ভ্রমণ ।। মাহবুব ময়ূখ রিশাদ

একটা সময় ছিল যখন ভাবতাম গল্প লিখতেই বসলেই বুঝি লেখা হয়ে যায়, লিখেছিও অনেক। মোবাইলে, ক্লাসের ফাঁকে। যেদিন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং শহীদুল জহির পাঠ করে ফেললাম, সেদিন থেকে গল্প নিয়ে চিন্তা-ভাবনা অনেকাংশে বদলে গেল। নিজের বইয়ের ভুলগুলো বড় প্রকট হয়ে চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো। সময়ে শিখছি, জানছি। এবারের পান্ডুলিপি সময় নিয়ে করা। পত্রিকায় কিছু গল্প ছাপা হয়েছিল। সেগুলো পরবর্তীতে সম্পাদনা করে পান্ডুলিপিতে দেয়া হয়েছে। আগের সাথে এটা একটা পার্থক্য বটে- গল্প প্রকাশে তাড়াহুড়ো কমেছে। গল্পের ক্ষেত্রে ভাষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার নিজের ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করি এবং নিজের ভাষাতেই চেনা জগতের গল্পটাই বলতে চাই। – মাহবুব ময়ূখ রিশাদ


বইয়ের নামঃ ক্রুশপথে নিখোঁজ গল্প
প্রকাশকঃ অনিন্দ্য।
প্রচ্ছদঃ কাব্য কারিম।


ভ্রমণ ।। মাহবুব ময়ূখ রিশাদ

রাজুকে পুলিশ খুঁজছে। এই খবর কানে আসার আগেই লাল রঙের থ্রি-কোয়ার্টার-প্যান্ট, হলুদ গেঞ্জি পরে, পাশের বাসার ছেলের স্কুলব্যাগ কাঁধে নিয়ে সে পালিয়ে গেল। কিছুদূর পথ পার হলে, সে বুঝতে পারল, ব্যাগটি অহেতুক ঝামেলার সৃষ্টি করছে। রাস্তার পাশে ব্যাগ নামিয়ে চলে যেতে চাইল। একটু পর আবার পেছনে এসে চেইন খুলে দেখতে গিয়ে বেশ বিষম খেল রাজু।

তার বয়স এখন কেবল ষোল। তাই ব্যাগ খুলে কনডম আবিষ্কার করে বিস্মিত হলো রাজু। সাত বছরের বাচ্চার ব্যাগে এই জিনিষ অথচ তার কাছে নেই। রাখতে হবে এমন ভাবনাও মাথায় আসেনি। সে ক্ষিপ্ত হয়ে ব্যাগ ফেলে দিল। আচমকাই খেয়াল করল যে পথে সে পালিয়ে যাচ্ছে সেই পথ চেনে না।

অনেক দূর-দুরান্ত পর্যন্ত মানুষের ছায়া নেই। একটা বিল্ডিং দেখতে পেল দুমড়ে আছে চানাচুরের প্যাকেটের মতো, রডগুলো বাঁকা হয়ে ঝুলছে সাপের মতো প্যাঁচ খেয়ে।  ব্যাগের কথা ভেবে পুনরায় বিষণ্ণ হয়ে উঠল সে। ব্যাগটি তার ছিল না কখনোই, ভেবেছিল সাথে থাকলে জিনিষ নিতে সুবিধে হবে কিন্তু কিছুই সে নেয়নি, উপরন্তু কনডমের আবির্ভাবে খানিকটা এলোমেলো বোধ করল সে। যেহেতু বয়স কম, সেহেতু রাজু বুঝতে পারেনি যে তার কাছে শূন্যতা ব্যতীত কিছু নেই। শূন্যতাকে বহন করতে চাইলে ব্যাগ কেবল বাহুল্যমাত্র, তারপরেও মন খারাপের অনেক কারণ থাকা সত্ত্বেও তার এই একটি জিনিষ নিয়ে খারাপ লাগতে থাকল।

মধু ভাইয়ের কথা শুনে সে বাড়ি ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অবশ্য রাজুর জানা নেই ভোররাতে ময়নার ডোবায় ভাইয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছে। আর তাকেই সন্দেহভাজন হিসেবে খোঁজা হচ্ছে।

