বাংলাদেশের কবিতার ষাটের দশকের প্রতিনিধি সিকদার আমিনুল হক (১৯৪২-২০০৩) গ্রন্থবদ্ধ আত্মপ্রকাশ করেছিলেন পরবর্তী দশকে। জীবদ্দশায় তার সময়ের অন্যদের চাইতে তিনি নিতান্তই স্বল্পালোচিত ও অনালোচিত কবি। যদিও তার সম্পর্কে অধ্যাপক আবু দায়েনের যথার্থ পর্যবেক্ষণ হলো, তিনি ‘বাংলা কবিতায় কোনো সংঘের কবি ছিলেন না। কিন্তু এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি করতে তিনি সমর্থ হয়েছিলেন’ (সাহিত্য: অনুভবে অনুধ্যানে, ১১৩)―তবু এমনকি ষাটের দশকের কবিতা-কেন্দ্রিক কোনো কোনো অধ্যয়নেও তিনি বাদ পড়েছেন। শুধু তাই নয়, কখনোবা তার কবিতাকর্মের মূল্যায়ন করতে গিয়ে গদ্য কবিতাগুলোকেও অবহেলা করা হয়েছে এবং আলোচক গদ্য কবিতাকে(১) কবিতারই রকমফের হিসেবে বিবেচনা করেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে।(২) অবশ্য সিকদার আমিনুল হকের রচনাসমগ্রের ভূমিকাতে কবি মিনার মনসুরকৃত লক্ষ্যভেদী এই মূল্যায়নকে ব্যতিক্রমই ভাবতে পারি আমরা:
তাঁর কবিতায় বহির্জগতের ছায়াপাত আছে তবে তা গৌণ, মুখ্য হলো অন্তর্জগৎ। বিশাল তার ব্যাপ্তি। মহাসমুদ্রের মতো সর্বক্ষণই তা ফেনিল ও তরঙ্গময়। বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য সব মাছের মতো সেখানে তাঁর ভাবনারা সাঁতার কাটে নিরন্তর। তার মধ্যে কিছু হয়তো আমাদের চেনা, বৃহদংশই বেগানা। (১৫)
দূরের কার্নিশের ২২টি অরুণ মিত্র প্রভাবিত গদ্য কবিতার পরে সিকদার আমিনুল হকের গদ্য কবিতার ধারা তিন পাপড়ির ফুল ও পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতার অন্তর্বর্তীকালীন প্রয়াসের পর সতত ডানার মানুষ-এ (১৯৯১) এসে যেন মহাসমুদ্রের সাক্ষাৎ পেয়েছে। ছয় বৎসর পরে প্রকাশিত বাতাসের সঙ্গে আলাপ (১৯৯৭)-কে তারই ধারাবাহিক পরিণতি হিসেবে দেখা যেতে পারে। পূর্ববর্তী গ্রন্থটির ভাব-পরিমণ্ডল ও প্রকৌশলের অনেককিছুই এখানে বজায় থাকলেও, কিছু বিষয়ে এই বইটি স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। এর পশ্চাৎ-মলাটে বইটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘টানা-গদ্যের এই সাম্প্রতিক গ্রন্থটি এক ভিন্ন অভিযান।’ এই ভিন্নতা কোন কোন ক্ষেত্রে, এবং একইসঙ্গে সাদৃশ্যও, অনুসন্ধান করা যেতে পারে:
১. সতত ডানার মানুষ পড়তে গিয়ে একজন পাঠক অনুভব করেন, এর ভেতরে কবির কল্পনা বিশেষ লক্ষ্যে নিয়োজিত, যার মাধ্যমে একটি ভাবপরিমণ্ডলকে পরিস্ফুট করে তোলা হয়েছে। তিনটি অংশে গ্রন্থটি বিভক্ত। এক শিরোনামের নীচে প্রায়শই একাধিক গদ্য কবিতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এর প্রতিটি গদ্য কবিতার শিরোনাম আছে এবং এদের কোনো পর্ববিভাজন নেই। একটি একক পরিকল্পনার অন্তর্গত ভাবজগতের অংশ নয় এই গদ্য কবিতাগুলো।
২. ইতঃপূর্বের গদ্য কবিতায় আখ্যানের দিকে কবির ঝোঁক দেখা না-গেলেও, এখানে দুয়েকটি লেখায় আখ্যান যেমন আছে, তেমনি অনেক লেখাতেই আখ্যানের আভাস রয়েছে।
৩. এই বইয়ের অধিকাংশ কবিতার উপজীব্য বিষয় হলো কবিতা। কবিতার অভিজ্ঞতা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অংশত শিল্প-সমালোচনা—ইত্যাদিকে নিয়েই লিখেছেন গদ্য কবিতাগুলো। এই বৈশিষ্ট্য অন্যত্রও দেখেছি আমরা। তবে এক্ষেত্রে কিছু পার্থক্যও রয়েছে।
৪. প্রতীকের ব্যবহার সতত ডানার মানুষ-এ কমে এসেছিল। এখানেও সেটি বজায় আছে।
৫. এখানে তার গদ্য কবিতার ভাষা আরেকটি বিবর্তনকে আত্মস্থ করেছে: হ্রস্ববাক্যের সাহায্যে বর্ণনাকে এগিয়ে নেওয়া। এতে এ-বাক্যগুলোকে গতিশীল মনে হয়, সতত ডানার মানুষের মতো মন্থর নয়।
বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এ গদ্য কবিতার ক্ষেত্রে যে-কাজটি কখনো করেননি আগে, আখ্যানের ব্যবহার, করতে চেয়েছেন। কিন্তু সম্পূর্ণ আখ্যান নয়, বর্ণনাত্মক গদ্য কবিতাই তার মূল ক্ষেত্র বলে, আখ্যানের প্রসঙ্গ দ্রুত বর্ণনাত্মক হয়ে উঠেছে। তবে কবিতার ভেতরে বিশেষভাবে আখ্যান বা গল্প ব্যবহার তার অভিপ্রেত নয়; অনেক কৌশলের এটি একটি মাত্র। যেহেতু অনেকটা স্বীকারোক্তির ধরনে তিনি বর্ণনা করেন, বিশেষত সতত ডানার মানুষ-এর লেখাগুলোতে, সেহেতু আত্মজীবনীর নানান বিচূর্ণ অংশ বিভিন্ন মুখোশে প্রবেশ করেছে। বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এ তার ধারাবাহিকতা আছে। পূর্ববর্তী গ্রন্থটিতে স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছিল মূল উৎস, এখানে বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এ তা নয়। এখানে অভিজ্ঞার জগৎ তা নিজের কিংবা অপরের যাই হোক-না-কেন, তার সঙ্গে নিজের কল্পনার জগৎও উৎস হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান গদ্য কবিতার বই থেকে নীচের গদ্য কবিতাটি পড়া যাক, যেখানে একটি আখ্যান রয়েছে এবং উপস্থিত-অনুপস্থিত অনেক চরিত্র :
একটা ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছিলো। শাদা তুষারে ঢাকা পিটার্সবুর্গের রাস্তাঘাটের ব্যবহার তখন কম। রাত্রি ছিলো। আলোকিত কক্ষ। টেবিলে জ্ব’লে যাচ্ছে মোমের বাতি।…
এই স্বপ্নটা আমি একদিন নয়, দু-দিন নয়, তিনদিন দেখলাম।
গাড়ি যাচ্ছে। ঘণ্টা বাজছে গাড়িওয়ালার হাতে। ভেতরে জিভাগো ছিলেন না। (উপন্যাস কার প্রতিবিম্ব?) ছিলেন পাস্তেরনাক নিজে। কবি। লেখক। মৃত্যু ভয়ে চিন্তিত। প্রেমিক। এবং যাঁর পশমের ওভার কোটের ভেতরে লুকানো থাকতো বাচ্চাদের কান্না !
চতুর্থ দিন আবিষ্কার করলাম, স্বপ্নটা আর কিছুই নয়। একটা ক্রোধ। সেই ক্রোধটা হ’লো আমি আরও একবার এক মৌলিক দীর্ঘাঙ্গীর প্রেমে পড়েছি। (“নতুন প্রেম” বাসআ ২৪-২৫)
আমরা লক্ষ করলে পাব, এখানে কবি একটি আখ্যান ব্যবহার করছেন। এবং অন্যদিকে এর বাক্যগুলো বেশ হ্রস্ব। আমাদের তার ছন্দে লেখা কবিতাগুলোকে মনে পড়ে, যেখানে হ্রস্ব বাক্যের ব্যবহার করা তার প্রবণতা। কবির ডাক্তার জিভাগো উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে এই গদ্য কবিতাটি উৎসারিত হয়েছে, তা মনে করা যায়। কিন্তু সে-অভিজ্ঞতাকে যেভাবে কথকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার সমান্তরালে এনে উপন্যাসের চরিত্র, ঔপন্যাসিক ও কবিতার কথককে জটিল সমীকরণের অংশ করে তুললেন তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সাধারণ গদ্যভাষা যা ঘটনার বর্ণনায় ব্যবহৃত হয়, তার সঙ্গে এ-ভাষার পার্থক্য সামান্যই। শুধু একটি বাক্য ব্যতিক্রম—‘এবং যাঁর পশমের ওভার কোটের ভেতরে লুকানো থাকতো বাচ্চাদের কান্না!’। এখানে এসে ভাষা বর্ণনাকে অতিক্রম করে গেছে। গল্পটি অবশেষে যেভাবে সমাপ্ত হয়, তাতে একটা অস্পষ্টতা কিংবা রহস্য তৈরি হয়। বিষয়কে প্রতীকায়িত করে এক প্রলুব্ধকর অস্পষ্টতা তৈরির প্রবণতাও সিকদার আমিনুল হকের গদ্য কবিতায় আমরা পেয়েছি।
কিভাবে আখ্যানটি বলা হয়েছে ও তাকে ব্যবহার করা হয়েছে তা মনোযোগ দাবি করতে পারে। প্রথমে একটি দৃশ্যের বর্ণনা, যেখানে বরফ-ঢাকা পিটার্সবুর্গের রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি যাওয়ার বর্ণনা। এরপর বলা হলো এটা আসলে পর পর তিন দিন দেখা স্বপ্ন। তৃতীয় অনুচ্ছেদে আবার পূর্ববর্তী দৃশ্যের বর্ণনা ও তার বিশ্লেষণ। আর শেষ অনুচ্ছেদে রয়েছে কথকের তরফ থেকে দেওয়া এই স্বপ্নের একটি ব্যাখ্যা।
আমরা বুঝতে পারি ডাক্তার জিভাগো (১৯৫৭) উপন্যাস পাঠের প্রতিক্রিয়া এখানে স্বপ্নদৃশ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। সিকদার জানাচ্ছেন আমাদের ঘোড়ার গাড়ির ভেতরে ছিলেন উপন্যাসটির লেখক বিশ্রুত কবি পাস্তেরনাক নিজে। উপন্যাসটি রচনার সমকালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে বরিস পাস্তেরনাককে কঠিন ও দুঃসহ পরিস্থিতি অতিক্রম করতে হয়েছিল, তা এর নায়ক ডাক্তার জিভাগোর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল। পাস্তেরনাক কবি ও প্রেমিক, যার হৃদয় শিশুর হৃদয়ের মতো—ওলগা ইভিনস্কায়ার সঙ্গে প্রেমকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু তাকে সহ্য করে যেতে হয়েছিল। তা-ই কি এখানে সিকদারের গদ্যে, গাড়ির ভেতরে জিভাগোর পরিবর্তে পাস্তেরনাক স্বয়ং থাকেন, এবং মৃত্যুভয়ে চিন্তিত? গদ্য কবিতাটির শেষ অনুচ্ছেদে পাই একটি দারুণ মোচড়—এতক্ষণ ধরে বর্ণিত এই স্বপ্নটি একটি ক্রোধ থেকে জন্মেছে, আর তা হলো, এর দ্রষ্টা আবারও প্রেমে পড়েছেন! আখ্যান ও তাৎপর্য ধরনের এই বিন্যাসে, তাৎপর্যটি এমন যে তা আখ্যানটিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। আমরা এই রহস্যটিকে একটু উন্মোচন করতে পারি যদি প্রেমিক পাস্তেরনাকের সমান্তরালে এই গদ্য কবিতাটির কথককে স্থাপন করি। আমাদের সমাজবাস্তবতায় এমন প্রেম যার সফল ও সহজ পরিণতি অসম্ভব, তা প্রণয়ীকে নিরাপত্তাহীনতায় আক্রান্ত করে—এই নিয়ন্ত্রণ-অসম্ভব প্রণয়কাতরতা, প্রেম, পরিণতির অনিশ্চয়তা ও ব্যর্থতার সম্ভাব্যতা পর্যায়ক্রমে ক্রোধের জন্ম দেয়। এই ক্রোধ অন্তর্মুখী, তাই স্বপ্নে রূপান্তরিত হয়েছে।
আমাদের প্রশ্ন জাগে প্রথম অনুচ্ছেদে আখ্যানের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কহীন ‘আলোকিত কক্ষ। টেবিলে জ্ব’লে যাচ্ছে মোমের বাতি।’—এই বর্ণনার কারণ কী? এই কক্ষের সঙ্গে রাস্তা আর ঘোড়ার গাড়ির দূরত্ব কতটুকু? এই কক্ষ থেকেই কি দেখা যাচ্ছিল ঘোড়ার গাড়িটিকে? কে ছিলেন ওই কক্ষে? লারা না-কি ওলগা ইভিনস্কায়া? না-কি পাস্তেরনাক নিজে, যিনি লিখছিলেন, জিভাগো যাচ্ছেন তুষারাচ্ছন্ন রাতে পিটার্সবুর্গের রাস্তা দিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে? আখ্যানের সূত্রে এতগুলো জিজ্ঞাসা জাগ্রত হয় আমাদের। গদ্য কবিতাটির আখ্যান বর্ণনার কৌশলে, এই কক্ষটি হয়ে ওঠে এমন এক দ্যোতক যার সুনির্দিষ্ট কোনো দ্যোতিত নেই এবং এ কারণে এর দ্যোতনা আরও বহুমাত্রিক। ওই কক্ষটি তাই হয়ে ওঠে কবিতার প্রতিবেদনের এক উৎসস্থল, যেখান থেকে কবি সিকদার আমিনুল হক লক্ষ রাখছেন, রহস্যময় ও নিঃসঙ্গ যাত্রায় জিভাগো রূপান্তরিত হলেন পাস্তেরনাকে! গদ্য কবিতায় আখ্যান যখন ব্যবহৃত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায় রচনাটির বহুস্বরবিশিষ্ট হয়ে ওঠার। এই গদ্য কবিতাটিতে যদিও আখ্যানটি কথকের স্বপ্নের অংশ, তবু পাস্তেরনাক ও জিভাগো যেমন এখানে এসেছেন, তেমনি অনুপস্থিত থেকেও পাস্তেরনাকের প্রেমিকা ওলগা কিংবা জিভাগোর প্রেমিকা লারাও উপস্থিত হয়েছেন। একইসঙ্গে এতে অনুচ্চার্য ইঙ্গিতে উপস্থিত হয়েছে দমনমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ঐতিহ্যবাহী বা রক্ষণশীল পরিবার ও সমাজের ভূমিকাও। এ-সবকিছুকে শেষ অনুচ্ছেদে সিকদার আমিনুল হক কথক-স্বরের অধীনে আনলেও, তা মিলিয়ে যায় না। আমরা ভাবতে বাধ্য হই, এই রচনাটির সূত্রে, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকামী চরিত্র এবং বিপরীতদিকে প্রেমের বিপ্লবী চেহারা—উভয়ের মধ্যে কত ধরনের সংলাপ চলতে পারে। ফলে, এই গদ্য কবিতাটি অর্জন করে অনেক ধরনের স্বরকে স্থান দিতে পারা একটি পরিসরে। বহু চরিত্রের এমন সমাবেশ আমরা এই কবির গদ্য কবিতায় আগে ততটা লক্ষ করিনি।
আখ্যান ব্যবহারের আরেকটি উদাহরণ হিসেবে “গালিব স্ট্রিটে” শিরোনামের গদ্য কবিতাটি প্রসঙ্গিক হতে পারে, যেখানে কলকাতার গালিব স্ট্রিটে টানা-রিকশার আরোহী এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ের ঘরে ফেরার দৃশ্য রহস্যায়িত হয়ে উঠেছে। পেছনের পট তৈরি করে দিয়েছে জ্যোৎস্না, ‘আকাশে এক গোলাকার বোকা চাঁদ ভাসিয়ে দিচ্ছে সব’ (বাসআ ১০)। আমরা দেখি তখন, মেয়েটির আত্মীয়স্বজনেরা ক্রমেই দূর-দূরান্তের দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে যায়, এবং বর্তমানকালের বাস্তবতা কিভাবে প্লাবিত হয়ে যায় অতীতের সাহায্যে—
এই হ্রস্ব কালো স্কার্ট, এই বিষণ্ণতা, এই পূর্ণচাঁদ আর ধূমপানের ক্লান্তি গালিব স্ট্রিটটাকে সোজা তুলে নিয়ে গেলো হারুনুর রশীদের বাগদাদে!
