পর্দার ওপাশে | সাজিদ উল হক আবির

মিনু ভাবি এ পত্রিকার মালিকের স্ত্রী। সপ্তাহে দু’বার, কোন কোন সপ্তাহে তিনবার দুপুরবেলা পত্রিকা অফিসে এসে সম্পাদক তরুণ চৌধুরীর রুমে ঢুকে গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা করেন ঘণ্টাখানেক। তারপর অফিসের কাজকর্মের খোঁজ নেয়ার জন্য আফসারকে ডেকে পাঠান সম্পাদকের কক্ষে। সেখানে আরও মিনিট দশেক আলাপের পর তিনি আর সম্পাদক তরুণ চৌধুরী একসঙ্গে অফিস থেকে বেরিয়ে যান হাসতে হাসতে।

 

“মিনু ভাবি কি আজকাল নিয়মিতই অমন টুকটুকে লাল লিপস্টিক দিয়ে অফিসে আসে, নাকি আজকের দিনটাই ব্যতিক্রম?”

আজকের দিন ব্যতিক্রম? তা তো বটেই।

দীর্ঘদিন শীতে কাবু, জুবুথুবু হয়ে থাকার পর শীতের সমাপ্তি, আর বসন্তের আগমন ঘোষণাকারী একটা বৃষ্টি হয় ফি বছর, ঢাকা শহরে, ফেব্রুয়ারি মাসে। তাই বলে শীতে কাতর এবং বসন্ত ঋতুর অপেক্ষায় পাগলপারা হয়ে থাকা একজন মানুষও শীত – বসন্তের মাঝামাঝি সময়ের সে ফিনফিনে বৃষ্টি পছন্দ করে না। কেননা, সে বৃষ্টির মুখোমুখি হওয়ার কোন প্রস্তুতি থাকে না কারো। ব্যাগে থাকে না ছাতা বা রেইনকোট। গায়ের শীতবস্ত্র ভিজে চুপসে যায়। রাস্তা জুড়ে থাকে প্যাঁচপ্যাঁচে প্যাঁককাদা। সুতোর মতো মিহিন বৃষ্টির সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস, মাথাব্যাথা আর সর্দিকাশিতে ছয়লাব চারপাশ। একইভাবে দেশ ইউরোপ – অ্যামেরিকা – চিন – জাপান – ভারত ইত্যদি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করছে। দেশের রেমিটেন্স বাড়ছে। উন্নয়নের চাকা গড়গড়িয়ে সামনে এগুচ্ছে। পত্রিকার পাতায়, কিংবা টেলিভিশনের সংবাদে এসব খবর দেখতে ভালোই লাগে। তবে ওসব দেশের সরকারের তালেবর ব্যক্তিত্বদের ঢাকায় আগমন উপলক্ষে যখন সড়ক আটকে রাখা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তাদের দেয়া হয় ভিআইপি প্যাসেজ, তখন আর উন্নয়নের গান ভালো লাগে না। স্কুল – কলেজ – অফিসমুখী, অথবা শেষবিকেলের ঘরফেরতা আমজনতার তখন নিজেকে কলে আটকা পড়া ইঁদুরের মতো লাগে।

দৈনিক রাঙা প্রভাত পত্রিকার কনফারেন্স রুমে পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আফসার আলীর সঙ্গে বসে পত্রিকার তরুণ রিপোর্টার শফিক, তুহিন, আর সাজিদের ঠিক সে কলে আটকা পড়া ইঁদুরই লাগছিল নিজেদের। তবে তফাতটা শুধু এই যে – রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানো দাতা দেশসমূহের ঐ সমস্ত মুরুব্বীদের কখনো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তারা আজ যার সঙ্গে মুরগীর খোপে আটকা পড়েছে – তাকে তারা নিয়মিতই চোখে দেখে। তবে তাকে অন্তরঙ্গভাবে পাওয়া যায় না কোন আলাপে। আজ পাওয়া গিয়েছে তাকে তাদের আড্ডায়, তা যথেষ্ট আচমকা, এবং প্রস্তুতি ছাড়াই।   

অফিসের প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তির সঙ্গে হাসি মশকরার সম্পর্ক হবে – এমনটা বেশীরভাগ কর্মচারীরই কামনা। তবে সে চাওয়া যখন পাওয়ায় পরিণত হয়, আর পাওয়ার সঙ্গে সুড়সুড় করে এসে হাজির হয় আনুসাঙ্গিক অজানা অস্বস্তি, তখন সবারই হাঁসফাঁশ লাগে।  আফসার আলী, তাদের আফসার ভাই এই পত্রিকার সেকেন্ড ইন কম্যান্ড। নির্বাহী সম্পাদক হলেও পত্রিকা প্রায় একাই টানেন কাঁধে করে। সম্পাদক তরুণ চৌধুরী স্রেফ নামকাওয়াস্তে বেলা দুটো আড়াইটার দিকে এসে বসেন তার রুমে। তারপর রাজা উজির মারেন। একসময় সিরিয়াস সাংবাদিকই ছিলেন। এখন তার খ্যাতি রাজনীতি ঘেঁষা মিডিয়া পার্সোনালিটি হিসেবে। তাকে মালিকপক্ষ সম্পাদকের পদে রেখেছে পত্রিকার মাথায় মুকুট হিসেবে, তার শোম্যানশিপের জন্য। পত্রিকার কাজ যা করার, তা আফসারের নেতৃত্বে বাকিরাই করে।

কাজেকর্মে আফসার নেতৃত্ব দেয় বটে, তবে সে ভিন্ন গোছের নেতা। সে বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) তার অন্তর্মুখী গোমড়া স্বভাবের জন্যে।

কল্পতরু মিডিয়া হাউজের ইংরেজি আর বাংলা – দুটো পত্রিকার অফিস একই ফ্লোরে, মাঝখানে থাইগ্লাস দিয়ে আড়াল করা। প্রতিদিন ঠিক সকাল এগারোটা বাজে  মাঝারি সাইজের এক ছায়া দেখা যায় অফিসের প্রবেশপথে লাগানো থাইগ্লাসের অপরপাশে। সেই ছায়া অবয়বের ঠোঁটে দেখা যায় ছোট একটা ঝুলন্ত সিগারেট। শেষবারের মতো চারপাশকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে দিয়ে ধুম্রশলাকাটিকে বাইরের বিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গুনে গুনে ঠিক তিন সেকেন্ডের মাথায় আফসার পাঞ্চমেশিনে কার্ড প্রেস করে ঢুকে পড়ে অফিসে। হাফহাতা স্ট্রাইপ শার্ট, ছাইরঙা বা চকোলেট কালারের গেবাডিনের প্যান্টে ইন করে পরা। ঝাঁ চকচকে বকলেস বেল্টের সঙ্গে পায়ে বেমানান চামড়ার স্যান্ডেল। পোশাক আশাকে সৌখিন লোকটি শু জুতো পরে না কেন? অফিসে কেউ জিজ্ঞেস করার সাহস করে উঠতে পারে নি। তবে ক্রমাগত চিনি ছাড়া দুধ চা পান, এবং অফিসে কেক – মিষ্টি ইত্যাদি এলেই তার ভাগেরটা অন্যদের টেবিলে পাস করে দেয়ার সূত্র ধরে অনেকে ধরে নিয়েছে, আফসার বহুমূত্র রোগের রোগী। সে কারনেই হয়তো আঁটসাঁট শুয়ের বদলে খোলামেলা চামড়ার স্যান্ডেল পায়ে। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল – জুলফির কাছ থেকে শুরু করে উপরের দিকে অর্ধেকটা পেকে গেছে। ততোধিক ঘন ঝাঁকড়া গোঁফ, এবং প্রায় সর্বদা কুঁচকে থাকা ভ্রূ ছাড়া বাকি মুখমণ্ডল তার চকচকে করে কামানো থাকে সবসময়। গোঁফের আড়ালে সিগারেটে পোড়া ঠোঁটের ফাঁকে দাঁতগুলোও ঝকঝকে হওয়ার কথা, কিন্তু আফসারকে দাঁত বের করে কেউ কখনো হাসতে দেখে নি বলে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। ঝনঝনে পেটা শরীরে দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে ডেস্কে বসে সেই যে  মাথা গুঁজে কাজের শুরু, সন্ধ্যা ছ’টার আগে সে কাজের আর থামাথামি নেই। বাসা থেকে নিয়ে আসা দুপুরের লাঞ্চও টেবিলে বসেই সাবাড় করেন। রিপোর্ট, ফিচার, বা সাক্ষাৎকারের বিষয়ে কথা বলা লাগলে স্টাফ রিপোর্টারদের নিজের ডেস্কে ডেকে পাঠান। প্রতি দেড় ঘণ্টা অন্তর ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উবু হন, আড়মোড়া ভাঙ্গেন। এছাড়া দুপুরে খাবার পর, আর বিকেলে চায়ের পর একবার বাইরে বেরিয়ে রাস্তার অপজিটের টং থেকে ধূমপান আর এককাপ লাল চা। এই পরিমিত নড়াচড়া ছাড়া তাকে আর ডেস্ক থেকে উঠতে দেখা যায় না। আফসারের এই রুটিন পত্রিকা অফিসের সবার এতোটাই পরিচিত যে, অফিস দিনে আফসার কোন মুহূর্তে কি করছে, তা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। এরকম যান্ত্রিক একটা মানুষকে বস হিসেবে পাওয়া ভালো কি মন্দ, আফসারের অধীনস্থ রিপোর্টাররা তা নিয়ে হিসেবনিকেশ করেও কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে নি। প্রতি দিন যার যে ফিচার লিখবার কথা, যার যে রিপোর্ট বা ইন্টার্ভিউ জমা দেয়ার কথা, সে সেটা সময় মতো আফসারের টেবিলে জমা দিলেই সে সেদিনের মতো খালাস। তবে এতে তারা মোটের ওপর খুশীই। অহেতুক কাজের হ্যাপা বস কখনো চাপান না তাদের কাঁধে। তবে কেউ কখনো নিয়ম ভাঙলে গোমড়ামুখো বস তার কি হাল করবেন, সে ব্যাপারে তারা একদমই অন্ধকারে, একারণে অজানা এক ভয়ও তাদের মাঝে কাজ করে। প্রতিদিনের একঘেয়ে একলয়ে চলা জীবন লাইনচ্যুত হলে অজানার সম্মুখীন হওয়ার যে বিপদ, এ মুহূর্তে অফিসের তরুণ তিন রিপোর্টার তাতে আটক।

