আমাদের স্ক্রিনময়ী জীবন অনর্গল ডিজি-ছবির বন্যায় চিন্ময়। এই নেটেড দর্শনের গ্লোবাল রাজত্ব শুধু আমাদের অবসরকেই শাসন করে না, কোন ছবির ঝাঁক কিভাবে ইন্টারনেট আর স্ক্রিন বেয়ে আমাদের চোখ ধাঁধায় আর মন মাতায়, তা দিয়ে গড়ে ওঠে আমাদের রোজওয়ারি গণদর্শন আর রাজনীতি। ভিসুয়ালের সেই সাইবারশাহীর নানা ঝাঁকিদর্শন নিয়েই এই কলামের নানান কিস্তি।
সেলফির আরশিনগরে
আপনি কি কখনও ফোনের মিরর বা আয়না অ্যাপ ব্যবহার করেছেন? আসল আয়নার অভাবে দাড়ি কামানো বা মেকআপ করার জন্য? শুরুর দিকে আপনার মুখ আপনি দেখে মুখে সেই মত রেজর বা বুরুশ চালাতে চালাতে মাথার মধ্যে একটা হালকা ঝিমঝিমে ভাব আসে, খানিক বাদে অভ্যেস হয়ে যায়। এ জিনিস কিন্তু আয়না দেখে হয় না। মিরর অ্যাপ মোবাইলের ক্যামেরানির্ভর । তার কাজ সেলফি তোলার ফ্রন্ট ক্যামেরা অপশনের মতই। ক্যামেরার মুখ সামনের দিকে ঘুরিয়ে সেটাকে আয়না বানিয়ে দেওয়া। কিন্তু সেই মিরর অ্যাপের মুখকে যখন মিরর-হাত ছোঁয় আর নিজের মুখকে যখন নিজের হাত ছোঁয় সেই দৃষ্টি আর স্পর্শের দুই রশিকে এক লাগামে এনে তাকে ঠিকভাবে চালনা করতে (নইলে গাল কাটবে, মেকাপ ধ্যাবড়াবে) গিয়ে আমাদের মগজের শ্রম হয়। সেই শ্রম থেকেই সাময়িক মাথা ঝিমঝিম। মানে মিরর-আমি আর আমার-আমি যে এক না, সেটা মগজ সহজেই বোঝে। কিন্তু সেলফি তোলার সময় তা কি আমরা বুঝি? নাকি বুঝেও বুঝি না?

২০১৩ তে সেলফি-অনভিজ্ঞ আমি এক সেলফিগরবিনীর বাস্তব মুখ আর সেলফি মুখমণ্ডলের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ দেখে বড়ই ব্যোমকে গেছিলাম। তখন তো জানতাম না ‘বিউটি ফিল্টার’ নামক বস্তুর কথা। এখন তা সবাই জানেন। মানুষের মুখছবির ওপর ডিজিটাল ফটো ম্যানিপুলেশন এফেক্ট লাগিয়ে আরও সুন্দর করে তোলাই এই প্রকরণের কাজ। তা সাধারণতঃ – মুখের চামড়া ফরশা করে; মুখ পালিশ করে সব দাগ, ছোপ, ঝুল তুলে দেয় ; চোখের কোণের বয়সজনিত কুঁচি মুছে দেয়; থুতনির নিচের মেদ মুছে দেয়; মুখ ডিমের আকারের করে; চোখ বড় বড় করে; ঠোঁট ফুলো ফুলো করে; নাক সরু করে; দাঁত সাদা করে, বয়েস কচি করে।
এই বিউটি ফিল্টার অ্যাপ আগে ফোনে আলাদা করে থাকতো, তাই সেটা ব্যবহার করা ব্যবহারকারীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতো। যত দিন যাচ্ছে, সেলফির জনপ্রিয়তার সাথে সাথে ফোন ক্যামেরার সেলফি মোড চালু করলেই নানা রকম বিউটি ফিল্টার আপসেই চালু হয়ে যায়। তাছাড়াও এরা নানা সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিও রেকর্ডিং ক্রিয়ার অংশ। এবং সেগুলো কিভাবে আপনার ছব্বা সুন্দর করে তুলবে সে নিয়ে আপনার কিছু করার নেই। চীনের চালাকফোনের বিশ্বব্যাপী বাজারবৃদ্ধির সাথে সাথে এই ট্রেন্ড আরও বেড়েছে। ভার্জ ম্যাগাজিনে স্যাম বাইফোর্ড লেখেন : “ছবি তোলার কথা বললে, চীনা ফোন ক্যামেরাগুলি তাদের মারকাটারি ইমেজ প্রক্রিয়াকরণের জন্যও পরিচিত হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে সেলফির ব্যাপারে। এই ফোনগুলির মধ্যে অনেকগুলি মুখকে উজ্জ্বল এবং ত্বককে মসৃণ করার কৌশল প্রয়োগ করে। আমি Xiaomi-এর Wang Qian (MIUI-এর ফটো সফ্টওয়্যারে কাজ করেন) -কে জিজ্ঞাসা করলাম এ ব্যাপারে তাঁর কোম্পানি চীনের বাইরের ব্যবহারকারীদের কথা কতটা বিবেচনা করে। “মনস্তাত্ত্বিকভাবে, চীনা ব্যবহারকারীরা নিজেদের দুধে-আলতায় ফর্সা দেখতে চায়, তবে আমরা বুঝি যে এশিয়ান দেশগুলির বাইরে, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের (ভারতকে ওনারা এশিয়ান দেশ ভাবেন না – লেখক) ব্যবহারকারীরা নিজেদের চামড়ার রং এতটা বদলাতে চায় না। অবশ্যই, আমাদের প্রথম পদক্ষেপ চীন এবং এশিয়ান ব্যবহারকারীদের উপর ফোকাস করা। তারপরে আমরা অন্যান্য অঞ্চলে এই পরিবর্তনগুলির বাস্তবায়ন করব। আমরা ইতিমধ্যে ইউরোপ বা মার্কিন ব্যবহারকারীদের পোশাক, ত্বকের টোন এবং অন্যান্য দিকগুলি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছি৷”
চিত্র ২,৩: সেলফিসুন্দর ও সেলফিসুন্দরী
আর এই বিউটি ফিল্টারের আগুনে যদি এ আই-র ইন্ধন পড়ে? ফোর্বস ম্যাগাজিনে বার্নার্ড মাড় লেখেন:
“(এ আই) প্রথমে মুখের বৈশিষ্ট্যগুলি সনাক্ত করতে এবং ম্যাপ করতে মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম এবং কম্পিউটার ভিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তারপর ত্বক, কনট্যুর, মুখের আকৃতি, চোখ এবং ঠোঁট বদলে তাতে ভার্চুয়াল মেকআপ দেয়। সেলফির উপর ডিজিটালভাবে তৈরি করা নানা স্তর চাপায়। কিছু উন্নত ফিল্টার পেশাদারী ফটোগ্রাফির বিভ্রম তৈরি করে আলো এবং রঙের ভারসাম্য সুচতুর ভাবে বদলে৷ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার কাজ শেখে সেলফির বিশাল ডেটাসেট থেকে। বিভিন্ন মুখের আকার, ত্বকের টোন এবং মুখের অভিব্যক্তি তার চেনা আর কিভাবে তাকে ‘সুন্দর’ করে তুলতে হবে তাও তার পাখিপড়া – ফলে তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয় এক প্রায়-আসল-নকল মুখ, যা আড়াল করে আর ভুলিয়ে দেয় সব কৃত্রিম কারিগরি৷ টিকটক-এর ‘বোল্ড গ্ল্যামার’ ফিল্টারটি যেমন “বিপজ্জনকভাবে বাস্তবসম্মত”।
মুখের ছবিকে মেকাপ, আলো, ফোটোগ্রাফি আর কম্পিউটার টেকনোলজির নানা কারিকুরিতে অলোকসুন্দর করে তোলা নতুন কিছু না। কিন্তু তার খরচা আর পদ্ধতি সাধারণ মানুষের দৈনিক খরচ আর জানকারি সীমার বেশ বাইরে ছিলো। কিন্তু এখন সেই অদৃশ্য সৌন্দর্য-মুখোশ অহোরাত্র মুখে চাপানোর আর তৎসংক্রান্ত মানসিক বিকারে অধিকার এখন সবার। শুধু সৌন্দর্য-বেসাতি-পেশাদারদের নয়।
ঠিক কিভাবে কাজ করে ‘বোল্ড গ্ল্যামার’ বিউটি ফিল্টার? দি ভার্জ ম্যাগাজিনের এক প্রবন্ধ এটা বোঝানোর জন্য লুক হার্ডের লেখা থেকে একটা চমৎকার উপমা ধার করে – দুটি শক্তির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, ক্যামেরা ফোটোকে ফোটোর মত রাখার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আর এ আই তার মুখ চিপে ধরে এক আদর্শ সুন্দর মুখোশ সেঁটে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যদি একে সিনেমার ফাইট সিনের মতো করে দেখানো যেত তা’হলে তা বেশ কয়েক মিনিট ধরে দেখাতে হ’ত। কিন্তু এখানে তা প্রায়-অদৃশ্য, আপাত-অহিংস ভাবে এক পলকে ঘটে যায়।
