“মুচিও তার ফাইনেস্ট ফিনিশিং দিতে চায় চামড়ায় আর কবি দেয় তার ভাষায়” – হাসান রোবায়েত

দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চার পরিবেশ নেই। প্রতিষ্ঠান আর স্বঘোষিত সাহিত্য-মোড়লদের থেকে মুক্তির জন্য চাই আলাদা প্ল্যাটফর্ম আর নিজের লেখাটি লেখার এবং নিজের কথাটি বলার সাহস। এই প্রজন্মের সেই সাহস আছে। তারা প্রতিষ্ঠিত ভ্রান্তিকে তীব্র আঘাতে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে চায়। সেই বিশ্বাস থেকেই আমরা আড্ডা দেয়া শুরু করেছি। সমালোচনা করছি নিজেদেরই। শুরু করেছিলাম রাজীব দত্তকে দিয়ে।এবার আড্ডা হয়ে কবি হাসান রোবায়েতকে কেন্দ্র করে। রোবায়েতের সঙ্গে আলাপচারিতাতেও সবার কণ্ঠেই যেন ভাঙাগড়ারই আহ্বান। তা আত্মবিশ্বাসী, ক্ষ্যাপা এবং যৌক্তিক। রোবায়েতকে ঘিরে আড্ডা দিয়েছেন আরো দশজন কবি। শুধু পিঠ চাপড়ানো নয়, সমালোচনার তীব্র বাণ ছুটে গেছে তার দিকে। রোবায়েত উল্টো তীর ছুড়েছেন। আলোচনায় উচ্চারিত হয়েছে এমন কিছু, বাংলা কবিতা নিয়ে যেসব কথা খুব কমই হয়েছে। অথবা কখনোই হয়নি এসব কথা। রোবায়েতের সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন ফয়সাল আদনান, অনুপম মণ্ডল, রাজীব দত্ত, রুহুল মাহফুজ জয়, রাসেল রায়হান, মোস্তফা হামেদী, হাসনাত শোয়েব, ফারাহ্ সাঈদ, হুজাইফা মাহমুদ ও শিমন রায়হান। এই আলাপচারিতা যতটা সাক্ষাৎকার, তারচেয়েও বেশি আড্ডা। চলুন, আড্ডা দেয়া যাক।


কবিতা তো মেকানিক্যালি বানানো যায় বলে মনে হয় আমার। এইটাও আসলে এক ধরনের ভাষিক দক্ষতা। আমি তো কবিদেরকে ভাষা-প্রকৌশলী বলে মনে করি।


ফয়সাল: রোবায়েত, এইটা আমার যেকোন ফর্মাল সেটিংয়ে প্রথম সাক্ষাৎকার নেয়া। তো আপনি প্রথম সাবজেক্ট।

রোবায়েত: আমারও তেমনি। প্রথম দেয়া। হা হা!

ফয়সাল: কেমন লাগছে এরকম একটা ব্যাপার? মানে সাক্ষাৎকার?

রোবায়েত: ভালোই। তবে অন্যরকম। ঐ কিছুটা নার্ভাস টাইপ আর কি!

ফয়সাল: আমার প্রথম সিরিয়াস প্রশ্ন, কবিতার কম্যুনিকেটিভ হওয়াটা কত গুরুত্ব রাখে আপনার কাছে?

রোবায়েত: কোনো গুরুত্বই রাখে না। কবিতা একটা মায়া। তো এইটারে আসলে কানেক্ট করা বা না করার কিছুই নাই। সেইটা যে যার যার মতো করে নেয়। না করে নিলেও কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না।

রাজীব: মায়া বলতে কি বুঝতে চান?

রোবায়েত: এক ধরনের টান। যেইটা আসলে ঠিক ব্যাখ্যা করা সম্ভব না মনে হয়।

ফয়সাল: তাহলে কবিতা আর পাঠকের মাঝে দূরত্ব রাখতে চান আপনি এমন কি ধরে নিবো? কবিতার ভাষা বিষয়ে তাহলে কি ভাবনা আপনার? ভাষাকে আপনি ঠিক কিভাবে ডিকন্সট্রাক্ট করতে  চান আপনার কবিতায়? বা আদৌ চান কিনা? আর মায়া তো একটু ভ্যাগ হয়ে গেলো, স্পেসিফিক হওয়া যায়?

রোবায়েত: ফয়সাল ভাইয়ের অনেকগুলো প্রশ্ন। আমি একটু সময় নিয়ে বলি।

ফয়সাল: হাহা, নিশ্চয়! সরি ফর বোম্বার্ডিং।

রোবায়েত: কবিতা আর পাঠকের মাঝে দূরত্ব তো থাকেই। টেক্সট হয়তো কখনোই পুরোপুরি ধরা দেয় না। আমি আসলে ইচ্ছা করে হয়ত দূরত্ব ক্রিয়েট করি না। টেক্সট নিজেই সেটা করে নেয়। তবুও তো কেউ কেউ তার দেখা পায়। আর ভাষার মাঝেই আমি আসলে বেঁচে থাকি। আমার ভাষাও আমি তৈরী করতে চাই একদম নিজের মতো করে। মানে, নিজের অ্যালগরিদমে। এই সেলফ অ্যালগরিদমটা মনে হয় ব্যক্তি টু ব্যক্তি আলাদা।

ভাষাকে ডিকন্সট্রাক্ট কীভাবে করতে চাই! সেইটাও ঐ নিজস্ব অ্যালগরিদমেই। আমি আসলে সিন্ট্যাক্স প্যাটার্ন নিয়ে প্রচুর ভাবি। সেইখানে যত ধরনের প্রোবাবিলিটি আছে সেইটারে ইউজ করতে চাই।

ফয়সাল: এমনটা আমারো মনে হয়েছিলো। মিলে যাচ্ছে।

রোবায়েত: মিলে যাচ্ছা বলে আমারও মজাই লাগতেছে। তবে মায়ার ব্যাপারে আর বোধ হয় সিগনিফিকেন্ট হইতে পারবো না। হা হা

রাজীব: টেক্সট হয়তো পুরাপুরি ধরা দেয় না – এটা নিয়ে একটা প্রশ্ন আছে।

রোবায়েত: নিশ্চয়ই রাজীব দা!

রাজীব: টেক্সট কিন্তু অনেক রকম। না?

রোবায়েত: অবশ্যই অনেক রকম। আমি যখন টেক্সট কথাটা উচ্চারণ করছি, তখন আমার টেক্সটকেই বোঝাতে চাই রাজীব দা।

রাজীব: ধরেন, গুণের টেক্সট- আই মিন কবিতা তার কি কোনো আড়াল আছে? আমার তো নাই  নাই লাগে। তো তার টেক্সট কিন্তু পুরাপুরি পাঠকের নাগালেই। কিন্তু উৎপলে (উৎপলকুমার বসু) গেলে হয়তো নাগাল থেকে দূরেই সরে যায়। তো টেক্সট পুরাপুরি ধরা দেয় না, এটা কি ঠিক?

রোবায়েত: আমি আমার নিজের টেক্সট নিয়ে এমন বলতে চাই রাজীব দা। আরো আরো টেক্সট আমার এই মন্তব্যের সাথে যায়।

ফয়সাল: ফয়সাল: ‘ঠিক’ কি উচিৎ অর্থে বললেন রাজীব?

রাজীব: রাইট কি-না বোঝাতে চাচ্ছিলাম। দেখলেন আমার টেক্সটও পুরাপুরি ধরা দেয় নাই।

ফয়সাল: আপনার কবিতায় আমি বিভ্রম, হেঁয়ালির ব্যবহার যেমন দেখেছি, এগুলো কি আপনি আলাদা করে ক্রিয়েট করেন, নাকি এভাবেই আপনার কবিতাগুলো হচ্ছে নিজেই? আই মিন কবিতা কি এভাবে মেকানিক্যালি বানানো যায় বলে ভাবেন?

রোবায়েত: আমার কবিতায় বিভ্রম এমনিতেই আসে হয়তো। সম্ভবত আমরা যেটাকে রিয়্যালিটি বলে জানি, সেইটাও এক ধরনের অ্যাপারেন্ট রিয়্যালিটি। সো, বিভ্রম আসলে এমনিতেই ঢুকে পড়ে। কবিতা তো মেকানিক্যালি বানানো যায় বলে মনে হয় আমার। এইটাও আসলে এক ধরনের ভাষিক দক্ষতা। আমি তো কবিদেরকে ভাষা-প্রকৌশলী বলে মনে করি।

ফয়সাল: আমি অবশ্য এভাবে দেখি যে ভাষা-প্রকৌশল কবিতার জন্য দরকার। তবে মেকানিক্যালি বা বানায়ে কবিতা হওয়াটা ডিফিকাল্ট, কবিতার কাব্যগুণ বা ফ্লুয়েন্সি তাতে আটকায়। যাই হোক – যত মত, তত পথ। পাসিং দ্য ফ্লোর টু অনুপম।

অনুপম: আপনি বলছেন ভাষা অর্থের দিকে যেতে চায়। আপনি এ দ্বারা কি বোঝাতে চাচ্ছেন? মানে ভাষাটাকে কোন দিকে নিতে চাচ্ছেন আপনি?

রোবায়েত: এইটা আমার একটা কবিতার লাইন ছিল। আমি এইটারে একটা শব্দ দিয়ে বলছিলাম, অহেতুক অর্থের দিকে যাইতে চায়। তো, সিমান্টিক্স নামে ভাষাবিজ্ঞানের একটা শাখা আছে। ওরা কিন্তু বলতেছে যে, অর্থ হইলো সবচে কুটিল। এইটা কার কাছে যে কীভাবে ধরা দেয়, তার ঠিক নাই। তো, আমি যখন অর্থের কথা বলি সেইটারে একটা ব্যারিয়ার মনে হয় আমার। আমি কবিতায় কোনো  ব্যারিয়ার রাখতে চাই না। ভাষাকে আমি সম্ভবত ইনফিনিটির দিকে নিতে চাই। যার যার ভাষা সে তার মতো করে কানেক্ট করুক। আমার মতো করে নয়।

অনুপম: ইনফিনিটি বলতে? অর্থের দিকে যেতে না দেয়ার কি না অর্থের দিকে নেয়া নয়?

রোবায়েত: ঐ যে, যার যার ভাষা। আমার বোঝা হয়ত আমার কাছে ঠিক। অন্যের কাছে তা নাও হইতে পারে। মানে, এইখানে, ইন্ডিভিজুয়াল সুপার সেট বলে কিছু নাই। সবই আসলে সাবসেট। অর্থের দিকে যেতে না দেওয়া আর না নেওয়া তো একই রকম অনুপম। শুধু সাবজেক্ট চেঞ্জ হয় আর কি!

অনুপম: আরো এক জায়গায় আপনি বলছেন ভাষার কোনো দায়িত্ব নেই আমাকে অযোগ্য করে  তোলা ছাড়া। মানুষই তো ভাষা তৈরি করে। তাহলে কথাটার ভিত্তি কি?

রোবায়েত: অযোগ্যতার উত্তর সম্ভবত ‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’র প্রথম কবিতার প্রথম লাইন। ‘এতটা বৈমাত্রেয় কেন এই ভাষা!’ আসলে আপনি যা বলতে চান তা কি বলতে পারেন সব সময়? ভাষা সেইখানেই আমাকে অযোগ্য করে তোলে। আমার সাবকনসাস, আনকনসাসকে ভাষা সব সময় ধরতে দেয় না। মানুষের নিজের তৈরীর কাছে মানুষ তো অসহায় হইতেই পারে। যেমনটা মেরি শেলির ফ্রাংকেনস্টাইন।

অনুপম: কবিতা কি আসে না বানাতে হয়?

রোবায়েত: দুইটাই। আমার কাছে আসে তারপরে আমি বানাই।

ফয়সাল: আমার এইখানে একটা সম্পূরক প্রশ্ন থাকে অনুপমের কাছে, কবিতা আসলে ‘আসে’টা কিভাবে? এইটা তো ওহী হইতে পারে না, নাকি পারে?

অনুপম: আমি আরোপিত আর স্বাভাবিকতার পার্থক্য বলতে চাইছি আসলে।


আমি তাকেই ভালো কবি বলি যার নিজস্ব ভাষা আছে এবং সেগুলো কবিতাও হয়ে ওঠে।


জয়: রোবায়েত, ভাষাই কি কবিতার প্রধান অস্ত্র?

রোবায়েত: নিশ্চয়ই। যেহেতু ভাষা দিয়ে এর সারফেসকে প্রকাশ করা হয়।

রাসেল: আপনি বললেন, কবিতা বানান। সেটা কবিতার জায়গায় কতটা উচিত (!), কিংবা বৈধ (!)? বৈধ হলে বোধের জায়গাটাকে কীভাবে দেখবেন? অনেকেই অভিযোগ করেন, আপনার কবিতার সাথে মাথার সম্পর্ক, হৃদয়ের না।

ফয়সাল: মানে ইংরেজিতে বললে অর্গানিক আর মেইড আপ, এইটাই দেখা যাচ্ছে রোবায়েতের কবিতা নিয়ে প্রধান আলোচনা কেন্দ্র আজকের!

রোবায়েত: এমন অভিযোগ তো বহু পুরোনো, আমার ক্ষেত্রে। বানানো বা না বানানোটা আসলে কিছুই না, পড়ার পরে পাঠকের কাছে সেইটারে কবিতা বলে মনে হয় কি-না সেইটাই আসল। আর পাঠক তো অজস্র। কে কোথায় কখন আমার কবিতা পড়ছে তা তো আমি জানি না। একই টেক্সট হয়তো ‘ক’ এর কাছে মনে হচ্ছে বানানো কিন্তু ‘খ’ এর কাছে মনে হচ্ছে স্পন্টেনিয়াস। সো, এইটারে আমি অতটা গুরুত্ব দিই না। হা হা!

রাসেল: পাঠকের ভূমিকায় উত্তর দিলে? মানে আপনি পাঠক হিসেবে?

রোবায়েত: মানে আমি যখন নিজেই আমার কবিতার পাঠক, সেক্ষেত্রে?

রাসেল: উঁহু, যে কারো, যার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ।

রোবায়েত: আমি সেই কবিতাকেই ভালো বলি, যা একই সাথে নতুন আর আমাকে কবিতার স্বাদ দেয়। কবি সেইটাকে কীভাবে তৈরী করেন সেইটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা একদমই নাই। আপনার এই প্রশ্নটা গ্রিকদের প্যারাডক্সের মতো যে, ঈশ্বর কি এমন পাথর বানাতে পারবেন যা তিনি নিজেই উঠাতে পারবেন না।

রাসেল: সম্ভবত ভাষা নিয়ে সব থেকে বেশি প্রশ্ন করা হচ্ছে আপনাকে। সেটা স্বাভাবিকও। আচ্ছা, স্বতন্ত্র একজন থার্ড ক্লাস কবি (নাম বলা যায়, বলব না), আর ভালো কবিতা লেখে, এমন একজন নিজস্বতাবিহীন কবি – এর মধ্যে কাকে এগিয়ে রাখবেন? কেন?

রোবায়েত: আমি তাকেই ভালো কবি বলি যার নিজস্ব ভাষা আছে এবং সেগুলো কবিতাও হয়ে ওঠে।

রাসেল: আমার বউ মাদ্রাসায় পড়া। আমার মনে আছে মেলার সময় সে ৩/৪ জনের বই পড়েছিল, যার মধ্যে সে আপনার কবিতাগুলোতেই বেশি মুগ্ধ হয়েছিল। অথচ সে ঐ অর্থে কবিতা পড়ে না। তো যে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ ওঠে আপনার বিরুদ্ধে, সেটা বোধ হয় এখানে খোঁড়া হয়ে যাচ্ছে। কিংবা দুর্বোধ্যতার পরেও আপনার কবিতা সুখকর (এটা আমার মত)। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি এই সুখটাকে কবি হিসেবে কতটা প্রাধান্য দেন? আর পাঠক হিসেবে?

রোবায়েত: কবি হিসেবে আমি ঐটা নিশ্চয়ই এনজয় করি। অনেকেই আমাকে এমন বলেছে, তিনি কিছুই বোঝেননি কিন্তু তার অন্যরকম ফিল হয়েছে। এক ধরনের মায়ার সন্ধান তিনি পেয়েছেন। তো, এইটাও মনে হয় আমার ভাষার জন্যই।

ফয়সাল: অভিযোগ আমলে নেওয়ার কিছু নাই, কৌতুহলকে এনকারেজ করা হোক। রাসেলের ‘অভিযোগ’ প্রসঙ্গে একটি সাইড কমেন্ট।

রোবায়েত: হা হা

রাসেল: নিশ্চিত নন?

রোবায়েত: কে আর নিশ্চিত! আমার থট প্রসেস তো আর তার না। হাহা

রাসেল: একটু ভাষা থেকে সরি। ননসেন্স টাইপ প্রশ্ন; ধরেন, সামনের বছর জানতে পারলেন যে আপনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়ে গেছেন। কী করবেন?

রোবায়েত: প্রথমেই একটা পুদিনাপাতার চা খেতে চাইবো। তারপর, আব্বুকে ফোন করে বলবো, বাবা, আজ তোমার সন্তান মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। হা হা

রাসেল: তারপর?

রোবায়েত: আপনার এই তারপর শুনে, হেমন্তের একটা গান মনে পড়তেছে। ‘তার আর পর নেই নেই কোনো ঠিকানা।‘ হা হা

ফয়সাল: পুরস্কার কি গ্রহণ করবেন? করলে কেন বা না করলে কেন না?

রোবায়েত: মেবি গ্রহণ করবো না।

রাসেল: আপনার কবিতায় আরবি শব্দের ব্যবহার এত বেশি কেন?

রোবায়েত: আমি তো মাদ্রাসায় পড়ছি রাসেল। সেই জন্যই হয়তো আরবী আসে।

রাসেল: আপনার বই পড়তে পড়তে শেষে একটা অপ্রত্যাশিত চমক আছে, অন্তত আমার কাছে। ছন্দের একটা কবিতা, দীর্ঘ। এখানে কি পরোক্ষ কোনো মুন্সিয়ানা দেখানোর ইচ্ছা ছিল?

রোবায়েত: ‘ঘূর্ণ্যমান দেরাজের গান’ লিখেছিলাম নিজের দমটাকে দেখার জন্য। আমি তো প্রায় ছোট ছোট করে লিখি তো ঐটাকে বড় করতে চাইছিলাম।

জয়: কবিতায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার কিভাবে দেখেন, বা ভাষাগত রূপান্তরের বা অনুবাদের জরুরৎ রাখে কিনা এই বিদেশী শব্দগুলা?

রোবায়েত: শব্দ আমার কাছে জাস্ট শব্দ। বিদেশি না দেশি তা আমি ভাবি না। আমি তা-ই ব্যবহার করতে চাই যা আমার অ্যালগরিদমকে সাহায্য করে। নট নেসেসারি যে সেগুলোর পরিভাষা হোক।

ফয়সাল: আপনার কি কখনো মনে হয়েছে এই এলগরিদমের সাথে থাকার চেষ্টা, আপনার কবিতাকে ছাঁচে ফেলে দিচ্ছে, নতুনত্বের পথে বাধা দিচ্ছে?

রোবায়েত: এইটা মজার প্রশ্ন ফয়সাল ভাই। একটু তো ছাঁচে ফেলে দেই-ই। সম্ভবত এই ছাঁচ আমি আরো কিছুদিন পছন্দ করবো। তবে, আমার নেক্সট বইটা অন্য রকম ফর্মে কথা বলবে। আর আমি তো প্রচুর লিখি। বিচিত্রও লিখি বোধ’য়। তাই এটা নিয়ে ভাবি না।

ফয়সাল: আপনার সেলফ কনশাসনেস ভালো লাগলো রোবায়েত। চিয়ার্স!

রাসেল: শব্দ জাস্ট শব্দ কেমনে? আপনি কিন্তু ফ্রেঞ্চ কিংবা হিব্রু ব্যবহার করছেন না। এমন শব্দ ইউজ করছেন যা আসলে পাঠক জানে। তার মানে কি এটা হতে পারে না, পাঠককেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে?

রোবায়েত: না রাসেল। আমি তো জানি না পাঠক কোন শব্দটা জানে আর কোনটা জানে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি আমার র‌্যান্ডম সিলেকশনকে গুরুত্ব দিই।

হামেদী: সবাই শুরু থেকেই ডিপে ঢুকে পড়ছে।আমি হাল্কা চালে শুরু করতে চাই।তারপর অন্যান্য প্রসঙ্গে যাব। আপনি কবিতার লাইনে আসলেন কবে? মানে, শুরুর গল্পটা শুনতে চাই।

রোবায়েত: কবিতার লাইনে আসাটা বেশ মজার। নাইন-টেনে আমার ক্লাশের এক মেয়েকে ভালো লাগতো। তো, তারে কিছু লিখে পটাইতে চাইছিলাম। তো সেও পটলো না আর আমার লেখালিখিরও পটল তোলা হলো। এর অনেক দিন পর যখন ফেসবুকে আসি। তখন আনফরচুনেটলি একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে কবিদের লিস্টে ঢুকে যাই, তাদের কবিতা রোজ রোজ ভাইসা আসতো, সেসব দেখেই মনে হলো, এ আবার এমন কি! লেখাই তো যায়! এই শুরু।

হামেদী: তার মানে মানুষ যে বলে- প্রেমে পড়লে লোকে কবি হয়ে যায়।এই কিংবদন্তি আপনার সাথে মিলে গেছে।হা হা হা

রোবায়েত: না না মেলে নাই। চিঠি লেখার সাহস হইতো না। পা কাঁপতো। তাই এই অন্য লাইন ধরা আর কি! সে অর্থে আমি তখন চিঠিই লিখতাম আসলে কবিতা না।

হামেদী: মানে অপ্রকাশের ভারটা কবিতার কাঁধে চাপিয়ে দিলেন।

রোবায়েত: সেই রকমই। তখন থেকেই বোধ হয় আমি আড়াল চাইতাম টেক্সটে।

ফয়সাল: আড়ালটাই কবিতা।

রোবায়েত: তারে সেই সময় লিখছিলাম, ‘রাত্রির মগডালে বসা তোমার চোখের পাখিটাই বুঝি প্রেম’।

হামেদী: নারী তাইলে সাবজেক্টিভ না হয়ে অবজেক্টিভ হিসাবে আসল আপনার কাছে?

রোবায়েত: হ্যাঁ। আমি সাবজেক্ট করতে চাইনি। অবজেক্টই করতে চাইছি সব সময়। বাংলা কবিতায় নারী তো প্রায় সব সময়ই সাবজেক্ট ছিল।


সেই আর্টিস্টই বড় যিনি প্রচুর নিতে পারেন। কিন্তু সেগুলো নিজের মতো করে ব্যবহার করেন।


হামেদী: গুড। শুরু থেকেই বাংলা কবিতারে উল্টাইয়া দেওয়ার একটা ফিকির ছিল আপনার মধ্যে?

রোবায়েত: সে তো ছিলই।

হামেদী: যাই হোক, প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আপনি একটা ঘটনার প্রসঙ্গ টানছিলেন।ঐটা একটু বিস্তার করেন।

রোবায়েত: হা হা। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। জুন মাসে গ্রীষ্মের ছুটি ছিল। বগুড়ায়  গেলাম। ওখানে ‘পড়ুয়া’ নামে বিখ্যাত বইয়ের দোকান আছে। একজনকে একদিন দেখলাম হাতে অনেকগুলো কাগজ। সবগুলোই হাতে লেখা। তো আমার একটু কৌতুহল হল উল্টে-পালটে দেখার। উনি যখন কাগজগুলো টেবিলের উপর রাখলেন, সুযোগও পেয়ে গেলাম। দেখি সবগুলোতেই হিন্দু নাম। আমার তো ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলো। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কী? উনি উত্তর দিলেন, এইগুলা হলো কবিতা, আসছে সুদূর কোলকাতা থেকে। আমার তো উনাকে বিরাট লোক মনে হইলো। বাপরে কোলকাতা! তখন তো কোলকাতা আমার কাছে সেই ব্যাপার! আমি বলে কয়ে উনার ফেসবুক আইডি নিয়ে বন্ধু হলাম। তারপর দেখে দেখে কোলকাতার কবিদেরকে রিকোয়েস্ট পাঠালাম। তখন থেকেই মূলত আমার ওয়ালে খালি কবিতা আসা শুরু করলো। ঐগুলো দেখেই ভাবলাম, এ লেখা আবার এমন কঠিন কী! এইটা ছিল একদম শিশুসুলভ ব্যাপার। হা হা!

