অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৫ এ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে অলাত এহ্সান-এর বৃদ্ধাশ্রম হয়ে ওঠা কফি হাউসটি। বইটিতে গল্পসংখ্যা ১০টি। প্রচ্ছদ করেছেন পরাগ ওয়াহিদ। গায়ের মূল্য ৪০০ টাকা। পাওয়া যাবে ঢাকা বইমেলা, জ্ঞানকোষ, প্যাভিলিয়ন ২৪।
নাজিবউদ্দিন রোডের পাশে অপেক্ষমান ছেলেটি
প্রতিদিন সকালে একগোছ নাইলনের সুতা দিয়ে একটা বাচ্চা মোরগ আমার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের সঙ্গে বেঁধে মা আমাকে বাড়ির সামনের ফুটপাতে বসিয়ে দিতেন। টিন-কাঠের কালো একঝাঁপ গেটটা যখন ধীরে ধীরে টেনে দিতেন, তখন আর আমার বাসায় ফেরার সুযোগ থাকত না। সারা দিন এই বসে থাকার মধ্যে ছিল না কোনো ভিক্ষাবৃত্তি বা সাহায্য প্রার্থনার কিছু। নাজিবউদ্দিন রোড তত দিনে অব্যবহারে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। আমি মনে করতে পারি, জনমানবহীন নাজিবউদ্দিন রোডের প্রশস্ত ফুটপাতে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে থাকতেই জীবনের গন্তব্য সম্পর্কে বুঝতে শিখেছি।
এটা ঠিক সেই সময়ের কথা, আমার বয়স মাত্র তিন কি চার বছর। আমি নিজের মতো খেলায় মগ্ন থাকতে শিখে গেছি। ঠিক জানি না, ওই বয়সে আমার প্রতি মা এতটা আস্থাশীল কিংবা রূঢ় হলেন কী করে! তাই বলে তাকে অবিবেচক বলা যাবে না। আমার বিশ্বাস, তার মতো স্বল্পভাষী নারী দ্বিতীয়টি কারো জানাশোনার মধ্যে নেই। একই সঙ্গে তিনি কাজমগ্ন। আমাদের ঘরের উত্তর দিকের ছোট্ট চৌক জানালা খুলে বসে সারা দিন তিনি কুশিকাঁটা দিয়ে কিছু একটা বুনতেন। কখনো কখনো উলের সুঁতো জড়ানো দুটো বাঁশের কাঠি দুই হাতে বিরামহীন নড়ত-চড়ত। দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল আর তর্জনী ক্রস করে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার মতো অনেকটা, তবে দ্রুত। কিন্তু কাজটা শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা কখনোই জানতাম না তিনি কী তৈরি করছেন। আসলে চৌক জানালা এতটাই ছোট ছিল যে একটা শীর্ণ আলো কেবল মায়ের হাতের ওপর পড়ত, বাকি সব ডুবে থাকত অন্ধকারে। কাজটা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর চৌকোর দিকে একবার মেলে ধরতেন, সেটাই প্রথম ও শেষ, তখন দেখতাম তিনি হয়তো রগের* মধ্যে পুঁতি গেঁথে ব্যাগ, ঝুড়ি, মেয়েদের বটুয়া; কুশিকাঁটার গেঞ্জি, টুপি, গা কচলানি অথবা উলের সোয়েটার, টুপি, চাদর কিংবা মাফলার তৈরি করেছেন।
উত্তরের নদীর মতোই প্রশস্ত ছিল দক্ষিণের নাজিবউদ্দিন রোড, একই রকম কালো। পানি কমে যাওয়া মরা নদীর বাঁধানো পাড়ের মতো উঁচু ফুটপাত। কিন্তু ওই ফুটপাত দিয়ে কাউকে হেঁটে যেতে দেখিনি। রাস্তায়ও ছিল না গাড়ি-ঘোড়ার যাতায়াত। শুধু প্রতিদিন সন্ধ্যায় উল্টো পাশের ফুটপাত দিয়ে শ্রমিক গোছের কিছু লোক ব্যথাতুর নত মুখে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে যেতেন। কিন্তু কোন বেলা তারা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে হেঁটে গিয়েছিলেন তা কখনোই জানতে পারিনি। এতটাই সাবধানে তারা পা ফেলতেন, মনে হতো শুকনো পাতায় কোনো শব্দ না করেই কীভাবে চলা যায় তা আয়ত্ত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা চলে গেলেই বুঝতে পারতাম, আমাদের ঘরে নেওয়ার সময় হয়েছে। স্বল্প ব্যবহৃত গেটটা তখন আস্তে আস্তে খুলে যেত। এক হাতে বাচ্চা মোরগের পালক ঢাকা গরম মাংসল দুটো পাখা এবং আরেক হাতে আমার শীর্ণ বাহু মেলে ধরে মা ঘরে ফিরে যেতেন।
ফুটপাতে বসে থাকতে প্রথম প্রথম নিজেকে ভীষণ একা মনে হতো। একটা চওড়া পুরোনো পথ, ঝরাপাতায় ঢেকে গেছে, ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কালো পিচের রং, এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত দেখাই যায় না; কিন্তু ফাঁকা ও নির্জন। কান পাতলে পাতা ঝরার শব্দ পর্যন্ত পাওয়া যায়, নাকে আসে পাতা শুকানো কড়া গন্ধ। তার পরও এই রাস্তাটা কেন তৈরি করা হয়েছে তা মনে করতে পারতাম না। রাস্তার ফুটপাত বোধ হয় দ্বিতীয় দফা প্রশস্ত করা হয়েছে। তাই একসময় পাড়ে থাকা অনেক গাছই এখন ফুটপাতের মাঝখানে পড়ে গেছে। এমন জনমানবহীন রাস্তার ফুটপাত প্রশস্ত করারই-বা কী আছে, ভেবে পেতাম না। শুধু বিরানভূমির মতো প্রশস্ত পথঘাট দেখে বুকটা খাঁ খাঁ করত। পৃথিবীর এই কাণ্ডকারখানার মানে বুঝতে চাওয়াই মানুষের বড় অন্বেষা, না পারলেই যত গন্ডগোল। পরে দেখলাম, মোরগটাও আমার চিন্তামগ্ন মুখের দিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। এটা আমার কাছে রীতিমতো আবিষ্কার তুল্য যে কার্যত আমরা যুগলবন্দি। তখন থেকে নতুন এক খেলায় মত্ত হলাম আমরা।
শুরুতে মোরগটা ভীষণ ছোটাছুটি করত। এমনকি আমি যখন তাকে শান্ত-আশ্বস্ত করার জন্য স্বহৃদয়ে হাত বুলিয়ে দিতে চাইতাম, তখনো। তাতে পায়ের আঙুলে সুতার বাঁধন এঁটে যেত। আরেকটু হলে কেটেই যেতে পারত—এমন হয়েছে কয়েক দিন। দিন শেষে টের পেতাম আঙুলটা ব্যথায় টন টন করছে। এ নিয়ে মা একটা কথাও না বলে পরের দিনের জন্য প্রস্তুতি নিতেন। অন্য পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে বেঁধে দিতেন সুতা। কখনো আঙুলে একটু কাপড় জড়িয়ে দিতেন যেন ক্ষত হয়ে না যায়। আঙুল রক্ষায় সুতা ধরে বসে থাকতাম নদীতে মাছ ধরার মতো। কখনো কখনো মনে হতো, বরং গেঁথে দেওয়া মাছ পুনরায় ধরার অভিনয় করছি। মোরগটা আমার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য উড়তে চাইত। কিন্তু সুতার টানে ঠিকই নেমে আসতে হতো ওকে। আমি মোরগটাকে নাম দিলাম ‘উড়ি’। যেহেতু তত দিনে উড়ির পালকগুলো লাল রং ধরতে শুরু করেছে, তাই আদর করে ডাকতাম ‘উড়িলাল’ বলে। একদিন উড়িলাল আবিষ্কার করল, পাতার নিচে তার জন্য খাবার আছে। তার পর থেকে পাতা সরিয়ে আহার খুঁজতে খুঁজতে ভুলেই গেল ওর পায়ে বাঁধা দড়ি হাতে ধরা। বরং ধীরে ধীরে আমার কাছে আসতে শুরু করল। আমিও পাশের মেহগনিগাছে গা এলিয়ে দিয়ে ঝিমানোর সুযোগ পেলাম।