প্রাচীন নগরে পরিভ্রমণ আরও একটি গদ্য কবিতায় পাওয়া যাবে, যেখানে তিনি ব্যাবিলনের এক নারীর বর্ণনা দিচ্ছেন। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কাব্যের কিছু কবিতায় প্রাচীন নগর ও ঐতিহ্যের প্রসঙ্গকে বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতকে রহস্যায়িত করার প্রয়োজনে আমরা ব্যবহৃত হতে দেখেছি। সেখানে ব্যবহৃত অতীত, নির্দিষ্ট করে তাকে ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ বলা যায় না, যদিও তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা ছিল, এক রহস্যময় ও ইতিবাচক অর্থে ঐন্দ্রজালিক মাত্রা সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই দিকটি উল্লিখিত “গালিব স্ট্রিটে” গদ্য কবিতায়ও আমরা পাই। কিন্তু “ব্যাবিলনের রাত্রির এইসব মেয়েরা” শিরোনামের গদ্য কবিতায় যে মেয়ে বা মেয়েদের দেখতে পাই আমরা, তারা, সন্দেহ নেই যে, রহস্য বা কুহক সৃষ্টি করে:
সম্ভবত আমি এই মেয়েটিকে দেখেছিলাম ব্যবিলনে। দুধ-শাদা ফর্সা। কোমরের নিচে বাঁধা পাখিগুলি সমুদ্রের কোনো মৃত পাখি নয়; দুরন্ত পাখির ঝাঁক; গোড়ালি পর্যন্ত চঞ্চলতা।
তার চোখ আঙুর বাগানের মতো বিষণ্ণ। ফলের মতো অতি রূপের ভারে তার কোন স্বপ্ন নেই। তার হাত ক্লান্ত, জিহ্বা ক্লান্ত, তার গ্রীবার গৌরব ক্লান্ত: আর তা এরকম থাকতে পারে শুধু ব্যাবিলনেই।
বালিকা, যুবতী কিংবা মহিলা ; কোন শ্রেণীতেই এরা পড়ে না। যেন অতিরিক্ত ঠান্ডা শাদা পাথর। উঁচু বুকের ওপর যে-মসলিন, তারও বয়স হলো এক হাজার বছর। (বাসআ “ব্যাবিলনের রাত্রির এই সব মেয়েরা” ২৭)
‘অতিরিক্ত ঠান্ডা শাদা পাথরের প্রতিতুলনা কিংবা বুকের মসলিন বস্ত্রের বয়স হাজার বছর বলার মাধ্যমে এই নারীকে মৃতের সগোত্রীয় করে ফেলা হলো এবং প্রাচীনতা ও রহস্যময়তার জন্য পাঠককে আরও প্রস্তুত করে তোলা হলো। আমরা লক্ষ করলাম ব্যাবিলনের এই মেয়েটি, যাকে অচিরেই ব্যাবিলনের সকল নারীর প্রতিনিধি করে তোলা হলো, হয়ে উঠছে নেতিবাচক রহস্যের আধার। জীবনানন্দ দাশের কবিতার অভিজ্ঞতা থেকে যা দূরবর্তী। পরবর্তী অনুচ্ছেদেই এই মেয়েটির ভেতরের নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিলেন কবি, ‘…বাজারের এক চারতলা গ্রানাইট পাথরের বাড়ির জাফরি-কাটা ঘরের মধ্যে, একে হাসতে দেখতাম সম্ভবত কোন খুনের আগে।’ এই হাসির শব্দে দেখা গেল চিরকালের জন্য আস্তাবলে বাঁধা ঘোড়াদের অস্থিরতা। এবং এইসঙ্গে জানানো হলো ব্যাবিলনবাসীর নৃশংস স্বভাবের কথা—‘ব্যাবিলনের লোকেরা দু-ভাবে খুন করে।’ ব্যাবিলনের নারীদের ভেতরে যে নিষ্ঠুর, হিংস্র, হৃদয়হীনতা তার একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হলো এভাবে, এবং কবি উপসংহার টানলেন:
ব্যাবিলনের কটকটে ফর্সা আর কিসমিস-গন্ধ মেয়েরা সেই নিষ্ঠুরতার গল্প মাতৃস্তন পান করার সময় থেকেই জানে। সেই থেকে ভয় বলে কোন বস্তু তাদের পাতলা অন্তর্বাসেও ঢুকতে ভুলে যায়! (২৮)
অতীতের সৌন্দর্যের ও রহস্যময়তার আকর্ষণ আমরা রবীন্দ্রনাথের কাব্যেও দেখতে পাই, যেখানে প্রাচীন ভারতের পটভূমি তার কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করেছিল এবং তার প্রতি আর্তি ধ্বনিত হয়েছিল, কেননা বাস্তবতার চাইতে সে-পরিপ্রেক্ষিতকে তার আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশ—উভয়ের কৃৎ-কৌশল থেকে সিকদার আমিনুল হক স্বতন্ত্র এ-জন্য যে, তিনি অতীতকে, যার ঐতিহাসিকতা বিষয়ে আমাদের সন্দেহ কখনোই ঘুচবে না, তার রহস্যময়তায় কল্পনা করলেও তাকে একইসঙ্গে প্রাচীন ও নেতিবাচক করে তুলেছেন। দ্বিতীয় বা পরবর্তী পাঠে লক্ষ করি এই গদ্য কবিতার প্রথম বাক্যে পাওয়া যাচ্ছে: সম্ভবত আমি এই মেয়েটিকে দেখেছিলাম ব্যাবিলনে।’—অর্থাৎ বাস্তবের কোনো নারীকে স্থাপন করা হলো অতীতে এবং তার ভেতরে আবিষ্কৃত হলো নিষ্ঠুরতা। আবার, চতুর্থ অনুচ্ছেদে লেখা হলো : জানি না ব্যাবিলনেই সে ছিলো কি না!’ (৩) অনিশ্চয়াত্মক এই বাক্যে ব্যাবিলন সংশয়ে দোদুল্যমান হলেও সংশয়টি শক্তিশালী হয় না, যেহেতু পরবর্তী অংশে এটি যথেষ্ট সমর্থন পায় না। ‘মেয়েটি’ যাকে ঘিরে ব্যাবিলনের মেয়েদের প্রসঙ্গের আগমন, তাকে আমরা চেনা বাস্তবের কোনো নারীর সমান্তরালে ঠিক প্রতিস্থাপিত হতে দেখি না। অন্যদিকে, বর্তমানকে কি ব্যাবিলনীয় সময় দিয়ে চিহ্নিত করতে চাইছেন কবি, পাঠক নিশ্চিত হতে পারেন না, কিন্তু অনুমানটি সম্পূর্ণ বাতিলযোগ্যও নয়। এভাবে গদ্য কবিতাটি পাঠকের জন্য নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ সরবরাহ করে, যেখানে অতীত একমাত্রিক ইতিবাচকতায় রহস্যময় ও আকর্ষণীয় নয়; বরং তার অন্যপ্রান্তে অবস্থান করে নেতিবাচকতাকেও উদ্ভাসনযোগ্য করে তোলে।
রহস্যময়তা ও ঘোর সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে, যাকে এই গ্রন্থে লেখকের প্রকৌশলের দিক থেকে বিশেষ মনোযোগ পেতে দেখি, তাকে সহায়তা করতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন আখ্যান সৃষ্টির—পূর্ণায়ত কোনো আখ্যান নয়, আখ্যানের আভাস বা ভগ্নাংশ, সোহেল হাসান গালিব যাকে বলেছেন, ‘আখ্যানের বালিয়াড়ি’ (৪) । রহস্যময়তা ও ঘোর সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমরা বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে পারি বাতাসের সঙ্গে আলাপের “কবরের গল্প”-এর ভাষা ও বর্ণনা-কৌশলের প্রতি, যেখানে ‘আখ্যানের বালিয়াড়ি’ আমাদের কৌতূহলকে চালিত করে শেষ পর্যন্ত:
পাতাগুলি ঝ’রে পড়লো; মার্বেলের চৌকো কবরের ওপর। কবরখানার ডানদিকে তিনতলা বাড়িতে এখন ম’ম’ করছে অর্গ্যান। একটা মেয়ে তার প্রেমিককে চুম্বনের অধিকার দিচ্ছে। ঝাউগাছ থেকে শব্দ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে কবরের ভেতরে অনন্ত নির্জনতার মতো এক চৌবাচ্চার মধ্যে।
শব্দে ও স্বপ্নে আমি ঘেমে উঠি।
রাত তিনটের ঘড়ি থেকে উড়ে গ্যালো ক্লান্ত তৃতীয় প্রহরের পরীরা। কবরখানার দরোজায় ঘুমে লেপ্টে যাচ্ছে দারোয়ান। তার শাদা দাড়ি কাশ্মিরী শালের চেয়ে ঘনশাদা। সে স্বপ্ন দেখছে গরম ভাত আর হরিণের মাংসের এক বাটি তাজা ঝোলের।
অনেকগুলি কবরের মধ্যে নীল-রঙের কবরটির রঙ, ঘাস আর নির্জনতায় ঠান্ডা। তাতে অন্ধকারের গন্ধ আছে। হাওয়ার রাত অনেকক্ষণ তার কাছাকাছি ব’সে থাকে। যখন আলো ম্লান হয়, তখন আমি ভাবি এটা পাস্তেরনাকের কবর। শীত যখন শরীরে বোধগম্য হয়, তখন আমি ভাবি এটা কীট্স-এর কবর।
আসলে এগুলি ধারণা মাত্র। সব কবরই মাইল-মাইল দূরে চলে যায়। কেবল ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে একটা উট। যার কাজ ভয়কে অনুবাদ করা। নিস্তব্ধতার দরকার হ’লে, তুমি তার কাছে যাবে। যে-সুন্দরীরা নেই; কিন্তু যাদের গন্ধ আমি ভালোবাসি; তাদের জন্য প্রলুব্ধ হলে আমি এইসব অপরিচিত কবরের কাছে গিয়ে বসি।…আমার কবিতাগুলি তরুণদের কাছে তাই এক মনস্থির করা সার্থকতা; যে, তার অহঙ্কার ও খুব উষ্ণ এক বিছানার জন্যে বিবেক দংশন ছাড়াই এক দীর্ঘ ভ্রমণের জন্যে খুব লালায়িত! (২৫-২৬)
কবির মৃত্যুভাবনার একটি বিশেষ অংশকে এই গদ্য কবিতায় রূপ লাভ করতে দেখি। একটি আখ্যানের গড়ে ওঠা লক্ষ করি প্রথম ও তৃতীয় অনুচ্ছেদে যা পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে অন্য অভিমুখে হারিয়ে গেছে। একটি কবরখানার পাশের বাড়িতে বাজতে থাকা অর্গ্যান ও প্রেম-চুম্বনের পাশাপাশি কবরের অনন্ত নির্জনতার বৈপরীত্যময় চিত্র এক নশ্বরতার ও সমাপ্তির অনুভূতি জাগ্রত করে পাঠকের মনে। কবরে ঝরে পড়া পাতাই রূপান্তরিত হয় শব্দে, সম্ভবত সঙ্গীতের শব্দে, যাকে কবরের নৈঃশব্দ্য ও অনন্ত নির্জনতার ভেতরে হারিয়ে যেতে দেখি আমরা। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ একটি মাত্র হ্রস্ববাক্যে দ্রুত সমাপ্ত: এই দৃশ্যাবলি স্বপ্ন না-কি বাস্তব তার নিষ্পত্তি অসম্ভব। এই বাক্যটির স্বতন্ত্র অনুচ্ছেদে ব্যবহার অনেকটা পদ্যকবিতার স্বতন্ত্র স্তবকের মতো। গড়ে তোলা বাকপ্রবাহে স্বল্পকাল-স্থায়ী আকস্মিক ছেদ বা বিরতি। তৃতীয় অনুচ্ছেদে জানা গেল রাত্রির গভীরতা এবং কবরখানার দারোয়ানের গভীর নিদ্রার কথা। এরপরের অনুচ্ছেদে বর্ণনাকারীর অংশগ্রহণ আখ্যান থেকে মুখ্যত আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করে, কিন্তু তখনও আখ্যানের আভাস রয়েছে—
কবরগুলোর মধ্যে একটিকে নিয়ে গড়ে তোলা সংশয় ও রহস্যের মধ্যে আখ্যানের এই মরীচিকা পাঠককে বিভ্রমগ্রস্ত করতে থাকে। পঞ্চম অনুচ্ছেদে এসে আমরা লেখকের গড়ে তোলা রহস্যকে আরও সম্প্রসারিত হতে দেখি। এই অনুচ্ছেদের শেষবাক্যটি কথকস্বর তার এই অনুপ্রবেশকে বৈধতা দিতেই উচ্চারণ করেন, যদিও এর কাব্যিক আবহে তা আড়াল করা সম্ভব হয়েছে। শেষ অনুচ্ছেদে কতৃত্বসহ নিজের অহংকে প্রতিষ্ঠা করতে লেখকের মরিয়া প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তা গদ্যপ্রতিবেদনটির অচ্ছেদ্য সম্প্রসারণ হতে পারেনি, পাঠক একে উপেক্ষাই করতে চাইবেন।
ভাষাগত দিকে লক্ষ করলে পাই, এখানে বাক্যগুলো দীর্ঘ নয়। আখ্যান বর্ণনার প্রয়োজনে কখনো সাধারণ অতীত এবং কখনো সাধারণ ও ঘটমান বর্তমান কাল ব্যবহৃত হয়েছে। বাক্যগুলোতে একটি গল্পকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রুততা রয়েছে। লক্ষণীয় যে, শেষ দুটি বাক্যে, বর্ণনার মধ্যে কথকসত্তা যখন নিজেকে হাজির করে সচেতনভাবে আত্ম-উন্মোচন করছেন কিংবা মন্তব্য করছেন, তখন বাক্য দীর্ঘায়িত হচ্ছে। জীবনানন্দ দাশের কোনো কোনো বাক্-মুদ্রা (coinage) ব্যবহার করলেও তাকে নিজের ভাষার ভেতরে এমনভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছেন যে, তাদেরকে পূর্বের স্বর ও সুরে পাওয়া যায় না। কবির মৃত্যুচিন্তার একটি বিশেষ ধরনকে এখানে লক্ষ্য করি আমরা। কবর, নির্জনতা, ঝাউগাছ, অন্ধকারের গন্ধ, শীত, উট ইত্যাদি মৃত্যুকে ভীতিকর ও রহস্যায়িত করে তোলে; কিন্তু এর পাশাপাশি অর্গ্যানের শব্দ, চুম্বন, গরম ভাত আর হরিণের মাংসের ঝোলের স্বপ্ন এই ভীতির বিপরীতে ভারসাম্য আনতে চায়। কবরখানার একটি কবরকে পাস্তেরনাক ও কীট্সের হিসেবে গুলিয়ে ফেলার মধ্যে তার মৃত্যুভীতিকে শিল্পবোধের পরিশীলন লাভ করতে দেখি। কবর বা মৃত্যু ভয়ঙ্কর কিন্তু কবরটি একবার পাস্তেরনাকের এবং একবার কীটসের মনে হওয়ার মাধ্যমে তা রহস্যমধুর হয়ে ওঠে। ‘যে-সুন্দরীরা নেই; কিন্তু যাদের গন্ধ আমি ভালোবাসি; তাদের জন্য প্রলুব্ধ হলে আমি এইসব অপরিচিত কবরের কাছে গিয়ে বসি।’—এই বাক্যটিতে মৃতুভাবনাকে যৌনতা ও সৌন্দর্যচেতনার সঙ্গে অঙ্গীভূত করতে চেয়েছেন তিনি, যা তার মৃত্যুচেতনায় বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এর সংযোজন।
কবরখানার দারোয়ানের প্রসঙ্গটি এই আখ্যানের বিশদীকরণের অংশ, যা একে বিশ্বাস্য হতে সহায়তা করেছে। কিন্তু আখ্যানটিকে আমরা অচিরেই মিলিয়ে যেতে বা ভেঙে পড়তে দেখি কবির আখ্যানের প্রসঙ্গে আত্মপ্রক্ষেপণের সূত্রে এবং যখন এটি ঘটে, অর্থাৎ অহংসত্তা অনুপ্রবিষ্ট হয়, তখন আখ্যানটি আত্মপ্রক্ষেপণের ভেতরে আত্মগোপন করে বা রূপান্তরিত হয়। পাঠকের মনোযোগও এভাবে আখ্যান থেকে বর্ণনায় কেন্দ্রীভূত হয়। এটিকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি কবিতার স্বভাব হিসেবে। কবিতায় আখ্যান ব্যবহৃত হওয়ার প্রবণতাকে মহাকাব্যের যুগ থেকেই পাঠক প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু কবিতাকে আমরা যেভাবে ঐতিহ্যগতভাবে উপলব্ধি করে এসেছি, তা অনেকটাই গীতিকবিতার সঙ্গে সাদৃশ্যবাহী, যা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। আখ্যানবর্ণনা প্রকৃতপক্ষে গদ্যের স্বভাবভুক্ত একটি বিষয় বিধায়, সাম্প্রতিককালে কবিতায় আখ্যানকে ব্যবহার করার প্রবণতাটিকে পদ্যের ভেতরে গদ্যের চাপ থেকে আসা বিষয় হিসেবে দেখা যেতে পারে, যেখানে মনন ও চিন্তা আবেগের ওপরে কর্তৃত্বশীল থাকে। গদ্য কবিতায় আখ্যানের সূত্র ধরে লেখক যখন আত্মপ্রক্ষেপণ ও বিশ্লেষণের দিকে চলে যান ও বর্ণনাত্মক ধরনকে গ্রহণ করেন, তখন গদ্যকাঠামোর ভেতরে কাব্যিকতার একটি মোড় ফেরা হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা যায়। সিকদার আমিনুল হক “কবরের গল্প” গদ্য কবিতায় ‘আখ্যানের বালিয়াড়ি’কে অবলম্বনের মাধ্যমে গদ্য ও পদ্যকবিতা উভয় স্বভাবকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। যদিও কবিতার দিকেই এর ভারসাম্যটি বেশি ঝুঁকে থাকে, যেহেতু তিনি আখ্যান বর্ণনায়ও গদ্যভাষাটির কবিতালগ্নতাকে ত্যাগ করেন না।
এ-পরিপ্রেক্ষিতে নারী সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিকে যদি বিবেচানায় আনি, দেখব, নারীর উপস্থিতি এখানে যৌনতার তাৎপর্যেই এবং উভয়ের উপস্থিতি আবার অনেক সময়ই শিল্পসৃষ্টির দ্যোতনা লাভ করেছে। এই প্রকৌশলটি সিকদার আমিনুল হকের ক্ষেত্রে অভিনব নয়—দূরের কার্নিশ হয়ে সতত ডানার মানুষ এবং বাতাসের সঙ্গে আলাপ―সর্বত্র এটি রয়েছে। তবে সর্বশেষ দুটি গ্রন্থের গদ্য কবিতায় এই প্রবণতাটি অনেক স্পষ্ট ও স্বতঃস্ফূর্ত। বাতাসের সঙ্গে আলাপ শুরুই হয়েছে প্রেমিকা ও তার যৌনতার অনুষঙ্গকে নিবিড়ভাবে কবিতাসৃজনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে:
মনে হয় এই গ্রীষ্মেই তুমি তোমার দরোজা খুলবে। তোমার মুখ তার চিহ্ন। তোমার বিশাল রাত্রি তার তোরণ।
তোমার সিঁথি এক রূপালী নদী। চুল পিঠের ওপর কালো বন্যতায় যখন ছড়িয়ে দিয়েছিলে, তার ঘ্রাণ আমি হিংস্রভাবে নিঃশ্বাসে নিয়েছিলাম উচ্ছ্রিত যৌনতায়।
বিহ্বল আর নিষ্পেষিত বাতাস; আমার মাথা পাল তোলা নৌকার মতো তখন টলছিলো।
[…] সব উজ্জ্বলতার শ্রোতা এই গোলাপই তোমাকে অভিবাদন করবে। প্রিয়তমা, আর তা করবে এই গ্রীষ্মে, যখন তুমি তোমার দরোজা খুলবে।
আত্মা আর নগ্ন উদ্দামতার দরোজা। এই পাত্র এখন পূর্ণ, আমাদের ওষ্ঠ চুম্বনের পক্ষে রয়েছে পবিত্র হৃদয়। মৃত্যু আর দাসত্বের চেয়ে যা বড়ো। আর রতি সম্ভোগের চেয়ে যা নিম্নতর। (“তুমি দরোজা খুলবে” ৯)
উদ্ধৃতিটিতে যৌনতার অনুষঙ্গগুলোর সঙ্গে কবিতারচনার অভিজ্ঞতা একাকার হয়ে গেছে—কখনো যৌনতা প্রবল হয়ে উঠেছে, কখনো তাকে ছাপিয়ে তার ভেতর থেকে শিল্পসৃষ্টির ইঙ্গিত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এদের অবশ্য শুধুু প্রেম ও যৌনতার রূপকল্প ও বিবৃতি হিসেবেও কেউ পড়তে পারেন, কিন্তু এর সঙ্গে যদি এই অংশটুকু পড়ি, যেখানে তিনি লিখেছেন: কবিতা হচ্ছে প্রয়োজন; যদিও পৃথিবীতে আসার মুহূর্ত তার নির্দিষ্ট, অযৌক্তিক ও যৌনতায় ভরা’ (বাসআ “একটি ভালো কবিতা লেখার পর” ১৫)—তখন আমাদের কাছে কবিতার মুহূর্ত ও যৌনতার সমীকরণকে এই কবির রচনায় স্বাভাবিক মনে হয়। আগেও এই বৈশিষ্ট্যটি তার গদ্য কবিতায় যে দেখা গিয়েছিল, যার উল্লেখ আমরা করেছি; কিন্তু সে-সময়ে নির্মাণে এই প্রকৌশলটি আরও অন্তরালবর্তী ছিল।
বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এ নিজের কবিতা বিষয়ে চিন্তা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিল্প-দর্শনকে অঙ্গীভূত হতে দেখি। কবিতা-বিষয়ক প্রবন্ধে যা আসতে পারত, তাকে এখানে কাব্যিকতা-আশ্রিত ভাষায় এনেছেন তিনি। কবিতার প্রত্যাশা তার কাছে কেমন তা ব্যক্ত হতে দেখি এই গদ্যাংশে:
খুব জটিল কবিতার কথাই আমি ভাবি। অর্থ নয়, শব্দের গড়ন আর তার বর্ণিল খাঁজ। এ-সব থেকে আবিষ্কৃত হবে শহরের ঘ্রাণ, উটের মতো অন্ধকার আর সেহরীতে জাগ্রত মানুষের গাম্ভীর্য। …পশু আর পাখিদের সমস্ত বৃত্তান্ত আমরা জানবো তার পদধ্বনি আর পাখার শব্দ থেকে। এবং তাও অতি বিমর্ষ, নিঃশব্দ হৃদয়ে। (“স্বদেশের চৌকাঠে” ২২)
সিকদার আমিনুল হকের কবিতার সঙ্গে এই প্রত্যাশার সাদৃশ্য অনেক। যদিও নিরর্থ শব্দের সঞ্চয়কে কবিতায় রূপান্তরিত করেননি তিনি। তাকে আমরা তার সমগ্র শিল্পসাধনায় নগরকেন্দ্রিক জীবনাভিজ্ঞতার রূপায়ণেই নিয়োজিত থাকতে দেখেছি, যেটি তার সমালোচকদের দৃষ্টি এড়ায় নি (৫)।জটিল, গম্ভীর ও নিঃশব্দ স্বভাবের যে-কবিতার ভাবনা তার, তা যে জনপ্রিয়তার পথ নয়, সেটি তিনি মেনে নিয়ে নিয়েছেন কিন্তু নিজের উদ্দেশ্য ও পথ বিষয়ে তাকে অনেক আত্মবিশ্বাসী মনে হয় আমাদের:
যে রাস্তা দিয়ে আমি যাবো, তার পথে পথে নিভৃত সরাইখানায় গচ্ছিত থাকবে আমার সব স্বপ্ন। বৃদ্ধ বয়সের জন্যে যা একপাত্র পানীয়ের মতো ঠান্ডা আর আরামদায়ক!…
লিখিনি না হয় কবিতা, যোগ্য নয় উন্মত্ততার সব শব্দ; কিন্তু এই শব্দগুলিই বলবে, আমি অপবিত্র ও প্রয়োজনে রূপান্তরিত হইনি তোমাদের মতো। আমার কবিতা ছিলো তরবারির মতো অমীমাংসিত গৌরবের। রাষ্ট্রের বাতাসও তাকে পর্যটকের মতো অস্পষ্টতা আর চাতুর্য শেখাতে পারেনি!…
(“চিত্রশালা থেকে ফিরে,” বাসআ ২৭)
নিজের কবিতা বিষয়ে এমন উচ্চাশা ও আত্মবিশ্বাস কাব্যিক অস্পষ্টতায় আবৃত ও শ্রুতিমধুর শোনালেও, কখনো তাতে স্পষ্টতাও লক্ষণীয়, যখন তিনি বলেন: ‘আমার রয়েছে টাই একশ-টা: তাকভর্তি মদের বোতল। সম্ভবত আরো কিছু; কবিতার শক্ত-কব্জি। আভিজাত্য দশগুণ!…’ (বাসআ “কবিতা লিখতে হয় তাই” ১২)। এর পেছনে যুক্তিও প্রস্তুত আছে তার, ‘হতে পারে অহঙ্কার ও দাম্ভিক আমার পদচারণা। কিন্তু দীর্ঘশ্বাস ও উপেক্ষা থেকে পেয়েছি আমি এই অটল আস্থা ’ (বাসআ “স্বদেশের চৌকাঠে” ১২)। শুধু নিজের কবিতার দিকে নিবদ্ধ নয় তার চোখ, সামগ্রিকভাবে কবিতার বিষয়েও তাকে চকিত মন্তব্য করতে দেখি, যাকে তার নিজের লেখাগুলোরও একটি সমালোচনা হিসেবে পড়তে পারি আমরা: ‘আর কে না জানে ধাতব বস্তুর অভাবে আমাদের কবিতাও ছিল বাতাসের সঙ্গে আলাপ!’ (“বাতাসের সঙ্গে আলাপ” ৪৪)। এই উচ্চারণে কি কবির কোনো আক্ষেপ নিহিত আছে? কিন্তু সিকদার তার গদ্য কবিতার ভেতরে স্বগত-ভঙ্গিতেই কথা বলতে চেয়েছেন সাধারণত, ‘ধাতব বস্তুর’ অনুসন্ধান করেননি।
গদ্য কবিতা হওয়ার কারণে এ-বিষয়গুলোকে সহজেই এখানে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছেন তিনি। গদ্যের পরিসর প্রায় সব ধরনের বিষয়বস্তুকে আত্মীকরণের সক্ষমতা রাখে—এই সুযোগটি তিনি গ্রহণ করেছেন বিষয়বস্তুর নির্বাচনে ও প্রসঙ্গের অন্তর্ভুক্তকরণে। তার পদ্যকবিতার বিষয়বস্তুর দিকে মনোযোগ দিলে স্পষ্ট যে, পদ্যকবিতার কাঠামোতেও এদের বিন্যস্ত করার উদাহরণ তেমন নেই। এই গ্রন্থের গদ্যভাষার বৈশিষ্ট্য সতত ডানার মানুষ-এর তুলনায় অনেকখানি স্বতন্ত্র, যা এর অনুচ্ছেদে বাক্যের বিন্যাস ও বাক্য-দৈর্ঘ্যের মাধ্যমে প্রকাশিত এবং এদের সম্মিলিত ফল ভাষায় গতিসঞ্চার করেছে এবং সৃষ্টি হয়েছে লেখক/কথকস্বরের নৈকট্য বা সম্পৃক্ততা। অনেক স্বল্প-দৈর্ঘ্যের বাক্যের পর একটি-দুটি দীর্ঘবাক্য বর্ণনার গতিতে বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। যে উদাসীনতা, দূরত্ব, সর্বজ্ঞসত্তার নিয়ন্ত্রণ ও স্মৃতির চাপ পূর্ববর্তী গ্রন্থে বিদ্যমান ছিল এখানে তার প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। এর ফল বাক্য-দৈর্ঘ্যকে প্রভাবিত করেছে কিংবা উল্টোভাবে বাক্য-দৈর্ঘের হ্রস্বতা ভাব-প্রবণতার দিককেও কিছুটা প্রভাবিত করেছে। এখানে নিজের কবিতা ও শিল্পচর্চা বিষয়ে তার আত্মবিশ্বাস ও দৃপ্ততা প্রায়ই প্রকাশিত হয়েছে।
বিভিন্ন গ্রন্থে প্রকীর্ণ গদ্য কবিতা
বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এর পর গদ্য কবিতার তৃতীয় গ্রন্থ তিনি রচনা করতে পারেননি। পরিকল্পিত ও একক ভাবানুভূতির জগৎ-সমৃদ্ধ গদ্য কবিতার পরিবর্তে বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কিছু গদ্য কবিতা আমরা পাই, যা বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিচিত্র ভাবনার ছাপ আছে এবং প্রকরণগত দিক থেকেও কিছু বৈচিত্র্যকে সনাক্ত করা সম্ভব। বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এর পরবর্তী বই লোর্কাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেলো-তে তিনটি গদ্য কবিতা আছে। এদের অনুসরণ করলে স্পষ্ট হয় যে, কবি এবার নতুন ধরনের ভাষা ও প্রকৌশল খুঁজছেন। তার গদ্য কবিতায় এই অনুসন্ধিৎসা সব সময়ই জাগ্রত ছিল, যেমন বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ‘দরকার ছাপা বইগুলি ফেলে দেওয়া। এবং বলতে হবে আমার কোনো আনুগত্য নেই। …শব্দ তার পূর্ব অবস্থান থেকে পড়ে যাবে’ (“কবিতাগুলি ঘন দরকার” ৪৬) গদ্য কবিতা “ছবি আঁকার নিয়ম”-এ আখ্যান ব্যবহার করেছেন এবং এর শেষে রয়েছে একটি মুক্ত-উপসংহার। এর আখ্যানে চিত্রকরকে ছবি-আঁকার দর্শন শেখানোর মধ্য দিয়ে তিনি নারীকে নির্মাণ করেছেন: ‘…নারী হচ্ছে আমাদের আন্তর-চোখ থেকে দেখা ভোর, দুপুর আর রাত্রি… একে তুমি বসন্ত, বর্ষা আর শীতও বলতে পারো। এবং সবশেষে বলতে পারো একটি উড়ন্ত মৃত্যু…!’ (“ছবি আঁকার নিয়ম” ২: ১৪১-৪২) এই ধারণা বা নারীর নির্মাণ অভিনব নয়, তাঁর গদ্য কবিতাগুলোতে, এবং কবিতাতেও এটি পাওয়া যায়। এর ভাষাও পূর্ববর্তী গ্রন্থের অনুরূপ। গদ্য কবিতা “কবি ও কবিতার পাঠক”-এ কবিতা-বিষয়ক নিজের ধারণাকে একটু স্বতন্ত্র ভাষায়, যে-ভাষা আগের গদ্য কবিতাগুলোতে ছিল না, উপস্থিত করেছেন। পাঠক কিংবা তরুণ কবি তার সম্বোধিত চরিত্র। ভাষা এখানে অন্তরঙ্গ ও কথোপকথনের, যদিও কথক নিজেই কথা বলছেন, শ্রোতাকে লক্ষ্য করে:
ধরুন আমি ব্যবহার করলুম তিনটি শব্দ, পাশাপাশি… টুথব্রাশ, ঘাগরা আর হাঁটুর ক্ষত। আপনারা বলবেন, এর কোনো অর্থ হয়…? কিন্তু হয়! আমি একালের মানুষ। তা ছাড়া আমি ভালো খারাপ কোনো রাজনৈতিক কবিতাই লিখতে পারি না। আজকের মানুষের হৃদয়ের কলকবজা অত্যন্ত জটিল। কিন্তু তারা তা অনুভব করে না। তারা বলে, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কত স্বচ্ছ!… (“কবি ও কবিতার পাঠক,” ২: ১৪১-৪২)