মিনু ভাবি এ পত্রিকার মালিকের স্ত্রী। সপ্তাহে দু’বার, কোন কোন সপ্তাহে তিনবার দুপুরবেলা পত্রিকা অফিসে এসে সম্পাদক তরুণ চৌধুরীর রুমে ঢুকে গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা করেন ঘণ্টাখানেক। তারপর অফিসের কাজকর্মের খোঁজ নেয়ার জন্য আফসারকে ডেকে পাঠান সম্পাদকের কক্ষে। সেখানে আরও মিনিট দশেক আলাপের পর তিনি আর সম্পাদক তরুণ চৌধুরী একসঙ্গে অফিস থেকে বেরিয়ে যান হাসতে হাসতে। আফসারকে দেখা যায় ভাবলেশহীন চেহারায় তার ডেস্কে ফিরে এসে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে। সেই মিনু ভাবিকে তাদের গোমড়ামুখো ইমিডিয়েট বস যে এতোটা খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেন, তা তাদের কারো ধারনায় ছিল না। আর মিনু ভাবি তাদের মালিকের বৌ। কার ই বা অতো সাহস আছে যে তার ঠোঁটের দিকে তাকাবে, অথবা সে কোন রঙের লিপস্টিক ঠোঁটে দিয়েছে সেটা লক্ষ্য করবে? বা ধরা যাক আড়চোখের চোরা চাহুনিতে হয়তো এক আধবার দেখে নেয়াই গেলো যে আজ তার লিপস্টিকের রং লাল কিনা, তাই বলে প্রতিনিয়ত তা দেখা সম্ভব? তর্কের খাতিরে যদি এটাও সম্ভব বলে ধরে নেয়া হয়, তাই বলে তাদের মালিকের বৌয়ের লিপস্টিকের রং কি তাদের অফিসের গসিপের বিষয়বস্তু হতে পারে? আফসার ভাই আজ কি শুরু করলেন? নাকি তিনি আসলে এই প্রসঙ্গ তুলে তাদের পরীক্ষা করে দেখছেন? তারা তিনজনই নিদারুণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে জেরবার অবস্থায় বসে থাকে মুখে ক্যাবলা হাসি ঝুলিয়ে।

“গত তিন সপ্তাহ ধরে উনি একই শেডের লিপস্টিক লাগিয়ে আসছেন অফিসে। টকটকে লাল।”

কথাটা বলে কনফারেন্স রুমের চেয়ারে আরেকটু শরীর এলিয়ে দিয়ে বসে আফসার। যেন তার অব্জারভেশনের ব্যাপারে সবাইকে আরেকটু নিঃসন্দেহ করার প্রয়াসস্বরূপ বক্তব্যটি রাখলেন তিনি।

“মেয়েদের ফ্যাশান, জামাকাপড় পড়বার, নিজেদের সাজাবার রুচি কতো দ্রুত গতিতে বদলে গেলো, তাই ভাবছি। আমাদের ফিচার বিভাগে নতুন যে মেয়েটা জয়েন করলো … আরে …  কি যেন নাম ওর …?”

