চিত্রপরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতেন। সে-ই অনুষ্ঠানে শিল্প-সাহিত্য-সিনেমাঙ্গনের গুণী শিল্পীদের অতিথি ক’রে আনতেন তিনি। একবার ঋতুর অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁদের সে-ই আলাপচারিতা ইউটিউবে পাওয়া যায়। সেখান থেকেই শিরিষের ডালপালার পাঠকদের জন্যে শ্রুতি লিখনের কাজটি করেছেন কবি শাদ আশরাফ। শাদকে সহযোগিতা করেছেন ধরিত্রী প্রকৃতি ও আব্দুর রহমান।
ঋতুপর্ণ: আজকে ঘোষ এ্যান্ড কোম্পানিতে… একচুয়ালি আজকে ঘোষ এ্যান্ড কোম্পানিটা ঘোষ এ্যান্ড গঙ্গোপাধ্যায়। আমার সঙ্গে সুনীলদা রয়েছেন। যার প্রায় ব্র্যান্ড নেম সুনীলদা হয়ে গেছে এখন। এখন ওনাকে সুনীলদা বললেই চেনেন সবাই। সুনীলদা গঙ্গোপাধ্যায়… সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এবং আমরা ভাবছিলাম আজকে যেহেতু আমি মনে করি সুনীলদা হচ্ছেন আমার কাছে কলকাতা শহরের একজন ক্রনিকলার। কলকাতা শহরকে নিয়ে সুনীলদার মতন….কলকাতা শহরকে অনেকটা চিনিয়েছেন সুনীলদা। আমরা যদি আড্ডার বিষয়টা সেটা রাখতে পারি, দেখা যাক, সেখান থেকে কোথায় গিয়ে পৌঁছোনো যায়। এটা তো সত্যি আমাদের একটা…আমাদের..এই যে…ইতিহাসবিস্মৃত বাঙালি এবং আমাদের ঐ অল্প কথায় প্রায় পুরো জিনিসটা চিনিয়ে দেওয়া, ঐ সময়টার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এটা তো আমরা একদম একটা রুদ্ধশ্বাস উপন্যাসের মত করে পড়েছি। আমরা ঐ সময়টার সঙ্গে বড় হয়েছি। এবং হয়তো যেটা, ঐ তুমি যখন সেই সময় লিখতে শুরু করেছো, তখন এটা এমন একটা ফর্ম্যাটিভ বয়স আমাদের যে আমরা রেসপন্ডও করেছি এটার সঙ্গে খুব সুন্দর করে। এবং আমাদের মনে হয়েছে যে যখন আমরা ইতিহাস পড়েছি তখন যদি এরকম করে কেউ আমাদের লিখে দিতো।
সুনীল: রণজিত গুহ বলে একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আছেন। বিদেশে থাকেন বহু বছর ধরে। তিনি আমাদের কি হলো- আমরা এত ইতিহাস নিয়ে লিখলাম-টিখলাম, লোকে বুঝি পড়ে না। আর তুমি যেই গল্প করে ছলে বললে, আর সবাই পড়তে লাগলো। তারপর উনি বললেন যে, এখনকার ইতিহাস বোধ হয় এভাবেই লেখা উচিত। আমি বললাম, দেখুন, আমি তো ইতিহাসের…কি বলবো..নবিশ… আমি তো সেভাবে গবেষণা করি নি। হ্যাঁ, বইপত্র অনেক পড়েছি, যা ভাঁজেখাঁজে এসেছে, পেয়েছি লাইব্রেরি থেকে , কাজ করেছি; কিন্তু, সেরকম একটা সাংঘাতিক ইতিহাস, এ কি নতুন তথ্য দিলাম – এরকম তো আমার কাছে কিছু নেই। বললো, না, কিন্তু গল্পটাই আসল। ঐ গল্পটাই লোকে চায়।
দেখলাম যে-সব আছে এখানে, কিন্তু বাংলা ভাষায় লেখালেখি করতে ইচ্ছে করে, রাত্তির বেলা ঐ একটা কবিতা, ছোট্ট কবিতা লিখলে মনে যে শান্তি পাই এখানে এতো মদ খেয়ে , বান্ধবীদের সাথে ঘুরেফিরেও তা পাই না।
ঋতুপর্ণ: ঠিক। কিন্তু, এটা যে তুমি বলছো যে আমি ইতিহাস পড়ি নি, বা তোমার একটা ফুলটাইম…
সুনীল: ওটা আমার খেয়াল নেই। আমি তখন করলাম কি-একটা তোমার এই কর্নওয়েল স্ট্রিটে ব্রাহ্ম- সমাজ লাইব্রেরি আছে একটা। তো সেখানে আমি পড়তে যেতাম। বিনা পয়সার লাইব্রেরি। সেখানে একটা বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। তাকে আমি গিয়ে বললাম দেখুন আমি ব্রাহ্ম হতে চাই, ব্রাহ্ম হতে গেলে কি করতে হবে? সে ভদ্রলোক কি ভালো, তোমায় কি বলবো। তিনি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন বলা যায়। তিনি আমাকে বললেন যে, ব্রাহ্ম হতে চাও ঠিকাছে কিন্তু এতো ব্যস্ততার কি আছে? আরেকটু অপেক্ষা করো, আরেকটু পড়াশোনা করো, ২-৩ বছর যাক। এখন যখন তোমার মনে ইচ্ছেটা হয়েছে ২-৩ বছর পরে তুমি বরঞ্চ আবার এসো আমার কাছে; ২-৩ বছর পরে আমার কোনো ধর্মের প্রতিই বিশ্বাস চলে গেলো। ভদ্রলোক আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন একেবারে।
ঋতুপর্ণ: তার মানে তোমার কলকাতা নিয়ে খোড়ার কাজটা শুরু হয়ে গেছে ততদিনে?
সুনীল: ওটা তখন মাথার ভিতর ছিলো, বুঝলে? তারপরে যদি আমার লেখালেখির কথা বলতে হয় তাহলে একটা কথা বলবো যে আমিতো গদ্যতে হঠাৎ এসছিলাম, আমি আগে কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম, ভেবেছিলাম কবিতাই লেখে যাবো সারাজীবন। এমনকি আমার ছাত্র জীবনে স্বপ্ন যদি জিজ্ঞেস করো, তো স্বপ্ন ছিলো এই যে- কোন একটা মফস্বলের কলেজে বড়জোড় যদি চাকরি পাই যথেষ্ট। আর জীবনে যদি ৩-৩ খানা কবিতার ছোট ছোট বই বের হয় এই তো যথেষ্ট। আমি তো একটা সময় এখানে যা, চাকরি-টাকরি করতাম, টিউশনি করতাম, সব ছেড়ে-ছুড়ে আমেরিকায় চলে যাই, একটা স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। তারপরে তখন আমি অবিবাহিত।সেরকম পিছুটান ছিলো না। তারপর আমেরিকায় গিয়ে সিক্সটি’স-এ, তখন সিক্সিটি-থ্রি, সিক্সটি-ফোর, থেকে যাওয়ার অজস্র সুবিধে, ইমিগ্রশনের সমস্যা ছিলো না। কিন্তু আমার মন টিকলো না। দেখলাম যে-সব আছে এখানে, কিন্তু বাংলা ভাষায় লেখালেখি করতে ইচ্ছে করে, রাত্তির বেলা ঐ একটা কবিতা, ছোট্ট কবিতা লিখলে মনে যে শান্তি পাই এখানে এতো মদ খেয়ে , বান্ধবীদের সাথে ঘুরেফিরেও তা পাই না।
ঋতুপর্ণ: তোমার কি গিন্সবার্গের সাথে আলাপ ঐ সময়েই?
