আহসান হাবীব-এর সাক্ষাৎকার ।। আলাপকারী : রাজীব দত্ত ও রুহুল মাহফুজ জয়

আহসান হাবীব। কার্টুনিস্ট। লেখক। উন্মাদ সম্পাদক। দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে বাংলাদেশে প্রকাশিত হচ্ছে কার্টুন ম্যাগাজিন উন্মাদ। শিশু-কিশোর তো বটেই, প্রায় সব বয়সী মানুষের কাছেই এই ম্যাগাজিনটি বেশ প্রিয়। তাই বাংলা কার্টুন নিয়ে কোন আয়োজন করতে গেলে অতিস্বাভাবিক কারণেই উন্মাদ এবং ম্যাগটির সম্পাদক আহসান হাবীব অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে বাধ্য। গত আগস্টে কবি-শিল্পী রাজীব দত্ত আর আমি রুহুল মাহফুজ জয় এক বৃষ্টিমুখর বিকেলে আহসান হাবীবের অতিথি হয়ে মিরপুরে উন্মাদের অফ দ্য রেকর্ড অফিসে (ওনার ভাষায়) হাজির হই। উনি তখন গেম অব থ্রোনস দেখছিলেন। কিন্তু মেহমানদারি করতে এতক্ষণের সব মনোযোগ বিসর্জন দিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতা করলেন ঘণ্টাখানেক সময়। দীর্ঘ এই আলাপচারিতায় শুধু উন্মাদ, বাংলাদেশের কার্টুনের বিষয়-আশয়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি। চলে এসেছে তার ব্যক্তিজীবন, সাহিত্য, সাহিত্যিক দুই বড় ভাই, পরিবার এবং তাদের পরের প্রজন্মের কথাও। পাঠক, শ্রদ্ধেয় আহসান হাবীবের সঙ্গে আলাপচারিতা পাঠ করা যাক…

IMG_20160816_184222


ঠিক আছে, ম্যাডের বাংলাই তো হতে পারে। উন্মাদ। ওইভাবেই ভাবছি। কিন্তু ব্যাপারটায় কিন্তু প্রবলেম হয়েছে আমাদের। এখনও হচ্ছে। এই নামের কারণে আমরা কিন্তু বড় বড় বিজ্ঞাপন পাই না।


জয়: ৩৮ বছর ধরে বাংলাদেশে উন্মাদের উন্মাদনা চলছে কি করে পারলেন এটা?

  – এটা পারার কারণটা কি, আমি নিজেও তো কার্টুন আঁকি, কাজেই। আমি তখন একটা ব্যাংকে চাকরী করতাম। দেখলাম যে সেই সময়, ব্যাংকের চাকরীটা যদি করতে থাকি উন্মাদটা বন্ধ হয়ে যাবে। উন্মাদটা অনেক জনপ্রিয় ছিলো তো, দুইটা একসাথে পারি নাই। প্রথমে ভাবছিলাম দুইটাই একসাথে করবো। দেখলাম দুইটা একসাথে সম্ভব না। পরে ব্যাংকের চাকরীটা ছেড়ে দিলাম আমি। উন্মাদকেই আঁকড়ে ধরলাম। উন্মাদটা তখন ত্রৈমাসিক ছিলো। ত্রৈমাসিক থেকে মান্থলি করে ওটাকেই পেশা হিসাবে নিলাম। সমস্যা হয়েছে অনেক। কিন্তু কাভার করে নিয়েছি। এই আর কি, উন্মাদ এভাবেই এখনও চলছে।

 

জয়: বাংলাদেশে অনেক পত্রিকাই তো আসে ঢাকঢোল পিটায়ে, এইসেই বলে আসে দেখা যায় কয়েকটা সংখ্যা বা দুতিন বছর পর বন্ধ হয়ে যায় সেখানে উন্মাদ ৩৮ বছর পার করে দিলো নিশ্চয় অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে

 – হ্যাঁ, অবশ্যই। অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। এখনও করতে হচ্ছে। সংগ্রাম করছি। আসলে কি কার্টুনিস্ট তো বাংলাদেশে খুব বেশি নাই, যারা কার্টুন আঁকে তারা মোটামুটি ডেডিকেটেড। সবার সহযোগিতাতে এটা চলছে। আর সবচেয়ে বড় কথা পত্রিকাটা এখনও মানুষ কিনে। বাংলাদেশে এখন কিন্তু মানুষ খুব একটা ম্যাগাজিন কিনে না। ওই মোবাইল-টোবাইল এটা-সেটায় পড়ে ফেলে। ডেইলি পত্রিকাও কিন্তু ওইভাবে কেনা হয় না। উন্মাদ এখনও কিনে মানুষ, সে কারণে সারভাইভ করতে পারতেছি। আর বিষয়টা তো অনেক ডিফরেন্ট। পাকিস্তানেও নাই, ভারতেও নাই, নেপালেও নাই, সব দেশে কিন্তু কার্টুন ম্যাগাজিন নাই। ইন্ডিয়াতে এক সময় তিনটা কার্টুন ম্যাগাজিন ছিল। তিনটাই বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এটা এখনও টিকে আছে।

জয়: সেক্ষেত্রে এটা তো বিরাট ব্যাপার উন্মাদের টিকে থাকাটা ৩৮ বছর আগে তো কার্টুনের অবস্থা অত ভাল থাকার কথা না যতটা বুঝি, এখনও তো নাই শুরু করার সাহসটা পেয়েছিলেন কিভাবে?

 – সাহস তো ছিলোই। আমার আসলে ব্যাপারটা কি চাকরি করবো, টিপিক্যাল চাকরী করবো এটা আমি কখনো ভাবি নাই। বুঝতে পেরেছি যে আমার অনেক কষ্ট হবে। কিন্তু আমি রিস্ক নিয়েছি আর কি। আর যেটা বললেন, কার্টুনের ক্ষেত্র আরো অনেক আগেই তৈরি হয়েছে। কার্টুনের ওই জায়গাটা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের কার্টুনিস্টরা অনেক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। আমি নিজেই তো তিনটা পেয়েছি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। কিন্তু আমরা বলে বেড়াই না। কার্টুনের ফিল্ডটা আরো অনেক আগেই তৈরি হয়েছে। এখন কমিকসের ফিল্ডটাও তৈরি হয়েছে। আমরা যখন উন্মাদ শুরু করলাম, তখন বাংলা কমিকস করতাম। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট কমিকস। সেই এপিসোড শেষ হয়েছে। এখন মেহেদীরা কালার কমিকস করছে। জিনিসটা এভাবে শুরু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানও হয়েছে। দুই-তিনটা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। কার্টুন আর কমিকসের। আমরা স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়েছি। সবকিছুরই কিন্তু একটা স্টেপ আছে। এখন অনেকে ধরেন থ্রিডি অ্যানিমেশন শুরু করে দিয়েছে। হুট করে থ্রিডি অ্যানিমেশন আঁকতে গেলে তো হবে না। আগে আপনাকে কার্টুন আঁকতে হবে। গ্যাগ কার্টুন আঁকতে হবে। ওই যে পত্রিকার কোণায় কার্টুন থাকে না? তো অনেকগুলো স্টেজ আছে। ওই কার্টুন আঁকতে হবে, পলিটিক্যাল কার্টুন, কমিকস স্ট্রিপ স্ট্রিপ আসবে, কমিকস আসবে, গ্রাফিক্স আসবে, তারপরে অ্যানিমেশন। তাও টু-ডি অ্যানিমেশন। তারপর থ্রি-ডি অ্যানিমেশন। আমাদের দেশে অ্যানিমেশন জিনিসটা আগাচ্ছে না এই কারণেই। কেউ একজন একটা টেকনোলজি শিখলো, শিখে ঝাঁপিয়ে পড়লো থ্রি-ডি অ্যানিমেশন আঁকতে। ব্যাপারটা তো তা না। স্টেপ বাই স্টেপ যেতে হবে। তো আমরা ওইভাবেই স্টেপ বাই স্টেপ এসেছি। এসে এখন অ্যানিমেশনের আগের স্টেপে পৌঁছাইছি। কংক্রিট আগানো যেটা, আমরা ওভাবে আগাচ্ছি। যে কেউ হুট করে আমাদের ফেলে দিতে পারবে না।

জয়: স্বপ্ন সবাই দেখে কিন্তু সেই স্বপ্নটা আঁকড়ে ধরে থাকা, প্রমোট করা আর ছড়িয়ে দেয়া তো চাট্টিখানি কথা না

 – এখানে আরেকটা ব্যাপার আছে। অন্য অনেক কার্টুনিস্ট আছেন, শুধু নিজেকেই বড় করছেন। আমি কিন্তু তা না। আমরা কিন্তু সবাইকে নিয়ে আগাচ্ছি। ইয়াং একটা ছেলে, যে ভাল কার্টুন আঁকে, উন্মাদে তার জায়গা আছে। হুট করে কোন পত্রিকা কিন্তু কারো কার্টুন ছাপবে না। তাই না? উন্মাদে আমরা সেই সুযোগটা দেই। আমার পরিচিত না, কিন্তু সে আঁকবে। সো, বাংলাদেশে যতো ইয়াং কার্টুনিস্ট আছে সবাই এখানেই এসে প্র্যাকটিস করে।

রাজীব দত্ত: সবাই কিন্তু উন্মাদেই আসতে চায় এটা কি আপনাকে মোটিভেট করে?

 – অবশ্যই করে। আমি তো তাই চাই। এটা তো প্ল্যাটফর্মের মতো। তাই না? সে প্র্যাকটিসটা এখানেই করবে। কার্টুনে যদি ভুল-ত্রুটি হয়, আমি দেখিয়ে দেই। বলে দেই এভাবে এভাবে করো, হিউমারটা এভাবে আনো। এই জিনিসের চর্চাটা কিন্তু এখানেই হয়। আমরা আটটা-নয়টা ওয়ার্কশপ করেছি, কার্টুন শেখানোর ওয়ার্কশপ। ওইসব ওয়ার্কশপ থেকে অনেক কার্টুনিস্ট তৈরি হয়েছে। এখনও একটা ওয়ার্কশপ চলছে, কমিক বুক ওয়ার্কশপ (আগস্ট, ২০১৬)। মেহেদী (কার্টুনিস্ট মেহেদী হক) করছে। সো আমরা চাই অনেক কার্টুনিস্ট আসুক। বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, সেখানে এখন মেম্বার মাত্র তিরিশ জন। তার মধ্যে প্রফেশনাল কার্টুনিস্ট ১২ কি ১৫ জন। এখনও অনেক কম। খালি কার্টুন আঁকলে তো হবে না। তাকে কমিকস আঁকতে হবে। গ্রাফিক নভেল আঁকতে হবে। তো, আমরা ওই জায়গাটাতে যাচ্ছি।

IMG_20160816_183722

জয়: এই যে এত কম কার্টুনিস্ট, তারপরও তো আপনারা কাজ করে যাচ্ছেন তার পেছনে নিশ্চয় আপনাদের বড় কোন স্বপ্ন আছে, যা আপনাদের ড্রাইভ করে

 – স্বপ্ন তো একটা আছেই। আমাদের স্বপ্ন হলো, আমরা কার্টুনের একটা স্কুল করবো। প্রফেশনাল স্কুল আর কি। যেখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখবে কিভাবে কার্টুন আঁকতে হয়। আর্ট কলেজে এটা হওয়া উচিত। কিন্তু নাই।

রাজীব: চারুকলায় কার্টুন নাই তো

 – তো শেখাবে না? শিশির তো আছে (কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য্য)। ঢাকা আর্ট কলেজে শিশিরই তো উদ্যোগ নিতে পারে। অনেক আর্ট কলেজ আছে দেশে। একটাতেও কি কার্টুন বিষয়টা থাকতে পারে না, বা ওয়ার্কশপ করাতে পারে না?

রাজীব: প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কি আছে?

 – ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে আমি একটা কোর্স পড়াই। ভিজিটিং প্রফেসর আর কি। ওখানে তারা একটা সাবজেক্ট খুলেছে। সেটা হচ্ছে গ্রাফিক নোভেল। আমি নিজে ওটা পড়াই। গ্রাফিক নোভেল মানে কি? একদম লাস্ট স্টেজ আর কি। কার্টুন, কমিকস তার পরে হলো গ্রাফিক নভেল। তো আমি কিভাবে গ্রাফিক নভেল আঁকতে হয়, স্টোরি কি হতে পারে, আমি এসব পড়াই আর কি। জিনিসটা শুরু হয়েছে। এখন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে আছে। কিছুদিন পর অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতেও খুলতে পারে।

জয়: পাবলিক এবং প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কাজ করার এখনই  সেরা সময় কীনা কার্টুন নিয়ে?

 – অবশ্যই। কত ধরণের, কত উদ্ভট সাবজেক্ট আছে না। সে জায়গায় এটা তো একটা পুরনো সাবজেক্ট। উদ্ভট বলাটা ঠিক হয় নাই। আছে না, অনেক সাবজেক্ট যেগুলা খুব কাজের না (হেসে), সেখানে কার্টুনটা তো অনেক পুরনো সাবজেক্ট। কাজেরও। কার্টুনকে বলা হয় দ্য ইউনিভার্সাল ল্যাঙ্গুয়েজ। মানে সার্বজনীন ভাষা। আমরা দেখি একটা কার্টুনের ছবি দেখে যে লেখাপড়া জানে না, সেও হাসছে। ল্যাঙ্গুয়েজটা তো ইউনিভার্সাল। এ কারণে এটার ইমপ্যাক্টটা অনেক বেশি।

জয়: উন্মাদ এই নামটা অন্যরকম আঁতলামি নাই, কিন্তু একটা স্যাটায়ার আছে নামটা কিভাবে সিলেক্ট করলেন?

 – আপনাদেরটা যেন কি, শিরিষের ডালপালা। আঁতলামি আছে। হা হা হা। এইটা হয়েছে কি, আমরা তো সব তখন ছোটই ছিলাম। উন্মাদটা কখন বের হয়, আমরা যখন ইউনিভার্সিটিতে না ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, সে সময়টায়। আমার দুই বন্ধু ইশতিয়াক হোসেন ও কাজী খালিদ আশরাফ ওরাই প্রথম শুরু করে এটার কাজ। তখন আমরা আমেরিকার ম্যাড ম্যাগাজিনটা পড়তাম। ওটা আসতো। একটু কম আসতো। ওটাই আর কি উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখতাম। বয়স তখন কম। ঠিক আছে, ম্যাডের বাংলাই তো হতে পারে। উন্মাদ। ওভাবেই ভাবছি। কিন্তু ব্যাপারটায় কিন্তু প্রবলেম হয়েছে আমাদের। এখনও হচ্ছে। এই নামের কারণে আমরা কিন্তু বড় বড় বিজ্ঞাপন পাই না। আমরা একটা টিভি অনুষ্ঠান করেছিলাম। নামের কারণে বিটিভি ওই অনুষ্ঠানটা নেয় নাই। কেননা, ন্যাশনাল ব্রডকাস্টে উন্মাদ শব্দটা দেয়া যাবে না। এই সমস্যাগুলি এখনও আছে।

জয়: এসব কোন কথা! এটা তো বড় কোন সমস্যা হওয়ার কথা না

 – না, আছে। অনেকে ধরেন একটা বড় কোম্পানি। তার কোম্পানি উন্মাদে বিজ্ঞাপন দেবে, এই বিষয়ে একটু ওয়ারিড আর কি। তার প্রোডাক্টটায় উন্মাদের ছাপ পড়ে যায় কীনা। এই সমস্যাটা এখনও আছে। যেখানে আমরা দীর্ঘ সময় দেশের একমাত্র বিজ্ঞাপনবিহীন পত্রিকা ছিলাম। কোন বিজ্ঞাপনই ছাপতাম না।

জয়: শুধু সার্কুলেশন দিয়ে চলতো!

 – এখনও প্রায় ওরকমই। কিছু বিজ্ঞাপন থাকে। ওগুলোর বেশিরভাগই আমাদের নিজস্ব।

রাজীব: কি রকম সার্কুলেশনটা?

 – আমাদের হাইয়েস্ট সার্কুলেশন ছিল রেগুলার তিরিশ হাজার। কিন্তু এখন কমেছে অনেক। এখন তো কাগজের দাম বেড়েছে। মানুষ পত্রিকা কেনে না। এখন কমে আসছে। এখন ধরেন দশ-বিশের মধ্যে থাকে।

জয়: কোন সময়টাকে আপনি উন্মাদের সোনালি সময় বলবেন?

– আমি তো সবসময়ই সোনালি সময় বলি। আমি তো চেষ্টা করি প্রতিটা সংখ্যাই ভালো করতে। হয়তো অনেক সময় ফেইল করি। কিন্তু আমি চেষ্টা করি, প্রতিটি সংখ্যায়ই যেন যথেষ্ট হিউমার থাকে। ভাল হয়।

জয়: একজন  কিশোর বা কিশোরী যে কার্টুন আঁকছে, সবারই একটা আকাঙ্ক্ষা থাকে সে উন্মাদের আঁকিয়ে হবে

– আমি সবার ইচ্ছাই পূরণ করি। যে-ই আসে উন্মাদে আঁকতে, সুযোগ দেই। আমাদের দলটা সবসময়ই অনেক ইয়াং। যারা আসে, তাদের কার্টুন যদি ঠিকঠাক না থাকে ঠিকঠাক করে তারপর ছাপি। একটা-দুইটা হলেও ছাপি। উন্মাদে আঁকতে এসেছে এমন কেউ বলতে পারবে না যে আমার কার্টুন ছাপে নাই। উন্মাদ এভাবেই চলতেছে। সবাইকেই আমরা উৎসাহ দেই।

জয়: কার্টুন আর এর ডায়লগ, তার ভেতর তো অনেক সেন্স অব হিউমার থাকে বাংলাদেশে কার্টুনিস্ট অনেক কম, রম্য লেখক কম তার মানে কি বাংলাদেশে সেন্স অব হিউমারঅলা মানুষ কম?

 – না না না। বাংলাদেশের মানুষ খুবই রসিক। খুবই রসিক। প্রত্যেকটা মানুষই রসিক।  একজন রিক্সাওয়ালা একজন বাসের কন্ডাক্টর আপনি খেয়াল করলেই দেখবেন, তারা কিন্তু অনেক মজার মজার কথা বলে। তাই না? সেন্স অব হিউমার সবারই খুব প্রখর। ইন্টেলেকচুয়ালিটির হয়তো একটু অভাব আছে। যেমন একটা সময় চীনে যারা জ্ঞানী লোক ছিলো, তারা হাসতো না। দাঁত দেখা যাওয়াটাই নাকি একটা মূর্খতার লক্ষণ (তিনজনেই সমস্বরে হেসে ওঠে)। গম্ভীর। কখনোই হাসা যাবে না। এটা তো হয় না।

IMG_20160816_183749

রাজীব: আমাদের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে এই প্র্যাকটিসটা আছে তো

 – প্রাণিকূলের মধ্যে একমাত্র মানুষেরই সেন্স অব হিউমার আছে। আমরা করি কি, যে কার্টুনিস্ট তাকে তো আগে ছবি আঁকা জানতে হবে। দুই নম্বর হচ্ছে তার সেন্স অব হিউমারটা থাকতে হবে। রসবোধটা থাকতে হবে। একজন কার্টুনিস্ট হয়তো তার নিজের কাজটা চালিয়ে যেতে পারে, কিন্তু আমাদের এটা তো একটা ম্যাগাজিন। অনেক কনটেন্ট থাকতে হয়। ফিচার তৈরি করতে হয়। আমাদের কিছু নিজস্ব লোক আছে। যারা আইডিয়া নিয়ে কাজ করে। তো আমরা তাদেরকে বলি আইডিয়ানিস্ট। তাদের কাজ হলো শুধু আইডিয়া দেয়া, আইডিয়া ডেলিভারি করা। যারা আইডিয়ানিস্ট হিসাবে কাজ করেছে, দেখা গেছে তাদের অনেকে বিভিন্ন অ্যাডফার্মে চাকরী পেয়ে গেছে। এটাও একটা প্রফেশন কিন্তু। একজন আইডিয়ানিস্ট বেশ বড় ব্যাপার। বিদেশের অনেক কার্টুন পত্রিকায় লেখা থাকে যে রাইটার অমুক, আর্টিস্ট অমুক। কিন্তু আপনি দেখবেন পুরা পাতায় কোন ডায়লগ নাই। শুধু ছবিটাই। কিন্তু রাইটার লেখা আছে। তার মানে আইডিয়াটা আঁকছে। ন্যুনতম একটা আইডিয়া দিলেও তার নাম থাকে। আইডিয়াটার গুরুত্ব তাই অনেক বেশি। আসলে সিক্সটি পার্সেন্ট আইডিয়া আর ফরটি পার্সেন্ট ড্রয়িং। তো আমাদের পত্রিকার কিছু আইডিয়ানিস্ট আছে। তারা মাঝেমাঝে আসে, বিভিন্ন আইডিয়া দেয়। ওগুলো আমরা চিন্তাভাবনা করে ছাপি আর কি। 

জয়: আইডিয়াবাজি যে একটা পেশা হতে পারে, উন্মাদই তো প্রথম এটা শুরু করে বাংলাদেশে নাকি?

 – মনে হয় আমরাই প্রথম শুরু করেছি।

রাজীব: উন্মাদের আইডিয়ানিস্ট, কার্টুনিস্টরা তো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে

 – আমাদের একজন বিখ্যাত আইডিয়ানিস্ট আছে। ওর নাম বাপ্পি। ও এখন কানাডায় আছে। এখন গেম অব থ্রোনসে কাজ করে। ক্যাপ্টেন আমেরিকায় কাজ করছে। সে এখন ফিল্ম মেকিংয়ে চলে গেছে। খুব ভাল একটা পজিশনে চলে গেছে ও। মাঝেমাঝে আসে। ওই যে মোটাসোটা, দেখছেন মনে হয়। যে হিমু হয়েছিল। বড় ভাইয়ের নাটকে অভিনয়-টভিনয় করেছে। আরেকজন আছে আজিজুল আবেদীন। ও এখন আছে গ্রামীণফোনে। আবার বিজ্ঞাপনের মডেলিংও করে এখন। ও ভাল আইডিয়ানিস্ট। আমাদের আইডিয়ানিস্টরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। কার্টুনিস্টরা যেরকম সাফল্য পেয়েছে, আইডিয়ানিস্টরাও পেয়েছে।

জয়: এত বছর ধরে উন্মাদ করছেন নিশ্চয় অনেক ঘটনা আছে, যা কোনদিন ভুলবেন না এরকম  একটা ঘটনা জানতে চাই

 – ওটা তো হয়েছেই। সবসময় অনেক ঝামেলাও হয়েছে। একবার এক জাজ আমাদের বিরুদ্ধে কেইস করেছিল। এক কোটি টাকার মানহানি মামলা। পরে আমরা ক্ষমা-টমা চেয়েছি। বুঝিয়েছি যে ব্যাপারটা আসলে তো আইন না, সিস্টেমের বিরুদ্ধে। তখন বুঝেছে।


কার্টুনে এসেছি আসলে আমার বড় ভাই (হুমায়ূন আহমেদ) ভালো ছবি আঁকতেন। মেজো ভাই (ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল) তো আঁকতোই। জনকণ্ঠে কার্টুন আঁকতেন মেজো ভাই। ওদের দেখে দেখেই আমি কার্টুন আঁকা শিখেছি। অফিসিয়ালি এখন আমিই আঁকি।


রাজীব: কবের ঘটনা এইটা?

 – এটা অনেক আগের। আশি সালের দিকে। তারপর একবার হামলা করেছিল অফিসে। আগে আমরা সিনেমা নিয়ে ব্যঙ্গ করতাম। কোন সিনেমা মুক্তি পেলেই ওটা দেখে ব্যঙ্গ করতাম। ওরকম এক ছবির প্রযোজক-পরিচালকের লোকজন অফিসে হামলা করেছে। আমাদের কারো ক্ষতি হয় নাই অবশ্য। লাকিলি আমরা ওইদিন অফিসে দেরি করে এসেছি। এরকম টুকটাক ঘটনা তো আছেই। আসলে হয় কি, ধরেন আমি যদি এখন আপনাকে নিয়ে কার্টুন আঁকি আপনার ভাল লাগবে না? এই যে আমাকে নিয়ে আঁকছে! ব্যাপারটা তো এইরকম। এই জিনিসটা সবার মধ্যে তো নাই। অনেকে আবার খুশি হয়, তাকে আঁকা হয়েছে তাই। কার্টুন করা মানে তাকে ছোট করেছে, ব্যাপারটা তো তা না। আপনি গুরুত্বপূর্ণ দেখেই তো আপনাকে নিয়ে কার্টুনটা করা হয়েছে। ব্যাপারটা এরকম। আরেকজনের কথা মনে আছে, তার নাম বলবো না আমি। এক বিখ্যাত লোককে ব্যঙ্গ করছিলাম। তার চামচারা তাকে গিয়ে বুঝিয়েছে, “অ্যাই দেখেন আপনারে নিয়া উন্মাদ এইটা করছে। উনি বলছেন, না এটা তো ভালো! এভাবেই তো দেয়া উচিত।” তার মানে অনেকেই কার্টুন ব্যাপারটা বোঝে, অনেকই বোঝে না।

জয়: মেহেদী হকের একটা বই পড়ে জেনেছি, বাংলাদেশে যখন প্যাকেজ নাটক বানানো শুরু হয় উন্মাদ থেকে নাটক বানানো শুরু করেছিলেন আপনারা

 – (হেসে) হয়েছে কি, যখন বাংলাদেশে নতুন কোনকিছু হয় বা আসে, আমি করার চেষ্টা করি আর কি। ওই কারণেই প্যাকেজ নাটক যখন শুরু হয়, বিটিভি থেকে কাগজপত্র এনে নিয়ম-টিয়ম মেনেই নাটক আর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বানানো শুরু করেছিলাম। বানানোর পরে বিটিভি ওইটা কি কারণে যেন নেয় নাই। কারণটা আমি জানি না। ওরা কারণ হিসাবে বলেছিলো, যে উপস্থাপনা করেছে তার উপস্থাপনায় চালানো যাবে না। তারকা উপস্থাপক নিতে হবে। আমাদের অনুষ্ঠানটা বেশ ভাল হয়েছিল। সেসময় লাখ খানেক টাকা আমি খরচ করে অনুষ্ঠানটা বানিয়ে ফেলেছি। আমি একা না। আমার আরো দুই বন্ধু ছিলো সাথে। তারা ইনভেস্ট করেছে। তখন তারা বলছে অনুষ্ঠান নিবে না। পরে ওটাকে করছি কি, তিনভাগ করছি। তিন টুকরো করে তিনটা আলাদা অনুষ্ঠান করেছি। করে চ্যানেল আইয়ের কাছে বিক্রি করেছিলাম। ওরা চালিয়েছে।

রাজীব: কি নাম ছিল অনুষ্ঠানটার?

 – ওটার নাম ছিল এক্কা-দোক্কা। প্রথমে নাম ছিলো নানান রঙ। পরে নাম বদলিয়ে করেছিলাম এক্কা-দোক্কা।

জয়: মূল ব্যাপারটা তো হওয়া উচিত অনুষ্ঠানের কোয়ালিটি এবং আইডিয়া কে উপস্থাপনা করলো না করলো, সেটা তো ব্যাপার না

 – যে ছেলেটা উপস্থাপনা করেছে, সে খুবই স্মার্ট একটা ছেলে। খুব সম্ভবত চিটাগং মেডিকেল কলেজে পড়তো। খুবই স্মার্ট ছিলো সে। ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করা। উপস্থাপিকাও যথেষ্ট সুন্দরী ছিলো। সবই ঠিক ছিলো আসলে। কিন্তু বিটিভির চাহিদা হচ্ছে তারকা লাগবে। এখন আমি তো তারকার পেছনে ছুটবো না। যে ছেলেটাকে ওরা বাতিল করে দিয়েছিল, পরে আমি দেখেছি বিটিভিই ওকে দিয়ে একটা অনুষ্ঠান করাচ্ছে। এই আর কি! আমরা একটা অ্যাকশন নাটকও বানিয়েছিলাম। এক্সপেরিমেন্টাল। ওইটা ফিন্যান্স করেছিলো আমার এক বন্ধু, হাসান খুরশিদ রুমি। ও উন্মাদে কাজ করেছে আইডিয়ানিস্ট হিসাবে। কাজী আনোয়ার হোসেনের একটা গল্প আছে শিকার, ওটা নিয়ে। হ্যাভি অ্যাকশনের নাটক। বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকশন নাটক আমরাই বানিয়েছি। নাটকটা ইটিভি প্রচার করেছিলো। লাভ বেশি হয় নাই। কিন্তু আমরা সফল। আমরা বানিয়েছি এবং প্রচার হয়েছে।

জয়: আপনি অনেক আদিভৌতিক ব্যাপারস্যাপার প্র্যাকটিস করেন হুমায়ূন আহমেদ স্যার একবার আলাপচারিতায় আমাকে বলেছেন এটা

 – ব্যাপারটা আসলে কি, আমাদের ফ্যামিলিতে আমার বাবার এসব নিয়ে অনেক আগ্রহ ছিলো। হাত দেখা, এস্ট্রনমি করা, ভৌতিক ব্যাপার, আত্মা আনা এসব আমার বাবা খুব পছন্দ করতো। বাবার থেকেই আমরা এইটা পেয়েছি। হুমায়ূন ভাই, মেজো ভাইও অনেক প্ল্যানচ্যাট করেছে। পারিবারিকভাবে আমিও করেছি আর কি। ব্যাপারটা এরকম।

জয়: কিন্তু হুমায়ূন স্যার বলেছিলেন, আপনি তিনজনের মধ্যে ব্যাপারটায় ওস্তাদ

 – আমি না, আমার মেজো ভাই। আমিও করেছি অনেক। শখের প্ল্যানচেট। আত্মা নিয়ে আসা, কাউকে ভয় দেখানো, ফাইজলামিও করেছি অনেক। দেখছি যে ভূত আসছে না, প্ল্যান করে ভয় দেখানো হয়েছে তখন। এখন আর ওসব করি না।

জয়: আপনাদের ফ্যামিলিতে আর কি কি চর্চা হয়েছে এরকম?

 – আমাদের ফ্যামিলিতে আসলে সব ধরণের চর্চাই হয়েছে। ভূত-প্রেত, এস্ট্রনোমি, সায়েন্স সবই চর্চা হয়েছে। যে কারণে আসলে সবাই কোন না কোনটার দিকে আগ্রহী হয়েছে।

IMG_20160816_183622

জয়: ফ্যামিলিতে এরকম  উন্মুক্ত জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাই কি আপনাদের তিন ভাইকে প্রভাবিত করছে?

 – অবশ্যই করেছে। আমার বাবা তো খুবই আলাদা রকমের মানুষ ছিলেন। তিনি সেই সময় ফটোগ্রাফি করতেন। পারিবারিক ছবি না। ন্যাচারের ছবি তুলতেন। চাকরীর কারণে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতেন। তখন ছবিও তুলতেন। অনেক ছবি ছিলো। আদিবাসীদের ছবি, হাতির ছবি, এই ছবি। খুবই ক্ল্যাসিক্যাল ছবি সব। একাত্তরে লুট হয়ে গেছে। আব্বাকে মেরে ফেললো না? বাসা লুট হয়ে যায়। পুরা বাসাই লুট হয়ে যায়। বাবা করতেন কি, মাঝেমাঝে ছবি আঁকার প্রদর্শনী, গল্প বলা প্রতিযোগিতা, এরকম নানা ক্রিয়েটিভ কর্মকাণ্ডের আয়োজন করতেন। শুধু আমরা না, পাড়ার অন্যান্য ছেলেপেলেরাও অংশ নিতো। আর আমার বড় ভাই যেটা করতো, হুমায়ূন আহমেদ আর কি। প্রতি ঈদে অনুষ্ঠান করতো। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে কোন বাসার বারান্দায় স্টেজ-টেজ বানিয়ে গান-বাজনা, গিটার-টিটার বাজানো, নাটক এসব করতো। ভাল মজা হতো। পাড়ার সবাই ইনভলভড থাকতো। আমরা অভিনয় করতাম। যে নাচতে জানতো, সে নাচতো। এখন দেখা যায় না, টিভিতে সাতদিন ধরে বর্ণাঢ্য ঈদের আয়োজন? ওরকম সাতদিন ধরে আমাদের বর্ণাঢ্য আয়োজন চলতো। রিহার্সেল হতো আর কি। ঈদের দিন এসে শেষ হতো সেসব আয়োজন। ওই সমস্ত কারণেই হয়তো আমরা লেখক হয়েছি। শিল্পের পথে এসেছি।

রাজীব: আপনি পড়ছেন কোন সাবজেক্টে?

 – আমি মাস্টার্স করেছি জিওগ্রাফিতে।

রাজীব: কার্টুনে আসলেন কিভাবে?

 – কার্টুনে এসেছি আসলে আমার বড় ভাই (হুমায়ূন আহমেদ) ভালো ছবি আঁকতেন। মেজো ভাই (ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল) তো আঁকতোই। জনকণ্ঠে কার্টুন আঁকতেন মেজো ভাই। ওদের দেখে দেখেই আমি কার্টুন আঁকা শিখেছি। অফিসিয়ালি এখন আমিই আঁকি।

জয়: ফ্যামিলির সবাই আঁকতে পারে?

 – হ্যাঁ, ফ্যামিলির সবাই আঁকতে পারে। ছোটবোন আছে, সেও ভাল আঁকে। সে একবার সরকারি পুরস্কার পেয়েছিল। আমার মেজো বোন, ও খুব ভাল আঁকে। মূলত ভাস্কর। সে ভাস্কর্য বানাতো। ও আর্ট কলেজে চান্স পেয়েছিল। পাগলাটে আছে একটু। শেষ পর্যন্ত আর্ট কলেজে পড়ে নাই।

জয়: তার মানে আপনাদের মধ্যে শিল্পসাহিত্যের ব্যাপারটা অনেকটা জেনেটিক?

 – আমার তাই মনে হয়। আমার মা এবং বাবা দুজনেই লিখতেন। দুজনেই ক্রিয়েটিভ ছিলেন। দুজনের জিনে হয়তো মিলেছে। যে কারণে এটা আমাদের মধ্যে এসেছে। আমার মা ওই সময়ে বই পড়তেন নিয়মিত। চিঠি লিখে কিভাবে কিভাবে যেন ইন্ডিয়া থেকে বই কিনে আনাতেন। বই পড়তেন আম্মা তার বান্ধবীদের নিয়ে। আমার দাদা-চাচারাও অনেক ক্রিয়েটিভ ছিলেন। কাঠ দিয়ে অনেক জিনিসপত্র বানায় না? ওসব বানাতেন। ওনারা ওভাবে শাইন করতে পারেন নাই। কারণ আমার দাদা একটু গরীব ছিলেন। আমার বাবাকেই শুধু লেখাপড়া করাতে পেরেছিলেন। বাবাকে পড়াশোনা করিয়ে বাবাকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তুমি বাকীদের পথ দেখাও। বাবা খুব চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাকীরা ওরকম মেধাবী ছিলেন না। যে কারণে শাইন করতে পারেন নাই। কিন্তু তারা ক্রিয়েটিভ ছিলেন।

জয়: আপনার দাদার স্বপ্ন তো ঠিকই পূরণ হয়েছে আপনার বাবার মাধ্যমে, আপনাদের মাধ্যমে

 – হ্যাঁ, তা হয়েছে। আমার দাদা সব সময় বলতেন, “আমি ধন চাই না, জন চাই”। মানে আর্থিক সম্পত্তি চাইতেন না। সত্যিকার মানুষ চাইতেন। দাদা একটু পীর টাইপের ছিলেন। এখনও আমাদের গ্রামের বাড়ির দিকে গিয়ে মৌলভী বাড়ি বললে লোকজন দেখিয়ে দেবে। অর্থবিত্তের প্রতি ওনার কোন আগ্রহ ছিলো না। উনি শুধু আমাদের বলেছেন, তোমাদের ভাল মানুষ হতে হবে। উচ্চশিক্ষিত হতে হবে। দার্শনিক টাইপ ছিলেন আমাদের দাদা।

জয়: আপনার আম্মাও তো লিখেছেন

 – হ্যাঁ, আম্মাও লিখেছেন। মেইনলি আমার বাবা লিখতো তো, বাবা আবার আম্মাকেও উৎসাহিত করতো, তুমিও লেখো। পুলিশদের একটা পত্রিকা আছে। ডিটেকটিভ। ওখানে আব্বা নিয়মিত লেখতো। আম্মাকে দিয়েও লেখাতো। বেগম পত্রিকায়ও আম্মা লিখতো। বেগম পত্রিকায় আবার যাদের লেখা ছাপা হতো, লেখার সাথে প্রত্যেক লেখকের ছবিও ছাপা হতো। তো আমার আম্মার ছবিও ছাপা হতো। আমরা ভাই-বোনরা মিলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়তাম দেখার জন্য। বলতাম, আম্মার ছবি! আম্মার ছবি! এই আর কি। আম্মা পরে একটা বই লিখেছে, ওটা বের হয়েছে। মৃত্যুর আগেও একটা বই লিখে গেছেন। ওটা এখনও বের হয় নাই। পরের মেলায় বের হতে পারে।

রাজীব: বইটার বিষয় কি?