শরতের দীর্ঘ দিনগুলোতে মেহগনির শরীরে নিজেকে হেলিয়ে দুপুরে একপশলা ঘুমিয়ে নিতাম। উড়িলাল ততক্ষণে সুতার সর্বোচ্চ দূর পর্যন্ত খাবার খুঁজতে ব্যাপৃত থাকত। পুরোনো আর বাকল ওঠা মেহগনির শরীর সব সময়ই নানা কীটপতঙ্গের আশ্রয়। কয়েক মাসের দীর্ঘ ঘুম ভ্রমণের পর শরতের শেষ দিকে জালে মোড়া শরীর নিয়ে শূককীটেরা মাটিতে নেমে আসে। এমন দিনের এক দুপুর গড়ান্ত সময়ে উড়িলালের দাপাদাপি-চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গেল। দূর থেকে নেভি-ব্লু রঙের একটা গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। নাজিবউদ্দিন রোডে বসে থাকার তিন-চার বছরের মাথায় সেবারই প্রথম এমন শব্দ তোলা অদ্ভুতকিমাকার গাড়ি দেখলাম। গাড়িটার আগাপাছতলা মোড়া, একেবারে বন্দরের কনটেইনারের মতো। শুধু বাক্সের ওপরের দিকটায় এক ফুট জায়গাজুড়ে ঘন মোটা লোহার নেট দেওয়া। তা দিয়ে ভেতরের কিছুই দেখা যায় না। পেছনের দিকে চিকন-লম্বা দরজা। গাড়িটা এতটাই গতিতে আমাদের পেরিয়ে গেল যে রাস্তার খয়েরি-কালসিটে শুকনো পাতাগুলো পানির মতো ছলকে উঠে দুই পাশে ছড়িয়ে পড়ল। দূরে ডান দিকের মোড়ে আড়াল হওয়ার আগপর্যন্ত গাড়িটাকে দেখছিলাম। উড়িলাল আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে তখনো ফুটপাতে উঁচু স্বরে কক্ কক্ করছে। ঠিক তখনই মা গেট খুলে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। অন্য দিনগুলোর মতো শ্রমিক গোছের মানুষগুলোর ফিরে যাওয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হলো না। কিন্তু আমাদের দ্রুত বাড়ি ফিরিয়ে আনা নিয়ে মা কিছুই বললেন না। আমাকে বারান্দায় নামিয়ে দিয়ে ঘরের চৌকো জানালার পাশে টুল টেনে কুশিকাঁটা নিয়ে বসে পড়লেন।
চোঙ্গি ঘরের টিকিট কাউন্টারের মতো চৌকো জানালায় ছিল না কোনো লোহার শিক বা গ্রিল, কিন্তু তা দিয়ে ছোটখাটো একটা মাথা গলানো যাবে মাত্র। জানালার ওপাশে নদী। সেখানে দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ছাড়া শরীর নিয়ে কেউ ঘরে আসার ছিল না। তাই সব সময় খোলা থাকত। কোনো কোনো বিকেলে দেখতাম মা চৌকোতে থুতনি ঠেকিয়ে উদাস চোখে নদী দেখছেন। একটা মজা পুকুরের মতো কালচে পানির নদীতে কী দেখতেন, তা কেবল তিনিই বলতে পারেন। তবে তার চোখে বিষণ্নতা আর অপেক্ষার ছায়া এড়ানোর উপায় ছিল না। এক রান্না ছাড়া তিনি ঘর থেকে তেমন বের হতেন না বলেই আমার ধারণা। ইট গাঁথা দুই কামরার দোচালার বারান্দায় তখন আমি খেলা করতাম। বড় বড় কাঠের গাছ আর দেয়ালঘেরা বাড়ির উঠোনজুড়ে থাকত মেহগনি ও অর্জুনের ঝরাপাতা। সেই শুকনো পাতা দিয়ে বারান্দার এক কোনায় রান্নাবান্নার কাজ চলত। এখন মনে হয়, মা যদি ঝরাপাতা দিয়ে রান্না না করতেন তাহলে হয়তো একদিন আমরা পাতাচাপাই পড়ে যেতাম। এতটা নির্জন জায়গায় বাড়িটা ছিল যে পাতাচাপায় মরে থাকলেও খুঁজে পেতে অনেকটা সময় কেটে যেত।
আগের দিনের ঘটনার পর আমি ভেবেছিলাম, উড়িলালকে নিয়ে আর ফুটপাতে বসতে হবে না। মা হয়তো রাতে কুশিকাঁটার কাজের সঙ্গে সঙ্গে কথা গুছিয়ে নিয়েছেন। পরের দিন যথারীতি যত্ন নিয়ে তিনি সুতা বেঁধে দিতে লাগলেন। কোনো কথা বললেন না। ব্যাপারটা যেহেতু নিয়মিত বিষয়, তাই আমিও কিছু বললাম না। এই দিন আমি প্রায়ই পশ্চিম দিকে তাকাচ্ছিলাম গাড়িটা আবার আসে কি না দেখার জন্য। তখনো উড়িলালের গত দিনের ভয় কাটেনি। ও প্রায় তক্কেতক্কে ছিল। কিন্তু কোনো গাড়ি এল না, কোনো ব্যত্যয়ও ঘটল না। প্রতিদিনের মতো সন্ধ্যায় রাস্তার উল্টো পাশের ফুটপাত দিয়ে কিছু শ্রমিক গোছের লোক নতমুখে ফিরে গেল আর আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। তাদের চলে যাওয়া আর আমাদের ফিরে আসার না ছিল কোনো দিন, না ছিল সপ্তাহ। ছায়াপথে ছুটে যাওয়া নক্ষত্রের মতো একদিকে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেন। কয়েক দিন তক্কে থাকার পর মনে হলো গাড়িটা সহসাই আর আসবে না। আমি পুনরায় দুপুরের ঘুমে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম।
ঘুম এমন এক অবস্থা যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে। কত বছর পর ঠিক মনে নেই, তবে এক হেমন্তের শুরুতেই প্রচুর মশা-মাছি আর পোকার আনাগোনা টের পেলাম। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ একটা পোকা আমার নাকের ডগায় হুল ফুটিয়ে গেল। খুব নড়েচড়ে উঠেছিলাম। হাত বোলাতেই টের পেলাম, নাকের খানিকটা উঁচু হয়ে উঠছে। প্রথমে এটা কিঞ্চিৎ ছিল। হাত ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে দ্রুতই চোখে পড়ার মতো বড় হয়ে গেল। আমার চোখ দুটোও ঘুরতে ঘুরতে নাকের ডগায় ওই গোটার ওপর আটকে যায়। তখন একটা ধাঁধা তৈরি হয়। চোখ খানিকটা ঝাপসা হয়ে আসে বটে, তবে সামনের সবকিছু জোড়া দেখা যায়। বেশিক্ষণ চোখ স্থির রাখা যায় না। দ্রুতই চোখ ব্যথা শুরু হয়, খুলির পেছনের দিকে চক্কর দিয়ে ওঠে। তবে ঘোর লেগে থাকে অনেকটা সময়জুড়ে। এটা একটা মজার খেলা, যখন সবকিছু একটা রেখায় এসে দ্বিত্ব দেখায়। খেলা এতটা উপভোগ্য হয়ে উঠল যে ঘোর লাগা চোখে এপাশ-ওপাশ তাকাতে শুরু করলাম।
