আমাদের স্ক্রিনময়ী জীবন অনর্গল ডিজি-ছবির বন্যায় চিন্ময়। এই নেটেড দর্শনের গ্লোবাল রাজত্ব শুধু আমাদের অবসরকেই শাসন করে না, কোন ছবির ঝাঁক কিভাবে ইন্টারনেট আর স্ক্রিন বেয়ে আমাদের চোখ ধাঁধায় আর মন মাতায়, তা দিয়ে গড়ে ওঠে আমাদের রোজওয়ারি গণদর্শন আর রাজনীতি। ভিসুয়ালের সেই সাইবারশাহীর নানা ঝাঁকিদর্শন নিয়েই এই কলামের নানান কিস্তি।
স্ক্রিনশট : শটিবনে কাহাদের ছায়া পড়িয়াছে?
তৃতীয় কিস্তিতে স্মার্টস্ক্রিনকে ‘নানা মসৃণ তলের এক মায়ামর্মরসরোবর’ কয়েছিলাম। তার গভীরতা বুঝতে না পেরে পিছলে পড়ে বা ডুবে মরে আনপড় আঙ্গুল। কিন্তু স্ক্রিনেরা টাচস্ক্রিন হবার অনেক আগে থেকেই ছিল মায়া-মিরর। কম্পিউটার স্ক্রিনের মায়াদর্পনত্বের মূল মায়া হ’ল, তার পূর্বজ টেলিভিশন স্ক্রিনের মতই, তা আয়নার মত নিকট, নয়নসমুখের দৃশ্যমানকে দেখায় না, দূরের অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তোলে। কম্পিউটার আর ফোন আবার কাছের অদৃশ্যকেও দৃশ্যমান করে তোলে – GUI (Graphic User Interface)দিয়ে। সেই কাছের অদৃশ্য হল স্ক্রিনমেশিনের যন্ত্রঅন্ত্রব্যবস্থা। মানে তার নাড়িভুঁড়ির খবর, তার সার্কিটে যা যা ঘটমান – তার সফটওয়্যার বা অ্যাপ-এর গ্রাফিক ইউজার ইন্টারফেস। দূরের ভিডিও, পরের ছবি, অন্যদেশের সিনেমার থেকেও বেশি সময় স্ক্রিন জুড়ে থাকে ফোনের ভিতরের মামলাপাতি। মুহুর্মুহু বদলাতে থাকে সেই স্ক্রিন। তাই দরকার পড়ে তারে নথি করবার। প্রথম প্রথম স্ক্রিনশট সেই কারণেই নেবার দরকার পড়ত। কিন্তু গ্রাফিক ইউজার ইন্টারফেসের আগে, যখন স্ক্রিনভরা শুধু ইকড়ি মিকড়ি থাকত, তখন কিভাবে নেওয়া হ’ত স্ক্রিনশট? Prt Scr বা Power ও Volume বাটন একসাথে টেপার সুবিধা আসার আগে?

গুগলের জেমিনি এ আই-কে ‘philosophy history of screenshot’ জিগাতেই ঝপাঝপ গরু রচনা নামিয়ে দিলো সে, যা ‘Screenshot’ wikipedia entry-র চেয়ে বেশ খানিকটা উন্নতমানের।
“স্ক্রিনশট” এর ভাবনা ১৯৬০-এর দশকে ইন্টারেক্টিভ কম্পিউটিং-এর বিকাশের সাথে সাথে আসে। প্রাথমিকভাবে, এটি ছিল ডকুমেন্টেশন বা শেয়ারিংয়ের জন্য কম্পিউটার স্ক্রিনের ভিজ্যুয়াল আউটপুট ক্যাপচার এবং সংরক্ষণ করার একটি উপায়। দার্শনিকভাবে দেখলে, স্ক্রিনশটগুলি ডিজিটাল মিথস্ক্রিয়ায় বাস্তবের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তকে দেখায়, যা ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা বা সফ্টওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনের অবস্থার একটি স্ন্যাপশট ক্যাপচার করে।
স্ক্রিনশটের বিবর্তন:
- প্রাথমিক দিনগুলি (১৯৬০): মেমরি থেকে স্ক্রিন ডেটা ক্যাপচার করার জন্য BASIC প্রম্পটে BSAVE কমান্ড ব্যবহার করার মতো পদ্ধতির মাধ্যমে সম্ভবত প্রথম দিকের স্ক্রিনশটগুলি নেওয়া হত।
- GUI-এর উত্থান (১৯৮০-বর্তমান): গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস (GUI) এর আবির্ভাবের সাথে সাথে স্ক্রিনশট নেওয়া আরও সহজ হয়ে ওঠে। উইন্ডোজ এবং ম্যাক এরে মতো অপারেটিং সিস্টেমগুলি স্ক্রিন চিত্র ক্যাপচারের জন্য ডেডিকেটেড কীবোর্ড শর্টকাট বা সফ্টওয়্যার সরঞ্জাম সরবরাহ শুরু করে।
- মোবাইল ডিভাইস (২০০০-এর দশকের শেষের দিক থেকে বর্তমান): স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেটের ব্যাপক ব্যবহার স্ক্রিনশটের ধারণাকে মোবাইল ডিভাইসেও প্রসারিত করেছে, এর ব্যবহারকে আরও গণতান্ত্রিক করে তুলেছে।
দার্শনিক প্রভাব:
- বাস্তবতার ফোটো: স্ক্রিনশটগুলি ডিজিটাল বিশ্বের একটি মুহুর্তকে ধরে রাখার একটি উপায় প্রদান করে, সময় এবং স্থানের একটি নির্দিষ্ট বিন্দু ক্যাপচার করে। এটি এই ধরনের উপস্থাপনার নির্ভুলতা এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে, কারণ এগুলি স্থির এবং শুধুমাত্র একটি স্ন্যাপশট ক্যাপচার করে।
- ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন: স্ক্রিনশটগুলি ডিজিটাল ডকুমেন্টেশনের একটি রূপ হিসেবে কাজ করে, ক্ষণস্থায়ী তথ্য এবং মিথস্ক্রিয়া সংরক্ষণ করে । এগুলি সমস্যা সমাধান, তথ্য ভাগ করে নেওয়া বা সফ্টওয়্যার বা ওয়েবসাইট ইন্টারঅ্যাকশনের ভিজ্যুয়াল রেকর্ড তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
- ডিজিটাল অভিজ্ঞতার প্রকৃতি: স্ক্রিনশট নেওয়ার কাজটি ডিজিটাল অভিজ্ঞতা ক্যাপচার এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি বৃহত্তর আগ্রহকে প্রতিফলিত করে। এটি ডিজিটাল ইন্টারঅ্যাকশনের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতি এবং সেগুলিকে আরও স্থায়ী করার জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে।
• ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশন: স্ক্রিনশট হল ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা ব্যবহারকারীদের তথ্য ভাগ করে নিতে, প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে বা ধারণাগুলিকে এমনভাবে চিত্রিত করতে দেয় যা কেবল টেক্সট দিয়ে সবসময় সম্ভব নয়।


চিত্র ৩: ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন না ডিজিটাল অভিজ্ঞতার প্রকৃতি?



ওপরের সুলিখিত গরু রচনাটির ‘দার্শনিক প্রভাব’ অংশের মুশকিল এই যে তা খুব এ আই-সুলভ, তাতে গোল গোল কথা বেশ গুছিয়ে বলা হয়েছে যাতে তা চোখা চোখা বলে ভ্রম হয়।
যেমন স্ক্রিনশট নিয়ে একটি মূল দার্শনিক প্রশ্ন হ’ল স্ক্রিনশট এর ontology কি? মানে সেটা আসলেই কি? শুধু ডিজিটাল এটাসেটা (digital ephemera) নাকি ইনস্টলেশন ফাইল বা টরেন্ট ফাইলের মত single-use রিসাইকেল বিন-অভিমুখী বর্জ্য নাকি খুব অন্য কিছু? শটিবনে যেমন বাংলার মুখের ছায়া অবিকল পড়ে, স্ক্রিনশটের ছায়া কোন তত্ত্বায়নের আয়নায় সবচেয়ে সঠিকভাবে পড়ে? ‘বাস্তবতার ফোটো’, ‘ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন’, ‘ডিজিটাল অভিজ্ঞতার প্রকৃতি’, ‘ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশন’- এরকম চারটি বাক্সে তাকে বন্দি করাটা সুবিধাজনক কিন্তু তা বেশ অবাস্তব-ও, কারণ বাক্সগুলো মোটেই খুব আলাদা আলাদা নয়।
Dandi Meng “The Confessional Image”-এ Hito Stereyl -এর “In Defence of Poor Image” থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে চেষ্টা করেন স্ক্রিনশটের তত্বায়ন করার। দ্রুত সঞ্চরমান হবার জন্যে হাল্কা-পল্কা স্ক্রিনশট আদর্শ। যদিও Christopher Moore ‘virtual photography’ বলে স্ক্রিনশটকে জাতে তোলার চেষ্টা করেন, কিন্তু ফোটোগ্রাফের মত ফোটোগ্রাফার আর ফোটোগ্রাফি পদ্ধতির মহাতথ্য বা metadata তাতে বিদ্ধ, শ্লিষ্ট থাকে না। তা অবিকল, হুবহু নকল। বরং কাটছাঁট করে মেটাডাটা মুছে ভিজুয়াল তথ্য অনলাইন থেকে অফলাইন করতে স্ক্রিনশট খুবই কাজের।