সুনীল: তার আগে থেকেই, গিন্সবার্গের সাথে কলকাতায় আলাপ। তা, তার আগেই আলাপ হয়েছিলো। তো যাই হোক, তো আমি দেখলাম যে নাহ- আমি ফিরে যাবো। অনেকে আপত্তি করেছিলো, বারণ করেছিলো। বলে- এই কলকাতায় গিয়ে হবে কি? বেকার হবে, অমুক হবে, তমুক হবে। তা ফিরে এসে একদম কাঠ-বেকার। উপার্জন নেই। বাড়িতে মা, ছোট ছোট ভাই-বোন রয়েছে।আমেরিকা থেকে টাকা পাঠানো সহজ ছিলো। এখানে কি করি? তখন আমি আরম্ভ করলুম- খবরের কাগজে নানারকম নামে গদ্য-টদ্য লেখা। আমার তো অনেক ছদ্মনাম, সব তখন শুরু হলো আরকি। একই নামে বারবার লিখলে লোকে যদি বিরক্ত হয়, তাই নানারকম ছদ্মনাম। তারপর সাগরময় ঘোষ বললেন যে- তুমি উপন্যাস লিখবে? আমি আকাশ থেকে পড়লাম। উপন্যাস? সে আবার কি করে লিখতে হয় রে বাবা? আমি রহমত বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম যে– রহমত বাবু উপন্যাস লিখতে গেলে চ্যাপ্টার কি করে ভাগ করতে হয়? তারপর সাগরদা বললেন যে- না! তোমায় লিখতে হবে। সে বছর থেকেই সাগরদা প্ল্যান করেছিলেন তার আগের দেশ পত্রিকাতে একটা উপন্যাস বের করত। এই প্রেমেন্দ্র মিত্র, বনফুল এইসব বড় বড় – তারাশংকর ইত্যাদি। সেই বছর থেকেই সাগরদা ভেবেছেন-তিনটি উপন্যাস বের করবেন। একটা হচ্ছে প্রেমেন্দ্র মিত্র , একটা হচ্ছে সমরেশ বসু। আর আমি হচ্ছি তরুণতম। এই তিনজন। তো আমিতো আত্মপ্রকাশ …
ঋতুপর্ণ: সমরেশ বাবুর কি?
সুনীল: সমরেশ বসুর বোধহয় বিবর বা তার কাছাকাছি কোনো একটা।
ঋতুপর্ণ: আচ্ছা,আচ্ছা। আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের? মনে নেই?
সুনীল: না, এখন আর নামটা মনে নেই। তো যাই হোক, তো আমিতো খুব মাথার চুল ছিঁড়ছিলাম – উরেব্বাবা! উপন্যাস লিখব! আর সেটা সাগরদা বলেছেন জুন মাসে। তো যাই হোক, আমি কি লিখব কি লিখব করে, উপন্যাস লিখবো কিভাবে, কি বিপদে পড়লাম, আবার একটা লোভও ছিলো যে উপন্যাস লিখলে বেশি টাকা পাওয়া যায়। টাকার তো খুব দরকার। সাবজেক্ট কি লিখবো সে কথা ভাবছি, প্লট কোথায় পাবো? তখন আমার মনে পড়লো যে আমেরিকাতে যখন আমি অ্যালেন গিন্সবার্গ, ওদের সাথে আড্ডায় উঠতাম তখন জ্যাক ক্যারোয়াকের সাথে দেখা হয়েছিল। জ্যাক একদিন কথায় কথায় বলেছিলো যে-শোনো, উপন্যাস লেখা খুব সোজা। আমি বললাম- তাই নাকি? বলছে- তুমি কি করে উপন্যাসটা লিখবে? তুমি জীবনের একটা তারিখ ভাববে। এই ধরো তেইশে মার্চ ১৯৬৪।তখনকার কথা বলছি। সেইদিন তুমি কি করছিলে? যদি তুমি মনে করতে পারো যে সেইদিন তুমি একটা বাস স্টপে দাঁড়িয়েছিলে। তো সেখান থেকে আরম্ভ করবে যে বাস স্টপে একটা ছেলে বা তুমিই দাঁড়িয়ে আছো, তা সে বাসে উঠলো, বাসটা কোথায় যাচ্ছে, ঐভাবে লিখবে দেখবে গল্প হয়ে যাবে। ঐটা আমার মাথার মধ্যে ছিলো যখন আমি উপন্যাস লিখবো তখন আমি ভাবলাম –তাই তো! জ্যাক আমাকে এটা বলেছিলো! ট্রাই করলে তো হয়! তারপরে অমুক রাত্তিরে আমি কোথায় ছিলাম এটা মনে পড়লো। আরম্ভ করলাম সেখান থেকে লিখতে।
ঋতুপর্ণ: আস্তে আস্তে একটা ফর্ম পেয়ে গেলে?
