বৈভব থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি শ্বেতা শতাব্দী এষ–এর নতুন কবিতাগ্রন্থ হাওয়া ও হেমন্ত। পাওয়া যাবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৫ এর বৈভব (স্টল নং ৫৭৫-৫৭৬)-এ। প্রচ্ছদ করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। মূল্য: ২২৫ টাকা।
তরঙ্গ মুছে গেছে
নতুন কিছু বোলো—
এই আকাশ ভেঙে পড়ছে বোলো না;
বোলো না তুমি আমার কথা
বুঝতে পারোনি!
আমি তো পাশে বসে থেকেছি অনন্তকাল
তারপরও তরঙ্গ মুছে গেছে শুধু—
এই বাদামি ত্বক, ঘোলা চোখ, ধূসর চুলের ভাষা
রাত্রি জানে না কিছু।
আমরা কোনোদিনও একে-অন্যকে চিনিনি,
অন্তত এইটুকু বোলো।
জলবিরাগী
নিউরন ধরে সংকেত আসে সূর্যপতনের
এমন ঘোরতর বৃষ্টিদিন
হঠাৎই শুরু হয় কর্কটক্রান্তিজুড়ে—
কোনখানে দাঁড়ালে পাব জলের আড়াল
সন্তরণ শিখিনি যেখানে!
সূর্যের কেন যে ছায়া নেই—
এই বৃষ্টিপথে যেতে যেতে
কেবলই মনে হয় একটা ছায়ামেদুর সূর্য
এঁকে দেই হিমগ্রস্ত পৃথিবীর কপালে!
কুর্চি ফুলের হাওয়া
না-হয় কুর্চি ফুলের বন থেকেই হাওয়া আসুক—
আমি তো কল্পনাতেই রং দেখে নিই,
মাথা নিচু করে পায়ের দিকে চেয়ে হাঁটি পথ!
এমন স্বভাবে আরও একা হওয়ার সুরে
কল্পনার কাছেই থাকে সমস্ত আশ্রয়—
না-হয় একটা আশ্বিনের বিকেলের কথা ভেবে
জানালায় গোপনে নীল সমুদ্র খুলে বসি, দূরে
ফেলে আসা বিশালাক্ষীর মন্দিরে দেবীও যে একা—
সেই কথা ভেবে আজো বিষন্ন হয় চোখ।
একটা হাওয়া আসুক, শূন্য থেকে ওলোট-পালোট
হয়ে যাক সব—সূত্র মেনে তোমাদের এই
নির্ভুল বেঁচে থাকা!
তথাগত
পৃথিবীর বিষন্ন মানুষেরা আমাকে টানে—
যেভাবে সলজ্জভঙ্গিতে ফুল ছড়িয়ে যায় ঘ্রাণ
খুব গভীরে যেন রূপান্তরিত শিলায় ফুটে ওঠে রং!
অনেক দূরের থেকে সিগনাল ভেসে আসে
অজানা বনের দেশে মধুবন্তী রাগ, সারি সারি
নৌকার ঘাট—রাতের শহরে শুধু মোমবাতি জ্বলে।
ধুলো আর পথ—হেডফোনে কখনোবা ডেনভার বাজে—
এইসব নিয়ে এইসব ফেলে দূরত্ব শুধু দূরত্ব
এভাবে আমাকে টানে অমীমাংসা—
বোহেমিয়ান অসুখজীবন!
উহ্য
এই যে বলার ঢঙে না-বলা মিশে থাকে
গম্ভীর পাহাড়ের সুর—
তোমারও কি বলতে ইচ্ছা করে?
পাখিশূন্য বনের মতো এ-সময় নিশ্চুপ!
গভীর যত্নে রাখা দোলনচাঁপার ঘ্রাণ
দীঘল অপেক্ষার পর সেও মুছে যায়।
দূর দূর থেকে ভেসে আসে ট্রামপেট—
দেখি হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের অজস্র মুখ
টুকরো টুকরো আয়নায়।
জলের শরীর থেকে পাথরে পাথরে
খাঁজ কেটে একদিন লিখে দিব
অন্য জীবন—নিহিত শুশ্রূষায়।
সলিচ্যুড
তোমাকে
বলবার মতো কথা না-থাকাই ভালো।
গ্রিলের একপাশে ভাবি—বনকুয়াশার নীলে
একদিন ভরে যাবে সমস্ত শহর,
ছোটো ছোটো ফুলে ছেয়ে থাকবে বিস্মৃত
ছবির অ্যালবাম—একাগ্র প্রার্থনায়—
তিন ভাগ জল দিয়েও বাঁচানো যায়নি যে মাছ
তারই উদ্দেশে
ভেসে যাবে নিজস্ব অর্থহীন কথোপকথন!
ফিলিস্তিন
রঙিন কাগজ, প্লাস্টিক ঠোঁটের বাহবা নিয়ে
সেই পুরোনো রাস্তাতেই হাঁটছেন, এখনো;
জেনেও জানবেন না বলে স্থির করেছেন,
বিবিধ প্রলোভনে, আরোপিত প্রয়োজনে;
ডুবে গেলে—জন্মের উদ্দেশ্য ঝুলে থাকে
জানালার গ্রিলে কাগজের পাখির মতন!
‘যা আসে নিজেই আসে’,
‘নিজ থেকে আসে না কিছু’
প্রতিটি যুক্তির নেপথ্যে ক্লান্ত হয় মন।
খাবারের জন্য সাগরে ঝাঁপ দিচ্ছে ক্ষুধার্ত কেউ!
আপাত নিশ্চিন্ত ঘরে ঘুমাতে যান,
পৃথিবীর কোথাও জেগে থাকে
অনিশ্চিত মানুষ ও ফিলিস্তিন।
জ্বর
একটা দ্বন্দ্বের সাপ
বুকে ছোবল তুলে বসে—
এইসব স্তব্ধতা জানে
প্রতিটি মুখরতার
মৃত্যু ইতিহাস।
সম্পর্কের পাশে মানুষ
একাকী হেঁটে যায়!
সমুদ্রে অশ্রুত ঢেউ
শুভ্র সত্য ভ্রম
অনিঃশেষ জিজ্ঞাসা—
তোমার চোখে রাত
ঘুমিয়ে গেলে
বেঁচে থাকে
নিরাশাকরোজ্জ্বল মন
জ্বর ছুঁয়ে বিভোর মনীষা!
শূন্যতা অথবা মুগ্ধতায়
শহরজুরে ক্লান্ত রিহার্সাল, আমরা ট্যুরে যাওয়ার কথা ভাবি—কোথায় যব?
পুরোনো কটেজ ছাড়িয়ে নদী—নদীর ওপারে বুদ্ধের জীবন—স্বপ্নে কুয়াশা ঢুকে যায় শরীরের ভেতর অথবা শরীর কুয়াশায়—আমাদের মনেপড়ে রিপ ভ্যান উইংকেলের কথা—শিকারি বন্ধুক নিয়ে ঘুমিয়ে যাই—
হুডি দিয়ে শীত পরি গায়ে—উলের মাফলারে লেগে থাকা পাতা পোড়া গন্ধ—নোনতা বিস্কিট খেতে খেতে
গমরঙা রোদ খুঁজতে যাব, ডার্কহর্স, খুরের ধুলায় ঢেকে যাবে নেমপ্লেট, বিগত স্টেশন—
আমরা ট্যুরে যব, উইন্টার অথবা ফল-এ, নত-সন্ধ্যার দিকে—ভুলে যাওয়া স্বপ্নের রং!
লালপাখি
ঘুম আসার পর আবার উধাও হয়ে যায়।
পাখিদের ঘুম—কতটা স্বপ্নের হয়
বৃক্ষ জানে না। অথবা জানে—
আকাশ থেকে নেমে আসে লাল পাখিটা।
অন্য পাখির মতো উড়তে গেলে
ভেঙে যায় আকাশের ডানা। অন্য
পাখির মতো ওড়ার অপ্রয়োজনে
উড়তে চায় না—লাল পাখি।
গান গায় না সে। খাবার খোঁজে না।
কোন মন্ত্রে বেঁচে থাকে এই রহস্য
সবার আজানা!
ঘুম আসার পর ঘুম ভেঙে গেলে
তৃষ্ণা পায়, এমন তৃষ্ণা, বুক জ্বলে যায়!
পাখিতো ধ্যান করে না, নাকি করে!
কীভাবে শান্ত থাকে, ক্লান্ত মোহে,
ঝড়ে ঝড়ে ভেঙে যাওয়া বনবীথিকায়!
সব কিছু ভেঙে যায়—সহজ সাঁকোও!
যতটা কঠিন হতে যায় তত তার ঘুম পায়,
নিজের সাথে না-বলা কথাটার জন্য,
দীর্ঘ কোনো যাত্রার জন্য—তুচ্ছ কোনও
কারণেও হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়!
লাল পাখি, ঘুম আর জাগরণের
সীমানা জানে না। পৃথিবীতে
সরল রেখা একটাও পায়নি বলে
এক আশ্চর্য অনিয়মে জেগে ওঠে—
আপাত সবুজ পাতার সাবলীল আশ্রয়ে,
ভুল হয়! শুধু একটা বাক্যের মাঝে
আটকে গেছে সময়—ঘুম আসার পর
কেন আবার ঘুম উধাও হয়ে যায়!
শ্বেতা শতাব্দী এষ
কবি
জন্ম: ১২ অক্টোবর, ১৯৯২, জামালপুর শহরে। শিক্ষা: স্নাতকোত্তর, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : অনুসূর্যের গান; রোদের পথে ফেরা; বিপরীত দুরবিনে ; আলাহিয়ার আয়না; ফিরে যাচ্ছে ফুল।
‘বিপরীত দুরবিনে’ বইয়ের জন্য ‘আয়েশা ফয়েজ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭’ এবং তরুণ কবি ক্যাটাগরিতে ‘আদম সম্মাননা ২০১৯’