কনফুসিয়াস ফ্রম দ্য হার্ট । ইউ ড্যান । বাংলায়ন : নাঈম ফিরোজ । দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ চতুর্থ পর্ব

                                              যাত্রাঃআত্মা অভিগমে, পেরিয়ে যাই অন্তর

 

জাপানি লেখক Daisetsu Suzuki এর বইয়ে আমি Edo যুগে এক প্রসিদ্ধ চা অলার আখ্যান শুনতে পাই, যিনি তার শক্তিশালী ও মহাত্মন প্রভুর অধীনে কাজ করতেন।যেমনটা আমরা সবাই জানি, জাপান চা উৎসবকে পালন করে থাকে Zen প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, যেখানে চা উৎসব ও মধ্যস্থতা-সালিশ একই আয়োজনের দুটো অংশ।

একদিন সেই প্রভু রাজধানীতে বাণিজ্যের কাজে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তার চা-অলাকে ফেলে যেতে পারছিলেন না। তাকে প্রভু শুধালেনঃ ‘আমার সাথে চলো হে, যাতে আমি তোমার চা প্রতিটি দিনই পান করতে পারি হে।’

কিন্তু সে সময়ের জাপান ছিলো খুবই বিপজ্জনক।দস্যু এবং প্রভুহীন Samurai-Ronin যারা কান্ট্রি সাইডের লোকালয়ে ঘুরে বেড়াতো আর অধিবাসীদেরকে ভয় দেখাতো। চা-অলা সন্ত্রস্ত হয়ে জানালো- ‘আমার অস্ত্রবিদ্যে কিছুই জানা নেই প্রভু, যদি আমি পথে কোনো বিপদে পড়ি তো?’

তার প্রভু উত্তরে বললেন- ‘একটি তলোয়ার নিয়ে নাও সাথে আর সামুরাইদের মতোন পোষাক নাও গায়ে চাপিয়ে।’

চা-অলার কোনো গত্যন্তর ছিলো না, সে একজন সামুরাই এর দেহবসন ধারণ করলো ও তার প্রভুর সাথে রাজধানীতে গেলো।’

একদিন তার প্রভু তার বাণিজ্যের নিয়তে বাইরে চলে গেলো, আর সেই চা-অলা নিজ থেকেই একাকী হাঁটতে বেরুলো। সেই সময়ে একজন Ronin যোদ্ধা তার সামনে এলো এবং তাঁকে যুদ্ধে আহ্বান করে বসলো এই বলে যেঃ ‘তুমিও তো দেখছি একজন যোদ্ধার বেশে আছো, আসো দেখি আমার শক্তির সামনে তোমার রণকৌশলের পরীক্ষা হয়ে যাক দেখি হে।’

চা-অলা বলে- ‘আমি তো যুদ্ধের কিছুই জানি না হে, আমি তো এক চা-অলা মাত্র।’

Ronin যোদ্ধা শুধায়- ‘তুমি তো সামুরাই নও, কিন্তু তাদের দেহ-বসন ধারন করেছো। তোমার যদি লজ্জা বা আত্মসম্মান থাকে তবে তোমার উচিত আমার তলোয়ারের নিচে জীবন দেয়া।’

চা-অলা মাথা ঘামাতে লাগলো কিন্তু সেখান থেকে কোনো সাড়া সে পেলো না এই বিপদে উদ্ধার পাওয়ার তরে। তাই সে প্রস্তাব দিলো- ‘আমাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য ছেড়ে দাও, যাতে আমি আমার প্রভুর দেয়া কাজগুলো করে উঠতে পারি। আজ অপরাহ্ণেই তোমার সাথে জলার ধারে আমার দেখা হচ্ছে।’

Ronin যোদ্ধাটি ভাবলো খেল খতম এবং সে বলে দিলো, ‘ তা যাও, তবে সেখানে এসো, নইলে…’

চা-অলা খুব দ্রুত রাজধানী শহরের সেরা মার্শাল আর্ট স্কুলে গেলো। সে সোজা প্রধান সামুরাই শিক্ষকের কাছে গিয়ে বললো- ‘আমি করজোড়ে প্রার্থনা করছি আপনার তরে, আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন, কী করে সর্বাপেক্ষা সম্মানজনক মৃত্যুকে বেছে নিতে পারে এক সামুরাই?’

প্রধান সামুরাই শিক্ষক যারপরনাই বিস্মিত হলেন। ‘মানুষ এখানে আসে জীবিত থাকার কৌশল রপ্ত করার মানসে আর তুমিই প্রথম যে চাইছো মরণের কৌশল শিখতে, কী হয়েছে আসলে তোমার?’- তিনি বললেন।

চা-অলা তার সাথে Ronin যোদ্ধাটির দেখা হবার কথা জানিয়ে জবাব দিলো- ‘আমি কেবল চা বানাতেই জানি, কিন্তু আজ আমাকে মরণপণ লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে। আমি শুধু চাইছি একটু সাম্মানিক মরণ, আমাকে তা দয়া করে শিখিয়ে দিন।’

প্রধান সামুরাই শিক্ষক বললেন- ‘বেশ তো, আগে তুমি আমার জন্য এক কাপ চা বানাও, আমি তোমাকে বলে দেই কী করা যাবে এই নিয়ে।’

চা-অলা খুব অবধস্ত হয়ে জানালো- ‘ এই বুঝি দুনিয়াতে আমার জীবনের শেষতম চা তৈয়ার!’ 

সে উহা খুব যত্ন নিয়ে করলো, শান্তভাবে লক্ষ্য করলো সে, কীভাবে ঝর্ণার জল নেমে আসে কেটলিতে, তা ফোটে উত্তাপে, ছোট এক চুল্লির ‘পর। তারপর  চা পাতা রেখে তাতে জলধারা বইয়ে ধুয়ে নিয়ে, ছেঁকে নিয়ে একদণ্ড, অল্প অল্প করে ঢেলে দেওয়া। তারপর চা হয়ে এলে একটি কাপে স্নিগ্ধভাবে ঢেলে তা সে প্রধান সামুরাই শিক্ষকের হাতে তুলে দেয়া।

প্রধান সামুরাই শিক্ষক পুরো প্রক্রিয়াটি অবলোকন করেই ফেললেন যেনো, তিনি মুখভরে চা পান করে নিয়ে যা শুধালেন- ‘এ হচ্ছে আমার জীবনে পান করা সেরার সেরা চা, আমি তোমাকে এখন বলেই ফেলতে চাই যে তোমার এখনি মরবার কোনো দায় নেই একদম।’

চা-অলা জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলে গেলো- ‘আমাকে তাহলে কী শেখাবেন এখন?’

প্রধান সামুরাই শিক্ষক বললেন-‘কিছু না তো, তোমাকে আমার শেখানোর নেই আর কিছুই, তুমি যখন Ronin যোদ্ধাটির মুখোমুখি দাঁড়াবে তখন তোমাকে শুধু সেই নিবিড় মনের উপর নির্ভর করতে হবে, যা তুমি চা বানানোর সময়ে প্রয়োগ করেছিলে এইখানে, আর কিচ্ছুটি না!’

এই বাণী শুনে চা-অলা তার নির্ধারিত সাক্ষাতের জন্য ফিরে গেলো আবার। Ronin যোদ্ধাটি সেখানে আগেই অপেক্ষা করছিলো তার জন্যে, তাকে দেখামাত্রই নিজের তলোয়ার বের করে সে তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে বললো- ‘ এই তো তুমি এলে, নাও আমার সাথে অস্ত্রের লড়াইয়ে উপনীত হও!’

মহান সামুরাই প্রধান শিক্ষকের কথা স্মরণ করতে করতে সে Ronin যোদ্ধাটির মুখোমুখি হলো, ঠিক সেভাবেই যেভাবে তার হাতে তৈরি হয়েছিলো অবিস্মরণীয় এক কাপ চা। সে একটানা স্থিরভাবে তার প্রতিপক্ষের দিকে চক্ষুপাত করলো, তারপর ধীরেই তার মাথার টুপিটা খুললো, তা সে নিজের পাশেই ভালোভাবে রেখেও দিলো, তারপর সে তার ঢিলেঢালা আস্তিন খুলে রাখলো ভাঁজ করে, এবং তা তার টুপির নিচে শয়ান করে দিলো। তারপর সে কাপড়ের কিছু টুকরা করে নিলো এবং তার ভেতরের পোষাকের বাঁধন শক্ত করে নিলো তার কব্জির সাথে। এইভাবে সে তার পাজামার বাঁধনও পায়ের সাথে জোরালোভাবে বেঁধে নিলো। সে তার আপাদমস্তক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে নিলো এবং সর্বাঙ্গীণ প্রস্তুতি নিয়ে নিলো।

Ronin যোদ্ধাটি উদ্বিগ্ন হতে লাগলো। যতই সে দেখলো ততই সে অপ্রস্তুত হতে লাগলো। সে বুঝতেই পারছিলো না তার প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা ঠিক কতটা বেশি। প্রতিপক্ষের চাহনি ও হাসি তার নিজের সম্বন্ধে নিজের অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলছিলো।

চা-অলার যখন পোষাক পরা সমাপ্ত হলো, তার চূড়ান্ত পদক্ষেপ ছিলো তরবারি ঝাকরে তার খাপ থেকে বের করে আনা, এবং তা শূণ্য বাতাসে কতকবার কাটাকুটি করে দেখানো, এবংএরপর সে থেমে গেলো কারণ এরপরের করণীয় তার ছিলো অবিদিত।

Ronin যোদ্ধাটি তখন তার পায়ে নতজানু হয়ে পড়ে প্রাণভিক্ষা চাইলো আর বললো- ‘ আমার জীবনে আমি এতো দক্ষ যোদ্ধা দেখি নাই।’

চা-অলার বিজয় কি তার যুদ্ধ কৌশলে উত্থিত ছিলো? না, তা ছিলো তার অন্তরের অকুতোভয় সাহস, এবং তার ধীর ও সুসংহত আত্মবিশ্বাস। তার বিজয় এনে দিয়েছিলো তার মনোভাব যা দিয়ে সে এই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

কৌশল ও দক্ষতাই জীবনযুদ্ধে শেষ কথা নয়। যা কিছু আমাদের কৌশল-বলের সীমাতীত, তা সম্পাদনে আমাদের অন্তর ও আত্মাকে কাজে লাগানো চাই। 

(চলবে)



পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

শেয়ার