উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে, মাত্র বিশ বছর পর ১৮৫৯ সালে নিজেরই লেখা ‘আ টেইল অব টু সিটিস’ এর মদের পিপার দৃশ্যটিতে ডিকেন্স যে সুক্ষ পর্যবেক্ষণ শক্তি দেখিয়েছেন, তা তার লেখনীর অন্য একটি কৌশলে পরিণত হয়েছে। তার এই কৌশলটি চমকপ্রদ, কিন্তু অলঙ্কারবহুল। বিশদ বর্ণনার গঠন প্রকৃতি অদ্ভুত ধরনের, যা পাঠকের চোখের চাইতে মনে বেশি ছাপ ফেলে যায়।
“মদের একটি বড় পিপা আছড়ে পড়ে ভেঙ্গে গেছে…দোকানের সামনের পাথুরে পথের ওপর বাদামের একটা খোসার মত সেটা পড়ে আছে।
দোকানের আশেপাশে যারা কর্মব্যস্ত ছিল বা অলসভাবে ঘোরাঘুরি করছিল, তারা সবাই মুহূর্তের মধ্যে বিনে পয়সায় মদ গেলার জন্য হুড়োহুড়ি করে ছুটে এলো। দোকানের সামনের পথটা তৈরির সময় অমসৃণ পাথরগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে, দেখে মনে হয় রাস্তাটি বানানোর উদ্দেশ্যেই হলো পথচারীর পা ভেঙ্গে খোড়া করে দেয়া। এই মুহূর্তে ঐ এবড়ো-থেবড়ো পাথরের টুকরোগুলোই ছোট ছোট গর্তের ভেতর মদ আটকে রেখেছে। দেখতে দেখতে প্রতিটি গর্তের সামনেই মানুষের ছোট-বড় জটলা বেধে গেল। তাদের কেউ কেউ হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাতে আজলা ভরে মদ উঠিয়ে গলায় ঢালছে। কেউ কেউ আবার তাদের কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়া মহিলাদের সাহায্য করছে যাতে তারা হাতের আঙ্গুল গলে মদ পড়ে যাবার আগেই গলায় ঢালতে পারে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে বাদবাকি সবাই মগ বা হাতের কাছে পাওয়া ছোট ভাঙ্গাচোড়া তোবড়ানো পাত্র গর্তে ডুবিয়ে মদ নিচ্ছে। এমনকী মহিলারা মাথার স্কার্ফ খুলে মদে ভিজিয়ে শিশুদের মুখে নিংড়ে দিচ্ছে এমন ঘটনাও ঘটছে……”
উপরের অংশটুকুতে ভাঙ্গা বাদামের খোসা আর ভাঙ্গাচোড়া তোবড়ানো মগ-এর বর্ণনায় তরুণ বয়সী ডিকেন্স যে পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র তুলে ধরে ঘটনার বর্ণনা দিতেন, তার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়া অন্যসব বর্ণনা পাঠকের সামনে সত্তর বছর আগের বিপ্লবী প্যারিসের বর্ণনাচিত্র ফুটিয়ে তোলার চাইতে বরং রাজনৈতিক কার্টুনের প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
মূলত সকল শাখার আবিষ্কার মিলেমিশেই সাহিত্য গড়ে ওঠে। আর বুৎপত্তিগতভাবেই সাহিত্য হয়ে ওঠে চিত্তাকর্ষক এবং বিচক্ষণ। সাহিত্য পাঠককে আনন্দ দিতে পারে। আবার সাহিত্যের এক একটি শাখার উৎকর্ষতার নিজস্ব মৌসুমও থাকে যা সময়ভেদে দীর্ঘ বা হ্রস্ব হতে পারে। তবে সাহিত্যে যতোই নতুন নতুন কাঠামো তৈরি হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত শুরুর কাঠামো উদ্ভাবকদের কাছেই আমাদের বারবার ফিরে যেতে হবে। চিরকালই সাহিত্যের শেষ কথা হলো ভালো মানের লেখা। কখনো কখনো পরীক্ষামূলক কাঠামো ব্যবহার করে আশ্চর্যজনক ফলাফল পাওয়া যায়। ‘দি ইম্পরট্যান্স অব বিইং আরনেস্ট‘ অথবা ‘ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল’ এর বেলায় এমনটিই ঘটেছে। তথাপি ভালো লেখা হলো সেটাই যার কাঠামো এবং উপাদান দুই-ই নতুন স্বাদের। ভালো কিছু সৃষ্টি করতে গেলে লেখার কাঠামো কেমন হওয়া উচিত তা লেখককে ভুলে যেতে হবে। কল্পনার ডানায় ভর করেই আমাদের নতুন আশাতীত কিছু তৈরি করতে হবে। এবং অবশ্যই লেখালেখির এইসব কলাকৌশল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখা অসম্ভব একটা ব্যাপার।
সকল চলমান শিল্পের মতোই সাহিত্য চির পরিবর্তনশীল। সাহিত্য তৈরির মূল কৌশলও সদা পরিবর্তনশীল এবং এই পরিবর্তনের ধারা সাহিত্যের অপরিহার্য অংশ। শেক্সপীয়ারের নাটক, মহাকাব্য, রেস্টোরেশন যুগের হাসির নাটক, রচনা অথবা ইতহাস ভিত্তিক সাহিত্য- এগুলোর কোনটাই লেখকদের চিরকাল একই গতিতে অনুপ্রাণিত করতে পারে না। মানুষের সৃষ্টিশীল মেধা যেমন সৃষ্টি করতে করতে ক্ষয় হয় তেমনি সাহিত্যের সকল শাখাই এগিয়ে যেতে যেতে একসময় সাধ্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায়।
উপন্যাসের নতুন ধারা উনিশ শতকের ইউরোপকে নতুন ধরনের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বার্তা পেতে পেতে পাঠকের মনে এই বিবমিষা সৃষ্টি হয় যে তারা সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছে। ঐ সময়ের উপন্যাস রোমান সাম্রাজ্যকালীন সময়ের মত পুনরায় উপজাতীয় বা আঞ্চলিক জাগরণের ধরায় ফিরে যাচ্ছিলো। ফলে তখন ভিন্ন ধরনের ব্যাখার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তারপরও বাহ্যিক দৃষ্টিতে যাই মনে হোক না কেনো উপন্যাস এখনো উনিশ শতকের কাঠামো উদ্ভাবকদের লেখার ধারাকেই অনুকরণ করে চলেছে। এখনো তা তার সেই উদ্ভাবক লেখকদের পুরোনো স্বপ্নকেই রসদ যুগিয়ে চলেছে যা কীনা সামঞ্জন্যহীন নতুন বাস্তবতাকে বিকৃত করে ফেলতে পারে।
কাঠামোগত দিক থেকে বিচার করলে উপন্যাস এখন বহুল পরিচিত একটি মাধ্যম। তবে উপন্যাস লেখার পদ্ধতি শেখানোর পরিসর খুব কম। উপন্যাস এখন বিভিন্ন মাত্রায় কখনো কাছ থেকে বা সরাসরি আবার কখনো দূর থেকে নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেমের জন্ম দেয়। এই আত্মপ্রেম বাস্তবতার পরিপূরক হিসেবে উপন্যাসের কাঠামোকে দাঁড় করায় যা জীবনের প্রতিরূপ সৃষ্টি করে ভ্রান্তির জন্ম দেয়। জীবনকে এই রূপে তুলে ধরায়, বর্তমানের বাণিজ্য সর্বস্ব ভ্রান্ত পৃথিবীর একটি দাম্ভিক ধারনা হলো যে সাহিত্যের সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ হলো উপন্যাস।
এই পর্যায়ে এসে আমাকে আবার শুরুর কথায় ফিরে আসতে হচ্ছে। ঘটনাবহুল উনিশ শতকের সামান্য ঔপনিবেশিক পরিবর্তনের কারণেই হয়তো কোন শিক্ষক বা বন্ধু দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই আমার বাবা ১৯২০ সালের শেষের দিকে লেখালেখি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যেমনটা তার ইচ্ছা ছিল তেমন না পারলেও কিছুটা লেখালেখি তিনি করতে পেরেছিলেন। তার লেখার হাত ভালোই ছিলো। তার গল্পগুলি ভারতীয়দের এমন এক অতীতকে তুলে ধরেছে যা প্রায় বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছিলো। জগতের ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে পাওয়া বাবার লেখক মনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর আমাদের সাহিত্যিক পরিমণ্ডলের মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক। ঔপনিবেশিক পরিমণ্ডলে আমাদের গোষ্ঠীর কাছে কোন চলমান সাহিত্যের ঐতিহ্য ছিল না। আর তাই সেই সামাজিক সীমানার ভেতর বাবার কষ্টপ্রসূত গল্পগুলোর পাঠকও ছিল হাতে গোনা।
বাবা তার নিজের ভেতরের লেখক হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার ভেতরে সৃষ্টি করেছেন। আর অন্য একটি সময়ে বেড়ে ওঠার সুবাদে আমিও সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রায় পরিপূর্ণ করতে পেরেছি। কিন্তু এখনও আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে জটিল অর্থবহ বইগুলো পড়া আমার জন্য কতোটা কঠিন ছিল। দুটি ভিন্ন জগতের অজানা অন্ধকার তখন আমার জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমার সমগ্র কল্পনার জগত ঘিরে ছিল চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের সবকিছুই অবশ্য অন্য এক দূরের জগত থেকে আসা কিন্তু সেই কৌতুহল জাগানো জগতের সবকিছুতে সহজে প্রবেশ করা যেতো। সেই জগতটা সত্যিকার অর্থেই এক বৈশ্বিক শিল্পের সৃষ্টি করেছিল। এ কথা অবশ্যই অতিরঞ্জিত নয় যে ১৯৩০ আর ১৯৪০ এর দশকের হলিউডি চলচ্চিত্র ছাড়া আমার আধ্যাত্মিক মনোজগতের কোন বিকাশই ঘটতো না। আমার পড়া আর লেখার কাহিনী বলতে গেলে চলচ্চিত্রের এই অবদানটুকু অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে বিংশ শতকে এসে কাল্পনিক সাহিত্যের মাধ্যমে সামাজিক প্রেক্ষাপট উপস্থাপনের ক্ষমতা বা মেধাটুকু উপন্যাস থেকে স্থানান্তরিত হয়ে চলচ্চিত্রে স্থান করে নিয়েছিল। বিংশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছরের চলচ্চিত্রের স্বর্ণালী যুগ আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। (শেষ)