‘পিয়েতা’ আমার দেখা অন্যতম সেরা সিনেমা | প্রদোষ পাল

গত ১১ ডিসেম্বর মাত্র ৫৯ বছর বয়সে বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক নক্ষত্র খসে গেল। কিম কি দুক দক্ষিণ কোরিয়ার এক অনন্য চলচ্চিত্র পরিচালক। প্রথম জীবনে চিত্রকর ছিলেন বলেই হয়তো তাঁর চলচ্চিত্রের ক্যানভাস আশ্চর্য আখ্যানে ভরে আছে। ভাষা দিয়ে সেসব ক্যানভাসের বর্ণনা সম্ভব নয়। সাক্ষাৎ শয়তানরূপী এক সুদখোর। বিপদে পড়ে মানুষ টাকা ধার নিতে বাধ্য হয় তার থেকে। সময়মতো টাকা শোধ না করতে পারলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সুদের হার। না দিতে পারলে এই শয়তান প্রাণে হয়তো মারে না, কিন্তু অর্ধমৃত তো করে দেয়-ই! এই মানুষরূপী শয়তানের জীবনযাপনও পশুর মতো। চোখ সদা নেশাগ্রস্ত। ঘরময় নোংরা। মেঝেতে পড়ে কাঁচা মাংস। মাছি ভন ভন। নোংরা বিছানা। কোনো সুস্থ মানুষ এমন পরিবেশে বাস করতে পারে না। হ্যাঁ, এবার যে ছবি নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি তার নায়ক এমনই। প্রথম দৃশ্যে তাকে দ্যাখা যায় লেপের তলায় হাত ঢুকিয়ে হস্তমৈথুন করতে। মৈথুন পরবর্তী বীর্য টিসুপেপারে মুছে মেঝেতেই ফেলে দিতে। ঘরে তার ব্যবহৃত চাকু গাঁথা থাকে নারীর উন্মুক্ত বক্ষের একটি ছবিতে। বুঝতে অসুবিধা হয় না এ শয়তান কতটা নারীবিদ্বেষী! সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ে সুদের টাকা আদায়ের জন্য। একদিন লেদ মেসিনে কাজ করছিল একটি ছেলে। সঙ্গে তার স্ত্রী। শয়তান এসে দাঁড়াল কলাপসেবল গেটের সামনে। ছেলেটি বুঝে যায় বিপদ আসন্ন। তারও তো কানে কমবেশি এসেছে শয়তানের কান্ড কারখানা ! কাকুতিমিনতি করলো কটা দিন সময় দিতে। কিন্তু এ শয়তান শোনার পাত্র নয়। ছেলেটিকে ঠেলে বাইরে বের করে প্রথমে ধরলো তার স্ত্রীকে। ভেতর থেকে কলাপসেবল গেট টেনে দিল। কলাপসেবলের নিচে ফাঁক ছিল। তা দিয়েই বাইরে একে একে ছুড়ে দিতে থাকলো ওর স্ত্রীর ব্রা, প্যান্টি ইত্যাদি। বুঝতে বাকি রইলো না ভেতরে কি চলছে ওর স্ত্রীর ওপর। ছেলেটি ক্রোধে উন্মাদে গালাগাল দিতে দিতে কলাপসেবল তুলে ভেতরে ঢুকলো। এবার বাইরে ওর স্ত্রীকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার গেট বন্ধ করলো। ভেতর থেকে ভেসে আসছে তীব্র আর্তনাদ। কলাপসেবলের নিচ দিয়ে গল গল করে বাইরের রাস্তায় এসে পড়ছে টকটকে রক্ত। ছেলেটির স্ত্রী গেট ঠেলে ঢুকে দেখলো লেদ মেসিনে তার স্বামীর জামাসুদ্ধু হাত পাক খাচ্ছে। হাত আর হাত নেই। নেতানো কাপড়ের মতো হাত থেকে পেশাই হওয়া গলগলে রক্ত মেঝে দিয়ে গড়িয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ছে। একদিন এমনই শয়তানের সামনে এসে দাঁড়ালো এক মধ্য বয়স্কা নারী। তিনি দাবি করলেন ঐ সুদখোরের মা! তাঁকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেও হঠাৎ উদয় হওয়া মা শয়তান রূপী ছেলের পিছু ছাড়েন না। আবার সুদখোর চলল টাকার তাগাদায়। উড়ে এসে দাবি করা মা’ও চলল তার পিছুপিছু। যে বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো সুদখোর ছেলে, সেই