সুনীল: আস্তে আস্তে আস্তে এবং আমি একটা এক্সপেরিমেন্টও করলুম বলা যেতে পারে। সাধারণত, বাংলা ভাষায় যেটা হয় না সেটা হচ্ছে নায়কের নাম দেয়া হলো- সুনীল। সুনীলই সব কিছু করছে, সে মদ খাচ্ছে, জুয়া খেলছে এমনকি ঐসব পাড়াতে যাচ্ছে। এইগুলো তো খুব বাংলা গল্পে হতো না? যাতে ব্যাপারটা আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়। পরবর্তীকালে আমার যখন বিয়ে-টিয়ের ব্যাপার হয় , তখন একটা মেয়ের সংগে প্রণয়-ট্রণয় হল, সবই হল। তো মেয়েটার বাড়ির লোকেরা ওর দাদার সেই আত্মপ্রকাশটা পড়ে- উরেব্বাবা!এরাম ছেলে নাকি! হুবহু সবই সত্যি ভেবেছিলো। এই যে আত্মপ্রকাশ লিখলাম, তারপর অরণ্যের দিনরাত্রি লিখলাম, প্রতিদ্বন্দ্বী লিখলাম- এগুলো সবই নিজের জীবনের ঘটনা। তো জীবনের ঘটনা লিখতে লিখতে একসময় মনে হলো যে আর কতো লিখবো? নিজের জীবনের ঘটনার তো শেষ আছে বা লোকের কাছে একঘেয়ে লাগতে পারে। তখন আমি ভাবলাম যে- এবার একটু অন্যদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। তখন আমি ঐযে আমার নাইন্টিন সেঞ্চুরির ইতিহাস পড়ার অভিজ্ঞতা ছিলো বাচ্চা বয়সে, সেগুলো মনে এসে গেলো। আমি তখন বিভিন্ন বন্ধুকে বা অল্পবয়সী ছেলেদের জিজ্ঞেস করতাম যে- আচ্ছা বলতে পার, বিধবা বিবাহ প্রথম কে করেছিলো? মানে আইনটা নয়, প্রথম কোন ব্যক্তি করেছিলো? কেউ বলতে পারে না। আমি বললাম যে- বলতে পারো যে কালীপ্রসন্ন সিংহ যখন মহাভারত অনুবাদ করলো তখন তার বয়স কত ছিল? কেউ বলতে পারে না। তখন আমি দেখলাম যে এতো একটা বিরাট ফিল্ড পড়ে আছে যে আমাদের একটা সাংঘাতিক ইতিহাস, একটা সময় অথচ আমাদের এখনকার যারা ভালো ছাত্রছাত্রী তারাই জানে না। তখন আমি ঐ বিষয়ে লিখতে লাগলাম। ওর মধ্যে অবশ্য আরেকটা কারণ আছে- আমি একদিন দুপুর বেলা ঘুমুচ্ছি, একটা উদ্ভট স্বপ্ন দেখলাম। আমি দেখলাম- মাইকেলের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের ঝগড়া হচ্ছে।
ঋতুপর্ণ: আচ্ছা আচ্ছা।
সুনীল: আমি তো তখন ঘুমুচ্ছিলাম। ওদের চেহারা দেখলাম, বেশ ঝগড়া হচ্ছে। বিদ্যাসাগর মাইকেলকে বলল যে- তুমি আমার টাকা ফেরত দাও। টাকা ফেরত দিতে বলছে। তখন আমি ভাবলাম- এদের তো জীবন্ত চরিত্র করে লেখা যেতে পারে। এদের নিয়ে জীবনী লেখা হয়, থার্ড পারসনে হয়। এরা যদি ফার্স্ট পারসনে আসে, কথা বলে তাহলে কেমন হয়? তো সেইজন্যই আমি ঐ সেই সময় উপন্যাসটাতে এদের জীবন্ত চরিত্র হিসেবে উপস্থিত করেছি এবং যেহেতু ইতিহাস আমি লিখছি না, ইতিহাস বই তো লিখছি না, এটি উপন্যাস। সেজন্য এসব জীবন্ত ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে একটা করে কাল্পনিক চরিত্র ঢুকিয়ে দিয়েছি। কাল্পনিক চরিত্রগুলোর কারণে গল্পটা এগোনো যায়।
ঋতুপর্ণ: তাহলে নবীন কুমার যে আমাদের কালীপ্রসন্ন, এই ইন্ডিকেশনটা তাহলে কি প্রচ্ছন্ন?
সুনীল: আমি যখন লিখবো ভাবলাম- তখন ভাবলাম যে কেনো লিখবো? ইতিহাস নিয়ে লিখলে ইতিহাসের গল্প তো আর হবে না।একটা কিছু ইতিহাসের ইন্টারপ্রেটেনশন দরকার। আমার নিজস্ব। সেই ইন্টারপ্রেটেনশনটা হচ্ছে বহুকাল ধরে বাংলাতে লেখালেখি হয়েছে যে- নাইনটিন সেঞ্চুরির একটা সময় একটা রেনেসাঁ হয়েছিলো। বেঙ্গল রেনেসাঁ বলে। কিন্তু আমার প্রশ্ন তোলা উচিত ছিলো যে-সত্যিই কি রেনেসাঁ হয়েছে? নাকি বাংলাদেশিরা শুধু-শুধু গর্ব করে?
ঋতুপর্ণ: এক্স্যাক্টলি।
সুনীল: সত্যি কথা- রেনেসাঁ হয় নি।
ঋতুপর্ণ: হয় নি?
সুনীল: না।
ঋতুপর্ণ: আচ্ছা।
সুনীল: রেনেসাঁ হতে গেলে একসঙ্গে সবকিছুর উত্থান লাগে।
ঋতুপর্ণ: ওকে।
সুনীল: মানে ছবি, নাটক তখন সিনেমা ছিলো না। ছবি, নাটক, সংগীত সবকিছু এবং সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষ যাতে তার ছোঁয়া লাগে।
ইসলাম কি করেছে? ইসলাম একেকটা দেশ জয় করেছে, তলা থেকে ওপর সমস্ত লোককে ইসলামধর্মে দীক্ষা দিয়েছে। আর আমাদের হিন্দুরা তো প্রথম কথা- এই ছোঁবে না, দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো। ব্রাহ্মরাও তো তাই-ই করলো।
ঋতুপর্ণ: ছোঁয়াটা গিয়ে সেখানে লাগে।
সুনীল: আমাদের কি হয়েছিলো, হয়েছিলো নানান দিকে একটু উত্থান হয়েছিলো বটে, ছবি ধরো কিছুই হয় নি, তখনকার দিনে ছবির কোনো ব্যাপারই ছিলো না। নাটকগুলো বস্তাপচা মানে খুব যতবড় নাট্যকারের নাম করি আসলে বিষয়বস্তু খুবই বাজে। কিন্তু আমি ভাবলাম ধর্মের রিফরমেশনটা হয়েছিলো, সাহিত্যের একটা নতুন জোয়ার এসেছিলো।
ঋতুপর্ণ: এটা কখন, কার হাত ধরে?
সুনীল: ঐতো ধরো, আস্তে-আস্তে প্রথমে একটা ক্রিশচিয়ানিটির একটা প্রভাব এসেছিলো সেটা কাটাবার জন্য দুটো ক্যাম্প হলো। একটা ক্যাম্প হলো দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ ওদের, ভক্তিবাদ নিয়ে এলো।
ঋতুপর্ণ: আরেকটা ব্রাহ্ম?
সুনীল: আরেকটা ব্রাহ্মরা, এই দেবেন ঠাকুর, কেশব সেন ইত্যাদি। তো এইগুলোও ফুটিয়ে তোলার ইচ্ছে ছিলো।
ঋতুপর্ণ: সাহিত্য সত্যি হয়েছিলো কিছু?
সুনীল: সাহিত্য-গদ্য এলো, উপন্যাসের ফর্ম এলো বঙ্কিমের হাত ধরে। তারপর কবিতাও ঈশ্বরগুপ্ত থেকে কিরকম পাল্টে গেলো, মাইকেল এসে একটা সাংঘাতিক নতুন কিছু করলো। এইযে নতুন কিছু করাই তো রেনেসাঁর ব্যাপার। কিছু-কিছু হয়েছিলো। আমার যেটা সবচেয়ে খারাপ লেগেছিলো, যেটা আমি ভেবেছিলাম ফোটাতেই হবে সেটা হচ্ছে কী- এইযে ভদ্দরলোক শ্রেণির ব্যাপার হয়ে গেলো।
ঋতুপর্ণ: কোনটা?
সুনীল: এই সমস্ত মুভমেন্টগুলো। আর সমাজের অন্য স্তরের লোকগুলোকে ছুঁলো না। যেমন- ব্রাহ্মধর্ম, কি সুন্দর একটা ধর্মের আইডিয়া ছিলো! ধর্মটা মারা গেলো এইজন্যে এটা সর্বস্তরে পৌঁছুলো না। সব বড়লোকরা ব্রাহ্ম হয়। যে বাড়িতে ব্রাহ্ম হয়, সে বাড়ির কিন্তু কাজের লোকেরা তারা কিন্তু কেউ ব্রাহ্ম হতে পারবে না। ভেবে দেখো তুমি ক্রিশ্চিয়ানরা যে দেশে যায় সে দেশে গিয়ে স্লেভদেরও ক্রিশ্চিয়ান করেছে। ইসলাম কি করেছে? ইসলাম একেকটা দেশ জয় করেছে, তলা থেকে ওপর সমস্ত লোককে ইসলামধর্মে দীক্ষা দিয়েছে। আর আমাদের হিন্দুরা তো প্রথম কথা- এই ছোঁবে না, দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো। ব্রাহ্মরাও তো তাই-ই করলো। শিবনাথ শাস্ত্রীর বইতে খুব ছোট্ট করে আছে যে- হীরা বুলবুল বলে এক বারবনিতা, সে হিন্দু-স্কুলে তার ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলো- আমি একে ভর্তি করতে চাই। তো ওরা কি রিজনে বলবে যে না, ভর্তি করবো না। মেয়েটা বারবনিতা বলে ভর্তি করবো না, এটা তো বলা যায় না।
ঋতুপর্ণ: বলা যায় না কেন? তখন তাদের কে আটকাচ্ছে এটা বললে?
সুনীল: সাহেবদের তো একটা জাস্টিসের সেন্স আছে, না? সাহেব তো হেডমাস্টার।
ঋতুপর্ণ: বুঝতে পেরেছি।
সুনীল: তার সেন্স অব জাস্টিস আছে। সে বলছে যে- আমি কী করে একে না বলবো? এমনকি ঐ সাহেব কিছুদিনের জন্য খুব দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলো যখন অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা সব স্কুল ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো ও একলা ক্লাসে বসে থাকতো। সাহেব বললো- হ্যাঁ, ও থাকবে। বুঝেছো?
ঋতুপর্ণ: আচ্ছা।
সুনীল: তারপর দেখলো স্কুল চলে না, তো বেস্ট হচ্ছে ওকেই তাড়াও বাবা। আবার অন্যদের ডেকে নিয়ে এসো। তা ওকে তাড়ালো।তাড়িয়ে ছেলেটা যা-হোক ঘুরতে লাগলো। তো আমি যেটা, তারপরে বাকিটা আমার তৈরি করা। তো সে তো লেখাপড়াও শিখেছিলো, সে তো তার সবই যোগ্যতা ছিলো। কিন্তু সমাজ তাকে কেনো স্থান দিলো না? বারবনিতার ছেলে বলে?
ঋতুপর্ণ: কিন্তু এগুলো গল্প, তার রেফারেন্সগুলো তুমি আস্তে আস্তে কোথা থেকে পেলে?
সুনীল: তখনকার দিনের পত্র-পত্রিকা, হুবহু সব পাই নি, একটু-একটু পেয়ে বাকিটা তৈরি করেছি। এছাড়া আমি কিছু কিছু সংবাদপত্রের ফাইল দেখে, নানান খবর বের হতো যে- একটা বাড়িতে চুরি হয়েছে তারপরে যা হয়, পরিচারিকাকে ধরে খুব প্রহার করা হলো, তারপর দেখা গেলো যে সে কিছুই নেয় নি।
ঋতুপর্ণ: কিন্তু এগুলো কি খবর হয়ে বের হতো?
সুনীল: বের হতো। এমনকি এ-ও বের হতো যে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের পরিবারের লোকেরা দার্জিলিং বেড়াতে যাচ্ছে, হাওরা স্টেশনে তাদের একটা সুটকেস চুরি গেছে, সেটাও কাগজে বের হতো।
ঋতুপর্ণ: আচ্ছা,আচ্ছা।
সুনীল: সব খবর হতো কিন্তু একটা খুব বিরাট জিনিস সব খবরের কাগজ চেপে গেলো সেটা হলো- কাদম্বরীর মৃত্যু। সেটা ছাপা হলো না।
ঋতুপর্ণ: সেটা চেপে গেলো, না?
সুনীল: হ্যাঁ। প্রমাণ আছে যে- দেবেন ঠাকুর সব সম্পাদকদের ডেকে খাওয়ালেন আরকি, আর হাতে করে একটা করে খাম দিয়েছিলেন। কিন্তু এটার কথা উল্লেখ নেই কোথাও বা কিছু একটা ধমক বা কিছু একটা করেছিলেন। কোনো কাগজে তো বের হলো না।
ঋতুপর্ণ: কিন্তু কাদম্বরীর মৃত্যুটা যে আত্মহত্যা বা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এটা জনসাধারণ জানতে পেরেছিলো কখন?
সুনীল: বহু পরে। তখন জানতে পারে নি। পরবর্তীকালে দেখা গেছে যে, তৈরি কাজে হিসাবের খাতায় দেখা যাচ্ছে যে করোণারকে বাড়িতে ডাকা হয়েছে। আবার তাকে মদের বোতল-টোতল এ সমস্ত দেয়া হয়েছে। তো এরকম সব অনেক ব্যাপার আছে।
ঋতুপর্ণ: হুম সেটাই তো। এটা আমাদের এমন একটা সুবিধে করেছে যে এই প্রত্যেকটা মানুষকে মানুষ হিসেবে চিনতে শিখিয়েছে এবং ক্যালেন্ডারে দেব-দেবীর ছবি ছিলো।
সুনীল: আমি তো তাই-ই বলি যে রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ একজন ব্যক্তি, কোনো সন্দেহ নেই। সত্যি কথা আমি মনে করি রবীন্দ্রনাথের মতো একজন ব্যক্তিরও তো দু-একটা ফ্ল তো থাকতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের দ্বারা প্রভাবিত বটেই। তিনি গগণ হরকরার গান, লালনের গান এবং অন্যান্য বাউলদের কাছে থেকে কিছু কিছু নিয়েছেন। নিয়ে সেগুলোকে অসাধারণ গানে উন্নিত করেছেন।
ঋতুপর্ণ: নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
সুনীল: দুর্বলতা তো থাকতে পারে। কেনো এইযে ধরো- সারা জীবনে কতো কষ্ট পেয়েছেন তার প্রকাশ হয়েছে তার শিল্পের মধ্য দিয়ে। কোথাও কখনো সেটা আলাদাভাবে প্রকাশ করেন নি। সাধারণ মানুষের মতো কান্নাকাটি, এসব কখনো করেন নি। আর কতো কাজ করেছেন বলো তো? কতো লিখেছেন। প্লাস কো-অপারেটিভ মুভমেন্ট নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, কোনো দরকার ছিলো না, শান্তি-নিকেতনের মতো একটা গড ফরসেকেন জায়গাতে, সেখানে একটা ইশকুল করেছেন। মানে স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে মাস্টারদের মাইনে দিচ্ছেন। কে বলেছিল এসব করতে? তার কারণ ওর অদম্য একটা শক্তি ছিলো, লেখা ছাড়াও। মানে লেখা ছাড়াও নানান দিকে ও নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাইতেন। এ বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায় না।
ঋতুপর্ণ: উনি জমিদার হলে কেমন জমিদার হতেন?
