সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা কিশোর মতিন মায়ের আঁচল ধরে কান্দে, ছোট বোনের গালে গাল লাগিয়ে কান্দে, ছোট ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে, বাড়ির সামনের তালগাছের গা-ছুঁয়ে কিভাবে! তারপর বাপের পেছন পেছন রওনা দেয়। ঢাকা এলে মতিনের সাথে দেখা হয় মনিরা পারভীনের।
বৈড়ইচারা গ্রামের চৌদ্দ বছরের ছেলে আবদুল মতিন যখন লুঙ্গির নিম্নাংশ উল্টিয়ে মালকোচা করে নিচু জমির ক্যাঁতক্যাঁতা কাদার মধ্যে পিচ্ছিল শোল-টাকি মাছ পাঁচ আঙুলের চিপায় কেচকি দিয়ে ধরে, তখন ঢাকা শহরের মনিরা পারভীন তাকে দেখেনি। আবদুল হাশেম অন্যের জমিতে হালচাষ করে বাড়ি ফিরে খালুই হাতে মতিনকে দেখতে পেয়ে একটানে খালুইটা উঠানে ছুঁড়ে ফেলে। টাকি মাছগুলো তখন তেজি, শুকনো উঠোনেই সাঁতার কাটে, ভয়ে মতিন দৌড়ে পালায়। রাতে সেই মাছের ঝোল ছেলের প্লেটে তুলে দিতে দিতে মা সাইদা বেগম ভাতমাখা হাতের দিকে তাকিয়ে মিনতিভরা স্বরে বলে— বাজান আর দুইডা ক্লাস পড়লি, কলেজে যাবার পারতি।
এই কথায় মতিনের গলায় বিষম লাগে, তবে গলায় কাঁটা ফোটে না। সেই আড়াই বছর বয়স থেকেই সে মাছের কাঁটা বেছে খেতে জানে। সে বলে— ঝোলে ম্যালা ঝাল হইছে।
সাইদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পড়াশোনা ফ্যালায় দুই চারটা কই-টাকি মারলে ছেলের কোনো ভবিষ্যৎ হবে নানে। বরং দেখা দেখি পরের দুইটাও স্কুল ফাঁকি দেওয়া শুরু করবেনে। আবদুল হাশেম সংসার চালাতে হিমশিম খায়। তার কথা— ডাঙ্গর পোলায় পড়ব না, তাইলে খ্যাতের কামে যাওন লাগবি। একথার পরেরদিন সকালে আর মতিনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সে শৈল্যডুগি মামাবড়িতে পালিয়েছে!
এমন করে আর কদ্দিন। শেষে মতিনের মামাই একটা ব্যবস্থা করে। ধার-কর্জ করে তার সৌদি যাওয়া চূড়ান্ত করে। তখন সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা কিশোর মতিন মায়ের আঁচল ধরে কান্দে, ছোট বোনের গালে গাল লাগিয়ে কান্দে, ছোট ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে, বাড়ির সামনের তাল গাঠের গা-ছুঁয়ে কিভাবে! তারপর বাপের পেছন পেছন রওনা দেয়। ঢাকা এলে মতিনের সাথে দেখা হয় মনিরা পারভীনের।
গ্রামের কথা মনিরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। হঠাৎই হাশেম নামেও দূর সম্পর্কের ভাই উপস্থিত হলে মনে পড়ে সে কথা। মতিন নতুন কেনা প্যান্ট-শার্ট পরে একপাশে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে মনিরা ভাবে, ঘাড়টা গুঁজো করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি নিতান্তই গোবেচারা টাইপের, এমন ভঙ্গির ছেলে-পেলেকে সে শেষ কবে দেখেছিল মনে নেই। এ ছেলে একা একা অতদূর যেতে পারবে! ছেলেটি এক দিনেই তাকে বেশ ফুফু ফুফু ডেকে-টেকে অস্থির, তাতেই কি মনিরার খুব বাবার কথা মনে পড়ে? বাবা-মা, মারা গেছে বছর দশ হলো! নিজের ভাই-বোন কেউ নেই দেশে। বহুদিন আগেই বড় ভাই অস্ট্রেলিয়াতে স্থায়ী হয়েছে। বড় বোনটা বিয়ের পর থেকেই আমেরিকায়। এ বছর নিজের ছেলেও কানাডা চলে গেল, মেয়েটাই কেবল কাছে আছে। গ্রাম থেকে বহু বছর কেউ আসে-টাসে না। জ্ঞাতি-গোষ্ঠির একটা বিচ্ছেদ ঘটে গেছে অনেক আগেই। পড়াশোনা-বিয়ে সব মিলে কত কত বছর! স্কুল পেরুবার পর মনিরা আর গ্রামে যায়নি। আবদুল মতিনের বিদেশ গমন উপলক্ষে মনিরা বেগম কেমন গ্রাম্য স্মৃতিতে ডুব দিয়ে ওঠে। বাপের ভিটা বলতে গ্রাম তাঁকে টানেনি, এই শহরের ঘোরটোপে আটকে গেছে।
মতিন সৌদি থেকে মাঝে মাঝেই ফোন করে। ছেলেটা এত বেশি ফুফু ফুফু করতে থাকে, ক’দিন বাদেই বিরক্ত লাগতে শুরু করে মনিরা পারভীনের। বিশেষ করে যখন ফোনে দীর্ঘ প্যাঁচাল দেয়, বলে— ফুফু ছোট বোনটারে কলেজে ভর্তি করছি, মাসে আব্বারে এত টাকা দিসি, মায়রে আলাদা খরচা দিই।
এসব শোনায় তেমন কোনো আগ্রহ হয় না মনিরার। তবুও ছেলেটা বলে যায় বলে বিরক্ত হলেও কানে ফোন ধরে থাকেন। প্রায় সব ফোন কলেরই শেষ বক্তব্যটি একই থাকে, ভালো হইচ্ছে না ফুফু?
বৈড়ইচারা গ্রামে মোবাইল আছে, কিন্তু সব সময় লাইন পাওয়া যায় না, চার্জ দিতে গঞ্জে যেতে হয়। বোধ করি একারণেই মতিন তাকে এত ফোন করে, এসব ভাবলেও মনিরা পারভীনের কাছে তা এক প্রকার অত্যাচারই মনে হয়। সেদিন সবে টিভিতে সিরিয়াল দেখতে বসেছে, তখনই মতিনের ফোন। কুশল জেনেই প্যাঁচাল শুরু। —ফুফু এই মাসে আব্বারে এক লাখ ট্যাকা পাঠাইছি, আমাগো হালটের পাশে বতুগো নামা জমিটা কিনবার জন্যি। ওইহানে ডাঁটা আর ঢ্যাঁড়সের চাষ যেমুন ভালো, হেমুন ধানের চারাও ভালো গজায়।
মনিরা পারভীন বুঝতেই পারে না নামা জমি কেমন, ধানের চারা গজায় ভালো মানে কি? আর মতিনদের হালটটা সে কি জীবনে দেখেছে? এদিকে টিভি সিরিয়ালে তখন চলছে চরম ক্লাইমেক্স। তাই মনিরা বলেন— মতিন, বাসায় তো গেস্ট, এখন রাখি, পরে কথা হবে। ভালো থেকো।
কিন্তু এরপরও মতিনের সঙ্গে মনিরা পারভীনের যোগাযোগটা কমে না, বরং বেড়েই যায়। মনিরা যত ব্যস্ত থাকুক, তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিক, মতিনের দূরালাপের লিস্টটা ততটা বড় না হওয়ায়, কিছুদিন পরপর সে ফোন করে। সম্প্রতি ফেসবুকে মতিনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে মনিরা পারভীন অনেকক্ষণ ভাবে একসেপ্ট করবে কি-না? প্রথমত মতিনের সঙ্গে তখনো সে তেমন আন্তরিকতা বোধ করছে না, কিন্তু ভেবে দেখল, ফেসবুকে দেখা হলে মতিনের যখন-তখন ফোন করাটা কমবে, তাই বন্ধু করে নিল তাকে।
চার বছর আগে যে ছেলেটি গোবেচারা চেহারা নিয়ে মনিরা পারভীনের বাড়িতে এসেছিল, সেই গেঁয়ো, হাঁদা আর নেওটাভঙ্গির মুখশ্রী তার প্রোফাইলে খুঁজে পাওয়া যায় না! মতিনের গায়ের এঁদো কাদামাটি যেন কোনোকালেই ছিল না। সহকর্মীদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে সমুদ্রে হাফপ্যান্ট পরা কিংবা বিশাল সুপারশপে খেঁজুর গাছের আলোর মধ্যে হাস্যোজ্জ্বল এই ছেলেটি কি আসলেই মতিন! পুতুল পুতুল মেয়েদের মাঝখানে দাঁড়ানো ছেলেটি! মনিরা আবার ভালো করে ইনফরমেশন দেখে, ছেলেটা বৈড়ইচারা গ্রামের নামটি পর্যন্ত ঠিক লিখেছে! সহসা মনিরার ভালো লাগে। কেন এই ভালোলাগা? বৈড়ইচারা নামের কথা তো সে নিজেই ভুলতে বসেছিল, যদি না মতিন বিদেশে যাওয়ার সময় তার বাসায় আসত। এমন কি তার মনে হতে থাকে, অস্ট্রেলিয়া থেকে ভাইয়ার ছেলে মেয়ের সঙ্গে কালেভদ্রে কথা হয়। ওরা খুব একটা বাংলা বলতে পারে না। অথচ মতিন কেমন ফুফু ফুফু ডেকে অস্থির করে ফলে, বিদেশে বসেও হালটের পাশের দোপের নামা জমিতে ঢ্যাঁড়সের স্বপ্ন দেখে! তাতে মনিরার বা কী যায় আসে? সে তো গ্রামের কাদামাটি মেখে বড় হয়নি, সাঁতার কেটে কেটে শালুকের গোল মোটা ঢ্যাপ তুলে আনেনি। তবুও এতদিন বাদে মনিরা পারভীনের খুব মরিয়ম ফুফুর কথা মনে পড়ে।
ছেলেবেলায় দাদাবাড়ি বেড়াতে যাওয়া মানেই বাবার সঙ্গে দল বেঁধে জ্ঞাতিদের বাড়িতে ঘুরে বেড়ানো। তখন সে পঞ্চম না ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত, নিশ্চিত হতে পারে না। বৈষ্ণবডাঙ্গি দিয়ে যাওয়ার সময় বাবা বলে উঠল— চল মরিয়মবুরে দেখে যাই। যে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, সেখানে বিরাট উঠোন, যেমন হয় আরকি, সামনে দুটো টিনের ঘর, খড়ের মাচা, লাউয়ের মাচা, বাচ্চাসহ মুরগির কক কক করে ঘুরে বেড়ানো। কত আগের সেই দিন এত বছর পর কেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে মনিরা পারভীনের মনে।
কিন্তু তারা উঠোন পেরিয়ে দুই টিনের চৌচালা ঘরের মধ্যে গরুর রাস্তা দিয়ে ভেতরে বাড়ির উঠানের প্রান্তে রান্নাঘরের সারির মাঝখানে দোচালা মাটির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, বাবা কেমন উঁচু গলায় ডেকে উঠল— মরিয়ম বু.. ও মরিয়ম বু…।
শণের ছাউনিওয়ালা ঘরের দোরটা ছিল পাঠখড়ির। মাথাভর্তি সাদা চুল, কিন্তু বেশ পেটানো শরীরের গঠন নিয়ে বেরিয়ে আসে বিবি মরিয়ম, সহসা— ভাই, ভাই রে…বলে জড়িয়ে ধরেছিল বাবাকে। তাদের আন্তরিকতায় মনেই হয় না তারা কেবল প্রতিবেশী ভাই-বোন! সেই বয়সে মনিরা নিজেকে কেবল বড় ভাবতে শুরু করেছে, অথচ বিবি মরিয়ম হামলে পড়ে তাকে পাখির ছানার মতো কোলে তুলে নিল! বলল— কী ফুটফুইটা মাইয়া!
তবে মনিরার ভীষণ অবাক লেগেছিল যখন মরিয়ম বিবি তাদের খেতে বসাল। না, সেসময় তার সেই খাওয়ানোর জোড়াজোড়ির চেয়েও সে অবাক হয়েছিল খাবার তালিকা দেখে। রাতের রান্না বাসি ভাত আর পাটশাক! যেন মহামূল্যবান সে খাদ্য না খেয়ে গেলে মরিয়ম বিবির জীবনে আর ভাত খাওয়া হবে না। বাপের বাড়ি থেকে আসা ভাই-ভাতিজি যদি না খেলো, তবে তার খেয়ে কী লাভ!
তখন মনিরাই কি জানত শাক আর ভাত মরিয়ম বিবির কাছে কত স্বাদের খাবার! দিনের পর দিন ফেনের মধ্যে নুন বা ভাতের সঙ্গে মরিচ ডলে খেয়ে তার জীবন চলে। স্বামী নেই, সন্তান নেই। শ্বশুরবাড়ির সবচেয়ে খারাপ একটা অংশে তার ঘর, জমি বলতেও ঘরের পাশে একচিলতে মাটি। পরম যত্নে পাটশাকে ভাত মেখে মনিরার মুখে তুলে বিবি মরিয়ম বলেছিল— সোনা আমার আর এক ন্যালা খা। সেদিন সে ভাতের কোনো স্বাদ পায়নি। কিন্তু বহু বছর পর মতিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার কাছে আজ পাটশাকে মাখা ভাতের স্বাদ যেন ফিরে এসেছে! মরিয়ম ফুফুর জন্য চোখ ভিজে ওঠে মনিরার।
ওর মুখে একটা দেশ কত দূরের মনে হলো! আসলেই বাংলাদেশ বহুদিন ওর দেশ নয়! ভাই তবুও কী চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করে বলে চলে, শ্রমশক্তি রপ্তানি করে কানো দেশের অর্থনীতি স্ট্যাবল হতে পারে? যদি কেউ শ্রমিক না নেয়?
২.
চার বছর বাদে দেশে ফিরবে আবদুল মতিন। সে ফোনে জিজ্ঞাসা করে— ফুফু আপনার লিগা কি আনমু?
মনিরা পারভীনের কাছে বিদেশি উপহার নতুন কিছু না। তিনি বলেন— কিছু লাগবে না, তুমি ভালোভাবে দেশে ফেরো।
তবুও মতিনের বিশাল তিনটা লাগেজের ভেতর থেকে তুলতুলে পশমি শাল বেরিয়ে আসে ফুফুর জন্য, ফুফার জন্য মাফলার, জায়নামাজ। বৈড়ইচারা থেকে মতিনের বাবা আর খালু এসেছে। বিশাল সব বাক্স-পেটরা। সঙ্গে লম্বা একটা কাগজের বাক্স। ৪২ ইঞ্চি এলইডি টিভি। মতিন যে বছর বিদেশে যায় সে বছরই বিদ্যুতের খুঁটি বসেছিল বৈড়ইচারা গ্রামে। এত দিনেও লাইন যায় নাই! তবুও যাবে বলেই এনেছে। হাশেম বলল— কারেন্ট নাই, খামাখা ইয়া নিলে চোর-ডাকাতের চোখে পড়ব। ওরা গ্রামে যাওয়ার সময় মনিরা পারভীনের বাসায় রেখে গেল টিভিটা। সেটি স্টোর রুমের আলমারির মাথার ওপরে তুলে রাখল সে। কবে তাদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসবে আল্লাহ জানেন।
কিন্তু দু’দিন বাদে মতিন আবার ঢাকায় এসে হাজির। সারা গায়ে লাল চাকা চাকা, খুব বিধ্বস্ত অবস্থা তার। বলল— বিদেশে তো এসির মধ্যে কাম করতাম, বাইরে যা গরম!
একদিনেই গ্রামের পরিবেশে ছেলেটার এই দশা, তাই বাবা-মা ছেলেকে নিয়ে দৌড়ে আবার ঢাকা এসেছে। হাঁসের মাংস আর রুটিপিঠা বানিয়ে এনেছে মতিনের মা।
ছেলেকে ভালো মতো এক-দুই বেলা খাওয়াতেও পারেনি বলে আফসোস করে সে। মনিরার সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকে নিজেই এটা-ওটা করতে যায়। হঠাৎ রাইসকুকার দেখিয়ে বলে— আপা, এমুন একখান জিনিস মতিনে আনছে।
— তাই নাকি?
— হঁ, পোলাডা কেমুন পাগল… বাড়িতে কারেন্ট নাই। পয়সাপাতি খরচা করনের কী দরকার?
— ছেলেটা শখ করে এনেছে, রেখে দাও, বিদ্যুৎ আসলে…।
সাইদা বেগমের চোখ বেশ জ্বলজ্বল করে। খানিকটা লাজুক হেসে বলে— মতিনে নাকি একখান টিপি আনছে…। আপনার বাসায় রাইখা যাইয়া ভালোই করছে…।
রান্নাঘরে হাতের কাজ করতে করতে মনিরা পারভীনের সবটা শোনা হয় না। তবে সে যখন বলে— টিপিটা একটু দেইখতাম,
তখন মনিরা বলে— ড্রইংরুমে আছে, মতিনকে বললে ছেড়ে দেবে।
সাইদা বেগম সে কথায় খানিকটা লজ্জা পায়। বলে— না, ওইডা না। আমার মতিনে যেইডা আনছে…।
এত কাজের ভিড়ে স্টোর থেকে টিভির প্যাকেটটা এনে খুলে দেখানোর ঝক্কি না নিয়ে মনিরা পারভীন সাইদা বেগমকে স্টোরের সামনে নিয়ে বলে— ওই তো।
সাইদার কণ্ঠে বিস্ময়— এমন চিকন আর বড় প্যাকেট!
সাইদা বেগম উঁচু হয়ে প্যাকেটটা ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করে, বলে— চেয়ারম্যানের বাড়িরডা কেমুন বাক্সো নাহাল মোটা! দাঁড়িয়ে পরম মমতায় ছেলের আনা এলইডি টিভির বাক্সে হাত বুলায় সে, যেন ছোট শিশুটিকে আদর করছে।
মনিরা পারভীন তা দেখেও না দেখার ভান করে সরে যায়।
কয়েক দিন তারা থেকে ছেলেকে ডাক্তার দেখায় ঔষধ কিনে আবার গ্রামে চলে গেল।
মাথা কাজ করছে না, বুকের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে মনিরার, মোবাইলে রিংটন বেজেই চলেছে। ভয় হচ্ছে ধরতে, মতিনের বাবা না তো! কি কথা বলবে তাঁর সঙ্গে, কিন্তু মোবাইলটা বেজেই চলেছে।
এক মাস ছুটি কাটিয়ে বিদেশে যাওয়ার সময় আবার মনিরা পারভীনের বাসায় ঘুরে গেল মতিন। মতিনের মা দুঃখ করে, এত কম দিনের লাইগা আইলো। কোনো কইন্যা দেখা-শোনা করোন গেল না। বিয়াডা দেওন দরকার। মনিরা পারভীন বলে- ছেলের বয়স তো বেশি না, এরপর আসলে বিয়ে দিও।
দুই মাস বাদে সৌদি থেকে ফোন করে মতিন জানায়, নতুন চাকুরি পেয়েছে, আরও বেশি বেতনের। সেই সঙ্গে বাড়তি টাকার নতুন নতুন পরিকল্পনার ফিরিস্তি। সব শেষে বলে— ভ্যালা হইবো না, ফুফু? সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় মনিরা— হ্যাঁ, ভালোই হবে।
মনিরা পারভীন ইদানিং মানুষকে মতিনের গল্প বলতে শুরু করেছে। সেদিন বড় ভাইয়ের ফোন পেয়ে মতিনের গল্প বলল বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে। শুনে খানিকটা দুঃখভরা গলায় বড় ভাই বলে— শোন মনি, এটা কোনো সুখের কথা নয়। একটা দেশের অর্থনীতি রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে, ভাবলেই আমার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে!
ফোনের এপাশ থেকে মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতির কারণে নয়, ভাইয়ের কথার জন্য, ভাইয়া যেন নিজের দেশের কথা বলছে না, ওর মুখে একটা দেশ কত দূরের মনে হলো! আসলেই বাংলাদেশ বহুদিন ওর দেশ নয়! ভাই তবুও কী চমৎকার ভাবে ব্যাখ্যা করে বলে চলে, শ্রমশক্তি রপ্তানি করে কানো দেশের অর্থনীতি স্ট্যাবল হতে পারে? যদি কেউ শ্রমিক না নেয়?
মনিরার মনটা কেবল খারাপই হতে থাকল ভাইয়ের কথায়। সে শুধু মতিনের উন্নয়নে ডুবে ছিল, অথচ তা মোটেও উন্নয়ন নয়! মনিরার খুব বাবা-মার কথা মনে পড়ল। তাদের মৃত্যুর সময় কেবল সে-ই ছিল কাছে। ভাইয়া আর আপা এসে শেষকৃত্যর আনুষ্ঠানিকতা করেই চলে গেল। ওদিকে শূন্য বাড়িতে গিয়ে কতবার সে কেঁদে-কেটে অস্থির হয়ে উঠত!
মতিনের সঙ্গে ফেসবুকে বেশ দেখাটেখা হয় মনিরার। ইনবক্সে মতিন জানাল, ছোট বোনটা ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। ভাইটা ক্লাস নাইনে, ওকে কমার্স নিতে বলেছে। নানারকম ব্যবসার চিন্তা আছে, পরে ভাইকেও নিয়ে যাবে সৌদি। বাবার শরীরটা ভালো না, জেলা হাসপাতালে টেস্ট করার টাকা দিয়েছে, পাইলসের সমস্যা ধরা পড়ছে…ইত্যাদি ইত্যাদি। মনিরা ভাবে, বৈড়ইচারায় হাশেম ভাইকে ফোন করবে। কিন্তু আলসেমিতে আর হয়ে ওঠে না। তাছাড়া মতিন সব এত সবিস্তারে বলে যে জানা হয়ে যায়।
মনিরার বাসায় সেদিন একটা গেট-টুগেদার পার্টি চলছিল। মতিনের ফোন এল তখনই। বাসায় মেহমান বলে তেমন একটা কথা হয়নি। মনিরা ভেবেছিল, মতিনকে পরে ফোন দেবে। হয়ে ওঠেনি। বরং ফেসবুকের ইনবক্সে লিখেছে, কী খবর মতিন? কেমন আছো? তারপর দু-চার দিন নিজেই ফেসবুকে বসার সময় পেল না, মতিনের খবরও জানা হলো না।
সন্ধ্যা সাত বেজে গেছে! মাই গড সিরিয়াল শুরু হয়ে গেছে, বেশ তাড়াহুড়ো করে মনিরা পারভীন টিভি অন করেন। গতরাতে আসিফ যে নিউজ চ্যানেল দেখছিল, শুরুতে পর্দায় ভেসে উঠল তারই মনোগ্রাম। অনেকটা আনমনেই নিচে দিয়ে যাওয়া স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজে চোখ আটকে যায় মনিরা পারভীনের, সেখানে ভেসে যাচ্ছে, সৌদি আরবে আগুনে পুড়ে পাঁচ বাংলাদেশির মৃত্যু! নাম-টাম নেই। তবুও সৌদির খবর দেখে মনিরার হৃদয়টা হঠাৎ ছলকে ওঠে। সে একটার পর একটা চ্যানেল ঘুরে ঘুরে এসে নামের লিস্ট পেল। তাতে লেখা, মৃত ব্যক্তিরা হলেন বৈড়ইচারার আবদুল মতিন…। নামটি জ্বলজ্বল করছে। সহসা ঘুরতে থাকে মনিরার মাথা, নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবে গ্রামে কি খবর গিয়েছে? সে কি ওদের ফোন করবে? কী বলবে? টিভিতে ইতোমধ্যে ভিডিও ফুটেজও দেখালো, কালো হয়ে পুড়ে যাওয়া লাশ। নানা স্মৃতি মনে পড়ে মনিরা পারভীনের, বৈড়ইচারায় বিদ্যুৎ নাই, মতিনের কেনা এলইডি টিভিটা তার স্টোরে এখনো বাক্সবন্দি।
মনিরা পারভীন ভাবে, বিদ্যুৎ পেলেও কি মতিনের বাবা-মার ছেলের আনা টিভিটিতে এমন অন্ধকার ছবি সহ্য হতো!
মাথা কাজ করছে না, বুকের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে মনিরার, মোবাইলে রিংটোন বেজেই চলেছে। ভয় হচ্ছে ধরতে, মতিনের বাবা না তো! কী কথা বলবে তাঁর সঙ্গে, কিন্তু মোবাইলটা বেজেই চলেছে। শেষ পর্যন্ত রিসিভ করলেন মনিরা পারভীন অস্ফুট স্বরে— হ্যালো.. বলেন।
ওপাশ থেকে মতিনের গলা— ফুপু, আমি ভালো আছি, খবর দেখছেননি, খবরের যে মতিনের কথা লেখছে, তা আমাগো গ্রামের শরফুদ্দিনের পোলা।
মনিরা বেগম ঝরঝর করে কেঁদে চলেন— ভালো থাক, বাবা।
বদরুন নাহার
জন্ম ১৯৭৭ সালে ফরিদপুর শহরে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা-সাহিত্যে এম. ফিল ডিগ্রী লাভ করেছেন।
সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। কাজ করেছেন দৈনিক আমাদের সময় এবং দৈনিক সমকাল পত্রিকায়। লেখক হিসাবে কর্মরত ছিলেন শিশু শিক্ষা ও বিনোদন মূলক টিভি শো ‘সিসিমপুর’-এ।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: গল্পগুলো ব-দ্বীপের (২০০৬), ঢেণ্টনপা’র দেশে (২০০৮, এই নামের ট-এর মাত্রা পড়ে যাবে, মূলত ঢ এর সঙ্গে ণ হবে), ভাতগল্প (২০১১), বৃহস্পতিবার (২০১৩), আমাদের গ্রামে মালোপাড়া নাই(২০১৬), বিচ্ছিন্ন সংযোগ(২০১৭) উপন্যাস- আশ্বিনের শেষ রাত্তিরে (২০১৫), মুল্লুক যাত্রা (২০২৪)।
শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ: ‘ককরোজ-নকরোজ’(২০১২)।
সাহিত্যের ছোটকাগজ ভূমিজ (২০০২) সম্পাদনা করেন। গল্প বিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন শূন্য পুরাণ (২০০৮-২০১১) সম্পাদনা করেছেন।
পেয়েছেন নির্ণয় কবি বাবু ফরিদী পদক (২০১১-১২)। ব্রাক ব্যাংক সমকাল সাহিত্য পুরস্কার (২০১৩)। সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য পুরুস্কার (২০১৭)। ২০১৯ সাল থেকে তিনি নিউইর্য়ক প্রবাসী।
b.nahar.p@gmail.com