আমাদের স্ক্রিনময়ী জীবন অনর্গল ডিজি-ছবির বন্যায় চিন্ময়। এই নেটেড দর্শনের গ্লোবাল রাজত্ব শুধু আমাদের অবসরকেই শাসন করে না, কোন ছবির ঝাঁক কিভাবে ইন্টারনেট আর স্ক্রিন বেয়ে আমাদের চোখ ধাঁধায় আর মন মাতায়, তা দিয়ে গড়ে ওঠে আমাদের রোজওয়ারি গণদর্শন আর রাজনীতি। ভিসুয়ালের সেই সাইবারশাহীর নানা ঝাঁকিদর্শন নিয়েই এই কলামের নানান কিস্তি।
স্যাটেলাইট থেকে নেমে আসে রোজ গাত্রে : অ্যাপ-টাইমের ভেল্কির তেল
“তাড়া – অনিকেত জীবনের গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল” সেই কবেই লিখে গেছেন সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ।
সেই তাড়ার আলোয় পথ দেখা দীনদৈনিকে যখন আমরা স্মার্টফোনঅ্যাপে ডাকিয়ে আনি ডিনার, বা ট্যাক্সি বা কাঁচাপাকাবাজার – আমাদের প্রতীক্ষারত চোখকে অপেক্ষারত রাখে ‘আর-কত-মিনিট-বাকি”-র কাউন্টডাউন। কিন্তু দেখতে দেখতে, হঠাৎ দেখি আরে, এক সেকেন্ডেই চার মিনিট নেমে আসে এক মিনিটে, বা আট মিনিট এক লহমায় হয়ে যায় পনেরো আর পরের চোদ্দ মিনিট ধরে তাতেই আটকে থাকে। তখন আমরা বুঝে ফেলি এই মিনিট নহে নহে ক্লকমিনিট। ঘড়ির কাঁটাধরা সময় যতই মেকি হোক না কেন (ষাট-ষাট-ষাটের হিসেব অন্য কিছুও হ’তে পারত) তার অন্তত এটুকু সহবত থাকে যে, সে সব ঘড়িতে এক মিনিটেই সে এক মিনিট হয়ে থাকে।
![]()
চিত্র ১ ক, ১ খ: অ্যাপ-টাইমের প্রমিসকাস প্রমিস
এই সময় গড় সময়। যে সে গড় নয় – গড় করার মত মহাজাগতিক, অ্যালগোরিদমিক গড়। রাঁধিয়ের গড় রন্ধনবেগ, প্যাকেট-বাঁধিয়ের গড় বন্ধনবেগ, চালকের গড় গতি, গড় ট্রাফিক ঘনত্ব, পথের নানা আসলেও-আসতে-পারে-দেরির গড় সম্ভাব্যতা ইত্যাদি-প্রভৃতি জুড়ে বানানো এক আনুপাতিক উৎকন্ঠা। তা স্যাটেলাইট ডাটাধারা আর ইন্টারনেটপ্রবাহের একূল-ওকূল ধরে আপনার চোখের চামড়ার ভাঁজ মূহুর্মূহু বদলাতে থাকে। স্যাটেলাইট থেকে তা নেমে আসে আম-গাত্রে।
এই সময় অবিশ্বস্ত, এক্সট্রা মেকি, অ্যালগোরিদমিক কিন্তু খুব অভিনব? স্মার্টফোনের অনেক আগের মেশিন যেমন ডেস্কটপ বা ওয়াশিং মেশিনের কোন কাজ সমাধা করতে কত সময় লাগবে তার সম্বন্ধে আমরা কেউ কেউ পরিচিত।
![]()
চিত্র ২ক, ২খ: মেশিন-টাইমের মিথিক মিথ্যাচার
কিন্তু মেশিন-টাইমের এই মিথ্যাচারের সাথে অ্যাপ-টাইমের মিথ্যাচারের তফাত কি? মূলতঃ দুটি। অ্যাপ-টাইম লাইভ, ব্যাপ্ত এবং দৈহিক। কম্পিউটার ও ওয়াশিং মেশিনের মেশিন-টাইমের মত তা একটি মেশিনে আবদ্ধ না। স্যাটেলাইট ডেটার সাথে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত হ’য়ে যে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে আমাদের সময়ের সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে তা শুধু মানসিক নয়, দৈহিকও।
