পাঁচটি কবিতা | সৈয়দা নীলিমা দোলা


গোপন নূরজাহান


নূরজাহানের বাকসো
খুলে যায়
একে একে আসে
ডর, দুঃখের নহর, প্রেম

জানালা আটকে যায় সশব্দে
নূরজাহানের বুক ধ্বক ধ্বক করে
কড়ায় আটকে যায় প্রেম

বৃষ্টির সাথে কুলকুল করে বয়ে যায়,
মাটির পৃথিবীর সুখ

প্রাণের কাছে আজ নাই কোনো আত্মীয়,
নূরজাহানের বুকে একটা ডালিম ফালি হয়

নূরজাহানের পায়ে বেজে ওঠে ঘুঙুর!
আজা নাচলে ইয়ার!
মুদ্রায় মুদ্রায় ক্ষোভ দলা হয়ে ওঠে

হৃদয় জয় করতে আসা সুহৃদ প্রেমিক,
বোঝে কি বেদনার ভাষা?

নিশুতি রাতে,
ভাগ হয় না পার্থিব সুখ
হায় নূরজাহান হায় সুবাস!


ফিজিক্স


দ্যাখেন ওস্তাদ, আমি ফিজিক্স বুঝি না।
তাই, আমার বাতাস কোথাও কোনো চাপ সৃষ্টি করে না।
আমার বাতাস গাছ দোলায়, ধানের বুকে ঢেউ খেলায়।
দ্যাটস ইট


একটা ফাঁকা সন্ধ্যায় আমারে খুঁজতেছি


বুকের মধ্যে একটা ফাঁকা সন্ধ্যা
ঝনঝনিয়ে ওঠে।
     ক্যালেন্ডারে নতুন একটা দিন আসে;
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই।
     দেখি, এখনো আমাকে ঘিরে ধরে আছে একটা ছটফটে ছোট্ট মেয়ে!
হুল্লোড় করে মেয়েটা আমার ভেতরে,
     আমি সেই নিরীহ কিশোরীকে বাঁচাতে চাই না।
চাই না তার পায়ে পায়ে ফেরত যেতে!

             বুকের মধ্যে একটা ফাঁকা সন্ধ্যা
ঝনঝনিয়ে ওঠে।
বিস্মৃতির কাছে রেখে এসেছি আমাকে।
     সাথে রেখে এসেছি কানামাছি, পুতুল খেলা
সেই আমাকে রেখে এসেছি এক জাদুর বাক্সে,
     যার চাবি নেই এই সময়ের হাতে।
       এই যে এখন দাঁড়িয়ে আছি আমি,
             যাকে চেনে না এই শহর আর মানুষেরা।
               যে জানে না জেব্রাক্রসিং কেনো গুরুত্বপূর্ণ!

বুকের মধ্যে একটা ফাঁকা সন্ধ্যা
        ঝনঝনিয়ে ওঠে।

মরা থেকে একটু একটু করে বাঁচার চেষ্টা করি।
      যদি একদিন ভালো লেগে যায় পৃথিবী!

আমি রোজ সকালের চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবি,
            সব্বাইকে দেখে নেবো।
ট্রাফিক মোড়ে মেরে ঝুলিয়ে রাখবো শয়তানের চামড়া।
লাভ হয় না, জানেন?
     হয় মাতাল, নয় বিষণ্ণ হয়ে পা রাখি বাড়িতে।
নিজেকে একটা ছেঁড়া খাতা মনে হয়।

   বুকের মধ্যে একটা ফাঁকা সন্ধ্যা
                 ঝনঝনিয়ে ওঠে।

আপনারা কি জীবনকে ইচ্ছামতো খরচ করতে পারছেন?
     এই সন্ধ্যাগুলো ভাল কাটছে?
      আপনাদেরও কি ঘিরে ধরে আছে শৈশবের দুটো ছটফটে হাত?

এতোগুলো বছর সেই কিশোরীকে নিয়ে চলেছি যে,
           নিজেকে একঘেয়ে সেতারের সুর মনে হয়!
                আমার বুকের মধ্যে একটা ফাঁকা সন্ধ্যা
                          ঝনঝনিয়ে ওঠে।

আমার চোখ-মুখ ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে।
      গত ২০ বছরের স্মৃতিকে কেনো মনে হয় কয়েক শতাব্দী আগে?
            কেনো সময়কে মনে হয় একটা মেডিকেল কলেজের গেইট?
                    যেখানে শুধুই ভাঙাচোরা মানুষেরা!

        তারপর আবারো
আমার বুকের মধ্যে একটা ফাঁকা সন্ধ্যা
                    ঝনঝনিয়ে ওঠে।

জীবনের সব নিষ্পাপ নদীর পথ পেছনে ফেলে,
    চলে এসেছি বহু বহুদূর।
এখন বাকি আছে শুধুই সন্তাপ, ক্ষিধা আর ভুল ধরে বের করা।

      এই যে জীবন এখানে মাফ নেই,
             কারো নেই নিস্তার!

আমার মনে হয়,
মায়ের একটা দুঃখ ছিলো!
  সেতারের মতো ঝংকারে সে দুঃখ জায়গা করে নিয়েছে বাবার পাঁজরে।
    তাই আমি হয়েছি রক্তে-মাংসে-দুঃখে তৈরি মানুষ।

আমার তাই
  বুকের মধ্যে একটা ফাঁকা সন্ধ্যা
                    ঝনঝনিয়ে ওঠে।

এই শহরটাকে বুকপকেটে নিয়ে অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
    তাদের কাছে জানতে ইচ্ছা করে,
       কবিতা কি বোঝেন আপনারা?
  ভালো লাগে পড়তে?

