ বা যুবক বয়েসীদের কে আর খুশী মনে ডলার হাতছাড়া করতে চায়?
প্রথম ক্লাসেই পরিচয় হলো গাট্টাগোট্টা শ্যামলবরণ সাইমনের সঙ্গে। হোটেল সোনারগাঁও-এ দীর্ঘদিনের বাবুর্চি অবসর নিয়ে মেয়ের কাছে বাকি জীবনের জন্য চলে এসেছে। গোমেজের ইংরেজি-জ্ঞান ভালো। এখানে এসে বলার অভ্যাস বেড়েছে। মাজেদুলের পাশে এসে বসতো শুরুর দিকে। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলতো— ‘মাস গেলে পাশশো ট্যাকা দিবো, তাই অগো প্যাচাইন্না ভাষার ক্লাশে আইসা বইসা ঝিমাই। কে শিখবো এইগুলা, কোন কোন শব্দ লেখে তিনহাত কয় দেড়হাত!’ একটুও না হেসে লাগাতার রসিকতা করতে পারে সাইমন।
মাজেদুল স্থির করেছিলেন যে যে করেই হোক, শিখবেন। ইংরেজি হলে বেশি সুবিধে হতো, কিন্তু এরা যেহেতু ফ্রেঞ্চ শেখায়, তা-ই সই। চলতে-ফিরতে এই ভাষাই তো লাগবে। তবুও বুকের ভেতর ইংরেজির জন্য একটা আত্মীয়ভাব বোধ হলে আপনমনে হেসে ফেলেন মাজেদুল। দু’শো বছরের উপনিবেশ বৃটিশদের ভাষাকে আত্মীয়জ্ঞান করতে উপমহাদেশের মানুষকে বাধ্য করেছে। ভাষা যে শাসকশক্তির একটা বড় অস্ত্র, সে তো দেশের ইতিহাস জানা সব মানুষই জানে।
নিজের ভাষা লিখতে বলতে যথেষ্ট পারঙ্গম হয়েছেন এমন দাবি মাজেদুলের নেই। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা কিছুটা খাপছাড়াভাবেই শেষ করতে হয়েছে। স্বাধীনতার পরের বছর যখন তার ডিগ্রি পাশ করে যাওয়ার কথা, তখনো পরীক্ষাই দিতে পারেননি। বি-কম পরীক্ষার জন্য আদা-জল খেয়েই লেগেছিলেন, ফলাফল একটা সেকেন্ড ডিভিশন। পরে প্রাইভেটে এম-কম পাশ করলেন। সে একটা সময় গেছে! কত কিছু যে ঘটলো! কত কিছু ধরে রাখতে পারলেন না।
জীবনের চক্করে পড়ে চাকরি, সংসারাদি শুরু করতে বেশ দেরিই হয়ে গিয়েছিল। বিদেশে ছেলের কাছে এসে মাজেদুল ভাষা শেখার সুযোগ পেয়ে নতুন কিছু শেখার যে স্পৃহা টের পেলেন তাতে নিজেকে সেই বি-কম পরীক্ষার্থী মনে হলো। ভাষা শেখার বিষয়টা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন মাজেদুল।
কিন্তু বিধি তো কেবল যুদ্ধের পরিস্থিতিতেই বাম হয় না! বহু বছর পরেও হয়।
বইখাতা কিনে গুছিয়ে বসলেও ভাষাটা কেন যেন মাজেদুলকে পছন্দ করলো না। শব্দে, বাক্যে নুন-ঝাল কম, কোথায় যে স্বাদের কমতি তা ঠিক ধরে উঠতে পারেন না। জেদ চেপে গিয়েছিল মাজেদুলের। বয়স হয়েছে বলে নতুন কিছু শেখা যাবে না এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করতে হবে। প্রতিদিন ফরাসি ব্যাকরণ বই থেকে টেন্স-এর ফর্ম মুখস্থ করতে শুরু করলেন।
জীবনে খুব করে চেয়েছেন এমন কিছু আর জুটলো কোথায়! বিদেশে এসে ভাষা শেখার চ্যালেঞ্জটাও তাকে প্রতারণা করলো।
