একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের কবিদের সঙ্গে ধারাবাহিক আড্ডায় এবারের মধ্যমণি ছিলেন ‘কাঠঠোকরার ঘরদোর’-খ্যাত আল ইমরান সিদ্দিকী। আগুনের ফুলকি ছোটানো এ ্আড্ডায় ইমরানকে ঘিরে প্রশ্নবান ছুঁড়েছেন হুজাইফা মাহমুদ, ফয়সাল আদনান, আসাদ জামান, মোস্তফা হামেদী, হাসান রোবায়েত, ফারাহ্ সাঈদ ও রুহুল মাহফুজ জয়। ইমরান সেসব প্রশ্নের চমৎকার উত্তর দিয়েছেন। এই আড্ডার মাধ্যমে কবি আল ইমরান সিদ্দিকীর কাব্যদর্শন সম্পর্কে স্পট ধারণা পাওয়া যায়। পাঠক, আড্ডায় অংশ নিন…
বাংলা কবিতা লিখতে এসে ধারাবাহিক ইতিহাসকেও অস্বীকার করা সম্ভব না
হুজাইফা মাহমুদ
ইমরান ভাই, কি অবস্থা? কেমন আছেন?
আল ইমরান সিদ্দিকী
অবস্থা ভালো। তোমার কী অবস্থা?
হুজাইফা
সব মিলায়া ভালই বলা যায়!
ইমরান
গুড
হুজাইফা
আপনার ইদানিংকার লেখালেখির কি খবর? কী লিখতেছেন?
ইমরান
ইদানিং লেখালেখি এক প্রকার বন্ধই আছে। আমার মোট কবিতার সংখ্যা ৮৬টা। আপাতত কিছুদিন কবিতা না লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একটা ব্রেক নেয়া দরকার। টানা অনেকগুলি বছর লিখলাম।
হুজাইফা
এবারের মেলার জন্য কোন বই রেডি করেননাই?
ইমরান
হুম, করছি। বইয়ের নাম ‘ধূপছায়াকাল’।
হুজাইফা
আচ্ছা! ভাল খবর!
ইমরান
আরও একটা পাণ্ডুলিপি প্রায় রেডি হয়ে আছে ‘গোধূলির প্যানোরামা’।
হুজাইফা
লেখালেখি থেকে ব্রেক নেবেন, সেটা কি টোটাল লেখালেখি থেকে, নাকি অন্যকিছু লেখবেন, গদ্য-টদ্য?
ইমরান
গদ্য বলতে কবিতা বিষয়ক গদ্য লেখা যেতে পারে; মেজাজ-মর্জির ওপর নির্ভর করে।
হুজাইফা
সেটা করা উচিৎ মনে হয়! কবিতা বিষয়ক গদ্য ইদানিং খুব কম হচ্ছে। অথচ এটা তো জরুরী ছিল!
ইমরান
ছিল তো বটেই। সবারই লেখা উচিৎ। কেউ যদি বলে আমি লিখি না তাহলে মানা যায়। লিখতে পারি না বললে সেটা মানা একটু কঠিন। নিজের লেখালেখি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে লেখা সম্ভব ।
হুজাইফা
আপনার লেখালেখির শুরু কী দিয়ে? কবিতা না গল্প?
ইমরান
কবিতা। কবিতাও না, পদ্য আসলে।
হুজাইফা
হা হা হা কোন সময়ে সেটা?
ইমরান
শুরুতে পদ্য, তারপর ব্যান্ডের গান, তারপর কবিতা। বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলে ‘ব্যান্ডের গান লিখতে গিয়া কবি!’’
হুজাইফা
আপনার এখনকার কবিতা পড়লে কিন্তু কল্পনা করা মুশকিল, আপনি রক টাইপের গান লেখতে পারেন!
ইমরান
ক্লাস সিক্সে। আছে আমার কাছে; পরে তোমাকে দিবো; খুঁজে বের করতে হবে।
হুজাইফা
কবিতার কনটেম্পোরারি ধারা বলে যে ধারাটা আছে, সেটা ধরতে বা বুঝতে কত সময় লেগেছিল?
ইমরান
আমি সেটা ধরতে চেষ্টা করেছি অনার্স সেকেন্ড ইয়ার থেকে। বছর দুয়েক তো লেগেছে। আমি ক্লাসিকাল পড়ে আসা লোক। প্রথমে তো কিছুই বুঝতাম না।
হুজাইফা
সেটাত ২০০৮/০৭ সাল হবে, না?
ইমরান
২০০৫/৬ হবে মনে হয়। আমার প্রথম বইয়ের কবিতাগুলির মধ্যে যেটা সবার আগে লেখা, সেটা ২০০৮ এ – ‘অবিবাহিতের গান’
হুজাইফা
শূন্য এবং দ্বিতীয়, মোটামুটি দুই দশকেই আছেন সমানভাবে! এই দুই দশকের কবিতায় কোন পার্থক্য খুঁজে পান? ফর্ম, কনসেপ্ট, থিম ইত্যাদিতে?
ইমরান
স্পষ্ট পার্থক্য আছে। দ্বিতীয় দশকে অনেক রকম কাজ হয়েছে ও হচ্ছে।
ফয়সাল আদনান
শূন্যের থেকে কি কি আলাদা? কিভাবে?
ইমরান
শূন্যে অনেক ভালো কবি আছে। ভালো লিখছেন তারা। তবে শূন্যের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর টানা-গদ্যের কবিতা। দ্বিতীয় দশকে ফর্ম নিয়ে অনেক রকম কাজ হয়েছে, হচ্ছে; আপনি আশা করি ওয়াকিবহাল আছেন।
ফয়সাল
আপনার থেকেই শুনতে চাচ্ছি
ইমরান
শূন্যে বৈচিত্র কম দ্বিতীয় দশকের তুলনায়। দ্বিতীয় দশকে বিচিত্র ছন্দে কাজ হয়েছে।
হুজাইফা
এই বৈচিত্র কি কেবলই ছন্দে?
ফয়সাল
আমিও একই কোশ্চেন করতাম হুজাইফা, থ্যাংক্স!
ইমরান
না, তা কেন! শূন্যে তেমন দীর্ঘ কবিতা নাই। দ্বিতীয় দশকের সেটা আছে। এবারের মেলায় একাধিক বই আসবে এমন। তাছাড়া ক্রিয়াপদ নিয়ে কাজ আছে। ফর্ম নিয়ে বহুরকম কাজ হচ্ছে।
ফয়সাল
কবিতার দৈর্ঘ্য, ছন্দ, ক্রিয়ার ব্যবহার এগুলা তো বেশ বেসিক ব্যাপার। আপনার অবজার্ভেশন যদি কারেক্ট মনে করি, তাহলে কি বাংলা কবিতা এখনো বেসিকের গণ্ডী পাশ করতে পারেনি?
ইমরান
প্রশ্নটা বেসিকের না, বৈচিত্রের; এসবের ভিতর দিয়েই বৈচিত্র সূচিত হয়।
ফয়সাল
আপনি তো শূন্য দশকেই লেখা শুরু করলেন। প্রথম বই ‘কাঠঠোকরার ঘরদোর’ কতটা শুন্যের আর কতটা দ্বিতীয় দশকের প্রতিনিধিত্ব করে?
ইমরান
আমি বেসিকালি লেট জিরোর কবি। ফলে ধরে নিতে হবে শূন্য দশকের কবিতায় যে সামগ্রিক রূপ দাঁড়িয়েছে, সেখানে আমার কোনো কন্ট্রিবিউশন নাই।
ফয়সাল
আমি আপনার কবিতায় শূন্যের কন্ট্রিবিউশন জানতে আগ্রহী
ইমরান
আমি এভাবে ভেবে দেখি নাই। তবে আমি লিখতে শুরু করেছি যখন, তখন কনটেম্পরারি কবিতার টোন ধরতে আশি, নব্বই ও শূন্য দশকের কবিতা পড়েছি। বই ধরে পড়েছি এমন না। লিটল ম্যাগ, কালের খেয়া এসব পড়েছি।
ফয়সাল
শুন্যের কারো কবিতা ভালো লাগে? বৈচিত্র্যপূর্ণ মনে হতো?
ইমরান
শূন্যে অনেকের কবিতাই ভালো লাগে, যদিও তেমন বৈচিত্র দেখি না।
আসাদ জামান
আচ্ছা, কবিতা লিখতে গিয়ে একজন কবিকে সর্বপ্রথম কোন দার্শনিক সত্যটিকে মোকাবিলা করতে হয়?
ইমরান
আমার মনে হয় ‘পরম’কে নিয়ে একটি সত্যে এসে দাঁড়াবার তাগিদ অনুভব করতে হয়।
ফয়সাল
‘পরম’ ব্যাপারটা কি? ধ্রুব?
হুজাইফা
পরমকে কিভাবে ব্যাখ্যা করেন আপনি?
ইমরান
আমি ‘ঈশ্বর’ বলি না, তাতে অথরিটির ব্যাপার আছে। আমি ‘পরম’ই বলি। আমাকে ডিল করতে হয়েছে বিষয়টা। যে কারণে আমি বললাম।
ফয়সাল
আচ্ছা, তো পরম শব্দটাও তো একটা অথরিটি মনে হয়
হুজাইফা
সুপ্রিম পাওয়ার, বা বোধ, কিছু একটা টের পাওয়া ভেতরে?
আসাদ
সবার আগে তো ‘নো দাইসেলফ’ আসার কথা
ইমরান
আমি পরমে বিশ্বাস করি। না ফয়সাল, আমার কাছে তেমন মনে হয় না। যদিও আমি সুফি ধ্যান-ধারণা থেকে অনেক দূরে, তবু আপনি সুফিতত্ত্ব ঘাটলে দেখবেন সেখানে অথরিটির বিষয় নাই।
হুজাইফা
‘নো দাইসেলফ’ আমার মনে হয় আরও বেসিক ধারণা। সেটা কবিতায় আসার আগেই তৈরি হয় মানুষের!
ইমরান
আন্ত:সংযোগ আছে আসাদ।
আসাদ
আগে সেই বেসিক ধারণাটাতেই অপনোদিত হতে হয়
ইমরান
হ্যাঁ
ফয়সাল
তো পরম ব্যাপারটা সুপেরিয়র না, তাহলে ব্যক্তির বর্তমান সত্তার সাথে পরমের কি পার্থক্য? সুফিরা পরমের কাছে, এশকের কাছে কেন যাইতে চান?
হুজাইফা
কবিতায় আরেক ধরনের বোধ তৈরি হয়, সেটা অব্যখ্যাত। কি যেন নেই, কি যেন আছে! সবকিছু শূন্য, আবার ভরপুর! “বিপন্ন বিস্ময়ের” মতো একটা ব্যাপার। এর আসলে কোন দার্শনিক ডেফিনেশন হয়তো নাই!
ফয়সাল
হুজাইফার সাথে টোটালি এগ্রি করি না। ইমরান ওরটা বলুক।
আসাদ
‘আদৌ কি আছে সেই ফুল যার পরাগের শূন্যে উঠে নাচ করে আবার ফুলেই ফিরে আসতে চায়’ আপনার কবিতার লাইন। আপনার কাছে পরম কি এরকম?
ইমরান
পরম প্রকৃতির বাইরে কিছু না।
আসাদ
মানে কবিতায়?
ইমরান
না, আসাদ। এটা ঐ জায়গা থেকে আমি লিখিনি। তুমি যদি কোনোভাবে রিলেট করে থাকো, তাহলে বলতে পারো।
হুজাইফা
আপনি তো রাগ সঙ্গীতের খুব ভক্ত। রাগে কি ওই পরম জাতীয় কিছুর আরাধনা করা হয়?
ইমরান
রাগের তেমন আরাধনা তো আছেই। তবে আমি রাগ শুনি সুরের কারণে, তাল-লয়ের কারণে। ঘোরগ্রস্থ করে তোলে।
হুজাইফা
তিরিশি আধূনিকতাকে কিভাবে দেখেন? অনেকেই এর ইতিবাচকতা আর নেতিবাচকতা নিয়ে আলাপ করেন! আপনার দৃষ্টিভঙ্গী কী?
ইমরান
ভালো প্রশ্ন। আমরা প্রায় ২০০ বছর বৃটিশ শাসনের আওতাধীন ছিলাম। এর প্রভাবকে অস্বীকার করার উপায় নাই, এড়িয়ে যাবারও দরকার নাই। বাংলা কবিতা লিখতে এসে ধারাবাহিক ইতিহাসকেও অস্বীকার করা সম্ভব না। আজকের কবিতার কথা যদি বলেন, তো আমি সম্মিলনের পক্ষপাতী- ‘দেবে আর নেবে, মেলাবে মেলাবে’। আমাদের কবিতা যেন বহুরকমের আত্তীকরণের ভিতর দিয়ে আমাদের কবিতা হয়ে ওঠে। চণ্ডীদাসের আমলের কবিতা থেকে নতুন করে শুরু করার প্রস্তাব অনেকে করে থাকেন। সেটা আমার কাছে কাজের কাজ মনে হয় না, সম্ভবও না। তবে পিছন থেকে আমাদের অনেক কিছু নিতে হবে। যত বেশি নিতে পারবো, ততই লাভবান হবো।
আসাদ
বাংলা কবিতার যে ধারাবাহিকতা, তা থেকে বাংলা কবিতা কোথাও কি জাম্প করেছে?
হুজাইফা
সম্মিলন হয়েছে ঠিক। তবে সেটা একতরফা হয়েছে না!?! আমরা তো সবসময়ই রিসিভিংয়ে ছিলাম। সেন্ডিংয়ে যেতে পারিনি। একটা ভাষার আধুনিকতার ভিত যদি অন্য আরেকটা মহাদেশ থেকে ধার করা লাগে, তাহলে সেটা কতটা ইতিবাচক?
ইমরান
কবিতার বাস্তবতা আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার বাইরের কিছু না। যদি জাম্প করে থাকে তো সেটা একটা বাস্তবতা। মেনে নিতে হবে।
আমার সংস্কৃতিকে যেমন আমি প্রতিনিধিত্ব করি, তেমনি একইসাথে আমি বিশ্বেরও। সংস্কৃতি সবসময় একরকম থাকে না।
আসাদ
এটা কি এডাপ্টেবল?
ইমরান
আমরা তো মানিয়ে নিয়েছি, তাই না? তবে নিজেদের যা-কিছু তা থেকে নিতে হবে অবিরত।
হুজাইফা
আপনার কি এটা মনে হয় যে, আপনি এখনো সেই তিরিশি আধুনিকতারই লেগেসি বহন করছেন? সেই পরম্পরাই এখনো জারি আছে?
ইমরান
এড়িয়ে যাবার সুযোগ নাই। কিছুটা তো বহন করিই। আমি এড়াতে চাইও না।
আসাদ
যে-কোন সামাজিক অবস্থার কথাই ধরুন উলম্ফনের একটি নেগেটিভ ব্যাপার থাকে। আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রে তেমন কিছু সমস্যা কি আপনার চোখে পড়েছে?
ইমরান
আমাদের কবিতা অন্য চেহারা পেতে পারতো। ত্রিশের কবিতার একটা বাস্তবতা হলো রবীন্দ্রনাথ। তারা সেটাকে এড়াতে চেয়েছে। অনেক বেশি নিয়েছে পশ্চিম থেকে। এটা মানতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার লেগেসি বহন করা ছাড়া উপায় তো নাই।
হুজাইফা
আমারও তাই মনে হয়, তিরিশে যেটা হয়েছে সেটা সময়ের প্রয়োজনেই করতে হয়েছে তাদেরকে। দৈত্যসম রবীন্দ্রনাথের বলয় ভাঙ্গাটা মুশকিল ছিল।
ইমরান
ঠিক। হ্যাঁ, নেগেটিভ দিক তো আছেই। রবীন্দ্রনাথের পর নজরুল, মোহিতলাল, সত্যেন্দ্রনাথ হয়ে কবিতাটা যে চেহারা নিচ্ছিল সেটা ভিন্ন দিকে যেত। হয়তো আমাদের এত আপত্তি থাকতো না তাতে, যতটা ত্রিশের কবিতা নিয়ে আছে। সেটা হয়তো আরো ভালো কিছু নিয়ে আসতো।
হুজাইফা
কবিতায় আঞ্চলিকতাকে কিভাবে দেখেন? কোন ভূখণ্ডের কবিকে কি তার নিজস্ব ভূখণ্ডের হাওয়া-বাতাসের আলোকেই লিখতে হবে? সেখান থেকেই উপাদান গ্রহণ করতে হবে? এখানে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয় আসলে। একদিকে যখন বৈশ্বিকতার কথা বলা হয়, স্লোগান দেয়া হয়- কবিতার কোন গণ্ডি নেই, মানচিত্র নেই। অপরদিকে, আঞ্চলিকতাটাকেও অপরিহার্য মনে করা হয়! নিজ দেশের কৃষ্টি-কালচার, সভ্যতা ইত্যাদি থাকতে হবে!
ইমরান
আগেই বলে নেই, আমি সমন্বয়ে বিশ্বাসী। দ্বন্দ্ব আমি দেখি না। আমার সংস্কৃতিকে যেমন আমি প্রতিনিধিত্ব করি, তেমনি একইসাথে আমি বিশ্বেরও। সংস্কৃতি সবসময় একরকম থাকে না।
হুজাইফা
আমার তো মনে হয় ঔপনিবেশ শাসিত দেশগুলোর মাঝে এটা একটা মৌলিক দ্বন্দ্ব হিসেবে কাজ করে।
ইমরান
হামদ-নাদ আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
আসাদ
এই যে পশ্চিম থেকে নেয়ার ব্যাপারটিতে দুটি বিষয় আছে একটা হলো- পোশাকি, আরেকটা প্রজ্ঞা। একসময় বঙ্কিমরাও নিয়েছেন। সেটা প্রজ্ঞা। এই সময়ের কবিদের মধ্যে সেই প্রজ্ঞার ব্যাপারটিকে এড়িয়ে পোশাকি ব্যাপারটাকে গ্রহণ করার প্রবণতাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ইমরান
যা আমাদের ছিল তার অনেক কিছু পরায়া হয়েছে। যা আমাদের না, তার অনেক কিছুকে আমরা গ্রহণ করেছি যুগে যুগে।
ফয়সাল
আসাদ জামান, বঙ্কিমেরটা প্রজ্ঞা হলে এখনকারটা পোশাকি কেন?
ইমরান
প্রশ্নটা যতটা অবলীলায় করা গেল, বিষয়টা তত সহজ না, উত্তরটাও স্বাভাবিকভাবেই সহজ না। ত্রিশের কবিদের কথা যদি ধরো, তাহলে আমি কখনও বলবো না তাদের নেয়াটা অনুকরণ মাত্র। এটা নিয়ে তর্ক থাকবে। তোমার কেন মনে হলো এই সময়ের কবিরা শুধুই অনুকরণ করছে?
আসাদ
আমি দুটো ব্যাপার স্পষ্ট করেছি ১) প্রজ্ঞা বা জ্ঞান যাই ধরুন এবং, ২) পোশাকি। দুটো টোটালি আলাদা বিষয়।
ইমরান
যেমন?
আসাদ
কারণ, সহজভাবে- আপনি যখনই পশ্চিমাদের বা অন্য কারও থেকে গ্রহণ করবেন আপনার জন্য লাভজনক হবে জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। পোশাকি ব্যাপারটি শুধু আপনাকে ময়ূরের পরিবর্তে কাকই করে রাখবে। যেখানে আপনার আইডেন্টিটি আছে…
ইমরান
আমরা তো শুধু ইউরোপ থেকেই নেবো না, সবখান থেকেই নেবো। তোমার কেন মনে হচ্ছে যেভাবে নেয়া হচ্ছে সেটা সঠিক পথ নয়? তুমি যাকে ’পোশাকি’ বলছো, তেমনটাই কি ঘটছে নেয়ার প্রশ্নে?
আসাদ
অনেক ক্ষেত্রে তাই ঘটছে
ইমরান
তাহলে তো সেটা খারাপই।
আসাদ
কিছু উদাহারণ দেয়া গেলে ভালো হতো
ফয়সাল
নিজের কবিতার কোন দুর্বলতা দেখেন কি ইমরান? কোন সেল্ফ এনালাইসিস বা একচুয়ালাইজেশন?
ইমরান
দুর্বলতার কথা জানি না। তবে আক্ষেপ আছে। আরও অনেক কাজ করতে চাই। আরও আরও জায়গা স্পর্শ করতে চাই। দুর্বলতার কথা তো আপনি বলবেন।
ফয়সাল
আক্ষেপগুলা যদি স্পেসিফিক্যালি বলেন…
ইমরান
দেখেন আল মাহমুদের ’সোনালী কাবিন’ নামক সনেটগুচ্ছ, রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’র মুক্তবন্ধ আমাকে মুগ্ধ করে। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজর কবিতার বৈচিত্র আমাকে মুগ্ধ করে। আমি অনেক কাজ করতে চাই। পড়তে গেলে তো আক্ষেপ তৈরি হয়ই।
ফয়সাল
এই সময়ে এসে আপনার যেমন কবিতা লেখার চেষ্টা, সেটা কিছুটা রিসেসিভ লাগে আপনার। এটার উৎসাহ কোত্থেকে আসে?
ইমরান
আমি একটু আগে বলেছি অতীত থেকে যত নেয়া যায় ততই ভালো; নিজের সময় ও বাস্তবতার সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে দেখার তাগিদ আমি পাই।
আসাদ
সাহিত্যিক সততা আর স্বতঃস্ফুর্ততা কোনটি আগে জরুরি মনে হয় আপনার কাছে?
ইমরান
সততার সাথে স্বতঃস্ফূর্ততার সংঘাতটা কোথায়?
আসাদ
একটা কবিতা স্বতঃস্ফুর্ত হতেই পারে, কিন্তু সেখানে সাহিত্যিক সততা নাও থাকতে পারে।
ইমরান
তেমনও হয় নাকি! আমি শিল্পের প্রশ্নটা আগে রাখি। কবিতা হয়ে উঠলে আমার নিতে আপত্তি নাই।
এই অঞ্চলের র’নার্ভগুলি চিহ্নিত করা ও কবিতায় ধরাটাও আমার কাজ বলে মনে করি
হুজাইফা
আপনার নিজের লেখায় কি কখনো কারো প্রভাব পড়েছে? বা এখনও কি বিশেষ কোন ক্ষেত্রে কারও দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে হয় নিজেকে?
ইমরান
আমি প্রভাবিত হতে পছন্দ করি না, পাশাপাশি প্রভাবিত হওয়াটাকে দোষের কিছু মনে করি না। প্রত্যেকেই একাধিক কবি দ্বারা প্রভাবিত। আমি বড়জোড় বলতে পারি আমি কাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত। আমি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু দ্বারা অনুপ্রাণিত। বাইরের কবিদের মধ্যে যারা আমাকে অনুপ্রাণিত করে তাদের মধ্যে জন কীটস্, হোর্হে লুইস বোর্হেস অন্যতম।
হুজাইফা
একজন কবি যখন তার লেখার যাত্রা শুরু করেন, তখন কি শুরুতেই নিজস্ব টোনটা আবিষ্কার করতে পারেন? আপনি পেরেছিলেন?
ইমরান
আমি চেষ্টা করেছি শুরু থেকেই। তবে নিজের স্বরই শেষ কথা না। আমি নিজেকে আঁকতে চেষ্টা করেছি মাত্র। তবে হ্যাঁ, কবিতা নিয়ে অনেক রকম চিন্তা-ভাবনা তো কাজ করেই। জীবনের যে অ্যাসেন্স বাংলা গানে আছে, সেটা বাংলা কবিতায় বিরল। সেটা আমার কাজ বলে মেনে নিয়েছি। ত্রিশের পর থেকে বাংলা কবিতা নেতির চর্চা করেছে এবং তা অব্যাহত আছে। আমি এর থেকে বের হতে চাই ও চেয়েছি। এই অঞ্চলের র’নার্ভগুলি চিহ্নিত করা ও কবিতায় ধরাটাও আমার কাজ বলে মনে করি।
আসাদ
কোন কবিতায় স্বতঃস্ফুর্ততা থাকার পরেও সেখানে সাহিত্যিক সততা নাও থাকতে পারে এমনটা কি হতে পারে না?
