শিরিষের ডালপালার আয়োজনে দ্বিতীয় দশকের ১৩ জন কবি কূটালাপে মধ্যমণি হয়েছিলেন। দ্বাদশ আয়োজনে আড্ডা হয় কবি মোস্তফা হামেদীর সঙ্গে। যিনি শেকড়সন্ধানী। হামেদীর সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন হাসান রোবায়েত, রুহুল মাহফুজ জয়, বিধান সাহা, হুজাইফা মাহমুদ, হাসনাত শোয়েব, ইলিয়াস কমল, ফারাহ্ সাঈদ এবং শিমন রায়হান। এই আড্ডা হয় গত নভেম্বরে। আড্ডাগুলি সংকলিত করে ইতোমধ্যে ‘কূটালাপ’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশক ঐতিহ্য।
শিল্পী হচ্ছে এমন এক জাত, যারা নিজেরাই নিজের গলায় ফাঁস লাগানোর জন্য মরিয়া, ফলে তাদের গলায় আলাদা করে তত্ত্বের ফাঁস লাগানোর চেষ্টা ভালো কিছু তৈরি করে না।
হাসান রোবায়েত: হামেদী ভাই, শরীর কেমন এখন? জ্বর-সর্দির কথা শুনেছিলাম।
মোস্তফা হামেদী: সেরে উঠছি। দুই দিন লাগবে আরও। এক মঙ্গলবার শুরু, আরেক মঙ্গলবার শেষ। আপনার কী খবর?
রোবায়েত: ঐ আপনার মতই অবস্থা। আপনার প্রথম বইয়ের নাম ‘মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ, ২য় বইয়ের নাম ‘তামার তোরঙ্গ’। বোহেমিয়ান নাম থেকে হঠাৎ ঐতিহ্য-গন্ধী নাম বেছে নিলেন কেন?
হামেদী: দুইটার জার্নি দুইরকম। প্রথমটায় ব্যক্তিলগ্নতা ছিল কিছুটা। এইটাতে পরিপার্শ্বের ভূমিকা বেশি। প্রতিবেশ এখানে একটা ক্যারেকটার হিসাবে এসেছে। যদিও এটি অঙ্কুরিত হয়েছে প্রথম কাব্যে।
রোবায়েত: কিন্তু ‘তামার তোরঙ্গ’-তে আপনাকে দেখা যায় ছোট ছোট বাক্যে ইমেজ লিখছেন। প্রথম বইয়ে এই ইমেজ-প্রবণতা তেমন দেখা যায় না। বেশ ন্যারেটিভ ছিল। ন্যারেটিভ থেকে অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে ওঠার পেছনে ঠিক কী কী কারণ কাজ করেছে?
হামেদী: প্রথম বইয়ের বৈশিষ্ট্যটাই সম্ভবত ন্যারেটিভনেস। সরাসরি বলে ফেলার প্রবণতা কাজ করতো তখন। বিমূর্ততা ভালো লাগতো না। কারণ তখন মনে হতো, ইমেজ আর বিমূর্ততার জোয়ার চলছে চারপাশে। ইয়োরোপীয় আর কলকাতার প্রভাবে যেন লেখা হতো সেসব কবিতা। এর বাইরে গিয়ে লিখতে চেষ্টা করেছি তখন। তবে ঐ বইয়ের দুর্বলতার একটা জায়গা আছে, সেটা হচ্ছে প্রগলভতা। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে ছোট ছোট ইমেজের হাতে ধরা পড়েছি।
রোবায়েত: তার মানে ইমেজ-প্রবণতাকে আপনি ইয়োরোপ আর কোলকাতার প্রোপার্টিজ বলতে চান? কিন্তু শিল্পে একক প্রপার্টির ধারণা কি চলে?
হামেদী: মোটেও না। আমি এই বইয়ে সেই কাজটাই করেছি। আমার প্রতিবেশের নানান বিষয়-আশয়কে ইমেজের বাহন করেছি। যেগুলোকে আপনার ইউরোপ বা কলকাতা মনে হবে না। বিমূর্ততার জায়গাটাকে অ্যাড্রেস করতে গিয়ে ওদের কথা বলেছি আসলে। ইমেজ বাংলা কবিতার প্রাচীন সম্পদ। চর্যাপদেও ইমেজের চমৎকার ব্যবহার আছে।
রোবায়েত: আমার তো মনে হয় ইমেজ আমাদের আদি সম্পদ। যেমন ধরেন, ‘কাদম্বরী’, ‘মেঘদূত’ এইসবই এই অঞ্চলের সম্পদ। ইমেজে ঠাসা। তো, হঠাৎ করেই ইমেজের স্বত্ব ইয়োরোপে পাঠানো হলো কেন?
হামেদী: ইয়োরোপে কারা পাঠিয়েছে, তার তদন্ত হওয়া দরকার আরও গভীরভাবে। ইতিহাস বিচ্ছিন্নতা থেকে এই ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সম্ভবত এক ধরনের উন্নাসিকতা তৈরি হয়েছিল বিংশ শতাব্দী জুড়ে। তখন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ইয়োরোপীয় হতে চেয়েছিল কায়মনোবাক্যে। ফলে তাদের শিল্পকলার ন্যাচারও সেরকম হয়েছে।
রোবায়েত: আপনি কি পৃথিবীর একজন হইতে চান নাকি পলিটিক্যাল বিবেচনায় আঁকা নির্দিষ্ট মানচিত্রের?
হামেদী: আমি আদতে পৃথিবীর হইলেও বাংলাদেশের বাইরে যাইতে তারকাটায় বাধা পাই। এই তারকাটা এখন রাজনৈতিক। জাতি-রাষ্ট্র গঠনের আগে এই বাধাটা ছিল সাংস্কৃতিক। ফলে সবসময়ই পরিসীমা তৈরি হয়েছে। এবং মানুষের পরিচয়টা এই ভূখণ্ড, ভাষা এসবের সাথে সমঝোতা মেনে বিকশিত হয়েছে। ফলে এগুলো এড়িয়ে আমি যেতে পারি না, যেতে চাইও না। আমি প্রথমত বাংলার। আর বাংলা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরের কিছু নয়। বরং বলা যায় এটাই আমার পৃথিবী। যার যার পৃথিবীটা আসলে তার তার চেনা-জানা জগত দ্বারাই পরিগঠিত।
রোবায়েত: তাইলে। আপনি যখন ইমেজকে কোলকাতার প্রপার্টি কইলেন সেটা কোন কোলকাতা? সাম্প্রতিক না কি পুরনো?
হামেদী: আমি ইমেজকে কোলকাতার বলি নাই, বরং যে ধরনের ইমেজের কবিতা চোখে পড়তো, সেগুলোর কথা বলেছি। যেসব ধরেন, পঞ্চাশের দশক এবং তার পরবর্তীকালের কবিতা দ্বারা প্রভাবিত। এইরকম মনে হত আরকি।
রোবায়েত: আমার তো মনে হয় ইমেজ অধিক ইউজ করছেন জীবনানন্দ। তিনি খাঁটি বাঙ্গাল। এরপর অন্যরা করে। তাইলে ইমেজের ব্যবহার কোলকাতার হবে কেন? এটা তো বাংলার হওয়া উচিত। যেমন ধরেন, আল মাহমুদ যখন লেখেন,
‘গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল’
এই যে ইমেজের ব্যবহার বাংলাদেশের কবিতায় হয়ে আসছে সেইটা হঠাৎ করে এই সময়ে এসে কোলকাতার হয় কী করে? যখন আমাদের ব্যবহৃত ইমেজ আমাদের জীবন-প্রতিবেশ থেকেই আসে। এই যে হুজুগ। আমার কাছে এইটা একদল কবির শিশুতোষ প্রোপাগান্ডা মনে হয়।
হামেদী: আপনি রিচেক করেন আমার মন্তব্য। আমি এক ধরনের প্রবণতার কথা বলেছি। যেটা আপনি উদাহরণ দিলেন, এটাই বরং সেই বলয়ের বাইরের লেখা, যেটা আমার পছন্দের পথ। ইমেজকে কোলকাতার বলি নাই। কোলকাতা ও ইয়োরোপীয় ইমেজের টেকনিকে যেসব কবিতা লেখা হতো, সেসবের কথা বলেছি। ‘সোনালী কাবিন’-এর যে এস্থেটিকস এটাকে যতটা প্রশংসিত করা হয় কথায়-আলাপে, কবিতায় তার চর্চাটা খুবই সামান্য।
রোবায়েত: আমি আসলে আপনার মন্তব্যকে ক্রিটিক করি নি হামেদী ভাই। এমন লোকজন আশেপাশেই আছে। আচ্ছা, একজন নতুন কবি কেন ‘সোনালী কাবিন’-এর নন্দন চর্চা করতে যাবে! তার কি নিজের নন্দন তৈরির ফিকিরে থাকা উচিৎ না? তারমানে, আপনি কি ‘সোনালী কাবিন’, ‘নকশীকাঁথার মাঠ’-এর এস্থেটিকস চর্চাকারী?
হামেদী: আমি পরম্পরায় বিশ্বাস করি। থট অব স্কুল ব্যাপারটাকে ওউন করি। আমার চিন্তার সাথে প্রাসঙ্গিক কিছু পেলে নিতে চাই। প্রভাবিত হতে চাই। তবে নিজের রং-রূপ-রস দিয়ে, আদর-দরদ দিয়ে তাকে নিজস্ব ভঙ্গির মধ্যে পুরে ফেলতে চাই। ‘সোনালী কাবিন’, ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এইখান থেকে আমি প্রেরণা নিয়েছি। আমাদের যে ঐতিহ্য ও বিশ্বাস, যাপন তথা জনসংস্কৃতি তাকে কীভাবে সাহিত্যের অংশ করে তোলা যায়, কীভাবে এসবকে ছেঁকে কাব্যরসের আধার করে তোলা যায়, সেই প্রেরণা পেয়েছি।
রোবায়েত: আচ্ছা, কবিতাই কি একটা জাতির দাঁড়ানোর শেষ জায়গা মনে করেন? আমার এই প্রশ্নের কারণ পরে ব্যাখ্যা করছি [যদি জানতে চান]।
হামেদী: শেষ জায়গা আসলে মানুষ। তবে কবিতা মানুষের অন্তর্জীবনের ক্ষমতাধর অধিপতি। যে কল্পনা, ছবি, সুর, স্বর ও নৈঃশব্দ্য কবিতা ধারন করতে পারে, বোধ করি মানুষ কখনও তাকে অতিক্রম করতে কিংবা অগ্রাহ্য করতে পারবে না।
রোবায়েত: তাইলে, একটু ব্যাখ্যা করি। আপনার সাথে বছরের শুরু থেকে অনেকদিন আড্ডা দিছি আমি। অনেক কিছুই শিখছি আপনার থেকে। সেইখান থেকেই ধার করে বলি। যেমন ধরেন, আমাদের স্থাপত্যবিদ্যা। ঢাকাসহ সারা বাংলার দিকে তাকাইলে মনে হয় স্থাপত্যের নৈরাজ্য চলছে। প্রায় প্রত্যেকটি ভবন তৈরি হয়েছে ইয়োরোপের নকশায়। যেন এই অঞ্চলের কিছুই নাই অমন। ক্ষমতাকেন্দ্রের সব কিছুই বিন্যস্ত হইছে ‘বাইরের’ আদলে। ঠিক এত কিছুর মধ্যেও কবিরা নিজেদের ঐতিহ্যকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের ভাষাকে ভিত্তি করে। একদিন হয়তো দেখা যাবে কবিতা ছাড়া আর সবকিছুই পশ্চিমা কাঠামোতে চলে গেছে।
তাই আমার ঐ আলাপের অবতারণা।
হামেদী: হা হা হা। নস্টালজিক করে ফেললেন। সতেরোর শুরুর সময়টা আপনাদের সাথে দুর্দান্ত কেটেছিল। আবারো সেই রকম একটা মৌসুমের প্রত্যাশা করি। এই আলাপগুলি আমরা তুলতে পারছিলাম তখন। আমার ‘তামার তোরঙ্গ’র বেশিরভাগ কবিতাও ঐ সময়ে লেখা। আগের প্রশ্নে আপনি যে প্রসঙ্গটা তুললেন, ‘মর্মান্তিকভাবে’ বাংলাদেশে এটা প্রাসঙ্গিক। সাহিত্য ছাড়া অন্য জায়গাগুলোতে আমরা নিজেদের রং-রূপ-রস-ঐতিহ্য-সুর-স্বরের সমাবেশ ঘটাতে পারিনি। এমনকী গান-সিনেমার ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়নি প্রবলভাবে। আমাদের নিজস্ব উপকরণগুলোকে, প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে বিবেচনায় না এনেই আমাদের উন্নতির প্রচেষ্টা। ফলে তার চেহারাটা কিম্ভূতকিমাকার। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী-এইটা একটা তথ্যের বাইরে বেশি কোনো ব্যঞ্জনা তৈরি করেনি। অথচ আমাদের স্থপতিরা নাকি মেধাবী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মেধা পশ্চিমের কাছে নতজানু মনে হয়। আমাদের রাজনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি কোনোকিছুতেই স্থানীয় জ্ঞান ও দর্শনের সফল প্রয়োগ ঘটাতে পারিনি আমরা। সে চেষ্টাও অপ্রতুল। অথচ দেখুন, বৃষ্টি হলে ঢাকা ডুবে যাচ্ছে। নদী ও খালকে আমরা সভ্যতার অংশ করে তুলতে পারি নি। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যে বাড়ি তৈরি করতেন, তার চারপাশে গড় ছিল, পানি নেমে যাওয়ার ও বর্ষায় নৌকা ভিড়ানোর চিন্তা মাথায় রাখতেন তারা। আজকে আমরা সাফারি পার্ক তৈরি করছি কোটি কোটি টাকা খরচ করে। অথচ, প্রতিটা গ্রামের বাড়ি একটা সাফারি পার্ক। মানুষ, গাছ, সাপ, ব্যাঙ, মাছ, বাগদাশের সহাবস্থান সেখানে। পূর্ব পুরুষের এই জ্ঞানকে নগরায়ণের ক্ষেত্রে আমরা কাজে লাগাইনি। এবার ভাদ্রের বৃষ্টিতে সবজির দাম বেড়ে গেলে, আমরা টের পাই বৃষ্টি ও হাওয়ার মতিগতি আমাদের কতটা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নীতি প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে ভূগোলের এইসব প্রবণতাকে আমলে নিই না। ধান ও নবান্নের দেশে রাস্তার মোড়ে মোড়ে তো পিঠার দোকান হওয়ার কথা, এত ফাস্টফুডের দোকান কেন? গানের ক্ষেত্রে দেখেন, আমাদের মূল ধারার গানকে ‘ফোক’ নাম দিয়ে প্রান্তে ফেলে রেখেছি। অথচ ঐগুলি হওয়ার কথা মেইনস্ট্রিম। আমাদের ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও দেখেন, পোশাক-পরিচ্ছদে নিজেদের রিসোর্সকে আত্তীকৃত করার চেষ্টা নাই। পশ্চিমাদের অনুকরণের মধ্যেই আমাদের স্বাধীনতা খাবি খাচ্ছে যেন। বাঙালির সহস্রাব্দ পুরনো সংগ্রাম আটকা পড়ে আছে অনুকরণের জালে।
রোবায়েত: এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা গদ্য আশা করছি আপনার থেকে। এবার একটা অন্য টাইপের প্রশ্ন।
আপনার লেখা
‘রোদের দিকে তাকিয়ে গাছ
গোছাচ্ছে ফল’
আমার একটা লাইন আছে এমন
‘ফলের দিকেই তাকিয়ে পাকে পথ’
দু-একজন আমাকে জানিয়েছেন আপনার লাইনটার সাথে আমার লাইনটার মিলের কথা। এই যে আমার লাইনের সাথে আপনার লাইনের মিল পাঠকের চোখে মনে হচ্ছে, এটাকে কিভাবে দেখছেন?
হামেদী: পাঠকের বিভ্রম তৈরি হয়, কিছু শব্দ একরকম হওয়ার কারণে। কিন্তু দুইটার থ্রোয়িং ও প্রজেকশন আলাদা। শৈলীও আলাদা। কবিতাটার নামের (বিভ্রম) সাথে কাজের মিল পাওয়া গেল মনে হচ্ছে। পুরো কবিতাটা পড়লে এটাকে বেখাপ্পা বা অন্য কারও মনে হবে না।
সম্ভবত কবিতা মানুষ যা হইতে চায়, বলতে চায়, কিন্তু ভাষা ও যোগাযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে তা হইতে ও বলতে পারে না, কবিতা সেইটা হওয়াতে ও বলাতে পারে। ফলে মানুষ কবিতাকে গ্রহণ না করলেও, এড়াতে পারে না।
রুহুল মাহফুজ জয়: হামেদী, বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার কবি-জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
হামেদী: সাহিত্য ও চিন্তার জায়গা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো একটা সময় কাটিয়েছি। আমাদের একটা সার্কেল ছিল, যারা হাতে কবিতার বই, দেশি ও বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের বই নিয়ে ঘুরতো। হাকিম চত্বরেই ছিল আড্ডা ও জমায়েতের মূল কেন্দ্র। লাইব্রেরিতে পড়তাম আর হাকিমে এসে সেগুলো কপচাইতাম। আমাকে ডাকত কবি হামেদী বলে। কবি মাহমুদ হাছান (প্রয়াত), ডাল্টন সৌভাত হীরা, রজত শিকস্তি, সাংবাদিক হুমায়ুন, সামসুদ্দোজা সাজেন, সমাজ গবেষক কার্ল মুজিব, বিপ্লবী ফারুক হোসেন, গদ্যকার আজিজুল রাসেল, চলচ্চিত্রকার মাহমুদ দিদার এরা আমাদের আড্ডার সদস্য ছিল। আমাদের মূল কাজটা ছিল সবকিছুকে খারিজ করা। বেশ জমজমাট ব্যাপার ছিল। বিভাগে জিনাত জাহান সেঁজুতি, রুবাইয়াৎ সিমিন (কুসুম) এরা আমার লেখাজোখার বেশ সমঝদার ছিল। কবি বায়তুল্লাহ্ কাদেরী, গদ্যকার মোহাম্মদ আজম আমার সরাসরি শিক্ষক। কাব্যচর্চার সুবাদে স্যারদের স্নেহ ও প্রশ্রয় পেয়েছি। হলে দুই বছর ‘বৃন্ত’ নামে একটা সাহিত্য সংগঠন চালিয়েছি আমরা। এটার স্লোগান ছিল, ‘ফলজ সম্ভাবনার নবীন সাঁকো’। সপ্তাহে একদিন হল সংসদে আড্ডা হত। বলা যায়, হল এবং ক্যাম্পাস মিলিয়ে দারুণ একটা কবি জীবন ছিল আমার।
জয়: দিদার আমার মোটামুটি বন্ধু ছিল। এখনো আছে। কার্ল মুজিব ক্লাস মেইট। তুমি-আমি একই ব্যাচের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমাদের পরিচয় হয় নাই। আমি কবিতাচর্চায় সেভাবে ছিলাম না বলেই হয়তো…আচ্ছা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সাহিত্যচর্চা বিদ্যমান, এতে কী কী ঘাটতি আছে মনে হয় তোমার?
হামেদী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন একটা সংগঠন আছে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদ’ এই নামে। ওরা আড্ডা – আলোচনা এগুলো আয়োজন করছে। দাওয়াত পেয়েছিলাম দুয়েকবার। যেতে পারিনি। অর্বাকের আড্ডা হয়। আর তেমন খোঁজ-খবর রাখি না এখন। তবে আমাদের সময় যেটা মনে হয়েছে, সৃজনশীল কাজের চেয়ে তত্ত্ববাগীশ হতে চাইত বেশিরভাগ। আর আশেপাশে শাহবাগ, আজিজ মার্কেট থাকায় সৃজনশীল ছেলে-মেয়েরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। যার যার মতো করে বলয় তৈরি হয়। এইটা খুবই স্বাভাবিক। তবে ঘাটতি যেটা লক্ষ্য করি, সেটা হচ্ছে লেখালেখির প্রতি যে একটা প্যাশন থাকা দরকার, এটা সিনিয়র হওয়ার সাথে সাথে কমতে থাকে। চাকরি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রধান হয়ে ওঠে। আর সৃজনশীল চর্চার প্রতি উৎসাহী লোকজন খুব কমই দেখেছি। বেশিরভাগ লোকজনকেই দেখেছি, তাড়াতাড়ি কিছু একটা পাইতে হবে। এমনকী যারা সাহিত্য করতে আসে, তারাও চায় আচমকা কিছু একটা করে ফেলতে। হলের পরিবেশ, সিটের জন্য হাহাকার এইগুলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীলতা চর্চার স্পেসগুলি, ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষাগুলি দমিয়ে দেয়।
জয়: ভাল বলেছ। খুঁজলে হয়তো আরো কারণ পাওয়া যাবে। আচ্ছা, তুমি কবিতা লেখো- এই কারণে, মানে কবিতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার প্রেম হয় নাই?
হামেদী: প্রেমই তো হয়ই নাই আসলে। কবি হিসেবে লোকজন আমাকে পছন্দ করত, অনেক মেয়েরাও। কিন্তু কোনো অফার পাইনি। কিন্তু গোপনে কেও ভালোবাসছে কিনা জানি না। হয়তো প্রেম করার মতো প্রতিভা আমার ছিল না। কিংবা আমি তখন খুব গরীব ছিলাম, আর খুব কৃশকায় ছিলাম। বাড়ি থেকে টাকা আসলে আগে বই কিনতাম। পোশাক ছিল কমদামি। এইরকম একটা গেঁয়ো ছেলেকে মেয়েরা ভালোবাসবে কেন? হা হা হা
জয়: তো এই যে ৩২/৩৩ বছরের জীবন, এই জীবনটুকুতে কবিতার কারণে প্রেম হইলো না তোমার?
হামেদী: এতো বয়স কি হইছে!!? হা হা হা। কবিতার কারণে প্রেম হইল না তো। এটা সম্ভবত আমার কবিতারই ব্যর্থতা। ভবিষ্যতে হয়তো হবে। কবিতায় আরও উন্নতি করতে হবে। মেয়েরা কবিতা ভালো বোঝে। আর অদ্ভুত ইমেজ তাদের নাড়া দেয় দারুণভাবে। এই কারণে অদ্ভুত ইমেজের কবিতা লিখতে হবে।
জয়: প্রেম-টেম থেকে অন্য বিষয়ে আসি। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, পেশাটা কি তোমার কবিতার জন্য ভালো না মন্দ?
হামেদী: সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে সুবিধা যেটা পাই, সেটা হল মুফতে কিছু জিনিস পড়া হয়ে যায়, আর সাহিত্যের বিষয়-আশয় নিয়ে আছি-এইরকম একটা স্বস্তি কাজ করে। তবে সাহিত্য চর্চার কারণে সুবিধাটা বেশি হয়, ক্লাস লেকচার তৈরি করার চাপটা কম বোধ করি, নিজের বোঝা-পড়া শেয়ার করেই ক্লাস নিতে পারি। যেটা বেশ কার্যকরীও হয়।
বিধান সাহা: হামেদী, আপনার কবিতার করণকৌশল কী?
হামেদী: আমার লেখার ক্ষেত্রে প্রতিবেশ উদ্দীপনা তৈরিতে বেশ সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ঘটমানতার ভিতরে আকস্মিক কোনো কোনো দৃশ্য, ঘ্রাণ, ধ্বনি হঠাৎ আমাকে স্তব্ধ করে দেয়। তখন যেন একটা অদেখা-অদ্ভুত জগত আবছা ভেসে ওঠে। জগতটাকে ছুঁয়ে দেখতে আকুল হয়ে উঠি। একটা শূন্যাবস্থার মধ্য দিয়ে ঐখানে পৌঁছাই। তখন উপযোগী দৃশ্য ও শব্দ আমাকে সঙ্গ দেয়।
বিধান: শব্দকে ধরার ক্ষেত্রে আপনার কোনো নিজস্ব কৌশল আছে কিনা? কিংবা বাক্যের বিন্যাসে কোন কোন দিকে মনোযোগী থাকেন? বা, আদৌ থাকেন কিনা?
হামেদী: দৃশ্য, ধ্বনি বা সুর, ঘ্রাণের মাধ্যমে নিজের মানসিক অবস্থার সাথে, স্মৃতি ও দেখা-অদেখার, কল্পনাপ্রবৃত্তির সাথে রিলেট করার চেষ্টা করি। ঐভাবে আগাই, একটা নতুন অবস্থা সৃষ্টি হয়-তাকে ব্যাখ্যা করি, বর্ণনা করি। প্রথমত বিষয়টাকে ধরার চেষ্টা করি, সাথে সাথে চলতে থাকে প্রাথমিক এডিটিং-মনের মধ্যে। উপযুক্ত শব্দটি নিয়ে ভাবি, বাক্যটাকে কীভাবে আরেকটু বাঁকিয়ে দেওয়া যায়, আরও নান্দনিক করে তোলা যায়, সে চেষ্টাও চলে। ঐ বিশেষ অবস্থাকে কতরকমভাবে, কোন কৌণিক বিন্দু থেকে সবচেয়ে স্পষ্ট ধরা যায়, দেখা যায়, সেই সম্ভাব্যতাগুলো খতিয়ে দেখি। এগুলো প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট। প্রায় স্বতঃস্ফূর্ত ও দ্রুতগতির। একটা শেপ দাঁড়িয়ে গেলে পরে আবার এটার উপর চিন্তা ও সুরের প্রলেপ পড়ে। চোখ, কান ও মনের সায় পর্যন্ত অপেক্ষা করি।
বিধান: যাপনের দিক থেকে আপনি নিজেকে কি নাগরিক ভাবেন?
হামেদী: আধা নাগরিক, আধা গ্রাম্য-এইরকম হল অবস্থা আমার। থাকা হয় গ্রামীণ প্রেক্ষিতের মধ্যে। আবার চাকরি-বাকরি, লেখা-পড়া, শহরবাসের অভিজ্ঞতা, সামাজিক প্রভাব সবমিলিয়ে নগরের কিছু ব্যাপার-স্যাপারও আছে।
বিধান: সেক্ষেত্রে, শব্দ বা বাক্যবিন্যাসের ক্ষেত্রে আলাদা করে কি কিছু প্রাধান্য পায় আপনার কবিতায়?
হামেদী: একটা দোলাচলের মধ্যে যেমন থাকা হয়, কবিতায় তার প্রভাব পড়ে। নগরবাস আমাকে কিছু জিনিস শিখিয়েছে, সেটা হচ্ছে সমাজ বা মানুষ বা কোনো ঘটনাকে ক্রিটিক্যালি দেখা, বিভিন্ন তল থেকে দেখা, গতিময়তার আনন্দ, প্রতিনিয়ত নিজেকে নবায়িত করার কৌশল, এগুলো শিখেছি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের কাছ থেকে। আর গ্রাম আমাকে শিখিয়েছে অভিজ্ঞতার সৌন্দর্য কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়, প্রকৃতির সাথে কীভাবে নিজের আত্মীয়তা তৈরি করতে হয়, সামষ্টিক বোধ বা যূথতা, আনন্দ ও বেদনার যৌথ উদযাপন, স্থিরতার স্বরূপ ও সৌরভ। এগুলোর প্রভাব আমার কবিতায় আছে। বাক্যবিন্যাসে, চিত্রকল্প সৃষ্টিতে এই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রাখে প্রায়শই।
বিধান: কবিতার জন্য কবিদের জগত নির্মাণের যে ট্যাবু, তা বিশ্বাস করেন?
হামেদী: হুম। স্রষ্টার সাথে জগতের সম্পর্ক আছে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির ধারণার মতোই এটা। একজন কবি আসলে সারাজীবন ধরে একটা জগত সৃজন করে যান, সেই জগতের বহু মানচিত্র থাকতে পারে-কিন্তু কমন কিছু ব্যাপারও থাকে। দুনিয়ার সর্বত্রই যেমন আলো, বাতাস, মাটি, পানি, আকাশ কমন বিষয়, ঠিক কবির সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সাধারণ কোনো রূপ পরিদৃষ্ট হয়। আর থাকে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, থ্রোয়িং, কাব্যভাষা বিষয়ক প্রস্তাব, এমনকী থাকতে পারে জীবন বিষয়ক প্রস্তাব, অভিজ্ঞতার সারোৎসার, সর্বোপরি বিশেষ কবিকল্পনা, যেটা অভূতপূর্ব, যাপনের নতুনতর সূত্র ও ব্যাখ্যা ইত্যাদি।
বিধান: আপনার কাব্যজগতটা কেমন সেক্ষেত্রে?
হামেদী: এইটা পুরোপুরি খোলাসা না করে আবিষ্কারের জন্য রেখে দিলাম। তবে কিছু ইশারা দিতে পারি। প্রকৃতি ও মানুষের আন্তঃসম্পর্ক, গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজের যাপন, জনসংস্কৃতির নানা রূপ, সুর ও স্বর— এইসব নিয়েই মোটামুটি আমার কাব্যজগতের ফ্রেম তৈরি হয়েছে।
বিধান: প্রেম নাই তাতে? বিশেষত নারী?
হামেদী: আছে। বেশিরভাগ নারীই ঐ গ্রামীণ আবহের মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে।
হুজাইফা মাহমুদ: হামেদী স্যার, আপনি কবিতা লেখেন কেন? আপনি নিজেকে যখন এই প্রশ্ন করেন, তখন কী জবাব পান?
হামেদী: অনেকদিন ধরে লিখি, এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। অক্ষরের প্রেমে পড়ে গেছি মনে হয়। লেখার মধ্যে নিজের চেহারাটা-অন্তর্জগতটা ধরে রাখতে পারি। মনে হয়, ঐ পঙ্ক্তিবিন্যাসের মধ্যে আরেকটা হামেদী পল্লবিত হয়ে আছে।
হুজাইফা: এই লেখার প্রতি কি আপনার কোন প্যাশন বা তীব্র আকাঙক্ষা আছে? এমন কি মনে হয় যে, না লিখে আপনার পক্ষে থাকা সম্ভব না!
হামেদী: আকাঙ্ক্ষাই লিখিয়ে নিচ্ছে আসলে। কী যেন অব্যক্ত হয়ে আছে এই চরাচরের মধ্যে, সেইটাকে ধরবার আকাঙ্ক্ষা তাড়িত করে। ফলে লিখব না এটা ভাবতে পারি না। ভাষার সম্ভবত একটা ঐন্দ্রজালিক শক্তি আছে। তার জাদুতে কেউ ধরা খেয়ে গেলে, আর বেরোতে পারে না। আমি সেই ধরা খাওয়া মানুষ, যে কারণেই হোক সে ভাষার জাদুমন্ত্রে বেঘোর হয়ে পড়েছিল কোনো এক মুহূর্তে। তারপর সে আর ঐ জাল ছিন্ন করতে পারেনি। এই যেমন এখন সবাই লেপ-কম্বলের নিচে আরামসে ঘুমাচ্ছে, আর আমি কার্তিকের চাঁদের নিচে শীতের মেহমান হয়ে গেছি। কেন দাঁড়িয়ে আছি, কে জানে? ঐ রহস্যময়তা ও অব্যক্ত কোনো শক্তিই হয়েতো আমাকে ঘর থেকে টেনে এনেছে শীতের দহলিজে।
হুজাইফা: বাহ, দারুণ কথা বলছেন! আচ্ছা, এই যে আপনি নিজের তীব্র আকাঙক্ষার পেছনে ভাষার ইন্দ্রজালের কথা বলছেন। ব্যাপারটা আমার কাছে ক্লিয়ার না, কবিতার পেছনে মূল তাড়না হিসেবে কোনটা থাকে! এক অব্যক্ত “বিপন্ন বিস্ময়”, যে বোধ কেবল একদল অতিশয় সংবেদনশীল মানুষের হৃদয়েই জাগে! যারা দৃশ্যের বহিরাঙ্গনটা দেখেন, এবং দৃশ্যের অন্তর্গত রূপ-রস অন্তশ্চক্ষু দিয়ে অবলোকন করতে পারেন, সেই বোধ! নাকি ভাষার জাদুময় ইঙ্গিতময়তা!?
হামেদী: দৃশ্যের ভিতর দিয়ে ভাষা তার সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে। দৃশ্যের অন্তর্গত রূপ-রস আমার কাছে ভাষার বাহনে হাজির হয়। সেই দৃশ্য তখন আর স্রেফ দৃশ্যমাত্র থাকে না, সেইটার সঙ্গে যুক্ত হয় আমার বোধ, আকাঙ্ক্ষা, বিপন্নতা, হাহাকার। এই যে প্রসেস যুক্ত হওয়ার, নিজেকে রুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করার, এইটাই আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। ভাষা সেই জগতের সাথে আমাকে যুক্ত করতে পারে, যেখানে আমি কখনো যাই নাই, অথচ যেতে চেয়েছি। এইটা একটা মায়ার জগত। যে মায়া আমি বাংলার প্রকৃতি, প্রতিবেশ ও মানুষ থেকে কুড়িয়ে নিই।
হুজাইফা: আচ্ছা! এই ভাষা কি আপনার বোধ ও মনোলোককে যথাযথভাবে বিম্বিত করতে সক্ষম? ভাষা ও প্রকাশের ভেতর তো অনেক টেকনিকের ব্যাপার থাকে! আপনার অন্তর্গত বোধকে কি কখনো কখনো ভাষার সাথে কন্ট্রাডিকশনাল মনে হয় না? অর্থাৎ, যে বোধ আপনার মনোলোক এলোমেলো করে দিচ্ছে, আপনাকে আপনার জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়ে অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছে, সেটা কি যথার্থভাবে ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন?
হামেদী: যে বোধ আমাকে এলোমেলো করে দেয়, সেটাকে ভাষায় ফুটিয়ে তোলা ছাড়া আর কোনো জুতসই পথ এখনও খুঁজে পাই নি। তবে, ঠিক যে জায়গাটা অভীষ্ট, কখনো কখনো মনে হয়, এই বুঝি পৌঁছালাম। কিন্তু পরক্ষণেই যেন গন্তব্য দূরে সরে যায়। আবার সে অভীষ্টে ছুটি। আবার একই অনুভূতি। গতি ও গন্তব্যের দ্বৈরথের ভিতর দিয়েই লিখে যাচ্ছি। ফলে অতৃপ্তিই ফলাফলরূপে মনবোর্ডে জমা পড়ছে।
রোবায়েত: আপনার ভাষা-ব্যবহারের টেকনিক কতটুকু আপনার নিজস্ব? এই সময়ে এত এত ইমেজিস্ট কবিতা লেখা হয়েছে যে ঠিক কী কারণে আপনাকে স্বতন্ত্র বলে চিহ্নিত করবো আমরা?
হামেদী: আপনি সম্ভবত আমার কনফিডেন্স যাচাই করছেন!? ওকে। শুধু ইমেজই আমার সম্বল নয়। কারণ চিন্তাকে ধারণ করতে পারে না, এইরকম ইমেজ আমি লিখতে চাইনি। প্রকৃতি ও মানুষের নিগূঢ় কোনো সৌন্দর্য, যাপনের বিশেষ কৌশল ও স্বাতন্ত্র্যে-একটা ভূমণ্ডলের রূপায়বয়বের স্মারকরূপে এই ইমেজগুলো গড়ে উঠেছে। নিছক সৌন্দর্য এখানে মুখ্য নয়, এর অন্তর্লোকে আছে গভীরতর কোনো অভিনিবেশ এবং প্রতিটা কবিতাই গড়ে উঠেছে টোটালিটি নিয়ে।
রোবায়েত: আচ্ছা, টোটালিটি ব্যাপারটা আসলে কী?
হামেদী: সামগ্রিক কোনো রূপ যেটা ক্রিয়েট করতে পারে। শুধু ইমেজই সেখানে প্রধান নয়, প্রতিটি শব্দ ও বাক্য পরস্পরের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে চলে যেখানে। তার গভীরে থাকে গোপন কোনো সুতা। এটা যেন ছাতার ডাঁটের মতো, যা পুরো কবিতাকে ধরে রাখে। সেই ডাঁটটা হল চিন্তা, যেটা অদৃশ্য থাকে। কাপড় হল ইমেজ, শিকগুলো হল শব্দ ও বাক্য। সবমিলিয়ে ছাতার অবয়ব বা কবিতা।
হাসনাত শোয়েব: আপনি অনেকদিন ধরে বিয়ে করতে চাচ্ছেন। আপনি বিয়ে করার জন্য এমন মরিয়া কেন? মানে বিয়ে প্রতিষ্ঠান আপনি কিভাবে দেখেন? আবার বিয়ের সঙ্গে কবিতা বা সাহিত্য চর্চার কোন যোগাযোগ বা অনুপ্রেরণা বোধ করেন?
হামেদী: বিয়ে তো ভালো একটা প্রতিষ্ঠান। জরুরিও। মানব জাতিকে ‘সাইজে’ আনতে বিয়ের বিকল্প নাই। এইটা হল জীবনের ভারসাম্য বিন্দু। জন্মের পরে বিয়েতে আইসা জীবন ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছায়, তারপর ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। মনে হচ্ছে, আমি একটা পাহাড়ের এক পীঠে দাঁড়িয়ে ভাবছি, অপর পীঠে কী যেন রয়ে গেছে। বিয়ে হচ্ছে সেই চূড়া, যেখান থেকে আমি অপর পীঠকে দেখতে পাব।
শোয়েব: তারপর কবিতাকে আমার মনে হয় আপনি অনেক একাডেমিক জায়গা থেকে দেখেন। সেটা কি আপনার একাডেমিক সাব্জেক্ট বাংলা ছিল বলে? আর কবিতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ আদৌ জরুরি কিনা?
হামেদী: বিয়ে করলে বুঝবো, সাহিত্য চর্চার সাথে এর সংঘর্ষ বা সম্পর্ক কতটা গভীর। আপাতত এইটা একটা এসাইমেন্টের মতো। যত দ্রুত পারা যায় শেষ করতে হবে। এইটা বেশ জটিল একটা প্রসেস আমাদের সামাজিক বাস্তবতায়। সেইটা শেষ কইরা শান্তিতে ঘুমাইতে ও কাব্য করতে চাই।
বাংলা সাবজেক্টের জায়গা থেকে দেখলে সাহিত্য চাঙে উঠবে। কারণ কোনো সাবজেক্টে সাহিত্য থাকে না। এইটা করে-টরে খাওয়ার সাথে রিলেটেড। অঙ্কও যা, বাংলাও তা। জয়ের একটা প্রশ্নের উত্তরে বলেছি, সাহিত্যের ছাত্র কিংবা শিক্ষক হওয়ার কারণে মুফতে কিছু বই পড়া হচ্ছে এই যা। আমার একটা স্বভাবগত দিক হচ্ছে, কোনোকিছুকে শেপের মধ্যে ভাবার প্রবণতা, একটা সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্যে চিন্তা করার অভ্যাস-যেটার প্রভাব হয়তো সাহিত্যবিবেচনার মধ্যে পড়ে। অন্যরা অন্যভাবে ভাবতে পারে। তবে আল্টিমেটলি প্রতিষ্ঠান লাগেই। প্রতিষ্ঠানিকীকরণ যেকোনো কাজেরই একটা পর্যায়। কবিতাও সে বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত ঐ প্রতিষ্ঠানের কেতার মধ্যেই ঢুকে পড়ে কিংবা প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়। আপনি যখন নয়া কোনো এস্থেটিক্স নিয়ে আসলেন, সেটা যখনই চর্চা শুরু হল- আলোচনা-সমালোচনা শুরু হল, আদতে তা প্রাতিষ্ঠানিকতার দিকে রওনা দিল।
মুখে বলে, তর্ক করে কবিতা এস্টাব্লিশ করা যায় না। কবিতা ইটসেল্ফ নিজের শক্তিতেই দাঁড়ায়। কবি মরে গেলেও ঐ কবিতাই কবির হাত ও মুখ হয়ে লড়াই করে।
ইলিয়াস কমল: একটা কথা বলে রাখি, যে কোনও যথাযথ জায়গায় এইটা রাখা যেতে পারে। ইতিহাস বা পরিসংখ্যান বলে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ছাত্র/শিক্ষকরা কবিতায় খুব একটা সফল না।
হামেদী: তাই তো দেখা যাচ্ছে। বরং খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, বাংলা সাহিত্যের খবরাখবর ঐ বিষয়ের ছাত্র ও শিক্ষকের চেয়ে অন্য নানাজনের কাছে বেশি পাই আমি।
শোয়েব: একটা সোসাইটিতে আসলে কবিতার কাজ কি? কবিতা না হলে কি ধরনেরর ক্ষতি হতে পারত?
হামেদী: আপাত মনে হয়, কোনো কাজ নাই। আসলে দৃশ্যমানতার জায়গা থেকে দেখলে, কবিতা ফালতু কাজ। কিন্তু এইটা অনেকটা স্লো পয়জনের মতো কাজ করে। আস্তে আস্তে নিজের কব্জার মধ্যে সোসাইটিকে নিয়ে আসে। সম্ভবত কবিতা মানুষ যা হইতে চায়, বলতে চায়, কিন্তু ভাষা ও যোগাযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে তা হইতে ও বলতে পারে না, কবিতা সেইটা হওয়াতে ও বলাতে পারে। ফলে মানুষ কবিতাকে গ্রহণ না করলেও, এড়াতে পারে না। আর কবিতাহীন সমাজ দুর্বল সমাজ। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মানুষের মতো রক্তহীন।
শোয়েব: ধরেন, কেউ যদি বলে আপনার কবিতা হয় না। তার উদ্দেশ্যে আপনার কি বলার আছে?
হামেদী: আগে তার চোখের দিকে তাকাব, বোঝার চেষ্টা করব কতটা সততার জায়গা থেকে কথাটা বলল এবং বলার মতো বোঝাপড়া আদৌও তার আছে কিনা। যদি দেখি যে, হ্যাঁ। তাহলে ব্যাপারটা আমলে নেওয়ার মতোই। আর ঐরকম ব্যক্তি না হলে, তার না বোঝার দিকে তাকিয়ে করুণার হাসি হাসবো। তবে, বুঝদার লোকও হয়তো এইরকম বলে ফেলতে পারে, সেইটা সাধারণত রুচির ভিন্নতা থেকে হয়। আর সেটা বোঝাও যায়। তবে, এসব ক্ষেত্রে বলার কিছুই নাই। কারণ মুখে বলে, তর্ক করে কবিতা এস্টাব্লিশ করা যায় না। কবিতা ইটসেল্ফ নিজের শক্তিতেই দাঁড়ায়। কবি মরে গেলেও ঐ কবিতাই কবির হাত ও মুখ হয়ে লড়াই করে।
ফারাহ্ সাঈদ: গত এক দশকে বাংলা কবিতায় কী কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে বলে মনে করেন?
হামেদী: বাংলা কবিতায় নতুন ফর্ম ও ভাষার যে নিরীক্ষা মূলত আশি থেকে শুরু হয়েছে, সেইটা অনেক বেশি সংহত হয়ে উঠছে এই সময়ে। ফলে এই সময়ে মেরিটের দিক থেকে প্রচুর ভালো কবিতা লেখা হইছে। বৈচিত্রও বেড়েছে অনেক।
ফারাহ্: ছন্দে লেখা কবিতা অনুবাদ করলে ঠিক কতটুকু মূল কবিতাটির অ্যাসেন্স বজায় থাকে?
হামেদী: এক ভাষার ছন্দ অন্য ভাষায় যথাযথভাবে ধরা যায় বলে মনে হয় না। ফলে যেটা দাঁড়ায়, কবিতাটা অনুবাদের সময় অনূদিত ভাষার অলংকারের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। অনুবাদকের পাঠই মূলত পরিবেশিত হয় তখন।
ফারাহ্: পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরা সমসাময়িক টেক্সট সম্বন্ধে জানতে পারে কি?
হামেদী: পাঠ্যপুস্তকে সমসাময়িক টেক্সট সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার সুযোগ নাই। আসলে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের গূঢ় উদ্দেশ্য আমার কাছে কখনোই পরিষ্কার হয় নি। সমসাময়িক চর্চা সম্পর্কে ধারণা না বইতে থাকে, না শিক্ষকরা দিতে পারেন। এইটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গুরুতর একটা সংকট মনে করি। এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসের ক্ষেত্রেও এই ধরনের স্থবিরতার চর্চা আমি দেখেছি। সমসাময়িকতার সাথে যুক্ত না হলে যে জ্ঞান আগায় না, এই বোধটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে এখনও প্রকটভাবে অনুপস্থিত। আপনি পদার্থবিদ্যা বলেন, সাহিত্য বলেন, দর্শন, অর্থনীতি বা ইতিহাস বলেন-একই চিত্র। এই কারণেই সম্ভবত আমাদের শ্রেণিশিক্ষা এত নীরস ও অনর্থ উৎপাদনকারী।
ফারাহ্: সাম্প্রতিক সময়ে লেখা কারোর টেক্সট দ্বারা কখনো অবচেতনভাবে প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত হয়েছেন কি?
হামেদী: মাসুদ খান, ব্রাত্য রাইসু, জহির হাসান, আন্দালীব, মাজুল হাসান, হাসান রোবায়েত এদের অনেক লেখাই নানা কারণে আমাকে বিভিন্ন সময় প্রাণিত করেছে। সমসাময়িকতার জায়গা থেকে বললাম। প্রভাবিত করেছে কিনা, সেটা তো আপনারা বলবেন।
শিমন রায়হান: হামেদী ভাই, অতি চর্চিত ও চর্বিত একটি বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করবো। তবে তা প্রাসঙ্গিক। আর কেন প্রাসঙ্গিক তা পরে বলছি। বিষয় হচ্ছে- ‘শিল্পের জন্য শিল্প ও জীবনের জন্য শিল্প’ বিতর্ক। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি এরকম বিভাজনে বিশ্বাস করেন কি?
হামেদী: এইটা আসলে পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত ধারণা। আমাদের এখানে সাহিত্য জীবনের অংশ হিসেবেই রচিত হত। বিকশিতও হয়েছে ঐ প্রক্রিয়ায়। চর্যাপদ বলেন, মঙ্গলকাব্য বলেন, বৈষ্ণব পদাবলী, কিংবা পূর্ববঙ্গ গীতিকা -এগুলোর সাথে জীবনের সম্পর্ক খুব গভীর। এবং শিল্পমানও এখানে সমুন্নত। আধুনিক সময়ে এসে এই তর্কটা আমদানি হয়েছে। এইটাকে আমি খুব কাজের বিষয় মনে করি না। আমি মনে করি, যাপনের সারোৎসার থেকেই সাহিত্য সৃষ্টি হয়। এবং সেখানে শিল্পমান অক্ষুণ্ণ থাকতে হবে। তার উদ্দেশ্য কী সেটা জরুরি না, জরুরি হচ্ছে সৃষ্টি হিসেবে সেটা দাঁড়াচ্ছে কী না এই প্রশ্নটা।
শিমন: আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিশেষ করে বামপন্থী বন্ধুদের কাছ থেকে প্রসঙ্গটির অবতারণা হতো খুব। তারা এক প্রকার প্রমাণ করতে চাইতেন আমরা সবাই যে প্রকারের সাহিত্য রচনা করছি তা শুধু ‘শিল্পের জন্য শিল্প’। জীবনের জন্য শিল্প হতে হলে লেখকের যে ভূমিকা, তা তারা নির্ধারণ করে দিতে চাইতেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আপনি ছাত্র রাজনীতি করেছেন আবার কবিতাও লিখেছেন। দুদিক থেকে আপনার অভিজ্ঞতা কী রকম ছিল?
হামেদী: রাজনীতি এবং কবিতা তথা সাহিত্য তার তার মতো করে করতাম। কখনো কখনো ওভারল্যাপ হতো। তবে সেটা স্বতঃস্ফূর্ততা থেকেই। আমার রাজনৈতিক বন্ধুরা আমার সাইকোলজি বুঝতো। ফলে আমার লেখার উপর তাদের হস্তক্ষেপ ছিল না তেমন। তবে প্রত্যাশা ছিল। আসলে শিল্পী হচ্ছে এমন এক জাত, যারা নিজেরাই নিজের গলায় ফাঁস লাগানোর জন্য মরিয়া, ফলে তাদের গলায় আলাদা করে তত্ত্বের ফাঁস লাগানোর চেষ্টা ভালো কিছু তৈরি করে না। শিল্পীকে সৃষ্টির স্বাধীনতা দেওয়ার পক্ষপাতি আমি। অন্য কেউ বিষয় নির্ধারণ করে দিবে, কবি লিখবে-এভাবে সাহিত্য হয় না।
শিমন: তাহলে মার্ক্সবাদীদের সঙ্গে শিল্পীদের দ্বন্দ্ব কী অনিবার্যই থেকে যাবে? আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নে বরিস পাস্তেরনাকসহ অনেক কবি ও লেখকের সঙ্কটের কথা জানি। ভারতবর্ষে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও শেষোব্দি পার্টি করতে পারেননি।
হামেদী: এইটা প্র্যাকটিসের সমস্যা। বাস্তব পরিস্থিতিতে কেতাবি সিদ্ধান্ত বা ফর্মুলা ফলানো ঠিক নয়। স্থান, কাল, পাত্র ধ্রুব ধরে রাজনীতি হয় না। ‘গ্রহণমূলক রাজনীতি’ মার্কসবাদ তথা যে কোনো মতবাদের জন্যই ভালো। মানুষের জন্যও কল্যাণকর। এই কারণে রাজনৈতিক কর্মীদের প্রচুর কবিতা পড়া উচিত, তাতে কল্পনার প্রসার ঘটবে এবং নানা তল থেকে জগৎ ও জীবনকে দেখার দৃষ্টি তৈরি হবে। রাজনীতির জন্য এই সংবেদনশীলতা ও সমন্বয়বাদীতার চর্চা খুব জরুরি। তবে দ্বন্দ্ব থাকা তো ভালো। মার্কসবাদ নিশ্চয়ই দ্বন্দ্বকে অনুমোদন করে। হা হা হা।
শিমন: বটে। রাজনৈতিক কর্মীদের কবিতা পড়তে বলার পরামর্শটা মজার। লেখকরা পাল্টা ‘রাজনীতির জন্য রাজনীতি’ ও ‘জীবনের জন্য রাজনীতি’ বিতর্ক মার্কেটে নামাতে পারেন।
হামেদী: এই বিতর্কের আইড়িয়া তো দারুণ! সময়োচিতও বটে।
শিমন: প্রথম বই ‘মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ’ থেকেই মোটামুটি আপনার একটা কাব্যভাষা দাঁড়িয়ে গেছে। আসন্ন বইয়ে এটি আরো পরিষ্কার হবে আশা করি। আপনার কবিতায় যে ফোক ট্রিটমেন্ট তা কি একেবারে যাপিত জীবন থেকেই উৎসারিত নাকি উদ্দেশ্যমূলক?
হামেদী: এইটা আসলে নিজের মধ্যেই ছিল। বেড়ে ওঠা তথা যাপিত জীবন থেকেই নিশ্চয়ই এটা পেয়েছি। লিখতে লিখতে নানা উদ্দেশ্য-বিধেয় দিয়ে আসলে একটা তাত্ত্বিক গ্রাউন্ড দাঁড়িয়েছে। একসময় আপনি, রজত শিকস্তি বলতেন, পরে জয়, রোবায়েত, হুজাইফা এপ্রিশিয়েট করলো যে, আমার হাতে এইগুলি ভালো খেলে। এইভাবে আগানো আর কী! ‘ফোক’ বলে আসলে একে প্রান্তে ঠেলে দেওয়ার কিছু নাই। এইগুলিই আসলে আমাদের মূল ধারার সামগ্রী। বাঙালির বড় অংশ এখনও এই ধরনের সংস্কৃতি তথা প্রেক্ষিতের মধ্যে যাপন করেন।
শিমন: তরুণরা যারা মহানগরে বসে লিখছেন তাদের লেখায় মহানগর নেই সেই অর্থে। আবার তাদের লোক উপকরণগুলোও অনেকাংশে আরোপিত মনে হয়। আপনার কী মনে হয়। আপনার কী মত?
হামেদী: বাংলাদেশে ঐ অর্থে মহানগরের মহানাগরিক তেমন নাই। বেশিরভাগের মনেই এক টুকরো গ্রাম। আর গ্রাম খুব দূরেও নয়, শহর থেকে ঘন্টাখানেক ছুটলেই গ্রাম। এখানে শহরমধ্যে গ্রাম, গ্রামমধ্যে শহর ঢুইকা আছে। ফলে এই দোদুল্যমানতা তাকে সমস্যায় ফেলে দেয়। এইটাকে ডিল করা সেয়ানা লোকের কাজ। আর আরোপন হয় মূলত চিন্তা, অনুভব ও বোঝাপড়ার সমস্যা থেকে।
শিমন: প্রযুক্তিজাত বিষয়-আশয়কে অনেকেই ধ্যানভঙ্গকারী মনে করেন। আপনি কি সমসাময়িকদের লেখায় এর প্রভাব ও নয়েজ লক্ষ্য করেন?
হামেদী: প্রযুক্তির এই জায়গাটাকে ইতিবাচকই মনে হয় আমার। যোগাযোগের সমস্যাটা প্রায় নাই-ই হয়ে গেছে। আমার তো মনে হয়, ফেসবুক না থাকলে আমার ব্যাক করা কঠিন হতো। অনেক ভালো কিছু পেয়েছি। নয়েজ সব জায়গায়ই আছে। বনেও আছে পশুদের হুংকার। পাশাপাশি থাক এসব। প্রকৃত ধ্যানী জনসমুদ্রের মধ্যেও ধ্যানমগ্ন হতে পারেন।
শিমন: আপনার বেশ কিছু কবিতা আমার প্রিয়ভাজন। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে- আমার ব্যাকডেটেড আব্বা, শহরে কোথাও ভালো রান্না হচ্ছে না, প্রলাপ ইত্যাদি। ‘প্রলাপ’ কবিতাটি আমার মাথায় আটকে আছে- গমক্ষেত। প্রিয় গমক্ষেত, লুট হয়ে যায়। এই নামে আপনাকে একটি বই করার অনুরোধ করেছিলাম। বলেছিলাম নামের গুণেই ডাবল বিক্রি হবে। তরুণীরা বই কিনে স্টক ফুরিয়ে ফেলবে। এই অবসরে আবার অনুরোধ জানাই।
রোবায়েত: এইটা আমারও অনুরোধ। ‘তামার তোরঙ্গ’-এর চেয়ে ঐটা, লুট হয়ে যাওয়া বেটার।
হামেদী: রাশেদ ভাই (কবি রাশেদুজ্জামান) ও রোবায়েতও একই মন্তব্য করেছে। হয়তো করেও ফেলতে পারি কখনও।
শিমন: গমক্ষেতের মধ্যে একটা জটিল আবেদন আছে। ফ্রয়েডীয়।
জয়: হামেদী, সেতুদির কী খবর? ‘মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ’ পর্যায় থেকে এই পর্যন্ত সেতুদির কী কী পরিবর্তন হয়েছে?
হামেদী: এই চরিত্রটা বাস্তব চরিত্র। তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন। যদিও তার সাথে কখনও কথা হয় নাই আমার। কল্পনার মধ্যেই রয়ে গেছে। এবং এরপর বহু চরিত্রের আসা-যাওয়ার ভিতর দিয়ে থিতু হওয়ার মতো মেঘের শামিয়ানার নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু কালচক্রে সেসবও আজ গল্প ও স্বপ্ন, অধরা ও অনাঘ্রাত-সুদূর।
জয়: ‘মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ’ থেকে ‘তামার তোরঙ্গ’-এ আসার জার্নিটা কি সেসব বিয়োগ করেই?
হামেদী: এইটা আসলে ভাবি নাই ঐভাবে। এখন মনে হচ্ছে কী, কিছু একটা আমি ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলাম, সম্ভবত। এই জন্যই কিনা মন গ্রাম্য জীবন-প্রকৃতির ঐশ্বর্য ও মায়ার মধ্যে শান্তি খুঁজছিল।
জয়: ধামাচাপাটা কী দিতে চাইছিলা মনে হয়? তোমার কী মনে হয়, নগর তোমারে নিতে বা ধারণ করতে পারে নাই?
হামেদী: ব্যক্তিজীবনের নানা টানাপোড়েন, অপ্রাপ্তি। কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি। আমিই সম্ভবত নগরকে নিতে পারি নাই। কারণ আমার কাছে এইগুলিরে নগরই মনে হয় নাই। আর আমাদের নাগরিকতাকে সম্ভবত নতুন তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করার সময় এসেছে। এবং আমাদের ভূ-বৈশিষ্ট্যকে ধারণ উপযোগী নগরসভ্যতা বিকাশের তত্ত্বায়ন করাটাও জরুরি হয়ে পড়ছে।
জয়: আমার মনে হয়, ‘তামার তোরঙ্গে’ তোমার যে ভাষা আর জগৎ তৈরি হয়েছে, তা তোমার কবিতার জন্য বিশেষ কিছু। আমাদের সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ।
হামেদী: আমাকে কথা বলবার সুযোগ দেওয়ার জন্য এবং দারুণ সহযাত্রার জন্য তোমাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
মোস্তফা হামেদী
জন্ম ১৯৮৫, ২৭ আগস্ট, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। প্রভাষক, সরকারি মুজিব কলেজ, নোয়াখালী।
প্রকাশিত কাব্য: মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ (২০১৫), তামার তোরঙ্গ (২০১৮)