প্রমিত ভাষার সীমাবদ্ধতা দুই দিক থেকে। একটা তার ভিতরের দিক, আরেকটা বাইরের।
এই ভাষা যেহেতু একধরনের বাছাই ও নির্মাণ, কার্যত তাকে বাদ দিতে হয়েছে অনেক কিছু। যেমন গাছ কেটে তা থেকে আসবাব বানাতে গেলে প্রথমে ছেঁটে ফেলতে হয় ফুল-পাতা-ছাল-বাকল, তারপর কাঠ কুঁদে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে তাকে ফের ক্ষত-বিক্ষত করতে হয় কাঠ-ঠোকরার মতো। নিষ্ঠুর রেঁদার টানে তখন অরণ্য কাঁপে থর থর।
শেষ-মেশ যা পাওয়া যায় তা আর যাই হোক গাছ নয়। তেমনি প্রমিত ভাষা বস্তুত ভাষার কঙ্কাল, যা শুধু ল্যাবরেটরিতে ব্যবহার্য।
এটাকে আমরা বলছি প্রমিত ভাষার দেহগত, মানে ভিতর-বাড়ির সমস্যা। এবার তাকানো যাক বহির্ভাগে।
আমরা যখন বাইরে থেকে এই ভাষার মধ্যে ঢুকতে যাব তখন কিছু সমস্যা হয়। ‘আজাইরা’ সমস্যা। আমাদের প্রাত্যহিকতার যে ছন্দ-স্পন্দন, যে সমস্ত হেঁয়ালি ও হুল্লোড়, তর্ক ও তামাশা, আর যত আত্মময়তা, সব কনুই মেরে রাস্তায় ফেলে আসতে হয়। ফেলে আসবার পর আমরা বুঝি আমার ‘আমি’টাকেই ছেড়ে এসেছি। তখন এই ভাষার মধ্যে যার কণ্ঠ শুনি সে তো আর আমি নয়, অন্য কেউ।
এই দুই দিকের চাপ সত্ত্বেও গড়ে-পিটে নেয়া ভাষা দিয়ে কিন্তু বেশ কাজ চালানো যায়। যাকে বলে কেরানিগিরি। এই যেমন নথিপত্র তৈরি করা, সংবাদপত্র ছাপানো, ক্লাসে লেকচার দেয়া। এর বাইরে আরও একটা গুরুতর ব্যাপার আছে।
সে ব্যাপারটা টের পাওয়া যাবে সিলেটের কোনো ‘পুরি’র লগে চাটগাঁয়ের কোনো বান্দার প্রেম হলে। আর তাতে যদি বরিশালের ‘মনু’ ঘটকালির দায়িত্ব নেয় তবে তো কথাই নেই। আজকের এই প্রমিত ভাষা গড়ে উঠবার আগে, ধরা যাক ত্রয়োদশ শতকে, তাদের ভাবের বিনিময় কেমন করে ঘটত সেটা ভাবতে গেলে হয়তো আমাদের মনে পড়বে ইশারা-ভাষার কথা।
আমরা মানছি, যোগাযোগের মধ্যস্থতাকারী মন্ত্র হিশেবে, নাগরিকের কুলঠিকুজি অনুসন্ধানহেতু একটা সাধারণ ভাষা প্রয়োজন। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন এজেন্সির বলবৎ থাকবার হাতিয়ার এটি। অনুশাসন জারি রাখবার কলকাঠি।
কিন্তু যে মনের কথাটি মনের মতো করে বলতে চায়, এই ভাষা দিয়ে তার কী ফায়দা! অর্থাৎ প্রশ্নটা হলো, সাহিত্যের ভাষা কোনটি হবে? কবিতা রচিত হবে কোন ভাষায়?
