মাহমুদ দারবিশ আরব ভূখণ্ডের কবি আর আরবী তাঁর মাতৃভাষা। তাঁর ভাষা ও মানচিত্র, উভয়েরই রয়েছে হাজার কয়েক বছরের গৌরবময় ইতিহাস। কোরান ও বাইবেলের নতুন, পুরাতন নিয়মে এর ভরপুর বর্ণনা আমরা পেয়েছি। পৃথিবী অন্যতম তিনটি ধর্মের পবিত্রভূমি। ফিলিস্তিন,প্যালেস্টাইন, কেনান, জুডিয়া, আরও কত নাম তার! এই পবিত্র ভূমিতেই জন্মান মাহমুদ দারবিশ। গালিলি প্রদেশের আল বিরওয়াহ গ্রামে,১৯৪২ সালে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলীদের আক্রমনের ফলে মাত্র ছয় বছর বয়সে সপরিবারে লেবাননের পথে রওয়ানা করেন, গভীর রাতে। পেছনে ফেলে যান উপত্যকার উপর সবুজ সুন্দর গ্রাম, শৈশবের সোনামাখা দিনগুলির স্মৃতি। সেই থেকে শুরু তার উন্মূল উদ্বাস্তু জীবনের। আমৃত্যু কোথাও স্থির হতে পারেননি। কখনো মিশর কখনো বৈরুত, কখনো প্যারিসে। আবার কখনো খোদ প্যালেস্টাইনে, নিজভূমে পরবাসী হয়ে। আর এই শেকড় বিচ্ছিন্নতা ও শেকড়ের প্রতি অদম্য টান, উভয়ের গভীর প্রভাব আমরা দেখি তার সমগ্র সৃষ্টিকর্মে। ফলে, তার ভাষা ও বক্তব্য উপলব্ধির জন্য তার এই শেকড় বিচ্ছিন্নতার কাহিনী জানা থাকাটা খুবই জরুরী। প্রাচীনকাল থেকেই আরবদের ভেতর গোত্রপ্রীতি ও দেশপ্রীতি অত্যন্ত প্রবল ছিল। দারবিশের ভেতর সেটা তো ছিলই, উপরন্তু তার দেশহীন, ভূমিহীন উদ্বাস্তু জীবন, সব মিলে তার ভেতর এমন এক গভীর দেশবোধ তৈরি হয়েছে, যা বিস্ময়কর! মাতৃভূমির প্রতি তার ভালবাসা ছিল অদম্য, একগুঁয়ে ও আপোষহীন! আজীবন একই কথা বলেছেন, একই সুরে গেয়েছেন, কখনো প্রত্যক্ষ্যে, কখনো পরোক্ষে। সেটা ফুটে উঠেছে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা ও প্রত্যয়ের ভাষায়। আরবী কবিতার যে গীতল ছন্দের ধারা ছিল, সেটাকে তিনি ভেঙে নতুন ধারা নির্মাণ করেছেন। বর্তমানে আধুনিক আরবী কবিতায় “প্রতিরোধের কাব্য” নামে যে ধারাটি ব্যাপক প্রচলিত সেটির জনক ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি তিনি। কিন্তু তাঁর সেই প্রতিরোধের ভাষা ও ভঙ্গি আশ্চর্যরকমভাবে শিল্পোত্তীর্ণ এবং ধ্রূপদী! এখানেই দারবিশ পৃথিবীর অন্য অনেক কবি থেকেই আলাদা, বৈশিষ্টমন্ডিত। তার কবিতা ও সঙ্গীতে ফিলিস্তিনিরা অনুপ্রাণিত হয়েছে। তার হাতের কলমই ছিল তার শাণিত অস্ত্র, যা দিয়ে তিনি আক্ষরিক অর্থেই লড়াই করে গেছেন। এবং ইসরাইলীরাও বারবার চেয়েছে তার কলমের কন্ঠ স্তব্ধ করে দিতে।
শিরিষের ডালপালার পাঠকদের জন্য পৃথিবীখ্যাত এই কবির একটি সাক্ষাৎকার আরবী থেকে অনুবাদ করেছেন ও ভূমিকা লিখেছেন কবি হুজাইফা মাহমুদ।
ঠিক কখন থেকে কবিতা লেখা শুরু করেন?
আমার শৈশবে শারীরিকভাবে আমি খুবই দুর্বল ছিলাম। ফলে কোনো ধরনের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারতাম না। অন্যরা কুস্তি বা ফুটবল খেলত, কিন্তু আমি সেসব খেলা জানতাম না। তাই ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ি। এটা এ কারণে হয়েছে যে, আমি তখন প্রচুর সময় বড়দের সান্নিধ্যে কাটাতাম। আর আমার দাদা প্রায়সময়ই পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে আরবী প্রাচীণ লো্কগাথা পাঠ করতেন। সেখানে আমার সমবয়সী আর কেউ থাকত না। কিন্তু আমি নিয়মিতই উপস্থিত থাকতাম। সেই গাথাগুলো ছিল খুবই চমৎকার ছন্দোবদ্ধ। আর কাহিনিগুলোও ছিল রোমান্টিক ও প্রণয়মূলক। যা কোনো প্রেমিক বা কবিকে আলোড়িত করত। আমিও শুনতাম আর ভেতরে ভেতরে দারুন আন্দোলিত হতাম। এটা কেন হতো আমি বুঝতাম না। কারণ আমি তখনো এই গাথাগুলো্র উচ্চাঙ্গীয় ভাষার সঠিক অর্থ উপলব্ধি করতে শিখিনি। তবু সেগুলো আমাকে এটা বুঝতে শেখাল যে, আমার সব সংকট আর অপূর্ণতা ভাষার মাধ্যমেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। সেই সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলোই আমাকে ভাষার প্রেমে ফেলল। আমি তখন থেকেই একজন কবি হয়ে ওঠার স্বপ্নে বিভো্র হয়ে পড়ি। আমি মনে করতাম কবি মাত্রই একজন অতিমানবীয় রহস্যময় মানুষ। মূলত খুব অল্পবয়স থেকেই লেখা শুরু করে দিই। কিন্তু কী লিখছি না লিখছি, যা লিখছি তা কিছু হচ্ছে কি না, সেসব বিষয়ে কোনো সচেতনতা ছিল না। আমার বাবা মা শিক্ষক, সবাই লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন। আসলে আমি মুক্তি চেয়েছিলাম। হয়তো খেলাধুলায় মেতে থাকলে সেই কাঙ্খিত মুক্তি পেতাম না। তারপর কবিতাই হয়ে উঠল আমার একমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র, আর ভাষা আমার একমাত্র হাতিয়ার। আমার যখন বারো বছর বয়স, তখন আমি স্কুলের অনুষ্ঠানে একটি স্বরচিত কবিতা পড়েছিলাম। ফলে পরদিন ইসরাইলী আদালতে আমাকে হাজিরা দিতে হয়েছে।
ভাবো তো, বারো বছরের হাফপ্যান্ট পড়া এক শিশু কবিতা লিখে আদালতে যাচ্ছে!
সাত বছর আগে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী যুসি সারিদ যখন আপনার কবিতা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলেন, যার ফলে কিছু কিছু কবিতার শিল্পমুল্য হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, এতে আপনার মতামত কী ছিল?
আমার কোনো কবিতা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হোক, এটা আমার কাছে মোটেও পছন্দনীয় নয়, যেখানে সরকারের কোনো বিশ্বাসই নেই আমার প্রতি, বরং দায়সারা মনোভাব পোষণ করে। আমি তো একবার কৌ্তুক করে বলেছিলাম, যেখানে ইসরাইলিদের উদ্ধত গর্ব আছে, সেখানে তারা একজন ফিলিস্তিনি কবির জন্য নিচে নামতে চায় কেন? আরবের কোনো স্কুলেই আমার কবিতা পড়ানো হোক তা আমি চাই না।
আসলে পাঠ্যপুস্তকে কোনো কবিতাই পড়ানো হোক তাইই আমি চাই না। কারণ সাধারণত ছাত্ররা সেই সাহিত্যকে ঘৃণা করে, যে সাহিত্য তাদেরকে বাধ্য হয়ে পড়তে হয়।
আপনার বাসা বাড়ি কোথায় এখন?
আসলে আমার কোনো ঘর বাড়ি নেই। এত ঘন ঘন আমি ঘর বাড়ি বদলাই যে, একটু গভীরভাবে বললে বলতে হয়, আমার কোনো বাসা বাড়ি নেই। বাড়ি আপনি তাকেই বলবেন, যেখানে আপনি ঘুমান, খাওয়া-দাওয়া করেন, লেখাপড়া করেন। তো, সেটা তো যেকোনো জায়গাতেই হতে পারে। ইতিমধ্যেই আমি বিশবারেরও বেশি বাসা বদল করেছি। আর প্রতিবারই সেসব জায়গায় আমার বইপত্র, ঔষধ, কাপড়-চোপড় ফেলে গেছি। আসলে আমি পালিয়ে বেড়াই।
সায়হাম দাউদের সংগ্রহে আপনার কিছু চিঠি ও কয়েকটি কবিতার পাণ্ডুলিপি আছে, যেগুলো আপনি ১৯৭৩ সনে ফেলে এসেছিলেন
আমি জানতাম না যে সেখানে আর ফিরব না। পরে অবশ্য ফিরে যাওয়ার চেষ্টাও করিনি। কারণ তখন আমি স্বেচ্ছাচারীর মতো ঘুরে বেড়াতে পারতাম না। দশ বছরের জন্য আমাকে ‘হাইফা’ ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। তিন বছর আমি ছিলাম পুরোপুরি গৃহবন্দি। তখনো আমার কোনো ব্যক্তিগত ঘরবাড়ি ছিল না। সুনির্দিষ্টভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না।
এজন্যই কি আপনার কোনো পরিবার বলে কিছু নেই, মানে স্ত্রী-সন্তান?
আমার বন্ধুরা মাঝে মাঝেই আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়্ যে, আমি দুইবার বিয়ে করেছি। কিন্তু একটু গভীর দৃষ্টিতে দেখলে আমার কাছে সেরকম মনে হয় না। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই, এর জন্য আমার কোনো আফসোসও নেই। থাকলে হয়তো তারা ভালো হতো্ না, হয়তো বখে যেত। এ ধারণা করা ঠিক নয়, তবু আমার কেন জানি এমনই মনে হয়। আমি জানি না কেন এমন মনে হয়। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এসবের কারণে আমার কোনো আফসোস নেই।
তবে কিসের জন্য আফসোস করেন?
খুব অল্পবয়সে আমি কিছু কবিতা প্রকাশ করেছিলাম, সেগুলো অত্যন্ত কাঁচা ছিল, শিল্পের বিচারে খুবই নিম্নমানের। আমার আফসোস সেইসব দুর্বল ও কাঁচা শব্দাবলির জন্য। সেসব যদি না ছাপাতাম!
এই একাকিত্ব কি আপনার পছন্দ?
খুব পছন্দের। যখন আমাকে কোনো ভোজসভায় নিমন্ত্রণ করা হয়, তখন আমার কাছে মনে হয়, আমাকে বুঝি কোনো অপরাধের কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। বিশেষত সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে এই নির্জনতাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কারণ মানুষকে আমার তখনই প্রয়োজন যখন আমি তাদের মুখপেক্ষি হব। তুমি হয়ত বলবে এটা তো স্বার্থপরতা। আমার পাঁচ-ছজন বন্ধু আছেন। আর এমন হাজারখানেক লো্ক আছে যাদেরকে আমি চিনি,কিন্তু তারা আমার কোনো কাজে আসে না।
এযাবৎ লিখিত কবিতাগুলোর মাঝে এমন কোনো কবিতা কি আছে, যে কবিতা লেখার পর আপনার মনে হয়েছে এ ধারা থেকে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়? ‘মায়ের কফি’ কি সেরকম কোনো কবিতা?
‘মায়ের কফি’ কবিতাটি লিখেছিলাম ১৯৬৩ অথবা ’৬৪ সালে মাসিয়াহু জেলে বসে। জেরুজালেম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে একবার কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি থাকতাম হাইফাতে। তো তাদের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠালাম ভ্রমণের জন্য। কিন্তু তারা কোনো জবাব পাঠালো না, তবু আমি একদিন ট্রেনে চড়ে রওয়ানা দিলাম। পরদিন ‘নাজারাথ’ থানায় আমাকে তলব করা হলো। সেখানে তারা আমার উপর চারমাসের নিষেধাজ্ঞা ও দুইমাসের জেল দেয়। জেলের ভেতর একদিন দেখি মেঝেতে একটা ‘এস্কট’ সিগারেটের বাক্স পড়ে রয়েছে। তার উপর ছিল একটা উটের ছবি। তো সেই প্যাকেটেই আমি তৎক্ষনাৎ লিখে ফেলি কবিতাটি। তারপর তো লেবানিজ সুরকার মার্কেল খলিফ এটাকে জাতীয় সঙ্গী্তে পরিণত করেন। আমি কারামুক্ত হয়ে হাইফায় গিয়ে একটি দৈনিকে কবিতাটি দিই। অনেকেই বলেন এটিই আমার সবচে সুন্দর কবিতা…
আপনি কি আপনার জন্মস্থান বিরওয়াতে যেতে চান?
নাহ। সেকি আজ আর গ্রাম আছে! ধূ ধূ মাঠে পরিণত হয়েছে। বসে বসে এর স্মৃতি রোমন্থন করতেই আমার ভালো লাগে।
কী বিশাল আর খোলা প্রান্তর ছিল! তরমুজ খেত, জলপাই গাছের সারি আর বাদাম বাগান, এসবের স্মৃতিই মনে পড়ে। সেই ঘোড়াটির কথাও মনে পড়ে, আমাদের উঠোনের মালবেরি গাছে বাঁধা থাকত যেটা। আমি খুব চেষ্টা করতাম এর পিঠে চড়তে, কিন্তু সেটা প্রতিবারই আমাকে ছুড়ে ফেলে দিত, আর মায়ের হাতের মার খাওয়াত। মা প্রায়ই আমাকে পিটুনি দিতেন, কারণ তিনি মনে করতেন আমি খুব দুষ্টু। আমার কিন্তু মনে হয় না, এত দুষ্টু ছিলাম।
সেই প্রজাপতিদের কথাও মনে পড়ে, যেগুলো্র পেছনে ছুটে ছুটে আমার মনে হতো পৃ্থিবীর সকল প্রান্তর আমার জন্য উন্মুক্ত। আমাদের গ্রামটি ছিল খাড়া একটি পাহাড়ের উপর। নিচে সবকিছুই ছিল সবুজ চাদরের মতো বিছানো। একদিন মাঝরাতে আমাকে ঘুম থেকে জাগানো হলো। মা বললেন আমাদেরকে পালাতে হবে। তখন যুদ্ধ বা এ জাতীয় হামলার ব্যাপারে কেউ কিছু বলেনি।
আমরা তিন ভাই-বোন, মা-বাবা ও অন্য আরও অনেকে হেঁটেই রওয়ানা দিলাম লেবাননের উদ্দেশ্যে। আমার সবচে ছোট ভাইটি, যে কেবল হাঁটতে শিখেছিল, সে পুরোটা পথই কেঁদেছে। একবারের জন্যও থামেনি।
আপনি কি লেখালেখির ক্ষেত্রে কঠো্র কোনো নিয়ম মেনে চলেন?
এ ক্ষেত্রে আমার কিছু অভ্যাস আছে। সাধারণত আমি সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত লিখি। হাতেই লিখি, কারণ আমার কোনো কম্পিউটার নেই। ঘরে বসে দরজা বন্ধ করে লিখি, যদি পুরো ফ্লাটে দ্বিতীয় কোনো প্রাণীও না থাকে। প্রতিদিন লিখি না, কিন্তু প্রতিদিন নিজেকে বাধ্য করে একবার হলেও লেখার টেবিলে বসাই। এখানে কোনো প্রেরণা আছে কি না, জানি না। কারন আমি মনে করি না সবকিছুই প্রেরণা-অনুপ্রেরণা দিয়ে হবে। যদি থাকেও, তাহলে উচিৎ হবে তখনই প্রেরণা জাগানো, যখন নিজে মূল্যহীন হয়ে যাব। মাঝে মাঝে খুব সুন্দর লেখার প্লট আসে মাথায়, কিন্তু সেটা এমন জায়গায়, যাকে ভালো বলা যায় না। যেমন বাথরুমে, হয়তো প্লেনে, বা ট্রেনে। আসলে তোমাকে জানতে হবে কিভাবে লেখার টেবিলে বসতে হয়। ভাল করে বসতে না জানলে তুমি লিখতেও পারবে না। এটাকেই শৃঙ্খলা বলা হয়।
আমার কেন যেন মনে হয় আপনার ভাল ঘুম হয় না। অনিদ্রায় ভোগেন?
মোটেও না। আমি একরাতেই নয় ঘন্টা ঘুমাই। অনিদ্রায় কখনোই ভুগি না। চাইলে যখন যেখানে ইচ্ছা ঘুমাতে পারি। কেউ কেউ বলে আমি ক্ষয়ে গেছি, শেষ হয়ে গেছি। জানি না তারা এসব কোত্থেকে পায়! হয়তো কোনো হিব্রু দৈনিকে এসব সংবাদ ছাপা হয়। আমাকে একপ্রকার রাজপুত্রই বলতে পারো। একজন যুবরাজ তো সমাজের সর্বোচ্চ মহলেই থাকেন। মূলত এটা কোনো বিষয় না।
কিন্তু এটা কি সত্য যে আমি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছি? এটা আমার কথা নয়, বরং কিছু মানুষ আমাকে এভাবেই ব্যাখ্যা করে থাকে।
আপনার জীবনে একবার মৃত্যুকে প্রায় স্পর্শ করেছিলেন। এখন এই শরীর ও বার্ধক্য কি আপনাকে ভীত করে তোলে?
আমি এযাবৎ দুইবার মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ফিরে এসেছি। একবার ১৯৮৪ সালে, আরেকবার ১৯৯৮সালে। দ্বিতীয়বার তো ডাক্তার আমাকে মৃতই ঘোষণা করে ফেলেন। আমার শেষকৃত্যের জন্যও সবাই প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। ১৯৮৪ সালে আমি ছিলাম ভিয়েনায়। সেখানেই হার্ট অ্যাটাক হয়। আমার কাছে মনে হয়েছিল আমি যেন উজ্জ্বল আলো্য শুভ্র মেঘের উপর সাবলীল ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছি। আমি মনে করিনি এটা মৃত্যু। আমি ভাসমানই ছিলাম যতক্ষণ পর্যন্ত আমার ভেতরে তীব্র ব্যথা অনুভূত না হলো। কারণ এই ব্যথার বো্ধই ছিল জীবনের দিকে ফেরার সংকেত। আমি বলি, সেবার দুই মিনিটের জন্য মরে গিয়েছিলাম।
১৯৯৮ সালে আবার হার্ট অ্যাটাক হয়। এবারে সে প্রচণ্ড প্রতাপ নিয়ে আক্রমণ করে। আগেরবারের মতো এটা কোনো সুখদ নিদ্রা ছিল না। এটাও মৃত্যু ছিল না, তবে ভয়ানক এক যুদ্ধ ছিল, যে যুদ্ধ আমাকে বিপন্ন করে ফেলেছিল।
মৃত্যু নিয়ে আপনার এখন কী মনোভাব?
তার জন্য আমি প্রস্তুত। তবে অপেক্ষমান নই। কারণ অপেক্ষা করাটা আমার পছন্দ নয়। আমার একটি প্রেমের কবিতা আছে, যেখানে এই বিষয়টি তুলে ধরেছি। কবিতাটি এমন :
তুমি অনেক বিলম্ব করেছ, এবং অবশেষে আসোনি,
আমি ভাবি হয়তো গিয়েছ এমন জায়গায়
যেখানে সূর্যোদয় হবে। হয়তোবা গিয়েছ কেনাকাটা করতে
হয়ত আয়নায় দেখছ নিজেকে
আর নিজে নিজেই পুলকিত হচ্ছ নিজের স্পর্শে
হয়তো সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে এখন হাসপাতালে আছ
হয়ত প্রভাতে ডেকেছিলে আমায়, আর আমি ছিলাম না।
এক তোড়া ফুল কিংবা মদ কিনতে গিয়েছিলাম
হয়তো তুমি মরেই গিয়েছ্,কারণ মৃত্যু আমার মতোই
অপেক্ষা পছন্দ করে না…।
মৃত্যুর সাথে আমার একটা অলিখিত চুক্তিপত্র আছে, যা খুব পরিষ্কার। আমি তো এখনো মূল্যহীন হয়ে যাইনি। এখনো আমার অনেক কিছুই লেখার বাকি, করার বাকি। আমার সাথে তোমার কাজ আছে, যুদ্ধও আছে, কিন্তু আমার কবিতার সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।
আমি তাকে বলেছি, এটা তো কোনো ব্যাবসা নয়, সুতরাং চলো, আমরা আলোচনায় বসি। অতঃপর তুমি তোমার সময় বলে দাও, আমি প্রস্তুত থাকব, উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করব আমার লেখার টেবিলে। তারপর একটি কবিতা লিখব, তারপর তুমি তোমার কাজ সেরো।
মৃত্যুকে নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই। আবার আমি এ ব্যাপারে অন্যমনস্কও নই। তাকে গ্রহণের জন্য আমি প্রস্তুত, তবে সে যখনই আসে, যেন বীরের বেশে আসে। চো্রের মতো চুপিচুপি যেন না আসে। কোনো ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মরতে চাই না।
কোন জিনিস আপনাকে কিছুটা সুখ দেয়?
ফরাসি ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, পঞ্চাশ বছর বয়সের পর যদি তুমি শরীরের কো্থাও ব্যথা অনুভব ছাড়াই ঘুম থেকে জাগো, তাহলে মনে করবে তুমি মৃত। প্রত্যহ ভো্রে ঘুম থেকে জেগে ওঠাই আমার কাছে আনন্দদায়ক। এক দৃষ্টিতে আমি মনে করি আনন্দ কোনো বস্তুগত আবিষ্কার নয়। আনন্দ হচ্ছে এমন কয়েকটি মুহূর্ত যা প্রজাপতির মতো। আমার তখনই খুব আনন্দ হয় যখন কোনো কাজ সম্পন্ন করি। আরও আনন্দময় সময় হলো যখন মানুষ আমার কবিতা পড়ে, এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে এবং আলোচনা সমালোচনা করে। একজন কবি তো পাঠকদের নিয়েই বেঁচে থাকতে চান।
আপনি একবার বলেছিলেন, ‘কবিতা পরিবর্তনের হাতিয়ার, একথা সত্য নয়।’ কিন্তু আপনি কি এটা অনুভব করেন যে ফিলিস্তিনি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আপনার অপরিশোধ্য ঋণ?
আমার কবিজীবনের শুরুতে আমি আমাদের ফিলিস্তিনি পরিচয়ের উপর জো্র দিয়েছি। একজন কবিই পারেন ভাষা দিয়ে কোনো জাতির পরিচয় চিহ্নিত করতে। হয়ত তিনি একজন মানুষকে অতিমানবীয় ক্ষমতাবান বানাতেও পারেন। যেন সে জীবনযুদ্ধে আরও ধৈর্যশীল ও সংগ্রামী হয়। ফিলিস্তিনের আকাশ-বাতাস যখন দুঃখের কালো চাদরে ঢেকে যায়, তখন মানুষকে আমার কবিতা পড়তে দেখেছি। আবার বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানেও তারা আমার কবিতা পড়ে। সেগুলো হয়তো তাদের শক্তি জোগায়। আমার কিছু কবিতাকে তো সঙ্গীতে রুপান্তর করা হয়েছে। যখন তারা পরাজয়ের গ্লানিতে ভেঙে পড়ে তখন তারা সেসব সঙ্গীত গেয়ে পুনরায় জেগে ওঠার স্বপ্ন দেখে। এসব করে তারাই তো ক্রমাগত আমাকে ঋণী করে তুলছে।
রামাল্লায় আছেন কত বছর ধরে?
প্রায় পাঁচ বছর হবে।
নিজের বাড়ি হিসেবে কোথায় বেশি স্বাচ্ছন্দ বো্ধ করেন? রামাল্লা না গালিলি?
আমার বাড়ি হচ্ছে গালিলি। আমার ব্যাক্তি স্বত্তার বিকাশও সেখানেই। আমার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীরাও সব সেখানে। সে জায়গাটির জন্য আমার মন সবসময়ই কাঁদে। গালিলির প্রতিটি বৃক্ষ, পাহাড়, রক্তিম সূর্যাস্তের জন্য আমার মন কাঁদে। পুরো ফিলিস্তিনই আমার মাতৃভূমি। কিন্তু আমার একান্ত আপন জায়গা হল সেটি, যেখানের প্রতিটি ফুলকে আমি বিপুল বিস্ময় নিয়ে দেখেছি, চিনেছি; আর তা হল গালিলি, রামাল্লা নয়। কিন্তু আমি তো আর সেখানে যেতে পারছি না। এই রামাল্লাতেই গৃহবন্দি হয়ে পড়ে আছি। প্রিয় গালিলি আর কোনোদিন আমার বাসস্থান হবে না।
(ইতোমধ্যেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আমরা ইসরাইলি ট্যাঙ্কগুলো্র গর্জন শুনতে পাচ্ছি। কার্ফিউর সময় শুরু হয়ে গেছে। তারা ট্যাঙ্কবহর নিয়ে আমাদের রাস্তায় রাস্তায় টহল দেয়া শুরু করছে। দারবিশ তড়িঘড়ি করে তার বাসার দিকে রওয়ানা হলেন। আমিও আমার বাসার দিকে হাঁটা ধরলাম।)