পাণ্ডুলিপি থেকে : আমরা কথা বলি কেননা নীরবতা ফ্যাসিস্টের ভাষা | হাসান রোবায়েত

ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি হাসান রোবায়েত-এর কবিতাগ্রন্থ, আমরা কথা বলি কেননা নীরবতা ফ্যাসিস্টের ভাষা। পাওয়া যাবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৫ এর ঐতিহ্য (প্যাভিলিয়ন ২৮)-এ। কবি সাফা প্রামাণিকের আর্ট-ওয়ার্ক অবলম্বনে প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত।

মিলিটারি ক্যাম্পের দূরে পাহাড়ি সূর্যের নিচে মাস্টারবেট করছে যে সৈনিক, সুরভিত রমণীর টসটসে বোঁটার দিকে চেয়ে আছে যে পুলিশ জেনেভা ক্যাম্পের ছায়ায়, প্যালেস্টাইনের শিশুদের দিকে বন্দুক তাক করে আছে যে আযাযিল, অরণ্যের গভীরতা থেকে ভেসে আসা জানকীর ক্লান্তিহীন কথোপকথন তারা কেউই শোনে নি কোনোদিন—একটা সরোদ পতঝর বিকালে দলছুট হয়েও শোনাতে পারে সুর, চিরদিনের জন্য যারা ভেসে গেছে ধলেশ্বরী অথবা শীতলক্ষার পানিতে, নক্ষত্রের পুবালী হিংসায় পুড়ে গেছে বনানীর রোদে, ইয়েমেনে হয়েছে শহীদ, হেমন্ত-প্রস্ফুটনের প্রতিটা শব্দ উড়ে যাচ্ছে তাদের লিখিত অর্কেস্ট্রার থেকে—এফ মাইনরের মধ্যে উড়ে যাচ্ছে শতশত পুড়ে যাওয়া অর্ধ ঝলসানো মুখ, শহিদের সোনালি দু-চোখ—তাঁবুর বাইরে এক রমণীর প্রতিক্ষায় আমরা ভাগ করে রেখেছিলাম নুন আর আতরের রোদ, যে পথ তৈরি হয় হেমন্ত আসার জন্যে সেখানে গরুর গোবরে লেপা হয় হাতাশের উঠান, তুমি জানো, উপত্যকা আর মালভূমি আমাদের নয় যেমন আমাদের ছিল না কোনোদিন আগুনে পুড়ে যাওয়ার বল্লম, নিজ সৈনিকের হেলমেটে বালু বহনের স্মৃতি, এস্রাজ বাজানোর সাথে সাথে শিশুদের স্লেটে লেখা আব্বার নাম ঝুরঝুর করে পড়তে থাকে দুপুরের স্তব্ধতা ভরে—

 

আমরা কথা বলি—কেননা ঝরাপাতায় পড়ে আছে পাখিদের শিস
আমরা কথা বলি—কেননা হাতিরা বৃষ্টি এলে পাতাকে শোনায় গান
আমরা কথা বলি—কেননা ভাষার মধ্যে উর্দি খুলছে অজস্র মিলিটারি
আমরা কথা বলি—কেননা শিশুদের বাক্য আসে প্রাচীন বৃক্ষের থেকে
আমরা কথা বলি—কেননা ভাষার সমস্ত অর্থকে সেলাই করছে দর্জিরা
আমরা কথা বলি—কেননা শিশুদের হাসি দিয়ে জুতা মোছে ফ্যাসিস্টেরা
আমরা কথা বলি—কেননা নীরবতা ফ্যাসিস্টের ভাষা
আমরা কথা বলি—কেননা মোজায় লুকানো ইঁদুর সারারাত চুরি করে তারা
আমরা কথা বলি—কেননা বাতাস সারাক্ষণ সঙ্গে রাখে সুরা আর রাহমান
আমরা কথা বলি—কেননা আগুন ছুঁতে পারে চড়ুই পাখির ওড়া
আমরা কথা বলি—কেননা কাকতাড়ুয়ারা মন্দিরের ঘন্টার মতো একা
আমরা কথা বলি—কেননা কৃষকের হাতের রেখা সরোদের সুর দিয়ে লেখা
আমরা কথা বলি—কেননা বনের গভীরে শীত চেরাই করছে কফিন
আমরা কথা বলি—কেননা সূর্যের সঙ্গে ডুবছে অজস্র কালো মোষ
আমরা কথা বলি—কেননা গ্রীষ্ম পরে আছে মখমলের বিষাদ
আমরা কথা বলি—কেননা জেব্রাক্রসিঙের উপর ফুটে আছে মগজের শিমুল
আমরা কথা বলি—কেননা মৃত্যুর মধ্যে উল ছড়াচ্ছে পাঁচ শ শাদা বিড়াল
আমরা কথা বলি—কেননা আমাদের ডাকবাক্সে কোনো চিঠিই ছিল না কল্পনা চাকমার জন্য
আমরা কথা বলি—কেননা ধর্ষিতার স্তনে ঘুমায় পবিত্র কাকাতুয়া
আমরা কথা বলি—কেননা লাল পোস্টবক্সে সূর্য ডুবছে প্রতিদিন
আমরা কথা বলি—কেননা অন্ধদের কালিজিরা ফুল মূলত বিসমিল্লা খাঁর সানাই
আমরা কথা বলি—কেননা কৃষকের বউ হাঁস ডাকে আর তারারা নেমে আসে চই চই করে
আমরা কথা বলি—কেননা নখে আমাদের দু ঠোঁট আঁকড়ে ধরছে সোনালি ইগল

 

আমরা কথা বলি কেননা—গান তার অশ্রুর আত্মায় ভর দিয়ে উঠে যায় রোদের হাওয়ায়, অরণ্যের গভীরে, পাতার কল্লোলিত অর্কেস্ট্রায় ঝরে পড়তে থাকে শীতঋতুর কাসিদা যেন আলতামিরার বাইসন বিকালের শিস ভেদ করে দৌড়ে যাচ্ছে প্রাচীন ঘাসের কোনো মাঠে, হাওয়ারা শিরশির বুনো ঘাসের অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে যায় দিনমান, পতঙ্গেরা ভাঙা কোনো খোঁড়ল থেকে বেরিয়ে এসে দেখতে পায় আশ্চর্য স্ফুটনোন্মুখ নীল কণ্ঠির ঝাড় ভেসে উঠেছে পুরাটা এপ্রিল জুড়েই—


হাসান রোবায়েত
কবি

জন্ম ১৯ আগস্ট, ১৯৮৯; বগুড়া। শিক্ষা : পুলিশ লাইন্স হাইস্কুল, বগুড়া। সরকারী আজিজুল হক কলেজ; বগুড়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ — ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে; মীনগন্ধের তারা; আনোখা নদী; এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে; মাধুডাঙাতীরে; তারাধূলিপথ; মোহাম্মাদ, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম; মুসলমানের ছেলে, রুম্মানা জান্নাত; ব্রিজ পেরোলেই অন্য ঋতুর দেশ; কুসুম তার সবটুকু জানে; ছায়াকারবালা।  ছড়া : মেঘের ভিতর হরিণ ঘুমায়।

শেয়ার