বাংলাদেশে এখন যারা কার্টুন আকঁছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মেহেদী হক। সেই ছোট থেকে আঁকছেন। উন্মাদের অন্যতম একজন কার্টুনিস্ট। নিউ এইজ পত্রিকায়ও কার্টুন আঁকছেন। ঢাকা কমিক্সের পুরোধাও। লিখছেনও।লিখেছেন: কার্টুন আঁকিবার ক খ গ এবং ক্ষ, উন্মাদ-এ দেড় যুগ, আঁকিবুকির কলাকৌশল এবং আহ!কাশ্মীর(কার্টুনিস্ট নাসরীন সুলতানা মিতু-সহ লেখা) কার্টুন ও কমিক্সে সবরকমভাবে সক্রিয় তিনি, এগিয়ে নিয়েছেন অনেকটুকু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ব্যক্তিগত কথা-বাক্সে মেহেদী হকের সঙ্গে এই আলাপ…
প্রশ্ন: প্রথম কবে কার্টুন আঁকার শুরু? অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কিভাবে?
মেহেদী হক: প্রথম কার্টুন আঁকার শুরু ক্লাস টুয়ে থাকতে, তবে সিরিয়াসলি আঁকা বা ছাপা হওয়া শুরু হয় ১৯৯৬ সাল থেকে। প্রথম কার্টুন দৈনিক সমাচার-এ বের হয়। সেটা একটা রাজনৈতিক কার্টুন-ই ছিল, তখন পড়ি ক্লাস এইটে। 🙂
প্রশ্ন: প্রথম কখন ঠিক করলেন সিরিয়াসলি কার্টুনই করবেন?
মেহেদী: অনার্স পাশ করে। তার আগে পর্যন্ত সবসময় মাথায় ছিল নগর পরিকল্পনায় শিক্ষকতা করব। কিন্তু পরে মনে হলো শিক্ষকতায় আমি যা করতে পারব, তার চেয়ে কার্টুনে বেশি কাজ করা যাবে, আর এই ব্যাপারটা আমি করতে পছন্দ করি।
প্রশ্ন: আপনি তো চারুকলায় পড়েন নাই। তো স্কিল জিনিসটাকে যদি সামনে আনি কিভাবে ইমপ্রুভ করলেন? ইমপ্রুভ বলতে কি প্র্যাকটিস তো অবশ্যই আছে। মানে কাকে, কিভাবে ফলো করতেন? চারুকলার বিষয়টা বললাম এজন্য, পড়লে স্কিলটা এমনিতে বাড়ে। গ্রামার শিখতে হয় তো।
মেহেদী: একাডেমিক শিক্ষা তো অবশ্যই একটা দারুণ প্রয়োজনীয় জিনিস, কারণ একাডেমি সবাইকে একটা সাধারণ শিক্ষার সুযোগ দেয়। তবে ভাল করার জন্যে একাডেমিতে যারা পড়েন, তাদেরও নিজেকেই শিখে নিতে হয়। আমি সেটাই করেছি। নিজের আগ্রহে বইপত্র জোগাড় করেছি, প্রচুর কাজ দেখেছি, নির্দিষ্ট একজন কোন আঁকিয়ে না, আমি সব ধরনের পেইন্টার, ইলাস্ট্রেটর, কার্টুনিস্ট, ভাস্কর এমনকী স্থপতিদের কাজও ফলো করি সবসময়। ভিজুয়ালি যেটাই ভাল লাগে সেটাই দেখি, হয়ত এভাবেই দেখতে দেখতে শেখা হয়ে গেছে। আর মেথডিক্যাল শেখার জন্যে রেফারেন্স বই তো এই গুগলের যুগে একেবারেই সহজলভ্য। ইন্টারনেট-ও একটা বিরাট সুযোগ করে দিয়েছে অবশ্যই। এছাড়া মেন্টর হিসেবে সবসময় ছিলেন কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব।
প্রশ্ন:পলিটিক্যাল ইস্যুগুলোকে কার্টুনে কিভাবে ফেস করেন? একটা নিউজকে যখন কার্টুন বানাইতে হয়। বিশেষ করে এডিটোরিয়াল কার্টুনের সময়।
মেহেদী: পলিটিক্যাল ইস্যু ফেইস করার সময় সবার আগে ভাবি আমি জার্নালিস্ট, যার কোন রাজনৈতিক মেরু থাকা যাবে না। সরকারে যেই দলই থাকুক, তার কাজ হবে বিরোধী দলের মত। আর ব্যঙ্গটা কারো ব্যক্তিগত চরিত্রের ওপরে না পড়ে যেন তার অনৈতিক, অন্যায্য আচরণের ওপরে পড়ে, এই ব্যপারে আমার গুরু- মানে কার্টুনে রাজনৈতিক মেসেজ কিভাবে আসতে পারে তার দিক নির্দেশনা পেয়েছি আমার সম্পাদক নুরুল কবীরের কাছ থেকে। রাজনৈতিক কার্টুন সত্যি যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা করে করার জিনিস। ব্যঙ্গ করে মূল মেসেজটাও দেয়া হবে আবার এমনভাবে দেয়া হবে যেন যাকে ব্যঙ্গ করা হলো সে সরাসরি রাগও করতে পারলো না। আর কিছু ব্যাপার থাকে যেমন কোন কাজ আবার রাষ্ট্রদ্রোহ বা ব্লাস্ফেমির কাতারে পড়ে কিনা, কন্টেম্পট অফ কোর্ট হচ্ছে কি না। আর রাজনৈতিক কার্টুনে আরেকটা যেটা কাজ সেটা হল প্রচুর পড়া, রাজনীতি নিয়ে ভালভাবে না পড়া থাকলে রাজনৈতিক কার্টুন না করাই ভাল। সমসাময়িক তো বটেই রাজনীতির ক্রমবিকাশের ইতিহাস না জানা থাকলে কার্টুনে অনেক ‘পান’ এবং ফান করা যায় না। আমি সবসময় সেই চেষ্টা করি। একটা কার্টুন আঁকতে লাগে বড়জোর ১ ঘন্টা। কিন্তু তার জন্য পড়াশোনা বা ভাবনা কিন্তু চলে সারাদিন, মাঝে মাঝে কয়েকদিন।
প্রশ্ন:পলিটিক্যাল কার্টুন করতে গিয়ে কোন সমস্যায় পড়েছেন কখনো? আমাদের পলিটিক্যাল ক্যারেক্টারদের সহনশীলতা তো নাই বললেই চলে। কিংবা সম্পাদকের কোন সেন্সরশিপ?
মেহেদী: আমি মনে করি আমাদের নিউ এইজ হাউজ তার জন্মলগ্ন থেকেই সব থেকে আউটস্পোকেন ও নির্ভীক। আমি যেই পরিমাণ স্বাধীনতা আমার হাউজ থেকে পেয়েছি আমার জানা মতে অনেক পলিটিক্যাল কার্টুনিস্ট-ই সেটা পান না। আমি এদিক থেকে ভাগ্যবান। না, সরাসরি কোন সমস্যা হয়নি, তবে বিভিন্ন মন্ত্রী বা উর্দ্ধতন ব্যক্তি একাধিকবার উষ্মা প্রকাশ করেছেন তাঁদেরকে কার্টুন বানানোর কারণে। আর আমি মনে করি আমাদের পলিটিক্যাল ক্যারেক্টারদের একটা সময় আমাদের পূনর্মূল্যায়ন করতে হবে। তাঁদের বরং অনেক ক্ষেত্রেই অনেক বেশি সহনশীলতা আছে, মোটা দাগে দেখলে আমাদের আগের সরকার (হিন্দু, মোগল, বৃটিশ, পাকিস্তান) যথাক্রমে মনার্কি, সাম্রাজ্যবাদী আর সামন্তবাদী ধারার ছিল। আমরা কিন্তু বলা যায় প্রথম জেনারেশন- যারা তুলনামূলক গণমুখী মানুষদেরকে রাজিনীতিবিদ হিসেবে পাচ্ছি। সুতরাং এই মডেলে কিন্তু তারা আরো বেশি সহনশীল হতে বাধ্য। তবে সবই আপেক্ষিক বলে আমাদের মনে হতে পারে – তাঁরা সহনশীল নন।
প্রশ্ন:আমাদের দেশের কার্টুনকে কিভাবে মুল্যায়ন করেন? আগে যারা করতেন, যেমন সেই কাজী আবুল কাশেম থেকে এখনকার সমসাময়িকদের কথা যদি তুলি–
মেহেদী: আমাদের দেশের কার্টুন এখন বেশ ভাল অবস্থানে আছে, সবচেয়ে দারুণ যেটা ঘটছে অনেক তরুণ এখন কার্টুনিস্ট হবার জন্যে আসছে। এটা আমাদের সময়ে কল্পনা করাও কঠিন ছিল। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে যাবার সুযোগ ঘটেছিল মাঝখানে, সেখানে এত বিরাট কার্টুনের ইতিহাস থাকলেও বর্তমানে একটা বড় সংকট; আগের মহারথীরা পরের প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে যেতে পারেননি। তরুণ কার্টুনিস্ট ওখানে বিরল। এমনকী যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাট ভের্কার যে এসেছিলেন- আমেরিয়াকন পুলিতজার উইনার কার্টুনিস্ট- তিনিও জানালেন ওদের ওখানে সিন্ডিকেশন কালচারের কারণে নিউজ পেপারগুলি কোন কার্টুনিস্টকে চাকরি না দিয়ে সিন্ডিকেট থেকে কম মূল্যে একই কার্টুন একাধিক পত্রিকা ছাপাচ্ছে। ফলে তাঁদেরও জব মার্কেট ভালো না, ওদিকে তরুণরাও উঠতে পারছে না। নেপালেও একই অবস্থা। হয়ত আমাদের এখানেও এক সময় এমন হবে, তবে আমি মনে করি এটা আমাদের উত্থানপর্ব। সমান্তরালে চলছে কমিক্স, এনিমেশন। আমাদের মূল শক্তি আমাদের তরুণসমাজ, আর আমাদের দুর্বলতা তরুণ সমাজের অস্থিরতা। তবে সময়ে সব ঠিক হবে।
প্রশ্ন: আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, শিশির পরবর্তী কার্টুনিস্টদের উপর শিশিরের প্রভাব ভয়াবহ? মানে মোটাদাগে বললে আর কি। এটাকে কিভাবে দেখেন?
মেহেদী: সেটা বটেই, এবং এটা খুবই স্বাভাবিক। তথাকথিত উন্নত দেশে কার্টুন স্কুলিং যেখানে হয় সেখানে কিন্তু এটা আরো স্বাভাবিক। যেমন ডিজনি স্কুল- সব আঁকিয়ে একটা স্টাইল-ই মাস্টার করে, মিয়াজাকির ঘিবলি স্টুডিও, তেজুকা’র বিগ আই স্টাইল। আমাদের এখানে প্রথম চমৎকার আঁকা যেটার আইডিয়া ছাড়াও আঁকাটাই একটা শিল্পগুণ দাবী করে সেটা কিন্তু শিশির স্যারই করেছেন। পরের প্রজন্ম সেটাকে এড়াতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু কার্টুন নিয়ে কোন একাডেমি এখনও নেই তাই ক্যারিকেচার অনেকে শিখেছে শিশির ভট্টাচার্য্যের আঁকা দেখে দেখে। এটা অবশ্য কোন ইন্ডিভিজুয়াল আঁকিয়ের জন্য ভাল কথা না, সবারই একটা নির্দিষ্ট স্টাইল থাকা উচিত। আগে যাদের নাম করলাম বাইরের সেগুলি কিন্তু এনিমেশন স্টুডিও, তাই অনেক আর্টিস্টকে একইভাবে আঁকতে হতো। এই মুহূর্তে শিশির স্যারের প্রভাব তরুণদের আঁকায় থাকলেও আমি খেয়াল করছি এটা অনেকটা কমতে শুরু করেছে। ইন্টারনেটের রেফারেন্স সম্ভবত একটা বড় কারণ।
প্রশ্ন: অনেক দেশে শুনেছি, কার্টুন শেখার প্রতিষ্ঠান আছে। আমাদের তো নাই। দরকার আছে একাডেমির? কি মনে করেন?
মেহেদী: একাডেমি অবশ্যই জরুরী। তবে সেটা থাকলেই যে সবাই ভাল কার্টুনিস্ট হবে তা কিন্তু না। যারা হবার তারা হবেই, হয়ত তারা একাডেমিতে সুযোগ পেলে অনেক দ্রুত অনেক ভাল করবে, ভিশন বড় হবে। একাডেমির দরকার আছে। আমরা নিজেরাই কিন্তু একটা স্কুলিং শুরু করেছি, কার্টুন, কনসেপ্ট আর্ট আর এনিমেশন স্কুলিং, সেটার নাম ‘আঁকান্তিস’। দেখা যাক কী দাঁড়ায়।
প্রশ্ন: অ্যাজ এ প্রফেশন, কার্টুন আঁকা কেমন?
মেহেদী: অবশ্যই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মতো স্যালারি আমাদের না, তবে শেষ ওয়েজ বোর্ড আমাদের বেশ ভাল একটা অবস্থানে তুলে দিয়েছে, আর প্রফেশন হিসেবে আমি মনে করি এটা সব থেকে আরামের প্রফেশন। অফিস এনভায়রনমেন্ট ঝামেলা সব জায়গাতেই থাকে তবে এখানের স্বাধীনতা অনেক। যদিও এটা আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। অন্যদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে।
প্রশ্ন:আরকেটা যেটা মনে হলো, আমাদের পলিটিক্যাল কারেক্টার নিয়ে, কার্টুনিস্টদের ক্রিটিক্যাল কোন থিংকিং নাই তেমন। ক্রিটিক্যাল বলতে বোঝাচ্ছি, তারা খুব একটা অন্যভাবে পলিটিকসটাকে আমাদের দেখান নাই? অনেকটাই এজ ইজুয়্যাল। আপনার কি মনে হয়?
মেহেদী: এটা কিছুটা সত্য, এটার একটা বড় কারণ আমি মনে করি কার্টুনটাকে হাল্কাভাবে দেখা। এটা যে কতটা সিরিয়াস রাজনৈতিক প্রতিবাদের একটা ভাষা এটা কার্টুনিস্টদেরই মধ্যে পরিষ্কার না। এ জন্যেই হয়ত একাডেমি জরুরি। রাজনৈতিক কার্টুনের ইতিহাস কয়জন কার্টুনিস্ট পড়েছে খোঁজ নিলেই সেটা বোঝা যাবে। এটা অনেকের কাছেই ছিল অনেকটাই টাইম পাস ধরনের কাজ, অতটা সিরিয়াসলি নেয়া কার্টুনিস্ট কিন্তু খুব একটা ছিলো না, উইট আর ভাঁড়ামি’র সীমারেখাটাও অনেকের কাছে পরিষ্কার না। এ ব্যাপারে সবথেকে অসাধারণ ছিলেন কাজী আবুল কাশেম আর কামরুল হাসান। দু’জনেরই একটা কমন জায়গা ছিল, দু’জনই রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সাক্ষী, গণমানুষের সাথে যোগাযোগ ছিল। নিজেদের রাজনৈতিক আইডিয়া পরিষ্কার ছিল। আমাদের ‘আই হেইট পলিটিক্স’ প্রজন্ম থেকে ওইরকম কাজ আশা করা কঠিন। তবে আশার কথা এই কমিউনিটি বড় হচ্ছে, মার্কেট তৈরি হচ্ছে। হয়ত দ্রুতই ভিন্ন ধারা কাজ শুরু হবে। আসলে মানুষ সময়ের বাই প্রোডাক্ট। সময় ঠিক করে দেবে কখন কী হবে।
প্রশ্ন:আমাদের কমিকসের কি অবস্থা? আপনি নিজেও কমিকসের সাথে যুক্ত।কাজ করতেছেন? আপনার অবজারভেশন কি রকম? সমস্যা বা সম্ভাবনা?
মেহেদী: আমাদের কমিক্স তার যাত্রা শুরু করেছে। যদিও অনেক আগে থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা কিছু প্রকাশনা থেকে কমিক্স আমাদের দেশে হয়েছে ও হচ্ছে, তবে একেবারে কোমর বেঁধে মৌলিক বাংলাদেশি কমিক্স শুরু হয়েছে বলা যায় ঢাকা কমিক্স থেকেই। সত্যি বলতে আমাদের দেশের কমিক্সের মান বেশ ভাল। আর ঢাকা কমিক্সের সবথেকে বড় অর্জন আমি মনে করি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস এনে দেয়া, যে আমরা চাইলেই পৃথিবীর সেরা মানের কাজ করতে পারি। এটা খুবই জরুরী। দেশের আনাচে-কানাচে থাকা অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ আঁকিয়ে কমিক্স দেখে উৎসাহিত হয়ে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে করে পাঠাচ্ছে। সমস্যা একটাই, সেটা হলো আমাদের দেশে পত্রিকা-পুস্তক বিতরণে একেবারে অপেশাদার একটা গোষ্ঠী মাফিয়ার মতো বসে আছে। এরা শিক্ষায় ও প্রযুক্তিতে মডার্ন না হওয়া পর্যন্ত পত্রিকা-পুস্তক ব্যবসা বর্তমান অবস্থা থেকে দাঁড়াবে না। ওদিকে ‘ডিজিটাল’ বাংলাদেশে ডিজিটালি মনেটাইজেশন মানে অনলাইনে টাকা দেয়ার সহজ কোন উপায় না থাকায় সেটারও কোন উপযোগিতা এখনও নেই। তবে আমরা আশাবাদী। সুসংবাদ যে- অচিরেই আমরা আন্তর্জাতিক কমিক্স মেলায় বাংলাদেশের কমিক্স নিয়ে যোগ দিতে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: উন্মাদ নিয়ে কিছু বলুন। আমাদের একমাত্র কার্টুন পত্রিকা। প্রথমও মে বি। আপনি তো যুক্ত আছেন। উন্মাদের কাজের প্রসেস আরও যা যা আছে আর কি।
মেহেদী: উন্মাদ নিয়ে বলতে গিয়ে তো গত মেলায় রীতিমত একটা বই লিখে ফেলেছিলাম, আমাদের দেশ যেসব জিনিস নিয়ে গর্ব করতে পারে আমি মনে করি ‘উন্মাদ’ পত্রিকা তার মধ্যে একটা। এর সবথেকে দারুণ ব্যাপার হলো একেবারে এদেশি পদ্ধতিতে একটা হাউজ ডেভেলপ করা। পুরো কৃতিত্ব আহসান হাবীব-এর, বাংলাদেশের কার্টুন একাডেমি হিসেবেও এই একটা পত্রিকাই কিন্তু কাজ করে গেছে। আর ভিন্নধর্মী কাজের কথা বলা হচ্ছিলো, উন্মাদের মতো এমন ভিন্নধর্মী স্যোসিও-পলিটক্যাল স্যাটায়ার এত বছর ধরে আর কে করেছে? সরাসরি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা ঘটনাকে স্যাটায়ার না করেও যে কতভাবে স্যাটায়ার করা যায় এই পত্রিকাই সেটার প্রমাণ। উন্মাদের কাজের প্রসেস আসলে অদ্ভুত, অফিসে সবাই কিন্তু কাজ করে না। মূল কাজ হয় আড্ডার মাধ্যমে সেখান থেকেই আইডিয়া আসে। সেটা টাইপ করে নিয়ে ব্ল্যাঙ্ক ফ্রেমগুলি কার্টুনিস্টদের ধরিয়ে দেয়া হয়, অনেকেই যে যার বাসা থেকে কাজ করে দেয়, ইদানিং ডিজিটালি আঁকা কাজ মেইলে চলে আসে। আর মূল কাজটা হয় মাসের ১৫ থেক ২৫ তারিখ।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে এতো টিভি চ্যানেল, একটাও কার্টুনের চ্যানেল নাই। একটা কার্টুন চ্যানেল হলে কীরকম উপকার হতো?
মেহেদী: এতো টিভি চ্যানেলই সম্ভবত এর জন্যে দায়ী। অতিরিক্ত টিভি চ্যানেলের কারণে কোন প্রোগ্রামই যথেষ্ট দর্শক পায় না। ফলে বিজ্ঞাপনের হার অনেক কমে গেছে। এর কারণে এনিমেটেড কার্টুন বানাবার যেই খরচ সেটা কোন চ্যানেলই দিতে রাজী হয় না। আবার গোটা একটা চ্যানেল শুধু কার্টুন দিয়ে- মানে বাংলাদেশি কার্টুন দিয়ে করে ফেলার মতো এত কার্টুন আমরা হুট করে বানাতে পারবোও না। সে ক্ষেত্রে হাইব্রিড- মানে কিছু বিদেশি বাংলায় ডাবিং করে আর কিছু দেশি কার্টুন নিয়ে চ্যানেল হতে পারে। কয়েকজন কিন্তু আমাদের কাছে এসেছিলও এই আইডিয়া নিয়ে, কিন্তু তাঁদের যেটা সমস্যা বোঝা গেল যে, তাঁরা কার্টুন ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা ওয়াকিবহাল নন, বরং ব্যবসা কিভাবে হবে সেটা নিয়ে বেশি চিন্তিত। কাজ ভাল করলে যে ব্যবসা এমনিতেই আসে, সেটা সম্ভবত আমাদের পরের প্রজন্ম থেকে বোঝা শুরু হবে।
প্রশ্ন:কার্টুনিস্ট হিসাবে সমাজে কিরকম ট্রিটমেন্ট পান? ব্যাপারগুলা কি ভালো লাগার?
মেহেদী: বেশ সুখকর ট্রিটমেন্ট। ভাল লাগার তো বটেই। দীর্ঘদিন আঁকার ফলে যেটা মজা লাগে হঠাৎ প্রায় সমবয়সী কেউ বলে আমি ছোটবেলা থেকে আপনার কার্টুনের ভক্ত। আসলে আমিও তো ছোটবেলা থেকেই আঁকছি।
প্রশ্ন: যদি কার্টুনিস্ট না হইতেন?
মেহেদী: তাহলে লেখক হতাম। আমি মনে করি আমি একজন অলস লেখক। পাঁচ হাজার শব্দের আর্টিকেল মাথায় আছে, কিন্তু আলসেমী করে সেটা কার্টুনে সেরে ফেলি। অবশ্য এখন না চাইলেও কমিক্সে অনেক লিখতে হচ্ছে 🙂
প্রশ্ন:কার্টুন ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলা কি পিছিয়ে আছে? তাদের ভূমিকা কীরকম হতে পারতো?
মেহেদী: আগের থেকে বরং ভাল অবস্থা। তবে কার্টুন ট্রিটমেন্ট ভাল হতে হলে অবশ্য সম্পাদক সবথেকে বড় ব্যাপার, তাঁর রুচি কেমন, সে কতটুকু শিক্ষিত তার ওপর নির্ভর করে কার্টুন কেমন হবে। অনেক বড় হাউজের কার্টুনিস্টদের থেকে আমি অভিযোগ শুনি যে, অনেক ভাল কার্টুন তাঁরা ছাপানই না। আসলে তাঁরা ওইটা বোঝার মতো শিক্ষিতই নন। কার্টুন একটা ভাষা, সেটা না বুঝলে তো সমস্যা হবেই। যদিও তাঁদের ভূমিকা আগের থেকে ভালো, বেশ কিছু ফান সাপ্লিমেন্ট বের হচ্ছে এখন। সবগুলির কন্টেন্ট যে সুরুচিকর বা ভাল তা বলা যাবে না, কিন্তু এতে করে মান যাচাই করার সুযোগ আসছে পাঠকের কাছে।
প্রশ্ন:সামাজিক আন্দোলনে কার্টুন তো শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। আপনি কি সেই দায়বদ্ধতা থেকেও আঁকেন?
মেহেদী: অবশ্যই, আমাদের দেশের ইতিহাসে সামাজিক আন্দোলনে বেশ অনেকবার এর ব্যবহার হয়েছে। আমি তিনটি কারণে আঁকি-
এক-ভাল লাগে তাই (কনসেপ্ট আর্ট, স্কেচবুক, কমিক্স)।
দুই- অনুরোধে।
তিন- সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বোধ থেকে। (পলিটিক্যাল কার্টুন) ।
বেশ কিছু ঘটনায় কিন্তু শুধু দায়বোধ থেকেই কাজ করা হয়। টিপাইমুখ বাধবিরোধী আন্দোলন, তেল গ্যাস রক্ষা কমিটির জন্যে, গাজা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে, বিশ্বজিৎ হত্যার প্রতিবাদে, নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে কার্টুন এঁকেছি। সামনেও আঁকব সবসময়।
প্রশ্ন:আমাদের ছোটদের কাছে কার্টুন কিন্তু খুব প্রিয়। এখন কেউ যদি কার্টুনিস্ট হইতে চায়, কি পরামর্শ দেবেন?
মেহেদী: পরামর্শ হলো প্রচুর কমিক্স পড়া, কার্টুন দেখা, প্রচুর বই পড়া- ফিকশন, নন-ফিকশন সব। আমাদের কার্টুন কোর্সে অনেক ছোট ছেলে-মেয়েরা আসে তাদের আমি জিজ্ঞেস করি যে সে কার্টুন দেখে কিনা, অনেকেই উত্তর দেয় – ‘না’। তাহলে কেন এসেছো? বলে আব্বু-আম্মু বলেছে। এটা একই সাথে মজার যে এখন বাবা-মারা কার্টুন আঁকতে উদ্বুদ্ধ করছে আবার ভীতিকর -কারণ বাচ্চা সেটা চাইছে কিনা সেটা তাঁরা দেখছেন না। যাই হোক, আশা করি দিন দিন আমরা ভাল’র দিকেই এগিয়ে যাব।
শিরিষের ডালাপালায় বসা সবাইকে শুভেচ্ছা।