বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ এবং সুফি-পীর আব্দুস কদ্দুস হাওলাপুরী : একটি সম্পর্কের অনুসন্ধান | সরোজ মোস্তফা

১৯৩০ সালে জালাল খাঁর বয়স ছত্রিশ বছর। এই বয়সে তিনি মানবিক বিবাগী হয়ে, জীবন জিজ্ঞাসার অভিমুখী হয়ে বাড়ি ছাড়লেন। বাড়িতে তিনি ফিরেছেন, তবে সেটা গৃহীর ফেরা নয়; সাধনার পরশে বাউল হয়ে ফিরেছেন। ঘরের ভেতরে থেকেও পরদেশি এক পরমকে খুঁজেছেন।


‘কেহ করে বেচাকেনা কেহ কান্দে রাস্তায় পড়ে
ধরবি যদি তারে চলো মুর্শিদের বাজারে’

মহাজন জালাল উদ্দীন খাঁ সাহেবের এই সাধনপংক্তির সাথে  শৈশব-কৈশরের অজ্ঞান পরিসরেই পরিচয়। বয়সের সেই চঞ্চল মুহূর্তে গানের বাগান আর সুরের মাধুর্যের চেয়ে গানের পরিবেশ ও পরিবেশনটাই ভালো লেগেছিল খুব। ‘অবাঞ্ছিত’ সিনেমায় ‘পাগলা বাবার ওরসে’ আব্দুল আলীম সুর ও লিরিকে বাংলার মরমি ভাব ও ভাবুকতাকেই ঢেলে দিয়েছেন। ছবির সাদাকালো ফুটেজে উঠে এসেছে সুফির পবিত্র খানকা, ধূপধোঁয়ায় বাউল গানের আসর আর হালকা জিকিরের তালে দেওয়ানা হয়ে যাওয়া বাংলার প্রাকৃতজনের তন্ময়-দৃশ্য। পীর-মুরশিদের দর্গায় মানুষ কেন যায় এবং নিজেকে কীভাবে সমর্পণ করে-তার একটা প্রাসঙ্গিক দৃশ্যায়ন আছে এই চলচিত্রে। মাজারের সামিয়ানায় পাগল-সাধুদের গানে ও জিকিরে আগুন্তুক, ভক্ত-প্রেমিক-দর্শনার্থীরাও কীভাবে শান্তি ও ভক্তিতে সমর্পিত হয়ে যায়- এমন দৃশ্য নেত্রকোণার শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমীর মাজারে দেখেছি। শুধু ওরসে নয়, বৃহস্পতিবারে এই মাজারে সারা রাত গানের মচ্ছব হয়। বৃহস্পতিবারের সেই মচ্ছবের রাতে মাজারের এক ভক্ত গায়কের মুখে এই গান সামনাসামনি শুনেছিলাম । গান ও জিকিরের মগ্নতা শেষে সাধুকে গানের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘এই গান মহাজন জালাল উদ্দীন খাঁ সাহেবের’। এই কথা বলে সাধু দুইহাত কপালে রেখে অগ্রজ মহাজনকে ভক্তি করলেন। আমি আবারও তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি তাঁকে দেখেছেন?’। সাধু আবারও ভক্তি রেখে বললেন, ‘আমি দেখিনি। আমার মুরুব্বিরা দেখেছেন। তিনি আমার পীরভাই। চট্টগ্রামের গাউসে হাওলার মুরিদ ছিলেন। সিংহেরগাঁয়ে তাঁর মাজারে গেছি। গান করেছি।’

 

দুই

বাংলার ভাব ও ভাবুকতায় ব্রহ্মপুত্র-সুরমা-মেঘনার পললবাহিত-হাওরস্নাত এই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নরম মাটিতে সৃষ্টি হয়েছে লোকসাহিত্যের স্বাতন্ত্রিক ও উজ্জ্বল ক্ষেত্র। মাটির উর্বরতা ও মাছের ঐশ্বযে জীবন-যাপন এখানে খুব সহজ। মাটির প্রাকৃত ধর্মে এখানকার মানুষ ভাবুক, প্রেমিক ও উদাসী। এখানকার ভূপ্রকৃতির চিত্রয়ান করে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন:

নদীমাতৃক দেশের মানুষ তার জাদু-ভাষায় বুঝেছেন লাকজীবনের গাথা, তার যাপনের অন্তরে লোকায়িত সৃজনবেদনার অন্তর্লোক কেমন ইয়াশীল। বলা হচ্ছে, ব্রহ্মপুত্রের পূর্বাঞ্চল বছরের বেশিরভাগ সময় জলাভূমি আবৃত থাকে। এই জলাভূমিই হাওর। সাগর শব্দেরই আঞ্চলিক রূপভেদে সম্ভবত হাওর শব্দের সৃষ্টি। জালিয়ার হাওর, নরুনসার, গণেশের হাওর, তলার হাওর পূর্ব ময়মনসিংহের মানুষের মনে আজও বহু স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে। এ ছাড়া মেঘনা, সোমেশ্বরী, মগরা, ঘোড়াউতরা, আড়িয়াল খাঁ, কংস প্রভৃতি নদী-উপনদী এ অঞ্চলকে সিঞ্চিত করে এর মাটিকে করেছে উর্বর আর কোমল করে দিয়েছে এর অধিবাসীদের মানস-ভূমি। এসব বিল-ঝিল, নদ-নদী ও হাওর-বাওরের বেলাভূমিতেই সৃষ্টি হয়েছে লোকসাহিত্যের উর্বর ক্ষেত্র।’ (জালাল-গীতি ‘কত রঙ্গের নকশি কাঁথা: নিরন্তর, ষষ্ঠ সংখ্যা, শীত সংকলন, পৌষ ১৪১২, পৃষ্ঠা-৪)

মুসলিম সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির আগমনের দেড় শতাব্দী পূর্বে ৪৪৫ হিজরীতে (১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে) ইসলাম প্রচার এবং সুফি ভাবুকতার মগ্নপুরুষ শাহ্ সুলতান কমর উদ্দীন রুমী বাংলায় আসেন। নেত্রকোনা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে কেন্দুয়া সড়ক পথে মগড়া নদীর তীরে মদনপুরে এই মহাজনের মাজার। এখানে প্রতি বছর ফাল্গুনের পূর্ণিমায় তিন দিনব্যাপী ওরস হয়। বহু বিচিত্র সাধকের গমনাগমনে এখানকার মানুষের মন ও প্রকৃতি পরিপূর্ণ। ভক্তি ও মরমে সাধুরা মাজারের নির্জন সামিয়ানায় নিজেকে সমর্পন করতে আসে। সাধুদের কাফেলায় এখানে গান হয়, জিকির হয়। গানে-গানে পরমের সাথে ভক্তের মিলন হয়। সুফি ভাবনায় আত্মশুদ্ধি আর প্রেমভাবে মগ্ন থাকার আচারিক রীতি ফল্গু ধারার মতো এই অঞ্চলে বহমান ছিল।

বাংলার সুফি ভাব ও মরমিজ্ঞানে স্নাত হাওরাঞ্চলের প্রাকৃত পরিবেশে  নেত্রকোনা এক আশ্চর্য সমৃদ্ধ জেলা। এই জেলার মদনপুর সংলগ্ন আসদহাটি গ্রামে বাউল সাধক জালাল উদ্দীন খাঁ ১৮৯৪ সালের ২৫ এপ্রিলে জন্ম গ্রহণ করেন। আটাত্তর বছরের পৃথিবীবাস রেখে ১৯৭২ সালের ৩১ জুলাই একই এলাকায় তাঁর স্থায়ী বাসস্থান সিংহেরগাঁওয়ে দেহ রাখেন। পূর্বেই বলেছি, সাধু-সন্তদের গমনাগমনে এই এলাকায় সহজিয়াপন্থী লোকধর্মের গান ও গায়কের আসর বসতো। সেইসব মাটির গানের সুর ও প্রবাহে তাঁর কিশোরমন আচ্ছন্ন হয়েছে। গানের প্রতি, কবিতার প্রতি মগ্ন-চৈতন্য উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। তাঁর পৌত্র গোলাম ফারুক খানের জবানিতে জানতে পারি:

‘তাঁর পিতা সদর উদ্দীন খাঁ নিজেও একজন কবি ছিলেন। পিতার কাছ থেকেই জালাল কবিতা ও গানের প্রতি আকর্ষণ অনেকটা পেয়েছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর কাব্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তখনই তিনি মুখে মুখে গান বেঁধে তা গাইতেন।’ (পরশমণি জ্বলে, বিডি আটর্স, ৩১ জুলাই,২০২২ )

স্কুলে পড়ার সময়ই একটা সচেতন দৃষ্টি তৈরি হয়েছিল তাঁর। মদনপুরের মাজারে গমনাগমনের প্রেক্ষিতে সাধু-সন্তদের জীবন-জিজ্ঞাসাও তাঁর মনকে প্রভাবিত করেছিল। জীবন কি? মানুষ কেন মরে? মরণের পরে কোথায় যায়?- এ সব জিজ্ঞাসার ভেতরেই বেড়ে উঠছিলেন তিনি। জীবনীকার মোহাম্মদ আজিজুল হক চৌধুরী বলেন,

আসাদহাটী গ্রামেই জালাল উদ্দীনের বাল্য ও শৈশব কাটে। ছোট ভাইদের অকালমৃত্যু জালাল উদ্দীনের মনেও দারুণ আঘাত লাগে। আসাদহাটী গ্রামেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। গ্রামের পাঠশালার পাঠ শেষ হলে তাঁকে নেত্রকোণা শহরে মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। কিন্তু নেত্রকোণা শহরে গিয়েও তাঁর বিশেষ কোন তাবাস্তর হলো না । এরপর তাকে ভর্তি করা হয় কেন্দুয়া হাইস্কুলে ১৯১৪ সালে। কিন্তু দশম শ্রেণীর পাঠ শেষ হতে না হতেই তাঁকে বিয়ে করানো হয় তৎকালীন সময়ে ‘কবি সরকার’ বলে খ্যাত তাঁর মায়ের ফুফাতো ভাই সিংহেরগাঁও নিবাসী জনাব হাসমত আলী তালুকদারের একমাত্র কন্যাকে। তাঁর স্ত্রী ইয়াকুতুন্নেছা ছিলেন একাধারে অনিন্দ্যসুন্দরী, বিনয়ী, উদার, দয়াশীলা, পতিগতপ্রাণা এবং কুরআনে হাফেজ ও অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা। তিনি কঠোরভাবে পর্দাপ্রথা মেনে চলতেন। ইয়াকুতুন্নেছা যদিও প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করেননি, তবুও তিনি ছিলেন বিদুষী ও জ্ঞান-পিপাসু। ফলে, পারিবারিক পরিবেশের সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে থেকেও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে লেখাপড়া করে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন।

এ সময়ে ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা-গান্ধীজীর ‘অহিং অসহযোগ’-এর আহ্বানে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলও জেগে উঠে। ইংরেজ শাসন অবসান করে কেন্দুয়ার গণ-মানসেও স্বাধীনতার সোনালী আভা উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। যুবক জালাল উদ্দীনও অন্যান্য বন্ধুদের সংগে ‘অসহযোগ ‘ আন্দোলনে অংশ নেন। কিন্তু বেশীদিন এ চেতনা তাঁর জীবনে স্থায়ীত্ব লাভ করেনি। তাঁর অস্থিতে, তাঁর মজ্জায় তখন হাজারো প্রশ্নের ভীড় : মানুষ কেন ? মরলে পরে কি হয়? মৃত্যুকে কি জয় করা যায় না ? আধুনিক বিজ্ঞান কতো কিছুইতো আবিষ্কার করছে, কিছু মৃত্যুকে জয় করতে পারছেনা কেন ? তবে যে ওরা বলেন, ঈশ্বর প্রেমে পাগল হলে মৃত্যু বলে কোন কিছু আর থাকে না ?- ইত্যাকার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি বার বার ছুটে গেছেন মদনপুরের দরগায়। কিন্তু মেলেনি উত্তর।

বিয়ের পর জালাল উদ্দীনের কিঞ্চিৎ ভাবান্তর হয়েছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু মদনপুরের আকর্ষণ থেকে তিনি মুক্তি পাননি। সময়ে অসময়ে প্রায়ই তাঁকে দেখা যেতো মদনপুরের দরগায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বাউলফকিরদের সঙ্গে এখানেই তাঁর পরিচয় ঘটে। অনেক বৈষ্ণব সাধকের সঙ্গেও তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। তিনি প্রায়ই একটি গানের কলি আপন মনেই গাইতেন আর উদাস নয়নে প্রকৃতির দিকে চেয়ে থাকতেন—

‘এ ভব সংসারে আপন বলো কারে ?
সকলি মায়ার ছল না।’ ( জালাল উদ্দীন খাঁ; বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা:১৫-১৭ )

‘জীবনীকার মোহাম্মদ আজিজুল হক চৌধুরীর ভাষ্যে আমরা জেনেছি দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এই স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাবে স্কুলের পড়াশোনাও ছেড়ে দেন। প্রেমিক জালালের সংসার জীবনও ছিলো অত্যন্ত শান্তিময়। কিন্তু প্রিয় স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে জাগতিক বিষয়াদি থেকে বিছিন্ন হয়ে বাড়ি ছেড়ে সাধু-সন্তদের আশ্রমে ঘুরতে থাকেন। জীবনীকার বলেন:

ভাবুক জালাল—প্রেমিক জালাল তাঁর স্ত্রী ইয়াকুতুন্নেছাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। স্ত্রীর প্রেমে তিনি ছিলেন ‘আকুল-পাগল পারা।’ বুদ্ধিমতি ও বিদুষী ইয়াকুতুন্নেছাও স্বামী জালাল উদ্দীনের হৃদয়-সিংহাসনে স্থায়ী আসন গড়ে তুলতে সক্ষম হন। ১৩৩০ সালে একমাত্র পুত্র আবদুল হাকিম আর কন্যা করিমুন্নেছাকে রেখে ইয়াকুতুন্নেছা মৃত্যুবরণ করেন। প্রেম-পাগল জালাল উদ্দীন সহজে এ চিরন্তন সত্যকে মেনে নিতে পারেননি।…. কপাটে খিল দিয়ে সারাদিন, সারারাত তিনি কেবলই কেঁদে কেঁদে গাইলেন…..এমনি করে কাটলো তিন দিন। এরপর ঘর থেকে বের হয়ে স্ত্রীর কবরের পাশে গিয়ে কেঁদে কেঁদে আকুল হলেন। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঝিমিয়ে পড়লেন কবরের পাশেই। ….প্রিয়তমা-পত্নীকে খুঁজতে এক সময় দেওয়ানা হয়ে বাড়ী ছেড়ে পালালেন ‘শায়ক-বেঁধা পাখিসম’ উদ্ভ্রান্ত জালাল উদ্দীন। ( জালাল উদ্দীন খাঁ; বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা:১৭-১৮ )

 

তিন

১৯৩০ সালে জালাল খাঁর বয়স ছত্রিশ বছর। এই বয়সে তিনি মানবিক বিবাগী হয়ে, জীবন জিজ্ঞাসার অভিমুখী হয়ে বাড়ি ছাড়লেন। বাড়িতে তিনি ফিরেছেন, তবে সেটা গৃহীর ফেরা নয়; সাধনার পরশে বাউল হয়ে ফিরেছেন। ঘরের ভেতরে থেকেও পরদেশি এক পরমকে খুঁজেছেন। ঘরকে করেছেন আত্মজিজ্ঞাসার আখড়া। গোলাম ফারুক খান স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বিশ শতকের বিশের দশকে পত্নী ইয়াকুতুন্নেসা খানমের অকাল-প্রয়াণের পর সেই ঘটনার অভিঘাতে তিনি সংগীত ও তত্ত্বসাধনায় মনপ্রাণ সঁপে দেন।’ মগ্ন হতে হতে বাউল যে তত্ত্বসাধনায় উপনীত হন সেটা একা একা ধারণ করা যায় না। গুরুর সহচর হয়ে, গুরুর পাঠশালায় সমর্পিত হলেই আত্মজ্ঞান উন্মোচিত হয়।

আমরা আগেই জেনেছি বাড়ির কাছেই শাহ্ সুলতান কমর উদ্দীন রুমীর মাজারে তাঁর নিত্য গমনাগমন ছিল। পীর-ফকির, সাধু-সন্ত-তান্ত্রিকদের জীবন প্রনালীর সাথে তাঁর পরিচয় এবং সচেতন আগ্রহ ছিল। স্ত্রী বিয়োগের বিষাদে এবার তিনি সে পথের পথিক হলেন। স্পষ্ট বলা যায়, একটি মৃত্যুর অমোচনীয় বিষাদে তিনি ভাবুক ও তাত্ত্বিক জগতে সমগ্ন হয়ে নিজেকে সমর্পন করেন। জীবনীকারের ভাষ্যে জানা যায়:

প্রাণ-প্রিয় পত্নী ইয়াকুতুন্নেছার অকাল প্রয়াণে তাপিতদগ্ধ হৃদরে ঘুরে বেড়িয়েছেন পথে-প্রান্তরে, বনে-বাঁদাড়ে, শহরে-নগরে, মঠে-মসজিদে, মন্দিরে-গীর্জায়, আখড়া-খানকায়, দরগায়-মাজারে, শ্মশানে-গোরস্থানে ! বাংলাদেশের এমন কোন দরগা বা মাজার নেই যেখানে তিনি না গিয়েছেন। হবিগঞ্জ জেলার বিতঙ্গল (বিতলং) আশ্রমে গিয়েও সাধু-সঙ্গ করেছেন তিনি। দীর্ঘদিন এভাবে তাঁর কেটেছে। নেত্রকোণার পূর্বদিকে বাইশ- চাপড়া গ্রামের বিশিষ্ট বাউল গায়ক রশীদুদ্দীন সাহেবের কাছেও বহুবার গিয়াছেন তিনি। রশীদুদ্দীন সাহেব পরবর্তীকালে তাঁর চাচাশ্বশুর হয়েছিলেন। জালাল উদ্দীন তাঁকে গুরুর মতো ভক্তি করতেন। নিজ গ্রামের (সিংহের গাঁও) বাউল গায়ক গোমেজ আলী ফকিরের সান্নিধ্যে গিয়েও বহু বিনিদ্র রজনী যাপন করেছেন। দলপা গ্রামের গোবর্ধন সাধুই ছিলেন তাঁর ‘লাউয়া’ (একতারা) শিক্ষার উস্তাদ। বিভিন্ন পীর-ফকির-সাধু-সন্ন্যাসীদের আস্তানায় ঘুরে ঘুরে তিনি বাউল ও সুফী তত্ত্বের অদ্ভুত জ্ঞান অর্জন করেন। এক সময় হৃদয়ের বন্ধ দরজা গেলো খুলে, জেগে উঠলো প্রাণ—মহাপ্রাণে বিলীন হবার দুর্বার বাসনায় মেতে উঠলেন তিনি ! দরাজ কণ্ঠে ‘লাউয়া’ বাজিয়ে গান ধরলেন তিনি—

বন্ধু কই রইলারে।
অকূলে ভাসাইয়া বন্ধু কই রইলারে।। (জালাল উদ্দীন খাঁ; বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা:২০-২১ )

এই বর্ণনায় অতিকথন থাকলেও যাপিত জীবনের ব্যক্তিত্বই স্পষ্ট হয়েছে। সাধনার বহুবিচিত্র পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ আত্মজিজ্ঞাসার অভিমুখে যাত্রা করেন। এই জিজ্ঞাসায় প্রেম ও মানুষই মুখ্য। এই জিজ্ঞাসায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাসীদের আচারিকতার পরিচয় বহন করেন না। এই জিজ্ঞাসায় ভক্তি আছে, গুরু আছে কিন্তু সবচেয়ে বেশি আছে নিজের আমিকে চেনার সারলিক আয়োজন। অর্জিত প্রজ্ঞা ও গানের সৃষ্টিতে মন ও মানবধর্মকে জানানোর এও এক সচেতন প্রচার। প্রচারের এই কাজটাই বাউলেরা গানে গানে করেন। একা করেন না, সবাই মিলে আলাদা-আলাদা স্বরে প্রকাশ করেন। মরমীবাদের গহিনপথে যুগ যুগ ধরে হাঁটছেন বাংলার মানবিক বাউল। ড. আহমদ শরীফ বলেন:

অনার্য-অধ্যুষিত বাঙলা দেশে জনগণ চিরকাল অত্যধিক ভাবপ্রবণ। এই ভাবপ্রবণতা বা হৃদয়োচ্ছ্বাস থেকেই বাঙালির গীতিকবিতার উদ্ভব । বাঙলা কেবল ধানের দেশ নয়, গানের দেশও। এখানকার মাটির ফসল ধান, মনের ফসল গান। শুধু বন্যাতেই দেশ প্লাবিত হয় না, গানেও হৃদয় প্লাবিত থাকে। লাল কাঁকরের পশ্চিমবঙ্গ শুষ্ক উত্তরবঙ্গ ও নদীবহুল পূর্ববঙ্গ-বাসীর দৃষ্টি চিরকাল আকাশের দিকে। শ্যামল সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যেমন আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতা জানায়, তেমনি প্রকৃতির নিদারুণ রুক্ষতায় কিংবা বিরূপতায় ঊর্ধ্বে দুচোখ তুলে ফরিয়াদও জানায়। মমতায় আঁকড়ে ধরা নয়, চরম ঔদাস্যে মোহ মুষ্ঠি শিথিল করাই এদের জীবনাদর্শ। তাই চর্যাপদের দেশেই বৈষ্ণব-বাউলের উদ্ভব। মূলত সবগুলিই এক। প্রকাশভঙ্গিই ভিন্ন। সিদ্ধ-সূফী-যোগী-বৈষ্ণবেরা যেমন গুরুবাদী, বাউলেরাও তাই। বাঙালির স্বভাবেই রয়েছে মরমীয়াবাদ। (আহমদ শরীফ রচনাবলী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৬৮)

বাংলার বাউলধর্ম ও বাউলতত্ত্ব মূলত হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সাধনা। সুফিজ্ঞান-ফকিরিতত্ত্ব-যোগাচার-বৈষ্ণবীয় প্রেমাচার মিলে এক ‘গভীর নির্জন পথ’ সৃজন করেছেন মানবিক মহাজনবৃন্দ। সাধু-শিষ্য মিলে পরম্পরাগত এই জ্ঞান চর্চা করেন,  অর্জন করেন। সাধুর দরগায় ঘুরতে ঘুরতে জালাল খাঁ সেই জ্ঞানই অর্জন করেছেন। মূলত বাউল-মহাজন সান্নিধ্যেই তিনি এই পথের পথিক হয়েছেন। মাটির প্রাকৃত জ্ঞান ও পরিবেশ তাঁর এই অসাম্প্রদায়িক পথপরিক্রমাকে সহজতর করেছে। জীবনীকার আমাদের জানাচ্ছেন:

‘প্রেম-পাগল জালাল উদ্দীন ‘মনের মানুষের খোঁজে বর্তমান নেত্রকোণা জেলার হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন। ‘নিমাই সন্ন্যাস’ কিংবা ‘রাই-বিরহ’ পালাকীর্তন শুনে ভাবে-আবেগে আপ্লুত হয়েছেন। নিজগ্রাম সিংহেরগাও, আশুজিয়া, দত্তনগুয়া, রামপুর, চন্দপাড়া কিংবা মনাং-তেতুলিয়া গ্রামের বিশিষ্ট হিন্দু পরিবারে ছিল তাঁর অবাধগতি। তিনি তাঁর গানে সকলকে মাতিয়ে রাখতেন।’ (জালাল উদ্দীন খাঁ; বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা:২৩-২৪ )

সাধনজগতে দীক্ষামন্ত্র অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। দীক্ষিত না হলে সিদ্ধি লাভ তো দূরের কথা, সাধনজগতে প্রবেশাধিকারও জন্মে না। ধারণা করা যায়, বিভিন্ন সাধু-সন্তের আশ্রম ঘুরতে ঘুরতে তিনি হবিগঞ্জের বিতলং আখড়ায় রামকৃষ্ণ সাধুর সান্নিধ্যে আসেন। বিশশতকের বিশের দশকে গুরু-শিষ্যের এই সম্মিলন ঘটেছে।সুধীর চক্রবর্তীর লিখেছেন:

নানা অজানা পির-ফকির-সাধুসন্ন্যাসীর সান্নিধ্যে এসে গানের জগতের চাবিকাঠি খুঁজে পান। বাউল সুফি-মারফতি তত্ত্বে ঘটে প্রবেশাধিকার। এবারে বেরিয়ে এল হৃদয়ের গোপন উৎস থেকে গানের অফুরন্ত ধারাপ্রবাহ। তবে বাউলতত্ত্বে দীক্ষা ও শিক্ষা তিনি নেন সম্ভবত সিলেটের বিতলং আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোঁসাইয়ের কাছে। এই রামকৃষ্ণ গোঁসাই ছিলেন বিখ্যাত গীতিকার দীন শরতেরও তাত্ত্বিক গুরু। (জালাল-গীতি ‘কত রঙ্গের নকশি কাঁথা: নিরন্তর, ষষ্ঠ সংখ্যা, শীত সংকলন, পৌষ ১৪১২, পৃষ্ঠা-৪)