 – বইটা লিখেছেন বড় ভাইকে (হুমায়ূন আহমেদ) নিয়ে। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পরে লেখা হয়েছে। তখন উনি ভাল দেখতে পেতেন না। লিখতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তারপরও সে লিখেছে। ওটা হয়তোবা বের হবে।

জয়: একজন  মায়ের দৃষ্টিতে সন্তানকে দেখা তাও সন্তানের মৃত্যুর পর তাহলে তো এটা বিশেষ একটা বই হবে

বইটা এখনও আমি পড়িনি। পাণ্ডুলিপিটা প্রথম পড়েছে আমার বড় বোন। এরপর মেজো ভাই (ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবাল) নিয়েছে পড়ার জন্য। এখনও তার কাছে আছে। এরপর আমার কাছে আসবে।

[বি:দ্র: বইটি ‘শেষ চিঠি’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।]

রাজীব: কার্টুন আঁকার অভ্যাসটা কি ছোট থেকে ছিলো আপনার?

 – এমনিতে তো আঁকতামই। প্রথম কার্টুন আঁকি অবজারভারে। ডেইলি অবজারভার। তখন বাচ্চাদের একটা পাতা ছিলো। কার্টুন ছাপাতো। কমিকস ছাপাতো। ওখানে রেগুলার এঁকেছি। প্র্যাকটিসটা ওখানেই হয়েছে। তারপরে তো আমাদের উন্মাদ বের হলো। এরপর ওখানেই শুরু করি।

রাজীব: উন্মাদের আগে অবজারভারে ছাপা হতো তো, তখন কার্টুন ছাপা হবার প্রসেসটা কি ছিলো?

 – তখন অনেক ঝামেলা হতো ছাপতে। যখন উন্মাদ শুরু করলাম, তখন তো সমস্যার অন্ত ছিলো না। এখন তো সবকিছুই অনেক সহজ। তখন কম্পিউটার ছিলো না। তখন আমাদের ট্রেসিংয়েই আঁকতে হতো। ট্রেসিং পেপারে স্ট্যাপলার পেন দিয়ে আঁকা লাগতো। তারপরে কম্পোজ করে, লেটার প্রেসে প্রিন্ট করে পাতলা পলিথিনের উপর ওইটাকে স্কচট্যাপ দিয়ে আটকাতে হতো। এখন তো ডিজিটাল টেকনোলজি। কিন্তু দীর্ঘ সাত/আট বছর আমরা উন্মাদ ওভাবে প্রকাশ করেছি। সিলোফিন পেপারের উপর জিনিসটা হাত দিয়ে প্রিন্ট করা লাগতো। তখন ত্রৈমাসিক ছিলো তো, তিন মাস লাগতো তার কারণও আছে। সব প্রক্রিয়া ছিলো দীর্ঘ। আইডিয়া দেয়া, আঁকা, তারপর সেসব ছাপার প্রক্রিয়া। দীর্ঘ সময়ের কাজ। এখন তো এমন মেশিন আসছে, কম্পিউটারে একদিকে কাজ করছে ওদিকে প্রিন্ট বের হয়ে যাচ্ছে।


ঢাকায় বাইশটা সেন্টারে পত্রিকা পৌঁছাতে হয়। ভোর পাঁচটার আগেই আপনাকে বাইশটা সেন্টারে পত্রিকা পৌঁছে দিতে হবে। ডিস্ট্রিবিউট করতে গিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছে। হাইজ্যাকারে ধরেছে, পুলিশ আটকেছে ।এই যন্ত্রণাগুলা সইতে সইতেই আজকের অবস্থানে আসা। ইটস অ্যা লং প্রসেস। এতো ইজি না।


জয়: প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিকও তো আছে অনেকে রাতারাতি কার্টুনিস্ট হয়ে যেতে চাচ্ছে, রাতারাতি খ্যাতির পেছনে ছুটছে

 – ইয়াং ছেলে-পেলেদের মধ্যে একটা জিনিস দেখছি। ফেমাস হতে হবে। শর্টকার্টে ফেমাস হতে হবে। কতো তাড়াতাড়ি ফেমাস হওয়া যায়। কিন্তু আমরা তো ফেমাস হওয়ার জন্য কার্টুনিস্ট হই নাই। আমরা এটাকে পেশা হিসাবে নিয়েছি। কাজ করতে করতে যদি মানুষ আমাদের চিনে থাকে, এটা তাহলে আমাদের উপরি পাওনা। আমি যে পেশা হিসাবে নিয়েছি, এটা আমার কাছে মাটি কাটার মতোই পরিশ্রমের কাজ। এখন হয়তো অনেক ব্যাপার ইজি হয়েছে। কিন্তু যথেষ্ট পরিশ্রম করতে করতে আজকের এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে। ঢাকায় বাইশটা সেন্টারে পত্রিকা পৌঁছাতে হয়। ভোর পাঁচটার আগেই আপনাকে বাইশটা সেন্টারে পত্রিকা পৌঁছে দিতে হবে। ডিস্ট্রিবিউট করতে গিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছে। হাইজ্যাকারে ধরেছে, পুলিশ আটকেছে।এই যন্ত্রণাগুলা সইতে সইতেই আজকের অবস্থানে আসা। ইটস অ্যা লং প্রসেস। এতো ইজি না। সবাই হুট করে পত্রিকা বের করে ফেলে না? আমার কাছে প্রায়ই আসে এরকম লোকজন, “স্যার, আমরা একটা পত্রিকা বাইর করতে চাই। আপনার সহযোগিতা দরকার”। পত্রিকার তো অনেক প্রসেস আছে। রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, ট্যাক্স দিতে হবে, হকার্স ইউনিয়নে জমা দিতে হবে, হকার্সের মাধ্যমে ডিসট্রিবিউট হবে, হকার্স ইউনিয়নের বাইশটা স্পটে পত্রিকা পৌঁছে দিতে হবে। এই জিনিসগুলো ঠিকঠাক সামলাতে পারলেই না তুমি পত্রিকা বের করতে পারবে। আবেগে একটা বের করে ফেললেই তো হয় না। একদিন-দুদিনে কিছু হয় না। বিন্দু বিন্দু করে গড়ে তুলতে হয় একটা প্রতিষ্ঠান। তারপর অনেক সময় ধরেন হকার্স ইউনিয়নেও অনেক ঝামেলা করে। তিনদিনে পত্রিকা নাই। গায়েব। হয় না অনেক সময় এরকম?

IMG_20160816_184117

রাজীব: যখন শুরু করছিলেন, ওই সময় কারা কারা ছিলেন?

 – সে সময় একদমই আর্টিস্ট ছিলো না। আমি ছিলাম, আহসান হাবীব। সুলতানুল ইসলাম নামে আমার এক বন্ধু ছিলো। সে মেইনলি ভাস্কর আর কি, ওই যে শিশু একাডেমিতে একটা শিশুভাস্কর্য আছে না, দৌড়াচ্ছে। ওর করা। সে ছিল। খুব ভাল আর্টিস্ট সে। তারপরে নওশাদ নবী নামের একজন আর্টিস্ট ছিলো। রফিকুন নবীর ছোট ভাই রেজাউন নবী ছিলো। রেনবী। এই চারজন। আমরা এই চারজন মিলে কাজ করতাম। এরপর অনেকেই এসেছে আস্তে আস্তে।

রাজীব: রনবী স্যাররা তখন করতেন না?

 – ওনারা তো তখন মেইনস্ট্রিমে। দৈনিকে কাজ করতেন। কিন্তু আমাদের মতো ৫৬ পাতা ধরে ধরে আঁকা খুব পরিশ্রমের কাজ তো। বড়রা আসতো না।

জয়: উন্মাদ তো ৩৮ বছর ধরে বাংলাদেশের নানা পরবির্তন, ঘটনঅঘটনের সাক্ষী উন্মাদের আর্কাইভ তো বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তন বিষয়ে গবেষণার কাজে আসতে পারে

 – আমাদের পত্রিকার আইটেম, সংলাপ-টংলাপ দেখলেই বোঝা যাবে যে বাংলাদেশে কি চেইঞ্জেস হচ্ছে না হচ্ছে। এরশাদ যখন ফল করলো, তখন আমরা একটা স্পেশাল ইস্যু বের করেছিলাম। তখন ৩২তম সংখ্যাটা বের হয়েছে। তখন আমরা কি করলাম, সাড়ে বত্রিশ সংখ্যা করলাম এরশাদকে নিয়ে। এইরকম আর কি। অনেক এভিডেন্স আছে। কেউ যদি হিউমার অ্যাঙ্গেলে গবেষণা করতে চায়। তাহলে উন্মাদ ঘেঁটে অবশ্যই করতে পারবে।

জয়: মোট কয়টা সংখ্যা হইছে পর্যন্ত?

 – আমাদের এখন ৩২০-৩০ এরকম চলছে।

রাজীব: কোনরকম কি সেন্সরশিপের মধ্যে পড়তে হইছে কখনো?