প্রায়ই বলতে শুনি, অমুক তো আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখে। উনি নব্য ঢাকার ডিজুস পোলাপানের মুখের বুলি দিয়া নাটক বানান।
পরিষ্কার করে এই কথাটা তাদের জানানো দরকার, সাহিত্যের ভাষা আঞ্চলিকও নয়, প্রমিতও নয়। শিল্পের নিজস্ব কিছু শর্ত আছে, যা আপনাতে আপনি-সিদ্ধ। আছে স্বতন্ত্র চিহ্নব্যবস্থা, যা দিয়ে সে ব্যক্ত হয়। অভিব্যক্তির সেই ভাষাটি কারো মুখের বুলি বা কিতাবের কোনো পৃষ্ঠা নয়। তার মর্মে লুকানো সম্পূর্ণ ভিন্ন বাগর্থবিধি। কোডিং-ডিকোডিং সিস্টেম। বীজগণিতের জটিল সমীকরণ যেন। কয়েকটি ধ্রুবকের অবস্থান-সাপেক্ষে নির্ধারিত হয় চলকের মান।
খালি চোখে যা দেখা যায় না তাকে দেখতে বীক্ষণযন্ত্র লাগে। যা শ্রুতির অগম্য তার জন্যও শুধু কান পেতে থাকলে হয় না। যে ভাব বা চিন্তা এখনও সমাজ-ভাষায় ফুটে ওঠে নি, অথচ ব্যক্তির মনে গুঞ্জরিত হচ্ছে, তাকে বাঙ্ময় করে তুলতে হলে সচল শব্দকেও প্রচল অর্থবন্ধনের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। যেমন করেই হোক। এবং শেষ পর্যন্ত সেটা হবে ভিন্ন কোনো ভাষারই নির্মাণ।
এজন্য সাহিত্য-ভাষার সংগঠন বিচার করতে গেলে অভ্যস্ততার সমরূপ, সুনির্দিষ্ট কোনো কাঠামো খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। সেখানে সব মিলেমিশে থাকে, আসঞ্জনবিদ্যার অগোচর কোনো সূত্রে। তাতে অবশ্য রসগ্রাহীর কোনো ব্যাঘাত ঘটে না—
কমলকোঠা কারে বলি
কোন মোকাম তার কোথা গলি
কোন সময় পড়ে ফুলি
মধু খায় সে অলিজনা।
‘সূক্ষ্মজ্ঞান যার ঐক্য মুখ্য’ তার কাছে এই তর্ক বৃথা। কেননা তার জগৎ তো লীলাময়। সে লীলার জনয়িতা তিনি নিজেই। তিনি স্বয়ং এখানে রীতিপ্রণেতা, নির্দেশক ও পারফর্মার।
এক অর্থে ভাষার স্রষ্টা প্রতিটি মানুষ। প্রত্যেকেরই ভাষা আলাদা। কিন্তু সেই আলাদত্বকে জাহির করতে গেলে যে ক্ষেত্র সৃষ্টি করা প্রয়োজন তা সম্ভবপর হয় না সবার পক্ষে। তাই একটা প্রস্তুত ক্ষেত্র খুঁজে নিয়ে তাদের খেলতে হয় নিজেদের খেলা। মান্য করে চলতে হয় অন্যের তৈরি করা বিধিবিধান। সেই অন্য কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়। আমরা তাকে বলে থাকি ‘সমাজ’ বা পরার্থপরতার যৌথখামার। যার কাজ শুধু সম্মতি আদায় নয়, অসম্মতি জ্ঞাপনও।
নতুন ও পুরনো, আগত ও বিগত নানা ভাবের সম্পাতে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতার বিচিত্র অভিঘাতে ভাষা টলমল করছে প্রতিটি ভাষিক-প্রাণে। একটু সতর্ক আড়ি-পাতলেই শোনা যাবে তার নিত্য জায়মান শিসধ্বনি।
নিতান্ত বধির না হলে সমাজে প্রমিত ভাষার রূপও পাল্টে যেতে বাধ্য। কিন্তু তার ধারক ও বাহক একে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে। সমস্যাটা সেখানেই।
অর্থাৎ প্রমিত ভাষার অসুবিধা সে নিজে যতটা না তৈরি করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে এর নিয়ন্ত্রকগোষ্ঠী। শেষ বিচারে তাই মামলাটা ভাষার ঠিকাদারি ও খবরদারির।