‘মানবদেহ’ বাউল সাধনার অন্যতম অনুসঙ্গ। বাউলরা মনে করেন ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা আছে ভাণ্ডে’। এই দেহমন্থন বা দেহচর্চার ভেতর দিয়ে বাউলসাধকেরা সিদ্ধি লাভ করেন। যোগাচার এবং ‘তন্ত্র’ শাস্ত্রই দেহসাধনার ভিত্তি। বাউলেরা পুরোপুরি তান্ত্রিক নয়, কিন্তু তন্ত্রশাস্ত্রের বামাচার বা কামাচারের ধারায় মৈথুনতত্ত্বে স্নাত হন। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম-এই পঞ্চভূতে মানবদেহ গঠিত হলেও এর ভেতরে আছে নানান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে আরও অনেক মোকাম জড়িত। বাউল মতে আঠারো মোকামের কথা বলা আছে। সেই আঠারো মোকামের অবস্থান দেহের আঠরো জায়গায়। দেহকে চালনা করে ষড়রিপু। এই ষড়রিপু হচ্ছে ছয় চোর, ছয় ডাকাত, ছয় লোভী। বাউলেরা ষড়রিপুর বস না হয়ে ষড়রিপুকেই বশে রাখেন। দেহে রয়েছে ছয়টি চক্র, তিনটি প্রধান নাড়ী, আট কুঠুরি, নয় দরজা, ছয় লতিফা। বাউল সাধকেরা দেহকে জেনে বুঝেই দেহ সাধনায় লিপ্ত হন। ‘নফস’ আরবি শব্দ। সাধারণ মানুষ ‘নফস’ বা দেহের দাবীর কাছে বন্দী থাকেন। বাউলসাধকগণ তাই ‘নফস’কে দমন করার জন্য সাধনা করতে থাকেন। বিতলং আখড়ায় সাধুর সান্নিধ্যেই যোগাচার জ্ঞানে ঋদ্ধ হন। যোগের একটি অর্থ হচ্ছে উপায়। নিজেকে চেনা, নিজেকে জানার উপায়। আত্মজিজ্ঞাসার এক চিরায়ত ভাবুকতায় সৃষ্টি হতে থাকে জালালীয় জ্ঞানের জগত। জালাল খাঁর গান শ্রোতার সামনে প্রশ্ন হাজির করে। সুর ও কথায় অভিজ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাও হাজির করে। বাংলার কৃষক সমাজে গান শোনাটাও এবাদতের মতো। এইসব গানের কথা ও সুরে তাঁদের অশ্রু ঝরে। প্রকৃত পক্ষে বাংলার কৃষক সমাজই এই গানের ‘রসের রসিক’।


সহজ কথায়, সহজ সুরে, সহজ গায়কীতে বাংলার কৃষক সমাজের জীবনজিজ্ঞাসার লৌকিকদর্শন হচ্ছে জালালগীতিকা। লোকায়ত দর্শন এবং কৃষক সমাজের নিত্যব্যবহৃত শব্দমালা দিয়ে সাজিয়েছেন তাঁর ভাবুকতার জগৎ। পূর্বময়মনসিংহের লোকায়ত ঘরানার দৃষ্টি-দর্শন ও সুরকে ধারণ করে বাংলার ভাব ও ভাবুকতাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছেন।


চার

আত্মজিজ্ঞাসার পথে জালাল খাঁ বিষয়ী লোক ছিলেন না; কিন্তু সমাজ-সংস্কৃতির দৃশ্যমান নৃত্যতার বাইরের লোকও ছিলেন না। অনুভবের নবজাগরণে, আত্মচৈতন্যের গান ও আয়োজনে তিনি সমাজকে বুঝতে চেয়েছেন। একজন বাউল ফকির নানান তরিকা ও মতবাদের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তৈরি করেন আত্মপরিচয়ের ভূমি। একক কোন কনসেপ্টের ভেতরে বাউল সাধনা নির্ভর করেনা । জালাল খাঁর মানস গঠনের উৎসপথেও আছে ইসলাম-মারফত-যোগি-সুফি-সহজিয়া-বৈষ্ণবীয় মন ও মননের অমোচনীয় রসায়ন। ভাবনা ও আচরণে এঁরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের উত্তরাধিকার। মাটি এঁদের এক। কিন্তু বীজধর্মের সারলিকতায় সুর ও আচার ভিন্ন ভিন্ন। পুরো বাংলার ভাবুকতার আবহাওয়ায়, তত্ত্ব ও তাত্ত্বিকতায়, গানে-সুরে-জিজ্ঞাসা-মিলনে জালাল খাঁ এক উজ্জ্বল পুরুষ।

বাউলেরা সহজতত্ত্বের সাধনা করেন। সমাজচিহ্নিত সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকে অতিক্রম করে প্রেমের পথে, সহজ আনন্দের পথে হৃদয়ধর্মের সেবক হতে চান। অন্তরের সহজ ধর্মের রসিক তিনি। সমাজ-সংস্কৃতির নিত্যতাকে অতিক্রম করে বাউল হওয়া সহজ নয়। সমাজ বাউলকে সন্দেহের চোখে দেখে। বাউলত্বে কোন চ্যালেঞ্জ নেই, লোক দেখানো নেই। সামাজিকতাকে নয়, নিজেকে জানার সহজ তরিকায় বাউল ব্যাকুল থাকেন। সমাজ এঁদেরকে পাগল, উন্মাদ বলে অভিহিত করে। সনৎকুমার মিত্র বাউল শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘বাউল শব্দের উৎপত্তি নিয়ে বহুতর ব্যাখ্যা আছে। এদের সকলের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে সাধারণভাবে বলা হয় যে : সংস্কৃত ‘ব্যাকুল’ বা ‘বাতুল’ শব্দ বাউল শব্দের মূল [সং. ব্যাকুল বা বাতুল>বাউল। এর অর্থ উন্মাদ, পাগল।’ (বাউল, লালন, রবীন্দ্রনাথ : সনৎকুমার মিত্র, পৃষ্ঠা: ১)

 

বাউল শব্দটি দিয়ে বাংলার এক বিশেষ ভাবুক সম্প্রদায়কে বুঝানো হয় যাঁরা জীবনকে প্রশ্ন করে, সামাজিক রীতি-নীতিকে অস্বীকার করে। আত্মশুদ্ধিতে সহজ থাকার এও এক ধর্মীয় ঐতিহ্য। সমাজে তাই তাঁরা উপেক্ষিত। কিন্তু কেন এই উপেক্ষা-অস্বীকার? ক্ষিতিমোহন সেন ‘বাউল’ সম্পর্কে বলেছেন: ‘বাউল শব্দটির অর্থ হল পাগল। সম্ভবত সংস্কৃত ‘বায়ু’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। বায়ু অর্থ স্নায়ু-প্রবাহ। অন্য আর-একটি ব্যুৎপত্তি একে শ্বাস-নিয়ন্ত্রণ-ক্রিয়া বা প্রাণায়ামের সঙ্গে যুক্ত করে, সম্প্রদায়বিশেষে এর অভ্যাস আছে। এই ধর্মীয় ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে বৌদ্ধধর্ম, তন্ত্র আর বৈষ্ণব ধর্মের অপভ্রংশ থেকে। নামের উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক, বাউল তার নামের সঙ্গে সংগতি রেখেই চলেছে। সতত ভ্ৰাম্যমাণ, সমস্ত পরম্পরার বন্ধন থেকে মুক্ত বাউলরা বায়ুর মতোই মুক্ত।’ ( হিন্দু ধর্ম : ক্ষিতিমোহন সেন; পৃষ্ঠা: ৯৭)

সাধনার ভেতর দিয়েই বাউলত্ব অর্জন করতে হয়। এই প্রাণায়ামের চর্চা, তন্ত্র ও বৈষ্ণবজ্ঞানের সাথে যুক্ত ছিলো জালাল খাঁর বাউল সাধনা। শাক্ত, সুফি, বৈষ্ণব, সহজিয়াবাদের চর্চার ভেতর দিয়ে তিনি উদারপন্থী মানবিক বাউল সাধক হিসেবেই সমগ্র বাংলায় পরিচিত হয়েছেন। জালালী গানের কথা, সুর ও গায়কীতে তন্ময় হয়ে বাংলার কৃষক সমাজই ‘জালালী গানকে’ তত্ত্বের সাগর বলেছেন। সহজ কথায়, সহজ সুরে, সহজ গায়কীতে বাংলার কৃষক সমাজের জীবনজিজ্ঞাসার লৌকিকদর্শন হচ্ছে জালালগীতিকা। লোকায়ত দর্শন এবং কৃষক সমাজের নিত্যব্যবহৃত শব্দমালা দিয়ে সাজিয়েছেন তাঁর ভাবুকতার জগৎ। পূর্বময়মনসিংহের লোকায়ত ঘরানার দৃষ্টি-দর্শন ও সুরকে ধারণ করে বাংলার ভাব ও ভাবুকতাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছেন। সাধকের সমকালীন বন্ধু কবি রওশন ইজদানীর মন্তব্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, “সারা ময়মনসিংহে তাঁর অশেষ খ্যাতি। বর্তমানে এতদঞ্চলে যে ধারায় বাউলদের গীতি সাধন চলছে তার প্রকৃত ও আদি রূপকার একমাত্র তিনিই। বাউল ও তত্ত্ব দর্শনে জালাল সাগর সদৃশ বিশাল, ময়মনসিংহের সমস্ত বাউল-গীতিকারেরই নমস্য। তিনি বাউল গীতি কাব্যের আজীবন একনিষ্ঠ সেবক ও সাধক, তাঁর প্রত্যেক গানেরই একটি নিজস্ব মৌলিক রাগিণী আছে”। (লোকসাধনার সংস্কৃতি: মাসুদ সিদ্দিকী, পৃষ্ঠা: ৮৭) 

শুধু ‘তত্ত্বসাগর’ নয় ভক্ত কিংবা শিষ্যরা তাঁকে ময়মনসিংহের বুলবুল নামেও অবিহিত করেছেন। মোহাম্মদ আজিজুল হক চৌধুরী বলেছেন : জালাল উদ্দীন জীবনভর ‘লাউয়া’ দিয়েই প্রেম-বিরহ তত্ত্বমুলক পদাবলী, মুর্শিদী-মারফতী-ভাটিয়ালী গান পরিবেশন করেছেন। তাঁর সুললিত দরাজ কণ্ঠের গানে সুরের এক ইন্দ্রজাল সৃষ্টি হতো। তিনি তাঁর শিষ্য-ভক্ত- অনুরক্তদের কাছে ছিলেন ময়মনসিংহের ‘বুলবুল’।   (জালাল উদ্দীন খাঁ; বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা:৩৫ )

মাজার-আখড়া ঘুরে তত্ত্বজ্ঞানের যে পাঠ তিনি নিয়েছেন সেই পাঠে যুক্ত করেছেন লোকায়ত জীবনধারাস্নাত মাটির সুর। সাধু-সন্ন্যাসী রামকৃষ্ণ গোস্বামীর কাছে যে পাঠ নিয়েছেন সুফিতত্বের ভেতর দিয়ে সেই পাঠকেই নতুন ভাবে আত্মস্থ করেছেন। ময়মনসিংহের এই গানের বুলবুল ‘সুফিতত্ত্ব এবং মুর্শিদীতত্ত্বের পাঠ কোথায়, কীভাবে নিয়েছেন? এই সম্পর্কে জীবনীকার বলেছেন: ‘জালালউদ্দীন খাঁ প্রথম জীবনে কোন পীরের মুরিদ হওয়াকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। তবে জীবনের প্রায় মধ্যাহ্নে এসে বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের আকুবদন্তী গ্রামের বিশিষ্ট আলেম মৌলানা সুফী সৈয়দ আবদুল কুদ্দুছ পীর সাহেবের মুরিদ হন বলে জানা যায়।’ (জালাল উদ্দীন খাঁ; বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা:৪১ )

অনুসন্ধানে জানা যায় জালাল খাঁ প্রথম জীবনে কায়াসাধকদের মতো চন্দ্রসাধনাও (মল-মূত্র-রজ-বীর্জ পান) করেছিলেন। ফকিরি এবং দরবেশি পন্থায় ধ্যানস্থও ছিলেন কিছুদিন। কিন্তু তাঁর মতো লৌকিক মানুষের পক্ষে অলৌকিক তাবিজকবজ দান এবং ‘আমার আমার’ বলে বাহারি কেরামতি দেখানোর কারবার কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই অন্তঃসারশূন্য এই আত্মপ্রতারণার পথ থেকে ফিরে আসেন নিজেকে চেনার অন্তর্সাধনায়। আত্মজীবনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং লোকালয়ের একটা নিখুঁত চিত্রায়ন আছে জালালের গানে।

মনে লয় যা কর খোদা সকলই তোমার
তোমাতে দিয়াছি আমি সব কাজে দুনিয়ার ভার ॥
নামাজ-রোজায় শান্তি দেয় না মনে চাহে ফকিরি
লম্বা চুলে নাচ-গজলে হালকা জিকির হুজুরি,
বহুদিন করিলাম গত, মন রহিল আগের মত,
ভাবনা চিন্তা করে কত চৌদিক দেখি অন্ধকার ॥
দরবেশি পাওয়ার আশে নিলাম পিরের উপদেশ
তসবি টেনে চিল্লা লয়ে শরীর করলাম শেষ,
ছাড়িয়া মুখের রাও, রাইখ্যা সদায় খড়ম পাও
হাতে দশপাঞ্জা দাও, নেওয়া-দেওয়া ইশারায়
জেতা মানুষ গোরে গেলাম মাথায় হইল জটা
গাতের ইন্দুর ভিতরেতে, ক্ষান্ত দেয় না ভুঁই কাটা,
কেবল টাকা পয়সা চায়, একের ঘরে নাহি যায়
ফন্দিবাজি বেলেহাজি মন তালাশে অনিবার ॥
কাপড় থুইয়া কাঁথা পরন, লেংটা হইলাম বাবাজি
চোরের নায়ে সাউধের নিশান ভেকে ভিক্ষার কারসাজি
মন চলে না জঙ্গল বনে, খাবার মজা স্বার্থ টানে,
দর হল না এ জীবনে জরু-জমি আমার আমার ॥
চন্দ্র সাধন করে যখন, চেহারাখান হয় পশর
লোকের কাছে পাওয়া যায় অল্প কিছু ভক্তি আদর,
পত্র ছিঁড়ে তাবিজ দিলে দশে দুই তিন কাজে ফলে
জালাল উদ্দীন দেখে বলে ভিতরেতে নাইরে সার ॥

(দ্বিতীয় খণ্ড, সংসারতত্ত্ব, পৃষ্ঠা : ২০৫)

 

প্রতিদিন লোকালয়ে ঘুরতে থাকা ফকিরি ফন্দিবাজিকে বোধের নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে তিনি শনাক্ত করেছিলেন। বুঝেছেন এইসব ভ্রান্তপথে পরমাত্মাকে পাওয়া যাবে না। আত্মার তাগিদে তিনি তাই প্রকৃত মুর্শিদকে খোঁজেন। মুর্শিদ ভজনা ছাড়া আত্মা ও পরমাত্মাতে সমর্পিত হওয়া যায় না। এই মুর্শিদকেই খুঁজে পেয়েছিলেন চট্টগ্রামে।সৈয়দ আবদুল কুদ্দুছ হাওলাপুরীর কাছে নিজেকে সমর্পন করেছিলেন। এই মুর্শিদের ছবিকে সামনে রেখেই তিনি জগতকে জানার পিপাসা মিটিয়েছেন। গানে গানে জালাল খাঁ তাঁর মুর্শিদের কথা প্রচার করেছেন।

‘খোদা কোথায় কেমনে আছে, জানতে হয় তাই পিরের কাছে
পির বিহনে খোদা মিছে না দেখিলে নয়ন ভরে ।’

 

 

পাঁচ

চট্টগ্রামের আকুবদণ্ডি গ্রামের বিশিষ্ট আলেম মৌলানা সুফী সৈয়দ আবদুল কুদ্দুছ সাহেব নেত্রকোণা-ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে বিশ শতকের প্রথমভাগ থেকে চারের দশক পযন্ত সুফি তরিকায় ইসলাম প্রচার করে গেছেন। ভারতীয় সুফিবাদে চিশতিয়া, কাদেরিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া, নকশবন্দিয়া-এই চারটি মতবাদই প্রধান। এই চারটি ঘরানায় বাংলার সুফিবাদী পীর সম্প্রদায় ইসলাম প্রচার করেছেন। সৈয়দ আবদুল কুদ্দুছ হাওলাপুরী মূলত চিশতিয়া তরিকার খাজা মাঈনউদ্দীন চিশতির অনুসারী। কামেলে মুর্শিদের সন্ধানে এঁরা গান ও জিকির করেন। গরিবে নেওয়াজের উত্তরাধিকার বহন করে জিকির ও মোরাকাবায় মশগুল থাকেন। মারেফাতে ইলাহিতে বিভোর থেকে আল্লার উদ্দেশ্যে প্রেমমূলক কবিতা ও সামা প্রকাশ করেন। এই জিকির ও সামার মাধ্যমে তিনি পূর্বময়মনসিংহে দ্রুত পরিচিত হতে থাকেন। দলে দলে মানুষ দিদার লাভের আশায় পীরের মুরিদ হতে থাকে। পীর সাহেবের সাধনকর্ম সম্পর্কে কবি নূরুল হক বলেছেন, ‘আবদুল কদ্দুস হাওলাপুরী সাহেব এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি যে গ্রামে গিয়েছেন সে গ্রামের মানুষ দলে দলে তাঁর মুরিদ হয়েছে। সন্ধ্যার পর বাড়ির উঠানে হালকা জিকিরের সুরে পুরো গ্রামে একটা মাতম ছড়িয়ে পড়তো। পূর্ববাংলার নিম্নজীবী মুসলিম সমাজে তিনি যথার্থ অর্থেই চৈতন্যদেবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।’ (সাক্ষাৎকার) 

জানা যায়, বিশ শতকের ত্রিশের দশকেই তিনি পীর সাহেবের মুরিদ হয়েছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি হাওলাপুরী সাহেবের তরিকত কর্মকাণ্ডকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। পীরসাহেবের কর্মকাণ্ডকে ব্যঙ্গ ও সন্দেহের চোখে দেখতেন। প্রথম জীবনে তিনি ব্যঙ্গ করে গানও লিখেছেন। জালাল খাঁ এবং পীর সাহেবকে নিয়ে মানুষের মুখে মুখে এখনও নানান উপকথা চালু আছে। পীর সাহেব ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে গ্রামে ভক্তের বাড়িতে ভ্রমণ করতেন। একদিন পীর সাহেবের ঘোড়াটি রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যায়। পীর সাহেব বুঝতে পারেন এটি জালাল খাঁ সাহেবের কাজ। তিনি জালাল খাঁ সাহেবকে ঘোড়াটি ফিরিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু জালাল খাঁ সাহেব ব্যাপারটি অস্বীকার করেন। এতে পীর সাহেব মনক্ষুণ্ণ হন। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই জালাল খাঁর পুত্র আবদুল হেকিম খান অসুস্থ হয়ে পড়েন। দিন দিন তাঁর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। পুত্রের শয্যাশায়ী অবস্থায় উদ্বেগ ও অশান্ত মনে তাঁর একধরণের আত্মোপলব্ধি ও অনুশোচনা তৈরি হলো। তিনি ভাবলেন, পীর সাহেবের সাথে তিনি বেয়াদবি করেছেন। তাই ছেলে আজ শয্যাশায়ী। শোকাতর পিতা ছুটলেন চট্টগামের পীর সাহেবের দরগায়। সেখানেই তিনি গাউসে হাওলার বায়াত গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে ‘গাউসে হাওলার’ তরিকত শিখা গ্রন্থে বলা আছে:

‘হযরত গাওছে হাওলা (রঃ) সাহেব ঘোড়ায় চড়ে ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাফেরা করতেন । শিষ্যদের সাথে দেখা করতেন, খোঁজ খবর নিতেন – কে সুখে আছে, কে দুঃখে আছে । যারা তাঁর কাছে মুরীদ হতে চান তাদেরকে তিনি মুরীদ করতেন। সে সময় জালালের মন ভ্রান্ত ধারণায় হুজুর কেবলার প্রতি ক্ষেপে উঠে । ত্বরিকার প্রতি বিদ্বেষে মন ভরে উঠে, সে তখন হুজুর কেবলার বিরুদ্ধে গান রচনা করে গাইতে থাকে । হযরত গাওছে হাওলা (রঃ) সাহেব এক গ্রামে অবস্থান করছিলেন, জালাল তখন কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে বের হলেন হুজুর কেবলাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে। রাতের বেলা হুজুর কেবলা যে গৃহে আতিথেয়তা বরণ করেন, জালাল সে গৃহের পাশে থেকে অনেক রাত পর্যন্ত ত্বরিকত বিরোধী গান গাইলেন, হুজুর কেবলা তাকে কিছুই বললেন না । শেষে জালাল ও তার সঙ্গীরা হুজুর কেবলার ঘোড়াটি লুকিয়ে ফেলে, সকাল বেলা ঘোড়ার খোঁজ না পেয়ে হুজুর কেবলা জালালকে ডাকালেন এবং ঘোড়া ফেরত দেয়ার জন্য শাসিয়ে দিলেন মহান ওলীর কথা শুনে বাধ্য হয়েই ঘোড়াটি ফেরত দেয়া হলো। উক্ত ঘটনার বেশ কিছু দিন পর জালালের একমাত্র পুত্র আবদুল হেকিমের অসুস্থতা দেখা দিলো অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখানো হলো, হাসপাতালে নেয়া হলো, কিন্তু কোন ফল হয়নি। পরিশেষে জালালের বিবেকে এসে ঠেকলো হুজুর কেবলার ঘোড়া চুরির ঘটনাটি, জালালের বিবেকে বারবার এ ঘটনা তীব্রভাবে আঘাত করতে লাগলো। প্রতি মুহূর্ত তাকে বিচলিত করে তুলল। বিবেক বলতে লাগলো – এ ফকির-এর ঘোড়া চুরি ঠিক হয়নি। আর কি থাকা যায় ? এক দিকে ছেলের জীবন, অপর দিকে মহাভুল । ভুল না শুধরালে ছেলের কি আশা আছে?

জালাল ছুটে চললো-সেই হুজুর কেবলার কাছে, চট্টগ্রামের আকুবদন্ডীতে । মহান আওলীয়ার পায় ধরে বারবার চাইলেন ক্ষমা। হযরতের মনে এতটুকুও ব্যথা রাখলেন না। জালাল ক্ষমা পেলো, হাত ধরে বাইয়াত গ্রহণ করলো। অশ্রু সজল চোখে ছেলের সুস্থতার জন্য ফরিয়াদ করলো। হুজুর কেবলা বললেন-” যান ! ছেলের চিন্তা করবেন না, এখানে থাকেন কিছুদিন”। জালাল হুজুর কেবলার কাছে কদিন থেকে বাড়ী এসে দেখতে পেলেন, সুস্থ ছেলের খুশী ভরা প্রাণ, দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকার হাসি। ঠিক সেই থেকে জালালের মনে এলো বিরাট পরিবর্তন। হুজুর কেবলার ত্বরিকার প্রতি হৃদয়ে ডাকলো ভক্তির তুফান । বাউল জালাল তখন থেকেই রচনা করতে লাগলেন, শত শত মুর্শিদী-মা’রেফাতী-গীত-গান। তাঁর রচিত জালাল গীতিকা’য় রয়েছে ।

“আমার গাওছে হাওলাই
দ্বীন ইসলামের ফুল।
তাঁর ত্বরিকা ধর সবে
নিগুম কথার পাবে মূল ।
তাঁর হাতে মুরীদ হয়ে নামের মালা গলে লয়ে
জপ গিয়ে একলা বসে প্রেমে হয়ে মশগুল ॥ ”

অগণিত মানুষের ভিড়ে ভিড়ে তিনি এই গান গেয়ে বেড়াতে লাগলেন। জালাল সত্যি তার মুর্শিদের প্রেমে আত্মহারা হয়েছিলেন। মুর্শিদকে মনপ্রাণ সপে দেয়ার প্রমাণ-তার গীতেই রয়েছে । এমন দু’টি লাইন-

“জালাল উদ্দীন তহবিলহারা পুঁজি নিল চুরে,
সেই তালাশে পাগল বেশে গিয়াছে হাওলাপুরে।
(মুর্শিদের বাজারে)।”

“বাউলদের সাধন প্রকরণে গুরুবাদ ও মানবানুরাগের চিত্র সুস্পষ্ট। মানুষকে জানার সাধনায় বাউলের অন্তহীন আন্তরিকতার সুর তার গানে ফুটে উঠে। গুরুভক্তি ও মানব প্রেমের সুর জালালের সৃষ্টিতে ও বিচিত্র ব্যঞ্জনায় চিত্রিত হয়েছে।”

“কোরআন পড়, তৌহীদ কর, চরণ ধর মুর্শিদের
মিছামিছি মূল্য দিনে বাক্স ভরা কেতাবের,
কেতাব তোমার কালির লেখা, চক্ষু বিনে যায় না দেখা
অন্ধ হইয়া রইলে একা, মানুষ থুইয়া পীড়িতের।”

জালাল তার আধ্যাত্ম পথের গুরু হিসেবে গাওছে হাওলা (রঃ)কে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রচিত “বিশ্ব-রহস্য” ও “জালাল গীতিকা” তৃতীয় ভাগ হুজুর কেবলার নামেই উৎসর্গ করেছেন । জালাল আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার মুর্শিদী-মারফতী সংগীত চিরদিন প্রেমিকজনের কণ্ঠে কণ্ঠে মালিকা হয়ে থাকবে।’


ভাবজগতের সকল অধ্যায়ে মাখামাখি হয়ে জালাল খাঁ তাঁর বাউলফকিরীতত্ত্বকে প্রকাশ করে গেছেন। জগতের পথে যে মনকে তিনি তালাশ করে গেছেন, সেই মনকেই প্রকাশ করেছেন।


বায়াত গ্রহণের সাথে সাথে জালাল খাঁর গান ও সাধনতত্ত্বে নতুন অধ্যায় শুরু হয়। নতুন চোখে শুরু হয় জালালের ভাবজ্ঞান ও আত্মজিজ্ঞার পথ। পীর সাহেব যেমন তাঁর প্রাণের মুর্শিদ ছিলেন তেমনি জালাল খাঁকেও পীর সাহেবও ভক্তের অধীন হয়েই থেকেছেন। জালাল খাঁর বাড়িতে তিনি নিয়মিত অতিথি হতেন। জালাল খাঁ সাহেবের গোলঘরে গান ও জিকিরের মাধ্যমে ‘ফানা’ এবং ‘ফানা ফিল্লাহ’য় উত্তীর্ণ হতেন। ড. আহমদ শরীফ বলেছেন:

‘পীরের খানকা, বা আখড়ায় সামা [গান] হালকা [ভাবাবেগে নর্তন], দারা (আল্লাহর নাম কীর্তনের আসর) হাল মূর্ছা), সাকী, ইশক প্রভৃতি চিশতিয়া খান্দানের সূফীদের সাধনায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতির আমল থেকেই। পরবর্তী কালে নিজামিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়েও গৃহীত হয় এই রীতি। গৌড়ীয় বৈষ্ণবসাধনায় রয়েছে এরই অনুসৃতি।’ (বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য: পৃষ্ঠা-৩৮৭)

সুফিতত্ত্বের এই বিশুদ্ধ জিকিরে মগ্ন হয়ে দিদার লাভ করা যায়। সুফিচর্চা মাত্রই পীর-মুর্শিদে নিজেকে সমর্পণ করা। সাধনায় গুরুর প্রতি আনুগত্য লাভের মাধ্যমেই সিদ্ধিতে উপনীত হওয়া যায়। ড. আহমদ শরীফ এ সম্পর্কে স্পষ্ট বলেছেন:

‘আল্লাহর ধ্যানের প্রাথমিক অনুশীলন হিসেবে পীরের চেহারা ধ্যান করা শুরু করেন সূফীরা। শুরুতে বিলীন হওয়ার অবস্থায় উন্নীত হলেই শিষ্য যোগ্য হয় আল্লাহতে বিলীন হওয়া সাধনায়। প্রথম অবস্থার নাম ফানা ‘ফিশশেখ’, দ্বিতীয় স্তরের নাম “ফানা ফিল্লাহ’। প্রথমটি ‘রাবিতা’ [গুরুসংযোগ] দ্বিতীয়টি ‘মুরাকিবাহ্’ [আল্লাহর ধ্যান] এই ‘মুরাকিবাহ’য় গৃহীত হয়েছে যৌগিক পদ্ধতি।’ (বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য: পৃষ্ঠা-৩৮৭)

পূর্বময়মনসিংহের মাটিতে হাওলাপুরীর তরিকত চর্চায় সংযোজিত হয়েছিল জালাল খাঁর জান। আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন গাউসে হাওলার ভক্তগণ জিকিরে জিকিরে সুরে সুরে জালালের গান গেয়েছেন। হালকা জিকিরের তালে তালে ভক্তবৃন্দ জালালী সুরের মাধ্যমে নিজেদের ভক্তি সমর্পণ করেছেন। শুধু শবে-বরাত আর শবে-কদরের রাতে নয় সাপ্তাহে সাপ্তাহে পীরের নির্ধারিত বারে এর আয়োজন হতে থাকে। জালালের গান ও পংক্তির তালে তালে মানুষ মশগুল হয়ে গেছে।গোলাম ফারুক খানের জবানিতে জানতে পারি:

আমাদের বাড়িতে যখন গভীর রাতে হালকা-জিকির অনুষ্ঠিত হতো তখন ভাবমগ্ন ফকিরদের আত্মহারা অবস্থা দেখে অবাক হতাম। অনেক ফকির নেচে নেচে জিকির করতে করতে কয়েক মাইল দূরে চলে যেতেন। বিশেষ করে একজনের কথা মনে পড়ে যাঁর নাম ছিল শরিয়ত শাহ ফকির। হালকা শুরুর কিছুক্ষণ পরেই তিনি অদৃশ্য হয়ে যেতেন। অনেক পরে এসে কেউ হয়তো খবর দিত যে, তাঁকে দু-তিন মাইল দূরে কোনো নদীর তীরে কিংবা বনের কিনারে একা একা জিকির করতে দেখা গেছে। শেষরাতে শরিয়ত শাহ ঠিকই ফিরে এসে মূল অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। সম্ভবত এইসব ভাবোন্মাদ ফকিরের কথা ভেবেই জালাল উদ্দীন খাঁ লিখেছিলেন তাঁর একটি বিখ্যাত গান:

‘ভাবের তরঙ্গে, আস আমার সঙ্গে
যদি কারো ভালো লাগে।।
ভাবের কথা কইতে গেলে না আছে তার শেষ
পুত্রকন্যার মাঝে থাক হইয়া নিরুদ্দেশ,
ছাড়িয়ে সন্ন্যাসীর বেশ, মাতাল বৈতাল সাজ আগে।।…
যে বোঝে না ভাবের মরম, তার কপালে ছালি
ঠাঁই চিনিয়া না মাখিলে কাজল হয় যে কালি,
জালাল কয় মোর গুদাম খালি, ভাঙ্গা ঘরে শিয়াল জাগে।।’ (পরশমণি জ্বলে, বিডি আটর্স, ৩১ জুলাই,২০২২ )

 

ছয়

বাংলার ভাবজগতে দু’ধরনের বাউলফকির আছে । একদল আছেন ধ্যান ও দেহচর্চার মাধ্যমে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছান। আরেকদল আছেন যারা সাধনায় অর্জিত জ্ঞানকে গানে গানে লেখেন, গানে গানে প্রচার করেন। তত্ত্বচর্চা এবং আত্মাণ্বেষণের মাধ্যমে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নানান জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি ঘটান। আত্মতত্ত্ব-পরমতত্ত্ব-নিগূঢ়তত্ত্ব-দেহতত্ত্ব-সৃষ্টিতত্ত্ব-সাধনতত্ত্ব-সংসারতত্ত্ব-প্রেমতত্ত্ব-মাতৃত্বতত্ত্ব -লোকতত্ত্ব-গুরুতত্ত্ব-প্রেমতত্ত্বের ধারণা ও স্তরকে আলাদা করে বুঝে নেন। জীবনের উৎস ও গন্তব্য সম্পর্কে তাঁরা জ্ঞাত। দেহের ভেতর-বাহির, নাড়ি ও নিঃশ্বাসের খেলা তাঁরা চর্চার মাধ্যমে অধিকার করেন। বাউল-ফকির চর্চা মূলত গোষ্ঠীগত জ্ঞান ও সাধনা। শিষ্যের কাছে গুরু কিংবা মুর্শিদ আস্তে আস্তে ভাব ও সাধন জগতের গূঢ়ার্থকে বুঝিয়ে দেন। সাধন পথে এঁদের আছে বিভিন্ন ভাব ও শব্দের জগৎ। ভাবজগতের সকল অধ্যায়ে মাখামাখি হয়ে জালাল খাঁ তাঁর বাউলফকিরীতত্ত্বকে প্রকাশ করে গেছেন। জগতের পথে যে মনকে তিনি তালাশ করে গেছেন, সেই মনকেই প্রকাশ করেছেন। মনের তালাশে তিনি যেমন বৈষ্ণব ঐতিহ্যের ধারক হবিগঞ্জের বিতলং আখড়ায় রামকৃষ্ণ সাধুর সান্নিধ্যে গিয়েছেন তেমনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার আকুবদণ্ডীর পীর সাহেব আব্দুল কদ্দুস হাওলাপুরীর শিষ্যত্বও গ্রহণ করেছেন। জালালের জিজ্ঞাসামণ্ডিত গানে দুই ধারার মিলন ঘটেছে।



টীকা:

 

কেহ করে বেচাকেনা কেহ কান্দে রাস্তায় পড়ে
ধরবি যদি তারে চলো মুর্শিদের বাজারে

ফুলের বনে আছে কাঁটা মনের ঘরে চাবি আটা
ভাঙতে হবে ঘরের চাবি খুঁজবি যদি তারে
কাঁটার ঘায়ে অঙ্গ রে তোর হয় যদি জরজর
কাঁদিস না আর বসে বসে পথের ধারে

মুর্শিদের-ই নামটি ধরো নিজের ঈমান ওজন করো
বিসমিল্লাহকে চাপা রাখো হৃৎপিণ্ডের ভিতরে
দুই চোখের পানি দিয়া যায় কি পাওয়া তারে
সাথে থাকলে মন মহাজন কিনা হইতে পারে।

উপরের গানটি ‘অবাঞ্ছিত’ সিনেমায় ‘পাগলা বাবার ওরসে’র দৃশ্যে আব্দুল আলীম গেয়েছেন। সিনেমায় বলা হয়েছে গানের গীতিকার অজ্ঞাত। কিন্তু এই গানটি জালাল খাঁ সাহেবের বহুল প্রচলিত একটি গান। গানের মুখটা ঠিক রেখে বাকি অংশটা সিনেমার গায়ক আব্দুল আলীম পাল্টে দিয়েছেন। অবশ্য গানের ছন্দ, সুর ও শব্দচয়ন দেখলেও বুঝা যায় এই গানের বাকি পক্তিগুলোও জালালের রত্নভাণ্ডার থেকেই গৃহীত। বাংলা ভাব ও ভাবুকতায় গানের দার্শনিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে গায়েনের কণ্ঠেও একেকটা গান রিমেকিং হতে থাকে। নিচে জালাল খাঁ রচিত গানটি উদ্বৃত করছি। স্পষ্ট বোঝা যায় এই গানটিও তাঁর পীর-গুরু সাহেব গাউসে হাওলাকে নিবেদিত।

দয়াল মুর্শিদের বাজারে
কেউ করিছে বেচাকেনা, কেহ কাঁদে রাস্তায় পড়ে ।
লা, শব্দে পাল্লা ধর, “এলাহা”-কে ওজন কর
“ইল্লাল্লা” চাপা রাখ, হৃৎপিণ্ডের ভিতরে
ইমান পাথরের ডাণ্ডি, নামাইওনা তারে
ওজনেতে মিল হইলে, মহাজনে খরিদ করে ॥
পঞ্চরশি পাল্লায় আঁটা, করিও না ডাণ্ডি কাটা
মাইর খাইবে প্রাণ হারাবে, নিবে নিলাম করে,
বেহুশের বন্দেগি নাই এই ভবপুরে
আল্লা-রছুল প্রেমে বাঁধা, মুর্শিদের পেশানি পরে ॥
বাজারে শক্ত বিচার, শোন রে ভাই সব দোকানদার
কর যদি ব্যভিচার, যাবে আইনের ঘরে,
জালালউদ্দীন তহবিল মারা পুঁজি নিল চোরে—
সেই তালাশে পাগল বেশে, গিয়েছে হাওলাপুরে ॥

 

হালকা জিকির এবং পীর-গুরু গাউসে হাওলা বিষয়ক কয়েকটি গান:

 

এক.

জিন-ফেরেশ্তা হুর ইনছান সবাই চাহে তোমার কোল
দুজাহানের বাদশা তুমি ওগো মোহাম্মদ রসুল ॥
তুমি এসে দেখা দিয়া ওলি উল্লা যাও বানাইয়া
আপন ছুরত বদলাইয়া ফোট নানা রঙ্গের ফুল ॥
বোখারা বলখ মুলতান মদিনা আর খোরাসান
বাগদাদে আউলিয়া দেওয়ান তুমিই যে সকলের মূল ॥
আল্লা নামে যারে কয় আরও কত নাম তার হয়
মানুষেতে নেয় পরিচয় মানুষে করে গণ্ডগোল ॥
যে যাহারে জানবে খাঁটি তারেই গিয়া ধর আঁটি
লেখা দেখে পরিপাটি কোনও দিন করিসনে ভুল ॥

(দ্বিতীয় খণ্ড, লোকতত্ত্ব)

 

দুই.

কোরান দেইখ্যা আল্লা চিনে নামাজ-রোজা গেল করে
দেখছি না কেউর দরগা হইতে মৌলবিদের কব্বরে ॥
গুণ্ডা যত গুৰ্দাবাজ ফেলে দিয়া তখত তাজ
ফকিরি পাগলের সাজ লইয়া জংলায় বসত করে ॥
শরিয়তের ভয় নাহি রাখে, মল-মূত্র গায়েতে মাখে,
গোনার বাইরে পড়ে থাকে উলটা কর্ম জনম ভরে ॥
এদেরই অন্তরে ফয়েজ বিচার নাহি উম্মি হাফেজ
পাইতে পারে সেই মহাতেজ মানুষের দয়া হলে পরে ॥
খোদা কোথায় কেমনে আছে, জানতে হয় তাই পিরের কাছে
পির বিহনে খোদা মিছে না দেখিলে নয়ন ভরে ॥
জালাল উদ্দীন মানুষের কাছে শান্তি দয়া চাহিতেছে
ভাগ্যে জানি কিবা আছে রহিল যে আশার ঘরে ॥

(দ্বিতীয় খণ্ড, লোকতত্ত্ব)

 

তিন.

আত্মায়ে রসুল হিন্দে কাওয়াল গৌসল আজম সাঞ্জারি
সোনার মানুষ মইন উদ্দীন স্নেহ-দয়ার ভাণ্ডারী ॥
আলা নূর নূরি অংশে হাসান ও হুসেন বংশে
উম্বুলওয়ারা গিয়াস উদ্দিন মাতাপিতা তোমারই ॥
বান্ধিয়া যাদুর পাথর শুকাইলা আনা সাগর
স্বপ্নযোগে পেয়ে খবর, করলা ইসলাম দীন জারি ॥
নাসির উদ্দিন চেরাগ দিল্লি, ফকর উদ্দিন ফানাফিল্লি
কদমে খাদেম ওলি চিশতি পিরান গৰ্দ্দেজি ॥
শিবলির চেলা মনসুর হাল্লাজ, শরিয়তে হয়ে নারাজ
জীবন্ত রয়েছেন শুয়ে কাছে জুনেদ বাগদাদী ॥
হাজি শরিফ জিন্দাগি, ওহদ উদ্দিন কিরমানি
চুমি কদম ইব্রাম আদাম বুরহান উদ্দীন চিশতারি ॥
মিরা হুসেন মামুদ আসান দরগায়ে তাগান তুগান
চার ইয়ারি মরা জিন্দান, শামছ উদ্দিন মাজ্বারি ॥
সালাম-দরূদ পাকরূহানে ফয়েজ দিদার চাহে প্রাণে
জালাল উদ্দীন এ জীবনে আছে দয়ার ভিখারি ॥

(দ্বিতীয় খণ্ড, লোকতত্ত্ব)

 

চার.

দেখলে ছবি পাগল হবি ঘরে রইতে পারবি না,
এই চৌদ্দ ভুবনে আমার মুর্শিদ মৌলানা ॥
মোহন মুরতি বাবার, দেখলে পরে ঘোচে আঁধার
আরশ কুরসি সাগর পাহাড় দেখবার বাকি থাকে না ॥
যিশু দেখে খৃষ্টানেরা ভাবে জিন-দেব জৈনেরা,
হিন্দু ভাবে মদনমোহন শ্রীনন্দের কেলে সোনা ॥
এক ভাবে রাখিলে প্রাণ, পানি হয়ে যায় পাষাণ,
নূরেরই তজল্লি-শান করিয়া দেয় দিল ফানা ॥
বাহিরেতে পিরের ছবি, ভিতরে সেই নূরের নবী
ধ্যানের দেশে আল্লা হবি জালাল কহে ডুবে দেখনা ॥

(দ্বিতীয় খণ্ড, গুরুতত্ত্ব)

 

পাঁচ.

হালকা-জিকির কর রে আশেক যত মুসলমান
শুনিস না কার নিষেধ মানা মানিস না যে কথা আর
আল্লা নামের পাল্লায় তোল সকলেরই দিল-ঈমান ॥
মুদারা সব জিন্দা হয়ে আশেকের লয় সন্ধান
ইচ্ছা বশে তাই তো আসে ওলি উল্লাহর গোরস্থান
নৃত্য করে ধুলায় পড়ে গাহে কতই গুণগান ॥
ভক্তি গুণে শক্তি আসে মন যদি কার মুগ্ধ হয়
উস্তাদে সাগরিদে হবে শুদ্ধ প্রেমের পরিচয়
রইবে না দোজখের ভয় মাশুক নিয়াই পেরেশান ॥
সাত সমুদ্দুর তের নদী নাচতে নাচতে হবি পার
জালাল চাহে দয়া তোমার গাউসুল আজম শা সুলতান ॥

 



সরোজ মোস্তফা

কবি ও গদ্যশিল্পী

গারো পাহাড়ের নদী মগড়ার তীরে ছোট শহর নেত্রকোণায় জন্ম, ১৯৭৬ সালে। কর্ম ও পৈত্রিক পরিচয়ে এই ক্ষীণস্রোতার পাশাপাশি স্বচ্ছ বসবাস। পেশায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। হাওরাঞ্চলের ভাবুকতা, ধ্যান ও জনসংস্কৃতিকে তিনি যাপন করেন। লিখেন।

‘সকাল সন্ধ্যার বীজতলা’, ‘কাগজে সমুদ্র লিখি’, ‘লাল রক্তের ব্রহ্মাংশ’, ‘হলুদ খামের হিমঘর’ ‘সুরমা নদীর দস্তখত’ কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। ‘যতীন সরকারের মাস্টারি’, ‘গৌরাঙ্গ আদিত্যের জীবন ও সাধনা’, ‘বিপ্লব চক্রবর্তী : গায়েনের সংগীতযাপন’ তার প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ।

শেয়ার