ব্যাগ পেছনে ফেলে, আলগোছে কনডমের প্যাকেট, প্যান্টের পকেটে চালান করে দিল সে। পকেট বেশ আঁটসাট। আশেপাশে লোক না থাকলেও তার ভয় হয় কেউ যদি বুঝে ফেলে কী ভয়ংকর এক মারণাস্ত্র নিয়ে পথ চলছে রাজু। তার ভাবনায় আসে কিভাবে এই জিনিষটি কাজে লাগানো যায়। বুঝতে পারে আর যাই হোক এমন  পোশাকে বাড়ি ছাড়া উচিত হয়নি, নিদেনপক্ষে গত ঈদে উপহার পাওয়া গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট পরে আসতে পারত।
ভাঙা বিল্ডিং-এর শিয়রে সে বসল। মাথার উপরে তখন দুপুরের সূর্য।

এই যে দেখ, তুই পড়াশোনা করতেছিস, স্কুলে যাচ্ছিস, লাভ কী এতে?

বেশ কিছুদিন আগের কথা। সোনারগাঁও-বাংলামোটর জংশনের পাশে ইউনিলিভারের অর্থহীন বিশাল স্তম্ভের নিচে দাঁড়িয়ে মধুভাইয়ের এই কথা শুনে প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি রাজু।

স্কুলের আবার লাভ-ক্ষতি কী? যাইতে হয় তাই যাই। রাজু উত্তর দিয়েছিল।

আহত বিল্ডিং এর ফাঁক-ফোকর দিয়ে ইঁদুর দৌড়ে যেতে দেখে রাজুর মনে পড়ল, মধু ভাই এটাও বলেছিল, আমাদের সবার ইঁদুরের জীবন। সে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পলায়নরত ইঁদুরটি দেখতে চেষ্টা করল। দেখতে পেল না। ঝোপের ভেতর হারিয়ে গেছে।

দেখ তো, তুই নিজেই ইঁদুর কিনা? মধু ভাইয়ের কণ্ঠ শুনতে পেল।

মধু ভাই এখানে নেই। তাই শোনাটা যে ভুল চমকে না গিয়েও বুঝতে পারে সে। কানে ভেসে আসা কথাটি অর্ন্তনিহিত অর্থ বুঝতে চেষ্টা করেও পারল না। তার একবার মনে হলো, মানুষ হয়তো অমন করেই পালিয়ে বেড়ায় কিংবা মানুষ মূলত নিকৃষ্ট শ্রেণির প্রাণীর মতো, নিজের অস্তিত্ব রক্ষা ব্যতীত যাদের আর কোনও জীবন-দর্শন নেই। বাড়ি থেকে আচমকা এভাবে পালিয়ে আসার জন্য এই প্রথমবার মন খারাপ হলো তার। প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ঐদিন সোনারগাঁও মোড়ে।

তুই একটা জায়গায় যাবি, লাভ-ক্ষতি ভাববি না?

চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল রাজু। উত্তর দিয়েছিল, আব্বা রাগ করবে।

মধু ভাই হেসে উঠেছিল। চলমান ভ্যানগাড়ির ব্যস্ত ফুচকা বিক্রেতা বক্র চোখে তাকিয়ে থাকল কিছু মুহূর্ত; বসে বসে হাসছে বয়সের পার্থক্যে বন্ধু হিসেবে বেমানান দুজন, অর্ডার দিচ্ছে না কিছুই। তারপরেও তাড়িয়েও দিতে পারছে না দোকানদার।

রাজু বলেছিল, লাভ-ক্ষতি আব্বা ভাববে নি। এসব প্রশ্ন করে মাইর খাওয়ার শখ নাই।

মধু ভাই চুপ করেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। পায়ের কাছে কুকুর ঘুরঘুর করছিল। কুকুরে আবার বেশ ভয় রাজুর। সে উঠে যেতে চেয়েছিল। মুঠোর ভেতর তার হাত ধরে রেখেছিল মধু ভাই।

তোর কিসের শখ?