বাড়িতেই আর এক মা ছেলেকে দ্যাখা গেল মধুর সুখ দুঃখের কথা বলতে। হাসি কান্নায় জড়াজড়ি করতে। এমন সময় দরজায় এসে দাঁড়ালো শয়তান সুদখোর। হাসি মিলিয়ে ভয়ের ছাপ ধরা পড়লো আনন্দে জড়াজড়ি করা মা ছেলের। ছেলেটি টাকার একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিল। বলল, বাকি সুদের টাকাটা এক সপ্তাহের মধ্যেই দিয়ে দেবে। কঠিন হলো সুদখোরের মুখ। টাকার প্যাকেট দিয়েই মারতে লাগলো ছেলেটির মুখে। ছেলেটির মা শিউরে উঠছে, আর্তনাদ করছে, অসহায়ের মতো চোখ বন্ধ করছে। ছেলের ওপর অত্যাচার দেখা সম্ভব নয়! কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই শয়তান সুদখোরের। প্রথমে টাকার প্যাকেট, পরে চড় থাপ্পড় মেরেই চলল। তাতেও নিস্তার নেই। পিঠে ছোরা ঠেকিয়ে নিয়ে গেল নির্মিয়মান এক বহুতলের চারতলায়। ওপর থেকে ঠেলে ফেলে দিল ছেলেটিকে। তার আগে বলল, তোকে জানে মারবো না, টাকাগুলো তবে পাবো না। সত্যিই জানে মরেনি। একটা পা ভেঙে বেঁকে গিয়ে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে ছেলেটি। নিচে নেমে এসে তারই ওপর সজোরে আরও কয়েকটা লাথি। উড়ে এসে জুড়ে বসা মা সব নিজের চোখে দেখছিল। কষ্ট হলো। ছেলের ভয়ংকর অত্যাচারে শিউরে উঠছিল, কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারলো না। আহত ছেলেটি যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে চিৎকার করে তার সুদখোর ছেলেকে অভিশাপ দিতেই মায়ের অন্য রূপ! ছেলেকে এমন গালাগাল সহ্য করে কোনো মা! তিনিও ছেলেটির ভাঙা পায়ের ওপর দড়াম দড়াম আরও কয়েকটা লাথি কষালেন। এ সব দৃশ্য দ্যাখা সত্যিই কষ্টকর। শিউরে উঠেছি ঠিক, কিন্তু উঠে যেতে পারিনি। কারণ এ ছবির যিনি পরিচালক, জানতাম তিনি কী এবং কোথায় নিয়ে যেতে পারেন দর্শকদের।

তাঁর ছবির উপজীব্য নিছক ভায়োলেন্স দ্যাখানো নয়। ভায়োলেন্সকে অন্য স্তরে নিয়ে যাওয়া।

বলছি দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম পরিচালক কিম কি দুকের কথা। আর যে ছবিটির বর্ণনা কিছুটা দিলুম তা বিশ্ব চলচ্চিত্রে সাড়া জাগানো একটি ছবি ‘পিয়েতা’। মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর সুবিখ্যাত ভাস্কর্য পিয়েতা। রোমের ভাটিক্যান সিটিতে রয়েছে এই মর্মর মূর্তিটি। ২০১২ সালে চাক্ষুস দ্যাখার সৌভাগ্য হয়েছিল। না, এখন তার আলোচনা নয়। এই পিয়েতাও ছিল ‘ভার্জিন’। যাঁকে ভার্জিন মেরীও বলা হয়। একটু-আধটু সে ইতিহাস অনেকেই জানেন। মা বলে দাবি করা মধ্যবয়ষ্কা মহিলাও তো ‘পিয়েতা’। কিন্তু পিয়েতা যাকে জন্ম দিয়েছিলেন পৃথিবীর তিন ভাগ মানুষ তাকে পুজো করে। আর একে? শয়তান ভেবে সবাই গালাগাল করে! শয়তান ছেলে ‘পিয়েতা মা’কেও একদিন ধর্ষণ করলো! মায়ের যোনিতে হাত ঢুকিয়ে জানতে চাইলো,… আমি কী এখান থেকে বেরিয়েছি? কষ্ট পেয়েও মা জানাল, হ্যাঁ। সত্যিই? তবে আমি ওখানেই ফিরে যাই? হ্যাঁ, আমি ওখানেই ফিরে যাচ্ছি। মা অসহায়ের মতো চেয়ে শুধু ছেলের নাম বলে, কাং দো। যদি তুমি আমার মা না হও, তবে আমি কিছুই করবো না। বলো তবে, তুমি