নিজের দিকে খেয়াল করে টের পেলাম, আমি শৈশব ছাড়িয়ে কৈশোরে পৌঁছে গেছি। উড়িলালের দিকে তাকিয়ে থেকে খেয়াল করা হয়নি। কিন্তু উড়িলাল ঠিকই একখণ্ড পাথরের মতো ওজনদার আর গোল হয়ে উঠেছে। দীর্ঘায়ুর পাহাড়ি বা বন মোরগের জাতটা কী করে এই শহরতলিতে এসেছে উত্তরের নদীর মতোই তা দুর্বোধ্য। শুধু মনে করা যেতে পারে, একার্থে সে আমার সমান বয়সী। তবে আমরা শরীরে যখন পৌরুষ উঁকি দিচ্ছে, নাকের নিচে গোঁফের হালকা রেখা, চেহারায় ঝিল্লি; উড়িলালের পায়ের চামড়া তখন খানিকটা মোটা আর খসখসে হয়ে গেছে। মরা পাতার মতো পালকের লাল রং বদলে খয়েরি আর চোখের হলদে বৃত্তটা ধূসর হয়ে এসেছে। ক্ষুদ্র পালকে ঢাকা কানের ছিদ্রের পাশে ঝুলে পড়েছে কানের পাতা আর গলার ওপর ঝুনঝুনি। তার এক পিঠ নোনতা ওঠা জামার মতো সাদা সাদা ছোপ। উড়িলালের সবচেয়ে সুন্দর ও মসৃণ চকচকে পালকগুলো প্রায় শিথিল হয়ে পড়েছে। যেভাবে তার হারগুলো শরীরের উষ্ণ কোমল মাংসে আবৃত না থেকে শক্ত হয়ে গেছে। যে ক্ষিপ্রতায় সিনা ফুলিয়ে, যখন-তখন চারপাশ কাঁপিয়ে ডেকে উঠতে পারত, তা অনেকটাই ফ্যাসফেসে হয়ে গেছে। তবে আনুগত্য বেড়েছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বয়সের ভারে নুইয়ে না পড়লে ওকে দিয়ে সার্কাস করানো যেত। খুব সম্ভব ছিল ওর পায়ের সঙ্গে বাঁধা সুতা ছেড়ে দিয়ে আগলে রাখা। কিন্তু সন্দেহ কিংবা মানুষের প্রাগৈতিহাসিক প্রভুত্ব উপভোগ থেকে তাকে আর রেহাই দেওয়া হয়নি।
সবচেয়ে ভালো লাগছিল উড়িলালকে দুটো দেখতে। দুটো মোরগ মুখোমুখি আধার খাচ্ছে; সিনা ফুলিয়ে গলা টান টান করে ডাক ছাড়ার দৃশ্য সীমান্তে দুই দেশের সৈনিকের পতাকা অভিবাদন জানানোর মতো দেখায়। উড়িলালের খয়েরি মইনের/// ওপর দিয়ে খাকি রঙের ছায়া চোখে পড়ল। প্রথমে মনে হয়েছিল, ওটা নাকেরই গোটা। কিন্তু দৃষ্টি স্বাভাবিক হতেই চমকে উঠলাম—ওটা একটা শিয়াল। এমন সময়ই পশ্চিমের সেই গড় গড় আওয়াজ শুনতে পেলাম। প্রায় অর্ধযুগ পরে শব্দটা শুনেছি, কিন্তু শিয়াল পালিয়ে গেল। এবার গাড়ির গতি আগের চেয়ে কম। এটা একটা প্রিজনভ্যান। এবার তাতে একজন কয়েদিও আছে। গাড়ির পেছনের দিকের দরজার মুখে একই পোশাকের দুজন লোকও দেখা গেল। সজাগ তাকিয়ে আছে। লোহা মোড়া গাড়িতে বন্দি মানুষকে পাহারা দেওয়ার কী আছে, বুঝতে পারিনি। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, কনটেইনারের মতো গাড়ির ভেতর একজন দাঁড়িয়ে আছেন। নেটের ফাঁক দিয়ে বের করা আঙুলে আঁকড়ে থাকা দুই হাতের মাঝে কপাল ঠেসে আছে একটা ব্যথাতুর মুখ। তার মুখে হালকা দাড়ি-গোঁফ, কান ঢেকে গেছে কত দিনের ঝাঁকড়া চুলে। তার দিকে তাকিয়ে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম উড়িলালের কথা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে গাড়ির শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করছে। উড়িলাল কিংবা গাড়ির শব্দে মা দ্রুত বেরিয়ে এলেন। ততক্ষণে গাড়িটা মোড়ের দিকে এগিয়ে গেছে। লোকটা তখনো আমার দিকে এক ধেয়ানে তাকিয়ে আছেন।
বাড়ির ভেতর নেওয়ার পর আমার দিকে মা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। যেন আমিই গাড়িটাকে ডেকে আনি কিংবা তাড়িয়ে দিয়েছি। পরের দিন মা ঠিকই আমাদের নাজিবউদ্দিন রোডে পাঠালেন। আমার বুঝতে শেখার এক যুগেও তার কোনো ব্যত্যয় ছিল না। অন্তত গ্রীষ্মের দিনগুলোতে ঝড়ের তাণ্ডব শুরুর আগমুহূর্ত কিংবা মাঘের শীতে ঘন কুয়াশার ভেতর কাছের বস্তুটিও ডুবে যাওয়া পর্যন্ত এর কোনো বদল হয়নি। তাই পরের দিন ফুটপাতে বসে গাড়ির জন্য অপেক্ষায় না থেকে, গেঁথে দেওয়া মাছ পুনরায় ধরা কিংবা ভৃত্য-মনিবের খেলায় মেতে উঠলাম। এ খেলা এতটা উপভোগ্য ও লোভনীয় যে বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে, সময়জ্ঞান ভুলিয়ে দেয়। যেমন আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম শিয়ালের কথা। পাতা শুকানো গন্ধ ভরা এক দুপুরে তাকে আবার দেখলাম। বয়সী আর খাবার অরুচিতে ভোগা চেহারা। যেন মুখের এক হাত দূরের আহারও খেতে পারবে না, এমন দুর্বল। তবু শিয়াল বিষয়ে শোনা গল্পগুলো তার প্রতি আমাকে সন্দেহপ্রবণ করে তোলে। দুপুরের ঝিমুনির মাঝে এক চোখের পাতা ফাঁক করে উড়িলালকে দেখতাম, ঘুমের ঘোরে হাতের সুতা টেনে নিশ্চত হতে চেয়েছি অনেকবার।
সন্ধ্যার পর আমাদের ঘরে কোনো বাতি জ্বলে না। নাজিবউদ্দিন রোডে যেখানে সন্ধ্যার আগেই বৈদ্যুতিক বাতির আলো ছড়িয়ে পড়ত, তখনো আমাদের বাড়িতে কুপিও জ্বলতে দেখিনি। হাতের আন্দাজেই মা সব কাজ সেরে নিতেন। এমনকি রাতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উলের কাজও করতেন অন্ধকারে, যেভাবে খুলির ওপর আঙুল ঘষে ঘষে উকুন এনে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের নখে পিশে মারতেন। তবে আমরা আগেভাগে শুয়ে পড়তাম। বেঞ্চির মতো দুই হাত চওড়া কাঠের চৌকিতে আমি আর মা ঘুমাতাম। আমি ঘুমানোর পর রাতের একসময় তিনি উঠে যেতেন। দুই ইট সমান দেয়ালের চিপা দিয়ে ঘরের ওপাশের কামরার মাচায় কাজ করতেন। গুছিয়ে রাখা ঘরগৃহস্থালির জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে যাওয়া জন্য ছোট ছোট শব্দে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। অন্ধকার ঘরে তিনি কী যে গুছিয়ে রেখেছেন আর কী অগোছালো হয়ে পড়েছে কে জানে। আমি কোনো দিনই ওপাশে যাইনি। আমার বয়সের তুলনায় ভারী একটা তক্তা দিয়ে বন্ধ থাকত দরজা। শুধু কোনো কোনো রাতে ওপাশের টুংটাং শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে, এ-ই যা।
শিয়াল বিষয়ে সব গল্প মায়ের কাছ থেকে শোনা। রাত শুরুর আগেই তিনি গল্প শুরু করতেন। আসলে সন্ধ্যার পর থেকেই তিনি গল্প শুরু করতেন। চলত আমি ঘুমিয়ে পরা পর্যন্ত। তার পরও গল্প চলত কি না আমি জানি না। আমি বুঝদার হওয়ার পর থেকেই তিনি চমৎকার সব গল্প শুনিয়েছেন। ভিটরে শিয়ালটা দেখার পর থেকে স্মৃতি সেই গল্পগুলো আবার মগজে ফিরতে শুরু করে। এর মধ্যে এক বর্ষায় ঘরে শিয়াল আশ্রয় দেওয়া আর বর্ষা শেষে গৃহস্থের মুরগি নিয়ে যাওয়ার গল্পটাও ছিল। সবচেয়ে চমকপ্রদ ছিল হায়েনা বশ মানানোর গল্পটা। তাও আবার চোখে চোখ রেখে সম্মোহন করে। শুধু তা-ই নয়, শিয়াল মনে করে হায়েনাটাকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার গল্পও ছিল।
শিয়ালটার দিকে তাকিয়ে সেই কথা ভাবতে ভাবতে আমি উড়িলালকে হারিয়েই ফেলেছিলাম। তখন পশ্চিমের সেই গড় গড় আওয়াজ আসতে শুরু করে। প্রায় চার বছর পরে হলেও তা ভুলে যাওয়ার নয়। তড়িঘড়ি করে সুতা টেনে আবিষ্কার করলাম, খাবারের খোঁজে উড়িলাল পাতার স্তূপে ঢুকে পড়েছিল। আসলে দৈনিক নির্দিষ্ট সীমায় আহার খুঁজতে হয় ওকে। পাতার ওপরের আহার শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে গভীরে যেতে হচ্ছে। আমার সঙ্গে না হয় মা কিছু শুকনো খাবার দিয়ে দিতেন।
এই দিন অদ্ভুত গাড়িটা এগিয়ে এল আগের চেয়ে ধীরে। পরে জেনেছি ওটা প্রিজনভ্যান। তাতে আটকে থাকা লোকটার চোখের দিকেও তাকানো যায়, এতটা মন্থর ছিল ওটা। তার মাঝ বয়স পেরোনো চেহারায় কিঞ্চিৎ আশার ঝিলিক। আমাকে দেখে তিনি নড়েচড়ে উঠলেন। প্রিজনভ্যানের নেটের ফাঁক দিয়ে একটা চিরকুট বাতাসে উড়িয়ে দিলেন, তারপর আঙুলের ইশারা করে কী যেন বললেন, বোঝা গেল না। গাড়ি চলে যাওয়ার পরও পেট্রল পোড়া ধোঁয়া আর শুকনো পাতার গন্ধের মিশ্রণে নতুন ঝাঁঝ পাওয়া গেল, কিন্তু গাড়ির শব্দে চাকার তলে পাতার মরমর ধ্বনি পাওয়া গেল না। বাতাসে ছড়িয়ে পড়া ধুলো মাটিতে নেমে এলে আমি সন্তর্পণে চিরকুট তুলে নিই। তাতে পেন্সিলের গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—‘হে বালক, লক্ষ করো।’ গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একই পোশাকের লোক দুটি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তখনই খেয়াল করলাম, পেছনে বাড়ির একঝাঁপ গেট খুলে যাচ্ছে। সামনে শিয়ালটাও নেই। বরাবরের মতো মা কিছুই বললেন না। মোরগটা হাতে ধরে নিঃশব্দে আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন। আমাকে বাইরে রেখেই চৌকো জানালার পাশে কুশিকাঁটা নিয়ে বসে পড়লেন। সন্ধ্যা হওয়ার খুব বাকি ছিল না। তাই বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে হলো না।
হেমন্তের শুরুতে গাছের পাতা সব ঝরে গেলে নাজিবউদ্দিন রোডে একটা লক্ষণীয় দৃশ্য তৈরি হয় বটে। গাছের ডালে ছোট পাখিগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়, উল্টো হয়ে ঝুলে থাকা বাদুড়গুলোও বিদায় হয়ে অন্য এলাকায় যায়। এগুলোই সারা বছর আমার চারপাশ মুখর রাখে। এখানেই শহরের সব পাখি জড়ো হয় কি না জানা নেই। নদীর পারে বলে শীতের শুরুতে প্রচুর পানকৌড়ি আসে। তখন মাছ খাওয়া কৌড়ির বিষ্ঠার গন্ধে টেকা দায়। তবে পাখিগুলো ডেকে উঠলে উড়িলালও সিনা ফুলিয়ে ডাক ছাড়ে, ডানা ঝাপটায়, কিন্তু তার চেষ্টা তুলনায় স্থূল শরীরটা কমই নড়ছিল। তখন সে নিজেকেও পাখি মনে করে কি না কে জানে। কিন্তু শীতের কুয়াশানামা শুরুর এক দুপুরে উড়িলালকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হাতে সুতো ধরা আছে, কিন্তু উড়ি নেই। শিয়ালটা তখনো রাস্তার ওপাশে ছিল, একসময় সে-ও চলে গেল। তখন থেকেই সন্দেহটা পোক্ত হলো। কিন্তু একটা শিয়াল শহরের কোথায় থাকে, এই সময়টুকুর মধ্যে হেঁটে কত দূরই বা যেতে পারে, তা নিয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। অস্থির হয়ে আমি হাঁটতে হাঁটতে পূর্ব দিকে অনেক দূর এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, শ্রমিক গোছের লোকগুলো ফিরছে। তাদের প্রত্যেকের কাছে উড়িলালের কথা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু তারা কেউ সাড়া দিলেন না।
‘আমি যে মোরগ নিয়ে বসে থাকি, তাকে দেখেছেন?’ একটু দম নিয়ে আবার, ‘পাহাড়ি মোরগ, অনেক বড় হয়, অনেক দিন বাঁচে।’ উত্তেজিত হয়ে বলছিলাম।
তখনো মাথা নিচু করে তারা হেঁটেই যাচ্ছেন। কাঁধে ছোট ঝোলা। আমি আবারও তাদের বললাম—‘এই যে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আপনারা ফিরে যাওয়ার সময় এত বছর ধরে আমি রাস্তা ওপাশে মোরগ নিয়ে বসে থাকি, সেই মোরগটার কথা বলছি।’ কিন্তু তারা কখনোই উড়িলালকে দেখেননি, কেবল নত মুখে হেঁটে গেছেন। আমার খেয়াল করা হয়নি প্রথম দেখার তুলায় তাদের শরীর অনেক বেশি ঝুঁকে, নত হয়ে গেছে। যাকে বলে কুঁজো, তেমন অনেকটা। আমি তাদের উড়িলালের বর্ণনা দিলাম—লাল মোরগ, খয়েরি মঈন**, বেশ বড় আর তাগড়া। কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না।