সত্যি ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল রাজু। এখন এই অবস্থায় বাড়ি থেকে দূরে, মধু ভাই দূরে বসে সে ভাবে, ভাগ্যিস ঝামেলায় পড়েছিল।

অচেনা জায়গায় বসে সে ভাবে, যদি বাড়ি ফিরে যায়, তবে কী কী হতে পারে? একবেলা কি দুইবেলা বাড়ির বাইরে থাকার জন্য তাকে বাড়তি প্রশ্ন কেউ করবে না, হয়তো কেউ খেয়াল করেনি তার এই গরহাজিরতা, স্কুলে তো দু একদিন এবসেন্ট হতেই পারে; সুতরাং এখন ফিরে গেলে সব আগের জায়গা থেকে শুরু হবে। আগের জায়গা থেকে শুরু হওয়া মানে, যা করতে চাচ্ছে না, তাই করে যেতে হবে। কিন্তু মধু ভাইয়ের করা প্রশ্নের জবাব সে এখনো পায়নি। তার শখ কী? সে কোথায় যাবে? এভাবে রাস্তায় বের হবার বুদ্ধি ভাইয়ের। রাজুর ভাবতে ভালো লাগে, এরপর যখন ওনার সাথে দেখা হবে তখন নিশ্চয় নিজের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা বলে তাক লাগিয়ে দেয়া যাবে। বাস্তবে যদিও এখনও এই ভাঙা বিল্ডিং আর পলায়নরত ইঁদুর ছাড়া কোনও কিছু দেখার সৌভাগ্য হয় নি। কনডমের কথা আবার মনে পড়লে, পকেটে হাত দিয়ে দেখে। হ্যাঁ, এটার কথাও বলা যাবে মধু ভাইকে।

সূর্যের উত্তাপ বাড়ছে। রাজুর মনে হলো, নদীর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। সে উঠে দাঁড়াল। নদীর শব্দ রাজুর একবারে বোঝার কথা নয়। নদী দেখেছে খুব কম। নানুবাড়ি ময়মনসিংহ। ব্রম্মপূত্র নদ। মাঝে চর। পার্ক। ছোট ছোট নৌকা। স্রোত নেই, ঢেউ নেই, কেমন উচ্ছ্বাসহীন, একঘেয়ে, শান্ত। নানার হাত ধরে যেত পার্কে। বয়স কম। স্মৃতি মলিন।

বিল্ডিং-এর চারপাশে ভাঙা দেয়াল। ধসে আছে। দেবদারু গাছ ছায়া দিচ্ছে এই ভূতুড়ে বাড়িটিকে। একপাশে গাছের ছায়া পড়েনি। সেখান দিয়ে সরু রাস্তা বাড়ির পেছন দিকে চলে গেছে। পানির একটা ছোট্ট ধারা পিঁপড়ের সারির মতো এগিয়ে যাচ্ছে কোনও গন্তব্যে। মাটি আছে জায়গাটায়। ঘাসের জঙ্গল নেই। দেখে মনে হয়, এই ছোট্ট পথে মানুষের যাতায়াত আছে। রাজু এগোয়। দেখতে পাই, ঠিক যেন বাড়ির পেছনে মাটি ফুরে বের হয়ে বিশাল জলরাশি চঞ্চল ছোটাছুটি শুরু করেছে।

রাজুর ছোটবেলায় দেখা নদীর মতো শান্ত নয়। বড় ঢেউ। রাগী ঢেউ। রাজুর মনে হলো, বাবার মতো রাগী। এক পা পিছিয়ে আবার সামনে যায় সে। পাতাহীন, কেবল শিকড়সমৃদ্ধ গাছের আড়াল থেকে এক কিশোরী বের হয়ে আসে। ভেজা চুল, গ্রামীণ চেকের ফতুয়া, হাতে বৈঠা।

রাজুর একবার মনে হলো, মেয়েটি এগিয়ে আসছে, আরেকবার মনে হলো, কেউ আসলে নেই সেখানে। চোখ কয়েকবার খুলে বন্ধ করল, নিজেকে চিমটি মেরে দেখল। একটা বানর দেখতে পেল। অমন নগ্ন গাছে, বানরের কী কাজ? এমন যখন মনে হচ্ছিল, ঠিক তখন বানরটি গাছ থেকে লাফিয়ে ঠিক তার পায়ের সামনে এসে পড়ল। ভয় পেয়ে একটু পেছনে সরে যেতে, গর্তে পা পড়ল রাজুর। কট করে শব্দ হলো। প্রথমে মনে হলো, বুঝি পা-টাই মচকালো, কিন্ত ব্যথা অনুভব না করায় নিচে তাকিয়ে রাজু দেখতে পেল,শত বছরের পুরোনো গাছের ডাল অবশেষে দ্বি-খন্ডিত হয়ে প্রাণ দিল বুঝি।

পথ ভুলে গেছে, পথিক?

