পাণ্ডুলিপি থেকে : একবিন্দু বেদনার পাশে | খালেদ হোসাইন

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৫-এ প্রকাশিত হবে কবি, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক খালেদ হোসাইন-এর নতুন কবিতাগ্রন্থ একবিন্দু বেদনার পাশে। প্রকাশ করেছে জিনিয়াস পাবলিকেশন্স। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। পাওয়া যাবে ঢাকা বইমেলায়, জিনিয়াস পাবলিকেশন্স, প্যাভিলিয়ন- ৩২ এ।  

 

হৃৎপিণ্ড খনন-করা শূন্যতার অনুভূতি

কেউ কেউ আসে নিঃশব্দে হারিয়ে যাবে বলে
হারিয়ে যায়ও
তবু জেগে থাকে নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে
আর লিপ্ত হয়ে পড়ে জীবন-যাতায়াতের
পরিপার্শ্বে।

অভিমানই সবচেয়ে ভারী
অথচ দেখতে সে একটা নুড়ির চেয়েও ছোট
যেন বালির একটি কণা
অথবা চোখে পড়বার মতোও নয়।
তবু বাসা বাঁধে চোখের মণিতে।

দূর কোনো মফঃস্বলে বাঁশঝাড় ভেদ করে
সরু একটা রাস্তা চলে যায় নক্ষত্রের গ্রামে
সেই পথে তার পায়ের পাতা
নানা তালে ও নানা লয়ে বিচরণ করতো—
সামন্য রৌদ্রে, অসামান্য ছায়ায়।

একটা চৌকোনো ভারী চশমার ফ্রেম
বড় একটা টিপের খুব কাছাকাছি
             পাহারা দিতো দুটি চঞ্চল চোখ

সবকিছু দৃশ্যের আড়ালে চলে যায়
কিন্তু ঢুকে পড়ে দৃশ্যান্তরে
চৈত্রমাসে সেখানেও ঝড়বৃষ্টি হয়
জাংলার খুঁটিতে ভাস্কর্যের মতো বসে থাকে কাক
আর দূরে
পুকুরের অন্যপাড়ে জেগে ওঠে শিশুদের স্বর।

নিঃশেষে কিছু হারিয়ে যায় না। কিচ্ছু না!

হৃৎপিণ্ড খনন-করা শূন্যতার অনুভূতি
            অতিরিক্ত মিথ্যে মনে হয়। 

 

তোমাকে আজও খুঁজি

তোমাকে আজও খুঁজি কেননা তুমি পুঁজি
যদিও মিশে আছ হৃদয়ে মর্মে
উপস্থিতি চাই কেননা ওড়ে ছাই
তোমার জনগণ গলদঘর্মে

খানিক বিচলিত, কেননা প্রত্যাশা
উপ্ত করেছ যা তা বিপর্যস্ত।
তোমার মননের সর্ব হননের
সঙ্গে নিহত যে উদয়-অস্ত।

মানব-র্দজায় গ্রেনেড গর্জায়
জীবন কেড়ে নেয় চাপাতি খড়্গ
দেশকে নারকীয় করতে ওরা চায়
পৈশাচিকতাতেই পায় যে স্বর্গ।

তোমার কর্ষণ জীবনদর্শন
জীবনব্যাপী যতো করেছ কৃত্য
গ্রহণ না করেই অনেক হা করেই
মুখোশ পরে আজ করছে নৃত্য।

হৃদয়ে রাখে যারা ছিটকে পড়ে তারা
‘চাটার দল’ দেয় প্রবল ধাক্কা
এখনো লুটপাট চলছে বেশুমার
এখনো উঁচুতেই আসন পাক্কা।

আলোর যে শিখাটি এখনো বেশি খাঁটি
হচ্ছে নিভুনিভু কেন্দ্রে প্রান্তে
খেই না হারাতেই তমসা তাড়াতেই
চাইছি তোমাকেই এখানে টানতে।

তোমাকে আজও খুঁজি কেননা তুমি পুঁজি
যদিও মিশে আছ হৃদয়ে মর্মে
চাই সে তর্জনি উপস্থিতি চাই
তোমাকে দরকার সকল কর্মে।

 

নীরবতার আর্তনাদ

আছি এক গোলকধাঁধায়।
হাসায়, কাঁদায়।
মন আছে, মুখ নেই।
চারপাশে নীরবতার আর্তনাদ।
পাতা ফাঁদ।

