আমরা যারা ছোট থাকতে এতিমখানায় মানুষ হয়েছি তারা বড় হলে বছরে একবার নিজেদের এতিমখানায় সম্মানিত ওস্তাদজিদের সাথে মোলাকাত করতে যাই। যেদিন যার ত্রিশ পারা কোরান শরীফ হেফজ করা শেষ হয়েছে সেই দিনটাতেই সে যাওয়ার চেষ্টা করে।
আমি বছরে একবার গেলেই ওস্তাদজিরা প্রশংসা করে বলেন,’মুত্তাকিম, এখনকার মতই ছোটবেলায়ও তোমার চেহারা মোবারকে সূর্যের রশ্মিই ছিল। তুমি ছিলা আরো টকটকা, নূরানি চেহারার।’
আমি লজ্জায় তাঁদের উত্তর দিই,’আপনাদের দোয়ার বরকতে আজ আমি সবচেয়ে কম বয়সে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। আমাকে খাস দিলে আরো দোয়া করবেন।’
আমার ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ছে। সেইদিনগুলো ছিল খুব কষ্টের! একেকদিন একেক ওস্তাদজি ফরমায়েশ দিতেন। মাঝে মাঝে খুব বেদিশা লাগত সবকিছু। গোস্বা করে খানা খেতাম না। ওস্তাদজিদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্কজন একদিন বললেন,’ মুত্তাকিম, ফজরের নামাযের ওযু সেরে পুকুর থেকে মসজিদে ফেরার পথে মেসওয়াকটা কোথায় যেন পড়ে গেছে পকেট থেকে, খুঁজে নিয়ে আসো।’
আমি মাটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খুঁজতাম দুপুরের রোদের মধ্যে, অনেকক্ষণ খোঁজার পর পেয়ে গেলে খুশি লাগত ঠিকই, তবে অসুস্থ হয়ে পড়তাম।
আরেকদিন আরেক ওস্তাদজি বললেন,’মুত্তাকিম, আমার চাবিটা মাঠের কোথায় হারিয়ে গেছে, খুঁজে আনো।’
আমি আবারো দুপুরের রোদের মধ্যে মাটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘাসে খুঁজতে নামলাম। কয়েক ঘন্টা পর পেলাম, কিন্তু অসুস্থ হয়েছি আবার।
এভাবে ওস্তাদজিদের যাঁর যাই হারানো যেত তালাশের দায়িত্ব দেওয়া হত আমাকে। একইভাবে মাটিতে চোখ রেখে রেখে বের করতাম।
শেষবার এক ওস্তাদজি আমাকে বললেন,’মুত্তাকিম, আমার পাঞ্জাবির একটা বোতাম খুলে পড়ে গেছে মাঠের কোথাও, অন্য বোতাম লাগালে বিদখুটে লাগবে। তালাশ কর।’
সেদিন টানা সাড়ে তিন ঘন্টা ঘাসের ভেতর তালাশের পর ছোট্ট বোতামটি খুঁজে পেয়েছিলাম। দীর্ঘসময় রোদে থাকায় আমার জ্বর এসেছিল।
আজ আমার এতিমখানায় আসার দিন দিল। সকালেই ওস্তাদজিদের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। কিন্তু আজ থেকে তাঁদের প্রতি আমার আর কোনো গোস্বা নাই। এক
ওস্তাদজি আমার ভুল ভেঙ্গে দিলেন। তিনি কথা প্রসঙ্গে বললেন,’মুত্তাকিম, ছোটবেলায় তুমি খুব মেধাবী ছিলে একথা সত্যি। কিন্তু সেইসাথে তোমার মন খুব অশান্ত থাকত, অস্থির ছিলে তুমি, আর ছিলে ধৈর্যহীনদের দলে। মাটিতে বিভিন্ন জিনিস খুঁজতে খুঁজতে এক সময় তোমার বদ স্বভাবগুলো চলে গিয়েছিল। আমাদের জিনিস হারানোটা ছিল অজুহাত মাত্র, ইলমের কৌশল।’
আমার ওস্তাদজিরা কতটা প্রজ্ঞাবান ছিলেন তা আপনাদের জানাতেই এই চেষ্টা, আমি কখনোই লেখক নই।