আমার মা নও! বলো! তা না হলে আমি ঢুকে পড়ছি! স্বাভাবিকভাবেই মা বলতে পারলো না, সে তার মা নয়। ধর্ষিতা হলো ‘পিয়েতা’! পরদিন সকালে কাং দো ঘুম থেকে উঠে দেখলো ঘরদোর সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তার পছন্দের সব পদ রান্না করে জুড়ে বসা মা টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে। বিস্ময়ে তাকালো কাং দো। এ কি দেখছে নব সাজে! কাং দো আবার বেরিয়ে পড়লো সুদের টাকা সংগ্রহে। রাস্তায় বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে গলি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল ‘পিয়েতা’ মা দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখ নিচু করে চলে গেলো কাং দো। কিন্তু এ কোন কাং দো? এ তো সেই শয়তান সুদখোর নয়! তবে কি পিয়েতার স্পর্শে শয়তানের বদলে মনুষ্যসত্ত্বা জেগে উঠছে? সেদিনও যার কাছে সুদের টাকা চাইতে গিয়েছিল সেও লেদ মেশিনে কাজ করে। হয়তো শুনেছে তার সমগোত্রীয় আর একজনের কি অবস্থা করেছে কাং দো। আগেই তাই লেদ মেশিনে নিজের হাত রেখে দিয়েছে। বলল, আমার টাকা দিতে দেরি হবে, চালিয়ে দাও মেশিন। কাং দো ছেলেটির মুখে কাপড় গুঁজে মেশিন চালাতে গিয়েও থমকে গেলো। সে যখন ঘরে প্রবেশ করে, ছেলেটি গিটার বাজাচ্ছে। তাকে দেখেই গিটার থামিয়েছিল। কাং দো উঠে পড়লো। পাশে রাখা গিটার ছেলেটির হাতে ধরিয়ে মুখ নিচু করে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। সুচিত হল নব অধ্যায়। একের পর এক তাগাদায় যায়, ঠিক সময়ে সুদ দিতে না পারার শাস্তি এতদিন যা দিয়ে এসেছে, তা দিতে গিয়েও আর পারে না! মা ছেলেতে রাস্তায় বেরোয় হাসতে হাসতে। রেস্টুরেন্টে একসাথে খাওয়া-দাওয়া করে। একে অপরকে খাইয়ে দ্যায়। দুজনে সখের চশমা পরে মজা করে। আবার মাকে সামান্য কেউ অপমান করলে তার দিকে কাং দো তেড়ে যায়। কাং দো একদিন মা’কে বলে, আমার জীবনে তুমি যেভাবে এসে উপস্থিত হয়েছো, আমি তো আর তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না! মা শুধু একটু হাসে। কিন্তু তাঁর ভেতরেও গভীর কষ্ট, যা সে ছেলের থেকে লুকিয়ে রেখেছে। নিভৃতে হাউমাউ করে কাঁদে। ঈশ্বরের কাছে কেঁদে বলে, কেন তার এতো কষ্ট? কাং দো-কে বলতে পারে না, কিন্তু সে জানে কাং দো’ই তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছে। বরফ ঢাকা ডিপ ফ্রিজে ছেলেকে জড়িয়ে কেঁদে-কেঁদে নিজেকে হাল্কা করে আসে। কাং দো’কে তিনি ক্ষমা করতে পারবেন না। একদিন মা আত্মগোপন করলেন। তার আগে মোবাইল ফোনে এক আশ্চর্য নাটক করে ছেলেকে শোনালেন। নিজেই বাড়ি-ঘরের জিনিস ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে আর্তনাদ করে বলতে থাকলেন, কাং দো আমাকে বাঁচাও। মায়ের আর্তনাদ শুনে ছেলে বিচলিত, উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটে বাড়ি এসে দ্যাখে মা নেই। বাড়িময় ছড়িয়ে রয়েছে নানান জিনিস। ভাবলো, নিশ্চয় তার কোনো শত্রু, যাদেরকে অর্ধমৃত করে রেখেছে তারা কেউ তার মায়ের ওপর অত্যাচার করে নিয়ে গিয়েছে। শহরময় সম্ভাব্য