আপনি কবিতা লিখতে শুরু করলেন কিভাবে?
সাহিত্য করার প্রবণতাটা আমার তৈরী হইছে আমার বাবারে দেখে। অনেকটা জ্যানেটিকেলি। আমার বাবারে দেখতাম, বেকার মানুষ সিগারেটের পর সিগারেট জ্বালিয়ে রাত জেগে জেগে লিখে যাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে কই যেন কোথায় পালিয়ে যেতেন। তারপর কয়েকমাস পর বই-পুস্তক নিয়ে ফিরে আসতেন। তো এভাবে বাপের লেখালেখি আমার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে পরে। প্রথম কবিতা লেখার ইতিহাস আমার সম্ভবত সেভেন-এইটে পড়াকালীন। প্রথম কবিতা প্রকাশও ওনার হাত দিয়ে।
আপনার কাছে কবিতা মানে কি?
লেখালেখির জায়গাটা আমার কাছে অভ্যাসে পরিণত। কবিতা বিষয়ে আমি তেমন কিছুই ভাবি না। ভাবলেও তা ছাড়া ছাড়া। এখন ভাবছি— কবিতা মূলত একটা জ্ঞানফল। এই জ্ঞানফল আপনি লাভ করবেন বস্তুগত জ্ঞানের ভেতর দিয়ে। ধরা যাক, জীবন আসলে এক গোলকধাঁধা। বহুজন বিবিধ উপায়ে বহু এ্যাঙ্গেলে তাকে অবজার্ভ করছে। আমিও করছি। এই দেখার ফলে, অনুধাবন ও অনুধ্যানের ক্রিয়ায় আমার ভেতর সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিক্রিয়া। অধীত জ্ঞান ও চেতনার সংমিশ্রণে এই ঘূর্ণত চক্রবালে আমিও মেলাতে চেষ্টা করছি স্বীয় পার্চমেন্ট। কবিতা আমাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করছে কেবল। প্রতিটা ধুলিকণা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কবিতা মূলত একটা ঘোর। সে আসলে কিছুই প্রকাশ করে না। ভেতরে ভেতরে গোঙাতে থাকে।
কবিতায় কোনো বিষয় থাকা কতখানি জরুরী?
কবিতায় শব্দ থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এবং তা যথাযথ ও যথাস্থানে।
সার্থক কবিতা হয়ে ওঠার জন্য একটি কবিতায় কি কি থাকা জরুরী মনে হয়?
সার্থক কবিতা হলো জীবনানন্দের বনলতা সেন বা আট বছর আগের একদিনের মতো। শিল্পের জায়গাটাতে তাকে সফল হইতে হবে। যেমন, ভ্যাগ গঘের সানফ্লাওয়ার; হলুদ রঙা একটা সূয্যমুখী তাকানোর সাথে সাথেই জীবনের দিকে রিফ্লেক্ট করছে। তাঁর মেঘের শ্যাপটা দেইখেন, সম্পূর্ণ আলাদা। এখন গঘের যে ব্যক্তিজীবনাচার আর তাঁর শিল্পের যে রঙ এটারে মিলায়া দেখেন। অর্থাৎ যে শিল্প মানুষকে সম্পূর্ণ কাতর ও কাবু করে চূড়ান্ত পর্যায়ের স্বাদ ও ঘোর তৈরী করে তাই সার্থক।
আপনার কোন বই প্রকাশ হয়েছে?
হাঁ। পনেরর বইমেলায় ‘কানা রাজার সুড়ঙ্গ ’ নামে একটা কবিতার বই পাবলিশ হইছিল। ষোলতে খড়িমাটি প্রকাশনী পুনরায় তার একটা রিভাইসড এ্যাডিশন করছে।
কবিতায় ছন্দ থাকা না থাকার তর্কে আপনি কোন পক্ষে, কেন?
ছন্দে লেখা যেমন প্রচুর ভাল ও বাজে কবিতা আছে তেমনি গদ্যঢঙে লেখা প্রচুর ভাল ও বাজে কবিতা আছে। মূলত প্রকৃত কবি সেইজন যে ছন্দ না শিখেও লিখতে পারে ছন্দোবদ্ধ কবিতা। আপনি যখন আনমনে গান করেন তখন অজান্তেই তুড়ি মেরে তাল দিতে চেষ্টা করেন। বেশিরভাগই তা করে। এই ছন্দটাও অবচেতনভাবে আপনার ভেতর ঘটে যাচ্ছে। গদ্যঢঙেও ছন্দের একটা আমেজ পাওয়া যায়। এখনকার ছন্দ বিষয়ক বালখিল্যতটা অনেকাংশে স্কুল বালকদের ঝগড়ার মতো। মানে, আপনি খুব গণিতে ভাল ফলে আপনি বলতে চাইতেছেন, আপনার মতো অন্যান্যদেরও গণিতে মাস্টার হইতে হবে। এটা জোরপূর্বক। আপনি আপনার ইচ্ছাধীন হোন এবং নিজের লেখাকে ভালবাসতে শিখেন। তাই যথেষ্ট।
আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশের কবিতায় পরিবর্তন আসছে?
বাংলা কবিতার অবস্থান বলতে গেলে এখন তুঙ্গে। পরিবর্তন হরহামেশাই ঘটছে। যেসব শব্দ বা চিন্তাদর্শ তৎকালীন কবিরা ব্যবহার করার সাহসও করেনি বা কেবল লিখে গেছে স্লোগান বা বিষয়ভিত্তিক কবিতা; এই সময়ে এসে বর্তমান দশকের কবিরা যাবতীয় বদ্ধকরণ থেইকা কবিতারে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে। কবিতার ট্যোটালিটির জায়গাটা ধরার প্রচেষ্টা আমাদের সময়ের কবিদের; আমারে মুগ্ধ করে রাখে। একটা বিবর্তন তো থাকেই সবখানে।
একজন কবিকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে কোন বিষয়টি?
একজন কবি এমনিতে সমাজের অনেকের চেয়ে আলাদা। সমাজে থেকেও সে যেন সমাজ বর্হিভূত-আগন্তুক। একজন ফুটবলার বা একজন গায়ক বা স্কুল টিচার যেভাবে সমাজের অন্যান্যদের সাথে মিলেমিশে চলতে পারে, কবি পারে বলে মনে হয় না। আর এটাও সত্যি, এক কবি আরেক কবি হইতে সম্পূর্ণ আলাদা। কেননা সে আলাদা হইতেই চায় সবদিক দিয়েই। তার চিন্তা-শব্দচয়ন-ভাষা-দেখা-ভঙ্গিই তারে আলাদা ভাবে উপস্থাপন করে।
সাহিত্যে রাজনীতি ব্যাপারটাকে কিভাবে দেখেন?
সাহিত্য রাজনীতি ব্যাপারটা ভাল। এটারে পজিটিভলি দেখা যায়। সাহিত্য চর্চা যে অব্যাহত আছে তা বুঝা যায় তার রাজনীতি দিয়ে। যেহেতু সাহিত্য কম্যুনিকেটিভ। রাজনীতি থাকা মানে হলো সাহিত্যের বহুভাবে চর্চা হওয়া আর না থাকা মানে কনভেনশনাল। সাহিত্যে রাজনীতি নিয়া আসা এবং কোন্দল তৈরী করাটা সহজ নয় কিন্তু। এর ভেতর দিয়ে নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটে।
বাংলা কবিতায় কলোনিয়াল হ্যাংওভার বিষয়ে আপনার মত?
আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকার বর্তমান সাহিত্যের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখব, তাদের সাহিত্য দাঁড়ায়া আছে পোস্ট কলোনিয়াল হ্যাংওভারের ভেতর দিয়ে। কিন্তু তাদের কাজের তুলনায় আমাদের বাংলা সাহিত্যে এই ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা খুব একটা চোখে পড়ে না। তবে এমন না যে, কাজ করা হয়নি। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, আমাদের একটা দেশ ও নিজস্ব ভাষা আছে। কিন্তু কলকাতা তাদের কথা সাহিত্যে দেশকে আনতে পারে না। তেমনি আফ্রিকা তাদের নিজস্ব ভাষাকে। আমাদের এখানে দুইটাকেই রিপ্রেজে্ন্ট করা যাচ্ছে। আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর মতো প্রচুর উপাদান আছে। তা কবিতায় হোক বা কথাসাহিত্যে।
আপনার প্রিয় কবি সম্পর্কে জানতে চাই। কেন তিনি প্রিয়?
প্রিয় কবি একদম নেই আমার। আইডলও। দুইদিন পর পর একেকজনরে ভাল লাগে। আমি কেবল কবিতা পড়তে পারলেই খুশি। অনলাইনের যুগ আসার পরে বিভিন্ন জনের প্রচুর কবিতা পড়া হয় দৈনন্দিন। কারও দশটা কারও বিশটা; এভাবে। তবে কারও কবিতার বই তেমন একটা কেনা হয় না এখন।
উপল বড়ুয়ার দশটি কবিতা
কামরাঙা
একটি উজ্জ্বল কামরাঙা নিজেকে বিভাজিত রাখে ঢেউ উতলানো সন্ধ্যায়। সমগ্র মতবাদের দাঁতে দাঁতে ভেঙে পড়া হে তোতলানো গার্ডার— জীবন একটি সংখ্যারও অনধিক। এহেন এ্যাহুদী ফল তুমি কামরাঙা— বেহুদা গান থেকে খুলে ফেলছো হারমোনিয়ামের যাবতীয় যাতনা। যদি শাদা ভাল্লুকের পিঠে রে রে তেড়ে আসে ভাবধারার সন্তান; যদি সে পড়ে থাকে মরে দুঃখভারাতুর যতি চিহ্নের তলে; ভাষালুপ্তির দেশে নদীতে বলকে উঠে লাইট; লাইটেতে আলো; আলোতে কামতাপুরী; পুরীতে বহ্মদত্তি কামেতে হয় রাঙা! যদিচ কামরাঙা জ্ঞানেরও অধিক। অধিকেরই সাম্রাজ্য।
আপেল
আমারে মনে রাইখো আপেল
তোমার পরিতৃপ্তির দিনে ধার
দিয়েছি আমার দাঁত।
তুমি খোদার আপেল বোঁটাসহ
ঝুলে থেকে বিব্রত সবুজ গাছে
জাগায়া দাও লোভ।
আমি ধরতে যাই; ধরাতে যাই
আলগা করি পাতা খুব যতনে
সমতে মারি ডুব।
এই ধরাধামে যতো ফুল ফল
সবার তো কর্তৃ তুমি
একমাত্র আপেলসম রাত।
ফলস্বরূপ
ধরো এসব কালচারাল থেইকা দূরে
আমরা দৃশ্যযাপনের চিত্র নিয়া বসে নখ খাচ্ছি।
ধরো, একটা এ্যাক্সেলেটর নিজের নাক
ঘষে দিচ্ছে মাটিতে আর আমরা বহুবিধ
বাতাসের সাথে উড়ায়া দিতেছি বিপুল বেগে
পিত্যেশ। আমরা, মনে করো এ্যাক্স এ্যান্ড ওয়াই
দ্বয় লুনেটিক ছিঁড়তেছি ঘাস; সবুজ গন্ধের ঘাস।
সিগারেটের রিংটোন ছড়ায়া দিতেছি বায়ুমন্ডলে
কিন্তু পাগলাদেরও তো থাকে শীতে আজানু
ওভারকোট—
ঘুম ঘুম লাল চোখ; ইরোটিক কথাবার্তা
তারচে’ আমরা স্তনের দিকে তাকায়া
তাকায়া এত ক্যান মৃদু কাঁপতেছি!
ফ্লাইওভারের ভারী ছায়াতলে বসে
কতো কিছু ভুলে থাকা যায় নিশ্চুপে
একটা জেব্রা ডিভাইডারকে দেখি—
এস্পার-ওস্পার করে দিয়েছে যাবতীয়
গতি। আমাদের দীর্ঘাঙ্গী ছায়ারা
নেমে আসে উড়ালসেতু হ’তে।
উড়ালসেতু আজও মানুষের হৃদয়ে
সেনসেশনাল আজও গুরুতর রহস্য
হয়ে কানাকানিতে ফেটে পড়ে তীব্র।
এমনও তো হতে পারে যে প্রতিটি
ওভারব্রীজের মালিক একজন পাগল!
বা যতোই শ্লথের কথা ছড়িয়েছে
স্পিড ব্রেকার তারচে’ বেশি মানুষ
দলে গেছে তার নিপলের চূড়া।
আজও বিস্মৃতি জ্ঞানে আড়ালে দাঁড়ায়া
আঁধারে শ্লেষের আলো মেখে গার্ডারের
দল ভেঙে ভেঙে পড়ে সবজিক্ষেতে।
তারও দূরে বিটুমিন ও কংক্রিটের
চেতনা মিশ্রিত জ্ঞান নিয়ে তোমরা
পার হয়ে যাও স্টেশনের কোলাহল।
আমারে কেন তথা যাত্রী ভেবে বাড়ায়ে
ধরো হেডলাইট হে মাতাল টেম্পু ড্রাইভার?
কতো আলো ঝরে যায়; কতো সন্ধ্যাবধি
সিগন্যালে মিশে যেতে যেতে সংকেত জানায়—
নীল ট্রাফিকম্যান নিজের বাহুতে ?
একটা লোনলি রোড ডিভাইডার কোমর
বাঁকিয়ে চলে গেছে আন্ডারকন্সট্রাকশনে
একটা ভারী এ্যাক্সেলেটর নাক ঘষে ঘষে
আমাদের পিষে দিয়ে যায় রাস্তার সাথে।
আমাদের ডিলেমা বাড়তে থাকে রাস্তায়
আমাদের সমস্ত বিবাদ ফুটপাতে চা খায়।
শীতের দিন
আমাকে টানছে না আর শীতের অরণ্য
ওক ছায়ারা; ঘুমপাহাড়ের নীচে তোমার
মতো হে বিরহী যক্ষ নাকি মেষপালক
আমিও কবে হারিয়ে ফেলেছি রোদ কয়েন!
চতুদ্দিসে মনোটোনাস শীতকাল রিলকে
ট্রামে- ওয়ালে নোটিফিকেশন জুড়ে ওড়ছে
শীতের পাতা; কেমন বয়স্ক সব দিন
পার হচ্ছে ঝাড়খন্দ হয়ে নদীয়ার দিকে
ডালিম বিচির মতো একেকটা রাত দেখো
কীভাবে নেমে পড়েছে ম্যারাথন ট্র্যাকে।
দি অ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনার
কেশর ফুলানো সমুদ্রতল
ডুবো জাহাজের খবর ভুলে
এগিয়ে দিলে বালির সুড়সুড়ি
এ্যালবাট্রসের শোক গাথা ছাড়া
আর কী সংবাদ তুমি আনলে
নাবিক বিবর্ণ মলিন পোশাকে?
`Alone, alone, all, all alone,
Alone on a wide, wide sea!’
ভোজ ও বাজি জ্বলে উঠল চতুদ্দিস
চার্চ ইয়ার্ড তোলপাড় করা নাচে
আজ মাতায় ভেতরের উলুধ্বনি
পাতলুন গুটানো ধুসর বুড়ো তবে
মুখোমুখি তাদের কাউকে থামাও
শুনাও ওদের—একেকটা হিংস্র দিন
কেটেছে কী দুঃসহ অহর্নিশ—ত্রস্ত তুমি
অভিশাপ ঝুলিয়ে গলায়- পিপাসার্ত
নাবিক—ভয় ও ঘোরের ভেতর
কীভাবে শুনেছিলে দুই দেবতার স্বর
খুনের পর যখন কেউ ভালবাসতে
শুরু করে তুচ্ছ–খুটিনাটি; প্রেরিত
সকল জীবে স্বয়ং এ্যালবাট্রস
বয়ে দেয় ছায়া ও অনুকুল হাওয়া
`All things both great and small
For the dear God who loveth us’
যদি জানতে সঞ্জীবের মতো কোন
পুনরুজ্জীবক মন্ত্র অথবা শাস্তা
যীশুর ন্যায় হতো যদি পয়গম্বর
শেষ এ্যালবাট্রসের রেজারেকশন
রোহিনী রোহিনী—ডাকে যদি একবার
কামদগ্ধ প্রিয়তমার পাশে অন্তত
সমুদ্রভেদে কাটতো কিয়দংশ!
পৃথিবীজুড়ে আজ কতো না আয়োজন
ভেস্তে যাচ্ছে নিরর্থ—নিঃসঙ্গ
অবর্তমানে এক ভুতুড়ে জাহাজে
যদি একবার খসে পড়ে অভিশাপ
সমস্ত গান লুটাবে কণ্ঠ ছিঁড়ে
লং শটে স্থির জাহাজ; পাল
যার ভেঙেছে তুমুল বাতাস আর
রাগী সূ্য্য। সমবধানহীন সময়
যেন দিন-রাত্রি ছাড়া কিছুই কোথা
করে না অনিয়ম। জলও অবিচল।
সন্ত নাবিকগণ—সারথি তোমার
শ্মাশ্রুমন্ডিত বিধ্বস্ত নাবিক সমস্ত
চতুরাশ্রব ক্ষয়ে যারা অতঃপর দেহ
করে নিথর নিজেদের শিয়রে এসে
দাঁড়ায়—নিজস্ব দেবদূত।
তখন তোমার ধনুকে নেই বিগত
টংকার। বায়ু বিরুদ্ধ স্যাটায়ার
শরীরের দ্বিগুন দৈর্ঘ্যের অভিশাপ
ঝুলিয়ে নিশ্চল শুয়ে আছো পাটাতনে
একা—বয়স্ক করুণ শীতমুদ্রায়
দুই দেবদূত নিঃশ্বাস ভাঙে ঘাড়ে
তুমি তাদের জেনেছো পাপ ও পুণ্য
ধর্মের ম্যাটাফর।
আয়ুফল
বিসংজ্ঞ দিন আজ লুটায় ধুলোয়
মিথ মুলা মদে চুরমার চোখ; তবু
আমাদের নিয়ে চলে বয়োজীর্ণ বায়ু
জাহাজ— নেক্রোপোলিস নগরে।
ফারাও আর ফরা অভিমুখে মুখর
বন্দরে কতো মাতাল সাধু পেয়ে গেল
বাহু-বন্ধনী; টীকা-টীপ্পনী- ভালগার
জীবনের। দৈনন্দিন খেরোখাতায়
ব্যস্ততা ফুলে ফেঁপে দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে
শার্টের কলার; নড়বড়ে ব্যাকবোন
দুই কাঁধে কতো সহজে দুই পা নেড়ে
চলেছে বাদী-বিবাদী দুই টিকেট চেকার।
গুহার ভেতরে আরো গুহা কতোদূর
ঘুরে ঘুরে তোলপাড় করা মধুবন
তুমি তা জানো না জয়লতা; প্রতিটি
সন্ধ্যা শেষে কীভাবে বাঁচে ডন জুয়ান।
আমাদের আয়ুফল শেষ হয়ে আসে
দ্বিধাযুক্ত জ্ঞানে যদিও ব্রহ্মবিহার
পেতেছি অমরাবতী তীরে অতঃপর
তক্র ছেড়ে আমারো চাই রিপুর দমন।
প্রত্যেকে একা একা প্রত্যেক বুদ্ধ
নিজেরে আকাশমার্গে করে উৎক্ষিপ্ত।
আমার মতোই হুবহু এক ডামির
হাতে নাম-রূপ-সংজ্ঞার পার্চমেন্ট
হুইসেল শোনার মুহুর্তে ছাড়তে
হবে জেতবন; মৌন স্যানাটোরিয়াম।
সিনামিনের স্মৃতি
তৃতীয় বিশ্বের সকল তরুণ বস্তুত বিপ্লবী। কিন্তু তাদের মাত্র একটি হাত। আর একটি পা জিম্মি। র্যাগার তালে তালে তারা কেঁদেছিল বহুদিন। এখন তারা বুঝে— হ্যাডব্যাং কতোটা সিডেটিভ। আর একদিন ‘তাহারা‘ আমার কাছে পৌঁছানোর আগেই নিজেদের পার্শ্বচিত্র ভরিয়ে তুলেছিল ইন অ্যা রিলেশনশীপে। তারপর নিজেদের ফেইক অভিব্যক্তিমূলক পাজামার তলায় ভয়ে গোপন রাখতে চেয়েছিল মৃত মাছ হারানোর শোক। তবু হে বিট্রেয়ার চাঁদ; গ্রহের অপভ্রংশ; তুমি বলে দিও তাদের— রকোহেলিক বুদ্ধের মতোন আমি তাদের কতোটা ভালবাসি।
সন্ধ্যার দিকে
যে সকল বিষাদকে ভেবেছো সন্ধ্যা
মৃতগান— অন্ধরাজ নামার আগে
দেখো ফিরছে দোভাষী বিট্রেয়ার চোখ
ইন্দ্রিয় খুলে রেখে চুপচাপ চলো—
হৃদয়কে করি আরো বিসংজ্ঞ বাদামী
এই ম্যাড়ম্যাড়ে সন্ধ্যায়।
হাওয়াভর্তি পাতা বাতাসে ওড়ছে
অন্তত আমাকে নাচতে দাও তার পাশে।
আমাকে নাচাও হাওয়া—
মুগ্ধ করো পাপড়ি যেভাবে মেলে
ধরে স্তন ভ্রমরার মুখে।
দেখো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে রেণু
তুমুল উৎসবে; ক্লান্ত প্রাণ এখানে
সমাহিত করে শুনে যাও কিছু
পত্রাঘাত ভায়োলিন তবে।
দরজা খোলার আগে মুমুর্ষু সুর
চলো পেরোয় ডোরাকাটা চেকপোস্ট।
বিজ্ঞাপিত দিন আজ ছিল নড়বড়ে
আমাদের দিন গেছে ওয়াইন ও উইডে।
তারের পেজগিতে পা ঝুলিয়ে একটি
কাক খুব গাইছিল দেশাত্মবোধক
তখন সন্ধ্যা চুলকায় পাছা তার।
এসব দিন অপরাধী পায়ে ঘুরে ফিরে
গ্যাবার্ডিন হতে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে
তাঁতিয়ে দেয় শ্লাঘা—বিদ্ঘুটে চাঁদঘড়ি
আমি জানি তারে ঘৃণা ও প্রেমে প্রতিদিন
যেমতে জেনেছে তারা আমারে খুউব।
দরজা খোলার আগে মুমুর্ষু সুর
চলো পেরোয় ডোরাকাটা চেকপোস্ট।
ছাদেতে তখন দোল মারে নারিকেল
তরবারি আর একটা স্কার্ফ দড়িতে
ফাঁস খেয়ে আওড়ায় ডেনিমের স্মৃতি।
এসব সন্ধ্যা মূলত রগচটা— ফুঁ’য়ে
বায়ুসিদ্ধ পাজামার তলে সাঁতার
কাটে। তবু হুডের ভেতর তাদের
গুণগুণ ধ্বনি— ভুলে যাওয়া ফার্স্ট
স্ট্যাঞ্জা— হাই তুলে ছাড়ে ধোঁয়া।
এইরকম সন্ধ্যায় রেইনট্রির নীচে
চুপিসারে তারা অন্ধকার আঁকে।
দরজা খোলার আগে মুমুর্ষু সুর
চলো পেরোয় ডোরাকাটা চেকপোস্ট।
কালকেতুকে
ফিরে যাবো কালকেতু পুন তপোবনে
নিষাদবৃত্তি ছেড়ে পারব না আমি
চাঁদ হয়ে ভাসাতে বাণিজ্যবহর
ফিরে যাবো ব্যাধযুগে; গুহার আঁধারে
আয়ুরেখা ধরে এই দূর বনে যদি
মুগ্ধ হই গেংখুলীদের গানে- সারা
রাত তবে কেটে যাক মিথে আর
মদে- হরিণীর শীৎকারে। জেনেছি
পৃথিবী বহুদূর চলে গেছে আরো এক
নক্ষত্রের কাছে; আরো বহু প্রেম তাকে
চুরমার বাণে করেছে অস্থির ফের
অধীত জ্ঞানে বহু জলে ভেসে বেহুলা
পরণে থান ম্লান করে ইন্দ্রের সভা
পূর্বে যারা সময়কে বেঁধেছে কাটায়
কথাকে দিয়েছে যন্ত্ররূপ তার গুম
হয়ে যাওয়া গানের দরজা নাড়াতে
আমার ভেতর জ্বলছে জুমপাহাড়
নাকশা ফুলের দেশ- যেখানে পুরুষ
মুর্চ্ছা রবে আর নারী হবে ধনপুদি
চুঙুলাং দিনে জেগে উঠবে চোলাই
জুমক্ষেত জুড়ে উল্লাসরেণু বাতাসে
এহেন মহোৎসবে মেঘডুমুর বনে
গোত্রপ্রধান ছুটবেন শিকারে ধনু
সহকারে- আগুন সহযোগে পুরুষ
ও নারী- নারী ও পুরুষ গেংখুলীর
গানে মাতোয়ারা হবে নাচে আগুনের
কাছে। এমন জীবন ছেড়ে বলে দেবী
ফুল্লরা—আমার রাগী ও র্যাগা জীবন
কিভাবে মেলাবে সালসার রিদম!