পাঁচটি কবিতা | তামিম ইয়ামীন


মহাপ্লাবন


                                 আমাকে
                           একলা
                       রেখে
                  একে
              একে
          উঠে
     গেলো
তারা

ব-দ্বীপ বেষ্টিত জলে
জলের সাহারা—

প্রলয়ের স্রোত ভাঙে যেদিকে তাকাই।

জোড়ায় জোড়ায় সব মাখলুকে দিলে তুমি ঠাঁই
আমি বন্ধ্যা চিরদিন
        বিস্তারের সম্ভাবনাহীন—
                         ভাবীকালে নয়া পৃথিবীতে
লাগবো না কোনো কাজে এই তত্ব মেনে নিতে নিতে
মহাপ্লাবনের স্রোতে ভেসে যাচ্ছি আজ।

আমাকে নেয়নি ডেকে নূহের জাহাজ।


বাসর


এমন নিশ্ছিদ্র ঘর! কেন এতো দমবন্ধ লাগে
বেহুলা তোমার বুকে মিশে থাকা মহুয়ার ঘ্রাণ
আমাকে উন্মনা করে। তবু এই নিরন্ধ্র বাসরে
সেসব ছাপিয়ে ওঠে চিতা আর শবের লোবান

আমি কি মরেছি না কি, মৃত এই দেশের নগর
নিজ হাতে নিয়তির ভাগ্য লিখে রাখেন ছুতার
কে-ই আর হতে চায় মনসার ক্রোধের কারণ
ছিদ্র পথে সাপ ঢুকে ভেঙে দেয় সোনার সংসার।

সকলি ক্ষণিক জানি, চেয়ে দেখো উনুনের আঁচে
হাড়িতে ফেনানো দুধ উথলিয়ে কিয়কাল পর
ক্রমশঃ চুপসে যায় পরতের মাঝে পড়ে থাকে
বুড়ো হওয়া মানুষের চামড়ার মতো সাদা সর।

দৈনন্দিন দীনতায় ম্লান হয় অবচয়ী সোনা
বাসন তেমন নয়, ভালো থাকে নিত্য ব্যবহারে
প্রতিবার মাজনের লেবু-রস-জারণে পেতল
আবার নতুন হয়, সেরকম তুমিও আমারে

ভাসিয়ে নাও গো প্রিয়। মৃত এই দেহের ভেতর
সঞ্চারো তোমার মুদ্রা, চেয়েছো যা ইন্দ্রের সভায়
প্রয়োজন নেই তার প্রাণহীন এই হাড় গোর
তোমার নাচের তালে ভেলাতেই ভেসে ওঠে প্রায়।

অকুল দরিয়া মাঝে গাও তুমি জাতিস্মর গান
আবার আমার যেন মনে পড়ে গর্ভিনী মায়ের
ফুলে ফেঁপে ওঠা পেট, মাঝে আমি গুটিসুটি মেরে
তোমার টানেই বুঝি পৃথিবীতে ফিরে আসি ফের।

যেন এই বেঁচে ওঠা মৃত কোনো লাশ থেকে নয়
ভেলা নয়, গর্ভজলে ভাসা সেই ভ্রুণের ভ্রমণ
থেকে পুনর্জন্ম আনো, ও বেহুলা ছিদ্র রেখে দাও
বাসরে ঢুকুক সাপ বিষ দাঁতে ঢালুক মরণ।


হারানো বিজ্ঞপ্তি


এপার ওপার নদীটার দুই
পাশে ছিল দুই গ্রাম
বলছি সে কথা কিভাবে আমরা
কোথায় কী হারালাম!

এপারের ছেলে ওপারের মেয়ে
মধ্যে স্রোতস্বিনী
দু’দেশ তো নয় পার হয়ে তারা
মিলবে না কোনোদিনই?

তাই জলচল ভাঙতে দু’জন
দু’হাতে সেলাই বোনা
ভঙ্গিতে দুই ভাগ করে পানি
নিতি চলে আনাগোনা।

একদিন এলো মিস্ত্রী রাজার
বললো সাঁতার বন্ধ
মানে, তার আর প্রয়োজনই নেই
গড়ে দিবে সেতুবন্ধ

যোগাযোগ আর অর্থনীতির
ইট বালু কংক্রিটে
ব্রিজ ওঠে গেলো যেনো বুড়ো নদী
হাঁটছেন কুঁজো পিঠে

ডানা খুইয়েছি পাখিযুগ শেষে
আর আজ এই ক্ষণ
কোথায় হারিয়ে ফেললাম নিজ
দেহের সন্তরণ!


ধৃতরাষ্ট্রের শোক


শকুনি তোমার চোখের নিশানা থেকে
হস্তিনাপুর কতদূর যায় দেখা
রাজ্য চাই না, প্রতিশোধ বড় আজ
পান্ডবদের দেমাগেই দায় টেকা

ঐশী আদেশে নেমে আসে পরাজয়
নিচে মানুষেরা শববাহকের দল
আকাশে অশনি পুড়ছে বনস্থল
দূরদৃষ্টিতে দেখছো কী সঞ্জয়?

আমার দু’চোখে দুর্যোধনের ক্রোধ
ছাড়া নেই কোনো আলো বা অন্ধকার
পিতৃদেনায় এ জীবন জেরবার
রক্তে জাগছে কবেকার প্রতিশোধ

শত পুত্রের জননী বলছি শোনো
মন বাঁধো যথা লতা তরু শাল্মলে
আসছে আমামা, দামামা বাজছে ওই
কুরুক্ষেত্রের পর্দা নামলো বলে!

বলো তো আমার চেয়ে বেশী দুর্ভাগা
কে আছে জগতে, যদিও অহংকার
বেদনাভারেও শোভনীয় নয়, কত
লোকে মরে যায় বেহুদা ও বেসুমার।

দেনার দায়েও অপমানে নেয় ফাঁস
ছেড়ে যেতে হয়, স্বদেশ সমুদ্দুর
খুদকুটো নেই, অতিথিবৃত্তি দূর
পুরুষানুক্রমে কেউ বা অন্নদাস!

আমার রয়েছে রজতচক্রযান
রাজ্যের সীমা ছড়িয়েছি বহুদূর
সুন্দরী বধু শোভিছে অন্ত:পুর
পূর্বপুরুষ সকলেই কৃতীমান

এইটুকু শুধু, জন্মের দোষে নেই
দুচোখের আলো, সেটাও আশীর্বাদ
যেহেতু আমার সইতে হবে না চোখে
শতপুত্রের মৃত্যুর অপঘাত।

একে একে সব যাবে ধর্মের নামে
জগতে নামবে শান্তি সুনিশ্চয়
এ দ্যুতসভায় তারই কি মহড়া চলে
যদিও বা পাশা উল্টালে পরাজয়!

শকুনি তোমার বাঁহাতের খেল খেলো
যুধিষ্ঠিরকে তাঁতাও জুয়ার ফাঁসে
পান্ডবগণ যায় যাক বনবাসে
চোখ রাখো শুধু কৃষ্ণ কোথায় গেলো

এছাড়া সকলে, কর্ণ ভীষ্ম আর
দ্রোণাচার্যের যতোসব কৌশল
আমাদের আছে সাথে আছে কত ছল
নরক দেখেছি যমালয় কোন ছাড়

চাইছি সকল ক্ষতির প্রত্যাহার
কেড়ে নিয়ে ভূমি ঘটিবাটি সম্বলও
পাশা খেলা নয় বাজিটা মুখ্য আজ
দ্রৌপদী ধীরে বসন তোমার খোলো


আবহমান


বিদরে বিজুলী মেঘে শ্যামসমঘনতমসার
আড়ালে কি বেলা গেলো বলো দেখি সখি বৃন্দাবনে
খরযোনী এ রজনী একাকিনী সবে কি আমার
যা কিছু জাগছে দেহে সামলিয়ে রাখি নিজ মনে

মনোবালা হেঁটে হেঁটে কোথা যাও কতো দূরে আর
আয়ানের ঘর থেকে এ রজনী পালালো কোথায়
একে তো বাঁশির সুর সাথে রাত গায় মালাহার
কার দোষে এই মতি এতো ভ্রম রাখা হলো দায়!

যেহেতু সে দেহহীন মনোলীন প্রেম তাতে গাঁথা
ছিলো কি, না কি শুধু ছলনার মায়াবী কুহক
এসব না ভেবে মন করো আজ যা যা চায় তা তা
যতই আক্ষেপ থাক খুঁজে নিও নিজের যমক

যদি চাও টেকাতে এ প্রেম আর সোনার সংসার
কিছুটা আক্ষেপ রেখো, কিছু দোষ কাউকে দেওয়ার!


তামিম ইয়ামীন

জন্ম ১৯৮৩, বিষ্ণুপুর, শেরপুর

কবিতাগ্রন্থ

প্রায় প্রেম, ঐতিহ্য, ২০২০
মিলনদহ, বৈতরণী, ২০২১
হাওয়া’র এ ঘরখানি, ঐতিহ্য, ২০২২

তামিম ইয়ামীনের কবিতা পড়তে পড়তে যেন এক লোক-কাহিনীর দেশ উন্মোচিত হয় পাঠকের মনে। নানা ছন্দে, অনুপ্রাস-চঞ্চল গতিতে আর আটপৌরে শব্দের নিবিড় বর্ণনায় তিনি সেই দেশের এক কবির রোমান্টিক হৃদয়ের আকুলতাগুলির কাব্যরূপ আমাদের সামনে তুলে ধরেন। নদী-নারী-প্রকৃতি-প্রেম-কাম-কামনার হুলুস্থুল ব্যঞ্জনার গভীরে কোথাও বিষণ্ণ বাসনার বাঁশি বেজে চলে তার কবিতায়। নর্তকীর নাচের লাস্যের সামনে স্তম্ভিত হয়ে বসে নিজেরই কবরের এপিটাফ লেখেন এই কবি।

-কামরুজ্জামান কামু

 

 

 

 

 

শেয়ার