ফলাফল, আড়াই মাসের মাথায় একদিন খুব নিবিষ্ট মনে টেন্সের ফর্ম ভাবতে ভাবতে মেট্রো স্টেশনের চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক। শরীরের ডানদিকে শক্তি যেন কোন বিরাট প্রলয় এসে এক লহমায় নাই করে দিয়ে গেল। হুইল চেয়ারের সংগে গাঁটছড়া বাঁধতে হলো। তবু ভালো, তার মাথাটাকে ছাড় দিয়েছে এই প্রলয়, মাজেদুল চিন্তা করতে পারেন। যদিও টেবিলের ওপর খয়েরি রঙের চামড়া বাঁধানো খাতা হাত বাড়ালেই আর ধরা যায় না, যেখানে মাজেদুল অনেক ফরাসি শব্দের অতীত, বর্তমান, আর ভবিষ্যৎ কাল মুখস্থ করে লিখেছিলেন।
যে রাতে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল, সেটা কি পঁচিশে মার্চ-এর রাত ছিল, মাজেদুলের দিন তারিখ গুলিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত ঐ কালোরাতই হবে। কিন্তু তা ছাড়াও প্রায় প্রতি রাতে বিচ্ছিন্ন গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যেত। কোনো কোনোদিন মনে হতো কানের পাশ দিয়ে গুলি ছুটে যাচ্ছে।
অনীকের খুব বাগান করার নেশা। শহরের সব নার্সারি চষে গাছ কেনে। এ বছর গ্রীষ্মের শুরুতে লাগানো স্টার জেসমিনের ঝাড়ে ঝেঁপে ফুল এসেছে। দরজা জানালা তো বটেই, সামান্য ফাঁক ফোকর গলে ঝলক ঝলক সুবাস ঢুকে পড়ছে ঘরে। তীব্র সুঘ্রাণে মাজেদুলের অস্থির লাগে। এ ঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা দেয় আর মাথার ভেতর স্মৃতির গুপ্তধনের প্যাটরা খুলে যায়। এক ঝটকায় মন চলে যায় হাজার মাইল দূরের তার নিজের দেশে, কত বছর আগে!
মন আর মস্তিষ্ক কি আলাদা? মন যে চোখের পলকে কোথায় কোথায় পৌঁছে যায়, সেকি মস্তিষ্ক সিগন্যাল দেয়ার আগে, না কি পরে? এসব শিশুতোষ প্রশ্নের সুরাহা তার আর করা হলো না। সারাজীবন তো ঐ মনের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলেন। মস্তিষ্কের কথা শুনলেন কোথায়! এই যে সোফিয়া মেয়েটিকে সুফিয়া বলে ভুল করছেন, এখানেও তো সেই মনেরই সায়। মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে অসার হচ্ছে। একটা ভোতা আতংক মনের ওপর জেঁকে বসতে চায়।
শনি রবিবার ছুটির দিন দুটো নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গে কাটায় অনীক। বিচ্ছেদের পর ফরাসিনী স্ত্রীর সঙ্গে সেইমত বন্দোবস্ত। আগে দু’একবার দাদুর সঙ্গে নাতি-নাতনী দেখা করতে এসেছে। কিন্তু মাজেদুলের কাছে এসে দুটোই তাদের বাবার আস্তিনে লুকাতে চায়। অনীককে সারাক্ষণ দোভাষীর ভূমিকা নিতে হয়। মাজেদুলের বাড়ানো বয়সী হাতের পাশে নিজেদের নিটোল মোমের মত হাত ওরা গুটিয়ে রাখে। কয়েকবার চেষ্টার পর অনীকও হাল ছেড়ে দিয়েছে। সে এখন তার জন্য বরাদ্দ দিনগুলোতে বাচ্চাদের বাইরে বেড়াতে নিয়ে যায়। রাতগুলোতে হোটেল, নয়তো এয়ারবিএনবিতে থেকে রোববার বিকেলে সন্তানদেরকে তাদের মা’য়ের জিম্মায় ফিরিয়ে দিয়ে নিজে বাসায় ফেরে।
এ বন্দোবস্ত শুধুই কি ছেলেমেয়ের সঙ্গে ভালো সময় কাটানো? না কি মাজেদুলকে এড়িয়ে যাওয়ার ছুতো, এ ভাবনাটাকে খুব করে কম্বলে আগুন চাপা দেয়ার মত চেপে রাখেন মাজেদুল। এছাড়া আর উপায় কী?
—‘ইতস ভেরি গুড দ্যাত ইউ আর এ ফাইটার। নাউ ইউ নিদ ঠু ফাইত এগেইন্সট ইয়োর ইলনেস। দিস ইজ আ ভেরি স্ত্রং এনিমি। সো ফাইত হার্ড’। সোফিয়া হুইলচেয়ারের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
আসলেই কি মাজেদুল যোদ্ধা? মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন তার গৌরব সবাইকে বড় মুখ করে বলতে পারতেন যদি সুফিয়া রক্ষা পেতো। নিজেকে তাহলে অন্তত পাশ নম্বর দিতেন।
মাজেদুল সোফিয়ার মুখের দিকে প্রত্যাশা এবং নিরাশার দোলাচল নিয়ে চেয়ে থাকেন, মেয়েটি তাকে এখনি ঘরে ঢুকিয়ে ফেলবে। বাইরে হামলে পড়া সূর্যের আলো হুড়মুড়িয়ে বারান্দা প্লাবিত করছে। তীব্র ছটায় চোখ বুজে আসে মাজেদুলের। তবু ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না। অনীক বাচ্চাদের নিয়ে যাদুঘর দেখাতে যাবে বলে যাওয়ায় মাজেদুল জানেন যে আজকে শনিবার। একটু বেশিক্ষণ বারান্দায় তো বসে থাকাই যায়। সোফিয়া কি একটু দেরি করতে পারে না? যদিও এও জানা যে সোফিয়া এক মিনিটও দেরি করবে না।
সবদিনই তাকে বিছানায় আধশোয়া করে, হাতের কাছে দরকারি সবকিছু রেখে যায়। অথচ মাজেদুলের ইচ্ছে করে বারান্দায় বসে থাকতে। কিন্তু অতক্ষণ বাইরে বারান্দায় বসে থাকা নাকি নিরাপদ না।
মেজাজ খারাপ হলে কথা বলেন না মাজেদুল। সোফিয়াকে নিজের গল্প বলার ইচ্ছে উবে গেছে। ঘরের ভেতরে তিনদিকে দেয়াল। শুধু একদিকের দেয়াল জুড়ে একটা জানালা। আধখোলা চোখের পাতা ভেদ করে কত কিছু যে মাজেদুল দেখে ফেলেন! সোফিয়াকে অনুরোধ করলে জানালার পাল্লা উজিয়ে দেয়। না করলে দেয় না। খবিশ বলে একদিন গালি দিয়েছিলেন মাজেদুল। সোফিয়া কী বুঝলো কে জানে, তার কাছে হাঁটু ভেঙ্গে বসে ব্যাখ্যা করলো কেন সে না বললে জানালা খোলে না।
ওর ব্যাখ্যায় মাজেদুল মোটেই খুশি না। এটা কোন কথা? কি, না যদি তার ঠাণ্ডা লেগে যায়। শীতকাল হলে না হয় কথা ছিল। এখন মধ্য জুলাইয়ের গ্রীষ্মকাল। আর জানালা দিয়ে তো মাজেদুলের কতকিছুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
এক পশলা বাতাস যখন ঘরের ভেতরে পায়চারী করতে আসে, তখন ঘরের ভেতর যে হাওয়া উথাল-পাথাল হতে জানে না, সেও ফুলে ফেঁপে উঠতে চায়। তখন মাজেদুলের মনে হয় ঘরের বাইরের সুন্দর ব্যালকনিটি বদলে গেছে। তার বদলে সেখানে সেই জানালাটি, যা মাজেদুলকে আমূল বদলে দিয়েছিল।
