কিছু কুকুর আছে এলাকায় মাংসসহ হাড় পেলেও খায় না। এমনকি শুঁকেও দেখে না। একটু-আধটু ফিরে তাকায়। তাও দ্বিধান্বিত হৃদয়ে। এলাকার অন্য কোনও কুকুর ওই হাড়ের দিকে তাকানোটা দেখে ফেললো না তো! তারপর এদিক-ওদিক যায়। অন্য পাড়ায় গিয়ে ভাব মারে, গুলতানি গপ্পো ছুঁড়ে দেয় কুকুর-কুকুরীদের দিকে, নিজের পাড়া যা-তা, গরীব। নেহায়েৎ ভুল জায়গায় জন্ম হয়ে গেছে, তা নাহলে কী তার মানের কুকুর ওই এলাকায় থাকে! এদিকটায়, প্রাচুর্যময় এলাকায় বেড়াতে এলেই কেবল জাতে ওঠা হয়। আহা, অভিজাত! এখানকার গু’টাও মনে হয় বেহেশতে অর্ডার দিয়ে বানানো। ভিনপাড়ায় গিয়ে এসব তাফালিং করে, দু-একটা কুকুরী পটাতে চেষ্টা করে, শেষ পর্যন্ত পাত্তা না পেয়ে গু-বাসি খেয়ে নিজের পাড়ায় ফিরে আসে। এসে দেখে হাড়-মাংস কিচ্ছু নাই। কিন্তু হেব্বি গল্প জুড়ে দেয়। জানিস রকি, ওই এলাকায় যা খাইলাম না আজকে! অমৃত! হাড় দেয় না; খালি মাংস আর মাংস, বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই হলো।
সত্যিটা ভিন্ন। অন্যদেশের কুকুরেরা কিন্তু এদের কলোনির আমলের নেটিভ কুকুর হিসেবেই দেখে। চাকর-বাকরের বেশি কিছু ভাবে না। ইউরোপ-আমেরিকার মানুষও ঠিক সেভাবেই দেখে বাদামি-কালো ত্বকওয়ালাদের। হলে হবে কি, আমরা কিন্তু ফরেন বলতে অজ্ঞান! প্রতিবেশী-আত্মীয়দের ফরেন মালপত্রের অ্যারিস্টোক্রেসি না দেখাতে পারলে বা, ব্যাপারটা গপ্পে না আনতে পারলে ইজ্জত থাকে না। আবার উপহারসামগ্রী হিসেবেও ফরেন মাল না পেলে সবাই নাখোশ! ফরেন মাল-পত্তর ছাড়া আমাদের চলেই না!
ফর্সা মানেই সুন্দর, আর কালো হলেই অসুন্দর এমন একটা বিশ্রী দর্শন এখনও আমরা মনে মনে লালন করি। বউ পছন্দ করতে গেলে আগে তার চামড়ার রঙ দেখি। টেলিভিশন-চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সুশ্রী হতে হবে, নাহলে হবে না। এই যে মনে মনে আমরা এতোটা বর্ণবাদী, এটা কি এমনি এমনি? এটা কলোনিয়াল ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সের একটা উদাহরণমাত্র।
একদা পুরো ভারতবর্ষ ছিল বৃটিশ কলোনি, প্রায় দুইশ’ বছরব্যাপী। ইংরেজ ক্লাবের দরজায় লেখা নোটিশ, ‘কুকুর ও নেটিভদের প্রবেশ নিষেধ’ আজ আমাদের বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। এক সময় বাঙলার মসলিনের খ্যাতি ছিলো জগৎজোড়া। লোকমুখে শোনা যায়, মসলিন এমন এক প্রকার কাপড় ছিলো, যার পুরোটা একটি আংটির ভেতর দিয়ে পার করা যেতো! বিলেতি মেমদের মনোযোগ নিলো মসলিন। তাদের জন্য মসলিন বানানো শেষ হলে কেটে ফেলা হতো গরীব তাঁতীর আঙুল; যাতে অন্য কারো জন্য অনুরুপ মসলিন আর না বুনতে পারে। এভাবে একেরপর এক আঙুল কেটে নেওয়ায় পরবর্তী প্রজন্মকে মসলিনের বুনন শিখিয়ে যেতে পারেননি সেসব তাঁতশিল্পী।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘হারানো আঙুল’ নামে অসাধারণ একটি কবিতা লিখে গেছেন। সেই হারানো আঙুল আসলে মসলিনশিল্পীর আঙুল। সোনারগাঁ, যেখানে মসলিনশিল্পীদের মূল আবাস ছিল, সেখানে গিয়েই হয়তো হাহাকারভরা এই কবিতাটি লিখেছিলেন রুদ্র-
হারানো উত্তাপ আমি খুঁজতে খুঁজতে কেন ওই জীবনের হাড়
লতা গুল্ম, ভাঙা ইট, কেন ওই দেয়ালের পাথর সরাই!
কেন শুধু মসলিন মসলিন বলে কেঁদে উঠি বুকের ভেতরে?
ভাঙা-ইট, ওই হাড় ও-তো শুধু বেদনার ব্যর্থ অবশেষ
আমি তবু সেই ধূলো খুঁড়ে খুঁড়ে শুঁকে দেখি ভেতরের মাটি।
কেন দেখি? কেন সেই শিল্পীর কাটা আঙুল খুঁজে পেতে চাই?
পেতে চাই তাঁতের হৃদয় থেকে বেজে-ওঠা শ্রমের সঙ্গীত
. . . . . . . . . . . . . .
রেশমের তন্তুমুগ্ধ এক নতুন আঙুল
বিশ্বাসের তাঁতে আজ আবার বুনতে চাই জীবনের দগ্ধ মসলিন।
কবি রুদ্র না হয় জীবনের দগ্ধ মসলিন ফিরে চেয়েছেন, কিন্তু এদেশের আর ক’জন মানুষ চান? আমাদের কলোনিয়াল হ্যাঙওভার আসলে এখনও কাটে নাই। প্রয়োজনীয়তার অপর নাম বিধাতা। তাই আইইএলটিএস কোচিং, সাইফুরস্, বিলেতি ডিগ্রি- এসব ব্যাপারে নাহয় নাই বললাম। তবে এটুকু তো সত্যি যে নিজের ভাষাটা ঠিকঠাক না শিখেই আমরা ওসবের পেছনে দৌঁড়াই। কেননা, বাংলাটা শিখলে পরিবারে, সমাজে, কর্পোরেট চাকরির বাজারে দাম পাওয়া যায় না। বিদেশি ডিগ্রি থাকলে, চোস্ত ইংরেজ হতে পারলে সব জায়গার মাথা হওয়া যায়। প্রভাব-প্রতিপত্তি পাওয়া যায়।
সাহিত্যের দিকেই তাকাই। বাংলাদেশে নব্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত হাজারে হাজার। এটা বলে অবশ্য মহাকবি মাইকেলকে অপমান করা হচ্ছে। মাইকেল মাতৃভাষাটা খুব ভালভাবে জানতেন। কিন্তু তা জেনেও কলোনির অসুখে আক্রান্ত হয়ে তিনি সাহেব হতে চেয়েছিলেন। যাদেরকে প্রভু আর দ্রষ্টা মেনেছিলেন তিনি তারা কিন্তু পাত্তা দেয় নাই তাকে। কখনো দেয় না। বাংলাটা ভাল জানতেন বলেই ফিরে এসে মেঘনাদবধ লিখতে পেরেছেন। ইদানিং অনেক ঔপনিবেশিক লেখক-কবি দেখি, যারা ইংরেজিতে লিখে বিখ্যাত হবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু নিজের মায়ের ভাষাটা ঠিকঠাক লিখতে জানেন না তারা। তাদের ভাবনাটা এমন, ইংরেজরা স্বীকৃতি দিলেই মহান সাহিত্যিক হয়ে উঠবেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত কোনও লেখিকার বই ইংরেজ রাজনীতিবিদ পড়লেও তাই দৈনিক পত্রিকার খবর হয়!
আরেকটা উদাহরণ একদম টাটকা। গেলো কোরবানি ঈদের দিন ঢাকায় প্রবল বর্ষণ হয়। সেই বর্ষণে ঢাকার সুয়ারেজ ব্যবস্থার করুণ অবস্থা ফুটে উঠলো, সারা ঢাকা শহর রক্তময়। পানির সাথে রক্ত মিশে একাকার। লাল স্রোত চারিদিকে। আর পায় কে! ছবি তোলা শুরু, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে সেই লালরঙা পানির স্রোতের খবর পৌঁছে গেলো বিশ্বময়। ঢাকা নোংরা শহর, ঠিক আছে। কিন্তু এই শহরটা তো আমাদের। সেই খবরে বিশ্ববাসী মনে করলো, ঢাকা বুঝি কানিবালের শহর। আমাদের সংবাদমাধ্যম এবং আমরা এই নগরের নাগরিকরা একবারও ভাবিনি, ঢাকার তিলকে যে দুর্নামটা লাগছে, তা আমাদের তো বটেই এই দেশের তিলকেও লাগছে। অত ভাবলে কি আর চলে! আমাদের মিডিয়ারও তো এখনো কলোনিয়াল হ্যাঙওভার কাটে নাই। এটাই প্রমাণ।
ম্যাকডোনাল্ডস এখনও আসে নাই বাংলাদেশে। শিগগিরই এসে যাবে, এ নিয়ে সংশয় সামান্যই। বিদেশে গিয়ে ম্যাকডোনাল্ডসে খাওয়ার গল্প করে এক শ্রেণির মানুষ জিভে ফেনা তুলে ফেলেন। আর আফসোস করেন, ফাকিং গরীবের দেশে ওরকম রেস্টুরেন্ট নাই। প্রেমিকা, পসারিণী, পরিবার নিয়ে একটু কোয়ালিটি সময় কাটাবেন, তা হচ্ছে না। তাও মন্দের ভালো কেএফসি, পিৎজা হাট। ওখানে গিয়ে খুব প্রেম করা যায়। খানাপিনাই যখন প্রেম আরকি! সেলফি তুলে ফেসবুকে চেকইন দেওয়া যায়। তাতে কলোনিয়াল মানসিকতার মানুষদের কাছে কদর বাড়ে। নব্য টাকাওয়ালা লোকের বউয়েরা সারাদিন ঘুমিয়ে, স্পা-টা করে, সিরিয়াল দেখে বিকেলের দিকে সোনামনিদের নিয়ে কেএফসি-পিৎজা হাটে যান। মুরগি-টুরগি খাইয়ে, একটু খেলিয়ে-দুলিয়ে বাচ্চাগুলাকে হাতির বাচ্চার মতো দেখতে খুব ভালবাসেন এসব মায়েরা-বাপেরা। ওরকম হাবদু-মাবদু টাইপের না হলে নাকি সমাজে মুখ দেখানো দায়! এসব মায়েরা নিজেরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছে ওরকম পুতুল বউ হতে। কলোনিয়াল মানসিকতা তাদের শিখিয়েছে, বিদেশি রেস্টুরেন্টে নিয়মিত না খেলে সামাজিক জীব হওয়া যায় না। বাসার কাজের মেয়েটাকে সাথে নিয়ে বসিয়ে রাখছে এবং খাচ্ছে। কিন্তু তার জন্য খাবার কিনে দিতে গিয়ে টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে! নিজের জাতি-পরিচয়ে সন্তানকে বড় হতে দিতে, নিজেদের খাবার খাওয়াতে ওনাদের অনীহা। আহা! এইসব ছেলে-মেয়েরা কোনদিন জানবে না দুধচি পিঠার স্বাদ। কলাপিঠা, চিতই, ভাঁপা, পুলি আরো কতো শত পিঠার স্বাদ ওরা কখনও পাবে না। মা পিঠা বানাচ্ছেন, পিঠা জ্বাল হচ্ছে আর মৌ মৌ করছে সারাবাড়ি। পিঠা খাবার জন্যে অপেক্ষায় জিভে পানি চলে আসার মুহূর্ত কোনদিন ওরা বুঝতে পারবে না।
ওসব পরিবারের কর্তা-বাবার ব্যাপক আনন্দ, সন্তান বাংলা বলতে-শিখতে না পারলেও ইংরেজিতে আটকায় না! কলিগ, বন্ধুদের সঙ্গে কথায় কথায় সেই গর্বের গপ্পো। এই যে এফএম রেডিওর জকিরা একশ’ শব্দ বললে সত্তরটাই ইংরেজি বলেন, বাকী তিরিশভাগ বাংলা শব্দকেও চিবিয়ে ইংরেজির মতো করে উচ্চারণ করার চেষ্টা করেন। নিজের নামটাও সেভাবেই বলতে চান (উদাহরণ: আবরারকে ‘ব্রার উচ্চারণ করা)- এসবেও ওই কলোনিয়াল অসুখ। আর রেডিওজকিদের এভাবে বলার জন্য মালিকপক্ষই নির্দেশ দেন। মালিকপক্ষের লোকজন হচ্ছেন সেই শ্রেণির, যারা বছরের বেশিরভাগ সময় ইউরোপ-আমেরিকায় কাটান। তারা সন্তানদের নামজাদা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, আলিশান কর্পোরেট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা বিদেশে পড়তে পাঠান।
যারা শিল্প-সাহিত্য করি, কথায় কথায় সমাজ বদলে দিই, অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ আওড়াই ব্যক্তিজীবনে সেই আমরা কতখানি স্বদেশি? খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে মাস্টার দা সূর্যসেন-প্রীতিলতার বংশধরদের কেউ কেউ ক্যাপিটালিস্ট সমাজের চূড়ায় বসে বা বিদেশি কোম্পানির হয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাঠাচ্ছেন! কিছুই অসম্ভব নয়। টাকা হলে মার্কস-এঙ্গেলস কপচানো লোকগুলো আরো ভয়ংকর কলোনিয়াল হয়ে যায়। আমরা বাইরে মুখে বাঙালি-বাঙালি বলে ফেনা তুলে ফেললেও আসলে ভেতরে ভেতরে চূড়ান্ত কলোনিয়াল সিটিজেন, বিশেষ করে নব্য ধনিকশ্রেণি। আমাদের জীবনাচরণ নিজ পাড়ার প্রতি ঘেন্না নিয়ে অন্য পাড়ায় গু খেয়ে আসা সেই কলোনিয়াল রোগগ্রস্ত কুকুরজাতের মতো। দুঃখিত, এটাই সত্যি।