কার্টুন নিয়ে আর দশটা মানুষের মতো আমারও আগ্রহ কম। তবে তাকে অপছন্দ করি না। খুব যে ভালোও বাসি তাও না। কিন্তু ভালো কার্টুনের প্রতি ভালোলাগা তো বটেই, ভালোবাসাও আছে। পাশাপাশি যেইটা আছে, সেইটা কার্টুনকে বাজে দৃষ্টিতে না দেখার মানসিকতা। বোধকরি এই যোগ্যতার দরুন মেহেদী হক-এর লেখা ‘উন্মাদ এ দেড় যুগ’ বইটা পড়তে কোনও বিধিনিষেধের মধ্যে ছিলাম না। বইটার একাধিক জায়গায় লেখক (এইখানে মেহেদী হকের লেখক সত্তা আগে) ও কার্টুনিস্ট মেহেদী হক বলে দিয়েছেন উন্মাদ পত্রিকা সম্পর্কে যার ধারণা নাই, এই বই তার জন্য নয়। সেই জায়গা থেকে ভয়ে ছিলাম। তাই কিছুটা কনফেস করে নেয়া গেলো আর কি।
ছোটবেলায় নব্বই দশকের শেষ দিকে ঢাকা থেকে ১শ ৫০ কিলোমিটার দূরের কোনও থানা শহরে যখন কোনও পাবলিক লাইব্রেরি বা পাঠাগার ছিলো না, তখন পত্রিকার দোকানে মাঝে মাঝে দুই একটা ‘উন্মাদ’ পত্রিকা দেখতাম। এই পত্রিকা কিসের, তখন জানলেও কার্টুন বিষয়ে খুব আগ্রহ না থাকায় পড়া হয়নি। কিন্তু সেই মফস্বল থানা শহরেও যে এইরকম পত্রিকার পাঠক আছে বা ছিলো তা এখন ভেবে আনন্দিত হই। অবশ্য এখনো জানতে পারিনি তখন ওই গ্রামে কে বা কারা এ পত্রিকটা পড়তো। একটা সময় যখন সেই থানা শহরটাতে বই পড়ার লাইব্রেরি হইলো তখনও মাঝেমাঝে সেইখানে দুই-একটা পত্রিকার সংখ্যা চোখে পড়তো। তারপর দীর্ঘ যুগের পরও উন্মাদ পত্রিকাটা কেবল দূর থেকে দেখে আসছি। ওই অর্থে মনযোগ দিয়ে পড়া আর হয়নি। তবে এই বই হাতে নিয়ে ‘উন্মাদ’ সম্পর্কে কিছু দুরবর্তী কৌতুহল মেটানো গেলো আর কি। দূরবর্তী বলতে আগ্রহটা ছিলো চাপা, জানতেই হবে এমন ছিলো না। তবে হাতের কাছে থাকায় জেনে নিতে তেমন বেগ পেতে হয়নি।
বই সম্পর্কে লেখক শুরুতেই বলছেন,‘উন্মাদ ম্যাগাজিনে যাপিত কার্টুন জীবনের এক ধরনের স্মৃতিচর্বণ আকারে লেখা এই বই। প্রথম দিকে ব্যক্তিগত বিষয় এড়িয়ে একটা নন-ফিকশন ধরনের কিছু দাঁড়া করাতে গেলেও শেষে সেটা ব্যক্তিগত নিতান্তই ব্যক্তিগত রোজনামচায় পরিণত হয়।’ মেহেদী’র এই বাক্য শতভাগ ঠিক। বইটা পড়তে গিয়ে উন্মাদ পত্রিকার প্রথম দিককার সার্বিক পরিস্থিতির কিছু অংশ যেমন জানা গেলো, পাশাপাশি জানা গেলো নব্বই দশকের শুরু বা শেষদিকে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতিও। তখনকার মুড়িরটিন বাসের স্মৃতিও পাওয়া গেলো বইয়ে। আর উন্মাদ পত্রিকা ঘিরে বেড়ে ওঠা চরিত্রগুলোকেও জানা গেলো আরও একটু। যেমন আহসান হাবীব। কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব এই বইয়ের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। তাকে আরও একটা পারস্পেক্টিভ থেকে দেখতে পাওয়াও ভালো অভিজ্ঞতা।
একটা পত্রিকার অন্তর্গত জীবনযাপনের ছবি জানতে পারা যে কোনও ধরনের পাঠকের জন্যই দারুণ অভিজ্ঞতা। মেহেদী হক এই অভিজ্ঞতার অনেকটাই শেয়ার করেছেন আমাদের সঙ্গে। বইয়ে উঠে এসেছে উন্মাদ সম্পাদক আহসান হাবীব, ছড়াকার ওবায়দুল গনি চন্দন, হাসান খুরশীদ রুমী, রোমেন রায়হানদের নাম। এরা সবাই উন্মাদের কাণ্ডারি। তবে এখনো যে পত্রিকাটা আছে, এবং তা বহাল তবিয়তে সেটা বোধহয় আহসান হাবীব ছাড়া কোনওভাবেই সম্ভব ছিলো না। বাংলাদেশের কার্টুনপ্রিয় মানুষদের পক্ষ থেকে বইয়ে আহসান হাবীবকে একটা বড়সর ধন্যবাদ দেয়া যেতে পারতো। যদিও লেখক নিজে এখানে কার্টুনের ভোক্তা হিসেবে আসেননি, কার্টুন স্রষ্টা হিসেবেই এসেছেন বলে বোধহয় তা করা হয়নি। হলে অবশ্য মন্দ হতো না বলেই মনে হয়। সর্বোপরি, সহজ গদ্যে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায় এমন একটা নন-ফিকশন ‘উন্মাদ এ দেড় যুগ’।