কবিতার সচরাচর অলঙ্কার, যা তার গদ্য কবিতার ভাষায় ব্যবহার করেন, এখানে নেই। পুরো রচনাটিতেই তার খুব কমই প্রয়োগ রয়েছে। এ কারণে এই গদ্য কবিতাটির ভাষা অনেক বেশি সমতল। এখানে নিজের কাব্যাদর্শকে তুলে ধরতে গিয়ে শ্লেষের ব্যবহারও করেছেন অশিল্পিত কবিতার প্রতি এবং জানিয়েছেন: ‘শুদ্ধ কবিরা খুব স্বার্থপর। আসল শব্দটি নিজের জন্য রেখে তার পাশের শব্দটি কবিতায় বসিয়ে দেন। দিলে কবিতা চিরায়ত হয়। বাঁচে।’ এই গদ্য কবিতায় যে-ভাষাকে আমরা পাই পরবর্তী কিছু গদ্য কবিতায় তাকেই ব্যবহৃত হতে দেখি, যেখানে তিনি সরাসরি গদ্যের ভাষায় বিষয়কে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। এই ধরনের স্বচ্ছ গদ্যে, যেখানে অস্পষ্টতা কিংবা রহস্য সৃষ্টির কোনো চেষ্টা নেই, আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছির গদ্য কবিতাগুলো লেখা হয়েছে। এই ধরনের বর্ণনাভঙ্গি ও ভাষার কিছুটা বাইরে রাখা যেতে পারে “কী রকম সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি”-র তৃতীয় গদ্য কবিতাটিকে:
কী নেই আমার! মেঘেদের প্রশংসা আর পরিষ্কার একটি বাড়ি। বাড়িটার নির্জনতা এত কোমল যে, মনে হয় তা দুপুরের আগেভাগেই সমুদ্রে পৌঁছে গেছে।
গ্যালে, যাবে! রাত্রির নক্ষত্র উঠলে নিজেকে মনে হয় ফুরফুরে যাযাবর। থেমে গেছি। ঘোড়াগুলি ঘাস খাচ্ছে, মাংস রান্না হচ্ছে, তার আগে ঘাম ঝেড়ে ফেলবার জন্যে স্নান!—বলো এর বেশি মুসাফির কী চায়? (৪২)
এখানে ভাষা তার পূর্ববর্তী ঐতিহ্যের পথেই অগ্রসর হচ্ছে। ‘বাড়ি’ শব্দটিকে তার ব্যবহারিক তাৎপর্যের বাইরে নিয়ে পড়তেই পাঠক প্রলুব্ধ হবেন। ভাষার সাহায্যে চিত্র রচনার প্রবণতাও এখানে লক্ষণীয়। কিন্তু আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছির গদ্য কবিতার ভাষাবৈশিষ্ট্য ঝরঝরে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার নিকটতম প্রতিক্রিয়া থেকেই উঠে আসা বলে এদের গদ্যকে এতটা গতিশীল ও সরাসরি বলে মনে হয়। যেখানে ক্ষোভ কিংবা দীর্ঘশ্বাস অত্যন্ত স্পষ্ট, পাঠককে বিভ্রান্ত করে না:
১. ষাট দশকের বাস্তবতা। ঢাকার আকাশে তখন অনেক নক্ষত্র ছিলো। নীরবতা ছিলো। নিশাত সাদানির মতো রূপসীরা ছিলো। তখন বাজারে আপেলের পাশে ছিলো আঙুরের ঝুড়ি। লোভ ছিলো, কিন্তু আমাদের হাতে পয়সা ছিলো না। (৩৭)
২. উঁচু চিন্তুগুলি মাঝে মাঝে আসে। তাও বাদ! গান গাও। লিখবার জন্য অত শক্তি আর দিচ্ছি না। চোখ বুজে আসে। বুঝতে পারি, তিন কাল যাওয়া দুপুর ঠক করে এসে থামল দুপুর দুটোর কাছাকাছি। (৪২)
এর সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে, অপ্রকাশিত অগ্রন্থিত কবিতার গদ্য কবিতাগুলোকেও। কিন্তু এই ভাষাভঙ্গির বাইরে লোরকাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেলো-তে “গল্প শিকারের চেষ্টা” শিরোনামে তিনটি গদ্য কবিতা পাচ্ছি, যেগুলো একেবারে হ্রস্ববাক্যে লিখিত হয়েছে:
নিরর্থক সব। যে দোকানের কর্তা, সে চলে গ্যাছে। কাটা তরমুজ, লাল। রোদ পড়ে-পড়ে আর কষ নেই।—কিছু গেছে অবশ্যই মাছিদের ধরে! তারা ঘামে, কিন্তু অগ্রসর হয়। অথচ সক্ষম কুকুর ছায়া ছাড়া নড়ে না! …তৃষ্ণা আছে। কিন্তু বিকেলের আগে তার ক্ষুধা মৃত! অতএব… সব ঘামে, ঝাউপাতা, তুমি, আমি, আমাদের প্রতিকৃতি, নগ্ন পেট, এই গন্ধ, বাজারের মাছ, অন্তর্বাস। অতএব…
(“গল্প শিকারের চেষ্টা: ১”)
বাক্যগুলো এখানে শুধু হ্রস্বই নয়, যেখানে দৈর্ঘ্য তুলনামূলক একটু বেশি সেখানে প্রচুর অর্ধযতি গতিকে বারবার থামাতে চেয়েছে। প্রতীকী বৈশিষ্ট্য এই গদ্য কবিতাগুলোর ভাষায় বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে এবং লক্ষণীয় যে, এদের ভাষা অনেকখানি তার পদ্যকবিতার ভাষা দ্বারা প্রভাবিত। কাফকার জামা কাব্যগ্রন্থের নামকবিতাটি থেকে উদ্ধার করছি:
হঠাৎ পরিয়ে দিলো মর্গে এসে কাফকার জামা
ডোমদের দীর্ঘ হাত। এত খসখসে! কালো রং…
আর কী বিকট গন্ধ!… দুটো পুলিশের একজন
একটা নার্সকে নিয়ে অন্ধকারে গ্যালো। কী বেহায়া!
আমি বেশ ভয়ে থাকি। ঠান্ডা লাগে। ওরা ফিরে আসে;
আমার জামাটি দিয়ে ঘাম মোছে। এদিকে বরফে
আমি প্রায় জমে যাই!… জামার বোতাম ঢিলেঢালা,
পকেট অবশ্য দুটো। তাতে হাত দিই। কী যে বিশ্রী
এক বিড়ালের ছানা ডান দিকে, আর বাম দিকে
রেজোরে না ধোয়া এক বাসি ব্লেড।… সাবান ও দাড়ি! (১৮, পঙক্তি: ১-১০)
এই কবিতাটির হ্রস্ব আকারের বাক্য ও প্রতীক ব্যবহারের প্রকৌশল আমাদের উদ্ধৃত গদ্য কবিতাটির সঙ্গে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ, পার্থক্য শুধু ছন্দ-ব্যবহার ও পঙ্ক্তি-ভাঙনে। উদ্ধৃত গদ্য কবিতাটিতে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের একটি প্রায়-স্পষ্ট প্রবাহও লক্ষণীয়। ফলে, এ-থেকে বলা যেতে পারে, এই কবিতাটিকে গদ্যে বিন্যস্ত করলে যে অবস্থা তৈরি হতে পারত, তার কাছাকাছি একটি অবস্থা এখানে গদ্য কবিতাটিতে সৃষ্টি হয়েছে। “গল্প শিকারের চেষ্টা”-তে আবার কিছু বৈচিত্র্যও চোখে পড়ে, যখন কবি একধরনের মিশ্রণের চেষ্টা করেছেন— হ্রস্ব, সুর কেটে দেওয়া গদ্যের সঙ্গে একটু দীর্ঘ মাপের বাক্য মিশিয়ে দিয়ে যার সঙ্গে বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এর ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে কিছুটা:
ঘুম ভাঙলো মাঝিদের হাঁকডাকে। পাটাতন ভেজা। এতক্ষণ যে-ক্ষরণ হচ্ছিল বিশ্রামের, তারই চিহ্ন এই ঘাম। সুখ ভেঙে গেলো, কিন্তু অনাসক্ত ক্ষুধা লাফিয়ে মাল্লাদের ধোঁয়া-ওঠা ভাতের থালা আর আগুনের মতো লাল সালুন দেখে! বাসন এগিয়ে দিয়ে তারা হাসে… জন্মভূমি; এই পৃথিবীতে যারাই বেঁচে আছে, তাদের রেখাচিত্র এক!… শাদা ভেড়ার দল নিয়ে, চুরুট মুখে যারা যায় জলপাই বাগানের পাশ দিয়ে; আর যারা এখন আমাদের জন্যে দাঁড় টেনেছিলো, তারা!