মা নিশ্চয়ই আজ আমাকে শাস্তির মুখোমুখি করবেন—এমনটা একটা সকারণ ভয়ে কেঁপে উঠছিলাম। স্বহৃদয়ে একজন কিছু বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। তার মুখটা বেঁকে গেছে কথা না বলতে না বলতে। কার্যত তিনি বোবা হয়ে গেছেন। আরেকজন খেপে গিয়ে বললেন, ‘একটা মোরগের জন্য এমন করছ কেন, এটা তো বছরের খাজনাও না। তার জন্য তোমার জমি কেড়েও নেওয়া হবে না, তাই না!’ বোকার মতো উড়ির সঙ্গে আমার বেড়ে ওঠার সম্পর্কের কথা বললাম।
‘তুমি তো একটা গরুও হারাওনি ছেলে, যার জন্য তোমাকে শহরের শ্রমিক হতে হবে! এত বিচলিত হচ্ছ কেন?’ দলের বয়সী লোকটা সবচেয়ে নিস্পৃহভাবে বললেন। আমি তাদের বোঝাতেই পারছিলাম না, এ জন্য আমাকে শাস্তি পেতে হতে পারে। আমি জানি না, এ জন্য আমাকে কাল কী কী করতে হবে। আমি দৌড়ে তাদের আগে বাড়ির গেটে এলাম—এতক্ষণে যদি উড়িলাল ফিরে থাকে! আমাদের ঘরে ফেরার সময় প্রায় পেরিয়ে গেছে। বাড়ির গেট খুলে মা দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি দরদর করে ঘামছি। তিনি একটা কথাও না বলে আমাকে ভেতর নিয়ে গেলেন।
এই দিন দেখলাম ঘরের মেঝেতে আরেকটা বিছানা পাতা, তাতে মায়ের বালিশ আর চৌকিতে আমারটা। এটা উড়িলালকে হারানোর শাস্তি কি না জানি না। বালিশ দুটোর স্থান বদল করে আমি চুপচাপ মেঝেতে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ এক জলের ছিটায় কেঁপে উঠলাম। অন্ধকারে হাত টিপে টিপে টের পেলাম এটা মায়ের পায়জামা। আগে সকালে মেঝে বরাবর টাঙানো দড়িতে মায়ের ভেজা সালোয়ার-কামিজ থেকে পানি ঝরতে দেখতাম। ইদানীং সন্ধ্যার আগে মায়ের কাপড় ছড়ানো থাকে। মা নিজ হাতে সেলাই করে জামা বানাতেন, কোনো দিন দর্জিবাড়ি যাওয়া হয়নি। আমার পোশাকগুলো তিনি তৈরি করে দিতেন। এসব এড়িয়ে আমি প্রিজনের লোকটার না শোনা কথাগুলো আর চিরকুট নিয়ে ভাবলাম—কী এমন কথা আছে এর মধ্যে : ‘হে বালক, লক্ষ করো’। সন্ধ্যায় ফিরতে থাকা শ্রমিক গোছের মানুষের দল, রাস্তার ওপাশ থেকে ফিরে যাওয়া ভিটরে শিয়াল আর হারানো উড়িলাল ছাড়া আমার লক্ষ করার কিছুই ছিল না।
সকালে ঘর্ঘর শব্দে ঘুম ভাঙল। বারান্দায় জাঁতা দিয়ে মা গম পিষছেন। গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আটা। গমের আমদানি বাড়িতে আগেই ছিল। কোনো কোনো সন্ধ্যায় মা রুটি তৈরি করতেন। তারপর তুলে রাখতেন। খেতে দেননি কখনো। কোনো কোনো দিন অলস সময়ের আহার হিসেবে মসলামাখা ছোলার সঙ্গে গমের দানা ভেজে দিতেন।
কুশিকাঁটা আর উল বোনার সঙ্গে মা এখন গম পেষার নতুন কাজ পেলেন। গতকালের সুতা পায়ে বাঁধাই ছিল। আমি নিঃশব্দে নাজিবউদ্দিন রোডে গিয়ে বসে রইলাম। আগের মতোই মা গেট টেনে দিলেন। উড়িলাল নেই, ভীষণ একা মনে হচ্ছিল। হঠাৎ কোথাও মোরগটাকে আবিষ্কার করব, এমন এক আশায় সময় কেটে যায়। শিয়ালটাও সঙ্গ ত্যাগ করেছে। মোরগ হারানোর সঙ্গে শিয়াল হারানোও কম ব্যথার নয়। সন্তান হারানোর দিনে সন্তানের খুনিকে দেখলেও ক্ষোভের সঙ্গে সঙ্গে কোথায় যেন সান্ত্বনা মেলে। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে। অথচ তার কাছে যেতে পারছি না। মা চাইলেই ভেতরে নিতে পারেন। ব্রত পালনের চেয়েও নিভৃতে তা উপেক্ষা করে চলেছেন। বাড়ির গেটের ফুটপাতে বসা আদতে মায়ের কাছে থাকা, আবার দূরেও থাকা। এটা এক আজব অবস্থা। তিনি হয়তো এটাই চান।
মধ্যদুপুরের ক্লান্তির ভেতর টের পেলাম বুকের বাম পাশে চিনচিনিয়ে উঠছে। হাত ছোঁয়াতেই মনে হলো, পাঁজরের একটা হাড় ভাঁজ পড়ে চোককা হয়ে উঠছে। এত বছরেও আমি তা খেয়াল করিনি ভেবে বিস্মিত হলাম। এভাবে হাড় বাড়তে থাকলে একদিন কী অবস্থা হবে! ভেবে শঙ্কা হচ্ছিল। কোনো ওজর ছাড়াই বুকের বাম পাশে হাত বোলানো আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তখনো শ্রমিক গোছের মানুষগুলো ফিরে যেত। বাড়ি ফিরে দেখতাম মায়ের জাঁতার চারপাশে প্রায় স্তূপ হয়ে মিহি আটা পড়ে আছে। দিনের পর দিন এই যে মা গম পেষেন, কিন্তু ঘরের কোথাও আটার সংরক্ষণ পর্যন্ত ছিল না।
উড়িলালকে ভুলে ভবিষ্যৎ দুর্ভোগের কথা চিন্তায় দিন পার করে দিচ্ছিলাম। হেমন্তের এক ঝলমলে সকাল জানান দিয়ে গেল উড়িলাল হারিয়ে যাওয়ার ঠিক এক বছর পূরণ হতে যাচ্ছে। এই দিনে বাড়ি থেকে বেরিয়েই পশ্চিমের গড়গড় শব্দ শুনতে পেলাম। আমি খেয়াল করেছি, এর আগে তিন-চার বছর পর গাড়িটা এসেছিল। এবার এল ঠিক দুই বছর পর। গাড়ির গতিটা কম ছিল। ভেতরের লোকটার ঝাঁকড়া চুলে সাদার আধিক্য বোঝা যায়। লোকটা প্রিজনের নেটে মুখ ঠেকিয়ে চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করছেন। তারপর বিচলিত হয়ে নেটের ভেতর দিয়ে আরেকটা চিরকুট ভাসিয়ে দিলেন। তখন মনে পড়ল, এর আগে তিনি লক্ষ করতে বলেছিলেন। আমি কাঁপা হাতে চিরকুট তুলে নিলাম। পেন্সিল ঘষে তাতে লেখা, ‘হে তরুণ, জিজ্ঞেস করো।’ নিঃশব্দে হাতটা নামিয়ে এনে তার দিকে তাকালাম। করুণ দেখাচ্ছিল তাকে। তিনি হয়তো আমাকে কিছু শেখাতে চান, কিন্তু আমি তা বুঝতে একেবারেই অপারগ। তার চেয়ে বড় কথা, কার কাছে জিজ্ঞাস করব? কী জিজ্ঞেস করব? ভেবে পাচ্ছিলাম না। গাড়িটা পেরিয়ে যাওয়ার পর গেট ঠেলে মা বেরিয়ে এলেন। তিনি বেরিয়ে এলে বুঝতে পারি, আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। সকালে আসার বিষয়টাও তাই। চৌকো দিয়ে একটা সরু আলো মুখের ওপর পড়ে ঘুম ভেঙে যায়। উড়িলাল হারিয়ে যাওয়ার এক বছরেও মা এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি। কেমন একটা প্রতিজ্ঞা পূরণের ব্যাপার ছিল। মেঝেতে শুয়ে চিরকুটা বের করলাম। আমি জানি তাতে লেখা আছে—হে তরুণ, জিজ্ঞেস করো।
উড়িলালের চিন্তায় আমার একটুও ঘুম হলো না। শুধু মনে পড়ছিল, লোকটা চিরকুটে লক্ষ করা জন্য বলেছিলেন। গভীর রাতে মাঝের দেয়ালে জোরে একটা আঘাতের শব্দ পেলাম। পাশের রুমের ভেতর থেকে একটা শব্দ। হেমন্তের রাতে চাঁদের ঝাপসা আলো আসছিল চৌকো জানালা দিয়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম, মা বুঝি পাশের রুমে তৈজসপত্র গোছাচ্ছেন। কিন্তু মাথা উঁচু করতেই দেখলাম মা চৌকিতে ঘুমাচ্ছেন। তখনই সন্দেহটা চাড়া দিয়ে উঠল। বয়সের তুলনায় ভারী তক্তা সরানোর ঝুঁকি আর অনাগ্রহের কারণে ও রুমে কখনোই যাওয়া হয়নি। এখন সে সামর্থ্য হয়েছে। আমি দুই ইটের সমান চিপা দিয়ে গা হেলিয়ে পাশের কামরায় ঢুকতে গিয়ে টের পেলাম, বয়সের সঙ্গে শরীরের আয়তনও খানিকটা বদলেছে। এ আরেক জগৎ। বাড়ির সবচেয়ে পরিষ্কার আর গোছাল কক্ষ, তবে চিকন। এক পাশে ঘরগৃহস্থালির জিনিসপত্র, আরেক পাশে পরিচ্ছন্ন বিছানা পাতা। ঘরের উত্তর দেয়াল আমার কামরার চৌকোর সমান, কিন্তু গোল একটা জানালা। সেখান দিয়ে আসছে আলো। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই বিছানা থেকে আস্তে আস্তে একটা মাথা জেগে উঠল। খানিকটা ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। একটা বয়সী মুখ, ঘন ও কোঁকড়া চুলে ছাওয়া। শুয়ে শুয়ে কী সব টুকরো কাগজ পড়ছেন, তার আঙুলের ফাঁকে পেন্সিলের মতো কিছু একটা। শরীরের অর্ধেক ঢেকে আছে একটা মোটা চাদরে। তবুও তার সুঠাম শরীর বোঝা যায়। যেন একটা ড্রেনের চিপায় আটকে থাকা ঘড়িয়াল। চাঁদের আলোর খানিক আমার মুখেও পড়েছে। আমরা পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছি, তিনি বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছেন। ভীষণ অস্বস্তিকর। একবার জানালার দিকে তাকালাম। অতটুকু জানালা দিয়ে কোনোক্রমেই এমন একটা মানুষ প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তিনি নিশ্চয়ই আগে থেকে আমাদের ঘরে ছিলেন, কিন্তু কোনো দিনই তা জানতে পারিনি। আমি আর একটা কথাও বললাম না। একটা ঝড়ো দম ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিঃশব্দে শুয়ে পড়লাম।
চৌকো দিয়ে আসা সরু আলো মুখে পড়ার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। আঙুলে বাঁধা সুতা দেয়ালে ঝোলানো ঘুলঘুলিতে রাখা হতো। চিরকুটগুলোও সেখানে রাখি। সেখান থেকে সুতাগোছা তুলে নিয়ে নিজেই আঙুলে বাঁধলাম। মনে হয়েছিল, এটাই আমার জীবনের একমাত্র প্রত্যাশিত কাজ, অমোঘ নিয়তি। যে কারণে মা কোনো দিন এ কাজে বাধা দেননি। তবে গেট ভিড়িয়ে দেওয়া ছিল অনভিপ্রেত, কিন্তু প্রাত্যহিক। গেট দিয়ে কোনো দিন কাউকে আসতে দেখিনি। ঘরের ভেতর স্বর তুলে কথা বলেনি কেউ। এমনকি নিশ্বাসের শব্দও পাওয়া যেত না। দিনের পর দিন এই ঘরের ভেতর থাকা একধরনের পরবাস। লোকটা কত বছর ধরে ওই ঘরের ভেতর নির্বাক পরবাস যাপন করছেন ভাবলে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু লোকটা কে? এত বছর ধরে কেন ঘরের ভেতর নিজেকে এভাবে সজ্জাগত বন্দি করে রাখছে? নির্জন নাজিবউদ্দিন রোডে তার জন্য হুমকিস্বরূপ কীই-বা থাকতে পারে? এই ভাবনাগুলো ঠিকই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অনেক দিন ভেবেছি, লোকটা সম্পর্কে মাকে জিজ্ঞেস করব। পরের দিন ভোরে বারান্দায় ঝুঁকে পড়ে মায়ের জাঁতা ঘোরানো দেখে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি।
সব সময়ই শুকনো পাতায় ঢেকে থাকত নাজিবউদ্দিন রোড। শহর কর্তৃপক্ষ থেকে কখনো রাস্তা পরিষ্কার করতে দেখিনি। রাস্তায় তেমন মানুষের চলাচল না থাকায় প্রকৃতির বুনো গন্ধ লেগে থাকে। একটা স্যাঁতসেঁতে ভাব প্রথম থেকেই ছিল। কোনো কোনো রাতে এমন গন্ধ আমার শরীরেও টের পেতাম। এমন দিনে বুকের হাড় বৃদ্ধি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। চামড়ার ভেতরে বেড়ে উঠলেও বাইরে তার ছাপ পড়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেছি আঙুলে চেপে হাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। আমার মতো আর কারো বুকের হাড় উঁচু কি না দেখার ইচ্ছা করছিল। তেমন কেউ আমার কাছে নেই। পাশের কামরায় লুকানো লোকের বুকে হাত দিয়ে পরখ করার কথা মনে হয়েছিল একবার। একটা শুকনো কুঁচকানো পাতা মেলে ধরার সময়ই মনে হলো, বুকের খাঁচাও যদি একটু প্রসারিত হয়, এমনিতেই সমান হয়ে যাবে। তার পর থেকে যখন-তখন ফুটপাতের ওপর পাখির মতো দুই হাত ঝাপটাতাম, উপুড় হয়ে বুক ডন দিতাম।