সুনীল: উনি জমিদার হয়ে কিছুদিনের জন্য ভালই কাজ করেন, কড়া জমিদার ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে জমিদারিটা উনিই লাটে তুলে দেন।
ঋতুপর্ণ: কী করে?
সুনীল: তার কারণ হচ্ছে ঐ অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন।
ঋতুপর্ণ: সেটা কি শিলাইদহতে গিয়ে?
সুনীল: হ্যাঁ।
ঋতুপর্ণ: ও।
সুনীল: আরেকটা হচ্ছে কী- রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন এই জমিদারিটা যাবার ব্যাপার।
ঋতুপর্ণ: জমিদারি প্রথাটাই যাবার?
সুনীল: যাবার, থাকবে না।
ঋতুপর্ণ: তাহলে এটাকে আর খুব একটা কন্সোলেটেড করে লাভ নেই।
সুনীল: লাভ নেই।
ঋতুপর্ণ: ও সেইটা বুঝতে পেরেছিল। আচ্ছা, এই যে রবীন্দ্রনাথ তার লালন নিয়ে একটা চলে না, যে কে কার থেকে ধার করেছে, এটার কি তুমি, সত্যি কি কাজটা করতে গিয়ে প্রামাণ্য কিছু পেয়েছো?
সুনীল: না, শোনো। এটা নিয়ে একটা গুজব চালু আছে যে লালন ফকিরের যে গানের খাতা সেটাকে রবীন্দ্রনাথ পেয়ে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এসেছিলেন আর ফেরত দেন নি। লালনের শিষ্যরা এরকম রটিয়েছিলো যে- বোলপুরের রবি ঠাকুর ওটা নিয়ে গেছেন আসল খাতাটা, ওটা উনি আর ফেরত দেন নি ফলে লালনের আসল গান পাওয়া যাচ্ছে না।
ঋতুপর্ণ: আচ্ছা।
সুনীল: এটা একদমই বাজে কথা । বিভিন্ন গবেষক প্রমাণ করেছেন যে রবীন্দ্রনাথের সাথে লালনের দেখা হয় নি, দেখা হয় নি কখনো। লালনের সাথে বরং রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল, যেহেতু উনি একটা স্কেচ করেছিল।
ঋতুপর্ণ: ঐ স্কেচটাও কি সত্যিই লালনের?
সুনীল : ঐ একটাই লালনের স্কেচ আছে। স্কেচটা মোটেই ভাল না। তবুও তো ঐটুকুই আছে। ইনফ্যাক্ট আমি আবার লালনকে নিয়ে পড়ছি তো সেজন্য এসবগুলো পড়াশোনা করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের দ্বারা প্রভাবিত বটেই। তিনি গগণ হরকরার গান, লালনের গান এবং অন্যান্য বাউলদের কাছে থেকে কিছু কিছু নিয়েছেন। নিয়ে সেগুলোকে অসাধারণ গানে উন্নিত করেছেন। গগন হরকরার একটা গান আছে। সে গানটা হচ্ছে এরকম , গানটা আমি গেয়ে শোনাচ্ছি। “হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে দেখো একলা নিতাই।। একলা নিতাই একলা নিতাই একলা নিতাই।” একটা সাধারণ পল্লীগীতি, এটাকে অসাধারণ স্তরে নিয়ে গেলেন, ”যদি তোর ডাক শোনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে।” এটা একটা ইউনিভার্সাল হয়ে গেল। এরকরম করে মনের মানুষ কথাটা কোথা থেকে আসল? কাজেই এরকমভাবে নিয়েছেন।
ঋতুপর্ণ: না, গোড়াতে তো শুরুই হয় খাঁচার ভিতর অচিন পাখি একটা ভিখিরি রাস্তায় গুনগুন করছে।
সুনীল: তারপরে তো নিজেকেও বলেছেন আমি তো রবীন্দ্র বাউল। কাজেই এটা ঠিকই আছে। লালনের গান থেকে চুরি করে লিখেছেন এটা ভোগাস কথা।
ঋতুপর্ণ: তুমি কালীপ্রসন্ন সিংহকে হঠাৎ ঐ..
সুনীল: হ্যাঁ, ঐ যে বললাম আমি যেহেতু ইতিহাসকে ইন্টারপ্রেট করতে চাই, চেয়েছিলাম মনে মনে, কিন্তু সেটা প্রকট না হয়, প্রকট হলে আবার উপন্যাস হয় না। সেজন্য আমি ভেবেছি এমন একটা চরিত্র আমার দরকার যে , তখনকার দিন দুটো দলে বিভক্ত ছিল, একটা রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের দল আরেকটা ব্রাহ্মদের দল, যে এই কোনোদলেই যায় নি, মাঝখানে যে আছে, তাকে আমার প্রতীক চরিত্রে দরকার ছিল, এটা রয়েছে কালীসিংহে। কালীসিংহ, সে রামকৃষ্ণ বা দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে কাঁদে নি, আবার ব্রাহ্মদের দলেও ভেড়েনি। আবার তিনি সাহায্য করেছেন অনেক। বিধবা-বিবাহ যখন আন্দোলন হয় তখন টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। মনে আছে তোমার নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাহায্য করেছেন। গল্প আছে, সত্যতা প্রমাণ করা কষ্ট, দীনবন্ধু মিত্র যখন নীলদর্পণ লিখলেন, নীলকর সাহেবদের অত্যাচার নিয়ে এটা তো সাহেবদের পড়া দরকার। বাংলায় লিখলে তো হবে না। তখন মাইকেল মধুসূদন ,ইংরেজী জানা, তাকে বলা হল এটা আপনি অনুবাদ করুন। সেটা অনুবাদ তো হল, ছাপবে কে? তখন রেভারেন্ড লং তিনি নিজের দায়িত্বে সেটা ছাপলেন। তখন লং-এর নামে মামলা হল। তো লং-এর এক হাজার টাকা জরিমানা হল। এই ছোকরা কালী সিঙ্ঘী, অল্প বয়সের ছেলে, পকেট থেকে টাকা বের করে ঝনাত করে ফেলে দিল। বলল ওর হয়ে জরিমানার টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। আচ্ছা কেনো বল তো করলো? এরাম একটা চরিত্র তো একটা। এমন অল্প বয়সী একটা ছেলে কি তেজ তার। আবার সে নিজেকে নষ্ট করছে। তার মেধা সাংঘাতিক কিন্তু বেশিদূর পড়াশোনা করল না। মহাভারত কে অনুবাদ করবে অতোবড় একটা বিরাট প্লান, নিজে করে নি পণ্ডিতদের দিয়ে করিয়েছে কিন্তু এই প্ল্যানটা তার।
ঋতুপর্ণ: কিন্তু এটা কি কোনো ধর্ম ভাবনা থেকে না কি এটা এপিক?
সুনীল: না না। ধর্ম ভাবনা থেকে না। এটা এপিক। ও ভেবেছিল সবার পড়া উচিৎ। মহাভারতটা অতো বড় বই, ছাপিয়ে প্রথমে বিনা পয়সায় বিলি করছিল। তারপর বিলি হচ্ছিল না বলে বলল, ঠিকাছে ডাক খরচটাও আমি দিয়ে দিব।
ঋতুপর্ণ: আচ্ছা ভান্ডারকারের মহাভারতটা কি তখন হয়ে গেছে?