গাছের জীবন নিয়ে ভাবার আর অবকাশ পেল না রাজু। কিশোরী, তার কাঁধে বানর-  তারমানে সে ঠিকই দেখেছিল। পকেটে সে আচমকাই কনডমের অস্তিত্ব পুনরায় অনুভব করল। টের পেল, লাল হয়ে আসছে চোখমুখ। পলকহীনভাবেই সে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে, যত না চোখের দিকে, তারচেয়েও বেশি বুকের দিকে।

টের পেয়েই বোধহয় মেয়েটি পোশাক ঠিক করে নিতে চাইল। খানিকটা বিরক্তও হলো হয়তো। যেচে কথা বলতে গিয়ে এমন সম্ভাষণ কে প্রত্যাশা করে?

ব্যাপারটা টের পেলেও ভাবান্তর হলো না রাজুর। উলটো আরো গভীরে দেখতে পেল সে। মেয়েটির ফতুয়ার অর্ধখোলা বোতাম, বাদামি চামড়ায় ছোট পশমে জমে থাকা শিশিরবিন্দুর মতো ঘাম পার হয়ে তার দৃষ্টি মেয়েটির অন্দরমহলে চলে গেল। দেখতে পেল- এই নদী নয়, অন্য কোনও অপার্থিব নদী তীরে পাড় থেকে পা দুলিয়ে মেয়েটি বসে আছে। জলধারা এখানে পোষ মেনে শান্ত। মেয়েটির পায়ের কাছে বাধ্য কুকুরের মতো ঘুরঘুর করছে জেলীফিস। মজা পেয়ে গেল রাজু। এবার তার চোখের অদৃশ্য রশ্মি অজান্তেই এফোঁড়-ওফোড় করে দিয়ে আরও গহীনে প্রবেশ করল। এবার সে অবলোকন করল, হিমালয় চূড়া- সেখানে বসে আছে মেয়েটি, অবনত মস্তক, ঠান্ডায় কাঁপছে। কী ভীষণ একা! মেয়েটির আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলে রাজুর চোখে দৃশ্যমান হলো, আমাজন কিংবা অন্যকোনও গভীর জঙ্গল। মানুষখেকো গাছ ঘিরে আছে কিশোরীটিকে। বড় বড় হা। তাকে গিলে ফেলতে এগিয়ে আসছে। সেই গাছের ভেতরে নিজের চেহারা দেখতে পেয়ে রাজুর ধ্যান ভাঙল। এবার বাস্তবে মেয়েটির দিকে তাকালো এবং আবিষ্কার করল, মেয়েটি প্রায় নগ্ন, রাজুর হাত তার শরীরে ব্যস্ত। চোখেমুখে তীব্র ঘৃণা আর ভয় নিয়ে তাকিয়ে আছে পথিক বলে ডাক দেয়া, মায়াময় কিশোরীটি।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রাজু। এদিক সেদিক তাকিয়ে পূর্বের পথ ধরে দ্রুত সরে আসল সে। এটা ঠিক কী ঘটল? কেন এমন হলো? এই মুক্তির কথা নিশ্চয় বলেনি মধুভাই, এমন মুক্তি চায়নি সে-ও। যাত্রার শুরুতে কনডম প্রাপ্তি কি তার মাথায় এটা ঢুকিয়ে দিল? নিজেকে ধিক্কার দিল। ভাবল, পেছনে ফিরে মেয়েটির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে। মেয়েটি মাফ না করলে, নদীতে ঝাঁপ দেবে। সাঁতার জানা নেই তার। স্রোতে মিশে যেতে বেশি সময় লাগবে না তার। তাছাড়া, যে জীবন পেছনে ফেলে এসেছে, ঐ জীবনে তো সে ফিরে যাবে না। যে জীবনে সে যাচ্ছে, তার শুরুই কিনা ধর্ষকাম দিয়ে? সুতরাং আত্মহত্যা করার পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রাজু। অথচ দেখতে পেল ম্যাজিকের মতো সবকিছু তার সামনে থেকে বিলীন হয়ে গেছে, সে এখন দাঁড়িয়ে আছে জনবহুল এক বাজারের মাঝে।

