পাণ্ডুলিপি থেকে : নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে | অস্ট্রিক ঋষি

অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৫ এ পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে কবি অস্ট্রিক ঋষি-র ‘নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে’। প্রকাশ করেছে কিংবদন্তী পাবলিকেশন। চার ফর্মার বইটির মুদ্রিত মূল্য : ৩৩৩৳ (২৫% ছাড়ে ২৫০৳)। পাওয়া যাবে কিংবদন্তী স্টলে : ৭৫-৭৭ (ঢাকা বইমেলা) এবং ৩০-৩১ (চট্টগ্রাম বইমেলা)। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শামীম আরেফিন।

 

অর্থময়তা

চিঠিতে আমি কিছু লিখিনি। সাদা একটা পাতা, খামে ভরতে দেখে তোমরা হো হো ক’রে হেসেছিলে। অথচ আমি জানি—মা যখন চিঠিটা পাবে তখন অঝোরে কাঁদবে, কাগজে আমার স্পর্শ আছে ভেবে। তুমি যা কিছু পাগলামি ভাবছো, ভাবছো—হাস্যকর, এর কোনো মানেই হয় না; কারো কারো কাছে তা-ই পরম পাওয়া, সবচেয়ে বেশি অর্থবহ। তুমি ভাবছো—অমাবস্যা, কী গভীর অন্ধকার! অথচ সূদুর সান্তিয়াগোতে খোলা মাঠের উপর ব’সে একজন বিমুগ্ধ তাকিয়ে দেখছে পঞ্চদশী চাঁদ। ভাবছে, এতো আলো! সুতরাং চিঠিতে কিছু লিখতেই হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। এবং তুমি যদি ভেবে থাকো—কিছুই তো হয়নি, এসবও কি অর্থময়? তবে শোনো, হোক বা না হোক, অনেকের হয় না ব’লেই কারো কারো হয়—

 

নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে

কখনো শীৎকারের শব্দ শোনেনি যে বধির, তার
তৃপ্ত সঙ্গিনীর
             একান্ত উচ্চারণের
                              বেদনার মতো করুণ কিন্তু
উজ্জ্বল একটা আলো কেঁপে কেঁপে উঠছে
যেন বিশেষ মুহূর্তের কম্পনরতা তলপেট
                                     কোনো রমনীর—
আজ
এই মুক ও বিষণ্ণ গভীর মেঘনায়
                               বৈঠার অবুঝ আঘাতে
ছিন্নভিন্ন চাঁদের মতোই একা ও অস্থির আমি
                    ফুটে উঠেও ফেটে পড়ছি জলে।

তবু মেঘ কত কথা বলে। মিথ্যা অনেকরকম।
আকাশে ফানুশ ওড়ে। কমলা-হলুদ কিছু তারা।

আমার মন—
প্রথম সঙ্গমরত ভয়ার্ত কিশোরীর
                      উদ্বেগজনকভাবে আনন্দিত কিন্তু
যন্ত্রণায় দিশেহারা একটা অস্ফুট শরীরের—অকস্মাৎ
প্রস্ফুটিত হবার ঘটনা চুরি ক’রে দেখে ফেলবার মুহূর্তের
                                           ছেলে শিশুর
না ফোটা শিশ্নের অগ্রভাগে চর্মের স্ফিত হবার উত্তেজনায়
বিক্ষিপ্ত হতে চেয়েও
বাঁধা পেয়ে ফুলে উঠবার ব্যথার মতো করুণ
                                               ও টনটনে।

কিন্তু কে কার কথা শোনে? ফুলেরা পচনশীল।
ধরা যাক সকলের মন আজ নদীতে ভাসমান।

এবং সাগরের পরিবর্তে
ধরা যাক নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে।

 

মাথার উপর একটা চাঁদ

মাথার উপর একটা চাঁদ
খুব হর্নি
আলোর অর্গাজম ঘটিয়ে যাচ্ছে;
নিজেকে মনে হচ্ছে—পৃথিবীর জিভ

এই মুহুর্তে—
খটখট ক’রে ছুটে গেলো ট্রেন; মাথার ভিতর তার বিভিন্ন স্টেশন।
দুটো আত্মহত্যাপ্রবণ পাখি
একটা বোঁটাভাঙা গোলাপ
ডাঙায় তড়পানো কিছু কৈ
এইসব আমার স্মৃতি, ভুলে গেছি;
যা-কিছু ভুলে গেছি তার সবই আমি মনে করতে পারি।
যেমন: তুমি; তোমার নামটাও ভুলে গেছি, ঋমু।

এই মুহূর্তে—
মাথার উপর নির্লজ্জ উলঙ্গিনী একটা চাঁদ,
কিছু অন্তর্বাসপ্রবণ মেঘ—উড়ে উড়ে যাচ্ছে,
নর্তকীর উদ্দেশ্য ছুঁড়ে দেয়া সোনালী মুদ্রার মতো চকচকে অসংখ্য তারা
এবং গোঙরাতে গোঙরাতে
কয়েকটি যুদ্ধবিমান ঢুকে গেলো শীৎকারের মতো।

তখন মাথার উপর একটা চাঁদ
খুব হর্নি
আলোর অর্গাজম ঘটিয়ে যাচ্ছে;
দূর থেকে ভেসে এলো বোমব্লাস্টের বিভৎস রতিচিৎকার।

 

হ্যালুসিনেশন

হাঁসের সাঁতার হয়ে বায়ু বয়
ধীরে রাত হয়ে আসে ফর্সা
কবিরা গোনাহ’র মতো বড়ো এক
বিধেছে মাগুর মাছ বর্শায়

গরুর চোখের মতো নিষ্পাপ
ও মায়াবি ভোর নামে নিখিলে
মাছ খেয়ে ফিরে গেছে পেত্নী
ব’সে আছি রোশনির মিছিলে

দুই মণ ঘুম নামে দু-চোখে
হ্যালুসিনেশনে ও কে হাসছে?
সাথীহারা সারসের নিঃস্ব
হৃদয়ের মতো ডোঙা ভাসছে

ভেসে ওঠে দেবতার কালো কেশ
মেঘেরা কতল করে সূর্য
ছিলিমে আগুন জ্বেলে কুঁড়ো দিই
এই কোপে কেটে যাবে দূর্ভোগ

খোয়ানো বউয়ের মিছে উছিলায়
কিভাবে ফসকে গেলো কাতলা!
কচুরিপানার ফুল দুলতেই
হেসে ওঠে রাশি রাশি শাপলা

 

আফসোস

আত্মহত্যা করবার বাসনায়—
পেতে রাখা জাল খুঁজছে যে কুচো-মাছ
                             ক্ষুদ্রতার অভিশাপে;
এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে
ঘুরে ঘুরে দেখছে শুধু—বড় বড় মাছগুলো
অনায়াসে ধরা পড়ছে জালে,
ঘুরে ঘুরে দেখছে শুধু—বড় বড় মাছগুলো
টোঁপ গিলে উঠে যাচ্ছে আরেক জগতে,

‘বঁড়শিতে বিঁধবার মতো এতটুকু মুখও তার নেই!’

এই বেদনায়, ক্ষুদ্রতার এমন গ্লানিতে
আরও বেশি আত্মহত্যা করতে যার ইচ্ছে হচ্ছে
                                              তার মতো,
তেমন ছোট্ট এক সামান্য মাছের মতো
অত বড়, অত বেশি, বিশাল আফসোস
নিজের ভিতর কেন নাই… এই বেদনায়,
                               তুমুল আফসোসে—
আরও একটা কাতলা মাছ ধরা পড়লো জালে।

 

সম্প্রীতি

গুলিস্তান গিয়ে দেখি—

জাতীয় মসজিদের পাশেই
                       জাতীয় স্টেডিয়াম

রাস্তার উল্টোপাশে সারি সারি
                        বন্দুকের দোকান

বন্দুকের দোকানের গা ঘেঁষেই
                    গ্রন্থ-ভবন

এবং
গ্রন্থ-ভবন ও সচিবালয়ের মাঝখানে
               রাস্তা যেইখানে
দুইপা ফাঁক ক’রে
আলাদা হয়ে গেছে,
         সেইখানেই…

উদ্দীপিত শিশ্নের মতো খাড়া হয়ে আছে
                        গোলাপ শাহ’র মাজার।

 

ডিম ফাটার মুহূর্ত

ফাটবে ফাটবে ক’রেও ফাটতে না পারার যন্ত্রণায়
ভিতরে ভিতরে লাল হয়ে ওঠে যে ডালিম
তার বেদনার্ত বোঁটায়
                   সে চায়—
                   একটা পাখি এসে বসুক,
যার সঞ্চিত ডানার ঝাপটায় বিপদখচিত কালবৈশাখী;
একটামাত্র আচমকা ঠোকরের বাসনায়, সে
গোপনে গোপনে
             গ’ড়ে তোলে রক্তিম শাঁস, তার
কেঁপে উঠার করুণ আকুতি যখন সংক্রমিত হয়
                                         সমীরে সমীরে…

তখন

খড়কুটো, নাড়া আর ফেঁসোর ভিতরে
                       ধীরে ধীরে ফাটতে থাকে ডিম।

 

টিফিন পিরিওড

তোমার ভিতর সূর্য উঠে তোমার ভিতর ডোবে
এমন কথা লিখেছিলাম সূর্য হওয়ার লোভে

সূর্য হওয়ার লোভে গেলাম আগুন দিতে গায়
শ্মশানঘাটে গিয়ে দেখি হাড়ই শোভা পায়

এমন সে হাড় নেয় না শেয়াল, নেয় না কুকুর মুখে
বৃষ্টি এলো, ছাই ভিজে যায় শ্মশানঘাটের বুকে

বুকের ভিতর হঠাৎ তখন অনল ওঠে জ্ব’লে
সঙ্গমে নয়, কিছু শাড়ি মৃত্যু হেতুও খোলে

খুলবো ব’লেই পরো তুমি, মুছবো ব’লেই সাজো
অঙ্গ-তারে রাখলে আঙুল বীণার সুরে বাজো

বাজলো কোথাও ঘন্টা বোধয় টিফিন পিরিওডে
মরুর বুকে পিঁপড়া ছোটে দুপুরবেলার রোদে

রোদ হবো না ছায়া হবো, কার ছোঁয়াটা গাঢ়?
তুমি বললে, মানুষ হয়েই মানুষ ছুঁতে পারো।

 

একটি ফুলের আবেদনপত্র

পাখি না হতে পারার যন্ত্রণায় রঙিন হয়ে উঠেছে যে ফুল
গন্ধ মূলত তার ব্যথা।

সুবাস নিতে গিয়ে, অসাবধানেই—তুমি
শুষে নিচ্ছ ব্যর্থ ডানার চিৎকার।
আমাকে যে এতো সুগন্ধি ফুলের নামে ডাকো,
খুলে খুলে শুকে যাও
                              পাপড়ি ও কেশরের প্রচ্ছন্ন ঘ্রাণ;
ওগো প্রজাপতি,
ডানা যদি খ’সে যায়,—শুঁয়োপোকা জীবনের ক্রোধে
তবে কি বোঁটায় ব’সে ছিঁড়ে দেবে ফুলের বাসনা?

ফুলকে ফলের কাছে যেতে দাও,
আহারের ছলনায় লুফে নিতে দাও তাকে পাখির জীবন।

 

বিভিন্ন আকাশ

ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্ককে রিফু করানোর জন্য গিয়েছিলাম দর্জির কাছে। সে জানালো—আজকাল জোড়া লাগাতে কেউ আসে না; আসে ছিঁড়িয়ে নিতে। জানালো—ছিঁড়ে যাওয়াই আধুনিকতা। আবিশ্বাসের মাথায় কিছু বরফকুচি ছিটাতে ছিটাতে আমি ফিরে এলাম। ফিরে এলাম—ছেঁড়া সম্পর্ককে সদ্যোজাত শিশুর মতো বুকে জড়িয়ে। ফিরতে ফিরতে সহসাই আমার চোখ পড়লো—আত্মদর্পনের উপন্যাসে; যার পাতায় পাতায় ছিঁড়ে যাওয়া নাড়ি থেকে মানবজন্মের আধুনিকতা।

তারপর—আমাদের সম্পর্কগুলো বিহঙ্গের মতো উড়ে গেলো যার যার ব্যক্তিগত বিভিন্ন আকাশে।

 

গ্রাম

এক দেশে এক নদী আছে, নদীর পাশে মাঠ
মাঠ ঘেঁষে এক রাস্তা, সেথাই পুলের পরে হাট
হাট পেরুলেই জোড়াপুকুর, বাবলা গাছের সারি
আম্রকানন ডাইনে রেখে বামপাশে সুপারি
পথের পেটে বাঁশ নোয়ানো, পাতার ফাঁকে পুকুর
মোড়টা হঠাৎ ঘুরতে গেলেই শাসানি দেয় কুকুর
থমকে যেতেই নাক খুঁজে নেয় পাঁচফোড়নের গন্ধ
একটি বাড়ির সদর-কপাট ভিতর থেকে বন্ধ
বাড়ির পরে আবার বাড়ি, জাম জারুলের ফাঁকে
একটি পাখি উড়াল দিলে একশো পাখি ডাকে
একশো বাড়ি পাশ কাটাতেই গোরস্তানের ঘাস
জংলা ফুলে দোল খেয়ে যায় সহস্র নিঃশ্বাস
আরেকটি মাঠ পড়লে চোখে ছাড়াচ্ছো এক গ্রাম
সেই গ্রামে এক নদী আছে, পাখির নামে নাম


অস্ট্রিক ঋষি
কবি

প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে; সতীতালয়।

শেয়ার