       আমার এই লেখা নির্লোভ।
আমি অনেক ভেবেছি কবিতা নিয়ে।
 নিঃস্পৃহতা আর কবিতা
    এই আছে আমার কাছে।
  আর নেই কিছু!
আমি বৃষ্টিভেজা ঢাকার সন্ধ্যায় চুপ করে দাঁড়াই।
  একটা ছোট্ট কিশোরী ছুটে যায় মাঝ রাস্তায়!

       তার গালে, চুলে, ফ্রকে আর চোখে লেগে আছে,
           হাওয়াই মিঠাই, বন্ধুদের সাথে বরফ-পানি খেলা!
আমার জীবনকে সে নিয়ে গেছে অনেক দূরের কোনো সময়ে!
আমি শুধুই খুঁজছি একটা সন্ধ্যা,
       একটা আশাবাদ!
যা আমাকে বাঁচিয়ে দেবে!


আজ ঘুম আসেনি


শহরে বৃষ্টি এলে, ভয় পেলে কিংবা একা হলে,
লোকে ফোন হাতে তুলে নিয়ে,
জিগ্যেস করে, “কই?”
 যাদের “কই” শুধানোর কেউ নেই,
তারা আয়না দেখে—
কিংবা
   চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে খোঁজে শ্রেণিশত্রু।
একই পথে অনেকবার হেঁটে ফেলার পর—
আমার জানতে ইচ্ছা হয়,
    প্রথমবার কী চোখে দেখেছিলাম এই পথটাকে?
ভয়ে ছিলাম নাকি বিস্ময়ে?
    নাকি আমি ছিলাম আকেলী চিড়িয়া?
প্রেমিক কিংবা রিক্সাওয়ালা
    সবাই এখন জিগ্যেস করে,
        কই?
আমি কিভাবে তাদের বলি-
    এই যে এখানে, গহীনে…
যেখানে আপনাদের চোখ যেতে পারে না!
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে,
    যদি ১০০ টাকায় জীবন বাইছা লওয়া যাইতো!
তাহলে আমি হতে চাইতাম ঋতু—
    ছয়বার, ছয়টি বাতাসে উড়িয়ে দিতাম বেঁচে থাকা।
যত্ন করে দু’বেলা চা খাওয়ানো বাদে,
     নিজের সাথে আর কোনো ইনসাফ আমি করিনি!
বৈষ্ণবী হলে,
চালের বদলে, দুয়ারে দুয়ারে আমি ভিক্ষা চাইতাম—
      মানুষ বাদে অন্য কোনো নাম!


স্মৃতির গন্ধ 


দু’মুখো একটা জীবন ঘিরে ধরে আছে।
দুঃখী হবার আগ্রহ নিয়ে,
     বেঁচে থাকছি—
জীবনে জড়িয়ে আছে,
প্রেমের অসুখ, আম্মার বুকের ব্যথা, চা-বিস্কুট,
      পোড়া তেলে ভাজা মাছ কিংবা একটা দুটো মানুষ।

বিস্ময়কর এই পৃথিবীতে
       বইয়ের সাথে, কফির সাথে, চিড়িয়াখানার বাঁদরের সাথে
   দিন কাটতে পারতো—
রিমিঝিমি হেসে উঠতে পারতো,
        বান্ধবীদের কোলাহল!
মানুষের আরেকটু কাছাকাছি,
    সাদা কাপড় গায়ে দাঁড়াতে পারতাম।
    চায়ের দোকানে বসে বসে কাটতে পারতো সময়—
       যেভাবে শব্দে কাটে কবিতারা!

‘রেলগাড়ি ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম’ ছড়া কেটে কেটে,
                    দু’হাতে বানাতে পারতাম মানুষের রেলগাড়ি—
রাস্তায় দাঁড়িয়ে শূন্যতা মনে করে আঁকড়ে ধরতে পারতাম
            তোমার শার্টের বুক পকেট!

যদি সব পথ শেষ হতো
     একটা শিউলি তলায়!
যদি শৈশবের বেভুল, অসতর্ক আছাড়
           আরেকবার চোঁট দিত হাঁটুতে!
আমি হঠাৎ পেতে পারতাম
ভোর আর তিল মেশানো মিষ্টি ঘ্রাণ!
আর যদি ভালোবাসতে না পারি?
   যদি হারিয়ে ফেলি নারীর কোমল গন্ধস্মৃতি?
যদি না জানি আর,
    কি করে হৃদয় প্রেমের কাছে নিচু করে মাথা?

তোমার সাথে আমার একটা দারুণ সম্পর্ক ছিলো
  সন্ধ্যার আকাশের মত সরোফুল, গ্লুমি!
তুমি ডাকলে,
  আমি পাঁজর হারিয়ে ফেলা পাখির মতো ছুটতাম।
    যেনো কি ব্যথা আমার বুকে, কি ব্যথা আমার বুকে!

বাড়ি ফিরে জামা বদলে, চুল খুলে দেই,
যেনো খুলে দিচ্ছি নিজেকে, ভাঙা ক্যাসেটের ব্যথাকে!
আমাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে
     একটা দু’মুখী জীবন!
আমার জীবনের চারিপাশে সভা হচ্ছে
সেখানে বাজছে, দেড় থেকে দু’ মিনিটের
   বিরামহীন পাহাড়ি রাগ!


সৈয়দা নীলিমা দোলা

জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফরিদপুরে।

নীলিমা দোলা একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং পেশাগতভাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বিজ্ঞাপনী সংস্থায়।
লেখালেখিতে অনেকদিন কেটে গেলেও এখনও তার কোনো বই প্রকাশ হয়নি।

শেয়ার