বিহবল হয়ে পড়ল রাজু। কোথায় আছে, কোথায় যাচ্ছে, কেন এভাবে চলে এসেছিল কিছুই আর ঠাহর করতে পারল না। সে ভাবল, নিজেকে অনুসন্ধানের  প্রচেষ্টা এবার ক্ষান্ত দেয়া উচিৎ। তাছাড়া, কাল রাতে প্রথমবারের মতো গঞ্জিকা সেবনে এলোমেলো লাগছে কিনা, তাও স্পষ্ট হয়ে বোঝা দরকার। মধু ভাই নিজেকে জানতে বলেছেন, বাড়ি থেকে বের হতে বলেছেন, পৃথিবী দেখতে বলেছেন, মানুষ দেখতে বলেছেন, নিজের কোন জিনিষটা করতে ভালো লাগে তা খুঁজে বের করতে বলেছেন। কিন্তু নিজের ভেতরের আসল পরিচয় যে মেয়েটির সামনে এভাবে কুৎসিতভাবে ধরা পড়বে, তা কী আর বুঝতে পেরেছিল সে কিংবা মধু ভাই?

ভরা বাজারের মাঝে আবার মেয়েটিকে দেখতে পেল, সবজি বিক্রেতার বেশে। দৌঁড়ে পালাতে নিল রাজু- পাছে ধরা পড়ে যায়। কোনমুখে সে দাঁড়াবে আবার তার সামনে? টের পেল কিছু একটা তাকে টেনে ধরছে, পালাতে দিচ্ছে না, টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটির সামনে। ভরা মজলিশে আবারও যেন মতিভ্রম ঘটল রাজুর। আগের মতো করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাজারসুদ্ধ মানুষ ছুটে এসে তাকিয়ে ছাড়িয়ে নিল। এবার নিশ্চিত গণপিটুনি। গেল বছর তাদের এলাকায় তো এভাবে একজন চোরকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল।  রক্ত, হাড্ডি ভেঙে একাকার। হাসপাতালে নেয়া পর্যন্ত বাঁচেনি মানুষটি। রাজু ভাবল, এভাবেই তবে কপালে মরণ লেখা ছিল? এভাবেই? তার ভেতরটা এত নোংরা? এটা জেনেই তবে মরতে হবে? কিন্তু রাজু বেঁচে গেল। তার সঙ্গে ওসব কিছুই হলো না। মানুষজন তাকে ছেড়ে দিয়ে মেয়েটিকে ওড়না ঠিক করতে বললে, রাজুর ইচ্ছে হলো মাটির সঙ্গে মিশে যেতে, যদিও তার চেহারা দেখে তা মনে হয় না সামনে কাঁদতে থাকা মেয়েটির। মেয়েটির মনে হলো, এক বখাটে ছেলে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ভিড়ে মিশে যাচ্ছে।

 

দুই.

রাজুর গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। একজন কিশোর, তার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং পরে নিজের অন্ধকারের আবিষ্কার হওয়া; এমন গল্প অজস্র ছেলের, কালের সাথে মিশে যায়, আলাদা কোনও মাধুর্য কিংবা দুর্গন্ধ তৈরি করে না পৃথিবীর স্রোতে। না, গল্পের রাজুও মহাকালের নিরীখে বিন্দুকণা ব্যতীত কিছু নয়, সেও বাড়তি কিছুই যোগ করবে না, তারপরেও জীবন যেমন থেমে থাকে না, রাজুর গল্পও এখানে শেষ হয় না।

রাজু দ্রুত বের হয়ে গেল বাজার থেকে। তার সামনে এখন কেউ আয়না ধরলে, সে নিজেই অবাক হতো। অদ্ভুত বৈপরীত্য তার চেহারা ও অন্তরের ভাষায়।