সুনীল: তখন পুনা থেকে অনেকগুলো এডিশন নানারকম ছিল। পুনার থেকেই অথেনটিক সংস্কৃত মহাভারত বেরিছে।
ঋতুপর্ণ: তার টিকাগুলো কী ভাষায়?
সুনীল: সংস্কৃততেই।
ঋতুপর্ণ: মানে মারাঠি ভাষায় নয়?
সুনীল: না। তা সেগুলো আনিয়ে এখানকার পণ্ডিতদের দিয়ে একটা জেনারেল ভাষার কালীপ্রসন্ন সিংহ তৈরি করায়। এবং জানো বোধহয় যে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজেও ভেবেছিলেন মহাভারত অনুবাদ করবেন।
ঋতুপর্ণ: না জানি না আমি।
সুনীল: তিনি খানিকটা এগিয়ে যখন শুনলেন কালিসিংহ করাচ্ছে ভাবলেন আমার তাহলে আর দরকার নেই। কারণ ওর অনেক পয়সা আছে, ও পারবে, কাজটা শেষ করবে। ওর উদ্দেশ্য ছিল যেন লোকে মহাভারতটা পড়ে। তার আগে কাশীরাম দাসের মহাভারত ছিল বটে, তা পদ্যে লিখা ছিল তো লোকে পড়তে চাইতো না।
একটা ধারণা আছে ক্ষুদিরাম হচ্ছে প্রথম ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। ঠিক না কথাটা। তার অনেক আগে মহারাষ্ট্রে চাপেকার ভাই নামে তিন ভাই তারা ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছিল।
ঋতুপর্ণ: তবে ওর মহাভারতটা অনেক পপুলার হয়েছিল।
সুনীল: ভীষণ পপুলার হয়েছিল। হরিদাস সিদ্ধার্থবাগীশ, তিনিও করেছিলেন মহাভারত। তিনি আবার মূল মহাভারত, মল্লিনাথকৃত টিকা তারপর নিজের অনুবাদ। কখনো কখনো নিজের টিকাও ছিল। তো সে বিশাল ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ গ্রাহক হয়েছিলেন, উনি গ্রাহক সিস্টেম চালু করেন। বলেন যে আমি খন্ড খন্ড বের করছি, গ্রাহক না হলে আমি খরচ চালাতে পারব না। তারপর উনিও পয়সা দিয়ে গ্রাহক হয়েছিলেন।
ঋতুপর্ণ: কারটা আগের?
সুনীল: না । কালীপ্রসন্ন প্রথম একদম। মানে বাংলায় গদ্য মহাভারত কালীপ্রসন্ন সবার প্রথম। কালীপ্রসন্নের সময় রবীন্দ্রনাথ তখন ছোট। কালীপ্রসন্নর সময় রবীন্দ্রনাথ ঠিক আসতে পারেন নি। কিন্তু হরিদাস সিদ্ধার্থবাগীশের সময় রবীন্দ্রনাথ নিজে তখন একটা কিউকেটারও।
ঋতুপর্ণ: কিন্তু একদিকে এটা অন্যদিকে একটা হুতুম প্যাঁচার নকশা!
সুনীল: ওটাও কালীপ্রসন্ন’র। কালীপ্রসন্ন একটা ধুরন্দর ছেলে ছিল তো। তেরো বছর বয়সে সে বিদ্যুৎ সায়নি সভা, আত্মীয় সভা এ সমস্ত স্থাপন করে। তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলে এসমস্ত কি করে করে!
ঋতুপর্ণ: কিন্তু এই ইন্টিলেকচুয়াল কোয়েস্টটা এলো কোত্থেকে?
সুনীল: একেকজনের আসে, একেকজনের হয় এবং প্রিকশাস স্টাইল যাকে বলে না ও তো তাই। ইঁচড়ে পাকা কিন্তু ভাল কাজে মেতে ছিল।
ঋতুপর্ণ: ওর উপর ভাল ইনফ্লুয়েন্স-গুলো সেসময় কোন মানুষের ছিল?
সুনীল: বিদ্যাসাগর ছিল। বিদ্যাসাগর ওকে স্নেহ করতেন। মাইকেলকে যখন লোকে পছন্দ করতো না
ঋতুপর্ণ: মাইকেল ওর থেকে কতো বড়।
সুনীল: ওর থেকে কিছু বড়। তখন মাইকেলকে ডেকে এনে ও বাড়িতে সংবর্ধনা দেয়। লোকে বলে উনি নাকি মাইকেলকে, উপহার দিতে হয় তো, এতো বড় একটা মদ্যপানের পাত্র উপহার দিয়েছিল। হরিস মুখপাধ্যায় যিনি নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন একা তাকেও সাহায্য করেছে কালীপ্রসন্ন গিয়ে। কাজেই এ একটা অদ্ভুত চরিত্র। সেজন্যই আমি ওকে তখনকার দিনের প্রতীকী চরিত্র করেছি যে কিনা কোনো ধর্মের ক্যাম্পে বিলং করে নি কিন্তু দেশের উন্নতির জন্যে, মানে কোনো পলিটিক্সে যোগ দিল না কিন্তু দেশের জন্য অনেক কাজ করলো অনেকটা সেরকম আরকি।
ঋতুপর্ণ: কিন্তু তোমার হরিস মুখার্জীর কথাটাতে আমার যা মনে হল, এইযে হরিস মুখার্জী রোডের উপর দিয়ে কতোবার গেছি আমরা তো কোনোদিন জানতাম না মানুষটা কে! সেটা জানলাম। তখন মনে হয়েছিল সুনীলদা যদি এই যে ইম্পরট্যান্ট রাস্তাগুলো যাদের নামে, তাদের যদি জীবন্ত করে তুলতেন আমাদের সামনে। তুমি এটা কখনো ভেবো সুনীলদা।
সুনীল: আমাকে তো একটা গল্প লিখে চরিত্র করতে হবে।
ঋতুপর্ণ: তারপরে যখন তুমি সেকেন্ড ক্রনিক্যাল এবাউট কলকাতা লিখছো সেটার নায়ক কোথায় যেন একটা প্রায় রবীন্দ্রনাথ, সেটা কি তুমি কনশাসলি নাকি?
সুনীল: না, সেটা আমি প্রথমে ভেবেইছিলাম রবীন্দ্রনাথকে নায়ক করব। বলে আমি আরম্ভই করেছি, মানে ত্রিপুরা রাজবাড়ি থেকে আরম্ভ হচ্ছে, তারপর ত্রিপুরার রাজা দুধ পাঠাচ্ছে যে এগুলো ঠাকুরবাড়ির একটা ভাল কবিতা লিখছে, তাকে একটা উপঢৌকন দিতে হবে। তা ঐ পর্যন্ত লিখে আমি দেখলাম পুরো তো রবীন্দ্রনাথকে করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে বাংলাদেশের আইকন। তাকে তুমি সবসময় ভাল ভাল ভাল বলে যেতে হবে। তার কোনো দোষ দেখাতে পারবে না। তা নিয়ে কি উপন্যাস হয়? সুতরাং আমি তখন রবীন্দ্রনাথকে পাশে ঠেলে দিলাম। রবীন্দ্রনাথ রইলেন আগা-গোঁড়া সবখানে, ভরতকে নিয়ে এলাম তখন। যে কাল্পনিক চরিত্র , যাকে নিয়ে আমি যা খুশি তা করতে পারি। তা এগুলো করতে করতে বিবেকানন্দ এসে আবার ঐ ভয়টা হয়েছিল। ওরে সর্বনাশ বাঙালিরা তো সামান্য এদিক-ওদিক হলে ছাড়বে না। আর আমাদের বিবেকানন্দ স্পেশালিষ্ট হচ্ছে আমাদের শঙ্করী প্রসাদ বসু , তিনি প্রত্যেক সপ্তাহেই, তিনি পড়তেন বোধহয়, মাঝেমাঝে আমাকে বলতেন তোমার এইটা ভুল হয়েছে। শুনে ভালই লাগতো আমার। যেমন আমি লিখেছি যে স্বামী বিবেকানন্দ তো তোমার বিশ্ব জয় করলেন, আমেরিকায় ওসব বক্তৃতা দিলেন, অমুক করলেন, কলকাতায় প্রথম এলেন, আসার পর ছাত্ররা ওর গাড়ি-টাড়ি টেনে নিয়ে এলো, তারপর শোয়া বাজার রাজবাড়িতে উনি প্রথম একটা বক্তৃতা দিলেন। আমি লিখেছি উনি বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু আমাকে শঙ্করিপ্রসাদ বসু বললেন না বাংলায় বক্তৃতা দেয় নি, ইংরেজিতে। কলকাতা শহরেও যে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিবে এটা আমার মাথায় আসে নি। আসলে তখনকার দিনে লোকেরা ভাবতো যে বাংলায় বক্তৃতা দেয়া যায় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এটা ভাল লাগতো না। বলতেন আমার দেশের ভাষা কি ব্যবহার করা যায় না! একবার একটা কংগ্রেসের অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথকে একটা গান গাইতে দেয়া হয়েছিল, উনি এমন একটা গান লিখলেন যেটা সবাই, যারা সংস্কৃত জানে তারাও বুঝতে পারবেন। সেটা হচ্ছে ঐ ভুবন মন মোহিনী। এমনভাবে শব্দগুলো আছে, যেটা সংস্কৃত নাসা শব্দ। যে বাঙালি না হলেও বুঝতে পারবে। তখনকার দিনে লালমোহন ঘোষ বলে একজন বক্তা ছিলেন। খুব ভাল বক্তৃতা দিতে পারতেন। তাকে রবীন্দ্রনাথ বললেন আপনারা এরকম চোস্ত ইংরেজি বক্তৃতা দেন, এই চাষা-ভুষারা শুনতে আসে তারা কি বুঝবে। তারপর তারা বললেন ঠিকাছে আমরা তো ইংরেজি ছাড়া বাংলায় বলতে পারি না, আমরা ইংরেজিতে বলব আপনি বাংলায় অনুবাদ করে দেবেন। সেবারে হল, রাজশাহীতে বোধহয়, বড় বড় নেতারা বক্তৃতা দিচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো লোক বসে বসে অনুবাদ করছেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষা। যখন হয়ে গেল অনুষ্ঠান শেষে সেই লালমোহন রবীন্দ্রনাথকে বলল, ওয়েল রবিবাবু ডিড ইউর চাষা এন্ড ভুষাস আন্ডারস্টুড ইউর ফ্লাউয়ারী বেঙ্গলী? মানে ঐ বাংলাও তো চাষা-ভুষারা বুঝতে পারবে না। এরকম গল্প তখন ছিল আরকি। বাংলা ভাষা নিয়েই গল্প। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সারাজীবন বাংলা নিয়ে লড়ে গেছেন। এজন্য ধরো বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৫-এর যে বঙ্গভঙ্গ তাতে রবীন্দ্রনাথ প্রথম রাস্তায় নামলেন। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা এমনই ছিলেন যে মোজা ছাড়া তাদের পা দেখা যেতো না। সব সময় মোজা পড়ে থাকতো। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথ রাস্তায় হাঁটলেন ঠাকুরবাড়ির সমস্ত নিয়ম ভেঙ্গে। আরেকটা ওখানে ডেঞ্জারাস কাজ করেছিলেন যে, আমার লেখায় আছে যেটা হচ্ছে রাখী পরাচ্ছে সমস্ত মৌলভীদেরকে। মৌলভীদের তো রাখী পরানো যায় না। এটা তো একটা হিন্দু রিচ্যুয়াল। কাজেই অনেক মুসলমান তখন ইতঃস্তত করছিল। যাই হোক রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কিছু দেখে তার চেহারা, তার সব কিছু অনেকে মেনেও নিয়েছেন। বিশেষ করে উনি নাকোদা মসজিদে ঢুকে পড়লেন গিয়ে, নাকোদা মসজিদ একদম বাঘের গুহা বলা যেতে পারে। সেখানে ঢুকে ইমামকে বললেন আমি রাখি পরাবো। খুবই সাহসের পরিচয় বলতে হবে। অবশ্য অন্যরা রাজী হচ্ছিল না ইমাম তখন হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। এ নিয়ে গন্ডগোল হয়েছিল, এখানে হয় নি কিন্তু রাখী পরানো নিয়ে পূর্ব বাঙলাতে গন্ডগোল হয়েছে। এই আন্দোলন নিয়ে পূর্ব বাঙলাতে মারামারি হয়েছে, খুনোখুনি পর্যন্ত হয়েছে, ধর্ষণ হয়েছে। কারণ এই বঙ্গভঙ্গ। পূর্ব বাঙলার অনেকেই বঙ্গভঙ্গ চেয়েছিল। আমরা ভাবি সব ভারতীয় এর প্রতিবাদ করেছিল আর সাহেবরা বঙ্গভঙ্গ করেছিল, আসলে তা নয়। সাহেবরা তখন ইতোমধ্যে বাঙ্গালিদের মধ্যে দুটো ভাগ করা শুরু করেছেন।
ঋতুপর্ণ: কেন চেয়েছিল? কি পেতেন এখানে?
সুনীল: এডমিনিস্ট্র্যাটিভ কারণ দেখিয়েছিল। তখন প্রভিন্স বলতো। এই প্রভিন্সটা অনেক বড়, এডমিনিস্ট্র্যাশনটাকে দু’ভাগ করো
ঋতুপর্ণ: মানে রিলিজিয়াস কারণটা দেখানো হয় নি?