শত্রুশিবিরে এক এক করে অভিযান শুরু করলো। কোথায় তার মাকে রাখা হয়েছে? এবং প্রতিটি ডেরায় গিয়ে লক্ষ্য করলো… কী করুণ দশা সে করেছে তাদের। যে লেদ চালিয়ে খেত, সে এখন কাগজ কুড়িয়ে ঝুপড়িতে বাস করে। কেউ খোড়া হয়ে ভিক্ষে করে। কেউ মৃতও! এ ছবির ডিটেল বর্ণনা আর আমি দেবো না। এর পরতে পরতে যে শিল্প লুকিয়ে তা বর্ণনা করতে গেলে আরও কয়েক হাজার শব্দ খরচ করতে হবে। এতদিন যত ছবির আলোচনা করেছি সবারই কাহিনির বেশিরভাগই বর্ণনা করে জানিয়েছি। কিন্তু এ ছবি দেখতেই হবে, প্রতিটি ডায়লগ প্রতিটি চাহনি, প্রতিটি অনুভূতি চাক্ষুস করে অনুভব করতে হবে। এ ছবি না দ্যাখা জীবনের অনন্য এক অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হওয়া। এতদিন যেসব ছবি নিয়ে আলোচনা করেছি তার কোনোটিকেই বোধহয় কিম কি দুকের ‘পিয়েতা’র সঙ্গে মেলানো যাবে না। আলোচনা করেছি ‘তুরিন হর্স’ এর মতো এই শতাব্দীর আশ্চর্য আধ্যাত্মিক ছবির! আলোচনা করেছি ‘লিজা ফরএভার’-এ একটি বাচ্চা মেয়ের চোরা পথে হারিয়ে যাওয়ার কাহিনি। ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’ এর মতো প্রতিটি ফ্রেমে পরাবাস্তবতা ও শিল্পে জড়িয়ে থাকার মতো ছবি। পিয়েতা’কে কোন পর্যায়ে রাখবো? যদিও পিয়েতা’র মধ্যেও পরাবাস্তবতা, কিন্তু চিরকালীন শাশ্বতরূপে নয়। সাধারণত এভাবে হয়তো আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই না। স্বপ্ন তেমনই দেখতে চাই যে স্বপ্ন হবে মায়াময়, রোমান্টিক, সৌন্দর্যময়। এমন ভয়ংকর পৈশাচিক, মানবিকতার লেশহীন রুক্ষ-শুষ্ক কদাকার স্বপ্ন কে দেখতে চায়?

যদিও আমরা অনেকেই হয়তো জানি না আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আরেকটি দৈত্যসত্তা। তার রূপ বোধহয় সুন্দর, রোমান্টিক, সামাজিক নয়। সেও ধর্ষক, খুনী পিশাচ! কিম কি দুক সেই সত্তাকে তুলে এনেছেন এই ছবিতে।

অসামাজিক, অসুন্দর, পিশাচময় হলে তার শেষ পরিণতি আর কী হতে পারে? পূর্বযুগে হলে গিলোটিনে চড়াত। মধ্যযুগে ফায়ারিং স্কোয়াডে, বর্তমানে ফাঁসিকাঠে লটকাতো। কিন্তু কী প্রমাণ হয় এতে? যুগ যুগ ধরে হাজার, লক্ষ এমন শাস্তি দিয়েছে সমাজ। সমাজই হর্তাকর্তাবিধাতা। তার চোখে যে খারাপ, খুনি বা শয়তান তার শাস্তি হয়েছে। প্রকৃত খারাপ, খুনি, ধর্ষক বা শয়তানের শাস্তি হলে সমাজ থেকে ঝেঁটিয়ে সব আবর্জনা দূর হয়ে যেত। বাস্তবে তা হয়নি। কখনো হয়ও না। কিন্তু কেউ নিজেকে যদি অসামাজিক মনে করে, সত্যিকারের দোষী, শয়তান মনে করে শাস্তি দেয় ,তার মতো বড়ো শাস্তি বোধহয় আর হয় না। কুবরিকের দর্শন কিছুটা ‘কিম কি দুক’কে স্পর্শ করলেও এ জায়গায় কিম কি দুক অনেক এগিয়ে। অন্তত আমার মনে হয়। নিজেকে কী পর্যায়ের শাস্তি দিচ্ছে? এর থেকে যন্ত্রনাময়, ভয়ংকর শাস্তি আর কিছুতে হতে পারত? সমাজের বড় কত্তাদের চোখে আঙুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দিল, তোরা কী শাস্তি আমায় দিতে পারতিস? গিলোটিনে মাথাকাটা? ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলিতে ঝাঁঝরা করা? বা ফাঁসিকাঠে লটকানো? তার শতগুণ কষ্টের শাস্তি আমি নিজে নিজেকে দিলুম। অথচ এই অসামাজিকতার প্রতিটির জন্য তোরাই দায়ী। আমিও তো আর পাঁচ জনের মতো সুন্দরভাবে বাঁচতে পারতুম! কেন অল্প বয়সে আমার জন্মদাত্রী মা’কে প্রসব দিয়ে তোদের ভয়ে ছুটে পালাতে হয়েছিল? তোরা তো কেউ কোনোদিন আমার দিকে ফিরেও তাকাসনি। অথচ অন্যায়কারী নিদান দিয়ে শাস্তি দিতে চাস? সে সুযোগ তোদের দিলুম না। তার থেকে অনেক অনেক বড় শাস্তি আমি নিজেই নিজেকে দিলুম। এ যেন সপাটে সমাজকে চাবুক মারা। আর কে এই জন্মদাত্রী মা? সমাজের চোখে অবৈধ পথে সন্তান প্রসব করা মা! সে মায়ের সঙ্গে কার তুলনা? পৃথিবীর তিন ভাগ মানুষ যে মাকে পুজো করে! পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্তরের ধর্মগুরুরা যাঁকে সর্বোচ্চ আসনে স্থান দিয়েছেন। এই দ্বিচারিতার মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন কিম কি দুক। আশ্চর্য এই স্বেচ্ছাচারী স্রষ্টা। প্রথম জীবনে যিনি শিল্পের মক্কা প্যারিসে গিয়েছিলেন ছবি আঁকা শিখতে। দক্ষিণ কোরিয়ায় ফিরে আসার পর ছবির চর্চা না করে দ্রুত ঢুকে পড়লেন সিনেমা জগতে। প্যারিস থেকে ফেরার দু বছরের মধ্যেই সিনেমা বানানো শুরু করলেন, এবং আবার সাফল্য। কেন ‘ছবির দেশ কবিতার দেশ’ থেকে ফিরে শুধু ছবির চর্চাই করে গেলেন না? হয়তো বুঝেছিলেন ছবি দিয়ে উনি যে অনুভূতি ব্যক্ত করতে চান তা পেরে উঠবেন না। ঠিকই তো, চলচ্চিত্র এমন একটি শিল্পমাধ্যম যা দিয়ে যে কথা, যত কথা যেভাবে লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, ছবি দিয়ে তার ১০ ভগ্নাংশও যায় না। খুব প্রতিভাময় বা প্রতিভাময়ী হয়েও হয় না! পৃথিবীর প্রথম সারির ধনতান্ত্রিক উন্নত দেশের প্রতিনিধি হলে তবুও কিছুটা সম্ভব। অন্যথায় কে পাত্তা দেয়? ক’জন আমরা চাইনিজ, জাপানিজ, কোরিয়ান, মেক্সিকান, ব্রাজিলিয়ান ইত্যাদি শিল্পীদের জানি? এমন একটু-আধটু যাঁরা নাম-ডাক করেছেন, খোঁজ নিলে জানা যাবে তাঁদের প্রায় সবার টিকি বাঁধা ঐ প্রথম সারির উন্নত দেশে। স্বয়ং পিকাসো যদি স্পেন ছেড়ে প্যারিসে পা না বাড়াতেন, তিনি পৃথিবীর চিত্রকলা জগতের রাজা হয়ে থাকতে পারতেন? কিম কি দুক ছবি আঁকার জন্য প্যারিসে থেকে গেলে হয়তো চিত্রশিল্পী হিসেবে কিছুটা জায়গা করতে পারতেন। কিন্তু কতটা? গুগলের মাধ্যমে যে কিছু ওঁর চিত্রকর্মের আভাস পেলুম তাতে খুব একটা আশার কিছু দেখতে পেতুম বলে মনে হয় না। তিনি কিন্তু ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা অন্য একটা সত্তার অবস্থান নিখুঁতভাবে ধরতে পেরেছিলেন। ঠিক যেভাবে হয়তো সত্যজিৎ রায়ও নিজেকে দ্রুত চিনতে পেরেছিলেন। শান্তিনিকেতনে ছবি আঁকা শিখতে গেলেও ওঁর যা দক্ষতা ছিল বড়জোর খুব বড়মাপের ইলাস্ট্রেটর হতে পারতেন এ দেশের। তা হলে বিশ্ব চলচ্চিত্রের এমন একজনকে আমরা আর পেতুম কি? কিম কি দুকও ঠিক সময় নিজেকে চিনতে পেরেছেন বলেই বিশ্ব চলচ্চিত্র জগত এক অনন্য পরিচালককে পেয়েছে! আমার দ্যাখা অন্যতম সেরা ছবি ‘পিয়েতা’।


লেখাটি বাক্ ব্লগজিনে পূর্ব-প্রকাশিত

শেয়ার