ইমরান
আসলে সততা না থাকলে কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত মনে হতে পারে। এটা কবির ক্ষমতা। তাঁর মেধার, তাঁর কব্জির জোর।
হুজাইফা
সাহিত্যিক সততা বলতে কী বোঝাচ্ছেন, সেটা আরেকটু ক্লিয়ার করলে মনে হয় ভাল হয়, আসাদ ভাই! ত্রিশের উনারা নেতির চর্চাটারে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের শুভ, মঙ্গল, ইত্যাদি বোধের বিরুদ্ধে, ইমরান ভাই!
আসাদ
সাহিত্যিক সততা বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা।
ইমরান
সেটা তো বটেই। তবে আমি সেটা থেকে বের হতে চাই তাদের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েই।
হুজাইফা
এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। অবচেতনভাবে আমার ভেতরও এই জিনিসটা কাজ করে। আরোপিত নেতির চর্চা ফাঁকা আর অন্ত:সারশূন্য।
ইমরান
সবসময় তা না। রোমান্টিকরা অনেক কিছুকে স্কিপ করে গেছে। ত্রিশের কবিরা যত্নশীল হয়েছে সেসব বিষয় ধরতে।
হুজাইফা
আরোপের বিষয়টা আমি নিজের ক্ষেত্রে বলছি আরকি। অর্থাৎ ট্রেন্ড মেনে চলতে গিয়ে নিজের উপর কিছু আরোপ করতে চাই না।
ইমরান
ভালো সিদ্ধান্ত।
মোস্তফা হামেদী
প্রথমে একটা মন্তব্য করে নিই। শূন্য দশকে দীর্ঘ কবিতার একটা সংকলন আছে অনন্ত সুজন সম্পাদিত। উপরে বলা হচ্ছিল শূন্যে দীর্ঘ কবিতা নাই। সেই প্রসঙ্গে বলা।
ইমরান
ধন্যবাদ। জেনে রাখলাম। সংগ্রহ করবো।
হামেদী
যাই হোক, এই সময়ে এসে আপনি এবং অনেকেই সংস্কৃত ছন্দে কাব্য চর্চায় বেশ নিয়োজিত ছিলেন এবং আছেন। হঠাৎ করে সংস্কৃত ছন্দ চর্চার দিকে ঝুঁকলেন কেন? আর্থ-সামাজিক বা দার্শনিক প্রেক্ষিতটা কী?
ইমরান
আমরা যারা সংস্কৃত ছন্দে কবিতা লিখি, তারা যে শুধুই সংস্কৃত ছন্দে কবিতা লিখতে চেষ্টা করি তা না। সনেট লিখতে চেষ্টা করেছি, বাংলা ছন্দে লিখতে চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছে ছন্দে ফেরা দরকার। বাংলার নিজস্ব সুর-স্বর ধরা দরকার। ভিন ভাষার ছন্দকে বাংলা কবিতায় ব্যবহার করে সমৃদ্ধ হওয়া দরকার। টানা-গদ্যেও কবিতা লিখেছি। কিন্তু টানা-গদ্যকে আঁকড়ে ধরে থাকার যে প্রবণতা, সেটা থেকে বের হতে চেয়েছি।
হামেদী
সংস্কৃত ছন্দ বা সংস্কৃত ভাষা কি বাংলার নিজস্ব সুর ও স্বরের ধারক? যেখানে এটাকে ইতিহাসে এলিট মহলের ভাষা হিসেবে পাই। আবার ভারতচন্দ্রের ‘যাবনী মিশাল’ বাংলার কাউন্টার হিসেবে ঔপনিবেশিক শক্তি সংস্কৃতের আশ্রয় নিয়েছে। সেক্ষেত্রে এটাকে আমরা কতটা প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করতে পারি?
ইমরান
ভালো প্রশ্ন। সংস্কৃত একটি সর্বভারতীয় ভাষা, স্বাভাবিকভাবে এই ভাষার কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দও সর্বভারতীয় ছন্দ। উপমহাদেশের অনেক ভাষাই সংস্কৃত দ্বারা পরিপুষ্ট। সেদিক থেকে দেখলে সংস্কৃত সবচেয়ে বেশি অস্তিত্বশীল। এলিট মহলের ভাষা তো অচ্ছুত হয়ে যায় না। যাবনী মিশালও শিরোধার্য। বাংলা ভাষা নিজেই সংস্কৃত দ্বারা পরিপুষ্ট।
হামেদী
বাংলা ভাষায় সংস্কৃত বেশ বড়সড় জায়গা জুড়ে আছে। এটা ঠিক আছে। কিন্তু এই সময়ে এসে যখন আরএসএস একটা সর্বভারতীয় প্রকল্প নিয়ে মাঠে আছে, সেখানে আমরা সেই ফাঁদে পা দিব কিনা? বাংলার অভিমুখ কি তাহলে সর্বভারতীয় আবেগের মোহনায়? নাকি বাংলা তার নিজস্ব পূর্ব ভারতীয় ভাব-সম্পদ নিয়ে দাঁড়াবে?
ইমরান
আমাদের অভিমুখ সংস্কৃত ভাষার দিকে না। আমরা বিভিন্ন ভাষার ছন্দ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। সেই আগ্রহের ভিতর সংস্কৃত ছন্দও ছিল। সর্বভারতীয় বলতে বুঝিয়েছি যে, এটা আমাদেরও। আমরা এর আওতার বাইরে নই।
হামেদী
আগ্রহের জায়গা নিয়ে আমার মোটেই আপত্তি নেই। কিন্তু আমার পছন্দ হচ্ছে নির্বাচন। আমি আসলে কী কী নিয়ে কাজ করতে পারি, বা কাজ করা দরকার? একটা ঐতিহাসিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে চিন্তা-ভাবনা করাটাকে জরুরি মনে করি। এমনকী রবীন্দ্রনাথও আক্ষেপ করেছিলেন, বাংলায় কোনো ব্যাকরণ নাই। এমনকী আলাদা নন্দনতত্ত্বও নাই। সেই চিন্তাগুলো আর এগোয়নি তিরিশের ধাক্কায়। এখন হয়তো একটা সময় এসেছে, এই বিষয়ে ভাববার। কী মনে হয় আপনার?
ইমরান
তা তো অবশ্যই। সেগুলি আমাদের ভাবতেই হবে।
হাসান রোবায়েত
সংস্কৃত ভাষা কিন্তু উচ্চারণ নির্ভর, তার আছে দীর্ঘ-হ্রস্ব শ্বাসের ব্যবহার। আছে হলন্ত শব্দের ধ্বনিগত বাধ্যবাধকতা। বিপরীতে বাংলা একদমই সান্দ্র, বাঙালি মায়েদের মতো। নরম, নম্র। সেই ভাষার শরীরে সংস্কৃতের ওই নাক উঁচু আভিজাত্য আর উচ্চারণের যুদ্ধংদেহী ভাবসঞ্চারণ রীতিমত খুনে চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইমরান
দেখো রোবায়েত, সুরে গাওয়া আর ছন্দে লেখা এক জিনিস না। বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্যকে মাথায় রেখেই সংস্কৃত ছন্দটা প্রয়োগ করা হয়েছে।
রোবায়েত
কিন্তু সংস্কৃত ছন্দে লেখা কবিতা আমাকে টানতে পারেনি কেবল তার সুরের ঐ দ্রিম দ্রিম ওঠা-নামার জন্য। মোর মেকানিক্যাল দ্যান মিউজিক।
ইমরান
নেহাৎ তোমার ব্যক্তি-রুচির ব্যাপার।
রণজিৎ দাশের কবিতা পড়লে মনে হয় আইডিয়াই একমাত্র কবিতা। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতায় তাও কিছু আছে, কিন্তু বিশেষ কিছু নাই যা তাদের সমসাময়িক জয় গোস্বামীর কবিতায় আছে।
রোবায়েত
হইতে পারে।
হামেদী
এই জায়গা থেকেই ‘মধ্যযুগ’ নাম দিয়ে যে বাংলাটাকে আসলে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদদের অনন্য প্রচেষ্টায় যে বাংলা পুনরুদ্ধার হয়েছে সেই দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার।
ইমরান
আমার মনে হয় মনোযোগ দেয়া দরকার আছে। আমি আগেও বলেছি এই কথা। সমন্বয়ের কথা আমি বলেছি।
হামেদী
বাংলার আঞ্চলিক শব্দ-ভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ। নতুন কবিতা লেখার ক্ষেত্রে এটা কতটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম?
ইমরান
এটা তো ইতোমধ্যেই ভূমিকা রেখেছে ও রাখছে। আমার নিজের কবিতাতেও আমি আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করি। মধ্যযুগ যাকে বলা হয়, সেখানেও আরবি-ফার্সিসহ প্রচুর বিদেশি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এখনও তার ধারাবাহিকতা বহাল আছে।
হামেদী
‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি, হতাশা, বেদনা, ক্লান্তির সুর অনেক বাজিয়েছে। সমষ্টির সংস্কৃতি কতটা ধরতে পেরেছে আধুনিক বাংলা কবিতা?
ইমরান
তুলনামূলক অনেক কম। আমাদের এই অঞ্চলের র’নার্ভ, যেমন নিবেদন, সমর্পণ, বিসর্জন, বৈরাগ্য, কুরবানী ইত্যাদি তথাকথিত আধুনিক কবিতায় তেমন একটা স্থান পায়নি। আমাদের কাজ করতে হবে এসব নিয়ে। এসব যেমন ব্যক্তির, তেমনি সমষ্টিরও।
হামেদী
ওকে। এবার অন্য একটা প্রসঙ্গে আসি। বাংলা কবিতায় কলকাতার প্রভাব নিয়ে ঢাকায় বেশ আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক আছে। খ্যাতি পাওয়ার জন্য কলকাতার স্বীকৃতি লাগে–এই রকম একটা বক্তব্য চালু আছে ঢাকায়। আপনার কী মনে হয়?
ইমরান
ঠিক। কোলকাতার স্বীকৃতি লাগে। আমাদের এখানে যেসব কবিরা নিজেদের কবিতার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারেননি, তারাই কোলকাতার সার্টিফিকেটের প্রচার-প্রসারের জন্য কাজ করেন, প্রচারণা চালান। তারাই মূলত থার্ড পার্টি হিসেবে সার্টিফিকেট এনে দেয়, নিজেরা নেয়। – দেবে আর নেবে, মেলাবে মেলাবে, কেউ যাবে নাকো ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’। কমে যাবে ধীরে ধীরে আশা করি।
রোবায়েত
ইমরান ভাই, আপনি একবার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী আর রণজিৎ দাস ঊন কবি। ঠিক কী কারণে এমন মনে হলো আপনার?
ইমরান
তুমি তো দেখি সবই মনে রাখো! রণজিৎ দাশের কবিতা পড়লে মনে হয় আইডিয়াই একমাত্র কবিতা। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতায় তাও কিছু আছে, কিন্তু বিশেষ কিছু নাই যা তাদের সমসাময়িক জয় গোস্বামীর কবিতায় আছে।
রোবায়েত
হা হা। বিষয়টা মনে রাখার মতোই আসলে। প্রশ্নটা করার কারণ একজন সমালোচক আপনার আর রণজিৎ দাশের কবিতা পাশাপাশি রেখে একটা সিমিলারিটি দেখিয়েছিলেন। আমি দুইটা কবিতাই তুলে দিচ্ছি। তো সেক্ষেত্রে কী বলবেন আপনি? রণজিৎ দাশের এই স্টাইল কি আপনাকে প্রভাবিত করেছিল?
নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের কথা / রণজিৎ দাশ
আজও মনে পড়ে সেই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের কথা, নদীতীরে বসে তিনি জাল বুনছিলেন। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মাছ ও জলের এই গভীর সংসারে তিনি এত একা কেন, সূর্যাস্তের পর কে তার প্রতীক্ষা করে, হাতে নিয়ে নিভু হ্যারিকেন। আকাশে নিবদ্ধ চোখ, মৃদু হেসে, ছিল তাঁর সংক্ষিপ্ত উত্তর : ‘এখানে আমার কোনো নিকট-আত্মীয় নেই, শুধু এক দূরসম্পর্কের ঈশ্বর আছেন।’
বলিরেখাময় / আল ইমরান সিদ্দিকী
ধরে নিয়েছিলাম, বৃদ্ধ লোকটি তার তামাটে মুখ ও এক নিরাকার ঈশ্বর ছাড়া আজ আর কিছুই ধারণ করে না। তার যৌবন, তার ফুলের মতো অগ্নিকণা, সেই কবে অগ্নিকণার মতো ফুল হয়ে শেষে আজ ছিন্ন পাপড়ি ক্ষীণতোয়া শরীরগাঙে ভেসে আছে। এখন দেখি সে বৃদ্ধ, মাধবীলতার দুলতে থাকা ছায়া নিজের টুপিতে ফ্যালে আর বলে ওঠে, ‘মরহুমার কথা মনে পড়ে’। হয়তো মনে পড়ে নতুন ঘর, দারুনকশা, কারো ভরাট স্তনের ওপর শিশুর কান্না, কান্নার দাগ, দাগে নিজের হাতটি মমতায় বুলিয়ে যাওয়া। আজ সবই তার স্মৃতি; তার আপন মানস জুড়ে শেষহীন ছায়াবাজি।
ইমরান
আমি আমার কবিতার সাথে রণজিৎ দাশের এই কবিতার কোনো মিল খুঁজে পাই না। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের প্রসঙ্গ ছাড়া আর কোনো মিলই না। দুটাই টানা-গদ্যের ঢঙে লেখা। আর কোনো মিল নাই। রণজিৎ দাশের কবিতাটা শেষ বাক্যে এসে একটা চমক দিয়ে শেষ হয়েছে; যে কারণে আমি তাকে ঊন-কবি বলি। সমালোচক নিজেই তো বলেছেন, যতটা গভীরে আমার কবিতা প্রবেশ করেছে, তাঁর কবিতা ততটা গভীর প্রবেশ করতে পারেনি। বৃদ্ধের জীবনের অতটা গভীরে কি তাঁর কবিতা প্রবেশ করেছে? করে নাই।
রোবায়েত
সমালোচক অবশ্য জীবনের গভীরতার কথা না বলে অগ্রজের প্রতি আপনার ঋণ পরিশোধের কথা বলছেন। ‘আমি বলি দুই কথা এগিয়ে ইমরান বৃদ্ধের জীবনের অন্তরে প্রবেশ করেন। অগ্রজের ঋণ শুধে দেন তিনি।’
ইমরান
অবশ্যই আমি ঋণী। রণজিৎ দাশ আমাকে চিনিয়েছেন ফালতু কবিতা কাকে বলে।
রোবায়েত
কিন্তু যারা রণজিৎকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তারা যদি এমনটা ভাবেন যে ওই স্ট্যাটাসটা আসলে রণজিৎ-এর ঘাড়ে পা রেখে তরুণ কবিটি আলোচনায় আসতে চান। সেইটার উত্তরে আপনি কী বলবেন?
ইমরান
ওই স্ট্যাটাস দিয়ে যতটুকু আলোচনায় আসা যায়, তার অধিক আলোচনায় আমি আগে থেকেই ছিলাম। নতুন কিছু না।
রোবায়েত
এই কনফিডেন্স বেশ ভালো ইমরান ভাই। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি।
রোবায়েত
আপনার কবিতা আমার বেশ ভালো লাগে। সেইটা স্বীকার করেই আমার একটা জিজ্ঞাসা ছিল। বাংলা কবিতায় প্রচুর ভালো কবিতার মতো আপনার বেশ ভালো কবিতা আছে। কিন্তু ভাষা এবং টেকনিকের জায়গায় আপনার অধিকাংশ লেখাই আমার বেশ গতানুগতিক মনে হয়। মনে হয়, কবিতার আন্তর্মেকানিজমে আপনি বেশ অর্থোডক্স। কোনো রিস্ক নেন না। অর্থাৎ ভাষা ব্যবহারে আপনার নিজের ভঙ্গি আমি খুব একটা খুঁজে পাই না। এ ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়?
ইমরান
ভাষা বলতে তুমি কী বোঝো আর টেকনিক বলতেই বা কী বোঝো? আমি তো মনে করি আমার নিজের ভাষা আছে, নিজস্ব স্বর আছে। দশজনে ভাষা বলতে যা বোঝে, তা নিয়ে আমি তোমার মতো কুস্তি করি না।
রোবায়েত
কুস্তিই যখন সুর হয়ে ওঠে, কবিতা হয়ে ওঠে, তখন সেটাকে সিগ্নেচার বলা হয়। এমন কুস্তির কথা কিন্তু ঠাকুর সাহেবও জীবনানন্দকে চিঠি লিখে বলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ইতিহাস অন্য কথা বলা শুরু করলো। তো, সেই কুস্তি তো তাহলে বাংলা কবিতার ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছিল। এইটা নিয়ে কী বলবেন?
ইমরান
জীবনানন্দকে উদাহরণ হিসেবে টানলে উত্তর দেয়াটা সহজ হয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে। আমার সিগ্নেচার আমি আমার মতো করে তৈরি করি। সেটা এত তাড়াতাড়ি ভিজিবল হবার কথা না রোবায়েত। সময় নাও, তাড়া নাই।
রোবায়েত
সময় অবশ্যই পাঠকের হাতে।
আচ্ছা, বাংলা কবিতায় আপনার স্কুল মূলত কোনটা? মানে, কোন স্কুলকে আপনি বিলং করেন?
ইমরান
আমি সরাসরি কোনো স্কুল বিলং করি না। অনেক স্কুলের অনেকের দ্বারাই অনুপ্রাণিত।
রোবায়েত
আপনার একটা কবিতা আমার বেশ প্রিয়। প্রাণায়াম রিপ্রাইজ। এইটা লেখার পটভূমিটা একটু বলবেন?
ইমরান
আমি ২০১১ সালে প্রথম এটার খসড়া করি। তখন দশ-বারো লাইন ছিল কবিতাটা। পরে আস্তে আস্তে শেষ করেছি। প্রায় ৩৬ বার এডিট করেছি আমি কবিতাটা। ২০১৫ সালে আমার বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এই কবিতাটা। টিভিতে একটা অ্যাড দেখেছিলাম এয়ার কুলারের। ঠান্ডা বাতাসে ঘরের ভিতরের টবের একটা গাছ ধ্যানের ভঙ্গি নিয়েছে। সেটা দেখে মাথায় এসেছিল কবিতাটা।
রোবায়েত
মানে, এই যে সান্দ্র-শান্ত একটি সুর। ধ্যানের ভঙ্গিমা। এইসব প্রায় পুরোটা বই জুড়েই আছে। মাঝখানে ছন্দের কিছু কিছু কবিতা সেই ধ্যান ভেঙে দেয় টানা পাঠকালে। আপনার কি মনে হয় না এখন যে, ছন্দের কবিতাগুলো না রাখলেই পারতেন! মানে, ছন্দে লেখাগুলো আলাদা বইয়ে থাকতে পারতো কিনা!
ইমরান
অনেকেই এই কথা বলে। অনেকে আবার উল্টো কথাও বলে। আরো বেশি ছন্দের কবিতা থাকলে নাকি ভালো হতো। আমার সব কবিতা আমি প্রিন্ট দিয়ে এক জায়গায় করেছি, যেন কবিতা সংগ্রহ। এখন আর আলাদা আলাদা বই হিসেবে ভাবি না কিছু।
রোবায়েত
আচ্ছা ইমরান ভাই, একটা অন্যরকম প্রশ্ন ছিল। বেশ মজার সেইটা।
ইমরান
করো
রোবায়েত
আপনি-আমি দুইজনই উত্তরবঙ্গের। তো, উত্তরবঙ্গের মাটি-আবহাওয়া-প্রাণ-রস সবই যেন সান্দ্র শীতল। এমন কি উপনিষদের সুরটাও সেই রকমই। অর্থাৎ প্রাচীন ভারত আর আমাদের উত্তরবঙ্গ যেন একই সুরে লীন হয়ে আছে। আপনার কি মনে হয় উত্তরের ঐ সুর-রস আপনার কবিতাকে সান্দ্র করে তুলেছে?
ইমরান
হতে পারে। আমি সান্দ্র-শীতল সুর পছন্দ করি। তবে আমি নিশ্চিত না উত্তরবঙ্গের কারণেই এমন হয়েছে কিনা। যেহেতু ধর-মার-কাটকাট হিজল জোবায়েরও উত্তরবঙ্গেরই।
হুজাইফা
ইমরান ভাইয়ের অনেক অনেক ভালো লাগা কবিতা থেকে কিছু কিছু লাইন আমার মাথায় গেঁথে আছে যেন। যেমন, আমার “শরীর ভর্তি ঠাট্টা” এইটা একটা। এই লাইনটা আমাকে মারাত্মকভাবে কাবু করেছিল। অদ্ভূত কথা। আপনার আরেকটা চিত্রকল্প আছে এমন “রোদে শুকাচ্ছে আষাঢ়ে ভেজা সেতু” এইটাও একদম চোখে লেগে আছে! এইগুলা আসলে ম্যাজিক লাইন, পুরো কবিতাটা এইরকম দুয়েকটা লাইনকে বেইজ করে দাঁড়ায়!
ফারাহ্
ইমরান, কবিতা কী কখনো কখনো অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি?
ইমরান
অবশ্যই। ভাষার ধরতে চাওয়া অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি। তাকেই ধরতে চাওয়া, কিছু যার দেখি আভা, কিছু পাই অনুমানে, কিছু যার বুঝিনা বা…
মধ্যযুগ থেকে শুরু করে গতকাল পর্যন্ত বাংলা কবিতায় উপস্থিত সকল প্রকার কলা-কৈবল্যের পুনর্বিবেচনা প্রত্যাশা করছি; রেজারেকশন দরকার
ফারাহ্ সাঈদ
সাহিত্যে সততা বলতে কী বোঝায়? বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে!
ইমরান
কে কি বোঝে আমি জানি না। আমি তো নিজের উপায়-উপলব্ধির প্রতি সৎ থাকাই বুঝি। প্রকৃতই মানবিক হয়ে ওঠাকে বুঝি আমি। শিল্পের দুনিয়ায় যা সব থেকে নান্দনিক, তাই সব থেকে মানবিক হয়ে ধরা দেয়।
ফারাহ্
“আমি যে পাত্রে আমার ঘুমগুলো জমিয়ে রাখি, তা ক্রমেই বিষপাত্রের রূপ নিচ্ছে।” আপনার লেখা ২০০৮ সালের কবিতার একটি লাইন (সামু ব্লগ)। এতটা সময়ে লেখা অনেকটাই বদলে গেছে হয়তো! কেমন ছিলো আপনার কবিতাভাবনা তখন?
ইমরান
এটা ‘অবিবাহিতের গান’- এরও অনেক আগে লেখা। ২০০৬ সালের দিকে লেখা। তখন অনেকভাবে লিখে দেখার চেষ্টা চলছিল। বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, খুঁজতে চেষ্টা করছিলাম নিজের জায়গাটা। আমি খুব দ্রুতই বিষপাত্র, ঘোড়া, নৃমুণ্ডু- এই ধরনের শব্দ ও তৎসংশ্লিষ্ট ইমেজারি তৈরি করা থেকে বের হয়ে এসেছি।
এইখানে একটা কথা আছে…
ফারাহ্
কথাটা জানতে চাই
ইমরান
এই ধরনের শব্দ একটা গথিক বা রূপকথাধর্মী জগৎ তৈরি করে। যে জগৎটা হয়ে দাঁড়ায় একটা অবলম্বন। আমি কোনো জগৎ অবলম্বন করতে চাই নাই। নিজেই একটা জগৎ তৈরি করতে চেয়েছি। তাছাড়া এই জগৎ অনেক বেশি জমকালো; কেওয়াটিক; এটা অমার চলে না। আমি জগৎ নির্মাণ করার পক্ষপাতী, অবলম্বন নয়।
রোবায়েত
আমাদের হুজাইফার অনেক ঘোড়া আছে, ইমরান ভাই।
ইমরান
আমি জানি সে আস্তাবলের মালিক। যেখানে প্যারাফিন লণ্ঠন নিভে যায়।
হুজাইফা
প্রাণিকূলের মাঝে ঘোড়াকে অনেক স্মার্ট আর আদিম মনে হয় আমার কাছে। অনেক মেটাফরের আধার হয়ে আছে এই একটি প্রাণী! বিশেষ করে আমি যে ধরনের চিত্রকল্প আর মেটাফোর তৈরি করতে পছন্দ করি, সেসবে ঘোড়া আমার ফার্স্ট চয়েজ! হা হা হা
ফারাহ্
ছন্দ ও মাত্রা অনুশীলনে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধকরণে আপনার প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় বটে! প্রায় ছন্দহীন এই পাঠকসমাজের আলোচনা ও সমালোচনার ভীড়ে কতটা সফল হবেন বলে মনে করেন?
ইমরান
আমার মনে হয় ছন্দে বহুরকমের কাজ হয়েছে বর্তমান সময়ে। কাজ করে যাওয়াটাই কথা। ফলাফল পরে দেখা যাবে; দেখার সময় তো এখন না। এই সময়ের কবিরা যে, শ্রম ও নিষ্ঠার সাথে কবিতা লিখতে চেষ্টা করছে, এটা অনেক বড় কিছু। সংস্কৃত ছন্দ নিয়ে এই সময়ের আগে বাংলা কবিতায় এত কাজ হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে দুই-চার জন কাজ করতে চেষ্টা করেছিল মাত্র। আমাদের সবাইকে আরও কাজ করতে হবে। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে গতকাল পর্যন্ত বাংলা কবিতায় উপস্থিত সকল প্রকার কলা-কৈবল্যের পুনর্বিবেচনা প্রত্যাশা করছি; রেজারেকশন দরকার। দ্বিপদী, ত্রিপদী, চৌপদী থেকে শুরু করে গদ্যছন্দ পর্যন্ত সবকিছুর সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো দরকার। সুর-ছন্দের বিপুল বৈচিত্রে সপ্রাণ হয়ে দেখা দিক আবার বাংলা কবিতা…
ফারাহ্
কবিতার সিন্ডিকেট নয় বরং মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলি——পক্ষে কিংবা বিপক্ষে, আপনি আল ইমরান সিদ্দিকী- সৃষ্টিশীল এক কবির কাছে আমাদের জানতে চাওয়া !
ইমরান
হা হা হা হা। এই ’সিন্ডিকেট’ শব্দটার সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। আমি এক সময় সিন্ডিকেটবিরোধী পেজের অ্যাডমিনও ছিলাম। আমার মনে হয় এইসব দলবাজির দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন তো তেমন দাপট দেখি না। যা আছে, আস্তে আস্তে তাও নাই হয়ে যাবে। ব্যক্তিগত শঠতা, অসসতা এগুলি তো থাকবেই। থাকুক।
রোবায়েত
আপনার শেষ জবাবটা বেইজ করে আমার একটা বিষয় জানার ছিল। এই যে সিন্ডিকেট ভাঙার কথা হইলো। এমন কি হয় না যে, একটা সিন্ডিকেট ভাঙার পর অটোমেটিক্যালি আরেকটা প্রতি-সিন্ডিকেট বা এন্টি-সিন্ডিকেট দাঁড়ায়া যায় পূর্বের ঐ পরশুরামদের হাতেই? অর্থাৎ, আবার সেই নতুন সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে বাংলা কবিতা?
ইমরান
দল ভেঙে তো আরেকটা দল তৈরি হয়ই। সমমনা লোকেরা একসাথে থাকতে চেষ্টা করে। এভাবে একাধিক সিন্ডিকেট তৈরি হয়। আবার যারা সিন্ডিকেট দ্বারা আক্রান্ত হয়, তারা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে একত্র হয়; দূর থেকে একেও সিন্ডিকেট মনে হতে পারে। আদতে সেটা সিন্ডিকেট নাও হতে পারে। সমমনা লোকেরা বিভিন্ন পার্পাসে একসাথে থাকে।
রোবায়েত
হ্যাঁ। অ্যাস্থেটিকস বেইজড সিন্ডিকেটকে আমি ভালো মনে করি। একদল আর্টিস্ট যারা প্রায় সমমনা আর্টে বিশ্বাস করে, তারা একসাথে থেকে প্রচারণা চালানো সেটা বরং অনেক হেলদি-ই। নিউ মুভমেন্ট তৈরি হইতে পারে।
হুজাইফা
কথা সেটাই। সিন্ডিকেট সব অর্থে খারাপ না। তবে এর খারাপ দিক আছে। যেটা আপনি বললেন। এইসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই তো ইউরোপ-টিউরোপে বড় বড় শিল্প আান্দোলন গড়ে উঠেছে।
ইমরান
সেটা খুবই জরুরি বিষয়। সমমনা লোকদের একসাথে থেকে নিজেদের মতাদর্শ প্রচার করতে হয়। ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটা যে অ্যারোমা নিয়ে আছে আমাদের দেশে, সেটা সুবিধার নয়। তুমি যেমনটা প্রত্যাশা করছো, তেমন লোকেদের সম্মিলনকে আমি সিন্ডিকেট বলতে নারাজ।
রোবায়েত
আচ্ছা ইমরান ভাই, সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় কোনো সংকট দেখতে পান আপনি?
ইমরান
সংকট সবসময়ই ছিল। সবার হাত ধরে সাহিত্য দাঁড়ায় না। দুই-চার-পাঁচজনই কাজগুলি করে যুগে যুগে। কাজ তো কমবেশি সবাই করতে চেষ্টা করছে, এর মধ্য থেকে দাঁড়াবে আশাকরি কিছু। আমাদের কবিতার ভালো অনুবাদ হয় না, অন্য ভাষার কবি-পাঠকদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছায় না আমাদের কবিতা। আরও সমস্যা আছে। যেমন ধরো অধুনা যারা শুরু করেছে, তাদের পাঠে সমস্যা আছে। আমরা ফেসবুকে কবিতা পড়ি। বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারছি না। পুরাতনকে সঠিকভাবে না জানলে, নতুন কিছু করাটা কঠিন।
রোবায়েত
এসব তো আছেই, তার সাথে আরেকটা বড় ব্যাপার আমি যোগ করতে চাই। ভাষা-মেটাফর-নিজ-জগত। এইসব কিছুর ব্যাপক অনুপস্থিতি বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলা কবিতায়। সবাই শুধু ভালো কবিতা লিখতে চাইছে। যে অর্থে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, উৎপলকুমার বসু, আল মাহমুদ, মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হকের জগত আছে সে অর্থে অন্য কারো জগৎ তেমন টের পাওয়া যায় না। এই ব্যাপারে আপনি কী ভাবেন?
ইমরান
জগৎ তো সবার থাকে না, বড় কবিরই শুধু জগৎ থাকে। আর সেটা একদিনে তৈরি হয়ও না। সেই জগতের অনেকগুলি দরোজা থাকে।
হুজাইফা
আমি কিছু লোককে বলতে শুনেছি, তারা সুর আর ছন্দকে একিভূত করে ফেলেন। অর্থাৎ ছন্দ থাকা মানেই সুর থাকা। আর ছন্দ বহির্ভূত হলে সুর থাকে না। এই ব্যাপারটা আপনি কিভাবে দেখেন?