“পৃথু সোমা,” মিনমিন করে বলে তুহিন।

“হ্যাঁ, হ্যাঁ! পৃথু … পৃথু সোমা! আজকালকার ছেলেমেয়েগুলির নামও হয় বটে একেকরকম, মনে রাখতেও কষ্ট।” আমাদের জেনারেশনের নামগুলি দেখো, কতো সোজাসাপটা – আফরোজা বানু, শান্তা ইসলাম, ইসরাত জাহান, রোকেয়া বেগম, উম্মে কুলসুম, এক একটা প্রোটোটাইপ। আর ওদের নামের তো অর্থ বুঝতেও ডিকশনারি ঘাঁটা লাগে।”   

“কিন্তু আমাদের নাম তো সেই মান্ধাতার আমলেরই, আফসার ভাই,” শফিক তার বসের কথার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে, তবে খুব সাবধানে, ঠোঁটে একান ওকান বিস্তৃত হাসি ধরে রেখেই।

“না, সেটা ঠিক আছে,” আফসার হালকা টোনে বলে, “কিন্তু এই ‘পৃথু’ শব্দের মানেটা কি? ও নিজেও কি জানে?”

কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে আফসার ফের বলে, “ও তো আবার মিনু ভাবির উল্টো। মিনু ভাবির বয়স হয়েছে, তবুও টকটকে লাল লিপস্টিক মেখে অফিসে আসে। আর পৃথুর বয়স তো বোধয় এখনো পঁচিশও পেরোয় নি। ওর হাতের নেইলপলিশ থেকে নিয়ে ঠোঁটের লিপস্টিকের রং পর্যন্ত কালো।”

“না ভাই, যা ভাবতেসেন তা না,” সাজিদ একটু ইনফরমাল হওয়ার চেষ্টা করে তার বসের সঙ্গে। “মেয়ের বয়স আছে ভালোই।”

“তাই নাকি!” আফসার ভ্রূ কুঁচকায়।

“হ্যাঁ ভাই,” সাজিদ বলে, “ও এখনো ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট দেইখা হয়তো আপনি মনে করসেন ওর বয়স কম। ও কিন্তু ন্যাশনালে দুই বছর পইড়া তারপর প্রাইভেটে ভর্তি হইছে।”

“ওহ, এই কেস তাইলে!” আফসার হাসতে হাসতে বলে। “কিন্তু এতো জেনে তোমার কি লাভ হল বলো সাজিদ। পৃথু তো ডেস্কে বসে লিপস্টিক লাগাতে লাগাতে শফিকের দিকে আড়চোখে তাকায় কেবল। তোমরা এসব টেরটুর পাওনা?” শফিকের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকায় আফসার।

“কি যে বলেন আফসার ভাই,” শফিক মনে মনে প্রমাদ গোনে। “অফিসের কাজ করেই কূল পাই না, এসব কখন খেয়াল করবো।” মুখে ক্যাবলা হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও শফিকসহ বাকি দু’জন রিপোর্টার এটা জানে পৃথুকে ঘেঁষেই শফিক কাজ করছে এ অফিসে, আজ মাসখানেক। মেয়েটা অফিসে এসেই টিশার্টের ওপরের শার্টটা খুলে ঝুলিয়ে রাখে চেয়ারের পিছে। তারপর যেন খানিকটা ইচ্ছা করেই সিনা টানটান করে চুল টেনে বাঁধে প্রয়োজনের চে’ বেশি সময় নিয়ে। পরনের টিশার্ট ঢোলা হলেও শরীরের চড়াই উৎরাই ঐ ফাঁকে বেশ বোঝা যায়। শফিক আড়চোখে সে আগ্নেয়গিরির চুড়ার সৌন্দর্য অবলোকন করতে গিয়ে ধরা খায় একদিন সোমার চোখে। ধরা খাওয়ার পর, নিদারুণ অপরাধবোধে ভুগতে থাকা শফিক অবাক হয়ে সে চোখে রাগ, ঘৃণা, কিংবা বিরক্তির বদলে আবিষ্কার করলো কৌতুক। এ যেন পাকা মাছ শিকারির জাল ফেলে মাছ ধরবার মতোই মজাদার এক খেলা। চোখের ইশারায় সম্মতি আবিষ্কার করে শফিকের সোমাঘেঁষা অফিসজীবন শুরু। কপাল ভালো, আফসার ভাই তার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে কথা বলছেন না। না কি কথার আড়ালে আসলে তাই বোঝাচ্ছেন তিনি? চাকরিটা কি গেলো তবে শফিকের?