ফিরেছি রাত্রির প্ররোচনায়। একা। অভিজ্ঞতা খেয়ে। অতএব… (“গল্প শিকারের চেষ্টা: ২”)
সর্বোপরি, “গল্প শিকারের চেষ্টা”-তে আমরা যা দেখতে পাই, তাকে বলা যেতে পারে আঙ্গিকগত নিরীক্ষা—এই নিরীক্ষা মুখ্যত গদ্যভাষায়। এই গদ্যভাষায় বাক্য-দৈর্ঘ্যের হ্রস্বতা ও গতি সৃষ্টির পাশাপাশি আখ্যান কিংবা তার আভাস জাগিয়ে রেখে বর্ণনা অগ্রসর হয় এবং প্রতীকের প্রয়োগ আবারও মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। বাক্যে ক্রিয়াপদ সংকুচিত হয়েছে এবং বিভক্তি ও অনুসর্গ যথাসম্ভব কম ব্যবহৃত হয়েছে। এই গদ্যভাষাকে নিয়ে আরও অগ্রসর হতে পারতেন কবি, কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। ফলে গদ্যভাষার এই রূপটি স্থায়ী হলো না, নিরীক্ষা হয়েই থাকল।
সিকদার আমিনুল হকের বিরুদ্ধে প্রধানতম অভিযোগ বিদেশি আবহ সৃষ্টি করা, এটি তার গদ্য কবিতাতে অনুষঙ্গগুলোকে পরীক্ষা করলেই স্পষ্ট হয়। পঠন-অভিজ্ঞতা থেকে আসা এসব আবহ তার শিল্পরুচিরও পরিচায়ক, আমরা বুঝতে পারি এই কবি ইউরোপীয় ও নাগরিক রুচিতে আস্থাবান। তার প্রিয় কবিদের তালিকা পাঠক সহজেই পেয়ে যান, যেহেতু তিনি তাদের প্রায় সবাইকে নিয়ে কবিতা ও গদ্য কবিতা লিখেছেন। ইংরেজি জটিল-বাক্যের আদলে বাক্য পরিলক্ষিত হয় বলে সতত ডানার মানুষ সম্পূর্ণত এবং বাতাসের সঙ্গে আলাপ কিছুটা বাক্যিক বৈশিষ্ট্যগত কারণে এই অভিযোগটিকে সহায়তা করেছে। অন্যদিকে, যে-শ্রেণির জীবন তার লেখার প্রধান উপজীব্য, তার সঙ্গে বিদেশি আবহ সঙ্গতিহীন নয়। অভিজাত রুচির অহঙ্কারী ও দৃপ্ত তার উচ্চারণ ও পদচারণা, যা সর্বত্রই পাওয়া যাবে:
জলবায়ুর পক্ষে শ্রেষ্ঠ পানীয় আমি পান করি। আমার পোশাক বিশদভাবে সংগ্রহ করা। আমি স্থূল আর নোংরা মানুষদের সঙ্গে কথা বলিনি। যাদের নখের নিচে ময়লা, অন্য জাতিদের ঘৃণা করে, আমি দেখেছি তাদের কল্পনা আর স্বপ্নও সেরকম দুর্গন্ধময়। (সডামা ৪২)
সিকদার আমিনুল হক গদ্য কবিতাকে কবিতারই একটি বৈচিত্র্য হিসেবে গ্রহণ করলেও, লক্ষণীয় যে, এর বিশেষত্ব বা চারিত্র বিষয়ে কিছু স্বতন্ত্র বিবেচনাকে তিনি স্থির করে নিয়েছিলেন। এটি তার গদ্য কবিতার ভাষা ও বিষয়বস্তুর দিকে মনোযোগী হলে স্পষ্ট হয়। দূরের কার্নিশ থেকে বাতাসের সঙ্গে আলাপ পর্যন্ত যে গদ্য কবিতা তাতে তিনটি বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট:
এক. পদ্যে লেখা কবিতা ও গদ্য কবিতা উভয়ের জন্য স্বতন্ত্র ভাষাকে সৃষ্টি ও ব্যবহার করতে চেয়েছেন।
দুই. গদ্য কবিতাকে চেষ্টা করেছেন কাব্যগ্রন্থের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র পর্বে বা অংশে রাখতে কিংবা স্বতন্ত্র গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করতে।
তিন. গদ্য কবিতাগুলোকে অনেকটা সিরিজ রচনার মতো, একটি পর্ব বা গ্রন্থের সমস্ত রচনাকে একটি সমগ্র হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন—একটি ভাবসমগ্রের অংশ হিসেবে এদেরকে অনুভব করতে পারি আমরা।
বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এর পর যে গদ্য কবিতাগুলো লিখেছিলেন সিকদার, সেগুলোতে গদ্যভাষা বিষয়ে বিভিন্ন নিরীক্ষা লক্ষ করেছি আমরা। কিন্তু এদের পূর্ববর্তীদের বিষয়ে যা বলা সম্ভব হয়েছে, তা এদের বিষয়ে প্রযোজ্য নয়।
সিকদার আমিনুল হকের গদ্য কবিতা ভাষাগত দিক দিয়ে বারবার বাঁক পরিবর্তনের মাধ্যমেই অগ্রসর হয়েছে, এই ভাষিক বিবর্তন ভাবগত দিককেও প্রভাবিত করেছে। তার গদ্য কবিতা গদ্যে লিখিত হওয়া সত্ত্বেও কাব্যিক উপকরণ ও প্রকৌশলের দিকে পক্ষপাতের কারণে কবিতার দিকেই ভারসাম্যটিকে অনুগত রাখে। বাক্যিক কাঠামো বা বিন্যাসের ক্ষেত্রে ব্যাকরণিক যে-শৃঙ্খলা রয়েছে তাকে বিপর্যস্ত করার কোনো প্রয়াস তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। বিষয়বস্তুগত দিক দিয়ে তিনি তিরিশি আধুনিকতাবাদী সাহিত্য-কাঠামোর বাইরে পা ফেলেননি। গদ্য কবিতার যে বিশেষত্ব তিনি অর্জন করেছেন, তা ভাষাগত দিক থেকে বিচার্য মূলত। তার কবিতায় পাঠক একজন ভ্রমণপিপাসু দ্রষ্টাকে দেখতে পায়, যে দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজের জীবনদর্শনকেও এতে অঙ্গীভূত করে নেয়। একই কথা তার গদ্য কবিতার জন্যও প্রযোজ্য। এখানেও একজন প্রাজ্ঞ ভ্রামণিককে পাই, যে বস্তু থেকে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্তায়, দৃশ্য থেকে দৃশ্যাতীতে এবং অনুভূতি থেকে সংবেদনের গভীরে প্রবেশ করতে চায়। সাধারণভাবে যৌনতা কিংবা মৃত্যু তার প্রিয় প্রসঙ্গ হলেও এদেরকে অনুসরণ করে নতুন শিল্পবোধে উপনীত হওয়া তার অভীষ্ট বলেই তিনি উচ্চারণ করতে পারেন এ-কথা:
সব শব্দের জয়, গন্ধ আর ক্ষমতার চিত্র আমি জানি। ভ্রমণের হাল্কা চোখ নিয়ে আমি আসিনি। আমার চোখ প্রাচ্য দেশের। এর ঠান্ডা গভীরতা সেই রুমালের মতো; বাক্স খুললেই যার গুমোট গন্ধ আর পরিণত ভাঁজ ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়বে। (“যে-সব শব্দ আমি জানি” বাসআ ২৫)
টীকা :
১. বর্তমান প্রবন্ধের লেখক টানা গদ্যকবিতার পরিবর্তে ‘গদ্য কবিতা’ (গদ্য ও কবিতাকে বিচ্ছিন্ন করে) লেখার পক্ষপাতী। কারণ এই সংরূপটির নাম যিনি দিয়েছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এভাবে লিখেছিলেন এবং এর ইংরেজি নামটিও এভাবেই লেখা হয়ে আসছে: । উপরন্তু, এভাবে লিখলে পরস্পরে আত্মীকৃত গদ্য ও পদ্যের স্বাতন্ত্র্যের দিকটিও পরিস্ফুট হয়।
২. বায়তুল্লাহ্ কাদেরী তার গবেষণা বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা: বিষয় ও প্রকরণ-এ সিকদার আমিনুল হককে ষাটের দশকের কবি বলে গ্রহণ করেননি (৪১-৪২)। অন্যদিকে, বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব শীর্ষক গবেষণাগ্রন্থে মাসুদুল হক সিকদার আমিনুল হকের কবিতা আলোচনা করলেও টানা গদ্যকবিতাকে বাদ দিয়েছেন। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইটির ভূমিকা থেকে জানতে পারি, ১৯৯৭-৯৮ সময়পর্বে তিনি এ গবেষণাটি সম্পন্ন করেন, যখন সতত ডানার মানুষ প্রকাশিত হয়েছে আরও ছয় বছর আগেই। তিনি টানা গদ্যকবিতাকে কবিতা বিবেচনা করেন বলেই আমাদের প্রতীয়মান হয়েছে, যেহেতু তিনি সৈয়দ আলী আহসান ও আবদুল মান্নান সৈয়দের টানা গদ্যকবিতার আলোচনা করেছেন।
৩. এই বাক্যের সঙ্গে আমাদের মনে পড়তে পারে জীবনানন্দ দাশের এই পঙ্ক্তিটি: এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে―জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা’ (“সপ্তক” কবিতা সমগ্র জীবনানন্দ দাশ ২০৯, প: ১)।
৪. লিটল ম্যাগাজিন বাবুই-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে গালিব বলেছেন: ‘পাঠাভিজ্ঞতা থেকে আমি উপনীত হয়েছি মূলত আখ্যানের বালিয়াড়িতে।… আমার মনে হয়, গল্প নয়, গল্পাংশের দিকেই আমাদের ঝোঁক পড়া উচিত’ (১২১)।
৫. স্মরণ করতে পারি, মাসুদ মোস্তাফিজ লিখেছেন, ‘নগরজীবনের প্রেক্ষাপটেই সিকদার আমিনুল হক তাঁর কবিতায় নির্বেদ্য নৈঃসঙ্গ্যচেতনাকে চিত্রায়ণ করেছেন।’
রাশেদুজ্জামান
কবি, প্রাবন্ধিক
কাব্যগ্রন্থ : পাখি ও প্রিজম (২০০৮) ঘুমসাঁতার (২০১২)
গবেষণা : বাংলা কাব্যধারায় টানা গদ্যকবিতা (অপ্রকাশিত)