সোফিয়াকে এসব কথা বলার জন্য যুৎসই শব্দ খুঁজে পান না মাজেদুল। সারাজীবন সরকারি ব্যাংকে মুখ বুজে কাজ করেছেন, যেখানে বাড়াবাড়ি ভাষার বালাই নেই, তার পক্ষে এত সহজ নাকি ইংরেজিতে বলা যে চোখ খুললে এ জানালা দিয়েই মাজেদুল গেন্ডারিয়ার ভাড়া বাড়ির ঘরটা দেখতে পান।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে ঐ বাড়ির দেয়ালই দেখেন মাজেদুল। খাড়া, লাল ইটের সে দেয়ালেও জানালা আছে, গাঢ় সবুজ রঙে চল্টা ওঠা শিকগুলোয় ধুলোর আস্তর। মাজেদুল নিজের হাতটা বিরাট লম্বা করে সে ধুলো মুছে দেন। মাঝে মাঝে ওপাশে একটা মুখ দেখা যায়। তখন আধশোয়া থেকে সিধা হতে ইচ্ছে করে তার। ওপাশে ঘরের ভেতরটা দেখা যায়। রান্নাঘরটাও খানিকটা দেখা যায়। জানালার গ্রীলে তেল মশলা মাখানো ন্যাকড়া। চুলার ওপর হাড়িতে টগবগিয়ে ভাত ফুটছে। সেই মুখটা মাথা থেকে ভেজা গামছা ছাড়িয়ে চুল ঝাড়ছে। গোলগাল মুখে প্রায় বোঁচা নাক, তাতেই যেন মিষ্টি উপচে পড়ছে মুখটায়। কেউ একজন গলা চড়িয়ে সুফিয়া বলে ডাক দিলে মুখটা জানালার ফ্রেম থেকে চকিতে সরে গেল।
পরে মাজেদুলের সঙ্গে চোখেচোখি হতে প্রথমদিন ভুরু কুঁচকে ঠকাস করে জানালার পাল্লা বন্ধ করে দিয়েছিল। পাল্লার ধাক্কায় বাতাসের সঙ্গে রান্নার ঝাঁঝ এসে নাকে মুখে ভুর ভুর করে ঢুকে পড়লে মাজেদুল কাৎ হয়ে আবার শুয়ে পড়েন। এবার তার মাথা স্বাভাবিকের চেয়ে ভারী বোধ হয়।
ঐ তো এক জানালা ভরসা। সারারাত না ঘুম হলেও ভোর ভোর উঠে জানালা বরাবর দাঁড়ানো ছিল। আর ছিল ফিনকি দিয়ে গড়ানো পূর্ণিমা রাতের জ্যোৎস্না। তখন জানালার গ্রীলের ওপর মুখ চেপে রাখতো সুফিয়া। আর মাজেদুল মনে মনে তার দীর্ঘ হাত আরো দীর্ঘ বানিয়ে স্পর্শ করে যেতো তার মুখ, চুল, হাতের আঙুল।
সুফিয়া ভরসা করেছিল মাজেদুলের ওপর। কী ভুলই না করেছিল মেয়েটা!
মাছের ঝাঁকের মতো হতাশা আর আফসোস এসে ভিড় জমায় মাজেদুলের কাছে। ভুরভুর করে স্মৃতি উঠে আসতে চায় একের পর এক সিনেমার রিলের মতো। আঠারো দুগুণে বত্রিশ রিলের সিনেমা তার। তবু শেষ হয়ে যাবে ভেবে মন দপ করে নিভে যায়।
ক্রমে ক্রমে জানালার ওপাশের রহস্য উন্মোচিত হলো।
মাজেদুলদের কামরায় দু’জন পাকসেনা হাতে রাইফেল উঠে এল। দু’একজনের প্রশ্নোত্তর শেষ করে সুফিয়ার নেকাবে ঢাকা মুখের দিকে রাইফেল তাক করে মাজেদুলের কাছে জানতে চাইল-‘ইয়ে কৌন হ্যায়’? ‘ইয়ে মেরা বহিন’- মাজেদুলের কাঁপা গলার উত্তর শুনে সুফিয়া ওর কনুই-এর কাছে খামচে ধরেছিল। ‘বেহেন তো আচ্ছা হ্যায়। বিবি হোতে তো হামারে লিয়ে জারা মুশকিল হোতা’ – খ্যাক খ্যাক করে হাসে খানসেনা। তারপর রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাজেদুলকে ঠেলে সরিয়ে সুফিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে মোড়ের দোকানে আলাপ হলো। একটা পারচেজিং কোম্পানিতে একাউন্টেন্ট। মাজেদুলও কমার্সের ছাত্র। কথাবার্তার সূত্রে একদিন আবিষ্কার হলো তাদের দেশের বাড়ি একই জায়গায়। সুতরাং আসা যাওয়ার খাতির জমতে সময় লাগে না।
