যদিও মহাপয়ারকে ২২/২৬ মাত্রা অব্দি টেনে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অনেকেই জীবনানন্দ দাশকে দিয়ে থাকেন, কিন্তু সেটিও মূলত রবীন্দ্রনাথেরই।
বাংলা ভাষায় সনেটের ইতিহাস খুব বেশি পুরাতন নয়, ফ্রান্সের ভার্সাইতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা ‘কবি-মাতৃভাষা’ কবিতাটি, বাংলা সাহিত্যের প্রথম সনেট, যার পরিমার্জিত রূপটি ‘বঙ্গভাষা’ নামে পরিচিত । ১৮৬৬ সালে ১০২টি সনেট নিয়ে তাঁর সনেটগ্রন্থ ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়। জন মিল্টনের ব্ল্যাঙ্ক ভার্সকে মাথায় রেখে যে-অমিত্রাক্ষর ছন্দ মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষায় এনেছেন, তারই একটি প্রকৃষ্ট রূপ হিসেবে সনেট দাঁড়িয়ে গেছে।
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি; –
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে –
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।
(বঙ্গভাষা// মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
যদিও ইউরোপীয় সনেট মূলত বাংলা স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রায়-সহধর্মী ছন্দে রচিত, কিন্তু সনেটের গাম্ভীর্য ধরে রাখতে বাংলায় তার প্রয়োগ হলো অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। ২৩ ফাল্গুন, ১৩০০ বঙ্গাব্দে (১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় প্রচলিত ১৪ মাত্রার প্রবাহমান পয়ারকে ১৮ মাত্রায় সম্প্রসারিত করে প্রবাহমান মহাপয়ার সৃষ্টি করার পর থেকে মূলত প্রবাহমান মহাপয়ারেই সনেট রচিত হচ্ছে। সেই মহাপয়ারের সনেট কখনও কখনও ২৮ মাত্রা অব্দি বিস্তৃত হয়েছে, যেমন জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’র অধিকাংশ কবিতাই সনেট, এবং সেই সনেটগুলি ২২ থেকে ২৬ মাত্রায় রচিত। যদিও মহাপয়ারকে ২২/২৬ মাত্রা অব্দি টেনে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অনেকেই জীবনানন্দ দাশকে দিয়ে থাকেন, কিন্তু সেটিও মূলত রবীন্দ্রনাথেরই।
মোরে করো সভাকবি ধ্যানমৌন তোমার সভায়
হে শর্বরী, হে অবগুণ্ঠিতা!
তোমার আকাশ জুড়ি যুগে যুগে জপিছে যাহারা
বিরচিত তাহাদের গীতা।
(রাত্রি// রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এই চারটি চরণকে যদি দু’টি চরণে নিয়ে আসি, তাহলে ২৮ মাত্রার মহাপয়ার দাঁড়ায়:
মোরে করো সভাকবি ধ্যানমৌন তোমার সভায় হে শর্বরী, হে অবগুণ্ঠিতা!
তোমার আকাশ জুড়ি যুগে যুগে জপিছে যাহারা বিরচিত তাহাদের গীতা।
ফলে, জীবনানন্দ দাশের ২৮ মাত্রা প্রকরণগত একটি গৌণ পরিবর্তন নিয়ে আসলেও, শ্রুতিগত নতুন কোনো সংযোজন ঘটায়নি।
পরবর্তীতে, বিনয় মজুমদার প্রবাহমান মহাপয়ারকে ৩০ মাত্রা অব্দি টেনে নিয়ে গিয়েছেন, তাঁর ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’য়। কিন্তু, আমি নিজে সেগুলিকে মহাপয়ার মনে করি না। কেননা, মহাপয়ারের যে সুর, যে সুষমা, সেটি ২৬ এর পর আর অবশিষ্ট থাকে না। বরং ‘অঘ্রাণের অনভূতিমালা’কে মুক্ত অক্ষরবৃত্ত বলাই শ্রেয়। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়ে প্রবাহমান মহাপয়ার প্রচলিত হওয়ার পর কেনই-বা অধিকাংশ সনেট ১৮ মাত্রাতেই লেখা হলো, ১৪ বা ২৬ মাত্রায় তত বেশি দেখা গেল না কেন! এর একাধিক কারণ থাকতে পারে; কবিরা সচরাচর সনেট লিখলে সিরিজ বা গুচ্ছকবিতা হিসেবেই লিখেছেন, ফলে সনেটগুলি সমসংখ্যক চরণের হওয়ার কারণে, অনেক বেশি বলার দায় তৈরি হয়ে যায় ২৬ মাত্রার ক্ষেত্রে এবং অল্পে সবটা বলার চাপ তৈরি হয় ১৪ মাত্রার ক্ষেত্রে, অর্থাৎ ১৪ মাত্রার আঁটসাঁট কাঠামোর কারণে অল্প পরিসরেই যা বলার, তা বলে নিতে হয়। ফলে ১৮ মাত্রার চালটি সব দিক থেকে সহনীয়। কিন্তু, এই সহনীয়তাই শেষ কথা নয়, মূলত ১৮ মাত্রার চালটি পয়ার গোত্রের ছন্দের মধ্যে সবচেয়ে সুষমামন্ডিত, স্বতঃস্ফূর্ত। কখনও আমার এও মনে হয়, পয়ার মূলত ১৮ মাত্রার মহাপয়ারেই গিয়ে তার বিকাশের মাত্রা চূড়ান্ত করেছে এবং এর পরে যা আছে, তা মূলত পয়ারের আনন্দ আনে না। যদি আমরা আক্ষরিক অর্থেও ‘পয়ার’ শব্দটিকে দেখি, তাহলে তার মানে দাঁড়ায় দ্বিচরণবিশিষ্ট কবিতা অর্থাৎ দুই চরণে একটি খণ্ডিত ভাব প্রকাশ পায়। পয়ার শুধু দ্বিচরণবিশিষ্টই নয়, বরং দ্বিপার্বিকও। ২২ মাত্রার মহাপয়ারে সে দ্বিপার্বিকতা কোথাও কোথাও আহত হলেও, ২৬ মাত্রার মহাপয়ারে তা একেবারেই নিহত হয়ে যায়। সনেট-সংক্রান্ত আলোচনায় পয়ার/মহাপয়ারের আলোচনা করছি, কারণ, বাংলা ভাষায় সনেট মূলত পয়ার/মহাপয়ারেরই একটি প্রকৃষ্ট রূপ। স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত সুখপাঠ্য কোনো সনেট আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি, পড়লেও হয়তো সেটিকে সনেট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি।
তাহলে, প্রথাবিরোধী সনেটই-বা কেমন? সেক্ষেত্রে যে-কোনো ছোট কবিতাকেই হয়তো ‘সনেট’ বলে চালাতে পারবো আমরা।
বাংলা ভাষার যে-প্রাক-মধুসূদনীয় পয়ার, যেখানে অমিত্রাক্ষরের প্রবাহমানতা নেই, যেখানে চরণ ও বাক্য একই মাপে ছাঁটা, বাক্য কখনোই চরণের সীমা ডিঙায় না—সেই পুরাতন পয়ার বা মহাপয়ারে পরবর্তীতে কোনো সনেট রচিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই, পড়লেও হয়তো খেয়াল করি নি। মধুসূদনের কয়েকটি সনেট আজও আমাদের পাঠাভ্যাসের মধ্যে আছে, যেমন কপোতাক্ষ নদ, বঙ্গভাষা, কমলে কামিনী ইত্যাদি। কিন্তু, মধুসূদন দত্ত থেকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত , এই দুই দত্তের মধ্যবর্তী পর্যায়ে প্রচুর উৎকৃষ্ট সনেট রচিত হলেও, সেগুলি আমাদের পাঠতালিকায় আর নেই। দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, মোহিতলাল মজুমদার, প্রমথ চৌধুরীসহ অনেকে উৎকৃষ্ট সনেট রচনা করলেও, সেগুলি আমরা পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছি বলা যায়। অবশ্য এটি শুধু সনেটের ক্ষেত্রে নয়, বরং সময়ের কাব্যভাষা ও কাব্যরুচির কারণে তাদের সামগ্রিক কাব্যই আজ ধূসর হয়ে উঠেছে আমাদের চোখে। শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অল্প বয়সের রচনা ‘কড়ি ও কোমল’র একটি-দু’টি সনেট, যেমন ‘প্রাণ’ এখনও লোকমুখে ফেরে। ‘চৈতালি’ গ্রন্থে দুই-একটি সনেট রয়েছে, কিন্তু, ‘চৈতালি’ ও ‘নৈবেদ্য’র যে-কবিতাগুলিকে সনেট হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করে থাকেন, সেগুলি (দুই-একটি বাদে) মূলত সনেট নয় বরং সমিল পয়ার, যেমন ‘প্রান্তিক’র শেষ কবিতাটি ব্যতীত আর সব কবিতাই মূলত সমিল/অমিল প্রবাহমান মহাপয়ার।
যাবার সময় হল বিহঙ্গের। এখনি কুলায়
রিক্ত হবে। স্তব্ধগীতি ভ্রষ্টনীড় পড়িবে ধুলায়
অরণ্যের আন্দোলনে। শুষ্কপত্র-জীর্ণপুষ্প-সাথে
পথচিহ্নহীন শূন্যে যাবে উড়ে রজনীপ্রভাতে
অস্তসিন্ধুপরপারে। কত কাল এই বসুন্ধরা
আতিথ্য দিয়েছে; কভু আম্রমুকুলের গন্ধে ভরা
পেয়েছি আহ্বানবাণী ফাল্গুনের দাক্ষিণ্যে মধুর;
অশোকের মঞ্জরী সে ইঙ্গিতে চেয়েছে মোর সুর,
দিয়েছি তা প্রীতিরসে ভরি; কখনো বা ঝঞ্ঝাঘাতে
বৈশাখের, কণ্ঠ মোর রুধিয়াছে উত্তপ্ত ধুলাতে,
পক্ষ মোর করেছে অক্ষম– সব নিয়ে ধন্য আমি
প্রাণের সম্মানে। এ পারের ক্লান্ত যাত্রা গেলে থামি,
ক্ষণতরে পশ্চাতে ফিরিয়া মোর নম্র নমস্কারে
বন্দনা করিয়া যাব এ জন্মের অধিদেবতারে।
(প্রান্তিক-১৪// রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
পরিণত রবীন্দ্রনাথ সনেটের প্রতি উদাসীনই ছিলেন। উপস্থিত একটি ফর্মে কাজ করা অপেক্ষা নব-নব ফর্ম উন্মোচন করার দিকেই আজীবন তার আগ্রহ বেশি ছিল, যে-কারণে আজ বাংলা কবিতা এতটা সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, যে-কারণে তিনি ছন্দগুরু। শেক্সপিয়র, পেত্রার্ক, স্পেন্সার—কারও ফর্মেই তিনি সনেট লিখতে আগ্রহী ছিলেন না। ‘কড়ি ও কোমল’ এবং ‘চৈতালি’ পর্বে যা-কিছু সনেট তিনি লিখেছেন, তা একান্তই রবীন্দ্রনাথের সনেট।
প্রশ্ন থাকতে পারে, একটি কবিতা কেন সনেট বা কেন সনেট নয় । মাইকেল মধুসূদন দত্ত সনেটের বাংলা নামকরণ করেছেন ‘চতুর্দশপদী কবিতা’। অর্থাৎ ১৪টি চরণ থাকছে একটি সনেটে। কিন্তু, চতুর্দশপদী কবিতামাত্রই সনেট নয়। পেত্রার্ক, শেকসপিয়র, স্পেন্সার, মধুসূদন দত্ত—যারই সনেট আমরা খেয়াল করি না কেন, কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যেমন: প্রতিটি সনেট ১৪ চরণবিশিষ্ট, প্রথম আটটি চরণের (অষ্টক) অন্ত্যমিলবিন্যাস ও শেষ ছয়টি চরণের (ষষ্টক) অন্ত্যমিলবিন্যাস একই রকম নয়। অষ্টক ও ষষ্টকের এই অন্ত্যমিলবিন্যাসের ব্যতিক্রমটিকে জোয়ার-ভাটার সাথেও তুলনা করা হয়েছে; অষ্টক যেনবা জোয়ারের মতো এবং ষষ্টক ভাটার টান, ফলে সেইমতো সঙ্গীত তৈরি হয়।– অষ্টকে ভাবের বিস্তারে এক রকম অন্ত্যমিল ও ষষ্টকে ভাবের পরিণতিতে আরেক ধরণের অন্ত্যমিল। যদিও ভাবগত দিক দিয়ে অনেকে সনেটকে অষ্টক ও ষষ্টকে এখন আর ভাগ করেন না, তবু সনেটের অন্ত্যমিলবিন্যাসের ক্ষেত্রে অন্ত্যমিলের বিভাজনটি অনুসৃত । কিন্তু, চতুর্দশপদী মাত্রই সনেট, এমন ধারণাও বলবৎ আছে। যেমন ডব্লিউ এইচ অডেনের ‘দ্য সিক্রেট এজেন্ট’কে অমিল সনেট ধরা হয়। শামসুর রাহমান তাঁর ‘তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি’ গ্রন্থে গদ্যছন্দে অমিল চতুর্দশপদী লিখেছেন।– সেগুলিকে তিনি ‘গদ্যসনেট’ নাম দিয়েছেন। এই সাহস অবশ্য পাশ্চাত্য-সাহিত্য থেকেই প্রাপ্ত। কোথাও কোথাও ষোড়শপদীকেও সনেট বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে, পেত্রার্ক-শেকসপিয়রের থেকে আমরা যে-সনেট পেয়েছি বা সেসবের প্রায়-সহধর্মী সনেটকে ’গতানুগতিক/প্রথাবদ্ধ সনেট’ বলতে হয়। তাহলে, প্রথাবিরোধী সনেটই-বা কেমন? সেক্ষেত্রে যে-কোনো ছোট কবিতাকেই হয়তো ‘সনেট’ বলে চালাতে পারবো আমরা। টানা-গদ্যে লেখা যে-কোনো ছোট কবিতাকেও হয়তো আমরা ‘সনেট’ বলতে পারবো এবং তা পারলে, যে-কোনো ছোট কবিতাকে ‘সনেট’ বলতে পারার ষোলকলা পূর্ণ হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ’সনেট’ বলতে প্রথাবদ্ধ সনেটকেই বুঝে থাকি; প্রত্যেকের বুঝ একরকম নয়।
যা হোক, কল্লোল যুগের কবিদের মধ্যে বড় কলেবরে সনেট নিয়ে কাজ করেছেন এবং গ্রাহ্যতা পেয়েছেন জীবনানন্দ দাশ, যদিও জীবদ্দশায় তিনি ‘রূপসী বাংলা’র কোনো কবিতা প্রকাশ করেননি। ‘রূপসী বাংলা’র সনেটগুলি ( রচনাকাল ১৯৩৪ইং) ২২ থেকে ২৮ মাত্রায় রচিত প্রথম সনেট। এছাড়া ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘শকুন’ কবিতাটি দেখি ২৬ মাত্রায় রচিত।
মাঠ থেকে মাঠে মাঠে – সমস্ত দুপুর ভ’রে এশিয়ার আকাশে আকাশে
শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি,- নিস্তব্ধ প্রান্তর
শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশে
আরেক আকাশ যেন,- সেইখানে শকুনেরা একবার নামে পরস্পর
কঠিন মেঘের থেকে ;- যেন দূর আলো ছেড়ে ধূম্র ক্লান্ত দিকহস্তিগণ
প’ড়ে গেছে;- প’ড়ে গেছে পৃথিবীতে এশিয়ার ক্ষেত মাঠ প্রান্তরের’পর
এইসব ত্যক্ত পাখি কয়েক মুহূর্ত শুধু;- আবার করিছে আরোহণ
আঁধার বিশাল ডানা পাম গাছে,- পাহাড়ের শিঙে শিঙে সমুদ্রের পারে ;
একবার পৃথিবীর শোভা দেখে,- বোম্বায়ের সাগরের জাহাজ কখন
বন্দরের অন্ধকারে ভিড় করে, দেখে তাই;- একবার স্নিগ্ধ মালাবারে
উড়ে যায়;- কোন এক মিনারের বিমর্ষ কিনার ঘিরে অনেক শকুন
পৃথিবীর পাখিদের ভুলে গিয়ে চ’লে যায় যেন কোন মৃত্যুর ওপারে ;
যেন কোন বৈতরণী অথবা এ জীবনের বিচ্ছেদের বিষণ্ণ লেগুন
কেঁদে ওঠে … চেয়ে দেখে কখন গভীর নীলে মিশে সেইসব হূন ।
(শকুন// জীবনানন্দ দাশ)
ছন্দহীনতা ও বিমূর্তায়ন থেকে বাংলা কবিতা ক্রমশ সরে এসে তার চিরাচরিত প্রবণতার দিকে বাহিত হচ্ছে ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের দিকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
কল্লোল যুগের অপরাপর কবিরা যেমন বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ প্রত্যেকেই কম-বেশি সনেট লিখেছেন। কিন্তু, মহাপয়ারে রচিত বাংলা ভাষার সব থেকে আলোচিত সনেটগুচ্ছ হলো আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’। এমন কি ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থটি বের হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষার সব থেকে আলোচিত কাব্যগ্রন্থ সেটিই। মহাপয়ারে রচিত সনেটগুচ্ছ হিসেবে সোনালি কাবিন’র কোনো তুলনা বাংলা সাহিত্যে নেই। ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ সমূহ দৃষ্টিকোণ থেকে উৎকৃষ্ট এবং সর্বাঙ্গ সুন্দর। আল মাহমুদের সমসাময়িক অনেক কবিই সনেট রচনা করেছেন, তন্মধ্যে শামসুর রাহমানের ‘মাতাল ঋত্বিক’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরাণের গহীন ভিতর’ স্মরণযোগ্য। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলি’তে মহাপয়ারের পাশাপাশি এক বা একাধিক উল্লেখযোগ্য সনেট রয়েছে। পঞ্চাশ-ষাট পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ সত্তর ও আশির দশকে আবির্ভূত কবিরাও অনেকে উৎকৃষ্ট সনেট রচনা করেছেন।
হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার
এবার গোটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে;
প্রবল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার
তার চেয়ে নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে।
এ কোন কলার ছলে ধরে আছো নীলাম্বর শাড়ি
দরবিগলিত হয়ে ছলকে যায় রাত্রির বরণ,
মনে হয় ডাক দিলে সে-তিমিরে ঝাঁপ দিতে পারি
আচঁল বিছিয়ে যদি তুলে নাও আমার মরণ।
বুকের ওপরে মৃদু কম্পমান নখবিলেখনে
লিখতে কি দেবে নাম অনুজ্জ্বল উপাধিবিহীন?
শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে
মুছে দেবো আদ্যক্ষর রক্তবর্ণ অনার্য প্রাচীন।
বাঙালী কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।
(সোনালী কাবিন-২// আল মাহমুদ)
গত শতাব্দির শেষ দশকে এবং বর্তমান শতাব্দির প্রথম দশকে (শূন্য দশক), এই বিশটি বছরে যারা কবি হিসেবে আর্বিভূত হয়েছেন, তারা সনেট রচনায় আগ্রহ দেখান নি, বলতে গেলে সেটি একেবারেই পরিলক্ষিত হয়নি। মূলত এই কালপর্বের কবিরা গদ্যছন্দের দিকেই বেশি ঝুঁকে ছিলেন। গদ্যছন্দই এই কালপর্বের কবিতার মূল বাহন, বলা যায় সর্বগ্রাসী প্রবণতা । যদিও কেউ কেউ বিচিত্র ছন্দে কবিতা রচনার প্রয়াস পেয়েছেন, কিন্তু সেগুলি মূলত মহাপয়ার, দ্বিপদী, চৌপদীতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু, ছন্দ তত গুরুত্ব পায় নি, অন্তত যাদেরকে আমার মেধাবী মনে হয়েছে, তারা এমনটাই; ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস ভাষা ও সাহিত্যে নিয়োজিত মেধাবীদের কর্মকাণ্ডের ইতিহাস, সকলের কর্মকাণ্ড ও কাণ্ডজ্ঞান বিবেচ্য নয়। এই কালপর্বের কবিদের অধিকাংশ লেখা, যা কবিতা হয়ে উঠেছে, তা মূলত গদ্যছন্দ ও মহাপয়ারেই রচিত। কিন্তু, ছন্দহীনতা ও বিমূর্তায়ন থেকে বাংলা কবিতা ক্রমশ সরে এসে তার চিরাচরিত প্রবণতার দিকে বাহিত হচ্ছে ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের দিকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। অধুনা প্রায় এক দশক ধরে বিচিত্র ছন্দে কবিতা লেখার প্রচেষ্টা কবিদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। বাংলা ছন্দের পাশাপাশি নানা রকম সংস্কৃত ছন্দেও প্রচুর কবিতা লেখা হচ্ছে। সামনের দিনগুলিতে যারা কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন, আশা করা যায় তারাও ছন্দের দিকেই ঝুঁকবেন। তবে, গদ্যছন্দ থেকে বের হয়ে মহাপয়ার রচনা করার মতো করে, সেটি মহাপয়ার রচনা করা থেকে বের হয়ে সনেটে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে না গেলেই ভালো হবে মনে করি। সামনের দিনে যারা কবিতা লিখতে আসবেন , তারা আশা করি বিচিত্র ছন্দে, চাল-চলনে কবিতা লিখতে প্রয়াসী হবেন।
আল ইমরান সিদ্দিকী
সম্পাদনা: ওয়েবম্যাগ ‘নকটার্ন’ (যৌথ)।