জার্মান দার্শনিক মার্টিন হেইডেগার (1889-1976)আমাদের সময়বোধ, স্ব-বোধ ও টেকনোলজির সম্পর্ক নিয়ে কিছু কিছু গভীর ভাবনা বিস্তারে ভেবেছিলেন যা আমাদের অ্যাপযুগে পুরনো চালের মতই ভাতে বাড়ছে। ক্রমান্বয়ে “অবশিষ্ট” অতীত আর “অপেক্ষিত” ভবিষ্যৎ তাদের মিলনসঙ্ঘাতে ‘বর্তমান’ উৎপাদন করে চলে । আর এই বর্তমান-উৎপাদন প্রক্রিয়া স্ব-বোধ এর উৎপাদন-প্রক্রিয়া বা ‘হতে থাকা’-র সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে মানে পিছমোড়া করে বাঁধা। এই বর্তমান-বোধের সাথে স্ব-বোধের বাঁধনের পাঁচটি বাঁধনের সবচেয়ে মামুলি ধরণ হ’ল ‘নাউ-টাইম’ বা ‘এখন-পল’। এই ধরনের বর্তমান- উৎপাদন প্রক্রিয়া ঘেঁটে ঘ-আকারের হ’তে থাকে অ্যাপ-টাইম টেকনোলজির ভেল্কির তেল প্রয়োগে।
![]()
চিত্র ৩: ঘেঁটে ঘ-আকারের
হাইডেগার এই অ্যাপ-টাইম টেকনোলজির বহু আগেই টেকনোলজির তত্ত্বায়ন করেছিলেন মানুষের বশ যন্ত্র হিসাবে নয় বরং মানুষের হয়ে ওঠার এক ক্ষেত্র হিসাবে যা রিয়ালিটি বা বাস্তবতাকে রসদ হিসাবে ব্যবহার করে। অ্যাপ-টাইম টেকনলজি সেই রিয়ালিটির এক গোড়াঘাটের উপাদান ‘সময়’ বা আমাদের সময়ের বোধকে রসদ হিসাবে ব্যবহার করে।
গবেষণামতে, সময় বোঝার জন্য, আমাদের মস্তিষ্ক অভ্যন্তরীণ ঘড়ির উপর নির্ভর করে যা বিভিন্ন হারে টিক টিক করে এবং আমরা কীভাবে আমাদের দেহ নাড়িচাড়ি, আমাদের চারপাশের দৃশ্য এবং শব্দ অনুভব করি এবং আমাদের স্মৃতিচারণ করি তা পর্যবেক্ষণ করে। প্রতিটি ঘড়িতে একটি পেসমেকার থাকে যা স্পন্দন তৈরি করে এবং আমাদের মস্তিষ্ক একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কতগুলি স্পন্দন ঘটে তা গণনা করে এবং সংরক্ষণ করে। যখন স্পন্দনের সংখ্যা সঠিক পরিমাণে পৌঁছায়, তখন আমরা জানি যে একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়েছে। তবে, মনে হচ্ছে এই পেসমেকারগুলি বিভিন্ন ধরণের উত্তেজনার প্রতি সংবেদনশীল। কিছু কিছু ধরণের উদ্দীপনা এই গতি পরিবর্তন করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে শরীরের তাপমাত্রা, হৃদস্পন্দন, মনোযোগের স্তর, বয়স, অ্যালকোহল এবং আবেগ – এই সবকিছুই আমরা কতটা সঠিকভাবে সময় বিচার করি তা প্রভাবিত করতে পারে। সময়বোধ যেহেতু দৈহিক, তাই আমাদের দেহে লিপ্ত টেকনোলজি সেই সময়বোধে দখলদারি করবেই।
![]()
চিত্র ৩: আর কতক্ষণ?
সময়ের বোধ বিগড়ে দেওয়ার ব্যাপারে অ্যাপ-টাইম যে একমাত্র দোষী, খুব স্বাভাবিকভাবেই নানা কারণে সেই বোধের উচ্চাবচ হ’তে থাকে তা বোঝা গেল। কিন্তু অ্যাপ-টাইম টেকনোলজির সাথে আমাদের দৈনিক এবং দৈহিক মাখামাখি ক্রমবর্ধমান, অতএব বেঁড়েব্যাটা সে তো বটেই। ইন্টারনেট ব্যবহার সার্বজনীন হবার পর ইন্টারনেট টেকনোলজি যে আমাদের ক্রমান্ব্য়ে তাড়া দেওয়া(নোটি ইত্যাদি) আর immersion বা ডোবানো (নেশাকারি কন্টেন্ট, স্ক্রলের নেশা) এই দুই গুঁতার মাধ্যমে আমাদের সময়বোধকে যথাক্রমে সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘায়িত করে তাকে ঘরছাড়া অনিকেত করে তোলে, অ্যাপটাইম টেকনোলজি তারই এক ওভার ওভারডোজ।
![]()
![]()
চিত্র ৪ ক, ৪খ: বই বনাম চালাকফোন
আমাদের সময় বোধের অবনতির প্রসঙ্গে ইন্টারনেট টেকনোলজির বিপ্রতীপে হামেশাই দাঁড় করানো হয় ছাপার অক্ষরকে। ছাপার অক্ষর আমাদের সময়বোধকে প্রগাঢ় আর প্রশস্ত করে। ইন্টারনেট যাকে ফাঁপা আর সংকুচিত করে। স্ক্রল না করে ফ্লিপ করুন, সুস্থ সময় কাটিয়ে স্বস্থ হোন, ইত্যাদি সেলফ-হেল্পিয়, মেন্টাল-হেলথিয় লেখাপাতিতে ছাপা-মিডিয়া ও নেট-মিডিয়া পরিপূর্ণ। কিন্তু বই আর অন্যান্য নানা দৈর্ঘ্ের ছাপাক্ষর সমুচ্চয় (খবর, প্রবন্ধ, গল্প) এখন অ্যাপ-টাইমের বাইরে নয়। কিন্ডল বা যেকোন ইন্টারনেট-নির্ভর পঠনমাধ্যমে তা পড়তে কতক্ষন লাগবে তা মিনিটের গুনতিতে লেখা থাকে ( a 4 minute read ইত্যাদি )। যদিও এই মেশিন-টাইম হিসাব স্যাটেলাইট ডাটার সাথে যুক্ত নয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা এক স্থির গড় (ইন্টারনেটের লেখার ক্ষেত্রে) বা এক পরিবর্তনশীল গড় (যেমন কিন্ডল দাবি করে যে পাঠের রিডিং স্পিড মানে পাতা উলটাবার গতিবেগ আর কি বুঝে সে ব’লে দেয় আর কত মিনিট পড়া বাকি আছে)। এই তাড়া অ্যাপ-ক্যাব ধরার তাড়ার মত না হ’লেও তার গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলগিরি খুব আলাদা না। সময়ের রসদ-করণে ভবিষ্যতের ভর্তুকি তাতে বেমাত্রা।
আরও পড়তে চাইলে:
https://www.uber.com/en-IN/blog/deepeta-how-uber-predicts-arrival-times/
https://plato.stanford.edu/entries/heidegger/
https://www.imperial.ac.uk/news/162009/scientists-find-first-evidence-local-clock/

সৌরভ রায়
লেখক, সম্পাদক, অনুবাদক ও চিত্রগবেষক
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের LGBTIQ+-সংক্রান্ত অনলাইন ভিসুয়াল কন্টেন্ট নিয়ে গবেষণা করছেন।