শহীদ মাহমুদ জঙ্গী একজন গীতিকবি। লিরিক লিখেন। বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের অনেক জনপ্রিয় গান তার লেখা। সোলসের ‘চায়ের কাপে’, ‘ভালোবাসি ওই সবুজের মেলা’, এলআরবির ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’, অথবা রেনেসাঁর ‘হৃদয় কাদামাটির মূর্তি নয়’, ‘হে বাংলাদেশ, তোমার বয়স হলো কত?’’—এ ধরনের বেশ কিছু পরিচিত গানের গীতিকার তিনি। বেশ কিছু একাকীত্ব, বিরহের গানও লিখেছেন। যেমন, সামিনার চৌধুরীর ‘সময় যেন কাটে না’ বা পার্থ বড়ুয়ার ‘দখিনা হাওয়া ওই তোমার চুলে’। বাংলাদেশের প্রবীণ এই গীতিকবির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও গদ্যকার নাজমুস সাকিব রহমান।
সুর হচ্ছে আল্টিমেট ছন্দ। সুরে পড়া মানে ছন্দে পড়ে যাওয়া।
নাজমুস সাকিব রহমান : বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের অনেকগুলো পরিচিত গান আপনার লেখা। একজন লিরিসিস্ট হিসেবে অনেক মানুষ আপনাকে চেনে। কিন্তু আমি যদি আপনাকে একদম অপরিচিত একটা জায়গায় ছেড়ে দিয়ে বলি, নিজের পরিচয়টা দেন—
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : প্রথমেই বলে রাখি আমি অপরিচিত জায়গায় হারিয়ে যাওয়ার আনন্দ উপভোগ করবো। পরিচয় দেয়ার দরকারটা কি? তবে দিন শেষে নিজের কাছে পরিচয় একটাই। আমিও দোষেগুণে একজন মানুষ।
সাকিব : চট্টগ্রামের তিনটা ব্যান্ড সোলস, রেনেসাঁ এবং এলআরবির সফলতার পেছনে আপনার লিরিকের ভূমিকা আছে। পেছনে ফিরে তাকালে কী মনে হয়?
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : লিরিকের কতটুকু ভূমিকা আছে জানি না। তবে এই ব্যান্ডগুলোর সাথে আমি জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ভাগ করে নিয়েছি। এই তিনটি ব্যান্ডের বেশির ভাগ সদস্যই চট্টগ্রামের। তারপরেও ব্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে গেছে। আধুনিক বাংলা গানের উত্তরণের ইতিহাস এদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
সাকিব : প্রথমেই সোলস প্রসঙ্গ। এই ব্যান্ডের সঙ্গে আপনার অনেক গান। কয়েকটি নিয়ে বলুন।
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : ৮০’র দশকে সোলসের জন্য প্রেমের গানের পাশাপাশি কিছু বক্তব্য নির্ভর কাজ করেছি। তাদের দ্বিতীয় অ্যালবামের জন্য লিখেছিলাম—‘মুক্তো মানিক পাবার আশায়, আমরা দিচ্ছি পাড়ি/ পদ্মা-মেঘনা-কর্ণফুলী, শঙ্খ ধলেশ্বরী’। এই গানটির সুর করেছিলেন তপন চৌধুরী। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়েও গান হয়েছে। ‘আণবিক আঘাতে হিরোশিমা কাঁদে, বিপন্ন নাগাসাকি/ বিবেকের ডাকে, এসো এক বাঁকে/ বন্ধ করি বিশ্বে যুদ্ধ’। এই গানটি নাসিম আলী খান প্রথমে সুর করে। পরে আমি কথা লিখি। এছাড়া ৯০ দশকের শুরুতে ‘চায়ের কাপে পরিচয় তোমার সাথে’ লিখেছি। এটাও বক্তব্য নির্ভর গান।
সাকিব : আপনার প্রিয় গীতিকার কারা?
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : সিনিয়রদের মধ্যে মীরা দেব বর্মণ। পর্যবেক্ষণ এবং সরল উপস্থাপনার জন্য ওনার লেখা ভাল লাগে। এছাড়া কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা ভাল লাগে। উনার অনেক গান সত্যিকার অর্থেই আধুনিক।
সাকিব : আমি যতটুকু বুঝি, মিউজিক্যালি বাংলাদেশের সবচেয়ে এলিট ব্যান্ড হলো রেনেসাঁ। এই ব্যান্ডের জন্য আপনি অনেক গান লিখেছেন। এর মধ্যে ‘আজ যে শিশু’ খুবই পরিচিত এবং ‘তৃতীয় বিশ্ব’ হয়তো একটু কম। যদিও ‘তৃতীয় বিশ্ব’ গানটার কম্পোজিশন রেঁনেসা যে গম্ভীরতা ধারন করে, তার পুরোপুরি বিপরীত। সম্ভবত এত লাউড কম্পোজিশন তাদের আর নেই।
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : রেনেসাঁ ব্যান্ড হিসেবে নিজস্বতা নিয়ে সবসময় একটা উঁচু অবস্থানে আছে। তারা গানের কথার ব্যাপারে অত্যন্ত চুজি। তাই তাদের গানগুলো আলাদাভাবে চেনা যায়। তারা ভালো গানকে জনপ্রিয় করেছে। ১৯৭৮ সালের দিকে চট্টগ্রামের ভাষায় আমার লেখা ‘আঁরো দেশত যাইয়ু তুঁই’ বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের প্রথম মৌলিক আঞ্চলিক গান। রেনেসাঁ সচেতনভাবেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে ব্যান্ড সঙ্গীতের মধ্যে নিয়ে এসেছে। পরবর্তীতে ‘ননাইয়া ননাইয়া কথা কই’ নামে একটা গান লিখেছিলাম। এটা প্রথম আঞ্চলিক ব্লুজ। গানটি আমি একটি করে লাইন লিখেছি। নকীব খানও একইভাবে সুর করেছে।
সাকিব : আপনি চট্টগ্রাম শহরে বড় হয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে থেকেছেন। আপনাকে যদি বলা হয়, নতুন প্রজন্মের কাউকে চট্টগ্রামে শহরে ঘোরাতে হবে। আপনি কি দেখাতে নিয়ে যাবেন তাকে?
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : প্রথমে সমুদ্র, তারপর পাহাড়। বাকি সব না দেখলেও চলবে।
সাকিব : আপনি লিরিক কীভাবে তৈরি করেন?
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : লেখার বিষয়বস্তু প্রথমে মাথায় আসে। এটা দিন বা রাতের যেকোনো সময় আসতে পারে। তারপর একটি একটি বাক্য সাজাই। ক্লিশে হয়ে যাওয়া শব্দ সচেতনভাবে বাদ দিই। অনেক সময় রেকর্ডিংয়ের আগ মুহূর্তেও শব্দ পরিবর্তন করি।
সাকিব : লেখার সময় ব্রিজ লাইন, মিটার এই ব্যাপারগুলো কি মাথায় থাকে?
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : ব্রিজ লাইন গানের চুম্বক। এটা গান লিখিয়ের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে তিনি কীভাবে ব্রিজ লাইন নির্মাণ করবেন। তবে মিটারের ব্যাপারটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। মিটার ঠিক না থাকলে সুর করা কঠিন। আমি নতুনদের প্রায় বলি, সুর হচ্ছে আল্টিমেট ছন্দ। সুরে পড়া মানে ছন্দে পড়ে যাওয়া।
সাকিব : এলআরবি ৯২’ সালে যেই ডাবল অ্যালবামের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল, তার প্রথম গান ছিল ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’। এটা আপনার লেখা একটি নাগরিক চিত্রকল্প।
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : এলআরবি বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে। আমি যখন ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ লিখি, ভাবতেই পারিনি এই গানটি দিয়ে ব্যান্ডটি পরিচিতি পাবে। বাচ্চু এটা প্রথমে সোলসের হয়ে টিভিতে গেয়েছিল। কিছুদিন পর সোলস ছেড়ে যাওয়ার সময় গানটি সে চেয়ে নেয়। পরে গানটি দিয়ে এলআরবির যাত্রা শুরু হয়।
বাচ্চু এদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতকে আমজনতার কাছে নিয়ে গিয়েছিল।
সাকিব : আপনার পছন্দের লেখক কে?
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : খুশবন্ত সিং। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে তার ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’-এর কথা। এই উপন্যাসে লেখক চমৎকারভাবে ঐতিহাসিক সময়কে ধারণ করেছেন। লেখার ধরন ও বিষয় বৈচিত্র্যের কারণে ওনার অন্য লেখাও আমার প্রিয়।
সাকিব : আগের প্রশ্নটাই যদি সিনেমা নিয়ে করি?
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : বারবার যে সিনেমা দেখেছি, তা হচ্ছে ‘গডফাদার’। মারিয়ো পুজোর উপন্যাস নিয়ে অসাধারণ সিনেমা। এখানে ক্যামেরার কাজ, মিউজিক ও অভিনয়—প্রতিটি ক্ষেত্রে দারুণ মুন্সিয়ানা রয়েছে। একসময়ের আমেরিকার বড় একটি অধ্যায় এই সিনেমায় দেখতে পাই। এছাড়া ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রায় সব সিনেমাই আমার প্রিয়। তবে ‘১৯শে এপ্রিল’ এর কথা আলাদাভাবে বলতে হবে। একসময় ‘মুঘল ই আজম’ অনেকবার দেখেছি। অল্প কিছুদিন আগে ‘চপস্টিক’ দেখলাম।
সাকিব : আপনাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, এমন কোনো ঘটনা জানতে চাই।
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : অনেক ঘটনা আছে, একটা বলি। এই সময়ের একজন লেখক একবার আমাকে বললেন, আমি আপনার পদধুলি নিতে চাই। আপনি জানেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় আপনার লেখা ‘হৃদয় কাদামাটির মূর্তি নয়’ আমাকে নতুন করে বাঁচার শক্তি দিয়েছে। এই গান না হলে আমি কোথায় থাকতাম জানি না।
সাকিব : নিজের লেখা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : মন্তব্য নেই।
সাকিব : শেষ প্রশ্ন করি। এই যে আমি আপনাকে এতক্ষণ প্রশ্ন করে বিরক্ত করলাম। নিশ্চয়ই এরকম আরো অনেকে করেন। আমাদের আপনি ‘মানুষ হও’ ছাড়া আর কি বলতে চান?
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী : আমি মোটেও বিরক্ত হই না। এনজয় করি। মানুষ তো আপনারা হয়েই আছেন। তবে অনেক ধন্যবাদ প্রিয় খাবার এবং প্রিয় পোষাক সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করেননি বলে।