 


আফসার রাস্তার ডানদিক থেকে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসা প্রাইভেট কার আর সিএনজির সঙ্গে কোনক্রমে ব্যালান্স করে করে লাফিয়ে লাফিয়ে এক সময় রাস্তা পার হয়ে যায়। রাস্তার সাইডওয়াকে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে হালকা নীল – সাদা ইউনিফর্মের এক মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগেই গিয়েছিল আরেকটু হলে। কিন্তু দারুণ অ্যাথলেটিক দক্ষতায় নিজেকে সামলে নেয় আফসার। মনে মনে নিজের পীঠ চাপড়ে দেয়ার একটা আগ্রহ তৈরি হলেও ইউনিফর্ম পরিহিতার সঙ্গে থাকা গার্জিয়ান ভদ্রমহিলার অগ্নিদৃষ্টিতে আফসারের ইচ্ছে একদম মিইয়ে যায়।

 

“কি বিড়ি আছে তোমাদের পকেটে? দেখি, দাও তো একটা আমাকে।” আফসার দ্রুত প্রসঙ্গ বদলায়। “মার্লবোরো খাও না কেউ?”

“আমাদের মধ্যে ঐ গোল্ডলিফটাই চলে ভাই,” কাঁচুমাচু করে উত্তর দেয় সাজিদ। কণ্ঠ শুনে মনে হয়, শফিকের সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেও চাকরির ভয়ে আছে।

“আচ্ছা, তাই দাও একটা।”

আফসারের বাড়িয়ে দেয়া হাতে সিগারেটের প্যাকেট তুলে দেয় শফিক। বেনসনের প্যাকেটে গোটা চারেক গোল্ডলিফ। তারই একটা তুলে নিয়ে ঠোঁটে পোরে আফসার। শফিক নিজ থেকে বসের ঠোঁটে দেশলাই ঠুকে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মনে মনে ধরে নেয়, চাকরিটা হয়তো এ যাত্রা বাঁচলো। সোমা আজ থেকে তার আপন মায়ের পেটের বোন।

“শান্তিনগরের ওদিকটাতে ফুলের দোকান কোথায় আছে বলতে পারো কেউ?”                   

 কনফারেন্স রুমটাকে ধোঁয়ায় ধূসরিত করে দিয়ে প্রশ্ন করে আফসার।

“বেইলরোড সুইস বেকারির উল্টাপাশে একটা ফুলের দোকান থাকার কথা ভাই।” তুহিন বহুক্ষণ পর মুখ খোলে।

“উল্টাপাশে না, তারও আগে।” সাজিদ শুধরে দেয় তুহিনের দেয়া তথ্য।

“ওটা তো অনেক পুরনো দোকান। এখনো খোলা আছে?” আফসার জিজ্ঞেস করে।

“আছে ভাই,” সাজিদ জোর গলায় বলে। “তবে ছোট দোকান তো, মনোযোগ না থাকলে ক্রস কইরা চইলা যাবেন হয়তো, টেরও পাবেন না।”

“থ্যাঙ্কিউ তুহিন, থ্যাঙ্কিউ সাজিদ,” আফসার উঠে দাঁড়িয়ে দুজনের পীঠ চাপড়ে দেয়। “তোমাদের জন্য মোগলাই আনাতে পাঠিয়েছি। খেয়ে যেও। আজ আমি একটু আগে বেরুবো।”

পত্রিকা অফিসে চাকরির এ দিনগুলোতে, বসের নির্ধারিত সময়ের আগে কখনোই অফিস ছেড়ে না যাওয়ার যে নিয়ম তার ব্যত্যয়, একই সঙ্গে মোগলাই পরোটার অফারের দ্বিবিধ প্রেষণে সাজিদ, তুহিন, আর শফিক কিছুক্ষণ বলবার মতো কোন কথা খুঁজে না পেয়ে চুপচাপ বসে থাকে কনফারেন্স রুমে। শফিকের মনে অন্য ভয়। যাওয়ার আগে বস সাজিদ আর তুহিনের পীঠ চাপড়ে গেলেও তার পীঠ চাপড়ায় নি। তাহলে কি তার চাকরিটা আসলেই গেলো?        