হামেদী: আপনার শুরুটা বেশ ইন্টারেস্টিং।আপনি কলকাতা হয়ে ঢাকায় ঢুকলেন।এইটা আপনার কবিতার মেজাজ নির্ধারণে কোনও প্রভাব রাখছিল কি-না শুরুর দিকে? এখনও বা ঐটার প্রতিক্রিয়া কতটা কাজ করে আপনার মনে?

রোবায়েত: মেজাজ নির্ধারণে ভূমিকা কিছু রাখছিল মনে হয়। এখন তেমন কাজ করে না।

হামেদী: কী রকম সেটা? খোলাসা করেন।

রোবায়েত: থট প্রসেসে। আর কোনো ভূমিকা রাখেনি মনে হয়।

হামেদী: আচ্ছা । এবার অন্য প্রসঙ্গে যাব। ‘মৌলিক কবি’ বা ‘মৌলিক কবিতা’ এই টার্মগুলি লজিক্যাল কি না? মৌলিক কবিতা লিখতে পারা আসলে কতটুকু সম্ভব?

রোবায়েত: না, লজিকাল না। প্রেজেন্টেশনের ভিন্নতাকেই আমরা হয়তো মৌলিকতা বলি। আর্ট আসলে মৌলিক নয়। আগের আর্টিস্টদের প্রভাব পড়বেই। আমরা তো আসমান থেকে পড়ি নাই কেউই।

হামেদী: তার মানে এইটা একটা ধারাবাহিক প্রসেস।আমি এক সাক্ষাৎকারে শাহ মাইদুল ইসলামরে বলছিলাম – আমরা হচ্ছি আসলে পরম্পরার সন্তান।এইরকম কি-না?

রোবায়েত: নিশ্চয়ই। সেই আর্টিস্টই বড় যিনি প্রচুর নিতে পারেন। কিন্তু সেগুলো নিজের মতো করে ব্যবহার করেন।

রাজীব: পিওর আর্ট বলতে আসলে কিছু নাই।

হামেদী: ভাষা নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন হয়ে গেছে এর মধ্যে। আমার এটা ঠিক ঐ অর্থে প্রশ্ন না। মন্তব্য আকারে নিতে পারেন।কিছু সংযোজন বা দ্বিমতও করতে পারেন।
**
প্রত্যেক কবির-ই ন্যূনতম কবিকল্পনা, কাব্যবোধ এই ব্যাপারগুলো থাকে।আমার মনে হয়, কবি সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েন ভাষা নিয়ে।বলা যায়, কবির দ্বৈরথ-ই মূলত ভাষার সাথে। আপনার মধ্যেও এই টানাপোড়েনটা বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়।আপনার কবিতা থেকেই কোট করি,

‘এতটা বৈমাত্রেয় কেন এই ভাষা’ কিংবা ‘ফুলের গর্ভে তার ভাষা ঝুলে আছে’ অথবা ‘ভাষা-অহেতুক অর্থের দিকে যেতে চায়’। ভাষাকে একটা স্বতন্ত্র ক্যারেকটার হিসাবে পাচ্ছি আপনার কবিতায়?

রোবায়েত: আমি ভাষার মধ্যেই বাস করি। আমার যত দ্বৈরথ ভাষার সাথেই, আইডিয়ার সাথে না।

হামেদী: রবীন্দ্রনাথের বিজয়িনী, জীবনানন্দের বনলতা সেন-অরুণিমা সান্যাল, বিনয় মজুমদারের চাকা, আপনার রোশনি আক্তার আলাদা কোথায়? এটা কি কেবলই নামের উল্লেখ? নাকি এর মর্মগত কোনও তাৎপর্য আছে?

রোবায়েত: নামের উল্লেখ নিশ্চয়ই না। এর মর্মগত তাৎপর্য তো আছেই। এই ক্যারেক্টারকে ঘিরে আমি অনেক কিছুই সৃষ্টি করতে চেয়েছি।

হামেদী: মানে এইটা আপনি সিম্বল হিসাবে ধরতেছেন?

রোবায়েত: ঠিক সিম্বল না। এইটা এক ধরনের আশ্রয় বলতে পারেন। এক ধরনের আইডিয়াল নারীও ভাবতে পারেন।

হামেদী: আপনি সাইলেন্স শিকার করতে চান। কখনও ইমেজ নিয়ে খেলেন। আবার কখনো বা বিমূর্তায়নের আরোহী। তো এই ব্যাপারগুলো তো জীবনানন্দ দাশ, জহরসেন মজুমদার, উৎপলকুমার বসুরা বেশ ভালোভাবেই চাষ-বাস করে গেছেন। আপনার ফসলের রং-ঘ্রাণ এদের থেকে কোন জায়গায় ভিন্ন?

রোবায়েত: ভিন্ন কি-না সেইটা আমি বলতে পারবো না। আপনার কী মনে হয়?

হামেদী: আপনার সিনট্যাক্স আলাদা।শব্দ জগতটাও আলাদা।কিন্তু আপনি চাপ বোধ করেন কি-না এই বিষয়গুলো নিয়ে ডিল করতে, যেহেতু আগে অনেক কাজ হয়ে গেছে?

রোবায়েত: না। আমি চাপ বোধ করি না। ঐ যে আপনি বললেন আমার সিন্ট্যাক্স আলাদা, শব্দ-জগতটাও আলাদা। সেইটার জন্যই আমি আলাদা হয়তো।

ফারাহ্: কবিরা এতো আত্মহত্যাপ্রবণ কেন হন?

রোবায়েত: কারুবাসনার ক্লান্তির জন্য।

রাজীব: আমার তো মনে হয় না। কয়জন আর করেছে! কি আরামে থাকে।

ফারাহ্: ‘শিরিন ওসমান’ আপনার একজন পাঠক ইদানিং মন্তব্য করেছেন যে আপনি কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেও, লোকে আপনাকে কবি বলেই চিনবে। আপনার অনুভূতি কি ? কখনো ভেবেছেন কি  লেখা ছেড়ে দেবেন ?

রোবায়েত: অনুভূতি নাই। এসব আমাকে তেমন টাচ করে না। তবে লেখা ছেড়ে দেবো কিনা ভাবিনি। যদি কখনো দেখি আর পারছি না, তখন প্রকাশ করবো না। কিন্তু নিজের খাতায় হয়তো ঠিকই লিখবো।

ফারাহ্: আপনার কবিতায় সুইসাইড ঘুরে-ফিরে আসছে।

রোবায়েত: সুইসাইড একটা রোমান্টিক কনসেপ্ট মনে হয়। যা সবার ভেতরেই থাকে, আমার ভেতরেও আছে।

ফারাহ্: বাক্ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘শাহানা আপা’ কবিতাটি প্রায় সব পাঠকই রোমান্টিক কবিতা বলে ধরে নিলেও, আপনি সম্ভবত বলেছেন সেটা ঠিক নয়। লেখক ও পাঠকের এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে আপনি কিভাবে দেখেন?

রোবায়েত: পাঠক যেভাবে নিছে সেইটা পাঠকের বোঝা। এইখানে আমার কিছু করার নাই। কবি-পাঠকের সম্পর্কটা আসলে রেসিপ্রোকাল। যার যার মতো করে কানেক্ট করে বা করে না।

ফারাহ্: আপনি কি ব্যর্থ তাহলে? অলমোস্ট কেউই আপনার মতো ভাবে না (শাহানা আপা?)।

রোবায়েত: সফলতা বা ব্যর্থতা কবিতায় নাই।

ফারাহ্: কিন্তু টোটালিটি ব্যবহার না করে কবি কি বেশিদূর যেতে পারেন?

রোবায়েত: আমি জানি না পারে কিনা! আমি যাবো, এইটা আমার রাস্তা।

ফারাহ্: আপনি ইমেজ তৈরি করেন কবিতায় , অনেক কবিতায় এইসব দৃশ্যকল্পের একের সঙ্গে অন্যের (একই কবিতায় বাক্যগুলোতে) কোন যোগাযোগ নেই। কিভাবে এইসব কবিতার অবতারণা?

রোবায়েত: যোগাযোগ থাকাটা কি জরুরি? আমি মনে করি না। এইখানেই আমার কাজ আসলে। একটা চায়ের আড্ডায় নানান রকম প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু সব শেষে সেইটা আড্ডাই। আমি স্ট্যাব্লিশড টোটালিটিকে অস্বীকার করি।

ফারাহ্: কবিতায় কখনও স্ল্যাং ব্যবহার করেছেন? অন্য কবিদের লেখাতে স্ল্যাং-কে কিভাবে দেখেন?

রোবায়েত: স্ল্যাং খুবই পছন্দ আমার। এইটা নিয়ে প্রচুর ভাবছি। ফাইনেস্ট ইউজ এখনো করতে পারিনি।একদিন হয়তো পারবো। আর যারা করেন তাদের ব্যবহার যদি পুরনো না হয় তবে ভালো লাগে।

ফারাহ্: কবি কি সত্যি দায়মুক্ত? দেশ/সমাজ/পাঠক বা অন্য কিছু থেকে?

রোবায়েত: না। সেও যেহেতু পলিটিক্যাল পার্সন সুতারাং মুক্ত নয় হয়তো।

ফারাহ্: শুধু দেশ/সমাজ নয়, পরিবার/আপনজন ওদের থেকেও?

রোবায়েত: পরিবার একেক জনের কাছে একেক রকম। মনে হয় না মুক্ত। অন্য মানুষের মতো কবিও পরাধীন।

হুজাইফা: জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত শব্দটি,” বিপন্ন বিস্ময়” এর যথাযথ একটি রূপ খোঁজার চেষ্টা করেছি আমি বহুদিন। শেষমেষ এক ধরনের অবশ অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই আসেনি আমার মনে। আপনি এর কোন অর্থ জানেন?

রোবায়েত: না । এইটা আসলে অদ্ভুত কম্পোজিশন। ক্লাসিক মিউজিকের মতো। অসহায় করে তোলে কিন্তু উত্তর দেয় না।

হুজাইফা: আমার মনে হয়েছে, সমগ্র জীবনানন্দই আসলে এই শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায়! গাঢ় অনুভব, কিন্তু অব্যক্ত! আপনি কি বলবেন?

রোবায়েত: আমারও তাই মনে হয়।


কত ওজনের শব্দের পর কত ওজনের শব্দ বসলে সেইটা হারমোনাইজড হবে এইটার একটা বিদ্যা বলতে পারেন ছন্দকে।


জয়: ব্যাখ্যা কোন?

রোবায়েত: বিপন্ন বিস্ময়ই আমাদের ক্লান্ত করে। এইটার মেটারিয়ালিস্টিক ব্যাখা দেয়া যেতে পারে কিন্তু সেদিকে যাচ্ছি না জয় ভাই।

হুজাইফা: ছন্দ নিয়ে আপনার কাজ কিন্তু কম না। মোটামুটি ভালই! ছন্দটাকে কিভাবে দেখেন? কেবলই একটি টুলস? নাকি এর আলাদা কোন তাৎপর্য আছে?

রোবায়েত: আলাদা কোনো তাৎপর্য আছে কি-না জানি না। তবে বাংলা ভাষার নার্ভ ধরতে বাংলা ছন্দ কাজে দেয় নিশ্চয়ই। এইটা আসলে বাংলা ভাষার মিউজিককে ডেনোট করে।

হুজাইফা: একটু ব্যাখ্যা করবেন? কখনোও তো এমন হয়, নিছক ছন্দের কারণে কবিতার এন্টায়ার মিউজিক ফল করে! মানে ছন্দ বজায় রাখতে গিয়ে বিভিন্ন কিছুর আশ্রয় নিতে হয়। যার ফলে কবিতার ন্যাচারাল ফ্লো-টা থাকে না! আমার কাছে এমন মনে হয় আরকি কখনো কখনো!

রোবায়েত: ভাষার একটা নিজস্ব হারমোনি থাকে। যেমন ধরেন, বাংলা ভাষায় ৪ অক্ষরের বেশি শব্দ খুব একটা নাই। তো এই শব্দগুলোর অ্যাসিমিলেশন কীভাবে হবে। কত ওজনের শব্দের পর কত ওজনের শব্দ বসলে সেইটা হারমোনাইজড হবে এইটার একটা বিদ্যা বলতে পারেন ছন্দকে। আমাদের মধ্যযুগের কবিতায় কিন্তু এই ব্যাপারটা প্রচুর আছে। ইনফ্যাক্ট সবই ঐ রকমই আর কি! জীবনানন্দও তো প্রায় সবই লিখেছেন ছন্দে। তো, এইটা ব্যারিয়ার না। চর্চার বিষয়।

হুজাইফা: আমাদের কবিতায় ট্র্যাডিশন ও মিথের ব্যাবহার কিরূপ হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন?

রোবায়েত: একদমই তছনছ করে। মিথ আর ট্রাডিশান যদি তার পুরনো রূপ নিয়েই হাজির হয় তাকে আমি চর্বিত চর্বনই বলতে পারি জাস্ট। কিন্তু যদি সেইটা আসে নতুন করে ‘নতুন মিথ’ হয়ে ওঠার প্রভোকিং ক্যারেকটারিস্টিক্স নিয়ে তবেই সেটা করা যায়। না হলে ঐ যেই লাউ সেই কদুই হবে! ট্রাডিশনাল জিনিসপত্র আমিও ইউজ করছি তবে ডিকন্সট্রাক্ট করে।

হুজাইফা: কিন্তু মিথ কে মিথের জায়গায় রেখে,বা ট্র্যাডিশনকে তার জায়গায় রেখেও কিন্তু কাজ হয়েছে প্রচুর। এবং সেগুলো একেবারে ফেলে দেয়ার মতো না কিন্তু! আমার তো মনে হয় তারপরও অনেক স্পেস থাকে, যেটা নিয়ে কাজ করা যায়!

রোবায়েত: আমি আমারটা বললাম।

হুজাইফা: আপনি যদি একেবারে তছনছ করে দেন, তাহলে সেটা মিথ বা ট্র্যাডিশন হিসেবে কতটা বাকি থাকবে? তখন কি সেটাকে মিথের ব্যাবহার বলা যায়?

রোবায়েত: যাবে। কারণ সিম্বলগুলো তো মিথেরই উপাদান।

হুজাইফা: হা হা হা। এখানে বোধহয় আরও আলোচনার স্পেস আছে, তবে আমি আর সেদিকে যাবো না।

রোবায়েত: গেলেও যাইতে পারেন। হা হা! আমাদের আব্দুল মান্নান সৈয়দেই এমন আছে।

জয়: রোবায়েত মনে হয় একটু ব্যাখ্যা দিতে পারো।

রোবায়েত: যেমন ধরেন,
“এই রাত্রিরা বেথেল্‌হাম্‌-কে ব্রথেলে পরিণত করে”
”জ্যোৎস্না হয় জল্লাদের ডিমের মতো চুলহীন, জলবায়ুহীন মুণ্ডু’’

এইখানে বেথেলহাম আর জল্লাদ একটা মিথের আরেকটা ট্রাডিশনের কিন্তু কেমন অদ্ভুত ভিন্নভাবে আসছে।

হুজাইফা: রিলকের “অর্ফিউস” সনেটগুচ্ছ যদি ধরেন, তাহলে সেটা অসাধারণ একটি কাজ। কিন্তু আমার মনে হয় না তিনি সেখানে ডিকন্সট্রাকশন করেছেন!

রোবায়েত: রিলকের সময়টায় কিন্তু মিথের ব্যবহার প্রচুর ছিল। জোসেফ ক্যাম্পবেল মিথের এইসব নানান সামাজিক ব্যবহার নিয়ে বলছেন।

হুজাইফা: মিথকে মিথের যায়গায় রেখে কি অসাধারণ লিখেছেন বুদ্ধদেব!

রোবায়েত: আমি অবশ্য বুদ্ধদেবের দিকে আর যাইতে চাই না যখন মান্নান সৈয়দ এইসব নিয়ে নতুন কাজ করছেন।

হুজাইফা: হা হা হা…কবিতায় এ্যাবসার্ডিটি অনেকটা আবশ্যকীয় রূপ ধারণ করেছে, সেটাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু ব্যাপারটা যখন অ্যাবসার্ডিটি অব অ্যাবসার্ডিটি বা বিমূর্ততার বিমূর্তায়নের পর্যায়ে চলে যায় তখন বিষয়টা অনেকটা টাফ হয়ে যায় না পাঠকের জন্য? আমার মনে হযেছে আপনার বহু কবিতায় এই বিষয়টা আছে।বিশেষ করে আগের কবিতাগুলোতে।

রোবায়েত: আমি কি জানি পাঠকের জন্য কোনটা টাফ আর কোনটা সহজ! আমি শুধু নিজের লেখাটাই লিখতে চাই। সোসাইটিতে তো আমার কোনো স্বাধীনতাই নাই। অন্তত লেখার খাতায় আমি স্বাধীন থাকতে চাই। আর অ্যাবসার্ডিটি আদতে সুন্দর। যেমন ধরেন, ক্লাসিক্যাল মিউজিক, ধর্ম, ম্যাথমেটিকস, কোয়ান্টাম ফিজিক্স এই সবই তো অ্যাবসার্ডিটি দিয়ে ভরা। আমার সেসব কল্পনা করতে ভালো লাগে।

হুজাইফা: আপনি যখন আপনার লেখা পাঠকের কাছে দিচ্ছেন, তখন কি তাদের কিছু বিষয় আপনার বিবেচনায় রাখতে হবে না? অবশ্য যদি সম্পূর্ণ দায়মুক্ত থাকতে চান তাহলে আমার আপত্তি নাই।

রোবায়েত: পাঠকের কাছে দিচ্ছি অর্থে সেধে দিচ্ছি না তো! পাঠক তার রুচি অনুযায়ীই বেছে নিচ্ছে।

হুজাইফা: প্রকারান্তে আমি বলতে চাইছি,আমাদের কল্পনার কোন ব্যারিয়ার নাই, এটা সত্য। কিন্তু আমাদের কল্পনাও তৈরী হয় চিন্তার অভিজ্ঞতা থেকে। সেটাকে অতিক্রম করব কিভাবে?

রোবায়েত: আমি এই ব্যাপারটা বহুত আগেই বলছি। স্ট্যাব্লিশড নলেজের মধ্যে আমি অধিকাংশ সময়েই থাকতে চাই না। নলেজ যে ধরনের কল্পনা বা চিন্তাশক্তি ক্রিয়েট করে আমি তার থেকে বের হইতে চাই। এইটারে বলতে পারেন, শূন্যজ্ঞান নিয়ে শুরু করতে চাই। জিরো নলেজ। যেমন  শিশুরা করে।

হামেদী: বাংলার রূপ-রস-ছন্দে কবিতা চর্চার নামে সাম্প্রতিক সময়ে একদল কবিকে অপ্রচলিত সংস্কৃত ছন্দে কবিতা লিখতে দেখি।এই প্রবণতাকে আপনি কতটা সার মনে করেন?

রোবায়েত: হা হা! দিলেন তো ঝামেলায় ফেইলা! সংস্কৃত ছন্দে যদি নতুন কবিতা লেখা হয় তবে সেটা তো খুবই ভালো। বাংলা কবিতার জন্যই ভালো। তবে একটা ডেড ল্যাংগুয়েজের ইনফ্রাস্ট্রাকচার কতখানি বাংলাভাষার মতো ফ্লুইড ল্যাংগুয়েজকে হ্যান্ডেল করতে পারবে সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বোধ হয় ব্যাপারটা জানতেন বলেই করেননি। উনার মতো বস লোক তো এই তল্লাটে বিরল! তার চেয়ে মধ্যযুগের কাজগুলো নিয়ে আমি বেশি উৎসাহী।


শুধু সাহিত্য নয় প্রায় ক্ষমতাকাঠামোর সব ক্ষেত্রেই এই মাস্তানি চলছে। মধ্যযুগকে আমার সব দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ মনে হয়। ইউরোপের মধ্যযুগ আর আমাদের মধ্যযুগের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক আছে।


জয়: সংস্কৃত তো মৃত ভাষা। একটা মৃত ভাষার ছন্দ নিয়ে এত মাতামাতি কি যৌক্তিক?

রোবায়েত: সেইটা যে কেউই করতে পারে জয় ভাই। যদি ভালো কাজ হয় তবে কেন করবে না! যে যার মতো করে স্বাধীন ভাবে কাজ করবে। সেটাই যৌক্তিক। তবে সমালোচনা থাকা ভালো। তাতে সাহিত্যই আগায়।

হামেদী: কিন্তু ধরেন, ভাষার অনেক ধরনের অভিমুখ থাকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে। এখন বাংলা ভাষা ঐরকম সম্ভাবনা ক্রিয়েট করতেছে কি-না এই সময়ে?

রোবায়েত: নিশ্চয়ই ক্রিয়েট করতেছে। বিচিত্র রকমের লেখা হচ্ছে। একেকজন একেক ভাবে ট্রাই করতেছেন।

হামেদী:

আপনি একটু ক্রোনলজি দেখেন মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার,

চন্ডীদাস :

কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নইকুলে
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকূলে
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ রান্ধন

বিদ্যাপতি :

এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর                     মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর 

ময়মনসিংহ গীতিকা :

কোথায় পাব কলসি কইন্যা কোথায় পাব
দড়ি
তুমি হও গহীন গাঙ, আমি ডুব্যা মরি

ভারতচন্দ্র :

প্রণমীয়া পাটুনী কহিছেন জোড় হাতে
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে -ভাতে

এবার আপনি দেখুন বাংলা ভাষার প্রথম ‘আধুনিক কবি’র ভাষা :

রুষিলা বাসবত্রাস ! গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি

সুর,ছন্দ ও কল্পনার আন্তরিক মিলমিশে যে বাংলা ভাষা ভারতচন্দ্র পর্যন্ত স্বাদু ও স্বচ্ছল ছিল, সেটা মধুসূদনে এসে দুর্বোধ্যতা ও আভিধানিক শব্দের আলখাল্লা পড়লো, যেটা ভেদ করে কাব্যের মর্মে পৌঁছাতে গলদঘর্ম হওয়ার দশা, এটাকে কি আপনি আধুনিকতা বলবেন? নাকি ইতিহাস-বিচ্ছিন্নতা বলবেন? কেন বলবেন?

রোবায়েত: এইগুলা হইছে ফোর্ট উইলিয়াম ঘরানার বেরাদারিতে। মানে, কলোনির প্রভাবে। আর  মধ্যযুগকে বলা হইছে ব্যাকডেটেড। শুধু সাহিত্য নয় প্রায় ক্ষমতাকাঠামোর সব ক্ষেত্রেই এই মাস্তানি চলছে। মধ্যযুগকে আমার সব দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ মনে হয়। ইউরোপের মধ্যযুগ আর আমাদের মধ্যযুগের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক আছে।

তো, মাইকেল সাহেবের ঐ কাজগুলোকে আমার বিরাট বিপ্লব মনে হয় বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে। সে  জন্য বাংলাভাষী হিসেবে আমি গর্বিত। কিন্তু আমাদের মূলধারার সাহিত্যকে যেভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বা হচ্ছে সেইটা থেকে বের হবার সময় আসছে হয়তো। আমাদের কবিতা হয়তো মধ্যযুগের থেকেই তার নতুন নতুন টুলস পাইতে পারে।

হামেদী: তার সময়ের প্রেক্ষিতে তিনি গ্রেট। কিন্তু বাংলা ভাষার স্বাভাবিক প্রবাহরে রুদ্ধ কইরা দিসেন তিনি।

রোবায়েত: তিনি গ্রেট। গ্রেটরা আগের সাহিত্যের যে কোনো প্রবাহকেই রুদ্ধ করে দেন।

হামেদী: শেষ প্রশ্ন আমার। রবীন্দ্র-বিরোধিতার নামে তিরিশের কবিরা যে ইউরোপের দিকে কেবলা রোখ করলেন, এইটা কতটা যুক্তি ও বুদ্ধি প্রসূত? রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাষা ও কাব্য-চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার আর কি বিকল্প তারা বেছে নিতে পারতেন? তাদের এই প্রচেষ্টা বাংলা কাব্যের সম্ভাবনা না সর্বনাশ হিসাবে দেখবেন?

রোবায়েত: এইটাও হইছে কলোনি হবার ফলে। তবে, তারা কোন দিকে যাইতে পারতেন সেটা আমার কনসার্ন না। জীবনানন্দ তো বাংলার টুলস নিয়েই বেশি কাজ করছেন। বাংলাকে তার মতো করে আর কে পারছে এক্সপ্লোর করতে? ‘অবসরের গান’ তো সে কথাই বলে। আমি এইটাকে এই সময়ে, গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক হিসেবে নিতে চাই। অন্তত আমার সময়ে। তবে, নিজেদেরই সাহিত্য যখন এত সমৃদ্ধ তখন সেখান থেকেই বেশি করে নেবো আমি।

শোয়েব: শুভ মধ্যরাত রোবায়েত। এই সময়ের তিনজন পছন্দের কবির নাম বলো এবং কারণগুলো বলো। আশা করি নাম এড়িয়ে যাবা না।

রোবায়েত: তুমি তো মধ্যরাতরে অশুভ কইরা দিলা। হা হা। শাহ মাইদুল ইসলাম, হাসনাত শোয়েব, অনুপম মণ্ডল। কারণ সম্ভবত, এদের ভাষাভঙ্গি।

শোয়েব: আচ্ছা । তোমার কি মনে হয় এই শহরে কবি হয়ে টিকে থাকতে গেলে কোন বিশেষ সার্কেল বা সিন্ডিকেট মেন্টেন করতে হয়?

রোবায়েত: না। ভালো কবিতা লিখতে হয়।

জয়: ভাল কবিতার সংজ্ঞা কি?

রোবায়েত: আমার কাছে যে কবিতা ভালো লাগে সেটাই ভালো কবিতা জয় ভাই।

শোয়েব: তুমি কি মনে কর শুধু ভালো কবিতা লিখে সারভাইভ করা সম্ভব?

রোবায়েত: তুমি কি রাজার মতো সারভাইভ করতে চাও নাকি কবিতা লিখে! সেটা তো সম্ভব না। কবি সারভাইভ করে টেক্সটে।

জয়: এইটা কোন অর্থপূর্ণ সংজ্ঞা হলো না

রোবায়েত: হলো না হয়তো। যেহেতু ভালোর কোনো ইউনিট নাই। তাই আমার ভালো লাগাই আমার ইউনিট।

শোয়েব: ভালো কবিতা যদিও আমি গুনি না। ঐটা আমার দরকার নাই। তবে কি আমি ধরে নেবো রোবায়েত তুমি কোন গ্রুপইজমের বাইরেই আছো? কিংবা যেটুকু তুমি মেন্টেন করো বা আমরা ধারণা করি, সেটা কিসের ভিত্তিতে? নাকি এটা তুমি মানোই না যা তুমি আসলে কোন গ্রুপে আছো?

রোবায়েত: আমি কোনো গ্রুপে নাই। যেসবে আমাকে হামেশাই দেখা যায় তাদেরকে ব্যক্তি আর কবি হিসেবে আমি পছন্দ করি।

শোয়েব: আচ্ছা। তুমি বলছিলা বাংলা একাডেমি নিবা না। এটা কি বিশেষ কোন পুরস্কার নিয়ে নাকি ওভারল পুরস্কার নিয়ে ধারণা?

রোবায়েত: যে পুরস্কার পাইলে আমারে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ চিনতে পারবে সেই পুরস্কার নিয়ে না। হা হা

শোয়েব: বাংলা একাডেমি পাইলে ত আরো বেশি মানুষ চিনবে। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বলে কথা

রোবায়েত: ধুর! কেউ চেনে না। আমিই জানি না গতবার কে পাইছিলেন।

শোয়েব: আসলে কোন পুরস্কার মানুষ চেনায় নাকি মানুষের কারণে পুরস্কারকে চেনা হয়

রোবায়েত: দুইটাই হয়। যেমন ধরো নোবেলের ক্ষেত্রে এইটা অনেক ঘটছে। আবার ধরো, কুন্ডেরা। উনি পাইলেই কি আর না পাইলেই কি! উনারে তো খুব ভালো করেই চেনে পাব্লিকে!

শোয়েব: আচ্ছা। আচ্ছা তোমার ছন্দে লেখার যে প্রবণতা সেটা কি হীনমন্যতা থেকে। মানে অমুক তমুককে দেখিয়ে দেয়ার জন্য? যে আমিও পারি?

রোবায়েত: না। ভাষার হারমোনিটাকে বুঝতে চাইছিলাম বলে চেষ্টা করছি।


একজন মুচি আর কবির মধ্যে আলাদা কোনো মহাত্ন্য নাই। মুচিও তার ফাইনেস্ট ফিনিশিং দিতে চায় চামড়ায় আর কবি দেয় তার ভাষায়।


শোয়েব: কিন্তু তুমি একবার আমাকে বলছিলা সম্ভবত যে কিছুটা দেখানোর ইচ্ছাও ছিলো।

রোবায়েত: শুরুর দিকে অমনটা মনে হইছিল। পরে ব্যাপারটা আরো গভীরভাবে ভাবতে চেষ্টা করছি।

শোয়েব: আচ্ছা। তোমার কি এইসব ছন্দে লেখার চেয়ে নতুন ছন্দ তৈরির চেষ্টা করা যায়? এগুলো যথেষ্ট ক্লিশে হয়ে পড়ছে?

রোবায়েত: ঠিক বলছো। আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতেছি অনেক দিন হলো। হয়ত একদিন করেও ফেলতে পারবো। দোয়া কইরো।

শোয়েব: দোয়া দরুদে বাংলা কবিতার লাভ নাই। আমাদের এখানে ছন্দ নিয়ে এত মাতামাতির কারণ কি বলে তোমার ধারণা?

রোবায়েত: আমি মাতামাতিকে পজেটিভ হিসেবেই নিই। এতে করে কবিতার অনেক উইন্ডোই খুলে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে ছন্দ নিয়ে মৌলবাদীতা বা আজাইরা বিরুদ্ধতা কোনোটাই আমার কামের কাম বইলা মনে হয় না।

শোয়েব: আমারো তাই মনে হয়। আচ্ছা, তুমি বানানো কবিতার কথা বলছিলা; আমার মনে হয় আলাদা হওয়ার একটা চাপ তুমি কবিতার ওপর এভাবে আরোপ কর। তোমার কি মত?

রোবায়েত: না। আমার তা মনে হয় না। কবিতা তো ওহী না। কবি সেইটারে বানায়-ই তার সাধ্য অনুযায়ী। এইসব ওহী টাইপের কথা-বার্তার জন্যই কবিরা আলাদা মূল্য হাজির করতে চায় সোসাইটিতে। একজন মুচি আর কবির মধ্যে আলাদা কোনো মাহাত্ম নাই। মুচিও তার ফাইনেস্ট ফিনিশিং দিতে চায় চামড়ায় আর কবি দেয় তার ভাষায়।

শোয়েব: সেইটা ঠিক আছে। আমি আসলে বলতে চাচ্ছি, বানানোর সময় তুমি আলাদা হওয়ার কোন চাপ বোধ কর কিনা? চাপ না বলে আখাঙ্ক্ষাও বলতে পারো।

রোবায়েত: না। চাপ বোধ করি না। আমার মাথায় কবিতা ওভাবেই ফাংশন করে। আমি এর বাইরে কিছু লিখতেও পারবো না। আমি যা পারি সেভাবেই লিখি । আলাদা হওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার ভেতর কাজ করে না। এইটা বলতে পারো, আমার টাইপ হয়ে গেছে।

রোবায়েত: আচ্ছা। কলকাতার সাম্প্রতিক কবিতা নিয়ে তোমার ভাবনা জানতে চাই। সেই সাথে বাংলাদেশের কবিতার সাথে একটা তুলানমূলক আলোচনাও। কারা কেমন করছে?

রোবায়েত: কারা কেমন করছে সেইটা আমি বলতে পারবো না। তবে কোলকাতায় আমার অনেক প্রিয় কবি আছে। মূলত তরুণদের কথাই আমি বলছি। আর তূলনামূলক আলোচনা যেইটা সেটা করাই যায়। বাংলাদেশের কবিতায় যে প্রাণ আছে সেইটা কোলকাতার কবিতায় বেশ কম।

শোয়েব: কয়েকজনের নাম বলো যারা ভালো করছে। তাইলে পাঠক উপকৃত হবে আর কি

রোবায়েত: সব্যসাচী সান্যাল, অস্তনির্জন দত্ত, নীলাব্জ চক্রবর্তী, অনিমিখ পাত্র, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল ঘোষ, বাপি গাইন আরও নাম আছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

শোয়েব: আচ্ছা। রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে তোমার মত জানতে চাই?

রোবায়েত: মত নাই।

শোয়েব: তোমার কাছে কি তার কবিতা এখনো প্রাসঙ্গিক?

রোবায়েত: না।

শোয়েব: আচ্ছা। আমার শেষ প্রশ্ন, সুন্দরবনের রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানো নিয়ে তোমার বক্তব্য শুনতে চাই?

রোবায়েত: সুন্দরবন কোনোভাবে আক্রান্ত হোক এইটা আমি চাই না।

জয়: রোবায়েত, ভাল কবিতা বিষয়ে তোমার উত্তরে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তোমার কাছে যে কবিতা ভাল, আরেকজনের কাছে সেটা খারাপ হতে পারে তো? সেক্ষেত্রে কবিতায় কি কি থাকলে তা ভাল কবিতা?

রোবায়েত: কী কী থাকলে ভালো কবিতা হবে এইটা সম্ভবত আমারও আত্মজিজ্ঞাসা। এখন পর্যন্ত আমি এইটা জানি না। তবে, নিউ ল্যাংগুয়েজে কোনো কবিতা যদি আমার ক্রিয়েটিভিটিকে উসকে দিতে পারে, মানে যে কবিতা পড়ার পর আমি কবিকে ঈর্ষা ও সমীহ করতে পারি আমার কাছে তাই ভালো কবিতা। আর যেকোনো ভালো কবিতার ক্ষেত্রে সুরের হারমোনি খুব ইম্পর্ট্যান্ট মনে হয়। যে কবিতাগুলো আমাদের কাছে গ্রেট কবিতা মনে হয় সেগুলোতে ভাষা তার ফাইনেস্ট হারমোনি নিয়েই হাজির হয়।

জয়: আচ্ছা, সেই হারমোনিটা ঠিকঠাক আনতে একজন কবিকে কতখানি পরিশ্রম করতে হয়? এখন ধরো এফএম রেডিওর আরজেরা যে ভাষায় কথা বলে, তা নতুন। ওই ভাষায় কি ভাল কবিতা হতে পারে?

রোবায়েত: পরিশ্রম তো করতেই হয়। ব্যাপক ভাবেই লেগে থাকতে হয়। তবে যেইটা প্রথম দরকার সেটা হলো, পূর্ববর্তী কবিতা-অভিজ্ঞতাকে ব্যাপক ভাবে অধ্যয়ন। এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সাধনা। আর সমসাময়িক এবং অগ্রজ কবিদের ঐতিহ্যকে স্বীকার করেই তাদের কবিতাবিষয়ক পরামর্শকে মাথায় না রাখা। নিজের কবিতা নিয়ে কনফিডেন্ট হওয়া। রাতারাতি খ্যাতিমান হইতে চাইলেই কবির নিজের ভাষার বারোটা বাইজা তেরোটার কাঁটা কাঁপাকাঁপি শুরু করে দেবে।

এফএমের ভাষায় অবশ্যই কবিতা হইতে পারে। মেধাবী কারো হাতে পড়লে হয়ত হয়েই যাবে। কোনো বিশেষ টাইপের ভাষার প্রতি আমার কোনো বিরাগ নাই আপাতত।

জয়: সত্তরটা ইংরেজি শব্দ আর তিরিশটা বাংলা শব্দের একটা কবিতা কেমন হতে পারে তাই ভাবছি! হা হা হা

রোবায়েত: ঐ যে ফাইনেস্ট সিন্ট্যাক্স হইতে হবে। হলেই দেখবেন ভালো লাগতেছে।


সমালোচকেরা কবি তৈরী করে না। কবি নিজেই তৈরী হয়। সমালোচনা সাহিত্যের আলাদা শাখা। এইটা না থাকলেও কবির যায় আসে না। হোমার কি ইলিয়াড ওডিসি  সমালোচকদেরকে পড়ে, শিক্ষিত হয়ে, তারপর লিখছিলেন?


জয়: রোবায়েতের কাছে ভাষা কী এখনও বৈমাত্রেয়?
রোবায়েত: অবশ্যই বৈমাত্রেয়। ‘তারে ধরি ধরি, মনে করি, ধরতে গেলে আর মেলে না।‘ এমন।

জয়: আচ্ছা। তুমি লিখেছ,

‘কত ফুল জেরক্স করছে ঘ্রাণ
হিংসার দূরত্বে দাঁড়িয়ে”

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতায় এই মুহূর্তের জেরক্স প্রবণতা নিয়ে তোমার মন্তব্য কি?

রোবায়েত: বই হাতে আসলে বলা যেত। তবে এই জেরক্সপ্রবণতা বহু আগে থেকেই ঘটে আসছে। কেবল অমেধাবী আর শর্টকাটে সাফল্য চানে-অলারাই এমন করতে পারেন। আর সমসাময়িকেরা যদি হুবহু বা আংশিক আইডিয়াও মেরে দেয় সেইটা হবে ফালতু ব্যাপার। প্রভাবিত তো হইতেই পারে কিন্তু চোর হওয়াটা বোধ হয় লজ্জার।

জয়: ফেসবুকে সাহিত্যচর্চার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এটা বেশি ঘটছে মনে হয়? আর এই জেরক্স সাহিত্যকে অনেকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এর ক্ষতিটা কেমন?

রোবায়েত: অবশ্যই। তবে সব সময়ই এমন ছিল। মেধাবীরা এইসব নিয়ে ভাবে না। নজরুল মনে হয় এমনটা বলছিলেন, সাগর থেকে এক বালতি পানি চুরি হইলে সাগরের কিছু যায় আসে না। পৃষ্ঠপোষকতা তো তাদেরই বেশি দরকার। হা হা!

জয়: কোন কবিতাটা লেখার পর মনে হয়েছে তুমি কবি?

রোবায়েত: এখনো তেমন কবিতা লিখতে পারি নি। তবে কারু কারু কবিতা পড়ে মনে হয়েছে আমি কবি।

জয়: ব্যাখ্যা করবে?

রোবায়েত: আমার প্রথম পড়া কবিতার বই রূপসী বাংলা। আজ থেকে প্রায় ১২ বছর আগে পড়া। ঐ লেখাগুলো পড়তে পড়তে আমার ভেতর এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল যে আমি কল্পনা করতে পারছিলাম আমার গ্রাম ধরমপুরে চুরি করে যে গোলাপ গাছটি লাগিয়ে ছিলাম, যার ফুল আমি দেখতে পারিনি, কেন যেন রূপসী বাংলা পড়ার সময় ঐ না দেখা ফুলগুলো আমার ভেতর ফুটতে শুরু করেছিল। ঐ সময়ই মনে হয়েছিল আমি কবি। যদিও লিখতে শুরু করি তারও প্রায় ৯ বছর পর।

জয়: সমালোচকদেরকে তোমার ‘অন্ধদের স্কুল ঘরে বসে থাকা সিরিয়াল কিলার’ মনে হয় কেন?

রোবায়েত: হা হা। সমালোচকেরা তো অন্ধস্কুলেরই ছাত্র। ইনারা অধিকাংশই সিরিয়াল কিলার। সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার যন্ত্রনা ইনারা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন প্রায়শই। আমি কিন্তু ভালোবসেই তাদের সিরিয়াল কিলার বলেছিলাম।

জয়: কিন্তু সাহিত্যের উৎকর্ষের জন্যই তো সমালোচক দরকার। অবশ্যই সৎ সমালোচক। সৎ সমালোচকের অভাবের কারণে কি আমাদের সাহিত্য পিছিয়ে নেই?

রোবায়েত: না। সমালোচকেরা কবি তৈরী করে না। কবি নিজেই তৈরী হয়। সমালোচনা সাহিত্যের আলাদা শাখা। এইটা না থাকলেও কবির যায় আসে না। হোমার কি ইলিয়াড ওডিসি  সমালোচকদেরকে পড়ে, শিক্ষিত হয়ে, তারপর লিখছিলেন?

জয়: ‘আয়ু কি অকস্মাৎ নড়ে ওঠা পাতা!’ তোমার এই লাইনটা আমাকে খুব ভাবায়। মৃত্যুটা অকস্মাৎ না আসলেও পারতো। হঠাৎ নড়ে ওঠা পাতা না হলে কি মৃত্যু ঠিক শিল্পের পর্যায়ে যায় না?

রোবায়েত: মৃত্যু আমার কাছে সেলিব্রেশনের বিষয়। আমি এইটাকে উদযাপন করতে চাই। অকস্মাৎ নড়ে ওঠা পাতার সৌন্দর্য আমি দেখেছি, এক মূহূর্ত পরেই যে স্থির হয়ে যায়। তো ঐ আনডিফাইন্ড বিউটিকে আমার ভালো লাগছিল। মৃত্যুও আনডিফাইন্ড বিউটি। একটা বিয়ের মতোন ব্যাপার আর কি! পরমের সাথে অন্তর্লীন হবার সুযোগ।

জয়: ‘লোকটা কোনদিন পার হতে পারছে না কলিংবেল’ যদি এই লাইনটা আর পুরো ‘এনট্রপি’ কবিতাটা উদাহরণ হিসেবে নেই, দেখা যায় যৌনতার সংশয় এবং তীব্রতা দুটোই আছে। আবার যৌনতা অনেক শীতলও মনে হইছে। এত শীতল-গীতল কেন তোমার কবিতার যৌনতা?

রোবায়েত: যৌনতার সংশয় ও তীব্রতা ঐ কবিতা দুইটাতে আছে কিনা আমি জানি না। প্রশ্নটাকে আলাদা ভাবেই নিলাম আর কি! আসলে যৌনতা একটা বিরাট ফাঁদ। সাহিত্যে এইটার ব্যবহার সবচে জটিল। খুব সহজেই স্লিপ করে। আমার লেখায় যৌনতা হয়ত এই জন্যই খুব চালাকি ভাবে আসে।

জয়: যে রকমভাবে আসছে, গৃহবন্ধনকালে প্রতিদিন ছোট হয় জামা?

রোবায়েত: এইটা আসলে যৌনতা না। অন্য কিছুকে ইন্ডিকেইট করতে চাইছিলাম আমি।

জয়: মেয়েদের চিরকালীন বড় হওয়া ইন্ডিকেট করে হয়তো। কিন্তু যৌনতা থাকে এখানে। একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি?

রোবায়েত: হয়ত থাকে। হয়ত থাকে না। ঐ লাইনটা মেবি নেগেটিভ ইনিফিনিটির দিকে যাত্রা হইতে পারে।

হ্যা। করতে পারেন।

জয়: তুমি যখনই প্রাইভেট টিউটর, তখনই নিজেকে সম্পাদ্যভর্তি জাহাজ মনে হয়, নাকি শুধু রোশনি আক্তারের বেলাতেই হতো। সরি…একটু স্টুপিড প্রশ্ন।

রোবায়েত: সত্যিই জানি না আমি। ‘রোশনি আক্তার’ কবিতায় এমন লিখেছিলাম। এগুলো কিংডম অব ফ্যান্টাসি। আইডিয়াল নারীকে দেখতে চাওয়ার একটা মাধ্যম।


সিকদার আমার কাছে সেই কবি যার নিজের জগৎ আছে। এইটাই বাংলা কবিতার প্রধান সংকট। অনেক ভালো কবিতা লেখা হইছে কিন্তু অনেকেরই নিজের জগত নাই। যেখানে ঢুকলে আপনার সহজেই মনে হবে এইটা একান্ত তারই।


জয়: তোমার ‘ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’ বইয়ে ময়ূর এবং ‘রাইপথ’ বারবার এসেছে। এই রিপিটেশন কি দরকার ছিলো?

রোবায়েত: রাইপথ শব্দটা ঠিক সে অর্থে রিপিটেশন নয়। উৎসর্গে একবার আর কবিতায় একবার। ময়ূর শব্দটি প্রায় ৬ বার ব্যবহার করেছি এইটাকে মেটাফোর হিসেবে আনার জন্য। আর আমার বইয়ের নামটাও তো রাখতে চেয়েছিলাম ‘সামান্য ময়ূর’ সেইটাও একটা প্ল্যান ছিল। যদিও পরে নামটা চেঞ্জ হয়ে যায়।

জয়: ‘নীল উড়ন্ত মাছের চোখ’ আব্দুল মান্নান সৈয়দকে মনে পড়ায়।

রোবায়েত: মনে পড়ানোটা স্বাভাবিক। মান্নান সৈয়দ আমার প্রিয়দের একজন।

জয়: যদি বাংলা সাহিত্যের একজন কবির নাম বলতে বলি, যার কবিতা নিয়ে অনেক আলাপ হওয়া দরকার – কে সেই কবি, কেন তাকে নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার?

রোবায়েত: অবশ্যই জীবনানন্দ। কিন্তু সেইটা অলরেডি হইয়া গেছে। আমি বরং সিকদার আমিনুল হকের নাম বলতে চাই। আপনি হয়ত খেয়াল করে থাকবেন মধ্যযুগের কবিতা তার মেটাফোর ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক কিছুকেই মিথ বানিয়ে ফেলেছিল। যেমন ধরেন বড়ু চণ্ডিদাসের বাঁশি শব্দটা। এইটা পরবর্তীতে এত ভাবে বাংলা কবিতায়, গানে, সিনেমায় এসেছে যে সেইটা অভাবনীয়। ঠিক সেভাবেই রবীন্দ্রনাথও প্রচুর মেটাফোর তৈরী করেছেন। এরপর জীবনানন্দ তো মহান এই ব্যাপারে, আজো নক্ষত্র হেমন্ত শিশির পেঁচা এইগুলো জীবনানন্দকেই স্মরণ করায়া দেয়। অর্থাৎ যেটাকে আমি বলতে পারি কবির নিজের জগৎ সেইটা কিন্তু মেটাফোরের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে।

সিকদার আমার কাছে সেই কবি যার নিজের জগৎ আছে। এইটাই বাংলা কবিতার প্রধান সংকট। অনেক ভালো কবিতা লেখা হইছে কিন্তু অনেকেরই নিজের জগত নাই। যেখানে ঢুকলে আপনার সহজেই মনে হবে এইটা একান্ত তারই। সিকদার আমিনুল হকের সেই বৈকুন্ঠ আছে। এই জন্যই তিনি গ্রেট। আর তার লেখার বৈচিত্র, সাহস তো অদ্ভুত!

জয়: বাংলা কবিতায় কলোনিয়াল হ্যাঙওভার না কমে দিন দিন বাড়ছে। এটা কেন হচ্ছে বলে মনে হয় তোমার?

রোবায়েত: এটা হবেই। আমরা যে ওয়ার্ল্ড অর্ডারের মধ্যে বসত করি সেইটাই প্রধান কারণ। তবে, আমাদের কবিতা কিন্তু ধীরে ধীরে অনেকটাই নিজদের জায়গায় চলে এসেছে কনটেন্টের দিক থেকে।

জয়: তোমার কাছে বাংলা কবিতার ইতিহাসে কোন সময়টাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈচিত্রময় মনে হয়, কেন?

রোবায়েত: অবশ্যই মধ্যযুগ। প্রচুর কাজ হয়েছে এই সময়ে। এবং সেগুলো আমাদের সম্পদে পরিণত হয়ে গেছে অলরেডি। কিন্তু আক্ষেপ হইলো, পরবর্তীতে বাংলা কবিতার সিলেবাস শুরু তিরিশের দশক থেকে।

জয়: আর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর?