এক ঈদের দিনে বাসায় দাওয়াত দিয়েছিলেন। মাজেদুল যতবার ভেতরের ঘরের দিকে চেয়ে থেকেছে, কোন লাভ হয়নি। খাওয়ার টেবিলে সুফিয়া আসেনি। আপা অবশ্য অতি যত্ন করে খাইয়েছেন। তারপর তো সারা ঢাকা শহর উত্তাল হলো।
যে রাতে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল, সেটা কি পঁচিশে মার্চ-এর রাত ছিল, মাজেদুলের দিন তারিখ গুলিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত ঐ কালোরাতই হবে। কিন্তু তাছাড়াও প্রায় প্রতি রাতে বিচ্ছিন্ন গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যেত। কোনো কোনোদিন মনে হতো কানের পাশ দিয়ে গুলি ছুটে যাচ্ছে। একরাতে মাজেদুল দৌড়ে ছাদে উঠে গিয়েছিলেন, ছাদে ওঠার সরু সিঁড়ি। যখন উঠছেন তখন কেউ একজন দ্রুত নেমে আসছে, মাজেদুল প্রায় কাৎ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলে একটা বেলীফুলের গন্ধ নাকে ঝাপটা দিয়ে অন্যপাশে কাৎ হয়েছিল। মাজেদুল ফিসফিসিয়ে বলে উঠেছিলেন—‘সুফিয়া’!
সুফিয়ার ছায়া একটু কথা বলেছিল কি! কিন্তু দাঁড়ায়নি। ঝটিতি দৌড়ে নিচে নেমে গেছে। একটু পরেই পেছন পেছন নেমে এসেছিল শহীদ ভাই আর তার স্ত্রী। তারাও ছাদে উঠে দেখার চেষ্টা করছিলেন ঠিক কোনদিকটায় গোলাগুলি হচ্ছে।
গ্রামের বাড়িতে বাবা মা ভাইবোনের জন্য দুঃশ্চিন্তা মাজেদুলেরও হচ্ছিল, দ্রুতই সেখানে যাওয়া দরকার। অথচ কি যেন একটা ঘোরের মধ্যে পড়েছিলেন। হাতের টাকা ফুরিয়ে আসছিল, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পারছিলেন, কিন্তু ঐ দিন-রাত্রির জানালার আকর্ষণই কি তাকে স্থাণুর মতো ধরে রাখছিল।
সে কারণেই ঢাকা ছাড়তে অত দেরি হয়েছিল? মনে পড়ছে না। আশ্চর্য তো! চাকরি খুঁজছিলেন? মাজেদুল কি শুরুতেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন না? কী হয়েছিল? মাথার খুলি যেন একটা ফাঁকা প্রকোষ্ঠ। ঐ সময়ের একটা পৃষ্ঠা কেউ ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।
শুধু মনে আছে, সেদিন অবাক বিহবল মাজেদুল ঝটপট নিজের দরকারি জিনিস গুছিয়ে নিয়েছেন। সুফিয়াকে মাজেদুলের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শহীদ ভাই। তখন এপ্রিল মাস শেষ। ঢাকায় থাকা তখন আর একদমই নিরাপদ না। সোমত্ত শ্যালিকাকে ঘরে রাখার ঝুঁকি নিতে চাননি শহীদ ভাই। রওনা দেওয়ার আগে মাজেদুলের হাত ধরে অনুরোধ করেছিলেন। সুফিয়া প্রসঙ্গে তার গলার স্বর দুঃখী এবং ব্যথাতুর শোনাচ্ছিল। মেয়েটি বড় দুঃখী—এমন কোনো কথা বলেছিলেন কি? মনে নেই মাজেদুলের। কিন্তু মনে আছে যে অবস্থাপন্ন স্কুল-শিক্ষকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সুফিয়ার। কিন্তু ধুমধাম করে বিয়ের মাসখানেকের মাথায় একদিন বাড়িতে ডাকাত পড়লো। সুফিয়া তখনো নতুন বৌ, তখনো গয়নাগাটি পরে থাকে। ডাকাতের একজন ওর গলার হার টান দিয়ে ছিনিয়ে নিতে চাইলে ওর স্বামী বাঁধা দেয়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তার মাথায় দা’দিয়ে কোপ দেয় ডাকাত দল। ঘটনাস্থলেই সুফিয়ার স্বামী হাবীবের মৃত্যু হয়।