 – অনেকবারই পড়তে হয়েছে। লোকজন এসেছে যে এই-এই আইটেম যাবে না। পরের দিন পত্রিকা মার্কেটে যাবে, ট্রেসিং হয়ে গেছে, দেড়শ কপি ছাপা হয়ে গেছে, তখন সেন্সরশিপ এসেছে এই-এই জিনিস যাবে না। পরের দিন ভোরবেলা পত্রিকা টাঙ্গাইল যাবে। তখন ভোরবেলা আমরা হাজির হয়েছি বাইন্ডিংস হাউজে। বলছি, স্টপ। এটা যাবে না। ওই পাতার পেছনে একটা ব্ল্যাক ইনকরেশন দিয়ে ঢাকতে হয়েছে। আমরা কেয়ারফুল থাকি। ধরেন আমরা আপনাকে নিয়ে একটা কার্টুন করলাম। আপনি রেগে ফায়ার হয়ে গেলেন। সেটা হলে তো হবে না। সেটাকে আপনার হজম করার শক্তি থাকতে হবে। মজাও পেয়েছেন, আপনার প্রচারও হয়েছে। যেমন ভারতের মনোরঞ্জন দেশাই। তাকে নিয়ে পত্রিকায় যত কার্টুন আঁকা হতো, উনি অগুলো অফিসে পেস্ট করে রাখতেন। উনি বলতেন, কার্টুন থেকে আমি শিক্ষা নেবো। আমরা অনেক ঝামেলা সহ্য করেছি। এখন একটু বয়স হয়ে গেছে। যে জন্য একটু কেয়ারফুল থাকি আর কি।

জয়: মাথায় সেন্সরশিপের বিষয়টা রাখতে হয়এটা এক ধরণের প্রেশার না?

 – তা একটু প্রেশার তো বটেই। তারপরও আমি মনে করি বাংলাদেশে সেন্সরশিপ অনেক কম আছে। অনেক সময় আমরা অনেককিছু্ই এঁকে ফেলি, যা হয়তো ঠিক না।

জয়: কার্টুন, কমিকসের পরের প্রজন্ম কি?

 – গ্রাফিক নভেল। গেম অব থ্রোনস কিন্তু গ্রাফিক নভেল। পৃথিবীর যত বড় বড় লেখকের ক্ল্যাসিক উপন্যাসগুলো আছে টলস্টয় বলেন, ম্যাক্সিম গোর্কি বলেন প্রায় সবার লেখাই গ্রাফিক নভেল হয়ে যাচ্ছে। মানুষের এখন তো অতো সময় নাই, বসে বসে বই পড়বে। গ্রাফিক নভেলে সে পেয়ে যাচ্ছে স্টোরিটা। সময় কম লাগে। এখন ওয়ার্ল্ডওয়াইড গ্রাফিক নভেলের আন্দোলন চলছে।

রাজীব: এনজিওগুলাও মনে হয় এটাকে কাজে লাগাচ্ছে

 – হ্যাঁ। অনেক ইজি তো। কমিউনিকেশন খুব সহজে করা যায় গ্রাফিক নভেল দিয়ে। আমাদের মেহেদীও তো অনেক কাজ করছে, এনজিওর সাথে কাজ করছে। গ্রাফিক নভেল দেখে দেখে এখন মানুষ মুভির শর্ট ডিভিশন করছে। আমাদের দেশে মানুষ জাম্প করে সব শুরু করতে চাইছে। আগে টু-ডি শেষ করেন। তারপর থ্রি-ডিতে যান। যারা এখন গ্রাফিক নভেলের কাজ করছে, তারা তো ওসব শেষ করে তারপর করছে। আমরা এক লাফে করতে চাইছি। এর জন্য আমাদের দেশে এনিমেশনটা ওভাবে আগাচ্ছে না। এটা আমার ধারণা।

রাজীব: সব জায়গায় তো এখন চ্যানেল ধরে যাইতে হয়

  – আগে হতো কি পত্রিকায় চিঠি লিখে, কলাম লিখে, এই পাতায় ওই পাতায় লিখে লিখে বা এঁকে লেখক-কবি-আঁকিয়েরা প্রস্তুত হতো। মানুষ তাদের লেখা পড়ে চিনতো, নাম জানতো। তারপর বই প্রকাশ করতো। মানুষ বই কিনতো। এখন সরাসরি বই প্রকাশ করে ফেলছে। বই বিক্রি হচ্ছে না। সবকিছুরই তো একটা স্টেপ আছে। আগে পত্রিকাগুলায় লেখা, আঁকা পাঠালে ছাপা হতো। এখন বিভিন্ন চ্যানেল বা সিন্ডিকেটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। একটু পরিচিত থাকলে ছাপছে। এটাও আবার খারাপ। যে কারণে হয়তোবা তরুণরা সরাসরি বই বের করে ফেলে।

রাজীব: দৈনিক পত্রিকায় কার্টুন প্রকাশ শুরু হয় ভোরের কাগজের রঙ্গব্যাংক দিয়ে, না?

 – হ্যাঁ, ভোরের কাগজের রঙ্গব্যাংক নামের একটা আলাদা পাতা ছিলো। কার্টুনের জন্য। কাজী তাপস নামের একটা ছেলে দায়িত্বে ছিলো। ও আমাদের উন্মাদের নির্বাহী সম্পাদক ছিলো। ভোরের কাগজের পর প্রথম আলোর আলপিন।

রাজীব: পাতাটা খুব ভালো ছিলো। আমার টুকটাক কার্টুন আঁকার হাতেখড়ি হইছিল রঙ্গব্যাংকে।

ভালো তো। এখনও আঁকেন না?

রাজীব: আমি ফাইন আর্টসের ছিলাম। চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে।

ওহ! ফাইন আর্টসের আপনি? তাহলে তো আঁকা উচিত। বেশি করে আঁকা উচিত। আপনারা ফাইন আর্টসের লোকজনই কার্টুন আঁকেন না। এটা তো দুঃখজনক। শিল্পীরাই তো কার্টুন আঁকবে। আমরা তো নন একাডেমিক আর্টিস্ট। কেউ নাই দেখে খালি মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছি। তবে এখন অনেকেই আঁকছে। ঢাকা আর্ট কলেজের আরাফাত, সাদাত আঁকে।

রাজীব: নন একাডেমিক হচ্ছেন মেহেদী হক আর তন্ময়।

বেশিরভাগই নন একাডেমিক।

রাজীব: মেহেদী হকের ইম্প্রুভমেন্টটা অনেক ফাইন আর্টসের লোকজনের চেয়ে ভালো।

ওই যে ওর ব্রেইন। ব্রেইনটারে কাজে লাগাচ্ছে।

রাজীব: উন্মাদের যে লোগোটা, এটা কি আপনার করা?

 – না। এটা করেছে খালেদ আশরাফ; কাজী খালেদ আশরাফ। সিনিয়র একজন আর্কিটেক্ট। ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন। নামকরা আর্কিটেক্ট। তো ডিজাইনটা উনি করেছে।

জয়: আবার একটু আপনার দিকে আসি আহসান হাবীব কার্টুনিস্টও, আহসান হাবীব লেখকও

 – লেখক হয়ে গেছি। আমাদের পরিবার তো লেখক পরিবার। আব্বা লিখতেন, আম্মা লিখতেন, বড় দুই ভাই লিখতেন। স্বাভাবিকভাবেই আমিও লিখি। ঠিক আছে, ওরা লিখছে আমিও লিখি আর কি। লেখালেখির ব্যাপারটা আসছে এভাবেই। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই হয়তো লেখক হতে পেরেছি। মেইনলি আমি রম্যই লিখি। মাঝেমাঝে একটু বাচ্চাদের জন্য লিখি, সায়েন্স ফিকশন লিখি। চেষ্টা করি আর কি।


আমার বড় ভাই প্রধানত উপন্যাস লিখতো। মেজো ভাই মেইনলি সায়েন্স ফিকশন লিখে। আর আমি লিখি রম্য। তিনজনের ধারা কিন্তু আলাদা।


জয়: নিজেকে কোন পরিচয় দিয়ে আরাম পান?

 – আমি নিজেকে কার্টুনিস্ট পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। লেখালেখি ব্যাপারটা বাইপ্রোডাক্ট। যদিও অনেক বই বের হয়ে গেছে।

রাজীব: আমাদের নারী কার্টুনিস্ট নাই বললেই চলে

 – আমাদের নারী কার্টুনিস্ট মিতু আছে, শিখা আছে, শিখার একজন বোন আছে জাহানারা নার্গিস। শিখা প্রথম আলোতে আলপিনের সময় থেকে কাজ করেছে। আমি রনবী স্যারকে একবার বলেছিলাম, আপনারা এতো ছেলে কার্টুনিস্ট তৈরি করছেন, মেয়ে কার্টুনিস্ট কই? একচুয়ালি মেয়ে কার্টুনিস্ট অনেকে আছে। হয়তো পেশাদার কাজ করে না। আমাদের এখানেই শিখছে অনেকে। কিন্তু কন্টিনিউটি থাকে না। ছেড়ে দেয়। হয়তো অন্যদিকে চলে যায়। কিছুদিন আগে আমরা দৃক গ্যালারিতে একটা প্রদর্শনী করেছিলাম। ওখানে দেখেছি মেয়েরাই বেশি আঁকছে। প্রচুর মেয়ে কার্টুন আঁকছে। আমরা অ্যাওয়ার্ড দিয়েছি। সার্টিফিকেট দিয়েছি। দেখলাম যে এইটি পার্সেন্টই মেয়ে। তো আমরা ইন্সপায়ার্ড হয়েছি। আমরা তাদেরকে বলেছিও, তোমরা এই লাইনে আসো। আমার মনে হয় মেয়েরা কার্টুন আঁকতে চায়। কিন্তু গার্ডিয়ানরা দীর্ঘমেয়াদে ইন্সপায়ার করে না। মিতু তো খুব ভাল করছে। কয়েকবার বিদেশে গেছে কার্টুন নিয়ে। শিখা ভাল করছে। জাহানারা কিছুদিন আগে একটা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। আরেকজন ছিল বুশরা, সে বিদেশ চলে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরকমই হয়। কেউ বিদেশ চলে যায়, কেউ অন্যদিকে ক্যারিয়ার গড়ে। সাদিয়া নামে একটা মেয়ে ছিলো। অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে। বিয়ে করার পর কার্টুন আঁকা ছেড়ে দিলো। বিকাশের সময়টাতে ড্রপআউট হয়ে যাচ্ছে।

রাজীব: আমাদের দৈনিকগুলাতে যে কার্টুন ছাপা হয় বা ফান ম্যাগাজিনগুলা হয়, এর সম্ভাবনা সমস্যাগুলা কি কি?

