১.
প্রতিটি সকাল যেন প্রসাধন। আমি মুঠো ভরে
দিয়েছি তোমায়। তবু সারারাত জেগে-থাকা পাখি
ডানায় লুকিয়ে রেখে পৃথিবীর সব মাখামাখি
উদভ্রান্ত অপচয় রুখে দিতে চাই। থরে থরে
সাজানো পাতায় প্লুত বেদনারা একা একা ঝরে।
পত্রল রাষ্ট্রের নীতিহীনতাই আমি লিখে রাখি।
সাজঘরে বসে বসে তুমি দেখো তুমুল বৈশাখী
ঝড়ের বাতাস। আমি মুক্তিকামী। দূরে গেছি সরে।
সিঁথির সঙ্গীত শুনে দূরগামী চুলের আশায়
চিরুনি থাকে না বসে। তার কাজ শোভন শৃঙ্খলা।
যতটা আঁচড় দিলে সমাজের প্রত্ন ছলাকলা
মনের আয়ত্তে আসে, চিরুনির মৌন ভূমিকায়
আমিও বিপ্লবী নাম- ততটাই লাঙলের ফলা।
তোমার পুঁজির প্রেম! অহেতুক এতো কথা বলা।
২.
কথার সবুজ বনে লুকিয়েছে তোমার বয়স।
তেঁতুল গাছের ভূত শিশুরাই শোনে অবিরাম
বিগলিত রূপকথা তুমিও কি কথার বাদাম?
কুটকুট হৃদয়ের অন্ধ লাঠি? শাসনের কষ
হঠাৎ লেলিয়ে ভাবো, মনভাঙা প্রণয়ের রস
মূলত পুলিশ! ভয়ে টপটপ পাতার প্রণাম।
আমিও বোঁটার মতো ছিঁড়ে গিয়ে ঠুকেছি সালাম।
অমূল্য প্রেমের নামে গাধারাই স্নেহপরবশ।
গাধার মনের জলে তোমাকেই ঘোলা করে রাখি;
ড্রেসিং টেবিলে তবু বহুমুখী জলো নিপীড়ন
আয়নায় ভাসে; ক্ষুব্ধ বলিরেখা থাকে না গোপন।
তুমি তো শ্রাবণসুখে সামাজিক শেকলের পাখি;
সংগ্রামের সিঁড়ি ভেঙে আমাকেই করেছো শোষণ;
যেন আমি কোল্ড ক্রিম, শরীরের মত্ত প্রসাধন।
৩.
প্রসাধন ফেলে রেখে ঘুমিয়েছে তোমার কলম
বিদীর্ণ অক্ষরে জমা আমাদের যতটা আলাপ
পণ্যের বিবিধ রঙে তারও বেশি অনবদ্য পাপ
দেশে দেশে জমা হয় রোজ। কত অনুপম
প্রেমের সদায় ব্যাগে ভরে রেখে তোমার শরম
পরাজয় ছুঁয়ে আছে। তাই এতো লেখালেখি চাপ
সইবে না। প্রেমের চিঠির মতো মগ্ন খরতাপ
কলমে জমিয়ে রেখে নীরবতা সততায় কম।
সঙ্কটের মহাকাল গুঁজে দিয়ে তোমার খোঁপায়
বিদিত সময় যেন ঘোষখোর, চুলে আবাসিক।
সুগন্ধি পয়সা মহাজোটে, তুমি আমলাতান্ত্রিক;
ঝনঝন বিক্ষোভের ভবঘুরে শব্দ শোনা যায়।
দুধমাখা হৃদয়ের কত ভাত ছড়িয়ে অধিক
মিছিল ঘনিয়ে আসে রাজপথে মনোজাগতিক।
৪.
রাজপথ কোনকালে সমধিক জনাকীর্ণ হয়?
যখন মানুষ নামে যন্ত্রণায়, সমূহ কাতর
বিক্ষোভে, অথবা আনন্দের দিনে যতটা মুখর
হলে তাড়নায় নেচে ওঠে সুখ, সকল বিজয়।
উন্মুখ শূন্যতা যেন এক পাখি; সময়ের ক্ষয়
সুরের আসরে খুনোখুনি, গুপ্ত মৃতের প্রহর
গানে গানে বলে। তুমি স্বৈরবধূ এখনও অপর।
নিজের শরীরে দেখো রাষ্ট্রজ্বর, কত ডিগ্রি ভয়!
ঘরে ঘরে সমাদৃত যাপনের শত শত ভুল
আমূল গোপনে রেখে আমরাও কেন ভালোবাসি?
ব্যাধির নিমিত্ত জেনে চোরা পথে অনেক সন্ত্রাসী
রাষ্ট্রের মাথায় বসে চিরদিন কেটে নেয় চুল।
এমন বিরূপ দিনে পোড়ামুখী মায়েরাও দাসী।
প্রেম যেন ঘাতকতা, চাকু দিয়ে কাটে হাসাহাসি।
৫.
তোমার হাসির ঘরে আমি এক কান্নার প্রহর।
বিপ্রতীপ সময়ের রঙ চুলের বেণীতে মেখে
গৌর অঙ্গে বিলিয়েছো প্রেম; শক্তি-সারথীকে রেখে
কে পায় তুমুুল অধিকার? তুমি দূরে গেছো; পর
হয়েছি নিখিল প্রলেতারিয়েত। তবুও বিস্তর
ভালোবেসে চাবুকে রেখেছি পিঠ। তোমার উল্লেখে
রক্ত মানে রুগ্ন পরাভব। জীবন অথচ শেখে:
আমাদের নিকটতা জল নয়, বিকশিত চর।
দেহে নদী, গণস্রোত, এক মনে বহু গান গাওয়া-
এমন বাতাস ঘিরে তন্ত্রও বিমুগ্ধ ছিলো কাল;
হাতের মুঠোয় নিয়ে মিছিলের ভাঙা মালামাল
উদ্বাস্তু বালির ঝিকিমিকি ছুড়ো; প্রাণে আসা-যাওয়া
স্থগিত রেখেছো বলে জনতার নিজের কপাল
সমুদ্র সঙ্কেতে ঢেউ হবে, শুরু হবে গালাগাল।
কাজী নাসির মামুন
জন্ম ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩
সহকারি অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:
লখিন্দরের গান [২০০৬, প্রকাশক: লোক]; অশ্রুপার্বণ [২০১১, প্রকাশক: আবিষ্কার]; কাক তার ভোরের কোকিল [২০১৭, প্রকাশক: প্লাটফর্ম]; রোহিঙ্গাপুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই [২০১৮, প্রকাশক: ঋজু ]; ‘লখিন্দরের গান’ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ Song of Lokhindar Translated by Ahmed S. Kaderi ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় এ্যান্টিভাইরাস প্রকাশনি থেকে।
এক সময় সম্পাদনা করতেন লিটলম্যাগ ‘মেইনরোড’