রোবায়েত: আশির দশক। ৭০ এর মনোটোনাস কবিতা থেকে তারাই আমাদের কবিতাকে মুক্তি দিয়েছে। আমাদের সময়ের অনেকেই ২য় দশক বলেন। কিন্তু আমি সেটা সময়ের উপর ছেড়ে দিতে চাই। আরো আরো অনেক অনেক দিন পর কেউ যদি ২য় দশককে সবচে বৈচিত্র্যময় মনে করেন সেইটা হবে আসল মূল্যায়ন।

জয়: আরেকটা প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারছি না। আশি, নব্বই আর প্রথম দশক থেকে একজন করে কবির নাম বলো, যাদের তোমার কাছে সেরা মনে হয়।

রোবায়েত: প্রথম দশকে এক জনের নাম বলতে পারবো না।

৮০ এর দশকের মাসুদ খান
৯০ এর দশকের মজনু শাহ

জয়: একজনের নাম বলতেই হবে, রোবায়েত!

রোবায়েত: ১ম দশকের সোহেল হাসান গালিব। তার কাজের বৈচিত্র্যের জন্য।


আমাদের কবিতায় ভাষার উপস্থাপন ভিন্ন। রাইসু ভাই বা টিপু ভাইয়েরা যে ভাষা-ঘরানায় কাজ করছেন সেইটা অনেকটা বাংলা কবিতার স্ট্যাব্লিশড কবিদের ভাষাকে মক করে এবং একটা বিশেষ অঞ্চলের ভাষাকে বাহন করে। কিন্তু আমাদের কবিতায় সেই স্যাটায়ারই এসেছে নিজেদের ভাষাভঙ্গী দিয়ে।


রাজীব: এ সময়ের কবিতা নিয়ে আপনার মুল্যায়ন কি?

রোবায়েত: নিজের সময়ের কবিতা নিয়ে মূল্যায়ন করা সবচে কঠিন। আমি এই সময় বলতে ২য় দশকই মিন করছি তাহলে। প্রচুর লেখা হচ্ছে এখন। অধিকাংশেরই একটা করে বই হয়েছে। কারো কারো আবার বই আসেইনি। তাই সামগ্রিক মূল্যায়নটা সম্ভব নয়। তবে বিচিত্র কাজ হচ্ছে। টানাগদ্য কবিতা যেমন লেখা হচ্ছে প্রচুর, তেমনি ফ্রি ভার্সেও লেখা হচ্ছে। ছন্দ এই সময়ে এসে একটা ওয়েভ তুলেছে, আমি মনে করি এর ফল আমরা আরো কিছু বছর পর পেতে শুরু করবো। আর, ভালো মূল্যায়নের জন্য সময়ই সবচে ভালো পরীক্ষক।

রাজীব: আমার লাগে আর কি, মোটা দাগে বাংলাদেশের কবিতা দুই প্রকার। একটা টাইপ ব্রাত্য রাইসু, সাখাওয়াৎ টিপু, ইমরুল হাসান ভাইদের ঘরানার। যথেষ্ট পলিটিক্যাল। স্যাটায়ারও আছে।  আরেকটা টাইপ আমরা যেরকম লিখি। কোমলমতি। দুঃখি দুঃখি। আপনি কি দেখেন এইভাবে?

রোবায়েত: হা হা। স্যাটায়ার আসলে আমরাও লিখছি। তবে নন্দন ভিন্ন।

রাজীব: আমাদের কবিতা কিরকম স্যাটায়ার?

রোবায়েত: আমাদের কবিতায় ভাষার উপস্থাপন ভিন্ন। রাইসু ভাই বা টিপু ভাইয়েরা যে ভাষা-ঘরানায় কাজ করছেন সেইটা অনেকটা বাংলা কবিতার স্ট্যাব্লিশড কবিদের ভাষাকে মক করে এবং একটা বিশেষ অঞ্চলের ভাষাকে বাহন করে। কিন্তু আমাদের কবিতায় সেই স্যাটায়ারই এসেছে নিজেদের ভাষাভঙ্গী দিয়ে।

রাজীব: আমার তো তেমন লাগে না। কেমন মুখ ভারী মুখ ভারী লাগে।

রোবায়েত: যেমন ধরেন, আমি যখন বলি, ‘হে অশ্ব, দণ্ডায়মান অভিশাপ’ তখন কিন্তু সেটাও এক ধরনের স্যাটায়ার। অথচ রাইসু ভাইদের ভাষায় বলা না এইটা।

ফয়সাল: আমি রোবায়েতের সাথে একমত এইটাতে। ওনারা স্যাটায়ারকে একটা ভাষা-নির্ভর কইরা ফেলতেছেন বলে আমার কাছে মনে হইছে কখনো কখনো। আমি পরে রাজীবরে কিছু বর্তমান  কালের লেখা দেখাবোনে যেইখানে একটা স্যাটায়ার আছে আর ভাষাটাও একটা টাইপের মাঝে পড়ে যায় নাই।

রাজীব: ব্যখ্যা করেন তো একটু

রোবায়েত: ওনাদের ভাষাটা আমার কাছে অধিকাংশ সময়ই শুধুই স্যাটায়ার মনে হয়। কেন যেন মনে হয় ঐ ভাষাটা আমাদের দৈনন্দিনতার পুরো সেটকে ক্যাপচার করতে পারে না। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত ঐ টেক্সট স্যাটায়ারেরই ভাষা হিসেবে থেকে যায়। আর ফয়সাল ভাইয়ের সাথে আমি সহমত।

ফয়সাল: ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে কোট পড়া লোক মাত্রই উকিল, কিন্তু অন্যরা কোট পড়লেও তাদের তখন উকিল উকিল লাগে আরকি।

রোবায়েত: হা হা। ভালো বলছেন ফয়সাল ভাই।

রাজীব: আমার অবশ্য ভিন্নমত। আমার লাগে আমাদের কবিতার টাইপকেই বেশি গতানুগতিক লাগে। ইভেন শব্দেরও একটা লিস্ট বানানো যাবো, বারবার ইউজ হয়ে আসতেছে। একটু এদিক  অইদিক হয়ে।

রোবায়েত: সেইটা আপনি বলতেই পারেন। এইটা আপনার অভ্যস্ততার জন্য হইতে পারে।

রাজীব: আমার বক্তব্যটা মোটা দাগে

ফয়সাল: আমি তো আবার রাজীবের সাথেও একমত হাহা.. বাংলা কবিতায় কিছু শব্দরে রিটায়ারমেন্টে পাঠানো আবশ্যক। নিজের বইয়েও আছে এইগুলা যদিও। তাও বলতেছি। যেমন ধরেন ঘোড়া।

রাজীব: ‘হে অশ্ব, দণ্ডায়মান অভিশাপ’ এটার স্যাটায়ারটা আমি ধরতে পারি নাই। ব্যাখা কইরেন  তো…

ঘোড়ারে খোড়া বানায় দেয়া হইছে ইউজ করতে করতে!

রোবায়েত: রাজীব দার বক্তব্য ভালো লাগছে। নতুন চিন্তা আগাইতে পারে। ঘোড়া তো সারা জীবন দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়াই ঘুমায়। তো তার দাঁড়ানোটারে আমার কাছে দণ্ডিত মনে হয়। এইটা তারে এক ধরনের অভিশপ্ত প্রাণীতে পরিণত করছে। ঘোড়া যদি আপনার বলতেই হয় রাজীব দা তারে কী নামে ডাকবেন? আর ধরেন এই যে স্যাটায়ারের কথা বলতেছেন তাইলে কি ধরবো স্যাটায়ারই কবিতা?

ফয়সাল: একজ্যাক্টলি। বাই দ্যা ওয়ে আমি ঐ ধরনের কবিতাকে গতানুগতিক বলি নাই। আমি বলছি তাদের স্যাটায়ারের ব্যাপারটা একটা ডায়ালেক্ট কেন্দ্রিক। অনেকটা টিভিতে নোয়াখাইল্যা ভাষায় বললেই আমরা যন্ত্রের মত হাসি শুরু করবো, এরকম যে এক্সপেক্টেশন থাকে অনেক পরিচালকের, তেমনই আরকি।

রাজীব: টিভিতে নোয়াখালি শুনে হাসাটা কিন্তু আমাদের সমস্যা। যদি পরিচালক না চান।

হামেদী: ওনাদের কবিতা পড়লে মনে হয়, স্যাটায়ার ছাড়া মানুষের আর কোনও কামই নাই। ওনাদের ব্যাপারগুলি ভাষার সম্ভাবনাকে সংকুচিত কইরা ফেলে। ভাষাটারে শুকনা শুকনা লাগে ।

ফয়সাল: আমার ইমরুল ভাই, ব্রাত্য রাইসু এদের কবিতা ভালোই লাগে। স্যাটায়ারের মনোটনের ব্যাপারটা বাদ দিলে। ক্ল্যারিফাই না করলে ভুল বোঝাবুঝি হইতে পারে।

রাজীব: আমি গরু-ছাগল ফেলে ঘোড়ার কাছে দৌড়াই ক্যান? কারণ, বাংলা কবিতায় ঘোড়ার  একটা ইমেজ, অলরেডি ঘোড়ার মতোন দাঁড়ায় আছে। আমরা উত্তরাধিকার সুত্রে সেই ঘোড়ার ছায়ার নিচে গিয়ে আশ্রয় নিছি।

রোবায়েত: হা হা। রাজীব দা, আমি কিন্তু গরু, মহিষ,‌ মোরগ, সাপ সবই ব্যবহার করছি। শুধু যে  ঘোড়াই ব্যবহৃত হইছে তেমন না।

ফয়সাল: রোবায়েত বর্তমান বাংলা কবিতাকে কি আপনার এই ধরনের প্রতীকের ভারে জর্জরিত মনে হয়? নাকি এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং চালু অনুষঙ্গ এবং এখনো যথেষ্ট বোরিং হয় নাই?

রোবায়েত: শব্দ ব্যবহারকে আমি গুরুত্বের সাথে দেখি। সেক্ষেত্রে ফয়সাল ভাইয়ের সাথে একমত যে কিছু কিছু শব্দ বাংলা কবিতায় এতো ব্যবহৃত হইছে যে সেগুলো ক্লিশে হয়ে গেছে। ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আরো সচেতন হইতে হবে। আর এইখান থেকেই শুরু কবিতা মেকিং-এর ব্যাপারটা। অর্থাৎ, আপনি যখন শব্দের উপর সেন্সর আরোপ করেন সেইটা কিন্তু মেকিং করেই করতে হয়। আর একটা ব্যাপার, শব্দ সম্ভবত ক্লিশে হয় না। ক্লিশে হয় বাক্যে শব্দের অবস্থানে।


যে ধরনের থ্রোয়িং এর আগেই বাংলা কবিতায় হয়ে গেছে বহুলভাবে, সেইটা আর করা যাবে না। আর আমাদের ফোক, প্রান্তিক মানুষের জীবনে ব্যবহৃত ভাষা, কালচারের দিকে তাকাইতে হবে মনে হয়। সেগুলো প্রাণবন্ত।


ফয়সাল: সেটাই, এইটা আমার ব্যাক্তিগত মতামত। নতুন বাংলা কবিতার ম্যানিফেস্টো হওয়া উচিৎ এই সব ক্লিশেকে আইডেন্টিফাই করে বছর বিশেকের জন্য বর্জন করা। নতুন কবিতা হয়তো এভাবেই আসতে পারে।

রাজীব: আমি আপনারে বলি নাই, রোবায়েত। টোটালি বলছি। আর স্যাটায়ার কবিতা না। তবে কবিতা খালি  কান্নাকাটিও না। কিন্তু এখানে কলকাতাবাহিত হয়ে কান্নাকাটিটা পার্মানেন্ট হয়ে গেছে, একপ্রকার। ফলত স্যাটায়ারের যে ধারা তা ছোটতরই রয়ে গেছে। কষা কবিতার ধারা প্রবলতর হয়েছে। তাই হামেদী ভাইয়ের সাথে আমার দ্বিমত, রাইসু-টিপু ভাইদের অপজিট ধারাটাই বেশি মনোটোনাস।

রোবায়েত: আমাদের কবিতায় যে ‘খালি কান্নাকাটি’র কথা বলা হচ্ছে। সেইটা ঠিক না। নানান টাইপের কবিতাই লেখা হচ্ছে।

রাজীব: নানান টাইপটা কম পাবেন। কেউ কেউ যে বলে ফরাসি কবিতার কপি এ ধারাটারে? একমত আপনি?

রোবায়েত: না। একমত না। ফরাসি কবিতা বহুত আগেই লেখা শেষ হইছে বাংলায়।

রাজীব: কবে নাগাদ?

রোবায়েত: আমি যেটুকু ফরাসি কবিতা পড়ছি তাতে সেইটা ৮০ থেকেই শেষ হয়েছে।

রাজীব: ফরাসি কবিতার কথটা ইমেজের প্রসঙ্গে আসে। আমার তো লাগে, এখনও সেই ধারা  প্রবাহমান। খালি ইমেজ আর ইমেজ। এইদিক অইদিক শুধু।

রোবায়েত: রাজীব দা, বাংলা কবিতায় যে ইমেজের কথা বলছেন, আমি অন্তত নিজের কবিতা নিয়ে বলতে পারি, আমার অধিকাংশ ইমেজ শুধু ইমেজ হিসেবে আসে না। এক ধরনের বোধ নিয়েই হাজির হয়।

ফয়সাল: আর রাজীবের অবজার্ভেশন ট্রু, কিন্তু আংশিকভাবে। মনোটন কিন্তু স্যাটায়ার কবিতা বা কান্না কান্না কবিতা না, সামগ্রিক বাংলা কবিতাতেই একটা ব্যাধি এখন। ডিস্টিংক্টিভ এবং সিগনেচার লেখা হইতেছে খুব কম। রোবায়েত কি এই ব্যাপারে একমত? যদি হন, আপনার মতে পরিত্রাণ কি?

রোবায়েত: ভাষা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট সচেতন হওয়া ছাড়া উপায় নাই। যে ধরনের থ্রোয়িং এর আগেই বাংলা কবিতায় হয়ে গেছে বহুলভাবে, সেইটা আর করা যাবে না। আর আমাদের ফোক, প্রান্তিক মানুষের জীবনে ব্যবহৃত ভাষা, কালচারের দিকে তাকাইতে হবে মনে হয়। সেগুলো প্রাণবন্ত। এইটা একটা উপায় হইতে পারে। ফরাসিদের ইমেজ আর আমার ইমেজের মধ্য পার্থক্য আছে যথেষ্ট।

রাজীব: পার্থক্য আছে। তবে ধরেন স্নো-ফল বলতেছে, আমরা কুয়াশা বলতেছি। বা আর কিছু।  এমন না যে স্নো-ফলও বলা যাবে না। আসলে এসময়টাতে নানাভাবেই আপনি স্নো-ফলের ইমেজ  পাবেন। কিন্তু খালি ইমেজই কি কবিতা কি-না?

রোবায়েত: না। খালি ইমেজই কবিতা না। আমার ‘মুখ’ সিরিজ পড়লে সেইটা ক্লিয়ার হবে মনে হয় রাজীব দা।

শিমন: কেউ কেউ হয়তো বলতে চান বা এক সময় বলেছেনও যে, রোবায়েত তো কলকাতার কবি। এবং এই অভিযোগ অবশ্য আমাকেও নিতে হয়েছে। আমি জানি না তারা ঠিক কোন চিন্তা থেকে এরকমটা বলতেন। আমি এ ব্যাপারে কৌতুহলী। তোমার কি মনে হয় নির্মাণের কারণেই তারা এমনটা বলতেন নাকি প্রকাশিত হওয়ার শুরুর দিকে ওপারে বেশি ছাপা হওয়ার জন্যে?

রোবায়েত: তারা ঠিক কোন চিন্তা থেকে সেইটা বলেন আমি জানি না। অধিকাংশ সময় এইটা আমার কাছে প্রোপাগান্ডা মনে হয়। আর কোলকাতা বা বাংলাদেশের সিন্ট্যাক্স কাঠামো প্রায় একই। শুধু কিছু কিছু অনুষঙ্গের ব্যবহার হয়তো ভিন্ন। সম্ভবত কোলকাতায় আমার কবিতা প্রথম দিকে বেশি ছাপা হওয়াই তার কারণ বলে মনে হয়। আর আমাদের এখানে অভিযোগগুলো ছোঁয়াচে বেশ। একজন বললেই সেইটা নিয়ে অন্যরা কথা বলা শুরু করে। ইভেন টেক্সট ভালো করে না পড়েই।

শিমন: অথচ বাংলাদেশে ছাপা হন এরকম পশ্চিমবঙ্গের কোনও কবিকে কিন্তু সাধারণত সেখানে ‘ঢাকার কবি’ বলতে শুনি না

রোবায়েত: হা হা। কেবল বাংলাদেশের কবিতাতেই এইটা সম্ভব। মেধাস্বত্ব অন্যের হাতে তুলে দেওয়া। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ হলে একটা নতুন কাজকে নিজের করে নেওয়ার ফিকিরই থাকতো বেশি।

শিমন: ‘সতীর্থ’ সম্ভবত বাংলাদেশ থেকে বেরুনো প্রথম কোনও কাগজ যেখানে তোমার লেখা প্রথম ছাপা হয় বাংলাদেশে। দু’হাজার তেরো সালে, হৃদিতা সিরিজের চারটে কবিতা। সেগুলো তোমার প্রথম বইয়ে নেই অবশ্য। প্রথম বইয়ে শুরুর দিককার এতো এতো কবিতা খুন করা হয়, ব্যাপারটা নিয়ে তোমার কী মত?

রোবায়েত: আসলে, সতীর্থতে যখন কবিতা ছাপা হয় তখন আমি একদমই নতুন লিখছি, মানে কেবল শুরু করেছি। পরে আমার কবিতাভাবনাও যথেষ্ট চেঞ্জ হয়। সে কারণেই একদম শুরুর দিকের লেখাগুলো বইয়ে নাই। এইটা ঠিক খুন না। নিজের বেস্ট কাজগুলোকে হাজির করার দায়।

শিমন: অবশ্য আমি ওই সিরিজটির ফ্যান। তোমার প্রথম বইয়ের প্রবণতার থেকে হৃদিতা খুব দূরবর্তী নয়

রোবায়েত: আমি নিজেও ফ্যান ঐ লেখাগুলোর। পরবর্তী কোনো বইয়ে ঐ লেখাগুলো নিশ্চয়ই আসবে।

শিমন: তোমার কি মনে হয় না, ‘কবিতা লেখা ছাড়া জাত কবি বাঁচতে পারেন না’ এটা রিলকের বাড়াবাড়ি মত ছিল একটা?

রোবায়েত: পারে তো! র‌্যাঁবো পারছিলেন, সমর সেন পারছিলেন।

শিমন: কবিতা কি ফুলটাইমারদের ডিমান্ড করে, যেরকমটা রাজনীতি করে?

রোবায়েত: না। কবিতা হয়ে গেলে আর কিছুই ডিমান্ড করে না।

শিমন: প্রথম বইয়ে তোমার প্রায় সব কবিতাই শারীরিক অবয়বে সংক্ষিপ্ত, ‘ঘূর্ণ্যমান দেরাজের গান’ ছাড়া। সাম্প্রতিক বাঙলা কবিতা উল্লেখযোগ্য ভাবে সংক্ষিপ্তবাদী হয়ে ওঠার কারণ কী আসলে?

রোবায়েত: এইটা শুধু কবিতায় না। টেকনোলজিতেও আছে। একটা ফোনের মাঝে কত কত ভিন্ন ভিন্ন অ্যাপস। তো, মানুষের ধৈর্যকে কিন্তু এই টেকনোলজি নিয়ন্ত্রণ করতেছে। কবিতাতেও তার  প্রভাব পড়েছে। আর কম কথায় কবিতা কম্প্যাক্ট, ডেনস হইলে বেশি কথায় যাবো কেন! আমি এইটারে বলি ‘মাইক্রোনন্দন’ বা ‘মাইক্রোএস্থেটিকস’।

শিমন: একুশ শতকের কবিতা কি নির্মাণকৌশল সর্বস্বতা বা চাতুরী বা তথাকথিত ছন্দের খেলার ময়দান থেকে অনেকটা ‘শুধু চিন্তা’র ময়দানে এসে সমবেত হয়েছে বলে মনে করো?

রোবায়েত: না। কবিমাত্রই চতুর। সে তার চিন্তাকেই এক্সপ্লোর করে অনেক টুলসের মাধ্যমে।

শিমন: হ্যাঁ, তবে অনেকে টুলস ফ্যাক্টরি তৈরী করে ফেলে আরকি।

রোবায়েত: সে তো করতেই পারে। টুলসকে কতটা মুন্সিয়ানায় ব্যবহার করছে সেইটাই তারে আলাদা করে দেয়।

রাসেল: আমি যদ্দুর জানি, আপনি টাকা দিয়ে বই করেছেন? প্রথমত অভিজ্ঞতা বলেন? দ্বিতীয়ত, নিজের টাকায় বই করার বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?

রোবায়েত: হ্যাঁ। আমি টাকা দিয়েই বই করেছিলাম। টাকা দিয়ে বই করার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই সুখকর নয়। আর বেশি বললাম না। বই নিজের টাকায় হইতেই পারে, তবে সেটা কোনো প্রকাশনীরে টাকা দিয়ে নয়। এইটা ভালোই লাগে আমার। খারাপ না।


আমার তেমন কোনো খারাপ কবিতা নাই যা পাঠ্য-বইয়ে স্থান পেতে পারে।


রাসেল: আপনি প্রচুর লেখেন জানি, কিন্তু প্রচুর বই নেই কেন? ধরেন আপনি সারাজীবনে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো ৫০০০ কবিতা লিখে ফেললেন। সেক্ষেত্রে ১০০ বই করতে আপত্তি আছে কি না?

রোবায়েত: আমি তো ভাবতেই পারি না আমার ১০০ বই হইতে পারে। এইটা বিব্রতকর লাগবে আমার। অনেক লিখি বলেই অনেক বই করতে চাই না আমি। আমি বই এমনভাবে করতে চাই যেন একটা কবিতা দূরের কথা, যেন একটা শব্দের রিপ্লেসমেন্টও বাজে না হয়। এখন তো আর ৩ ফর্মার বইও করার সাহস নাই আমার।

রাসেল: রোবায়েত, আপনার অন্ত্যমিল আর ছন্দজ্ঞান চমৎকার, আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে অন্তত। এবং বড় কথা হলো, এরপরেও লেখাটা সম্ভবত শেষপর্যন্ত প্রাণপ্রাচুর্যময় কবিতা হয়ে ওঠে, অন্তত আমার কাছে। ভয়াবহরকম ভালো ছন্দের মৃত কবিতা আর বালকসুলভ অন্ত্যমিলের ভালো হয়ে উঠছে এরকম কবিতা পড়লে কেমন বোধ হয়?

রোবায়েত: লজ্জা লাগে। মৃত কবিতা নিয়ে কথা না বলাই ভালো।

ফারাহ্: পাঠ্যপুস্তকে আপনার কোন কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হলে আপনি চাইবেন কোন কবিতাটি স্থান পাক ? কেন ?

রোবায়েত: আমার তেমন কোনো খারাপ কবিতা নাই যা পাঠ্য-বইয়ে স্থান পেতে পারে।

ফারাহ্: তার মানে ভাল কবিতা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায় না?

রোবায়েত: বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পায় না।

ফারাহ্: কবিসত্তার কাছে প্রশ্ন : আপনার কবিতা মৌলিক বলে মনে করেন কি ? কেন মনে করেন ? এ বিষয়ে মনের ভেতর কোন দ্বন্দ্ব আছে?

রোবায়েত: মৌলিক বলে কিছু নাই। আমার ভাষাচিন্তা আলাদা। প্রেজেন্টেশন আলাদা। এই যা!

জয়: তাহলে হাসান রোবায়েতের সাক্ষাৎকার শেষ হলো। রোবায়েতের সবার উদ্দেশে কিছু বলার আছে?

রোবায়েত: ধৈর্য নিয়ে যারা এই আলাপ-বিলাপ পড়লেন সবাইকে ধন্যবাদ। যারা সাক্ষাৎকার নিলেন প্রত্যেকেই অসাম। আমি বেশ এনজয় করেছি। সবাইকে আমার কৃতজ্ঞতা।

শেয়ার
সর্বশেষ সংখ্যা