এই কাহিনী শহীদ ভাই তাদের যাত্রার প্রাক্কালে কেন বলেছিলেন? যাতে মাজেদুলের মনে সুফিয়ার জন্য মমতা ও দায়বোধ বেড়ে যায়? অথবা, যুদ্ধের রক্তক্ষয় এবং প্রাণ সংহারের কাছে, হানাদারদের অত্যাচারের কাছে সুফিয়ার গোপন দুঃখ খুবই সামান্য, এবং প্রকাশ্য হওয়ার মতো যথার্থতা এর আছে।
ওষুধের বাক্স নিয়ে কাছে আসে সোফিয়া। ব্রেকফাস্টের পরে ব্লাড সুগার মাপতে হবে। হার্ট, কিডনি দুটোরই অবস্থা বেশি সুবিধার না। রক্তে শর্করা, এবং উচ্চ রক্তচাপ সবকিছুর দিকে গোয়েন্দার মতো নজর রাখতে হচ্ছে। মাজেদুল নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে আক্ষেপ শুরু করলে সোফিয়া নিষেধ করে— ‘ডু নত রিগ্রেত মিস্টার হাক। আমরা বাঁচিয়া রহিয়াছি ইহাই কি বেশী নহে?’
স্টেশনটার কি নাম ছিল? যেখানে ট্রেনের কামরায় আর্মি টহল দিতে উঠলো? প্ল্যাটফর্মে সারবেঁধে কিছু পুরুষ দাঁড় করিয়েছে। একটু দূরে তিনজন মহিলা। একজনের মাথায় জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর। সবুজ সাটিনের আটো কামিজ পরা মেয়েটি ফুপিয়ে কাঁদছে। সমস্ত প্ল্যাটফর্ম স্থবির হয়ে আছে। শুধু থেমে থাকা ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে ভাঁপ বেরিয়ে বাতাসের গরমে মিশে হলকা তৈরি করছে।
মাজেদুলদের কামরায় দু’জন পাকসেনা হাতে রাইফেল উঠে এলো। দু’একজনের প্রশ্নোত্তর শেষ করে সুফিয়ার নেকাবে ঢাকা মুখের দিকে রাইফেল তাক করে মাজেদুলের কাছে জানতে চাইল— ‘ইয়ে কৌন হ্যায়’?
—’ইয়ে মেরা বহিন,’ মাজেদুলের কাঁপা গলার উত্তর শুনে সুফিয়া ওর কনুই-এর কাছে খামচে ধরেছিল।
—’বেহেন তো আচ্ছা হ্যায়। বিবি হোতে তো হামারে লিয়ে জারা মুশকিল হোতা,’ খ্যাক খ্যাক করে হাসে খানসেনা।
তারপর রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাজেদুলকে ঠেলে সরিয়ে সুফিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
—উতরো! শক্ত গলায় আদেশ দেয়। আদেশ যে সুফিয়াকে উদ্দেশ্য করে মাজেদুল সহসা বুঝতে পারেননি। সামনে পেছনে বন্দুক ঠেকিয়ে নিয়ে যাওয়া দেখে শরীর কাঁপুনি দিয়ে দর দর ঘাম হতে থাকলো শুধু। মিনমিন করে জানতে চাইল— ওকে কেন নিয়ে যাচ্ছে তারা। কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ শোনা গেল না। গিয়েছিল কি? তা না হলে ডানহাতে বন্দুক ধরে বাঁহাতে পেছন দিকে তাকে থামার মতো একটা ইশারা করে গেল কেন হানাদার সৈনিকটি!
সুফিয়াও চিৎকার প্রতিবাদ কোনোটাই করেনি। তার নেকাব ওঠায়নি। ওরা প্লাটফর্মে নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিল। মাজেদুলকে নামিয়ে নেয়নি, বা গুলি করেনি দেখে এতদিন পরেও আশ্চর্য লাগে তার।
আরো আশ্চর্য লাগে, মাজেদুলের সঙ্গে সুফিয়াকে দেয়ার কথা ভাবলে। তাকে নিয়ে কী করবে এ নিয়ে বোন দুলাভাইয়ের দুশ্চিন্তা দেখে সুফিয়া নিজেই নাকি বলেছিল— ‘মাজেদুল ভাইয়ের সঙ্গে দেশের বাড়ি চলে যাই।’
শহীদ ভাই কিছুটা কাচুমাচু হয়ে অনুরোধ করে বলেছিল— ও-ই বললো তোমার সঙ্গে যাবে।
মাজেদুল হুইল চেয়ারের ব্রেকটা চেপে ধরেন। আজকে ঘরে ঢুকবেন না। তার স্খলিত মুখের পেশীতে জেদ দেখে সোফিয়া আবার পাশের চেয়ারটা টেনে বসে। মাজেদুল কিছুক্ষণ দুলতে থাকা লাল লাল পিটুনিয়াতে টকটকে কলাবতীর লাল রঙ দেখেন। সোফিয়ার হাত দুটো ধরে বলতে থাকেন— ‘সুফিয়া, আমি চিৎকার করতে পারতাম, লাফ দিয়ে উঠে একজনের বন্দুক কেড়ে নিতে চেষ্টা করতে পারতাম। তাতে হানাদারেরা আমাকে তৎক্ষনাৎ গুলি করে মেরে ফেলতো। তাতে কি, প্রমাণ তো হতো যে আমি প্রতিবাদ করছি। সুফিয়া, তুমি তো অন্তত জানতা। আমি হোমরা-চোমরা কাউকে চিনি না। কিন্তু তারপরেও কারো কাছে গেলে হাতে পায়ে ধরলে ফিরায় দিতো কি? তোমার খোঁজ পাওয়া যাইতো? আমি সেসবের কিছু করি নাই। আমি ফিরে গিয়ে শহীদ ভাইকে খবর দিতে চাইছিলাম, কিন্তু ওনাদেরকে পাই নাই। সুফিয়া বিশ্বাস করো, আমি কোনো উপায় চিন্তাই করি নাই। আমি তোমার কথা যুদ্ধের বাকি মাসগুলিতে ভাবি নাই। খালি চাইছিলাম দেশটা স্বাধীন হোক, তাইলে তোমাকে খুঁইজা পাব। আমি যুদ্ধে গেছিলাম সুফিয়া, দেশ স্বাধীন করতে।’
মাজেদুল হু হু করে কাঁদতে থাকেন। সোফিয়া তার চশমা টেনে হাতে টিস্যু দিয়ে দেয়। ওর ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে হাসে, তারপর কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে— ‘আবারো আমাকে সুফিয়া বলিয়া ডাকিতেছেন মিস্টার হাক।’
ওর কান্নাময় কণ্ঠে হাসির সঙ্গে পেশাদার আবেগ।
নাহার মনিকা
লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে নাহার মনিকা’র প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে-
‘দখলের দৌড়’ (গল্পগ্রন্থ-২০১৯ পুঁথিনিলয়), ‘মন্থকূপ’ (উপন্যাস-২০১৯ বৈভব)। ‘বিসর্গ তান’ (উপন্যাস-২০১৬ বেঙ্গল পাবলিকেশন্স)।‘জাঁকড়’(গল্পগ্রন্থ-২০১৪ দিব্যপ্রকাশ)। ‘পৃষ্ঠাগুলি নিজের’ (গল্পগ্রন্থ-২০১১ দিব্যপ্রকাশ)। ‘চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল’(কাব্যগ্রন্থ, ২০০৭, বাংলামাটি প্রকাশন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। বর্তমানে ক্যানাডা’র ক্যুবেক এ সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন।