পাঁচটি কবিতা | আলতাফ শাহনেওয়াজ


আমি, হোটেলবয় ও অন্যান্য


অপমানের প্রতিটি গল্পে
নামহীন হোটেলবয় আমার পাশে শিস দেয়
শ্মশানে কুড়োনো বন্ধুদের শ্বাস কাঁধ ছুঁয়ে
বলে,
ভালো আছিস তো…

আমি ও হোটেলবয় হাসি
গন্তব্যের ওপাশে যেখানে এক আনায়
সন্ধে কেনা যায়,
সেই দিকে হেঁটে যেতে থাকি।
কাউকে জিজ্ঞেস করি—
সাধু, কোথায় পাব দুধভাই,
যে আমার মার স্তন ছিঁড়ে নিয়ে
গহিন রাত্রির বুকে
ঢেলে দিয়েছে আদিমতম জোছনার সর।

তুমি নিশ্চুপে মধুর হয়ে থাকো
আমি তাই হোটেলবয়ের পকেটে
মুহূর্তের হাওয়া আর বেলিফুল গুঁজে দিয়ে বলি,
অপমানের গাছটি বড় হোক
তারপর গন্ধ নিস মৃত মানুষের।
মৃতেরা জানে, ইতিহাস-তৃষ্ণায় ভেঙে যাওয়া টি-স্টলের সাথে
সর্বশেষ আগুনে পাওয়া রাজকন্যাটিও আকুল হয়ে ওঠে,

তাদের বেলি ফুলগাছে তখন থোকায় থোকায় ফুটে থাকে
মৃতদেহের প্রেম, আমার হাসি…


বসন্ত শেষের চৈত্র


অস্থিরতার শব্দমুখী জিভ ব্যক্তিগত ঘড়ির
কাঁটার ওপরে বসে যে কথা বলছে
সবটুকু কি শুনতে পাচ্ছি?
অমীমাংসিত মানুষ ঘড়ির ভেতর
একদিন গোপন রেখেছিল বজ্র পাওয়া হাওয়া—দ্রুতগামী
বসন্ত শেষের জোড়াতালি চৈত্র…

প্রশংসাপত্রের মতো দাঁড়িয়ে আছে সময়, যেন
অনেক পাগলামির লাশ! ছিন্নভিন্ন অচেনা কেউ—অন্ধ
বিকেলের ছেঁড়া জামায় সূর্যাস্ত ঘষে দিয়েই বলেছে, এই নে রংধনু,
কী যেন বলছিলাম তোকে… ঘড়ির গুপ্ত কাঁটা পেরিয়ে
একশ বছর আগেই উদাসী হয়ে গেছে
মানুষের বাড়ি যাওয়ার রাস্তা;
কেবল কয়েকটি উস্খুশ চিঠি ক্রমাগত ফেল করার পর
কথা বলছে আর বলছে…
ওদের প্রশংসা নেই

শুকনো গোলাপের ডালে প্রশংসার পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে সময়
দোস্ত, সবকিছু কি শুনতে পাচ্ছ?


অমাপর্ব


একটা জীবনের মধ্যে পা গলিয়ে খোঁড়া পা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কীভাবে কীভাবে, তার শব্দ তুমি জানতেও পারবে না। গুলে খাওয়ার মতন এই গলে যাওয়া হয়তো বিদ্যুৎচ্চমক—ময়লা আকাশে শাদা দাগ হয়ে থাকা। একটানা বজ্রপাত মাথায় চেপে অনেক রাতে গ্রিল ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছি। আমার তো ঘরই ছিল না। মায়া, প্রেম, স্নেহ—তোমাদের ভাষা এসব চূড়ান্ত সুখীমহলার, সুইটের মোড় সবকিছু লিখে রাখে। লোহার ব্রিজ পার হয়ে কতটা হাঁটতে পারি, পাগুলো কতটা রেইনট্রির সমান উচ্চতা পায় দিনের শেষে, কেউ কি তা দেখে? আর ক্লেদ, আর মরে যাওয়া… যেতে যেতে তালাবদ্ধ বাথরুমের ভেতর আটকে থেকে একদিনেই বড় হয়ে যাওয়া, অবিশ্বাস্য গল্প এগুলোই, এবং নিজের গল্পের নুয়ে পড়া গাছগুলো… আমি কি না অপমানে ওই গাছের বিষাক্ত কাননবালার ফুল! নাকি শ্বাসমূল ছিলাম একদিন? একদিন আমার আগুনে পোড়া কামার, চামারের অভিশাপে তার গড়ন কি তামার… যদিবা সেই কামার তামা তামা হয়ে গিয়েছিল জীবনের মরে যাওয়া তাপে, তবু এই যে এখানে দাঁড়ির বদলে কমা বসালাম চাপে, তার মানে খাওয়ার কোনো থালা ছিল না আমার। তাই গলায় সোনার টাকা ঝুলিয়ে প্রণয়ের ছলে আমাকে সবাই ভাসিয়ে দিলে কচুর পাতায়…পানিতে পানিতে, কিন্তু কেউ কি জানিতে, জলের কলকল তোড়ে কতবার সজল চোখের মণি খুলে ফেলব আমি, কভু আর কাঁদিব না বলে! ভিক্ষার খুঁদকুড়ো ছুঁড়ে দেবে কখন? যাকাতের লুঙ্গি চুরি করে আমাদের বাড়িতে যেদিন পরা হলো, দূরের সাইরেন ও অ্যাম্বুলেন্সের লাল শব্দ আমার বোনের মৃত্যুকে নিকটে নিয়ে এলো, পিতা তখন বোনের লাশ দেখে বারবনিতার গৃহের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন। তখনো আমি জেগে, গাছে গাছে নামাজের ভঙ্গিতে হাতাপাতা নাড়িয়ে চলেছি, কুলহু আল্লাহু আহাদ কুলহু আল্লাহু আহাদ…


ফানা


ভালোবাসার ভেতর ফিনকি দিয়ে ঝরছে আপনার রক্ত,
আমার কাটা মুণ্ড সুর হয়ে সেই গান স্পর্শ করতে চায়;

অবিরল বর্ষা বোবার মতন দুকূলে নিরলে ঝরতে ঝরতে
কাকে বলছে, ‘আল্লাহ! আপনিও আমার মতো
ইয়াতিম!’

আপনি একটি বিশেষ বিশেষণ, আমার রক্তের ভেতর
শত পাখি
সকাল-সন্ধ্যা কদম্ব ডালে বসে আপনারে ডাকে…


অনাত্মীয়


আপনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন
আমিও আপনার দিকে,
তবু কেউ কাউকে আমরা কখনো দেখি না!
অনেক বছর ধরে গাছের পাতার নিচে
ছায়া তৈরি করতে করতে এমনই সন্ধ্যায়
গোধূলি ফেটে আমরা পাশাপাশি আসি—
গ্রামোন্নয়নের অংশ হিসেবে একত্রে চা-কফি খাই;
পাখির নীড়ের ‘পরে
সূর্য ডোবার আগে যেটুকু অন্ধকার
ঘিরে ধরে,
আপনি ডুবতে চান তার ভেতরেই;
অথচ বারবারই আমি আপনাকে টেনে তুলি
আর ওই মুহূর্তেই মৃত্যু হয় আপনার!

হাসপাতালে যারা কাঁদছে, তারা কেউই আমাদের আত্মীয়স্বজন নয়…


আলতাফ শাহনেওয়াজ

জন্ম ২৫ জুন ১৯৮৩, ঝিনাইদহ শহরে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর। লেখালেখির শুরু নির্লিপ্ত নয়ন নামে, ছোটকাগজে। কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রির অদ্ভুত নিমগাছ’ (২০১১), ‘আলাদিনের গ্রামে’ (২০১৬), ‘কলহবিদ্যুৎ’ (২০১৯), ‘সামান্য দেখার অন্ধকারে’ (২০২০), ‘সহসা দুয়ারে’ (২০২১), ‘গ্রামের লোকেরা যা বলে’ (২০২৩); নাট্যগ্রন্থ ‘নৃত্যকী’ (২০১৬)। সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ ‘ঢোল সমুদ্দুর’ (২০০১)‘শাখাভরা ফুল’ (২০০৯)।

আলাদিনের গ্রামের জন্য ‘আদম সম্মাননা ২০১৬’ (ভারত) এবং নৃত্যকীর জন্য ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৭’সহ লেখালেখির জন্য সিলেট মিরর প্রদত্ত সম্মাননা পেয়েছেন। কাজ করছেন প্রথম আলোয়।

যোগাযোগ: altaf.shahnewaz@gmail.com

শেয়ার