এক দরিয়া শূন্যতা
সবুজ পাতার মাঝে আশ্চর্য সব আলো। হাওয়াদেরও খুব ছুটোছুটি। গাছদের সাজ তখন অবধি কেউ খুলে নেয়নি। ফুলের রঙ দিয়ে আঁকা হচ্ছে সাম্পান। আকাশের কোথাও কোথাও মেঘ জমছে, টুকরো, ছাই ছাই রঙা তবে সেসব খুব অল্প সময়ের জন্য। মেঘ সরে গেলেই আবার হাওয়ার টানে আমরা এক হয়ে, গোল বৃত্ত হয়ে, বুঁদ হয়ে গান গাইছি। আঁকা হয়ে গেল আমাদের সাম্পান।
কম্পাসে রাখা চোখ এখন খুঁজছে দরিয়া।
সেই সাম্পান এবং কিছু গান, এই সম্বল। আমাদের শরীর ভর্তি কুয়াশার বৃত্ত। সেই বৃত্তকে ছোট করে আনতে গিয়ে আমরা জায়গা বদল করি। ইরেজার ঘষে ঘষে ছোট হতে থাকি। একসময় বিচ্ছিন্ন কিন্তু কাছাকাছি অবস্থানের দুটো বিন্দু হয়ে দুদিকে দাঁড়িয়ে দুজন। কখন বিচ্ছিন্নতার শেষ প্রান্তে রাত আসে, রাত শেষ হয়। ভোর হয়ে আসার মুখে ভাগ করে নিই আমরা আমাদের সমস্ত কথা।
আমার হাতে জমে ওঠে তোর উষ্ণতা। তোর চোখে সেঁটে যায় আমার জলের রঙ। দুজনে মিলে এবার একটা দ্বীপ খুঁজতে বেরোই। খুঁজেও পাই। চারপাশে থৈথৈ অগাধ জল। বালি চিকচিক, সামনে এগোই। পিছনে যাই। বিন্দু কি মানুষের চেয়ে বড়? তোকেই জিগ্যেস করি। তুই গেয়ে উঠিস, ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে সাথীরে.. তোর চোখে তখন চুলের ছায়ার মত চিরল বিকেল নামছে। তুলিতে তোর সায়াহ্নের রঙ। প্রথম চুমুটি আঁকছিস তুই। প্রাণে প্রাণ লেগে টলমল করে জল। জলরাশি.. দুজনে মাখামাখি দরিয়ার জলে; নুনের বন্ধনে।
তারপর আবার তোর চুলের ফাঁক গলে যত চাঁদের গল্পরা হুটোপাটি ঢুকে পড়ছে.. টের পাস? আমার কাছ থেকেও শব্দ ছিটকে যায়। পড়ে থাকে একাকি বিষণ্ণ নুড়ি। খুব কাছাকাছি তোর, অথবা আমার, থেকে থেকে খুব ধীরে স্পষ্ট হয় আরও একটি বিন্দু, টের পাস? বল পাস? ঈশানের মেঘে কে যে এত ওড়ায় সিঁদুর?
দূরে, পেন্সিল ঘষে ঘষে কে লিখে রাখে যেন, শূন্যতা..
অন্ধ সে অরণ্যে যখন
উত্তরের কার্নিশ ঘেঁষে প্যারাগ্লাইডিং ভঙ্গিতে দাঁড়ালে এ পাড়ার শেষ মাথা অবধি দেখা যায়। আবার এক পাঁশটে আকাশের নিচে দমবন্ধ চিলেঘর। মেঘগুলো ঝুলে আছে এদিক সেদিক। মনে পড়ে, সেখানে দাঁড়িয়ে কেউ রোদ কুড়াচ্ছে খড়কুটো মেখে।
আমাদের পারস্পরিক সম্মতিপত্রটির কথা কেবল জানতো শৈশবের বকুলগাছের কোটর! বাকি কথা কবেই বলা হয়েছে মেঘের ঠিকানায়। সে সমস্ত বলার ভেতর দিয়ে একটা অস্পষ্ট অবয়ব ফুটে উঠতে গিয়েও কেন যেন ফোটেনি আর। তার কথা ভাবলে এই অবেলায় চোখের ভেতর, বুকের ভেতর কেন বলো তবে আজও এত তরঙ্গ জাগে.. মন, ও মন সে কি তুমি, ডেকে নিতে চাইল যে, আর যাকে আমি খুঁজলাম জীবনভর সেও শুধু এইটুক ক্ষীণ আলো হয়েই ভেসে রইল আমার আকাশে..কে সে?
তামাম চিলেঘর থেকে আজও বৃষ্টি ঝরে। একটানা ঝরঝর, ঝরঝর। আমি বাসনকোসন পেতে, খবরের কাগজের ওপর বসে থাকি একঘর বই বাঁচাবো বলে। বৃষ্টির ছাঁট লেগে ভিজে ওঠে মন খারাপের পাতা। তারপর কখনো বৃষ্টি থামে। দেয়ালে দেয়ালে ছায়ার মত সন্ধেরা নেমে আসে। তখন তুমি ঝাড়বাতির আলো তুলে নাও আঙুলে। তোমার দীর্ঘ ছায়া আমার জানলা বরাবর..তোমার দীর্ঘ ছায়া আমাকে দ্বিখণ্ডিত করে। ব্যালকনি জুড়ে তোমার জেসমিন গন্ধের ওড়াউড়ি। স্নানের দেয়াল জুড়ে তখন আমি লিখতে থাকি – মন খারাপ, মন খারাপ.. কেন যে সুর লাগে না সুরে, পিছন ফিরে আর মেলাতেই পারি না অমলিন সব সমিল সঙ্গীত!
এইসব রঙচটা দিন আর যুগলবন্দী কাশের হেলে পড়ার ভঙ্গিতে বুঝতাম এক রাশ লাল পিঁপড়ে মগজে সার বেঁধে চলছে। অকালবোধন, উৎসব, ভাসান.. শুরু থেকে তুমিও তো ছিলে। সেও হয়ত ছিল। কিন্তু আমার প্রতিটি না দেখার ভেতর ছিল অস্পষ্টতা। প্রতিবার ভেঙে পড়ছিল কাচের ঘর, ভেঙে পরছিল স্নান। অথচ কুয়াশার দাঁড় বেয়ে কেউ আসছিল আমার শৈশবশহরে। বুকের ভেতর দ্রিমি দ্রিমি নিয়ে আমি তার অপেক্ষায় কতগুলো ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড.. কবে যেন এসব অপেক্ষা পেরিয়ে আমার একাকিত্বের ভেতর ভেতর অরণ্য তৈরি হলো আর চারদিকে আলোর কারফিউ ..
এখানে অন্ধকার
তুমি বা সে কাউকে আর আমি দেখতে পাই না..