ইমরান
সুর তো আলাদা কিছু না। সুরের কথা মাথায় রেখেই ভাষার চরিত্র ঘেঁটে ছন্দকে তুলে আনা, তাই না? তবে হ্যাঁ, ছন্দে মাত্রাচ্যুতি ঘটলেই যে সুর-ছন্দ ত্রুটি ঘটে তা কিন্তু না। তোমার প্রশ্নটা আমি বুঝেছি হুজাইফা। গদ্যছন্দও কিন্তু ছন্দ।
রোবায়েত
কিছুদিন আগে আপনার হাতে একাঙ্কিক নাটকের একটা বই দেখা যায়। ঘটনা কী কন তো! কাব্যনাট্য লিখতেছেন নাকি!
ইমরান
ভবিষ্যতে কাব্যনাট্য লেখার ইচ্ছা আছে। ঐ যে বললাম অনেক রকম কাজ করতে হবে। আমি তো আশা নিয়ে আছি, তুমিও লিখবা।
রোবায়েত
ইনশাআল্লাহ! একটা প্ল্যান আছে। আরেকটু শিখি। দোয়া কইরেন।
রুহুল মাহফুজ জয়
ইমরান, আপনি তো ট্যাঙ্গো শিখতেছেন। এইদিকে আগ্রহ জন্মালো কিভাবে?
ইমরান
ট্যাঙ্গো আমার খুব প্রিয়। এতদিন খোঁজ করিও নাই, পাইও নাই। তাই শেখা হয় নাই। বাড়ির কাছেই রাশান কালচারাল সেন্টার, সপ্তাহে কয়েকদিন আমি যাই। শুধু মাথা-মনকে কেন, পুরো শরীরকেই আমি শিল্পে প্রবেশ করিয়েছি। হা হা হা
তিনটা বইয়ের নাম বেছে নেয়াটা একটু কঠিন। আমি একাধিক বইয়ের নাম বলি বরং – তনুমধ্যা, পাখিতীর্থদিনে, লীলাচূর্ণ, সাতশো ট্রেন এক যাত্রী। ইমরান মাঝির বইটার নাম মনে পড়ছে না। ভালো বই। ও হ্যাঁ, বইটার নাম দুধভাই।
জয়
প্রিয় তো অনেককিছুই থাকে। সেই প্রিয়র ভেতরে নিজেরে প্রবেশ করানো একটা ব্যাপার। আমরা কি আপনার নাচের শো দেখতে পাবো।
ইমরান
আমি দাওয়াত করবো যখন হবে। এর মধ্যে ছোট পরিসরে একটা হয়েছে। আমি ভালো পারি না; বেগেইনার তো। দেখতে যত সহজ, আসলে ততটাই কঠিন এইসব নাচ।
জয়
বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে সম্ভবত এই জায়গায় আপনি অদ্বিতীয় (ট্যাঙ্গোর ক্ষেত্রে)। আগে মেয়েরা কবিদের প্রেমে হাবুডুবু খাইতো। এখন ওইরকম দেখা যায় না। এই বিবর্তনের কারণটা কি আপনার মতে, আপনার প্রেমিক জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়াই যদি বলতেন।
ইমরান
কবিদের প্রেমের বাজার একটু খারাপ; কবিরা তো পারফরমার না। একটা সময় মেয়েরা প্রেমের কবিতা পড়তো, তখন বিনোদনের মাধ্যম কম ছিল, কবিতাও ছিল সরল। এখন তো DSLR অলাদের চাহিদা কবির চেয়ে বেশি মেয়েদের কাছে। আমি সুদর্শন, ফলে নিশ্চিত না আমি, আমার প্রেমে কেউ কেন পড়ে।
হ্যাঁ, কবিদের মধ্যে আমিই সম্ভবত একমাত্র ড্যান্সার।
ফয়সাল
সিন্ডিকেট নিয়ে একটা তুমুল বিতর্ক হয়ে গেছে সে সময়ে। এর পরে অনেকের অবজারভেশনে আপনার ও আপনার বন্ধুদের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ চলে এসেছে। আপনি এর আগের রোবায়েতের এই রিলেটেড প্রশ্নের জবাবে বলেছেন যে আপনাদের এই যূথবদ্ধতাকে ‘সিন্ডিকেট’ থেকে আপনারা আলাদাভাবে দেখেন। সেটা কিভাবে?
ইমরান
সিন্ডিকেট সিন্ডিকেটই, সেটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নাই। এরা যে-কোনো একটা বড় পত্রিকার তাবেদরী করে, এরে ওঠাও তারে নামাও এর রাজনীতি করে, ফেক আইডি দিয়ে অন্যকে অপদস্ত করে, নিজেদের বইয়ের রিভিউ অন্যকে দিয়ে লেখায়, না লিখলে ফেক আইডি দিয়ে শায়েস্তা করে। এদের সাথেই তো আমাদের তুমুল বিরোধ ছিল। আমি এদের ছায়াও মাড়াই না আর। আমি সমমনা লোকদের সাথে মিশেছি। যেমন, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, জুয়েল মাজহার, সৈয়দ তারিক, শহীদুল রিপন, হিজল জোবায়ের, আবুল বাশার চঞ্চল, ডাল্টন সৌভাত হীরা প্রমুখ। এবার আপনি বলেন, এর বাইরে কারা আমার বন্ধু? কোথায় এখানে সিন্ডিকেট। হ্যাঁ, অভিযোগ তারাই করতে পারে, যাদের সাথে বিরোধ ছিল ও আছে।
জয়
নাকি কবিদের চলনে-বলনে আরো স্মার্ট হতে হবে?
ইমরান
কবিরা তো স্মার্টই। শুধু প্রেম করার জন্য আরও স্মার্ট হবার দরকার নাই। আরও স্মার্ট হবার সুযোগ থাকলে কবি হিসেবেই হওয়া দরকার। এই যুগের প্রেম অনেক বেশি এনগেজ করে রাখে। কবিদের জন্য মুশকিলের বিষয়।
জয়
এবার একটু কবিতার দিকে আসি। কবিতায় গল্প বলা, গল্পের ন্যারেশন ব্যাপারটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ইমরান
অনেক কিছুই কবিতার মতো কিন্তু কবিতা না, যেমন একটা ছবি বা একটা গল্প। কবিতায় গল্প থাকতে পারে কিন্তু কবিতায় আর যা যা থাকে সেটাও থাকা দরকার। সুর-ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্প ইত্যাদি। যেহেতু আমরা স্পষ্ট করে বলতে পারি না, কেন একটা লেখা কবিতা হয়ে ওঠে, ফলে এভাবেই বলতে হচ্ছে। মেঘনাদবধ কাব্যও তো কাহিনী। এদিকে রবীন্দ্রনাথে একটা কবিতার বই আছে, যেটার নামই ‘কাহিনী’। অসাধারণ সব কবিতা।
জয়
দশক যেহেতু হিসাব করাই হয়, এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন দশক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন সেটা মনে হয়?
ইমরান
আমি তিনটা দশককে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। পঞ্চাশ, ষাট ও আশি। পঞ্চাশের কবিরা বাংলাদেশের কবিতার স্বতন্ত্র একটা জায়গা তৈরি করেছে। শুধু শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের কারণেও এই দশক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অসমান্য দুই কবি। ষাট গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চাশের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে। ষাট সবথেকে বেশি বৈচিত্রময়। আর আশি তো উপরিতলসর্বস্ব, অতি ন্যারেটিভ, উচ্চকিত, ডায়লুডেট কবিতার জয়জয়কার থেকে বাংলাদেশের কবিতাকে রক্ষা করেছে। তাদের এই বাঁকবদল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জয়
আশি, নব্বই আর প্রথম দশকের সেরা তিনটা কবিতার বইয়ের নাম নিতে বললে কোন তিনটাকে বেছে নেবেন?
ইমরান
তিনটা বইয়ের নাম বেছে নেয়াটা একটু কঠিন। আমি একাধিক বইয়ের নাম বলি বরং – তনুমধ্যা, পাখিতীর্থদিনে, লীলাচূর্ণ, সাতশো ট্রেন এক যাত্রী। ইমরান মাঝির বইটার নাম মনে পড়ছে না। ভালো বই। ও হ্যাঁ, বইটার নাম দুধভাই।
জয়
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ইমরান। আড্ডা দিয়ে আনন্দ পেয়েছেন নিশ্চয়?
ইমরান
আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আমিও আনন্দ পেয়েছি।