বাজার থেকে বের হয়ে মফস্বলের চার-রাস্তার মোড়ে এসে পড়ল। এটা কোন শহর, ভাবার অবকাশ পেল না। চারপাশ থেকে যাত্রীবাহী অটোগুলো খামচে ধরতে চাইল যেন তাকে। সে কোনোক্রমে, ফুটপাতে সরে এলো। ফুটপাতেও অজস্র হকার। মানুষ। রাজুর দমবন্ধ, দমবন্ধ লাগল। মনে হলো, অল্প কয়েক ঘন্টায় তার বয়স বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এমনকি মুখ হালকা গোফের অস্তিত্ব অনুভব করল সে। হাত দিয়ে টের পেল, হালকা গোঁফ নয়, একেবারে পুরষালী গোঁফ। তবে বয়স বেড়ে যাওয়া বিষয়ক তার চিন্তাটি যে অমূলক নয়, ভেবে খুশি হলো। কিন্তু, এখন সে কোথায় যাবে?

রাজুর ভাবতে ইচ্ছে হলো, পুরো ব্যাপারটি একটি দুঃস্বপ্ন। সে বাড়ি থেকে পালায়নি, তার বাসায় কোনও সমস্যা নেই, মধু ভাই তাকে কিছু করতে বলেনি, সে এখন ঘুমিয়ে আছে, ঘুম থেকে উঠে সে স্কুলে যাবে, ক’দিন পর তার এসএসসি পরীক্ষা।

এখান থেকে ফোন করা যায়। সাইনবোর্ডটি দেখতে পেয়ে ছুটে গেল রাজু। মধু ভাইয়ের নাম্বার মুখস্থ আছে। ফোন দিল সে। খানিকক্ষণ বেজে বন্ধ হয়ে গেল। আবার ট্রাই করল সে। রাস্তার কাজ চলছে। বেশ শব্দ। শব্দ থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়াল। তার সঙ্গে যা ঘটছে, মধু ভাইকে বোঝাতে হলে নির্জনতার প্রয়োজন। এবার অপরপ্রান্তে ফোন ধরল। কান্নার শব্দ শুনতে পেল রাজু। ফোনের ওপাশে বেশ হৈ-চৈ।

হ্যালো, দ্বিধা নিয়ে বলল রাজু।

জ্বি, বলেন।

এটা মধু ভাইয়ের নাম্বার না?

হ্যাঁ, ছিল। এখন আর নাই। আপনি কে?

রাজু ভাবল, নাম্বার ভুলে অন্য কোথাও ফোন করে ফেলেনি তো? হাতের তালুতে মোবাইল নিয়ে, চোখের সামনে ধরে দেখতে পেল- না, নাম্বার ঠিক আছে।

ওপাশ থেকে জানতে চাইল, আপনি কে?

আমি, রাজু। মধু ভাইয়ের ছোটভাই।

ওরে, হারামজাদা, হারামখোর, মাদারচোদ…

রাজু আর শুনতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে ফোন রেখে দিল। দোকানিকে টাকা দিতে যাবে, ঐ সময় নাম্বার থেকে পাল্টা ফোন এলে খুব দ্রুত টাকা দিয়ে বের হয়ে আসল রাজু।

ঘটনার প্যাঁচগুলো মেলাতে চেষ্টা করল সে। আখের শরবত বিক্রি হচ্ছে। সেটা গলায় ঢেলে একপাশে স্থির হয়ে বসল। এই অবস্থা থেকে যে উদ্ধার করতে পারত, সে মধু ভাইকে ফোন দিয়ে কোনও কুল-কিনারা তো পেলই না বরং আরও বেশি ধোঁয়া রাজুকে ঘিরে ধরল। হতে পারে, মধু ভাইয়ের মোবাইল হারিয়ে গেছে কিংবা অন্য কেউ ধরেছে। অন্য কেউ ধরলে, এই কথা নিশ্চয় বলত না, হ্যাঁ, ছিল। এখন আর নাই। আর যদি কোনো কারণে বলেও থাকে, তাকে কেন গালি দিবে?

হাঁটু গেড়ে বসায়, প্যান্টের পকেটে শক্ত কিছু একটা লাগল। এটা আবার কী? পকেট থেকে বের হলো, কুরবানীর মাংস কাটার চাপাতি। এবার হেসে ফেলল রাজু। নিশ্চিত হয়ে গেল, পুরো ব্যাপারটি একটি দুঃস্বপ্ন। তার ছোট পকেটে এত বড় চাপাতির জায়গা হবার কথা নয়, জায়গা হলেও তাকে বিন্দুমাত্র রক্তাক্ত না করে, চুপচাপ সুবোধ বালকের মতো বসে থাকার বান্দা নিশ্চয় চাপাতি না; বাড়ি থেকে বের হওয়া অব্দি এতক্ষণ তো কম ঘটনা ঘটেনি। পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল রাজু। ঘুম চলে এলো। ভীষণ ক্লান্ত সে। ঘুমের ভেতরে ঘুম। স্বপ্ন আর কতক্ষণ চলবে? কিছুক্ষণ পর নিশ্চয় ভেঙে যাবে।

 

তিন.

না, ঘুম ভেঙে রাজু দেখল, এখনো সে স্বপ্নের ভেতরেই আছে। জায়গা পরিবর্তিত হয়েছে কেবল। চার দেয়ালের ভেতরে বন্দি। জেলখানা। ক’দিন আগে দেখা আয়নাবাজি মুভির আয়নার মতো কিছুই সে করে না, সুতরাং এখানে এভাবে বসে থাকাটা অসম্ভব বটে। স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার জন্য অস্থির হয়ে উঠল।

পাশে থাকা ডোরাকাটা জামা পরনে আরেক কয়েদি। তাকে চোখ খুলতে দেখে বলল, তুই তো দেখি বেশ। এই বয়সে একেবারে জব্বর চাপাতি চালানো শিখেছিস।

লোকটাকে চেনা মনে হলো রাজুর। চিনতে পারল না। উত্তরও দিল না প্রশ্নের।

তা, মধুরে মারলি কেন? তার সাথে তোর বেশ চলাফেরা ছিল, বলে শুনেছি।

মধুকে মেরেছি? চাপাতি? এসব, আপনি কী বলছেন?

ওরে সাধু, খালি কি খুন? তুই তো ধর্ষণ মামলারও আসামি। বয়স কম দেখে, ন্যাকা সাজা হচ্ছে ?

লোকটির চেহারা হিংস্র হয়ে উঠল। রাজু কেঁদে ফেলল দেখে। বলল- বাড়ি যাব, বাড়ি।

বিশ্রীভাবে হেসে ফেলল লোকটি। শখ কত, বান্দার। তোর মুক্তি নাই। সাজা হইলেও মুক্তি নাই। ছাড়া পাইলেও মুক্তি নাই।

রাজু অজ্ঞান হয়ে পড়ল। এরপর অচেতন অবস্থায়, অবচেতন মনে দেখতে পেলো, ময়নার ডোবায়, মধু ভাইয়ের বুকের উপর ছুরি চালাচ্ছে সে। মৃত্যু নিশ্চিত করে, ছুরি হাতে নির্বিকার ভাবে লাশটি ফেলে চলে গেল। এরপর বাড়ি গিয়ে ব্যাগ নিয়ে পালানোর পথে যাত্রা শুরু করল। পথে এক জায়গায় থেমে, একজন থেকে নোটের তোড়া হাত নিল। তবে কি সে কন্ট্রাক্ট কিলার?

অবচেতন অবস্থায় বহুদূর থেকে, বাবা-মা’র কণ্ঠ ভেসে এলো।

ছেলের দিকে খেয়াল রাখতে পার না? মা হইস কিসের জন্য?

হ্যাঁ, দোষ তো আমার। বলসিলাম, বাচ্চা নেয়ার দরকার নাই আর। চারটা আছে। শুনলেন না, আমার কথা। এই পোলাই এখন বংশের সব বাতি নিভায় দিবে।

মা’র পাল্টা প্রশ্নে বাবার গলা থেমে আসল। মিনমিন করে বলল, তখন কি আর কনডম-টনডম ছিল ঐরকম। পিল-পুলের ব্যাপারগুলাও কি বুঝতাম?

রাজু অজ্ঞান অবস্থাতেই দেখতে পেল, পকেটে থাকা কনডমটিও চাপাতির স্পর্শে ফুটো হয়ে গেছে।

স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝে ঝুলে থাকতে থাকতে রাজু ভাবল, সুযোগ পেলে আরও কয়েকটা খুন করবে রাজু। নিজের আত্মপরিচয়ের প্রকৃত সন্ধান পেয়ে একেবারে মন্দ লাগল না তার।

শেয়ার