কিন্তু এই ‘আদর্শ সুন্দর’ কেমন? তা সব সময় নবযৌবনময় তা ঠিক, কিন্তু দেশে দেশে তার মধ্যে ফারাক আছে – এশিয়ায় দুধে-আলতা ফর্সা থাকা কঠিন আর খরচসাপেক্ষ তাই তার কদর, ইউরোপে তামাটে ট্যান হওয়া ঠিক তাই, কারণ একই। দু-ভাঁজ চোখের পাতা চিনেদের কাছে সুন্দর কিন্তু ভারতীয়দের কাছে নয়। কিন্তু সেটা ছাড়াও মুখের সরু-চওড়া, চোখের ছোট-বড়, ঠোঁটের ফুলো-চুপসো, মুখের সলাজ-নিলাজ ভাবের নিক্তি দেশে-দেশে দিশি-দিশি আলাদা আলাদা ভাবে মাপা হয়। সেখানেও ব্যাপারটা ঠিক যার-যার-তার-তার থাকে না। লি সিব্রুক-সাক্লিং এশিয়া মিডিয়া সেন্টারের একটি প্রতিবেদনে তলিয়ে দেখান যে এশিয়ার ত্বকচর্চা আর প্লাস্টিক সার্জারির পীঠস্থান কোরিয়ার ‘আদর্শ-সুন্দরের’ সংজ্ঞা কিভাবে গিলে খাচ্ছে চীন, জাপান বা ফিলিপিন্সের স্থানীয় ‘আদর্শ সুন্দরের’ সংজ্ঞাকে। তাই ব্যাপারটা ঠিক প্রযুক্তির বদতিমিজি বা এ আই-য়ের বদমাইসিতে থেমে থাকে না। কারণ সেই ফিল্টারের ডিজাইন বা সেই এ আই এলগোরিদমের ট্রেনিং ডেটাসেট আসে ফ্যাশন, ত্বকচর্চা আর মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির হাত হয়ে। তা আকাশ থেকে পড়ে না।
চীনা পুরুষ আর নারীদের ‘আদর্শ সুন্দরের’ তুলনাত্বক সংজ্ঞা নিয়ে দুটি ইউটিউব ভিডিও (লিঙ্ক নিচে) পরপর দেখে পথচলতি মানুষের মুখে আদর্শ সুন্দরীদের নিখুঁত সংজ্ঞা (ওজন কত কেজির মধ্যে আর উচ্চতা ঠিক কত ফুটের মধ্যে হতে হবে) শুনে বুক কেঁপে ওঠে। পরে নানা অন্য জাতির রূপের প্রতি পথচলতি মানুষের আকর্ষণের কথা শুনে প্রাণে একটু জল এলেও সেই জল বেশিদূর গড়ায় না। নানা জাতির সেই মুখগুলোও এ আই আর্টের আঁকা। একই অঙ্গের নানা রূপ। যেন একই লোক মেকাপ নিয়ে কসট্যুম পরে নানা-জাতি-নানা-পরিধানধারী হয়েছে। ব্যাপারটা বিবিধ নয়, মিলনটাও নয় মহান।
আরও পড়তে চাইলে:
https://en.wikipedia.org/wiki/Beauty_filter
https://www.theverge.com/2018/10/17/17988564/chinese-phone-software-android-iphone-copy-ui
https://www.forbes.com/sites/bernardmarr/2023/06/09/picture-perfect-the-hidden-consequences-of-ai-beauty-filters/
https://www.theverge.com/2023/3/2/23621751/bold-glamour-tiktok-face-filter-beauty-ai-ar-body-dismorphia
https://www.amc.org.nz/features/korean-beauty-ideals-have-changed-the-asian-standard/
https://www.youtube.com/watch?v=YYYZychM5Ds
https://www.youtube.com/watch?v=XoYK21SMgrQ

সৌরভ রায়
লেখক, সম্পাদক, অনুবাদক ও চিত্রগবেষক
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের LGBTIQ+-সংক্রান্ত অনলাইন ভিসুয়াল কন্টেন্ট নিয়ে গবেষণা করছেন।