অফিস থেকে আফসার বেরিয়ে আসে বেশ হন্তদন্তভাবে, তাড়াহুড়ো করে। অফিসের ঠিক সামনে যে রিকশাগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, তার একটায় চড়ে বসে সে ভাড়া ঠিক না করেই। রিকশাওয়ালার “কই যাইবেন” প্রশ্নের উত্তরে সে স্রেফ বলে, “বেইলিরোড”।

রিকশা এগিয়ে চলে নয়াপল্টন পেরিয়ে কাকরাইলের দিকে। ডান দিকে তাকিয়ে আফসার পুনরায় নিশ্চিত হবার চেষ্টা করে জোনাকি সিনেমা হলটা আসলেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিনা। পত্রপত্রিকায় পড়েছে, তারা নিজেরাও রিপোর্ট করেছে, তাও তার বিশ্বাস হয় না। যেমন আজ দেখা যাচ্ছে, হলের নীচে একটা কাবাবের দোকান, তার সামনে তন্দুর মুরগি টাঙ্গিয়ে রাখা আছে, ধোঁয়া ছড়াচ্ছে চারপাশে, সেই ধোঁয়ার সঙ্গে নিদারুণ খুশবু, তবুও তার বিশ্বাস করতে মন চায় না যে সিনেমা হলটা সত্যি সত্যিই বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকা শহরের তার শুরুর দিকের দিনগুলির স্মৃতি বিজড়িত প্রতিটি জিনিস একে একে উধাও হয়ে যাচ্ছে। সব সিনেমার হলগুলো উঠে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সিনেপ্লেক্স কালচার। একটা সংস্কৃতিকে আর একটা সংস্কৃতি প্রতিস্থাপন করা মানে আগের সংস্কৃতির ধারকবাহক যে মানুষগুলো – তাদেরও বাতিলের খাতায় চলে যাওয়া। আফসার শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

বেশীক্ষণ অবশ্য সে এরকম মনমরা হয়ে থাকার সুযোগ পায় না। হঠাৎ তার পকেটের মোবাইল ঝনঝনিয়ে বেজে উঠলে আফসার এমনভাবে চমকে লাফিয়ে ওঠে যে আর একটু হলে সে রিকশা থেকেই পড়ে যেতো। ফোন হাতে নিয়ে দেখে, সীমার ফোন। সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারা ছাইবর্ণ হয়ে যায়।

“এতো আওয়াজ কেন? বাসের হর্ন, গাড়ির প্যাঁ পোঁ? কই তুমি?”

“এইতো, অফিসের ছাদে এসেছি একটু।” আফসার ঢোক গিলে ভয়ার্ত কণ্ঠে জবাব দেয়। আশা করে, ফোনে তার কণ্ঠের এই কাঁপাকাঁপি বোঝা যাবে না।

“ছাদে এই সময় তোমার কি কাজ?”

সীমার ঝাঁঝালো প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে আফসার একদম চুপ মেরে যায়। 

“বুঝতে পেরেছি…” সীমা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে। আফসার উপর্যুপরি ঢোক গেলে। তাহলে কি সে ধরা পড়ে গেলো! 

“সিগারেট খাচ্ছ, তাই না?”

“হ্যাঁ,” আফসার উত্তর দিতে গিয়ে হাঁফছেড়ে বাঁচে। চুরি করে সিগারেট খেতে গিয়ে ধরা পরে গেছে বৌয়ের কাছে – এরকম অভিনয় করার জন্য কণ্ঠ খানিকটা মিনমিনে বানিয়ে নেয়।  

“কয়টা খেলে আজ সারাদিনে?” সীমার কণ্ঠের ঝাঁঝ ফোনের এপাশে, আফসারের গায়ে এসে লাগে। “ডক্টর না সম্পূর্ণ মানা করে দিলো তোমাকে?” কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার নিজেনিজেই সে গজগজ শুরু করে, “ধিঙ্গি একটা মেয়ে আছে ঘরে, কলেজে যাবার নাম করে যে সারা ঢাকা শহর টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। ছেলে একটার কোচিং থাকে বিকেলবেলা সপ্তাহে সাত দিন। এদের রাখালগিরি করা আর সংসার সামলানো – এই করতে করতে আমার জানটা বেরিয়ে যাচ্ছে। তুমি করোটা কি প্রতিদিন? বাড়ির কাজ তো কিছু না করো, নিজের শরীরের খেয়ালটা অন্তত রাখতে পারো। ডক্টর স্পষ্ট বলে দিয়েছেন সিগারেট খাওয়া যাবে না, আর তুমি বসে বসে একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকতে থাকো সারাদিন।”