সুনীল: না। কিন্তু এমন একটা কায়দা করে বলেছিল যে ভাগ করো তাহলে ঐ ভাগটা মুসলমান বেশি হয়ে যাবে, মুসলমানদের ওটা অধিকার হয়ে যাবে। লর্ড কার্জন বলেছিল কি ব্যাপার কোনো একদিন বাঙালি এসে ভাইসরয়ের বাড়িতে বসবে নাকি? সেজন্য বাঙালিদের ভাগ করার জন্য উঠে-পরে লেগেছিলেন।
সেরকম হবার ই রবীন্দ্রনাথ আটান্ন বছর বয়সে একটা চৌদ্দ বছরের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছেন এটা কি হচ্ছে, এটা ভাল না। নিজের আটান্ন বছরপর ভাবি মন্দ নয়, হলেও হতে পারে।
ঋতুপর্ণ: ওহ। মনে হয়েছিল প্রদিবাদটা এলে এখান থেকে প্রথম আসবে। ডিভাইড অ্যান্ড রুলটা প্রথম বাঙালিদের দিয়ে শুরু হল। রিলিজিয়াস সেন্টিমেন্টটা হয়তো বুঝে গিয়েছিল।
সুনীল: ঢাকার নবাব ছিল সলিমুল্লাহ বলে, তখন তাকে এক লক্ষ পাউন্ড দেওয়া হয়েছিল ধার বলে বা যাই বলে হোক। তখন তো এক লক্ষ পাউন্ড মানে বহু টাকা। কেন দিয়েছিল আমি জানি না। ইতিহাসে আছে। যে লর্ড কার্জন দিয়েছে। এবং সে হচ্ছে এক নম্বরের সাম্প্রদায়িক ছিল। তখনকার তরুণরা যখন দেখলো সাহেবরা বিচারের পথ ছেড়ে দিয়ে বিভাগের পথে যাচ্ছে, তখন তারাও বোমা বানাতে শুরু করল। তবে আমি প্রসঙ্গিকভাবে বলি বাঙালিদের একটা বিশেষ ধারণা আছে, বাঙালিদের কতোগুলো দোষও আছে, তারা কতোগুলো ব্যপার নিয়ে অনেক গর্ব করে প্রায় না জেনে। যেমন ধরো একটা ধারণা আছে ক্ষুদিরাম হচ্ছে প্রথম ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। ঠিক না কথাটা। তার অনেক আগে মহারাষ্ট্রে চাপেকার ভাই নামে তিন ভাই তারা ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছিল। এবং তীলক তাদের ইন্সপায়ার করেছিল। কিন্তু ক্ষুদিরামকে যে পাঠানো হয় পিস্তল দিয়ে যে যাও সাহেব মেরে এসো, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে এর মা-বাবা নেই, গেলো গেলো, ঠিকাছে। যদি ধরা পড়ে মরলো তো মরলো। নেতারা যে পাঠিয়েছিল এই একটা ম্যানুপুলেশন তাদের মধ্যে ছিল। আর প্রফুল্ল যার সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। প্রফুল্ল তো বরং ধরা দেয় নি; সে আত্মহত্যা করেছিল রেলস্টেশনে আর ক্ষুদিরাম ধরা পড়ে। কাজেই প্রফুল্লর অবদান কম কিছু না। কিন্তু প্রায় কিছুই জানা যায় না। আমিও খুব কম জানি। আর এই যে ফাঁসিতে যাওয়া এসবের কারণ একটা বারীণ বোস বলেছেন- এগুলো হচ্ছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। হ্যাঁ আমরা জেল খাটবো, দরকার হলে ফাঁসিতে ঝুলবো। যাতে আমাদের দেখে তরুণ সমাজ উদ্দীপ্ত হয়। আন্দামানের জেলে যদি যাও, ওখানে একটা তালিকা করা আছে ওখানে কারা কারা ছিলেন। তুমি দেখবে এইটি পারসেন্ট বাঙালির নাম।
ঋতুপর্ণ: তার একটা কারণ কি সুনীলদা কলকাতা-টি ক্যাপিটাল?
সুনীল: না। ক্যাপিটাল তো ১৯১৩ সালে শিফট হয়ে গেছে। তারপরে তো আর কলকাতা ক্যাপিটাল না। এটা কুড়ির দশকের শেষ পর্যন্ত চলেছে। সূর্যসেন পর্যন্ত। তারপরে গান্ধীজীর প্রভাবটা বেশি আসে।
ঋতুপর্ণ: কোন সময় থেকে?
সুনীল: ঐ যে তিনের দশকের গোড়া থেকে। গান্ধীজীর অহিংসাই অস্ত্র যেটা ।
ঋতুপর্ণ: সেটা বাঙলায় কী এফেক্ট ফেলেছিল?
সুনীল: বাঙালীরা খুব একটা নেয় নি। কিন্তু বাংলার কংগ্রেস মেনে নিয়েছিল।
ঋতুপর্ণ: এইযে গান্ধীজীর নেতৃত্বটা সর্ব ভারতীয় স্তরে, এটা কী অনেকটা অঘোষিত নেতার মতো?
সুনীল: শোনো, গান্ধীজীর গ্রেটনেস স্বীকার করতেই হবে। যেমন কি করে বুঝলেন উনি এই যে ভারতের অধিকাংশ জনতা যাদের একটা পরবার মতো পোষাক নেই, লেটি পরে ঘুরে বেড়ায় তাদের নেতা হয়ে ব্যারিস্টার হয়ে, কোর্ট পরে, টাই পরে তাদের নেতা হবে? চিরকাল তো তাই হয়ে আসছে, অন্য নেতারা তো তাই করে আসছে। উনি যে কোট-প্যান্ট খুললেন এবং ধুতি পরলেন, বললেন আমি তো ওদেরই একজন।
ঋতুপর্ণ: বোধহয় গান্ধীজী বুঝেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রটা হচ্ছে ইংরেজী ভাষা।
সুনীল: না সেই সঙ্গে উনি তো গুজরাটিতেও লিখতেন, গুজরাটি ভাষারও উন্নতির চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনী পড়লে তুমি দেখতে পারবে গান্ধীজী যখন রবীন্দ্রনাথকে গুজরাটে নিয়ে গেছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ গুজরাটিতে কি করে দিবেন, ইংরেজিতে দিচ্ছেন, গান্ধীজী নিজে তখন রবীন্দ্রনাথকে বললেন তুমি হিন্দিতে দাও। তবুও লোকে বুঝতে পারবে। রবীন্দ্রনাথ তো হিন্দিতে খুব একটা অভ্যস্ত নন; আর রবীন্দ্রনাথ তো ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়েছেন দু’য়েকটা জায়গায়। রেকর্ড আছে।
ঋতুপর্ণ: এটা তো মনে হয় তোমার রানু-ভানুতেও আছে। আমার মনে হয় রানু-ভানু যখন লিখলে তখন প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথের প্রতি তোমার একটা মমতা এল।
সুনীল: শুধু তাই না, যখন অল্প বয়স আমাদের ছিল, তখন আমরা ভাবতাম ষাট বছরের লোক একদম যা-তা অবস্থা। তা নিজের ষাট বছর হওয়ার পর ভাবলাম খুব তো খারাপ না। সবই তো ঠিকঠাকই আছে। সেরকম হবার ই রবীন্দ্রনাথ আটান্ন বছর বয়সে একটা চৌদ্দ বছরের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছেন এটা কি হচ্ছে, এটা ভাল না। নিজের আটান্ন বছরপর ভাবি মন্দ নয়, হলেও হতে পারে।
ঋতুপর্ণ: আমাদের তো ইতিহাস বলে কিছু রইলো না । এগুলো অন্তত থেকে যাবে বলে মনে হয়।
সুনীল: দেখা যাক।