‘ক্যালেন্ডার সিরিজ’ বই থেকে কবিতা ।। জয়ন্ত জিল্লু

আমার কবিতায় ক্যালেন্ডার একটা বিশদ অনুষঙ্গ হিসেবে ধরা দেয়। মূলত রূপক এই অনুষঙ্গ নিয়ে বেশ কিছু কবিতা লেখা হলে অনেকেই আলাদা করে গ্রন্থের কথা বলে। আমার ইচ্ছে একদম ছিল না। আমি আরেকটা কাব্যগ্রন্থের কথা ভেবেছিলাম। পরবর্তীতে মত পাল্টে ‘ক্যালেন্ডার সিরিজ’ করার সিদ্ধান্ত নিই। অতটুকুই। এই বাইরে বই প্রকাশ নিয়ে আলাদা কোনো গল্প নেই।

-জয়ন্ত জিল্লু


বই: ক্যালেন্ডার সিরিজ
প্রকাশক: তৃতীয় চোখ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
প্রচ্ছদ: জয়ন্ত জিল্লু


‘ক্যালেন্ডার সিরিজ’ হতে কবিতা

 

সেলুকাস

আয়নাটা আমরা অন্ধের জন্য তুলে রেখেছি। শীতের সকালে ঝরে যাওয়া বকুল ক্যালেন্ডারে। সোমবারে মানুষ জানল, পৃথিবী একটি কমলালেবু। অন্ধকে জানানো হলো না সেটা। ভিক্ষুককে জানানো হলো নামুদ্রার শাপলা একটি ফুল। হরিণকে জানতে দেওয়া হলো না সুন্দরবন। অন্ধকে ব্রেইলি শেখানোর আগে জানতে দেওয়া হলো না স্পর্শ। মানুষ তবু জানল, পৃথিবী সূর্যাস্তের দিকে যাচ্ছে। দেয়ালের ক্যালেন্ডার থেকে দরদ তুলে মানুষ জানতে চাইল পৃথিবীর বয়স কত। আত্মহত্যার আয়ু টাঙিয়ে দেওয়া হলো, অন্ধের সামনে। তবে অন্ধ কি মানুষ নয়? মানুষের মতো তারিখ জানতে স্কুলে নামতা শেখানো হলো। মানুষ গণিত শিখল। মানুষ শিখল, পৃথিবী যেহেতু কমলালেবুএকে ভাগ করে খেতে হবে।

 

চয়নিকা

আমাদের গল্পগুলো সুন্দর ছিল—চয়নিকা। আলিফ-লাম-মিম ছুঁয়ে থাকা ময়ূরের ফুল, রেহালে কিতাব, তারও পরে শাদা মেঘ, কালো মেঘ। এখন বৃষ্টি। ঝাপসা অন্ধকার পৃথিবীর চোখে আমি তোমাকে খুঁজিচয়নিকা।

চয়নিকা এক বিষণ্ন বালিকার নাম যার ছিল একটি ময়ূরের ফুলের আক্ষেপ। যে আলিফ-লাম-মিম ও রেহালে শোয়ানো কিতাবকে ঈর্ষা করতে করতে মরে গিয়েছিল পড়ার টেবিলে—আমার আধোঘুম পাঠাভ্যাসে।

শৈশবের ক্যালেন্ডারে!

 

নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার

প্রতিদিন মা ও আমি পাশাপাশি দুটি রুমে ঘুমাই। আমাদের মাঝখানে একটি বারান্দা। বারান্দায় ঝুলে আছে শাদা একটি ক্যালেন্ডার। আমরা প্রতিদিন ক্যালেন্ডারে জামা শুকাতে দিই। প্রতিদিন একটি করে তারিখ মুখস্থ করি আমরা। আমার মা ভাবেন, যেদিন ক্যালেন্ডারে সূর্যের বদলে একটি বৃক্ষ উঠবে, সেদিন আমার একটি অস্তগামী নৌকো হবে। আমি অবশ্য এসব বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি, ক্যালেন্ডারে প্রতিদিন মা অস্ত যাচ্ছে, প্রতিদিন মায়ের ক্যালসিয়াম ক্ষয় হচ্ছে, প্রতিদিন মায়ের ওজন কমছে। কিন্তু মা অতকিছু জানেন না। মা জানেন, সন্তানের ক্যালেন্ডারে একটি করে তারিখ জমিয়ে রাখতে। যেমন, জ্বর হবে আমার; কিন্তু তারিখটা মা জমিয়ে রাখবেন। একদিন না খেয়ে ঘুমাব; মা সেটাও জমিয়ে রাখবেন। এভাবে ছেলের ক্যালেন্ডার সমৃদ্ধ করেন মা। তারিখ থেকে দিনে, দিন থেকে বছরে, বছর থেকে মহাকালে মা একটি নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার, যেখানে স্নেহ হচ্ছে বার, মায়া হচ্ছে তারিখ, ভালোবাসা আস্ত বছর!

 

স্তনবিদ্যা

বিন্দু একটি ধারণা। বিন্দুর বাইরে একটি বৃত্ত। বৃত্তের ভেতরে অসংখ্য তারিখ। গোপন জামা শুকাতে দেওয়া দুপুর, বিন্দুর অতীত। প্যাডেলে পা জমা দেওয়া সাইকেল একটি স্মৃতি, বৃত্তের ভেতরে। বাইরে মেঘ কালো, মা শুকাতে দেওয়া জামা কুড়িয়ে আনে। সংসারধর্ম বিন্দুর বাইরে, বাবা ভাত-বাসন ছেড়ে রাগ করে উঠে পড়ে, এটা বৃত্তের ভেতরে। ঘুম হয় না, বিন্দু থেকে বিঘত দূরত্বে। অন্ধকার একটি বৃত্ত। চাকায় পরিমাপ হওয়া রাস্তা, বিন্দুর সমষ্টি। ক্যালেন্ডার, সাল, তারিখ বৃত্তের ভেতরে। প্রেম প্রেমিকা মা, বিন্দু থেকে শুরু। বিন্দুর গোল চক্কর, স্তন। লাবণ্য, স্তনের রূপ বৃত্তের ভেতরে। ঘুম, জীবন, বেড়ে ওঠা স্তনবিদ্যা। এই স্তনবিদ্যা থেকে আমি তিনটি বিষয় শিখি—বিন্দু, বৃত্ত ও মাতৃত্ব!


কবি পরিচিতিঃ

জয়ন্ত জিল্লুর  জন্ম ১৯৮৭ সালের ১০ অক্টোবর কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলায়। পড়াশোনা অপটোমেট্রি ও আইনে স্নাতকোত্তর। কাজ করছেন, শেভরন চক্ষু হাসপাতালে এসোসিয়েট অপটোমেট্রিস্ট হিসেবে। অন্যান্য প্রকাশনাঃ পৃথিবীর কোথাও রাস্তা দেখি না [কাব্য, ২০১৪, তৃতীয় চোখ] ও ‘ছায়াশরীরের গল্প’ [গল্পগ্রন্থ, ২০১৫, কাকতাড়ুয়া]

শেয়ার