রাস্তায় পাতার স্তর জমার মতো অনেক স্মৃতি ও জিজ্ঞাসা জমা হচ্ছিল মগজে। প্রচুর পাতা জমে গিয়েছিল রাস্তায়। সব ঢেকে যাওয়ার মতো। শুধু রাস্তার ওপাশে ক্ষীণ রেখা দেখে কিছু মানুষের হেঁটে যাওয়ার আন্দাজ করা যায়। তা ছাড়া বাতাসের তোড়ে শুকনো পাতাগুলো জায়গা বদল করে। গ্রীষ্মের দুপুরে প্রচণ্ড রোদে শুকনো পাতায় দাবানলের শঙ্কা হতো। সামান্য বৃষ্টি হলে পাতা ধোয়া কালচে পানি বয়ে যেত নদীর দিকে। শরীরে পুরুষালি ভাঁজগুলো ফুটে উঠছিল। বুক ডন দিয়ে কি তা প্রশমন করছি, মনে হতো কখনো। একটা লোক বছরের পর বছর পাশের রুমে থাকছে, অথচ আমি তার কিছুই জানি না। মা-ও কিছু বলেননি। গোপন বিপ্লবীদের মতো আগলে রেখেছেন।
নাজিবউদ্দিন রোডের গাছগুলোর বয়স হয়েছিল। শুকনো মরা ডালগুলো ভেঙে পড়ত। ঢেকে রাখা কঙ্কালের মতো গাছের পাতা তাকে ঢেকে ফেলত। পাতার ওপর দিয়ে, মরা ডালগুলো ভাঙতে ভাঙতে প্রিজনভ্যান একেবারে কাছে চলে আসে। ছয় মাসের মধ্যেই ভ্যানের ভেতরের লোকটার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। আমি ভ্যানের দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনি আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। কিন্তু একজন আটকা পড়া লোকের পক্ষে আমাকে দেখে খুশি হওয়ার কীই-বা থাকতে পারে। তিনি হাতের ইশারায় আমাকে থামতে বললেন। ভুলভাল বলার চেয়ে ছোট্ট চিরকুট বাড়িয়ে দিলেন। খুব কাছ থেকে চিরকুট নিতে গিয়ে আমি বিহ্বল হয়ে তাকে দেখছিলাম। প্রায় আমারই মতো চেহারা। বিশেষ করে আমার নাক-চোখ-কপাল মায় থুতনির ভাঁজটুকুও মেলানো যেতে পারে। তার চোখে থিক থিকে জল, কিন্তু মুখে স্মিত হাসির ঝিলিক। চিরকুটটা মুখের সমানে তুলে দেখি, পেন্সিলের শেষটুকু দিয়ে ঘষে লেখা—‘হে যুবক, তৈরি হও।’
উঁচু ফুটপাতে পা দুলিয়ে বসতে শুরু করেছিলাম। এখন বসলে হাঁটু মুখে যায়। কখনো পা না তুললে এখন হয়তো হাঁটু পর্যন্ত পাতায় ডুবে যেত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের হাড়ের ভাঁজ মিশে গেছে অনেকটা। বয়সের তুলনায় যুবক বলা-ই যায়। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও মা নিতে এলেন না। দরজা পর্যন্ত খুলে দেননি প্রতিদিনের মতো। ভীষণ মর্মাহত হলাম। প্রতিবার গাড়ি যাওয়ার পর মায়ের এগিয়ে আসা ছিল আমার জন্য বড় প্রাপ্তি, দিনের পর দিন বসে থাকার সান্ত্বনা। দুঃখে-কষ্টে গেটের টিনে কয়েকবার আঘাত করলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে এলেন না। আমার ভেতর ধক করে উঠল। হালকা করে গেট টান দিলাম। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে গেটটা ধীরে খুলে এল। সবচেয়ে বিস্মিত হলাম গেটে কোনো শিকল বা ছিটকিনি পর্যন্ত নেই!
হায়, দুর্ভাগ্য আমার, এত দিন ধরে আমি বাড়ির সামনে নাজিবউদ্দিন রোডে বসে আছি, বাড়িতে ফিরতে চেয়েছি, কিন্তু কোনো চেষ্টা করিনি! বরং দিন শেষে মা-ই আমাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়েছেন। আমার মতো তিনিও আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন কি না কে জানে। শুধু কষ্ট দিয়েছি তাকে! গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই বারান্দায় মায়ের গম পেষার জাঁতা দেখা যায়। চাকতি দুটি ঘিরে আছে সাদা আটার স্তূপ। কিন্তু বসার পিঁড়ি ফাঁকা পড়ে আছে। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। হাতের আটাগুলো গায়ে মেখে গেছে। নিঃশব্দে চোখ তুলে আমাকে স্বাগত জানালেন। কিন্তু এই বেলায় ঘরে থেকে বেরোতে দেখে আমার ক্ষোভ চড়ে গেল।
‘মা, লোকটা কে?’—নিজেকে সামলে নিতে নিতে বললাম। তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন। জাঁতার ছোট্ট ছিদ্রে গম দিয়ে তা আবার পিষতে লাগলেন।
‘তাহলে লোকটা ঘরে আশ্রয় দিয়েছে কেন?’
একবারের জন্যও জাঁতা ঘোরার গতি কমল না। জাঁতার ছোট্ট গর্তে নড়ি দিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে আবার ঘোরাতে লাগলেন। জাঁতার পাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়া আটার স্তূপ তার হাতের ছোঁয়ায় ভেঙে যাচ্ছে।
‘লোকটা কী এমন করেছে, তাকে এভাবে পালিয়ে বাঁচতে হবে? লোকটা কি খুনি, না বিপ্লবী?’ আমি স্বর করে বললাম।
আলতো করে চোখ তুলে আমার উত্তেজিত দাঁড়িয়ে থাকা দেখলেন। কাজ চালিয়ে গেলেন আগের মতো। দাঁত চিপে শক্ত হয়ে ওঠা চোয়াল দেখা যাচ্ছিল।
শৈশবের পর মাকে তেমন কথা বলতে শুনিনি। তবুও কথা না বলতে না বলতে তার মুখ বেঁকে যায়নি। কোনো বিকৃতি, স্থবিরতা ছিল না। তখনো তিনি পৌঢ়া হয়ে ওঠেননি।গলায় কাঠির মতো রেখাটা চাপা পড়েনি চামড়ার ভাঁজে। খর্বকায় বলে কুঁজো হওয়ার ঝুঁকি তার ছিল না। শরীর আর বয়সের তুলনায় তেজি মনোভাব তাকে কর্মঠ রেখেছে। তিনি দৃঢ় হাতে জাঁতা ঘুরিয়ে যাচ্ছেন।
‘লোকটা কি আমার বাবা?’ আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। জিজ্ঞাসার চেয়ে এতে বিদ্রোহই বেশি ছিল।
হাতের নড়ি ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনি মুখ চেপে ঘরের ভেতর গেলেন। উড়তে থাকা আঁচলের মতো পেছন থেকে শোনা যাচ্ছিল কান্নার স্বর। পেছন পেছন আমিও ঘরে গেলাম। কিন্তু আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি দ্রুতই দুই ইটের চিপা দিয়ে পাশের কামরায় ঢুকে পড়েন। এ পাশ থেকে কেবল তার কান্নার সুর শোনা যায়। অথচ এত বছরেও কান্না করতে দেখিনি, এতটাই সর্বংসহা ও দৃঢ়চেতা ছিলেন তিনি। এত দিন ঘরের লোক সম্পর্কে আমাকে কিছুই বলেননি। শুধু শিয়ালের চমকপ্রদ গল্প শুনিয়ে গেছেন একের পর এক। এসব গল্পের আড়ালে তিনি ওই লোকটার প্রসঙ্গ ঢাকা দিতে চেয়েছেন কি না, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন, তা-ও জানা হয়নি।
সারা রাত মা নিজের কামরায় ফিরলেন না। মাঝরাতে স্বগতোক্তির মতো চাপা ক্ষোভ আর অপারগতা, কী সব কথা শোনা গেল। মায়ের টুল টেনে চৌকো জানালা দিয়ে নদীর দিকে তাকালাম। তাতে নেই কোনো স্রোত। রাতের অন্ধকারে নদীর কালচে জল নতুন রূপ নিয়েছে। গুমোট আবহাওয়ায় তাতে কোনো তরঙ্গও তৈরি হচ্ছে না। দিনে দিনে পাতার তলে ঢাকা পড়ছে নদী ও পাড়। দৃষ্টিসীমা কাছে নিয়ে এলেই দেখলাম, আমাদের ঘরের পেছনের পাড়ে নৌকা ভেড়ার দাগ। অথচ এখনো এই ঘরে কোনো অতিথি আসেননি। এ পাশ-ও পাশ কয়েক টুকরো কাগজ পড়ে আছে। আমার প্রিজনভ্যানের লোকটার কথা মনে পড়ল। তিনি কে? কেনই-বা বলছেন তৈরি হতে? উত্তরটা তিনিই দিতে পারেন কেবল।
সারা রাত মা কামরায় না আসায় আমার দুঃখ বেড়ে গেল। কোনো উত্তর জানা ছিল না। পলায়নপর মনে কী এক অপরাধ বোধ করলাম। এখানে থাকা মানে মাকে ওই ছোট্ট ঘরে আটকে রাখা। রাতে চিরকুটগুলো দেখতে ঘুলঘুলিতে আঙুল দিলাম, এখানে আমি প্রতিদিনে চিরকুটগুলো রাখি। কিন্তু সেখানে নেই। সুতার গোছা পড়ে আছে।
রাতঘরে এলোমেলো ভাবনার পর মায়ের টুল ছেড়ে পায়ের ওপর ভর দিলাম। ব্যথাতুর, কিন্তু জিজ্ঞাসু মনে সকালে চুপচাপ নাজিবউদ্দিন রোডে গিয়ে বসে পড়লাম। এখানে বসে থেকেই আমি বড় হয়েছি। মা আমাকে এখানে বসিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে বসিয়ে দেওয়ার মধ্যে মায়ের কোথাও যেন দায়মুক্তি আছে। দুপুরে খুব ধীরগতিতে প্রিজনভ্যান এগিয়ে এল আমার দিকে। এতটাই ধীরগতি যে অনেক দিন ধরে এদিকে আসছে। তারপর গাড়িটা আমার সামনে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে খুলে গেল তার দরজা।
প্রিজনভ্যানের লোকটা আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল সেখান থেকে। একই পোশাকের লোক দুজন তাকে ধরে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন।
‘তোমার মা কেমন আছেন?’ আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে লোকটা জিজ্ঞেস করলেন।
‘বাবার কথা কিছু জানো?’ উত্তর দিতে দেরি করায় তিনি দরদ নিয়ে বললেন।
‘তিনি আমার মায়ের কথা জানলেন কী করে! কার কথা বলছেন?’ আমি এক ভাবনায় তলিয়ে গেলাম। যিনি আমাকে প্রতিদিন ফুটপাতে বসিয়ে দিয়ে যান, তাকেই মা বলে জানি। তিনি ছাড়া কেউ তো তাকে আমার মা বলে মনে করিয়ে দেননি! জন্মের পর যে নারী প্রথম শিশুর ঠোঁটে চুমু খায়, শিশু জানে না তিনি তার মা কি না। কেবল একটা অনুভূতি থাকে তার। মনে হয়, মা হচ্ছে মানুষজন্মের প্রথম বিভ্রম। আর বাবার কথাও মা কোনো দিন বলেননি। তবু বাবা হচ্ছে মানুষের প্রথম বিস্তৃতি।
আমার কোনো জবাব না পেয়ে তিনি বললেন—‘তুমি তৈরি তো? যেন আগে থেকে তৈরি হওয়ার কথাই ছিল।’
হ্যাঁ, এ কথা তিনি আগেই লিখেছিলেন। কিন্তু কিসের জন্য তৈরি? তবু বললাম, ‘হ্যাঁ।’
লোকটা শেষবারের মতো আমার কাছে বাড়িতে কেউ আছে কি না জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি স্রেফ মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিয়েছি। তারপর একই পোশাকের দুজন লোক আমার দুই বাহু ধরে প্রিজনভ্যানে তুললেন। শুধু বললেন, ‘এবার তোমার পালা।’
কনটেইনারের মতো আগাপাছতলা লোহায় মোড়া গরাদে তুলে দিয়ে ঘর্ঘর শব্দে গাড়ি চালু হলো। লোকটা তখন ধীরপায়ে গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। শেষবারের মতো দেখলাম বাড়ির গেট তখনো সেঁটে আছে। দেখে মনে হয়, ভেতর থেকে আটকানো। লোকটা ধীরপায়ে হেঁটে সেদিকে গেলেন। কিন্তু গেটটা বন্ধ দেখে হাতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে ফুটপাতে বসে পড়লেন। বিতৃষ্ণা আর অনীহা ভরা বলিরেখাময় মুখে গেট খোলার জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রিজনটা ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। আমি চিৎকার করে বলেও শুনবেন না—‘গেটটা বন্ধ না, একটু চেষ্টা করলেই খুলে যাবে।’ কিন্তু তখনো তিনি সেদিকে এক ধেয়ানে তাকিয়ে আছেন।
অলাত এহ্সান
মূলত গল্পকার। নিজেকে মনে করেন ‘পাঠকপর্যায়ের’ মানুষ। প্রবন্ধ ও সমালোচনা লেখেন। তার নেওয়া সাক্ষাৎকার অনেকবার নেটিজেনদের চিন্তা ও তর্কের খোরাক হয়েছে। প্রথম গল্পগ্রন্থ-ই পেয়েছে পাঠক-সমালোচকের সমাদর।
কবিতাচর্চা এখনো আছে, তবে অনিয়মিত। যা লিখতে চান, যেভাবে লিখতে চান তা কবিতায় লেখা যাচ্ছিল না বলে নিয়েছেন গল্পের আশ্রয়। বিচিত্র বিষয়ে পাঠাভ্যাস লেখাকে করেছে সীমিত ও সংহত।
জন্ম ১৯৮৭ বা তার আগে, ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার করপাড়ায়, বেড়ে ওঠা বারুয়াখালী। ঢাকা কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। ক্যাম্পাসে নেতৃত্ব দিয়েছেন বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের।
পেশা শুরু এনজিওতে অনুবাদক হিসেবে। বর্তমানে একটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত। অবসরে চর্চার বিষয় জাপানি ভাষা।
তত্ত্বের উপনিবেশমুক্ত তার গল্প। তবে বিষয়-বৈচিত্র্য, দেখার সূক্ষ্মতা, উপস্থাপনের অনির্দিষ্টতা, কৌতুক, চিন্তার স্বচ্ছতা, ভাষা ও উপস্থাপনের প্রতি অভিনিবেশ আর আবেগের প্রতি সৎ থাকা তার প্রকাশকে দিয়েছে স্বাতন্ত্র্য।
* অনভ্যাসের দিনে (গল্পগ্রন্থ), প্রথম প্রকাশ, ২০১৮
* দশকথা: বিশিষ্টজনের মুখোমুখি (সাক্ষাৎকার সংকলন), বেঙ্গল বুকস, ২০২৪