তাহমিদ রহমান-এর কবিতা

টু লাইফ

 

আল্লাহ মানুষকে বেহেশত দিয়েছিলো

আর ইবলিশ পৃথিবী!

 

 

প্রতিমার মতো ভেঙে পড়ে যে কুয়াশা

[উৎসর্গ: মীর হাবিব আল মানজুরকে]

 

তোমার কবিতায় জোর আছে, তোমার বিষণ্ণতা কি প্রচণ্ড শক্তিশালী!

কী অদ্ভুত ক্ষমতায় মরে যেতে পারো তুমি— সুনিশ্চিত দ্বিধায়।

অথচ এভাবে ধরাম করে মেটাফোরে মরে যেতে, আমার দারুণ লজ্জা লাগে!

 

আমার পথ হারানোর পথ না পেলে, নাই বা হলো মসনবি

তোমার মধ্যরাতের জায়নামাজে বেহাল হলো দরবারি।

 

গোলাপী নরম ওয়েদারে, ঘাসের কোলে শুয়ে যারা বাজায় ইউকুলেলে— তারা হয়তো সুখি।

আমি তো থ মেরে দাঁড়িয়ে আছি, ওদের পিঠের নিচে চাপা পড়ে গেছে ভিনসেন্টের সূর্যমুখি!

 

আমাকে সঙ্গে নেও, নিয়ে যাও প্রজাপতি,

আমি দেখেছি তাদের যারা আলতো করে ধরতে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলে তোমার পাখা,

কবিতার মাহফিলে তাদের জীবন কেটে যায়, কাযা হয়ে যায় কারবালা।

 

আমি একটু লিভ নিতে চাই, কবিতার খোদায় করে দাসত্বের জিন্দেগি

সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে থেকে আঁধারের ইলহানে,

ফুল ফোঁটার আগেই চলে যেতে চাই বিষণ্ণ কারাভানে,

শুধু

রেখে যাবো সুরভী।

 

 

 

শর্তাধীন

 

মায়ের ভালোবাসার কায়দাটা কখনোই আমাদের পুরোপুরি জানা ছিলো না,

আমরা তো জানতাম বাবা পাঞ্জাবি নিয়ে বাড়ি ফিরলেই আকাশে ঈদের চাঁদের হদিস মেলে,

নাইলে কালকেও রোজা, কিংবা তারপর… তারপর…

বাবা আর কবে ফিরে!

 

 

ঢাকার রাস্তায় বৃষ্টির দিনে নর্দমার পানিতে দাঁড়িয়ে তোড় তোড় করে ডুবে যাই বিষ্ঠাগলা জলে।

শরীরের বিষাক্ত ক্লেদ নিংড়ে নিংড়ে পড়ে পঙ্কিল ফেনায়, উপরে গন্ধর্ব বাতাস—

এ আমার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত,

লাইটহাউজের মতো দু হাতে চুলের মুঠি ধরে আমি ঠাহর করতে পারি না,

এই শহরের উদাম ম্যানহোলগুলার গভীরতা, ব্যাস কিংবা পরিধি কত—

সূর্যাস্তের পর তুমি থাকবা তো?

 

 

একটা শব্দের পিছনে পরিযায়ী হয়ে

আমি ছুটতে ছুটতে চলে এলাম গুলবাগ ছেড়ে—এখানে নরক গুলজার।

এমন শব্দ কি আমি কখনো খুঁজে পাবো আর?

বাদুড়ের মতো বাসের ভেতর ঝুলতে ঝুলতে

আমি কার কালো বোরখার ভিতর হারিয়ে ফেলেছি দুটি আকীক ভরা চোখ।

এরপর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আমি আমার কিবলা খুঁজে পাই নাই।

শূন্য মরুভূমির উপর ডানাভাঙা পাখির মতো ঘুরপাক খেতে খেতে,

আমি ঠাহর করতে পারি না কোনটা মরীচিকা কোনটা পথ।

এভাবে চক্রাকারে ঘুরতে থাকাই তোমার নিয়তি পারাবত?

 

 

এমন কোনো মরীচিকার খোঁজ আমি পাইনি কোথাও খোদা,

চোখের ভিতর জল নিয়ে অপেক্ষায় ছিলো না কেউ౼

এখন পড়ন্ত মাগরিব, আমি কি ভাঙবো না রোজা?

মাথার ওপর আছড়ে পড়ছে অনন্ত বালি, রাশি রাশি ঢেউ౼

 

 

 

জলজ

[উৎসর্গ: তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী]

 

মহাপতনের শব্দ কেমন?

শুনেছো কোনো দিন? কেমন স্বর

কোন ধ্বনি?

কোমল? না

গম্ভীর?

আদম যখন ভ্রষ্ট হলো

আসমানসে জমিন,

খোদার আরশ কেঁপে উঠলো তখন,

বিদীর্ণ হলো বক্ষ

চৌচির চির্‌ ধরিত্রীর

উত্তরতক্‌ দক্ষিণ।

হিমালয়ের গর্ভে তার প্রতিধ্বনি

পাওয়া কি যায় যদি কান পেতে শুনি।

কিংবা প্রাত্যহিকতার গ্যারাকলে

বিষণ্ণ শহর নগর আর বন্দরে

হয়তো ডুবে আছো,

মোৎজার্ট আর বিটোভেনে

যেমনি ডুবে থাকে অতল

অতল সমুদ্রে

নিঃসঙ্গ

সাবমেরিন।

 

 

একটি

শিশির জল

কেয়ার পাতায়

রৌদ্র মেখে করছে

ঝলমল, তার রাত্রি জমা ভর

প্রভাত আলোয় ছড়িয়ে গেলো

দৃষ্টি তোমার

উত্তল-অবতল।

হে ক্ষুদ্র

ক্ষুদ্র প্রতিফলন

বিমল তোমার বর্ণালি 

আর সব ক’টি তার রঙ

যখন আমার বুকে

অশ্রু তোমার প্রিয়, প্রিয় প্রিয় সে জল

এঁকে দেয় নীলের নকশা দিয়ে নীল সরোবর!

যেমন আরব-মরুর বুকে, কাফেলার

আকুল পিয়াসা, দেখে অস্তাচল,

দেখে শূন্য ধূ ধূ প্রান্তরের খাঁজে

দেখে চকিতে, চকিতে দেখে

ওই যে! ওই যে জমজম!

তখন বেহেশতী কোন হাওয়ার দোলে

তোমার চোখের শিশির জলে

কেয়ার পাতায় টলমল

এবার তবে সন্তর্পণে

পতন হবে

হোক পতন।

 

 

ক্যাসিনি

তুমি নির্ভীক,

পৃথিবীর অভিযাত্রী।

সভ্যতার ইতিহাসে

যে অনন্ত গৌরব সারথী,

করেছ অধিকার, দেখেছ

শনির বিস্তীর্ণ বলয় ঘিরে

প্রকাণ্ড দিকচক্রবাল!

ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে

তোমার অন্তিম মহাবর্তনকাল।

তাই আজ স্মরণ করো পৃথিবী

যার কোনো নিভৃত মহাকাশচারী

পেছনে ফেলে যা কিছু পরিচিত, যা কিছু জানি

তোমার বিস্ময়ের সাক্ষী হতে

কক্ষচ্যুত

গ্রহের মতো মধ্যাকর্ষণহীন

নির্ঘুম নিষ্পলক চেয়ে আছে

তার লাগি যা কিছু সত্য,

মহান, অকৃত্রিম।

 

বিদায় ক্যাসিনি

বিদার নভো নীড়।

পতন তোমার পুণ্য আনুক।

আয়ুষ্মান ভবঃ পৃথ্বী।

আমীন।

 

 

অনশন আর অনাহারে

ঝরে পড়ে যে আলতো করে

শুভ্র সে বলাকা।

একে একে খসে পড়ছে পালক

তার মোমের তৈরি পাখা।

পালকে কিসের দাগ?

ঘাম নাকি রক্ত?

হয়তো তারা সমার্থক, কিংবা প্রতিশব্দ।

বিশাল এ নদীর বিশাল বাঁকে

স্খলিত পালক একে একে

চক্রাকারে ছড়িয়ে দিলো

মৃদু মৃদু ঢেউ।

শ্রুতির অতীত সে ধ্বনি

ডুবে যাওয়া বিষাদ সিম্ফনি

তোমার কানে পৌঁছে কি না জানি౼

 

কিন্তু নদী

তোমার নবনী কোমল বুক

ধারণ করে সকল ধ্বনি, কম্পন বিস্তার

অনর্গল কিংবা মূক।

নবপল্লবের আধো আধো বোল

তার জীবনচক্রের সমস্ত শোরগোল

তোমাতে শুরু হয়ে তোমাতেই সমাসীন।

আর তুমি আর আমি তাতে

ডুবে যাই যদি একসাথে

ডুবিয়ে দিয়ে মুখ

প্লাবিত করি সারাদেহে জলজ সুখ-দুখ।

তখন সমস্ত পতন মহাপতনের ধ্বনি

থমকে থমকে

হয়তো চমকে দেবে বুক

যেমন চমকে দেয় মেঘমুক্ত দিনে

প্রশান্ত বাতাবরণে

মুহুর্মুহু

বিদ্যুৎ।

 

 

 

নির্বাসন

[উৎসর্গ: আনমনা মনীষিতা]

 

তোর ছোট্ট কালো টিপ

আমার নির্বাসনের প্রহর গোনা

আন্দামান দ্বীপ।

 

 

 

আবহাওয়া

 

ফটোকপি করা লেকচারের উত্তাপ

কনুই দিয়ে বুকে চেপে ধরতেই বেমালুম হাওয়া।

যেই তাপমাত্রায় চায়ের ভিতর বিস্কুট গলে পড়ে

তাতে জিভ পুড়লেও, সন্দর্ভ রচনা হয় না।

 

চোখে মুখে কুয়াশার ঝাপটায় কিসের যেন ঘোর লাগে।

দেখি চশমার উপর বরফ জমাট বাঁধতেছে।

হাতের রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়িটা, বজ্রাহত গাছের মতোই বেকুব,

বিগব্যাং-এর পর থেকে একই অক্ষে পরিভ্রমণ করতেছে (মাত্র)।

কিন্ত কিন্ত… সময় তো এবসল্যুট না, রিলেটিভ

ঘড়িটা ফেলে দিলাম।

 

আমার স্যাটেলাইটে বসবাসের বড় ইচ্ছা।

আপাতত সেইদিকেই হাঁটতেছি, ক্রমশ…

আলোকদূষণে মিল্কিওয়ে দেখার খায়েশ পূরণ হলো না পৃথিবী থেকে।

সেইখানে গিয়ে দেখবো।

আর মাঝে-মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিবো।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading