বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের অর্থাৎ ডোবা এলাকাগুলোর কৃষাণদের দেখেছি, তারা পুরো বর্ষাকালটা অপেক্ষায় কাটিয়ে দেয়। এখান থেকেই হয়েছে গালগপ্প, পুঁথিপাঠ, জাল বোনা, শিকার কাজ। অর্থাৎ সৃজনশীলতার একটা তৃপ্তিকর মৌসুম।
আমার মধ্যে প্রবল বর্ষণের যত স্মৃতি আছে এ সবই গ্রামাঞ্চলের। শহরে দীর্ঘ জীবন কাটালেও বর্ষণের সমস্ত আবেগ আমাকে নিয়ে যায় কোনো উপচে পড়া নদীর কিনারে। টিনের চালায় বর্ষণের অবিরাম শব্দ আমাকে আর ঘুমুতে দেয় না। বৃষ্টি কখনো নিঃসঙ্গভাবে আসে না; কাউকে নিয়ে আসে। কোনো উন্মুখ চেহারা জানালায় এসে দাঁড়ায়। দেখি আর কেশ সিক্ত করে নেমে যাচ্ছে বর্ষা সেতু। সে শুধু প্রবেশের অনুমতি চায়। অথচ মুখে কিছুই বলছে না। আমি উঠে গিয়ে দ্রুত হাতে কপাটের খিল খুলে দিলে সে নিঃশব্দে সিক্ত শরীরে ঘরে এসে একটা শুকনো কাপড় দাবি করে। আমি তার জন্য বিছানার চাদর তুলে দেওয়া ছাড়া আর শুকনো কিছু খুঁজে পাই না। এখানে সবই ভেজা। প্রতিটি শক্ত জিনিস এখানে কাদা হয়ে গেছে। আমি আমার শ্রবণেন্দ্রিয় তো আর কানে আঙুল দিয়ে প্রতিরুদ্ধ করতে পারি না। শুধু শুনতে পাই আঁটি ফাটিয়ে উদ্গমের শব্দ। শুধু মিলিত হওয়ার, যুক্ত হওয়ার কিংবা বলা যায় দ্রুত নিঃসরণের শব্দে আমি যেন জাদুমন্ত্রবলে জলের কিংবা বলা যায় স্রোতের আজ্ঞাবাহী হয়ে উঠি।
যে প্রবেশ করেছে, সে তো কোন দাবী তুলছে না। হাত বাড়িয়ে বলছে না যে এটা তার দরকার। বরং আমাকে বুঝে নিতে হচ্ছে কেন সে এসেছে।
বর্ষণের শব্দে সে সব কিছুর জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছে। অথচ আমি কবি, আমার কোন প্রস্তুতি নেই। জলের নির্দেশ আমি বুঝি। বৃষ্টির গুঞ্জন আমাকে শিখিয়ে দিচ্ছে নিঃসরণের রন্ধ্রপথ কোন দিকে। বর্ষণের ঋতু প্রকৃতপক্ষে কোনো বাণী নিয়ে আসে না। কেবল যুক্ত হওয়ার, নিঃসরণের এবং অঙ্করোদগমের একটা অদৃশ্য নিয়মের কথা কবিকে বলে যায়।
যারা এই দেশে জন্মেছেন, কবিতার কাছে আত্মসমর্পিত, তাদের কিন্তু এই ঋতুটি না হলে চলে না। সৃষ্টি মানেই হলো বৃষ্টি। মনে হয় যেন সমস্ত ঋতুর রাজা হলো প্রবল বর্ষণের ঋতু।
বর্ষা কোনো তত্ত্বকথা মানে না। এর সবটাই শুধু জলস্রোত নয়, শুধু নিঃসরণ ও নির্গমন নয়। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে হিংস্রতা। সাপের মুখে ব্যাঙের কাতর চিৎকার কেউ দেখছে না, কিন্তু একজন আরেকজনকে, এক প্রাণ অন্য প্রাণকে গ্রাস করে বেঁচে থাকতে চাইছে। পানির ভেতর এত খেলা, এত অবিশ্বাস্য আকুলতা! একই সঙ্গে প্রেম ও সংহাররীতি আর কোনো ঋতুতেই ঘটে না। এসব বোঝার জন্য যে কবিত্বের দরকার, তা এতটাই নিরাসক্ত যে, ঘড়ির মতো দুই চোখ মেলে কবিকে কেবল তাকিয়ে থাকতে হয়। কোনো পক্ষপাত নয়, কোনো উদ্যমে উত্তেজিত হলে এই বর্ষণ কবিকে কিছুই দেয় না, এই ঋতু যেন কানে কানে বলে সমস্ত উদ্যম ত্যাগ করো, সমস্ত উৎসাহ ভাসিয়ে দাও, শুধু রচনা করো পঙতি, যা নিরপেক্ষ।
এক বর্ষা শত বর্ষার স্মৃতিকে উন্মোচিত করে, আলোড়িত করে, বিলোড়িত করে। যারা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের পানির বড় প্রয়োজন। শক্ত পাথর হয়ে থাকা প্রকৃতিকে নমনীয় করতে হলে এমন কিছু উপাদান প্রকৃতির কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়, যা দাঁড়িয়ে থাকার সমস্ত প্রতিজ্ঞাই একটু নুইয়ে দেয়। বর্ষণ হলো অসম্মতকে রাজী করানো বা সম্মতিতে সিক্ত করানোর ঋতু। বৃষ্টি যে সৃজনশীলতার দৈবাদেশ মাত্র তা কবি ছাড়া সম্ভবত আর কেউই ব্যাখ্যা করতে পারে না।
কেউ কেউ বলেন, বর্ষণ ঋতু ভোঁতা করে দেয়। কথাটার মধ্যে খানিকটা সত্য আছে বৈকি। মানুষের জীবীকার যত কৌশল আছে, মানুষের রাজনীতির যত তীক্ষ্নতা আছে সবই বৃষ্টির কাছে পরাভব মেনে শিথিল হয়ে যায়। তারা প্রকাশ্যেই বলে, আজ থাক, কাল দেখা যাবে। তারা বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেই টিনের চালায় বৃষ্টির হাসি শুনতে পায়। বৃষ্টির মূল কথা হলো, আজ শুয়ে থাকো। কাল আবার অন্যরকম কিছু করতে চাইলে উঠে দাঁড়িও। আজ আমি যে তোমাকে শুইয়ে রেখেছি, উদ্যমহীনতার এবং কল্পনার ভেজা কাঁথার ভেতর ওম দিয়ে। তুমি তো স্বপ্ন দেখতে না অথচ স্বপ্ন না দেখলে তুমি কিসের মানুষ। আমি তোমাকে বৃষ্টির শব্দে স্বপ্নের ভেতর ভিজিয়ে রাখব।
আমি শুধু মানুষকেই স্বপ্ন দেখাই না। প্রতিটি প্রাণী, পাখি-পতঙ্গ, যাদের পরমায়ু আছে, তাদেরই স্বপ্নের কাদায় কিছুক্ষণ ঘুম পাড়িয়ে রাখি।
বৃষ্টি ছাড়া কোনো সৃষ্টিই নেই। বৃষ্টিও নেই। দেখতে পাচ্ছ না, যে কৃষাণটি জমির ভেতর একের পর এক ধানের চারা রোপন করে এগিয়ে চলেছে, তার স্বপ্ন হলো সোনার ধান।
কেউ কেউ ভাবেন বর্ষা এক বাধাস্বরূপ। কিন্তু এদেশের কবিরা সবসময় বলে এসেছেন বর্ষণ হলো অপেক্ষার ঋতু। কার জন্য অপেক্ষা? চির আকাঙ্ক্ষিত একটি দেহের আকর্ষিক আগমণের অপেক্ষা। তুমি চেয়েছিলে, তাই আমি এসেছি। আবার একই সঙ্গে তুমি চাওনি বলে আমি এসেছি। নাও আমাকে। আমার মধ্যে সঞ্চায়িত করো তোমার বীজ। আমি তোমার চেয়ে গতিময় এক প্রাণের সৃষ্টি করব আমার উদরে। বৃষ্টি না হলে তো আমার আগমণ হতো না। সৃষ্টির মূল কথাই হলো বৃষ্টি। স্রোত, নিঃসরণ এই মূলমন্ত্র জানা না থাকলে মানুষ উদ্যমের অর্থ খুঁজে পেত না। এজন্যই পৃথিবীর বৃষ্টিহীন অঞ্চলেও কোনো একটা সময় প্রবল বর্ষণ পাথরকেও ভিজিয়ে দেয়। প্রাণী মাত্রই বৃষ্টি দরকার।
বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের অর্থাৎ ডোবা এলাকাগুলোর কৃষাণদের দেখেছি, তারা পুরো বর্ষাকালটা অপেক্ষায় কাটিয়ে দেয়। এখান থেকেই হয়েছে গালগপ্প, পুঁথিপাঠ, জাল বোনা, শিকার কাজ। অর্থাৎ সৃজনশীলতার একটা তৃপ্তিকর মৌসুম।
এভাবেই সম্ভবত বাংলাদেশে বর্ষাকে সৃজন মৌসুম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কারণ যারা বপন করে, শস্যের সনাতন রীতিকে মান্য করে, তাদের জন্য এই বর্ষা ঋতু নানা উদ্ভাবনা ঘটায়। তারা এটাকে অবসর অবশ্যই বলে না। বলে বর্ষাযাপন। এই বর্ষাযাপনের মধ্যে রয়েছে আনন্দের গুঞ্জন।
আমি দেখেছি এই ঋতুতে মাছের ব্যাপক আনাগোনা। এমন সব মাছের নাম আমাদের শৈশবে গ্রামাঞ্চলে উচ্চারিত হতো, তা আজ আর হয়ত হয় না। একটা মাছের নাম এখনও আমি স্মরণ করতে পারি, কবিতাতেও লিখেছি। মাছটির নাম নীল বৈছা। এই বর্ষা ঋতুতে এই মাছটিকে এমনভাবে সময়োপযোগীকে সজ্জিত করে প্রবল স্রোতের মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হতো যে কখনো দৈবাৎ তার সাক্ষাৎ পেলে প্রিয়তমা নারীর চোখের সঙ্গে এর মিল খুঁজে পেতাম আমি। জানি না, এখন একালে এ মাছটির আর অস্তিত্ব আছে কি না। হয়তো আছে, কিন্তু প্রকৃতির কাছে দেখার মতো চোখ তো আমার নেই। তবে আমার স্মৃতির মধ্যে, আমার সৃজনশীলতার মধ্যে, আমার সহমর্মিতার মধ্যে আমি আমার সব কিছু ধরে রেখেছি। কেন জানি মনে হয়, আমি যখন থাকব না, প্রবল বর্ষণ ঋতুর এক অফুরন্ত ইতিহাস আমার সঙ্গে লুপ্ত হয়ে যাবে, এ জন্যই কি কবিকে কালের সাক্ষী বলা হয়?
বৃষ্টি আমাকে বিমর্ষ না হতে শিখিয়েছে, পরাজিত না হতে পরামর্শ দিয়েছে। আমি অপরাজিতদের মধ্যে চুপচাপ বসে আছি।
বর্ষা ঋতু মানবিক আত্মীয়তা বৃদ্ধি করে। কাছের মানুষকে, যারা এখন আর আমার কাছে নেই, তাদের প্রতি আকুলতা জাগিয়ে তোলে। কত ভাই-বোন ছিল আমার। একসঙ্গে বড় হয়েছি। কেউ খ্যাতি, কেউ অখ্যাতি অর্জন করে পৃথিবীর কত অজ্ঞাত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। বর্ষাকালে তাদের কথা খুব মনে পড়ে। সবচেয়ে দুষ্ট ছিল যে মেয়েটি, তার চেহারা ফিরে ফিরে আসে। কারণ, আমরা একই মায়ের উদর থেকে নির্গত হয়ে পৃথিবীতে বেঁচে আছি। অথচ প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ ঘটে না বছরের পর বছর। বর্ষা ঋতুতে তাকেই কেন মনে পড়ে?
সবসময় ভাবি, আমি কোনো এক বর্ষায় এক দীর্ঘ ছন্দময় কবিতা রচনা করব। কবিতাটি হবে কাহিনীর মতো, প্রেমের দীর্ঘশ্বাসের মতো। কিংবা থাকবে কামের উদগ্র প্ররোচনায় ছন্দময়। প্রতি বর্ষা ঋতুতেই এই উদ্যম নিয়ে বেঁচে থাকি। বর্ষা শুরু হলে কবিতার বদলে অন্য কোনো সংক্রমণ আমার সৃজনশীলতাকে অক্টোপাসের মতো বেঁধে ফেলে। এক কাজ করতে গিয়ে অন্য কাজ করে ফেলি। এক বিষয় লিখতে গিয়ে অন্য উদ্ভাবনায় বাংলা ভাষাকে মাতিয়ে তুলি। যা চাই তা হয় না, যা কল্পনাও করিনি, তা হয়ে যায়। ভাবি বৃষ্টি না হলে কিছুই হতো না। বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে বর্ষা ঋতুকে গালমন্দ করি। কিন্তু এই মন্দ বলার মধ্যে বৃষ্টি আমার ভাগ্যকে বদলে দেয়। আমি অন্য উদ্ভাবনায় মত্ত হয়ে যাই। আমার নিকটবর্তী সবাই আমাকে এগিয়ে এসে বলে, আরে, তুমি এসব কি করছ? তুমি তো সমস্ত রীতির বিরুদ্ধে নতুন কথা শুরু করেছ। এ তো এক ধরনের বেয়াদবি। বৃষ্টি তোমাকে পাগল করে দিয়েছে। বৃষ্টি থামলে দেখি আমার পাগলামির পরাক্রম শুরু হয়েছে।
বৃষ্টি কেবল প্রথাবদ্ধ খ্যাতির বিপরীত বিষয়কে উত্থাপন করে। বৃষ্টির হাতে কোনো দাড়িপাল্লা নেই। সে কাউকে প্রথম বলে ঘোষণা করে না। যে প্রথম হওয়ার যোগ্য বারবার বৃষ্টি তাকে উত্থাপন করে। প্রথা তাকে যতই নাকচ করুক, বৃষ্টি কখনো ভুল করে না। বৃষ্টি নকলের রঙ চটিয়ে দেয়। বৃষ্টি বলে না, কে আগে কে পরে। কিন্তু বৃষ্টি নকল রঙ ধুয়ে আসল বের করে আনে বলে সবাই বৃষ্টিকে গালমন্দ করে। বৃষ্টির কাজ বৃষ্টি করে। আর সৃষ্টিশীল মানুষ যিনি উদ্গাতা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তার উপাসনায় অবনত।
সব কিছুরই শেষ পর্যন্ত একটা পরিসমাপ্তি আছে। যেহেতু আমি প্রাণ ধারণ করি, সে জন্য আমার প্রাণশক্তির নির্বাপণেও আমি সমানভাবে বিশ্বাসী। বৃষ্টি আমাকে বিমর্ষ না হতে শিখিয়েছে, পরাজিত না হতে পরামর্শ দিয়েছে। আমি অপরাজিতদের মধ্যে চুপচাপ বসে আছি। কেন বসে আছি? আমি জানি আমি যখন থাকব না, আমার ব্যক্তি প্রভাব যখন থাকবে না, তখন কোনো এক ভবিষ্যৎ বর্ষণ ঋতুতে কেউ আমার ফেলে যাওয়া কিংবা বলা যায় জমিয়ে যাওয়া সোনার ধান ভেনে নিজের ক্ষুৎপিপাসা পরিতৃপ্ত করবে। আমার কথা এমনভাবে বলবে যা আমি পৃথিবীর কোথাও না থাকলেও অন্য এক পৃথিবী থেকে, অদৃশ্যের কোনো এক বন্দর থেকে নিশ্চয় শুনতে শুনতে পাব। আমার পরমায়ু দিয়ে তো আমার কাজের বিচার হতে পারে না। মানুষের পরমায়ু আর কত দিন! ৬০/৭০ বছরও তো পার হয় না! কিন্তু মানুষের সুকৃতির মধ্যে সবচেয়ে বড় যে বিষয় তার নাম কাব্য। তাকে বিফল করার সাধ্য কারো নেই। এই বিশ্বাস না থাকলে সমস্ত সৌন্দর্যতত্ত্ব ও অলঙ্কার শাস্ত্রই ব্যর্থ হয়ে যেত। বৃষ্টি আমাকে অনেক শিখিয়েছে। আবার অনেক বিষয় ভুলিয়েও দিয়েছে। যা বিস্মৃত না হলে কবি সতেজ থাকেন না। আমি কি বৃষ্টির গুনগান না করে পারি?
সূত্র: ২৪ জুন, ২০০৫, কালের খেয়া