পাণ্ডুলিপি থেকে : মরাকটাল | আসেফ আব্দুল্লাহ

অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৫ এ প্রকাশিত হচ্ছে আসেফ আবদুল্লাহ’র প্রথম গল্পগ্রন্থ মরাকটাল। প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। প্রচ্ছদ করেছেন নাওয়াজ মারজান। বইটি পাওয়া যাবে ঐতিহ্য, প্যাভিলিয়ন ২৮-এ।

মনঃসমীক্ষা

 

১.

বিশ্ববিদ্যালয় হলের সবথেকে কোণার রুমে মলিন বিছানায় শুয়ে থাকা এক যুবকের ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার মা। মায়ের চুল, চোখ, চিবুক, গলা, পেট,পা । তারপর যুবকটি হারিয়ে যায় এক গভীর অপরাধবোধে, এক গভীর অনুশোচনার সমুদ্রে সে তলিয়ে যায়। কিন্তু মা যেন ভাবনা থেকে দূর হয় না। পরশুই বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেছে, হল প্রায় খালি। তাকেও বাড়ি ফিরতে হবে। দীর্ঘ একবছর দু’মাস সে বাড়ি ফেরেনি। মায়ের সাথে দেখা করেনি। কিন্তু এবার বাড়ি ফিরতে হবে। মায়ের কাছে আবার যেতে হবে, কিন্তু আপাতত মা যেন তার ভাবনা থেকে যাচ্ছেই না।

বাধ্য হয়ে যুবকের হাত যায় তার ওষুধের বাক্সে। একটা একটা ক’রে দু’টো ঘুমের ওষুধ গেলে মাকে তাড়াবে বলে। তারপর সে নিজেকে একটা বড় আয়নায় দেখতে পায়। কিন্তু আয়নার মধ্যে তার প্রতিবিম্ব ধোঁয়ার মতো হারিয়ে যেতে থাকে। সে চোখে হাত দিয়ে চোখ ডলে। আয়নায় তাকায়। আয়নায় যুবকের শরীর তার  মায়ের শরীরের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। তার প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে মায়ের প্রতিবিম্ব। তারপর তার যথেষ্ট ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করে। সে দেখে তার শরীরে কোনো কাপড় নেই। তারপর আয়নায় তাকিয়ে দেখে যে তার মা উলঙ্গ। শুধু লম্বা চুল দিয়ে তার পুরো শরীর ঢেকে আছে। হঠাৎ কেমন শব্দ করে পুরো আয়না কাঁপতে থাকে। আয়না ভেঙে টুকরো হতে শুরু করে। ঠিক তখনি তার ঘুম ভেঙে যায়।

বিছানায় তার ফোনটা কেঁপে কেঁপে বাজতে থাকে। বন্ধ জানালা দিয়ে ভোরের আলো ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। যুবক ফোনটা ওঠায় না, মা ফোন করেছে। বাজুক। তারপর সে বাথরুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়। এক বড় আন্টির কথা ভাবতে থাকে। তাকে ভাবতে ভাবতে নিজেকে শান্ত করে। অতঃপর পানি দিয়ে সব গ্লানি ধুয়ে ফেলে, স্বমেহনের পর বের হওয়া সব ঘাম মুছে ফেলে পানির ফোয়ারায়।

গোসল শেষে নিজের রুমে এসে বসে। এবার তেমন কিছু নেবে না বাসার জন্য। এক সপ্তাহের মতো কিছু জামাকাপড় নেয়। সাথে একটা ডায়েরি আর সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষা। নিজের রুম ছেড়ে বাড়ি যাবে। যুবকের মনে কিন্তু হতাশা। মনের মধ্যে একটাই ভয়। একটাই ইচ্ছা, মায়ের থেকে দূরে থাকা।

 ২.

আজ দু’দিন ধরে নিজের ঘরে বসে বসে যুবক বই পড়ছে। ননফিকশনে ডুবে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ আর পড়ায় যুবকের মন নেই। আজকে বাসায় কেউ নেই। তার বাবা আর মা বাইরে গেছে তারই জিনিসপত্র কিনতে। মায়ের সঙ্গ এড়ানোর জন্য সে বাসায় থেকে গেছে।

বাসায় যখন কেউ নেই যুবকের ইচ্ছে হয় মায়ের ঘরটায় যেতে। সে যায়। তার পা দু’টি মায়ের বিছানার কাছে তাকে নিয়ে যেয়ে রাখে। সে নিজের সামনে একটা ছোট্ট ছেলেকে দেখতে পায়। ছেলেটা বড়ই মা ভক্ত। বাবা মায়ের মাঝখানে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। মায়ের আঁচল ছাড়ে না কখনো। ছোট্ট ছেলেটা প্রায়ই মাকে চুমু খায়। মায়ের আদরে আদরে বড় হতে থাকে।