 – এটার সমস্যা আছে। ভাল সমস্যাই আছে।অনেকেই বলেন যে ফান ম্যাগাজিনগুলো আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কীনা, এটা ঠিক না। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী না। আবার প্রতিদ্বন্দ্বীও এক অর্থে। অনেক সময় গার্জিয়ানরা উন্মাদ কিনতে দেয় না। বলে, উন্মাদ কেনার দরকার কি। তুমি তো মাসে চারটা ফান ম্যাগাজিন পাচ্ছো। ব্যাপারটা এরকম। গার্জিয়ানরা হচ্ছে কি, খরচটা কমাতে চায়। ফান ম্যাগাজিন তো একটা পত্রিকার সাপ্লিমেন্ট আর আমাদেরটা একটা পরিপূর্ণ ম্যাগাজিন। দুইটার মধ্যে পার্থক্য আছে। ফান ম্যাগাজিনের দায়িত্বে যারা থাকে, হিউমার ভালো এরকম একটা লোক থাকতে হবে। আইদার কার্টনিস্ট অর রম্য লেখক। ওরকম একটা লোক থাকা উচিত আর কি। নাহলে কিন্তু জিনিসটা ভালো দাঁড়াবে না। সমস্যা হলো ওখানেই। এটা কার্টুনিস্টদের জন্য একটা ক্ষেত্র তো অবশ্যই, আবার যারা রম্য লিখে তাদের জন্যও একটা ভালো জায়গা। সেজন্যই সেন্স অব হিউমার ভালো এরকম কাউকে দায়িত্ব দেয়া উচিত। খারাপ হচ্ছে আমি বলবো না। আরেকটু ভালো হওয়া উচিত। আরো ভালো হওয়া উচিত আর কি।

জয়: আপনার বড় দুই ভাই বাংলাদেশের সবচেয়ে সেলিব্রেটেড লেখক ব্যাপারটা কি আপনার সাহিত্য প্রতিভার ক্ষতি করেছে, নাকি উপকার করেছে?

 – আমি তো ব্যাপারটা উপভোগ করি। ব্যাপারটায় আমার সাহিত্যিক ক্যারিয়ারে যদি ক্ষতিও হয়, সেটাও আমি পজিটিভলি নেবো। কোন সমস্যা নাই। আমার মেইন ফিল্ড হচ্ছে কার্টুন। আমি ওই জায়গাটায় থাকি। আর সাহিত্যে আমার ফিল্ড হলো রম্য। রম্য রচনা লিখি। ওই জায়গায় আমি সাকসেসফুল। অনেক প্রকাশনা, পত্রিকার ঈদ সংখ্যা আমার কাছ থেকে রম্য চেয়ে নিয়ে ছাপছে। তার মানে আমি আমার জায়গায় সাকসেসফুল। আমার বড় ভাই প্রধানত উপন্যাস লিখতো। মেজো ভাই মেইনলি সায়েন্স ফিকশন লিখে। আর আমি লিখি রম্য। তিনজনের ধারা কিন্তু আলাদা। আমি বলবো, আমার ভাইদের একটা গুণ আছে। ভারতে যে পূজা সংখ্যাগুলো বের হয়, দেখবেন ওখানে সব ধরণের লেখা আছে। শীর্ষেন্দু গল্প লিখছে তো সমরেশ সায়েন্স ফিকশন লিখছে। বাংলাদেশে যখন ঈদসংখ্যা বের হচ্ছে, দেখবেন যে ভ্যারিয়েশনটা নাই। সেখানে আমার ভাইয়েরা কিন্তু আলাদা। তারা নানারকমের লেখা লিখেছে। সায়েন্স ফিকশন, গল্প, উপন্যাস সব ধরণের লেখাই লিখেছে। ছোটদের জন্যও লিখেছে। একজন লেখকের তো তাই হওয়া উচিত। সব ধরণের লেখায় তার হাত থাকা উচিত। আমার দুই ভাই এদিক থেকে ঠিক আছে।

রাজীব: আপনার ভাইয়েরা কি উন্মাদে লিখতেন না?

 – লিখতো না আবার! বড় ভাইয়ের এলেবেলে লেখাটা উন্মাদে বের হয়েছে ধারাবাহিক। সে যখন লিখতো, উন্মাদের সার্কুলেশন অনেক বেড়ে যেতো। দীর্ঘদিন সে লিখেছে উন্মাদে। দুই বছর টানা লিখেছে। এরপর তো অসুস্থ হয়ে গেলো। মেজো ভাই যখন আমেরিকায় ছিলো, বলতাম উন্মাদে নিয়মিত লিখতে। তখনও সেও একটা ধারাবাহিক লিখতো, দেশের বাইরের দেশ। আমেরিকা থেকে লিখেছে। সেটাও দীর্ঘদিন। আমাদের এখানে তো আনিসুল হকও লিখেছে। আবদার রশীদ লিখেছে। খন্দকার আলী আশরাফ লিখেছে। সালেহা চৌধুরী লিখেছে। মোটামুটি বিখ্যাত অনেকেই লিখেছে।

জয়: বড় ভাই হিসাবে হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবাল কেমন ছিলেন?

 – আমার ভাইবোনেরা তো খুবই ভাল। বড় ভাই বয়সে অনেক বড় ছিলো বয়সে। মেজাজ একটু কড়া। পণ্ডিত লোক, একাডেমিশিয়ান ছিলেন তো। মেজাজ যখন ভাল থাকত তখন বয়সের দূরত্ব থাকতো না। পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। আমাদের যখন পড়াশোনার ব্যাপারে ধরতো, তখন খুব বিপদে পড়তাম। ইংরেজি ধরতো, অংক ধরতো, ফিজিক্স ধরতো, মানে মাস্টারি ভাবটা তার মধ্যে ছিলো আর কি। বিশেষ করে আমি আর আমার ইমিডিয়েট যে বড় বোন, এই দুজন একটু বেশি বিপদে পড়তাম। আমাদের দুজনকে নিয়ে হতাশ ছিলো সে। আর মেজো ভাই ছিলো সবসময় বন্ধুর মতোই। তার কাছ থেকে গল্প শুনতাম। আমি এক দিক দিয়ে ভাগ্যবান। ছোটবেলায় বড় ভাইয়ের মাথাব্যথা থাকতো বেশি। তার মাথা মালিশ করে দিতাম। মাথা মালিশ করে দিলে সবথেকে বেশি গল্প করতো সে। আর ওনার মতো গল্প বলতে আমি কাউকে দেখি নাই। বড় ভাইয়ের কাছে গল্প শোনার লোভে আরো বেশি মাথা মালিশ করে দিতাম। আর মেজো ভাইয়ের একটা ব্যাপার ছিলো, তার বিছানা ঝেড়ে দিতে হতো। বিছানা সুন্দর করে ঝেড়ে দিলে সে একটা গল্প বলতো। আমার বড় বোনও আমাকে গল্প শোনাতো। সে অবশ্য কোন কন্ডিশন ছাড়াই শোনাতো। নারী জাতি যে মহৎ এখানেই বোঝা যায় আর কি (তিনজনেই সমস্বরে হেসে উঠি আমরা…)। ওদিক থেকে হিসাব করলে আমি গল্প শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি। সেদিক থেকে হিসাব করলে আমি যখন বাবা হয়েছি, আমার একটাই তো মেয়ে, মেয়েকে কিন্তু গল্প শোনাই না। এটা আমার মনে হয়, আমি যেভাবে গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, বাবা হিসাবে নিজের সন্তানের প্রতি সেই দায়িত্বটা পালন করতে পারি নাই। মেয়ে অবশ্য নিজেই গল্পের বই পড়ে।

রাজীব: আপনি যখন ব্যাংকে চাকরীটা করতেন, তখন বয়স কেমন ছিলো আপনার?

 – তখন তো বয়স অল্প ছিলো। জাস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বের হয়েছি। বের হয়েই প্রথম চাকরি ওটা।

জয়: কোন ব্যাংক?

 – গ্রামীণ ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংক তখন জোরেশোরে শুরু হয়েছে। পোস্টিং হয়েছিলো মানিকগঞ্জে। সাতদিন মতো ছিলাম। কিন্তু বুঝলাম এই কাজ আমার জন্য না। চাকরী ছেড়ে দিলাম। ফ্যামিলিতে অনেক সমস্যা হয়েছে। তখন আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। তখন আম্মা রিকুয়েস্ট করেছিল, তুই ব্যাংকের চাকরীটা ছাড়িস না। আম্মাকে তখন কি বলবো, কিছু না বলেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। অনেক সমস্যা ফেইস করতে হয়েছিল আম্মাকে আমার শ্বশুরবাড়িকে ম্যানেজ করতে। আমার শ্বশুর তখন পিডিবির বড় অফিসার ছিলেন। তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারেন নাই। আম্মারও আস্থা ছিলো না। একটা কার্টুন ম্যাগাজিন, তার ভবিষ্যত আছে কি নাই।

জয়: ওনার, মানে ভাবীর রেসপন্স কি ছিল?

 – আমি তো প্রেম করেই বিয়ে করেছি। সে তো উন্মাদ দেখেই আমাকে পছন্দ করেছে। আমার পাড়াতেই থাকতো সে। আমার প্রতিভা দেখেই সে প্রেমে পড়েছিল হা হা হা হা হা…। এদিক দিয়েও উন্মাদ সফল। আমার প্রেমটাও উন্মাদের দান।

রাজীব: আপনার মেয়ে আঁকেন?

 – না, আমার মেয়ে আঁকে না। আঁকার হাত ভালো, কিন্তু ওভাবে আঁকে না আর কি। আঁকলে ভালোই করতো সে।

রাজীব: হুমায়ূন আহমেদের ছেলে তো আঁকে, নুহাশ?

 – হ্যাঁ, নুহাশ আঁকছে। ডেইলি স্টারে সম্ভবত মাঝেমাঝে আঁকে। ঢাকা ট্রিবিউনে আঁকে। ওর কার্টুনগুলা অনেকটা বিমূর্ত। আঁকে, ভালোই আঁকে। আইডিয়াগুলো অনেক ফার্স্ট, বোঝা একটু কঠিন। ইন্টেলেকচুয়ালিটির জায়গাটা ভাল ওর। বিদেশে এই ধরণের কার্টুনই এখন করে।

জয়: আপনাদের ভাইদের মতো বোনরা শিল্পসাহিত্যের জগতে আসেন নাই কেন?

 – আমার বাবার ইচ্ছা ছিলো আমাদের বড় বোনকেই লেখক হিসাবে গড়ে তুলবেন। সেজন্য বাবাই তাকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলা সাহিত্যে ভর্তি করিয়েছিলেন। বাংলায় পড়াশোনাও করেছে বড় বোন। অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপাল হিসাবে কবি নজরুল বিশ্বিদ্যালয় কলেজ থেকে অবসর নিয়েছে সে। কিন্তু বড় বোন কিছু লিখে-টিখে নাই। আবার মেজোবোন লিখেছে। মেজোবোনের দুই/তিনটা বই আছে। সে আবার আমার বড় ভাইকে নিয়েও লিখেছে একটা বই। বড় বোনকে আমি মাঝেমাঝে খুব উৎসাহ দেই লিখতে। ভাই-বোনদের মধ্যে বড় ভাইয়ের সাথে সে সবচেয়ে ক্লোজ ছিলো। আমি বলি, তুমি শুধু বড় ভাইকে নিয়ে না, আমাদের ফ্যামিলি নিয়েই লেখো। আব্বা কিভাবে কি করেছে, আম্মার লাইফস্টোরি; সে বলেছে হ্যাঁ লিখবো।

রাজীব: উন্মাদের একটা ইস্যু বাইর করতে গেলে কাজের প্রসেসটা কি কি?

 – একটা ইস্যু বের করতে গেলে মানে, মাসের শুরু থেকে বিশ তারিখ পর্যন্ত খুব ব্যস্ততা। বিশ তারিখ পত্রিকা প্রেসে চলে যায়। তখন আমি ঝিমাই আর কি। অন্য কাজ করি। বাই দিজ টাইম যেসব আইডিয়া আসে, সাথে আমার আইডিয়া মিলিয়ে তাদেরকে বলে দেই এই-এই হবে, এভাবে এভাবে আঁকতে হবে। ভেতরে ভেতরে ব্রেইন টু ব্রেইন কাজ চলতে থাকে। এখন একটা সুবিধা হয়েছে, সবাই কাজ মেইল করে দেয়। আগে যেমন কাগজে লিখে-এঁকে নিয়ে আসতো। এখন সশরীরে না আসলেও চলে। ওরা মেইল করে দেয়, আমি এখানে বসে সেসব দেখি। ঠিকঠাক করি।

রাজীব: কয়জন কাজ করেন আপনারা?

 – আমাদের কাজ করার আর্টিস্ট আছে দশ বারোজন তো হবেই। আর আইডিয়ানিস্ট, অফিসের অন্যান্য লোকজন আছে। আমাদের আরেকটা অফিস আছে মতিঝিলে। এটা অফ দ্য রেকর্ড অফিস আর কি।

রাজীব: কাজগুলো কোন অফিসে হয়?

 – কাজগুলো এই অফিসে শেষ করে ওই অফিসে (মতিঝিল) পাঠিয়ে দেই। ওখান থেকেই বের হয়। ওখানে একজন আছে সাগর হোসেন নামে। ব্যবসা-ট্যাবসা সব ও-ই দেখে। ছোট থেকেই আছে আমাদের সাথে।

জয়: অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও তো নিজে যা চাইছেন, সেটাই হইতে পারছেন নিজেরে নিশ্চই সুখী মানুষ মনে করেন

 – আমি আসলেই হ্যাপি। আমার প্রফেশন নিয়ে আমি হ্যাপি। যা করতে চেয়েছি, ওটাই করছি।


বড় দুই ভাই-ই সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে জীবনে। মেজো ভাইয়ের সায়েন্স ফিকশন পড়ে মনে হয়েছে, হায়! এভাবে যদি লিখতে পারতাম! বড় ভাইয়ের উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছে এভাবে একটা লিখি।


জয়: বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষই তো এটা পারে না

 – না, পারে না। ইভেন পত্রিকার ব্যবসা করতে হলে অনেক সময় যারা অ্যাড দেয় তাদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। থাকতে হয় না? অনেক প্রবলেম আছে কিন্তু! আমার ওই টেনশনও নাই। ধরেন একটা অ্যাড দিলো, ছাপা হবার পর বললো কালার ঠিক হয় নাই, এটা ঠিক নাই-ওটা ঠিক নাই। আমার ওই ঝামেলাও নাই। ওদিক দিয়াও আমি হ্যাপি।

রাজীব: ৩৮ বছর, এতো দীর্ঘ সময় ধরে তো আর কোন ম্যাগাজিন নাই নাকি?

 – আছে। আরেকটা পত্রিকা আছে। বিজ্ঞান সাময়িকী আছে। ওটা পঞ্চাশ বছর ধরে বের হয়। আমি ওটার আর্টিস্ট ছিলাম এক সময়। আর উন্মাদ ৭৮ সালে আমার দুই বন্ধু শুরু করেছিলো। পরে আমি জয়েন করেছি।

রাজীব: আপনাদের উন্মাদের সবচেয়ে ভালো প্রোডাক্ট কে?

 – মেহেদী হক আছে। আরো অনেকেই আছে। ওই যে র‌্যাটস হোসেন আছে। অনেক সুন্দর সুন্দর ডিজাইন করে। আরেকটা ছেলে আছে একদমই নতুন, ভাল আঁকছে না (তার আঁকা দেখিয়ে)? তারপর নজীব ফরায়েজি আঁকছে। সত্তর বছর বয়স। তার কার্টুনও আমরা ছাপাচ্ছি এখনও। আর কেউ ছাপে না। এখন আমাদের আর্টিস্ট অনেক। তারপর আর্ট কলেজের একটা ছেলে, তানজিম। মোর্শেদ মিশু আছে।

জয়: তো, আপনি জীবনে সবচেয়ে প্রভাবিত হইছেন কার দ্বারা?

 – আমার বড় দুই ভাই-ই সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে জীবনে। মেজো ভাইয়ের সায়েন্স ফিকশন পড়ে মনে হয়েছে, হায়! এভাবে যদি লিখতে পারতাম! বড় ভাইয়ের উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছে এভাবে একটা লিখি। এভাবেই আমার লেখাগুলো হয়েছে। যদিও আমি রম্য লিখছি।

জয়: আর কার্টুনে?

 – কার্টুনেও মেজো ভাই ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবাল। উনি যদি শুধু কার্টুন আঁকতেন, দেশের সেরা থাকতেন হয়তো।

 

রাজীব: আপনার পছন্দের কার্টুনিস্ট কে?

 – বাংলাদেশে এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে পছন্দের কার্টুনিস্ট হচ্ছে মেহেদী হক। খুবই ম্যাচিউরড কার্টুন্টিস্ট। মেহেদী সেই ক্লাস নাইন থেকে আমার সঙ্গে আছে।

রাজীব: ওনার বইটা পড়লাম। পড়ে খুব মজা পাইছি।

জয়: হ্যাঁ খুব মজা পাইছি।

বিদেশে একজন আছে। তার নাম হচ্ছে সার্জিও আরাগন্স। মেক্সিকান কার্টুনিস্ট। খুব ভালো আঁকেন। এমনি অনেকেই প্রিয়। কিন্তু স্পেশালি মেহেদী আর সার্জিওর কাজ ভাল লাগে।

রাজীব: আপনাদের উন্মাদের কি কোন আর্কাইভ আছে?

 – ওটাই তো সমস্যা। আমাদের কিছুই নাই। এখন বুঝতে পারি, করা দরকার।

রাজীব: অনলাইন আর্কাইভ করা যায় মনে হয়

 – আমরা একটা ওয়েবসাইটের জন্য ডমেইন-টমেইন কিনে রেখেছি। এখন কাজ করতে হবে। হচ্ছে না। কিন্তু করা তো উচিত আসলে। এখন নানারকম অফার আসে। আমাদের ব্যর্থতার কারণে হয় নাই এখনও। আমি নিজেও ফিল করছি।

জয়: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।

 

সাক্ষাৎকারের মাঝপথে শুরু হওয়া বৃষ্টি ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে। রাস্তায় হাঁটুপানি। আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারের পরেও আমাদের তিনজনের আড্ডা চলেছে অনেকক্ষণ। নৈতিক কারণেই সেসব আলাপচারিতা অপ্রকাশিত রয়ে গেলো।

শেয়ার