একটাই সড়ক
নরক বরাবর।
যারা আপন
তারাই সবচেয়ে পর।

আছে অসম্মান নির্যাতন
যূপকাষ্ঠ, বলি।
নির্বিকল্প পথ— ধেয়ে চলি।

 

নক্ষত্রহীন এক গুমোট আকাশ

অনেক ক্লান্তি নিয়ে আজ ঘরে ফিরেছি।
এখন এই মধ্যরাত। বারান্দায় বসে আছি।
নক্ষত্রহীন এক গুমোট আকাশ। শীত আসছে।
শীতের পাখি বা শীতবস্ত্রের কথা নয়—
আমি ভাবছি, তোমার কথা, আমার স্বদেশ—
সংগ্রামের কথা, যুদ্ধের কথা, শহিদদের রক্তের কথা
সার্বভৌমত্বের কথা, গণতন্ত্রের কথা, আমাদের মতো
সাধারণ মানুষদের কথা। ক্রমাগত তাদের নিহত হবার কথা,
তাদের ঘর্মাক্ত রক্তাপ্লুতশৌর্য ও স্বপ্নের কথা।

হিমেল বাতাস, কানে কানে বলে যাচ্ছে,
চুপ! চুপ! চুপ!
মুখ খোলা যাবে না, খাবার সময়টুকু ছাড়া।
কিন্তু খাদ্য কোথায়?
সে-সব সময় নাগালের বাইরে থাকে। এখন আরো দূরে সরে যাচ্ছে।
যেন, দিগন্তের পাহাড়, যত এগিয়ে যাই, তত পিছিয়ে যেতে থাকে।
উপরে উঠে যাচ্ছে, সাত আসমান পেরিয়ে।

ভাতের গন্ধ, আনাজের সুবাস, মাছের আঁশটে ঘ্রাণ অন্ধ আজ
কালো গহ্বরের দিকে ছুটছে।

 

এখন গৃহদাহ, এখন জতুগৃহ

এখন গৃহদাহ, এখন জতুগৃহ
এখন আসমান কাঁপছে কুণ্ঠায়
ঘিঞ্চি গলি আর সদর রাস্তায়
না, কোনো কিছু নেই মানব-আস্থায়।

এখন নদীতীরে বালুরা ঝলকায়
একটি বালুকণা অগ্নিফল খায়
নদীতে জলও নাই, ও নদী, জ্বলো তাই?
পূর্বাভাসে তুমি এ-কথা বলো নাই!

দখিনা বায়ু বয়, বাতাস এ তো নয়
বায়ুতে ভাসবে কি ফুলের সে প্রণয়?
এমন অসমান দেখিনি প্রান্তর
যে দিকে চোখ যায় সব অবান্তর।

স্তম্ভ নড়ে যায় মানুষ মরে যায়
চাওয়া ও পাওয়াতে যে তফাৎ বিস্তর
রক্তে ঘামে আর কিংবা সাধনায়
একটি অঞ্জলি দে জল তিস্তায়।

এদিকে দ্বিপ্রহরে গ্রাম কি এ শহরে
বানের মতো নামে তীব্র চিৎকার
জঙ্গি ভঙ্গিতে সঙ্গী সঙ্গীতে
হিসেব নিতে চায় কতোটা জিত কার।

জলের প্রাণ নেই সে অপরাহ্ণেই
পাখিতে গান নেই দীর্ঘকাল
অনেক চাওয়া নেই একটি চাওয়া—এই
শান্ত ও স্নিগ্ধ ধীর সকাল।


খালেদ হোসাইন
কবি, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক

জন্ম ১৯৬৪ সালের ২০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ফাজেলপুরে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন নারায়ণগঞ্জে। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করছেন।

উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ
ইলামিত্র ও অন্যান্য কবিতা, শিকার-যাত্রার আয়োজন, জলছবির ক্যানভাস, পাতাদের সংসার ইত্যাদি।

গবেষণাগ্রন্থ
মীর মশাররফ হোসেন : জীবন ও পরিবেশ, আধুনিক বাংলা সাহিত্য প্রসঙ্গ, মীর মশাররফ হোসেনের জমীদার দর্পণ : বিষয় ও শৈলী ইত্যাদি।

ছড়াগ্রন্থ 
হাউমাউ, বৃষ্টি যদি আসে, লেজ, একা একা বানান শেখা, পায়রা উড়ে যায় ইত্যাদি।

সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন  ‘আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার-১৯৮৮, ‘শ্রুতি সম্মাননা-২০১২’, জীবনানন্দ পুরস্কার-২০১৪, দাগ সাহিত্য পুরস্কার-২০১৬।

শেয়ার