চোখের সামনে যেন নিজের ছেলেবেলা কেটে যায় যুবকের। প্রচণ্ড ঘৃণা বোধ হয়। আবার ছোটবেলার সেই মুহূর্তগুলোর কথা ভেবে অনুশোচনাও হয়। কিন্তু আলনায় মায়ের শাড়ি দেখে যুবক সব ভুলে যায়। শাড়িটা হাতে নিয়ে গন্ধ শোঁকে। চিরচেনা মায়ের ঘ্রাণ। শাড়িটা হাতে নিয়ে আয়নায় অবয়ব খোঁজে মায়ের। শাড়িটা মায়ের প্রতিরূপ হয়ে ওঠে। যুবক নিজেকে হারিয়ে ফেলে। নিজেকে নগ্ন করে মায়ের শাড়ি পেঁচিয়ে নেয় গায়ে। একটা নিষিদ্ধ সুখে ভাসতে থাকে সে। শারীরিক কামতাড়না যেন সূঁচ হয়ে শরীরে ফুটতে থাকে। নিজেকে সংযত করতে চেয়েও করতে পারে না সে। মনের কল্পনা আয়নায় প্রতিফলিত হয়। তারপর যুবকের কামনার রস নিঃসৃত হয়। শরীরের তাপের সঙ্গে সব কল্পনা উড়ে যায়। ‌গ্রাস করে ফেলে নিস্তব্ধতা, অনুশোচনা আর আত্মগ্লানি।

 

 

 ৩.

সেদিনের পর থেকে যুবকের মনে শুধুই অপরাধবোধ। অনুশোচনার গ্লানি আর অপরাধবোধে জীবনবোধ থেকে ছিটকে গেছে সে। সেদিন রাতে তার মা বাসায় ফেরার পর মায়ের সঙ্গে স্বাভাবিক কথা বলতেও তার বাঁধছিলো। মায়ের ঘনচুলের গন্ধে সে পাগল হয়ে যাচ্ছিলো। মায়ের সংস্পর্শও সে সহ্য করতে পারছিলো না। এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় তার ঘৃণা হচ্ছিলো। সে নিরুপায়। নিজের তাড়না সে কমাতেও অক্ষম, আবার বাড়ির ভেতরে মা’র থেকে একদম আলাদা হয়ে যাওয়াও অসম্ভব। আর কত দিন এরকম চলবে!

ঘৃণা হয় নিজের জীবনের ওপর। ঘৃণা হয় মনের মধ্যে। প্রতিদিন রাতে কল্পনার অঙ্গরাজ্য থেকে মাকে তাড়ানোর জন্য ঘুমের ওষুধ আর কতদিন খেতে হবে। কেন আর দশটা সন্তানের মতো মাকে সে আপন করে নিতে পারে না। অনেক প্রশ্ন। উত্তর তার অজানা নয়। সে জানে। এজন্যই এই জীবন নিয়ে সে হতাশ। থেরাপিস্টের সাথে কথা বলেও তার লাভ হয়নি। বাড়ি ফেরার পর থেকে যেসব খেয়াল তার মাথায় ঘুরছে সেগুলোর জন্য সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না।

এতো কিছুর পরে, এতো ভাবনার পরে একটা সুন্দর সিদ্ধান্তে এসে সে অনড় দাঁড়ায়। আর এভাবে বেঁচে থাকা নয়।

গভীর রাতে মায়ের ঘরে চলে যায় সে। মাকে খুব ভালোমতো দেখে। আশ্চর্যজনক ভাবে এবার তার কোনো কিছুই অনুভব হয় না। নিজেকে পাপমুক্ত লাগে যুবকের। যুবক নিষ্পাপ বোধ করে। মায়ের কপালে একটা আলতো চুমু খায়। নিষ্কাম চুমু, শুধুই ভালোবাসা আর মায়া আছে এই চুমুতে। তারপর মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসে। খুবই ঘুম পাচ্ছে। মাকে দেখতে দেখতে সে ঘুমিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে আবারো মা আসে। কিন্তু এবার তার মাকে একদম স্নিগ্ধ লাগে। আর নিজেকে সে ২৩’র যুবক ভাবতে পারেনা। সে যেন এখন নিষ্পাপ শিশু। মায়ের কোলে খেলছে। মায়ের বুকের ওম নিচ্ছে। মায়ের ওমে সে স্বপ্নের মধ্যেও ঘুমিয়ে পড়ে।

 ৪.

পরদিন সকালে যুবকের মায়ের ঘুম ভাঙে। পায়ের কাছে নিজের সন্তানের নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখ দেখতে পায় সে। মা বুঝতে পারে তার সন্তানের এই ঘুম আর কখনো ভাঙবে না। এই বোধ যখনই মনের মধ্যে ঢোকে তার নিজেরও ইচ্ছে করে নিজের সন্তানের সাথে ঘুমাতে। একটা লম্বা ঘুম।

নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে যুবকের কপালে চুমু খায়। চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু অশ্রু ঝরে। যুবকের মুখে সেগুলো মুক্তার মতো চমকায়। মা জানে তার এই সন্তান নিষ্পাপ, একদম পবিত্র। এর বেশি কিছু সে জানতে চায় না।


আসেফ আব্দুল্লাহ

জন্ম ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, রাজশাহীতে। গল্পকার হিসেবে প্রথম বিচরণ লিটলম্যাগ ‘গৈল্পিক’- এর পাতায়, বর্তমানে সেখানেই যুক্ত আছেন। ভালোবাসেন বেড়াতে, আঁকতে, নতুন কিছু শিখতে, রান্না করতে, আর রোজকার জীবনে গল্প খুঁজতে। জেন্ডার, নারীবাদ, এবং নৃতত্ত্ব নিয়ে বিশদে জানতে আগ্রহী।

শেয়ার