তখন আমাদের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের একটি ভাষা-বিভাগে ভর্তি হবার কথা হচ্ছিল। আমরা মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থরা। এই ব্যাপারে বাপ্পী নামের ভিন্ন বিভাগের জুনিয়র ছেলেটা খুব নাচতেছিল। আমরা কয়েকজন একসঙ্গে ভর্তি হবো এমনটাই কথা।
এর মধ্যে আমি কিম কি দুকের the bow মুভিটা দেখে ফেলেছি। আর বলা বাহুল্য কোরিয়ান ভাষার এক্সেন্টটা রপ্ত করে নিয়েছি। বাসার লোকজন হরদম আমার কাছ থেকে কোরিয়ান ভাষা শুনতে চাইতেন। আমি অনর্গল বলা শুরু করতাম। তাঁরা স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগ করতেন।
কিন্তু এমন নির্মল আনন্দ-কাণ্ড সব সময়ই যে সবখানে ঘটবে এমন নয়। ক্যাম্পাসের সেই জুনিয়র বন্ধু বাপ্পীকে এসে কোরিয়ান শোনাতে লাগলাম। শুনে বাপ্পী সেকি রাগ! অন্য বন্ধুরা অবশ্য দেখে হাসতে হাসতে শেষ। বাপ্পী রেগেমেগে আমাকে বলছে: ‘আপা, আপনি একা-একাই কোরিয়ান ভাষায় ভর্তি হয়ে গেলেন? একটু বললেনও না?’ সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না কোনো প্রকার তালিম ছাড়াও ভাষা নকল করা সম্ভব, কিন্তু তা কোনোভাবেই অর্থবহ হয় না। কাজও চলে না। কারণ, ওর মাথায় তখন ভিনদেশি ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহটাই বেশি সক্রিয় ছিল, ভাষা শেখার পদ্ধতি অতোটা নয়।
কিম কি দুকের the bow সিনেমাটা প্রথম দেখি ২০০৯ সালে। একই সময়ে spring, summer, fall, winter… and spring দেখি। এটা দেখার পর সিনেমা সম্পর্কে আমার ধারণাই পাল্টে যায়। বিলকুল সংলাপবিহীন কোনো মুভি যে হতে পারে এবং সেটা মনে ও মগজে গেঁথেও যেতে পারে সেই ব্যাপারটা এই মুভি দেখেই মনে হলো।
নির্বাণের জন্য সাধনার কোনো বয়স হয় না। দর্শকের মন কেড়েছে ছেলে শিশুটির সাপ, ব্যাঙ নিয়ে খেলার শাস্তির দৃশ্যগুলো। গুরুজি শিশুটিকে যে কঠোর সাধনার ভেতর দিয়ে পথ দেখান, শিশুটি যুবা বয়স সেসব এলোমেলো করে দেয়। ফলশ্রুতিতে নির্বাণ লাভের আশা তাকে ছাড়তে হয়। এই যে খুব সাধারণ ও সহজ বিষয়, যা কিতাব থেকে কিতাবে লিখে লিখেও মানুষকে অনুধাবন করানো যায় না, তা তিনি তাঁর সাধারণ সংলাপহীন ভাষায় দেখিয়ে দিয়েছেন।
সিনেমার এক বিশেষ ‘ভাষা’র দীর্ঘ সাধনা ছাড়া এ ছবির মুক্তি এবং ছবিতে মানুষিক মুক্তি দেওয়া অসম্ভব।
এর অনেক পরে কিম কি দুক সম্পর্কে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর একটি লেখা পড়েছিলাম। তিনিও লিখেছিলেন কিম কি দুকের সংলাপহীন ন্যারেটিভ নির্মাণের দুর্দান্ত কৌশল সম্পর্কে। সেটাও ছিল ভালো কিছু পড়বার অভিজ্ঞতা।
কথা না বলে বলেও কেবল ঋতুর পরিবর্তনের মাধ্যমে মনুষ্য চরিত্র ও প্রবৃত্তি পরিবর্তিত হতে পারে। এটা ঠিক সিনেমা নয়। একে আমি বলবো নির্বাণের নতুন এক পথ নির্মাণ। কোনো কোনো ধর্মে যেমন সুর ও সংগীতকে উপাসনার মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়, কিম কি দুকের সিনেমাও আমার কাছে উপাসনার বিশেষ তরিকা। এ যেন কোরিয়ান ‘ভাষা’র মধ্যে আরও বিশেষায়িত নিবিড় কোনো ‘ভাষা’র উপাসনা।
কিম কি দুক মানেই নতুন কিছু। the bow মুভিতে একজন ষাট বছরের জেলে বৃদ্ধ ছোট্ট একটি কন্যাকে তুলে এনে বিয়ে করার জন্য যেভাবে যত্ন করে বড়ো করেন, কিম কি দুকের সিনেমার যত্নটা ঠিক যেন সেরকম। প্রতিটা দিন ক্যালেন্ডারের গায়ে দাগ কেটে রাখেন বৃদ্ধ। কন্যার বয়স এখনও ১৬, ১৭ অবধি তাকে পালের মুরগির মতো বড়ো করতে থাকেন তিনি। কন্যাকে আদর করে নাওয়ান, খাওয়ান, বাদ্যি বাজিয়ে শোনান। কিন্তু কন্যার ভালো লাগে অন্য এক টিন এজার ছেলেকে। কাহিনীর ভেতর আহামরি কিছু নাই। কিন্তু সিনেমার যত্নটা চোখে লেগে থাকার মতো। খুব বেশি সংলাপের চেয়ে দৃশ্যকল্পের পরিচর্যা তাঁর সিনেমায় একেবারে নতুন কিছু দেখায়।
ভিন্ন’ভাষা’র সিনেমা হলেও মানুষ কেন দেখে তাঁর সিনেমা? দেখে মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে থাকে? সে কি এমনি এমনিই?
কোরিয়ান কিচ্ছু না বুঝলেও কিম কি দুকের সিনেমার যত্ন খুব ভালো করে বোঝা যায়। হলিউডের জৌলুশ ত্যাগ করে পুরোপুরি প্রাকৃতিক নির্যাসে তৈরি তাঁর সিনেমাগুলো। তিনি খুব সহজেই পারতেন ইংরেজি ভাষার প্রাধান্যে সিনেমা বানাতে। কিন্তু তিনি তা বানাননি। নিজের ‘ভাষা’কেই পরিচর্যা করেছেন।
গোটা বিশ্ব তাঁর সেই ‘ভাষা’ ভক্তিকে ভক্তিও করে চলেছে।
একটি ‘ভাষা’কে ভালো না বেসে তার আত্মাকে স্পর্শ না করে কোনোদিনই সেই ‘ভাষা’র মানুষ হওয়া যায় না।
সে আরবিই হোক আর সংস্কৃতই হোক আর ইংরেজিই হোক। ভাষার শক্তি তার এক্সেন্ট-এ না, বরং ব্যবহারিক অর্থে। এক্সেন্টটা অনেকটা পোশাকের মতো, বাহ্যিক চিহ্ন মাত্র, যা কোনোভাবেই ওই ভাষার কেউ না, কিছু না।
কিম কি দুক আদ্যপান্ত তাঁর নিজের ‘ভাষা’র নির্মাতা। এ যেন ঠিক ছবি নির্মাণ নয়, এ যেন ছবি নির্মাণের নতুন ‘ভাষা’র নমুনা তিনি দেখালেন। হিচকক, কুবরিক, ক্যামেরন বা স্পিলবার্গের মতো বাঘা বাঘা নির্মাতাদের নিজস্ব ধারার পাশে কিম কি দুক এক ভিন্ন রকম নিসর্গের স্রষ্টা। মাত্র ৫৯ বছরের জীবনে সিনেমা নির্মাণে তিনি যে পরিপক্কতা অর্জন করেছেন, পৃথিবীর সিনেমার ইতিহাসে তা খুবই বিরল।
কিম কি দুকের জীবনাবসান ঘটলেও তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর অভিনব সিনেমা-ভাষার মধ্যে, কোটি কোটি দর্শকের হৃদ-মাঝারে।