এরই মধ্যে রিকশাওয়ালা প্রশ্ন করে বসে, “মামা শান্তিনগর মোড়েই নামবেন, না হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের পাশের গলি দিয়া ঢুকায়া দিমু?”

রিকশাওয়ালার প্রশ্ন শুনে আফসার প্রবলভাবে মাথা দুপাশে নেড়ে তর্জনী ঠোঁটের ওপর ঠেকিয়ে ইশারায় তাকে চুপ করতে বলে। ভয়ে সে আরেকটু হলে চলন্ত রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে যেতো। রিকশাওয়ালা পেছনে তাকিয়ে একবার অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে, তারপর কাঁধ শ্রাগ করে এগিয়ে চলে সামনে। সে তার প্রশ্নের উত্তর না পেলে কোন সমস্যা নেই। শান্তিনগর মোড়ে যদি প্যাসেঞ্জারকে নামিয়ে দেয়া যায় তো তার কিছু খাটুনি বাঁচে। অন্যদিকে টেলিফোনের ওইপাশে সীমা দীর্ঘক্ষন যাবত নীরব থাকায় আফসার ভয় পেয়ে যায় নতুন করে। সীমা কি তার মিথ্যে টের পেয়ে গেলো?

“আজ সন্ধ্যায় রিয়াসাতকে কোচিং থেকে নিয়ে আসতে পারবে, অফিস থেকে ফেরার পথে? আমি দিয়ে আসবো ওকে একটু পর। সন্ধ্যায় আজ আবার বের হতে ইচ্ছে করছে না।”

সে যে রিকশায় বৌ সেটা ধরতে পারে নি দেখে আফসার হাঁফছেড়ে বাঁচে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এও স্পষ্ট বোঝে, বাচ্চাকে কোচিং থেকে নিয়ে আসার প্ল্যানে সম্মতি জানালে তার বিকেল বেলার বিশেষ প্ল্যানটি মাটি হয়ে যাবে। তাই সে পুনরায় মিনমিন করে বলে, “আমার তো অফিস থেকে বের হতে আজ একটু দেরি হবে। একটা ফিচার এখনো হাতে পাওয়া বাকি। টেবিলে এলে পরে আরও খানিকটা ঘষামাজা করা লাগবে …”

“… বাসায় নিয়ে এসো হাতে করে।” আফসারের অসমাপ্ত বক্তব্যের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে একবাক্যে আফসারের মুখে কুলুপ এঁটে দেয় তার বৌ। “রাতে বাসায় বসে ঘষামাজা কোরো। একদিন একটু আগে বেরুলে কিছু হয় না।”              

ফোন বুক পকেটে চালান করে, রিকশাওয়ালার ভাড়া মেটানোর পর আফসার একটু সময় নিয়ে নিজেকে গোছায়। শার্টের কলারটা নেতিয়ে গেছে। ওটাকে বহু কষ্টে টেনে সোজা করে। কোমরের কাছটায়, শার্ট যেখানে প্যান্টের ভেতরের ইন করা, সেখানে শার্টের ভাঁজ একটু কুঁচকে গেছে। সে বেল্টের ফাঁকে আঙ্গুল গলিয়ে দিয়ে শার্টের ইন সোজা করে। প্যান্টের উরুর ওপরে ধুলো ঝাড়ার ভঙ্গীতে কয়েকবার চাপড় মারে। স্যান্ডেলের স্ট্র্যাপের ওপর ময়লা জমেছে। আশেপাশে তাকিয়ে কোন মুচি খুঁজে না পেয়ে অগত্যা পকেট থেকে টিস্যু বের করে উবু হয়ে বসে সেটা দিয়েই ঘষে ঘষে ধুলোময়লা মোছে। তারপর প্রবল বেগে দু’হাত ঝাড়া দিয়ে আঙ্গুলে লেগে যাওয়া ধুলোময়লাগুলো ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করে। পরিশেষে চুলে আঙ্গুল চালিয়ে চিরুনির কাজ সেরে বেইলি রোডের ডানদিকের ফুটপাথ ধরে হাঁটা শুরু করে সে, বামে চোখ রেখে। ফুলের দোকানের খোঁজ তার প্রখর দৃষ্টিতে। ফাঁকেতালে চোখ পড়ে প্রায় প্রতিটি দোকান ও তার উপরের বিলবোর্ডে। আজকাল চারপাশে তাকালে মনে হয় যে পৃথিবীতে মানুষের করার মতো কাজ আছে কেবল দুটো। এক, ফার্স্টফুড বা রিচফুড খাওয়া; দুই, কেতাদুরস্ত জামাকাপড়, জুতো পরে ক্যামেরার সামনে পোজ দেয়া। কি যে বাজে এক অবস্থা!

