ব্রিটিশ গ্রাফিতিশিল্পী ব্যাঙ্কসি ২০০৭ সালে প্যালেস্টাইন ভ্রমণ করেন। সে সময় বেথেলহেম শহরের দেয়ালে ছয়টি গ্রাফিতি আঁকেন তিনি। ব্যাঙ্কসির গ্রাফিতি মানে ইঙ্গিতপূর্ণ, রাজনৈতিক এবং বিদ্রুপে ভরা কিছু। এর মধ্যে একটা গ্রাফিতি এরকম : একজন করে ইসরায়লের সৈন্য ও গাধা দেখতে পাবেন আপনি। স্বাভাবিকভাবেই তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলবে না। এটা সম্ভবও নয়। কিন্তু গ্রাফিতি চাইলে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। তাই সৈন্যটিকে দেখবো, গ্রাফিতির মধ্যে গাধার পরিচয়পত্র চেক করছে।
অবশ্য এটা গ্রাফিতির চরিত্রের একটা দিক। অপরদিকে শহরটা বেথেলহেম। যিশুর শহর। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষণে রাখলে নাটকীয় জায়গাও। এখন শহরজুড়ে কিছু গ্রাফিতি দেখে বাসিন্দারা প্রথমে এটা উপদ্রব ভাবতে পারেন। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন, প্যালেস্টাইনের মানুষগুলো কী গাধা? এটা এড়িয়ে কেউ দেখতে পারেন ভিন্নদিক। শিল্পমূল্য তার একটি। কিন্তু একজন আছেন যিনি এর মধ্যে সত্যিই ভিন্ন কিছু দেখে ফেলেন।
লোকটির নাম ওয়ালিদ। ওয়ালিদ দ্য বিস্ট। একজন বডি বিল্ডার ও স্থানীয় ট্যাক্সি চালক তিনি। ব্ল্যাক মার্কেটের উদ্যোক্তাও।
ইতালিয়ান নির্মাতা মার্কো প্রোসারপিওর ডেব্যু কাজ `দ্য ম্যান হু স্টোল ব্যাঙ্কসি’ (২০১৮)। দেড় ঘণ্টার এই ডকুমেন্টারিতে গ্রাফিতিশিল্পের মিথ ব্যাঙ্কসি তো রয়েছেন, কিন্তু এর ‘দ্য ম্যান’ ওয়ালিদ দ্য বিস্টই। ডকুমেন্টারিটি বেথেলহেমের পাশাপাশি লন্ডন, লিভারপুল, প্যারিস, লস অ্যাঞ্জেলস, রোম, নিউইয়র্কের মত জায়গায় শুট করা হয়েছে। কারণ ব্যাঙ্কসির আঁকা ইসরায়েলি সৈন্য আর গাধার গ্রাফিতি দেয়াল থেকে কেটে নিয়ে নিলামে তোলেন ওয়ালিদ। এজন্য স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর সহায়তাও নেন তিনি। নিলামে উঠে আসে ছয় অংকের অর্থ। ডেনিশ একজন সংগ্রাহক কাজটি কিনে নেন। এরপর শুরু হয় ঘনঘটা। তাই শুধু ব্যাঙ্কসি নয়―এটা যেন আরো প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে উঠে আসে।
আবার এটা ইলিগ্যাল একটা প্রক্রিয়াকে লিগ্যাল করার উপায় দেখায়। একই সঙ্গে নিয়ে যায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে পশ্চিমা শিল্পের বাজারের দিকে। তৈরি হয় থ্রিলিং একটা ককটেল। অবশ্য এই দিকটির সমালোচনা রয়েছে ডকুমেন্টারিটির। তবে এটা শিল্পের কথা বলে। আর্টিস্টের কপিরাইটের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ফলে কিছুক্ষণ পরপর বোধে এসে ‘কপিরাইট’ শব্দটি টিকটক টিকটক করে। নূপুরের মত সুরক্ষা সংকেত বাজায়।
নির্মাতা মার্কো প্রোসারপিও ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এমটিভি ইতালিয়ার সঙ্গে। উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে। এরপর শর্ট ফিল্ম, বিজ্ঞাপনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। একদিন ডেব্যুর জন্য বেছে নেন ডকুমেন্টারিকে। এর একটা কারণ হতে পারে জীবনের একটা সময় ডকুমেন্টারিকে অসাধারণ কিছু হিসেবে বিবেচিত হতে দেখেছেন তিনি। তবে যে প্রত্যক্ষ ও দ্বিধাহীন ডকুমেন্টারিটি নিয়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন, তা ছিল অপ্রত্যাশিত।
২০১২ সালে প্রথমবারের মত প্যালেস্টাইনে যান প্রোসারপিও। কিছু একটা বানাতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রোসারপিওর ভাষায়, পরিকল্পনা ছাড়াই প্যালেস্টাইনে যাওয়া। তিনি ভেবেছিলেন, এটা হবে অন্যরকম কিছু। প্যালেস্টাইনের মানুষগুলো উঠে আসবে ক্যামেরায়। এরপর হঠাৎ করেই যেন গ্রাফিতির চোখে পড়ে যান তিনি। প্রোসারপিও প্রথমে বুঝতে পারেন নি, স্ট্রিট আর্ট নিয়েই হবে তার ডকুমেন্টারি। পরে সামলে নেন। তিনি শুধু জানতেন, বেথেলহেম শহরের বাসিন্দাদের শিকার করবে না তার ডকুমেন্টারি। রোদের মধ্যে দাঁড়ালে তাদের ছায়া পরবে। দেখা যাবে বিভিন্ন কৌতূহল। পরিণতির তদন্ত।
ইগি পপের ন্যারেশন ছাড়াও ‘দ্য ম্যান হু স্টোল ব্যাঙ্কসি’ বিষয়-বৈচিত্র্যে উত্তেজক। এটা বিনোদন দেয়। এর চরিত্রগুলো নির্মাতার সঙ্গে যে ভঙ্গিতে কথা বলে, তা প্রাণবন্ত। এগুলো ধারণ করে নিজস্ব মতামত। যদিও গল্পটি জটিল। আবার নির্মাতা প্রোসারপিও যেসব চরিত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের জন্য ছিল না কোনো গাইডলাইন। প্যালেস্টাইনের মানুষগুলো যাতে নিজের কথাটি বলতে পারে সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি। ফলে ওয়ালিদকে বলতে দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত ব্যাঙ্কসি কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না।