“গুড মর্নিং!”, রুবাঈ এসে বসে ইন্দিরার পাশে।
“গুড মর্নিং”, অল্প হাসে ইন্দিরা।
“পেলে?”
“কি?”
“ডোমেন?”
“মানে?”
“মানে আমরা কে কোন বিষয়ে ট্রেনিং পাবো সেটা আজকে ঠিক করা হচ্ছে”
“তুমি পেয়েছো?”
“না, মেইল আসবে একটা, ওতেই লেখা থাকবে”
“কি ভাবে ডোমেন ঠিক করছে এরা?”
“কে জানে, যারা পেয়েছে তারা কেউই বলতে পারল না”
“আচ্ছা, ডোমেন ঠিক হয়ে গেলে তারপর ট্রেনিং শুরু হবে?”
“হ্যাঁ সম্ভবত, মেইলে লোকেশান লেখা থাকবে”
ট্রেনার ঘরে ঢুকলে সবাই একসাথে গুড মর্নিং বলে ওঠে। প্রতিদিনের মত সবার পরিচয় জ্ঞাপন পর্ব শেষ হলে ট্রেনার ইংলিশে বলে ওঠেন, “আজ আমরা একটা খেলা খেলবো, যা আমাদের মধ্যে যোগাযোগটা আরো দৃঢ় করে তুলবে, তোমরা সবাই উঠে পরপর লাইন করে দাঁড়াও”
বাকীদের দেখাদেখি ইন্দিরাও লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। ট্রেনার এক, দুই, তিন করে ভাগ করে দিয়ে তিন জনের একেকটা দল তৈরি করেন। তারপর বলেন, “প্রতি তিনজনের দলে প্রথম জন আর তৃতীয় জন পরষ্পরের হাত ধরে দাঁড়াও, এমনভাবে যাতে চারহাত মিলে গেলে মাথার উপরে একটা ^ তৈরী হয়। এবার দ্বিতীয় জন সেই ^ এর নীচে এসে দাঁড়াও।”
প্রতিটা দল এইভাবে দাঁড়িয়ে পড়লে ট্রেনার আবার বলতে শুরু করেন, “এই যে ^, এটা হল একটা বাড়ি, আর তার নীচে যে দাঁড়ালে, সে হচ্ছ বাড়ির বাসিন্দা। এবার আমি স্টার্ট বললে প্রতিটা বাড়ি থেকে বাসিন্দারা বেরিয়ে আসবে, এসে ঘরের মধ্যে এমনিই হাঁটবে, আমি যখন ফিনিশ বলব তখন প্রতি বাসিন্দাকে যেকোনো একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে যেতে হবে। এক বাড়িতে একের বেশি বাসিন্দা থাকলে চলবে না, আবার কোনো বাড়ি খালি থাকলেও চলবে না।”
দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে বাকীদের মত ইন্দিরা প্রস্তুত হয়। সবাই প্রস্তুত হলে ট্রেনার বলে ওঠেন, “স্টার্ট!”
জনা পঞ্চাশ ছেলে মেয়ে বেরিয়ে এসে ট্রেনিং রুমের বিভিন্ন দিকে চলতে শুরু করে। ইন্দিরাও তার ‘বাড়ি’ ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ইন্দিরার পাশ দিয়ে নিজের মত হেঁটে যাচ্ছে বিভিন্ন মানুষ। ইন্দিরা বুঝে পায়না কোন দিকে এগোবে, অথচ থেমে থাকলেও চলবে না। কতক্ষণ এরকম চলতে হবে ইন্দিরা ভেবে পায় না। অদ্ভুত অসহায় লাগে তার। দূরে দূরে দেওয়াল ঘেঁষে খালি ‘বাড়ি’গুলো দাঁড়িয়ে আছে। অথচ তার ভিতরে ঢুকে পড়া যাচ্ছে না। এও অসহায়তার এক কারণ। আরেক কারণ হল সময়ের অনিশ্চয়তা। এই যে এলোমেলো হেঁটে চলা, এ অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে, যদি না ট্রেনার থামতে বলেন। ইন্দিরা আড়চোখে ট্রেনারের দিকে তাকায়। মহিলাকে সর্বশক্তিমানের মত দেখাচ্ছে। হঠাৎ ট্রেনার বলে ওঠেন, “ফিনিশ!”
হেঁটে ফেরা দলের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। কে আগে ঘর পাবে সেই উদ্দেশ্যে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। ইন্দিরা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঘরের এক কোণায়। সবাই প্রায় ‘বাড়ি’ পেয়ে গিয়েছে এমন সময় হঠাৎ কে যেন টেনে নেয় ইন্দিরাকে। সে দেখে একটা ‘বাড়ি’র মধ্যে এসে পড়েছে সে। তাকে টেনে এনেছে মোবাইল ভেঙে ফেলা সেই মেয়েটা। ইন্দিরা অবাক হয়ে তাকায় মেয়েটার দিকে। মেয়েটার চোখ তখন ট্রেনারের উপর।
ট্রেনার বললেন, “কি শিখলাম আমরা এর থেকে?”
কেউ কেউ হাত তোলে বলার জন্য, কিন্তু ট্রেনার বলে চলেন, “সব কিছুই ঠিক ছিল যতক্ষণ না আমি ফিনিশ বললাম। তোমরা সবাই চুপচাপ হাঁটছিলে, কিন্তু যেই সময় শেষ হয়ে এল, সবাই ছুটলে বাড়ির খোঁজে, নিরাপত্তার খোঁজে। অর্থাৎ আমরা সবাই দিনের শেষে নিরাপত্তার পিছনে ছুটি। এই যে হেঁটে চলা পুরোটাই অনির্দিষ্ট। আর কেউ অনির্দিষ্টকে পছন্দ করে না। তোমরা সবাই তাই অপেক্ষা করছিলে আমি কখন ফিনিশ বলি। ফিনিশ বলতেই একটা অস্থিরতা এসে পড়ল তোমাদের মধ্যে। কেন এল? যতজন বাসিন্দা, ততগুলো বাড়ি আছে জেনেও! কারণ তোমরা কেউই অনিশ্চয়তা সহ্য করতে পারছিলে না, তোমাদের মনে হয়েছিল, ‘বাড়ি’ পৌঁছাতে পারবে কি না! সেই সন্দেহই তোমাদের ছুটিয়ে বেরোল। অর্থাৎ অনিশ্চয়তা থেকে সন্দেহ আসে নিজের ক্রিয়াকর্মে, জীবনধারণেও। আমাদের সংস্থা তোমাদের শুধুমাত্র নিশ্চয়তাই দেবে না, সাথে সাথে দেবে নিরাপত্তাও…”
সবাই নিজের জায়গায় এসে বসলে ট্রেনার সংস্থার দেড়শো বছরের ইতিহাস সম্পর্কে বলতে শুরু করেন। ইন্দিরার পাশে এসে বসেছে রুবাঈ। রুবাঈয়ের কিছু পরেই বসে আছে মোবাইল ভেঙে ফেলা মেয়েটা। ইন্দিরা আড়চোখে দেখে তাকে। মেয়েটা মন দিয়ে ট্রেনারের কথা শুনছে।
“ওর নাম আনন্দী”, রুবাঈ বলে ওঠে।
“আনন্দী?”
“যাকে দেখছো তুমি এখন”
“ও,আচ্ছা,”
“পশ্চিমভারতের মেয়ে”
“তুমি জানলে কি করে?”
“ইন্ট্রোডাশনের সময়ই তো বলল, কালও যেমন বলেছিল, তুমি শোনোনি?”
“খেয়াল করিনি”
রুবাঈ অবাক চোখে ইন্দিরার দিকে তাকায়। নিজের ডেস্কটপের দিকে ফিরতে ইন্দিরা খেয়াল করে একটা মেইল এসেছে। মেইল খোলার পর সে জানতে পারে তার ডোমেন।
ইন্দিরার মেইল দেখে রুবাঈ হেসে বলে, “আমারও একটু আগেই এসেছে,- একই।”
হাসি ফুটে ওঠে ইন্দিরার মুখে।
ছোট একটা বিরতি পাওয়া গেলে ইন্দিরা বাকীদের থেকে দূরে সরে এসে মোবাইল বের করে। ইনবক্স শূন্য, হোয়াটস অ্যাপে কোনো নোটিফিকেশান নেই। থাকার কথাও না। এই সব না থাকার মধ্যেই কোথাও হয়ত রঞ্জনা আছে, থেকে গেছে।
ইন্দিরা বাড়ির নম্বর ডায়াল করে,
“হ্যালো” জ্যেঠুর গলা শুনতে পায় সে,
“আমি বলছি, জয়তী কেমন আছে এখন?”
“আগের চেয়ে ভালো, তুই জানলি কি করে? তোর বাবা বলেছিল তোকে না জানাতে…”
“কাল রাতে ফোন করেছিলাম, দাদা বলল”
“পিকু!ও জানে!?”
“কেন?”
“তুই যাওয়ার পর সেই একদিনই রাতে দরজা খুলে খাবার খেয়েছিল, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি দরজা খোলানোর। কাল যখন এইসব হল, ডাক্তার এল, চিৎকার চেঁচামেচি… ও তো তখনও দরজা খোলেনি!”
“সে কি! খাওয়া দাওয়া করছে তো ও?”
“হ্যাঁ, বিন্তি দরজার বাইরে খাবারের থালা রেখে গেলে এক সময় নিয়ে নিচ্ছে”
“হুম”
“তুই এসব নিয়ে চিন্তা করিস না, আমরা ঠিকই আছি, এরকমই তো চলছে সেই থেকে। ভাবিস না, হ্যাঁ? তোর ওখানে সব কেমন এখন?”
“ভালোই, কাল থেকে ট্রেনিং শুরু”
“আচ্ছা, মন দিয়ে সব শিখে নিস, হ্যাঁ?”
“জ্যেঠু,… বাবা ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, এই বাড়িতে আমরা দুটো প্রাণীই একমাত্র ঠিক আছি, থাকতে হয়, বুঝলি… না হলে চলে না” জ্যেঠুর গলায় হাসির রেশ টের পায় ইন্দিরা।
“আচ্ছা, জয়তী কেমন থাকে জানিও আমায়। আমি রাখি এখন”
নিজের জায়গায় ফিরে আসে ইন্দিরা।
তার পাশে রুবাঈ তখন এক বাটি লেমন রাইস খুলে বসেছে। এক চামচ ইন্দিরার দিকে এগিয়ে রুবাঈ বলে, “তোমার ভিতরটা হঠাৎ কেমন খালি খালি দেখাচ্ছে… সব ঠিক আছে তো?”
সব…? ইন্দিরা ভাবে, তারপর হেসে উঠে বলে, “কাল যে তুমি বলেছিলে, শুধু আমিই একা মানুষের ভিতরটা খুঁজে ফেলতে চাই?”
রুবাঈ বাসে উঠে পড়লে ইন্দিরা হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করে। আজ চকচকে রোদের বদলে আকাশ ভরে আছে মেঘে। হাঁটতে হাঁটতেই চোখ বোজে ইন্দিরা। বুক ভরে শ্বাস নেয়,… বৃষ্টি। গন্ধটা কোলকাতার মতই। চোখ খুলতে হঠাৎ করে তার সামনে দিগন্ত জুড়ে জেগে ওঠে হাওড়া ব্রীজ। ফুটপাথে থমকে দাঁড়িয়ে যায় ইন্দিরা, নাহ্ মনের ভুল। হাওড়া ব্রীজ নয়, কারেন্টের তার চলে গিয়েছে রাস্তার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে। ইন্দিরা হাঁটতে শুরু করলে তার কপালের ওপর এক ফোঁটা বৃষ্টি এসে পড়ে। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ইন্দিরা বলে, বছরের প্রথম বৃষ্টি। পকেটে খচখচ করে ওঠে মোবাইল, অন্য কোনো বৃষ্টিদিনের কথা মনে পড়েছে যেন তার। ইন্দিরা তবু হেঁটে চলে। হোটেলের কাছে পৌঁছোতে সে খেয়াল করে, তার আগে আগে হেঁটে যাচ্ছে মোবাইল ভেঙে ফেলা মেয়েটা… “না,… আনন্দী,- ওর নাম আনন্দী।” মনে মনে বলে ইন্দিরা। হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে সে আনন্দীর চলে যাওয়া দেখে। অন্য কোনো এক গলিতে মেয়েটা ঢুকে পড়লে ইন্দিরাও হোটেলে ঢুকে আসে। বাইরে তখন বৃষ্টি নেমে এসেছে।
শান্ত একটা চোখ। তাতে কাজল লাগানো নেই, সুরমাও পরানো নেই, সাদামাটা অথচ শান্ত তীক্ষ্ণ একটা চোখ তাকিয়ে আছে ইন্দিরার দিকে। খুবই চেনা যেন… পলক পড়ছে না, জল ঝরছে না। বড় বড় চোখের পাতা মেলে শুধু শান্তভাবে চেয়ে আছে ইন্দিরার দিকে। ইন্দিরার অস্বস্তি হয়, সে চোখ সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে,- পারে না। চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করে,- পারে না। ছটফট করতে করতে, ছটফট করতে করতে একসময় তার ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়েই ইন্দিরার মনে হয়, শান্ত- সাদামাটা ওই চোখটা সে কোথায় যেন দেখেছে। ফোন বেজে উঠলে তার ঘোর কাটে, অজানা একটা নম্বর,-
“হ্যালো”
“হাই, রুবাঈ বলছি, ফ্রি আছো?”
“হুম, কেন?”
“আমি তোমার হোটেলের নিচে দাঁড়িয়ে, একটু হেঁটে আসি চলো”
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে বাইরে। রাস্তায় গোলাপি ফুলের শবযাত্রা। ফুল বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে হেঁটে চলে ইন্দিরা। পাশে চুপচাপ হাঁটছে রুবাঈ।
“তুমি এখানে কেন এসেছ বললে না,”
রুবাঈ অল্প হাসে, “বছরের প্রথম বৃষ্টি, ইট নিডস্ টু বি সেলিব্রেটেড”
“কিভাবে?”
“জাস্ট এক্সপেরিয়েন্স করে”
“মানে?”
“তুমি জীবন উৎযাপন করো কি করে?”
“উৎযাপন করি না, অতিবাহিত করি”
“আচ্ছা, কিন্তু যারা করে, তারা কিভাবে করে? জীবনটাকে অনুভব করে, উপভোগ করে করে। সেইভাবেই বৃষ্টি, রোদ, ঝর, তুষারপাত, সবই অনুভব করে উৎযাপন করতে হয়”
“আর কেউ যদি অনুভব করতে না চায়?”
রুবাঈ ইন্দিরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তবে বেঁচে থেকে লাভ কি?”
ইন্দিরা দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তায়, রুবাঈ ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, গোলাপি ফুলের শবের উপর দিয়ে। একটু আগে ঘুমের মধ্যে দেখা চোখটা কি রুবাঈয়ের? ইন্দিরা মেলাতে পারে না। ফুল বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রুবাঈয়ের দিকে এগিয়ে যায় সে।
“রুবাঈ, তুমি আমার ফোন নাম্বার পেলে কি করে?”
“তোমার অফিসিয়াল মেইল আইডির সাথেই লেখা আছে, মানে আমাদের সবারই তাই”
“আচ্ছা”
হঠাৎ কি দেখে রুবাঈ দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তায়, ইন্দিরা দেখে সামনের গলি থেকে আনন্দী বেরিয়ে আসছে।
“আমি জানতাম না ও তোমার হোটেলের কাছেই থাকে”
“আমিও আজকেই জানলাম”
“চলো কথা বলি ওর সাথে,”
ইন্দিরা বলে, “না, আজ থাক”
“কেন?”
“আজ প্রথম বৃষ্টির দিন”
“তাতে কি হয়েছে?”
“আজ কথা বলার দিন নয়, অনুভব করার দিন”
ইন্দিরা আর রুবাঈকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় আনন্দী। ইন্দিরা কিছুক্ষণ তার চলে যাওয়া দেখে।
রুবাঈ বলে, “চলে যেতে দেখার মধ্যেও একটা মাদকতা আছে, না?”
“হুম?”
“এই যেমন ফুল ঝরে যাওয়া, বৃষ্টি শেষে গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়া জল, এই শেষ হয়ে আসার মধ্যেও তো নেশা আছে…”, বলে রুবাঈ রাস্তা থেকে একটা ভেজা গোলাপি ফুল তুলে দেয় ইন্দিরার হাতে, “জানো এই সময়ের আশেপাশেই জাপানে চেরি ব্লসম হয়, এই ফুল ফোটার সময় ওরা উৎসব করে, ফুলের বেঁচে থাকাটুকু অনুভব করবে বলে। অথচ আমাদের দেখ…”
ইন্দিরা হাতের পাতায় শুয়ে থাকা ভেজা, মৃত গোলাপি ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রুবাঈ চলে গেলে ঘরে এসে ইন্দিরা খাতা পেন নিয়ে টেবিলে এসে বসে,
“জয়তী,
জানিনা কিভাবে তুমি গোলাপি ফুলের কথা জানলে, কিন্তু এখন সত্যিই রাস্তা ছেয়ে আছে গোলাপি ফুলে। আজ বছরের প্রথম বৃষ্টি হল হাওয়া শহরে। অথচ তুমি,- দেখ কেমন পালিয়ে যেতে চাইছ আবার। পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে কিসের আনন্দ পাও তুমি, যে বারবার চেষ্টা কর পালিয়ে যেতে! বরং ফিরে এসো, এসে বসো আমার হোটেলের জানালার ধারে, দেখো কিভাবে ফুলেরা ঝরে যায়। দেখো কিভাবে রাস্তার ওপর শুয়ে পড়ে, ঘুমিয়ে পড়ে ফুলগুলো।
রুবাঈ নামে আমার এক বন্ধু হয়েছে এখানে। সে আজকে আমায় অনুভব করতে শেখাচ্ছিল। বৃষ্টি, হাওয়া, জীবন। একদিন তোমায় রুবাঈয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দেবো। ততদিন না হয় অপেক্ষায় থেকো, জেগে থেকো, ভালো থেকো… থেকো।
ইতি,
ইন্দিরা।”
চিঠির খামের মধ্যে ভেজা গোলাপি ফুল ভরে দেয় ইন্দিরা, কাল অফিসে যাওয়ার পথে চিঠিটা পোস্ট করে দিতে হবে।
মঞ্জুনাথ উঁকি দিয়ে দেখে ইন্দিরা কাগজের ঠিক জায়াগায় সই করছে কি না। সই করা হলে কাগজটা তাকে ফেরত দিয়ে ইন্দিরা অল্প হাসে। মঞ্জুনাথ তার ট্রলিটা তুলে ঘরে নিয়ে আসে। কাঁধ আর পিঠের ব্যাগ নিয়ে ইন্দিরা তার পিছু পিছু ঘরে ঢোকে। এই কদিনে ঘর রঙ করে পরিষ্কার করা হয়ে গেছে। উজ্জ্বল রোদে চকচক করছে সারা ঘর। সাদা দেওয়াল ঘেঁষে আছে একক বিছানা, তার পাশে জামা কাপড়ের ছোট আলমারি। ঘরে একটাই বড় জানালা, সেই জানালা দিয়ে যতটা সম্ভব আলো আসতে পারে, আসছে। জানালার পাশে একটা ছোট টেবিল, কাঠের, পুরোনো। টেবিলের সামনে একটা হাতলবিহীন চেয়ার। নির্বাসনে ঠিক যেমন প্রয়োজন সবই আছে ঘরটায়।
মঞ্জুনাথ ইন্দিরার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে, “গ্যাস সিলিন্ডার, রান্নার লোক, কাজের লোক, হোম ডেলিভারি সবের নম্বর আছে এখানে। আর কোনো অসুবিধা হলে আমায় জানাবেন। আপনার রুমমেট জানিয়েছেন রাতের দিকে আসবেন, তাঁকে ঘরে পৌঁছে দিতে আমি আবার আসবো। এখন আসি তাহলে?”
মঞ্জুনাথ চলে যেতে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ইন্দিরা হলের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। এই এতখানি, আপাতত তার, নিজের। ‘নিজের’ শব্দটার ওপর বার কয়েক জিভ বোলায় ইন্দিরা। সংশয় হয়। সংশয় নিয়ে ইন্দিরা ঘরে আসে। ব্যাগ খোলে। কিছু বই সমেত রবীন্দ্রনাথ চলে যান টেবিলে। অল্প কিছু জামাকাপড় আলমারিতে ভরে ফেললে আরো অনেকটা জায়গা খালি থেকে যায়। খালি, ‘খালি’ শব্দটা নিয়ে কোনো অস্বস্তি নেই ইন্দিরার, এই একটা শব্দের সাথে সে স্বচ্ছন্দ্য। তাই নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে তোলার পর সে পাশের খালি ঘরটায় এসে দাঁড়ায়। আজ তারই মত একজন এই ঘরে আসবে। সে মানুষটার গল্প, সে মানুষটার কথা, সে মানুষটার ছোঁয়াচ, সব আলাদা। কি অদ্ভুত সম্ভাবনার মধ্যে ডুবে আছে এই ডানদিকের ঘরটা। মানুষটা এসে গেলে, এসে থাকতে শুরু করে দিলে আস্তে আস্তে সম্ভাবনাগুলো মরে মরে যাবে, পড়ে থাকবে ফ্যাক্ট, সাদা ফ্যাটফ্যাটে কিছু ফ্যাক্ট। ঠাসাঠাসি করতে থাকা সম্ভাবনাদের আটকে রেখে ইন্দিরা নিজের ঘরে ঢুকতেই তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা হাতে তুলে নিলে ইন্দিরা দেখতে পায় স্ক্রিনে নাম ভাসছে,- “রঞ্জনা”
চলবে
প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন