মুহম্মদ ইমদাদের কবিতা

মা

যে জমিতে আয়ু ফলে তার নাম জরায়ু।

 

 

পৃথিবীর বাইরে থেকে আমি ফোন ধরতে পারি না

 

ট্রেন আসবে

তাই অপরিচিত ইস্টিশনে

বসে ছিলাম চারশো বছর

আরো চারশো বছর বসে থাকতাম

কারণ ট্রেন আসবে, আমি জানতাম

কিন্তু হাঠাৎ কে ঘোষণা করলো

‘ট্রেন আসবে না?’

আমি কোনোদিন ট্রেন না-আসার খবর জানতে চাই নাই

আসুক বা না-আসুক

চিরদিন নিজেরে বলে গেছি, ‘ট্রেন আসবে’

এখন অপরিচিত এই ইস্টিশনে আমি

কী কারণে থাকবো, কীসের অপেক্ষায়?

সকল যেতে চাওয়া লোক চলে গেছে

অন্য পথ অন্য পরিবহনের খোঁজে

খোঁজ পেয়েও গেছে

পৌঁছে গেছে

বৃষ্টিভেজা কামিনীফুলের কাছে

চালতাফুল

কামরাঙাফুল

নিমফুল

জলপাই ফুলের কাছে

আর বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে

আর আমি অর্থহীন ইস্টিশনে

‘কোথাও যাবার নেই’ এমন কয়েকটা মানুষের কাছে

যাদের আলাদা আলাদা কোনো নাম নাই

যাদের সকলেরই একই নাম ‘পাগল’

আমি পাগলের পাশে

পাগল হতে চেয়ে

পাগল হতে না পেরে

প্রথমে শহরে

পরে শহরের পাশের গ্রামে

পরে গ্রামের পাশের বিজনে

বসে থাকি

বসে বসে আম্মাকে ভাবি

ভাবি, কোন মুখে বাড়ি ফিরে যাই

যখন আমার বাড়ি ফিরতে লজ্জা লাগছে খুব

তখন দূর থেকে কারা আমারে দেখে ফেলে

আর ধরে নিয়ে যায়

চোর সন্দেহে মারধর করে

আমার জুতা খুলে নেয়

বলে, আমি জুতা চোর

আমার জামা খুলে নেয়

বলে, আমি জামা চোর

আমার চোখ খুলে নেয়

বলে, আমি চোখ চোর

একে একে তারা আমার

হাত, পা, জিব, চুল, নাক, কান

স্মৃতি ও স্বপ্ন খুলে নিয়ে

কোথায় যেন ফেলে দেয়

আমি জানি না!

পৃথিবীতে

আমার ছেলে আমাকে খোঁজে, পায় না

বউ আমাকে খোঁজে, পায় না

আব্বা আমাকে ফোন করেন

আম্মা আমাকে ফোন করেন

পৃথিবীর বাইরে থেকে

আমি ফোন ধরতে পারি না

 

 

 

আম্মাকে লেখা চিঠি

 

আম্মা,

ফোন করলেই আমি যে বলি—ভালো আছি,

তা সবসময় সত্য না

এই যে আমি মিথ্যা বলি

এই কথা আব্বাকে বলো না।

শুধু দোয়া করো

মানুষ যেনো আমাকে ভালোবাসে।

মানুষ আমাকে ভালোবাসে না—

এই কথা কীভাবে বলি,

বলতে লজ্জা লাগে।

তবু ,

এমনকী ভাতও কেড়ে নিতে চায়

পৃথিবী এমন জানলে আমি বাড়িতে

তোমার কাছে থাকতাম

মনু গাঙে মাছ ধরতে যেতাম

তুমি মাছ দেখে হাসতে

এই হাসির দাম আমার একশো একটা জীবনেও

রোজগার করতে পারবো না, জানি

অথচ এই পৃথিবীতে তুমি-আমি একই সকালে জাগি

তবু দেখা হয় না প্রতিদিন, দূরে থাকি

রোজগার করতে চেয়েছি অন্য কারো কারো হাসি

তারা হাসে নাই

কারণ আমি তাদের নিজের ছেলে না

বরং তারা দলবেঁধে নেমেছে আমার কবর খুঁড়তে

আম্মা, আমি তো এখনো মরি নাই

এরা কী আমাকে জীবন্তই কবর দিয়ে দিবে?

আম্মা, শোনো, চুলায় লাকড়ি দিতে দিতে তুমি যে কবিতা বলতে

ক্লাস ওয়ান-টু’র আমাকে

সেই কবিতার সৌন্দর্য় আমাকে এখনো ঘিরে রেখেছে

ফলে ভালো না-থেকেও বলি ভালো আছি

বলতে বলতে ভাবি,

বড় গাছের ছায়ায় ছোটো গাছ বাঁচে না, মরে

কিন্তু তুমিও তো বড় গাছ

কেমনে বাঁচালে

 

 

আম্মা, চিন্তা করো না

আজই হয়তো লিখব অমর একটি কবিতা

যে কবিতাটি কোনো কবরই মানে না

ভেঙে বেরিয়ে যায় চাঁদের দিকে

চিরকালের দিকে

 

 

ইতি

তোমার ইমদাদ

 

 

 

মাছের চোখে পানি

আব্বা আমাকে নিয়ে নদীতে যেতেন
আব্বা কোমর পানিতে নেমে জাল উড়াতেন।
আমি পারে দাঁড়িয়ে মনে মনে দোয়া করতাম।
আব্বা জাল টানতেন। আমি তার মুখের দিকে তাকাতাম।
আব্বার মুখে হাসি দেখে বুঝতাম জালে মাছ আছে।
মাছ ব্যাগে ভরতে ভরতে আমার খুব আনন্দ হতো।
আমাকে আর আব্বাকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হতো।
আমি বুঝতাম না নদীর সবচেয়ে দুর্ভাগা মাছটা আমার হাতে বন্দী।
আমি বুঝতাম না আমার হাতে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে মাছটি।
আমি বুঝতাম না নদীর পানি তখন বেড়ে গেছে
বুঝতাম না এই বেড়ে যাওয়া পানি জীবিত মাছগুলোর চোখের পানি

 

 

 

অধ্যাপক

ওহে অধ্যাপক,
একটা পাখির ২টা পালক ঝরে গেছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাথায়
তাদের পৌঁছে দিতে পারবা ফের পাখির ডানায়?

ভাষা চিনো?
জলপাই পড়াইতে পারো?
মেঘের অক্ষর?
কবরের উপর জোনাকি, তাদের স্বপ্ন?
পাতাবাহার কাকে বলে?
কাকে বলে যমুনা?
সংক্ষেপে বলো তো শুনি, দুধ ও ভাতের ডেফিনেশন।

বিষ পড়াতে পড়াতে বিষধর হয়ে গেছো হে
ফুলরে বানাচ্ছো সাপ।
হে গবেষক, মৌমাছির দিকে তাকিয়ে দেখো
কে বেশি শিক্ষক!

 

 

 

বুকের ওপর লিপস্টিকের গাছ

আমি সভ্য মানুষ।
আগে অসভ্য ছিলাম
অসভ্য থাকার সময় লিপস্টিক
সাবান শ্যাম্পু ইত্যাদি লাগতো না
এখন লাগে
সভ্য মানুষের সভ্যতা লাগে
ঘড়ি/সোফা/ফ্রিজ/তালা/টিভি/টুথব্রাশ
এবং আরো ৭ লাখ ৭০ হাজার ৪৯২টা জিনিস
ভাবছিলাম এগুলো গাছে ধরে
গাছ লাগানোর জন্য জমি পাই নাই
সব বিক্রি হয়ে গেছে
(কার জমি কে বিক্রি করলো কে জানে)
দেখি জিনিসগুলো দোকানে আছে
কিনতে টাকা লাগে
আমার টাকা নাই
ফলে আমি মলম পার্টিতে যোগ দিই
একদিন ধরা পড়ি
এখন অবস্থা এমন যে উঠে দাঁড়াতে পারি না
কিন্তু জিনিসগুলো আমার চাই-ই
ভাবছি আমার সাড়ে তিন হাত শরীরই আমার জমি
বুকের ওপর একটা লিপস্টিকের গাছ
পেটের ওপর একটা ফ্রিজের গাছ
মুখের ভিতর একটা টিভির গাছ
হাঁটুতে দুইটা সোফর গাছ লাগাবো…
শরীরের যা অবস্থা
গাছগুলো বাঁচবে কি না, ভাবছি।
ভাবছি, ফল ধরবে কি না

 

 

 

একটা নয়নতারা ফুল ফুটেছে অথবা ফোটেনি  

 

আব্বার কিছুই আমরা পছন্দ করতাম না, স্বপ্ন ছাড়া। আব্বা খুব চালাক ছিলেন। দূর এক দেশের গল্প বলতেন। রঙিন। পাখিওড়া। গান-গুঞ্জরিত এক দেশ। আমরা সে দেশে যাবো বলে ভাবতাম। এবং চারপাশে, দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে থাকা আম্মার গেরস্থালির দিকে ফিরেও তাকাতাম না। আমরা তাকাতাম আব্বার স্বপ্নের দিকে।

 

এখনো, সেই স্বপ্ন আমাদের ঘিরে রেখেছে। আমরা ভাইবোনেরা সেই স্বপ্নের ভিতর বসে আছি…। আমাদের ঘিরে রাখা স্বপ্নের চারপাশে পড়ে আছে আমাদের যার যার নিজস্ব গেরস্থালি, দারিদ্র্যসীমার একটু নিচে, লাজুক ও মৌন, তাতে একটা নয়নতারা ফুল ফুটেছে অথবা ফোটেনি   

 

 

 

একদিন পৃথিবীতে নদীর জন্ম হতো খুব

 

নদী তো পাহাড়ের মেয়ে।

সাগরে যাবে বলে একদিন

মাকে না বলে বেরিয়ে পড়ে…

আর

তৃষ্ণার্ত মানুষ এসে তার পাশে দাঁড়ায়

সে পিপাসা মেটায়।

বিনিময়ে বিষ পান করে নদী

মানুষ করায়

তারপর শুরু করে ক্রয়-বিক্রয়

এখনো বাজারে নদী পাওয়া যায়

মরা নদী

কেউ কিনতে আসে না

লাশ কিনতে যাবে কে?

নদীর বীভৎস লাশ নিয়ে বসে আছে

পৃথিবীর নদীবিজ্ঞান

সৎকারের পদ্ধতি পাচ্ছে না।

গবেষণা চলছে। একদিন পেয়ে যাবে।

 

নদীর জন্মের খবর শোনা যায় না।

কারণ, মানুষের পায়ের গন্ধে, সেই কবে

পাহাড়ের গর্ভ থেকে উধাও হয়ে গেছে

পৃথিবীর সম্ভাব্য সব নদী।

 

নদী হত্যার সংবাদ শোনা যায়।

শোনা যায়,

একদিন পৃথিবীতে নদীর জন্ম হতো খুব।

 

 

 

পাখির জুতা নাই

 

পাখির জুতা নাই।

পাখি তাই খুশি।

খালি পায়ে ওড়ে।

মাঝে মাঝে হাঁটে।

পাখি গরিব। ঘর নাই।

ন্যাশনালিটি, পাসপোর্ট নাই

পাখি খুশি। বন্দুক নাই। বোকা।

বুদ্ধি নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নাই।

চাকরি নাই।

পাখি যারপর নাই খুশি। জামা নাই।

জামার পকেট নাই। পকেটে পয়সা নাই। ছুরি নাই।

গান গায়। ওড়ে। হাঁটে।

মাঝে মাঝে মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে বসে হাসে।

দেখে তারা পোশাক/খাদ্য/জুতা প্রকৌশল

দেখে তারা রিকশা/রাষ্ট্র ইত্যাদি বিজ্ঞান

দেখে তারা প্রতিষ্ঠিত হতেছে।

পাখি খুশি। ডানায় জাহাজ। পোশাক। বিমান। গাড়ি।

মানুষের দুঃখে সে কাঁদে একলা একলা রাতে।

সকালে তাই ঘুম ভাঙাইতে আসে।

 

 

 

গ্লাসে পানি খেতে খেতে আপনি অনেকটা গ্লাস হয়ে গেছেন

 

মালি শুধু মালি না কিছুটা ফুলও

সৈনিক শুধু সৈনিক না, একটু রাইফেলও।

ড্রাইভার একটু গাড়িও।

 

ফলে কী হয়?

ফলে আপনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে

আশা করেন, আমি একটু আপনার মতো

মানে আপনার চোখের মতো দেখি ধান পাখি নারী আকাশ ও স্বপ্ন।

কিন্তু আমি আমার চোখ দিয়ে হয়তো কিছুই দেখি না।

হয়তো দেখি আপনার অসুখ ও মৃত্যুর সম্ভাবনা।

ফলে আপনি ভয় পেয়ে যান।

আমার থেকে দূরে সরে যেতে যেতে ভাবতে থাকেন,

প্রতিটি মানুষই একটা একটা ভিন্ন প্রাণি

কেউ হরিণ কেউ বাঘ কেউ শুয়োর কেউ মাছ

কেউ গাছ কেউ জিরাফ কেউ সাপ কেউ শকুন কেউ মাছরাঙা কেউ…

 

কারণ কসাই একদিন নিজেরে জবাই করবে আমরা জানি

কারণ শিকারি একদিন নিজেরে গুলি করবে আমরা জানি

কারণ জেলে একদিন নিজেরেই আবিষ্কার করবে তার জালে আমরা জানি

কারণ শিক্ষক একদিন পড়া না পারার অপরাধে নিজেরেই পেটাবে আমরা জানি


মুহম্মদ ইমদাদ

কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক

জন্ম ৬ জানুয়ারি ১৯৭৮

কটারকোনো, মনু, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি ও লোকপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর।

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ :

কবিতা : অন্ধ পৃথিবীর জানলাগুলি, নদীমাতৃক পৃথিবী মেঘমাতৃক আকাশ, প্রেগন্যান্ট পাগলি ও অন্যান্য কবিতা।

অনুবাদ : চূর্ণচিন্তন, দূরাগত স্বর, আর্থার শোপেন হাওয়ারের কথাগুলি

প্রবন্ধ : আধুনিক কবিতা বিষাদবৃক্ষের ফুল ও অন্যান্য প্রবন্ধ

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস : এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে।

শেয়ার