স্মার্টফোনে স্ক্রিনশট নেওয়া এতটাই সহজ (পাওয়ার আর ভলিউম বাটন একসাথে টেপা) যে শট নেওয়া প্রায় আমাদের দৈহিক অভ্যাসে পরিণতপ্রায় আর ঠিক যে অংগসংস্থানিক কারণে শট নেওয়া সহজ হয়, সেই একই সার্কিট বিশেষ ক্ষেত্রে স্ক্রিনশট নেওয়াকে রুখে দেয়- সুরক্ষা বা গোপনীয়তার নামে (যথা মোবাইল ব্যাঙ্কিং) কিন্তু অন্য ফোন বা ক্যামেরা দিয়ে তা সেরে ফেলা যায়। ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে স্ক্রিনশট রোখা অসম্ভব ছিল আগে কিন্তু তার বন্দোবস্ত হচ্ছে ক্রমে ক্রমে। যখন স্ক্রিনশট দৈহিক অভ্যাসে পরিণত হয়, cultural artifact হিসাবে তার অস্তিস্ত্ব আর পরিচয় কি বদলে যায়?
চিত্র ৮ ক, খ : স্ক্রিনশটিং অ্যাজ দৈহিক অভ্যাস?
স্ক্রিনশট এতটাই low-tech আর transparent process যে এটা নিয়ে গভীরভাবে কেউ ভাবে না কিংবা ভাবার দরকার বোধ করে না – এই খেদ গবেষকদের। তার ওপর স্ক্রিনশট একবাসি বা সাতবাসি মামুলি ছবি। এখানে transparent সরল অর্থে প্রযুক্ত, সহজবোধ্য অর্থে নয়। স্ক্রিনশট আর স্ক্রিনের ঘটমান-এর সম্পর্ক যেন সাপ আর তার নির্মোকের মত। সাপের ছাল যখন সাপের গায়ে লেগে থাকে তখন তা অদৃশ্য, ছাড়লে তা প্রায় অবিকল সাপের মত দেখায় (যদিও ভেতরে সাপ নেই) আর কিছুদিন বাদে তা হাল্কা-পল্কা এক বর্জ্যে পরিণত হয়। চিহ্নশাস্ত্রের তত্ত্বে স্ক্রিনশট একইসাথে icon আর index.

এই নির্মোকতত্ব সবচেয়ে ভাল বোঝা যায় সবচেয়ে দামি ডিজিটাল ইমেজ বা NFT Art -এর স্ক্রিনশট নেওয়ার ব্যাপারে। দামি NFT Art নেহাত একটি ডিজিটাল ইমেজ না, তাতে গাঁথা থেকে একটি unique ডিজিটাল ফাইল যা নকল করা যায় না।

চিহ্নশাস্ত্রের তত্ত্বে স্ক্রিনশট একইসাথে icon আর index হলেও সে যে সাথে সাথে symbol ও হতে পারে, তার উদাহরণ নিম্নরুপ।
চিত্র ১০ ক, খ : karagarga.in তার বিপুল সিনেমা আরকাইভ অভিযাত্রী হ’তে বলেন র্যান্ডম স্ক্রিনশটে সওয়ার হয়ে
আরও পড়তে চাইলে
https://jacket2.org/article/confessing-image
Moore, Christopher. “Screenshots as virtual photography: Cybernetics, remediation, and affect.” In Advancing digital humanities: research, methods, theories, pp. 141-160. London: Palgrave Macmillan UK, 2014.
Švelch, J. (2020). Redefining screenshots: Toward critical literacy of screen capture practices. Convergence, 27(2), 554-569. https://doi.org/10.1177/1354856520950184 (Original work published 2021)

সৌরভ রায়
লেখক, সম্পাদক, অনুবাদক ও চিত্রগবেষক
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের LGBTIQ+-সংক্রান্ত অনলাইন ভিসুয়াল কন্টেন্ট নিয়ে গবেষণা করছেন।