তামার তোরঙ্গ খুলে দেখে নেওয়া হাজার ঘ্রাণ

                তামার তোরঙ্গ খুলে দেখে নেওয়া হাজার ঘ্রাণ 

                                                   – হাসান রোবায়েত

 

ধরেন, একটা বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্য দিয়ে আপনি হাঁটছেন। দুপুর প্রায় শেষ শেষ। চারদিকে গাছেরা তাদের ফল গুছিয়ে নিচ্ছে রৌদ্রের থেকে। পুরনো সাইকেলে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তুলে কেউ হারিয়ে যাচ্ছে নিজের ছায়ায়। আপনার তৃষ্ণার ভেতর মিঠা পানির কল চাপছে একজন ছিপছিপে তরুণী। তারপর রাত নেমে এলে মূক এক তারা চুপ হয়ে বসে আছে আলোর তল্লাশে। গুল্ম ও ঘাসের মর্মে একটা ট্রেন মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অদূরেই কারো প্রিয় গমক্ষেত লুট হয়ে যাচ্ছে।

 

ভাবছেন, এমন ইশারা, ধ্বনি কোথায়?

 

মোস্তফা হামেদী ছোট ছোট বাক্য আর সান্দ্র ইমেজ দিয়ে তার কবিতায় এমনই একটা আশ্চর্য জগৎ তৈরি করেন। এ যেন বহু পুরনো কোনো তামার তোরঙ্গ খুলে হঠাৎ পাওয়া যাবে সেইসব ঘ্রাণ যা মেঠোফুলের বয়ানে উজ্জ্বল। হামেদী সহজেই নিয়ে যেতে পারেন তার আপাত-লোকো-জগত আর রোদ-ঝরঝরে ভাষা দিয়ে এক আর্কাইক বাংলায় যা চিরদিনের হয়েও কী গভীর সমকালীন!



              মোস্তফা হামেদী প্রণীত ‘তামার তোরঙ্গ’ পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতা


 

বিভ্রম

 

শুয়ে থাকা লম্বাটে ছায়ার নামই শেষ দুপুর

 

রোদের দিকে তাকিয়ে গাছ

গোছাচ্ছে ফল

 

পিতলের থালায় এখনও কেউ লিখে যাচ্ছে

কতিপয় রোগের নাম

 

কাঠের ঘ্রাণ শুঁকে বলে দিতে পারে

জাহাজের মাস্তুলে

কী কী কথা বুনেছিল নাবিকেরা

আর ক’নটিক্যাল পরে

মিঠা পানির কল চাপছে

ছিপছিপে তরুণী

 

তার চেহারার রঙে গড়িয়ে যায়

যেসব মোহ

 

মেঘের নামাবলী ভেসে উঠছে সেসব আর্দ্র

আয়নায়—

 

 

সায়াহ্ন

 

চিরচুপ মানুষের বাড়ি

কবরখোলার গাছে বায়ু

পাতা কাটাকুটি খেলা শেষে

অতল ঘুমের গহ্বরে

সায়াহ্ন একমাত্র ঋতু

ভ্রমণের মেয়াদ ফুরিয়ে

কেবলি বেকার বেসে থাকা

যেন নষ্ট ফিতার ক্যাসেট

অথবা ফাঁপা ট্রানজিস্টার

কেউ খুলে নিয়ে গেছে গান

মহা আসরে বাজাবে বলে

ফুসফুস থেকে উবে গেছে

হাওয়া, বাক্যের প্রয়োজন

 

 

নিব

 

নিভন্ত কলমের ভিতর

কে জেগে থাকে

মৃদু নিদ্রায়

অস্ফুট সে বোল

খোলে না

সম্পূর্ণত

 

সমাহিত ঢেউ ছিঁড়ে

নারীরা বানায় ঘুঙুর

পায়ের মুদ্রায়

 

তার ধীর ছন্দে

মূক এক তারা

আরও কোনো আলোর

তল্লাশে

         চুপ

 

 

হুইসেল

 

যেখানে মিলিয়ে যায় ট্রেন

শাঁসটুকু ফেলে

 

ধ্বনিকণার রেশ

ছড়িয়ে যায়

গুল্ম ও ঘাসের মর্মে

 

কোনো ফুল

যদি ছুঁয়ে দেখে

ঐ সুরের প্রোটন

 

গান গায় মিহি রাগে

 

সে সমর্পণ

 

পাতায় মৃদঙ্গের দোল

নৃত্যপর হাওয়া

 

 

সঙ্গলিপ্সা

 

সে রকম ইশারা

 

ধ্বনি

 

কোথায়

 

বলো, ঝরা পাতার বুক,

আর্দ্রতা

 

 

মধুলগ্ন

 

দুপুরের জন্ম আফিম বাগানে

 

হারিয়ে যাওয়ার বাসনারা জড়ো হয়

কোথাও ডাকছে তিলা ঘুঘু

 

পুরনো সাইকেলে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তুলে

কেউ হারিয়ে যায় নিজের ছায়ায়

 

 

আকার

 

একটা ফুল হলো ডাঁটা

 

একটা ফুল হলো চোখ খোলা পাঁচটি পাঁপড়ি

 

একটা ফুল হলো নিকটবর্তী ঘ্রাণ

 

একটা ফুল হলো রঙের ঘনিষ্ঠ মিত্র

 

একটা ফুল হলো সংবেদনের ধারণামাত্র

 

সে একটা রাজহাঁস

ভেসে উঠছে সময়ের তরলাভ পর্দা ছিঁড়ে ছিঁড়ে

 

 

প্রলাপ

 

গমক্ষেত। প্রিয় গমক্ষেত, লুট হয়ে যায়।

শেয়ার