 


আফসার টাকা পরিশোধ করার সময় গুনে দেখে, ফুলের সংখ্যা আদতে আরও তিনটা কম। বেশীর ভাগই হলদে গোলাপ, লাল গোলাপের সংখ্যা বেশ কম। প্রায় পাঁচভাগের একভাগ। এতো লাল গোলাপ কেন কেনে মানুষ? হলুদ গোলাপে কি ভালোবাসা ঠিকভাবে প্রকাশ পায় না?

 

খানিক হাঁটার পরেই ফুলের দোকানটা চোখে পড়ে। আসলেই ছোট্ট। বেইলি রোডের চড়া দোকান ভাড়ার মধ্যে ফুল বিক্রি করার বড় দোকান খুলে বসা প্রায় অসম্ভব। ফুল খাসির মাংসের সাথে মিলিয়ে, বা মেয়নেজ – সসে ডুবিয়ে খাওয়া যায় না। আবার সারা শরীরে খালি ফুল জড়িয়ে রাস্তায় বেরও হওয়া যায় না। আফসার রাস্তার ডানদিক থেকে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসা প্রাইভেট কার আর সিএনজির সঙ্গে কোনক্রমে ব্যালান্স করে করে লাফিয়ে লাফিয়ে এক সময় রাস্তা পার হয়ে যায়। রাস্তার সাইডওয়াকে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে হালকা নীল – সাদা ইউনিফর্মের এক মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগেই গিয়েছিল আরেকটু হলে। কিন্তু দারুণ অ্যাথলেটিক দক্ষতায় নিজেকে সামলে নেয় আফসার। মনে মনে নিজের পীঠ চাপড়ে দেয়ার একটা আগ্রহ তৈরি হলেও ইউনিফর্ম পরিহিতার সঙ্গে থাকা গার্জিয়ান ভদ্রমহিলার অগ্নিদৃষ্টিতে আফসারের ইচ্ছে একদম মিইয়ে যায়।

আফসার ভিড় ঠেলে গিয়ে দাঁড়ায় ফুলের দোকানের সামনে।

দোকানে কেবলমাত্র একটি মেয়ে বসা, খুব টিপটপ সালোয়ার কামিজে। দোকানে হলুদ, কমলা, গোলাপি রঙের ফুল থরে থরে সাজানো। তার মধ্যে হলুদ কামিজ, আর সাদা সালোয়ার – ওড়নায় মেয়েটা মোটামুটি মিশে আছে দোকানের ফুলগুলোর সাথে। পায়ের ওপর পা তুলে ছোট টুলের ওপর তার বসে থাকার স্টাইলে তাকে খানিকটা অন্যমনস্ক, খানিকটা বিষণ্ণ লাগছে। তার হাতে যে স্মার্টফোন ধরা, তাতে ম্যাসেঞ্জারে ক্রমাগত নতুন ম্যাসেজ আসার টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকা মেয়েটার কোন খবর নেই। সে কেন এখানে বসা? মনে মনে ভাবে আফসার। নিশ্চয়ই কোন উৎসব উপলক্ষে সে ফুল কিনতে এসেছে এখানে। খুব সম্ভবত গায়ে হলুদের ফুলই সে অর্ডার করতে এসেছে। তাকে কি আফসার জিজ্ঞেস করবে, ফুলের দোকানি কই গেছে? কিংবা, তার ফিরতে কতক্ষণ লাগবে? আফসারের প্রশ্ন করে ওঠা হয় না। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা নিজেই খেয়াল করে আফসারকে, এবং তাকে চমকে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “স্যার, ফুল খুঁজছিলেন?”

“হ্যাঁ,” আফসার খুব আলগোছে উত্তরটা দেয়, এমনভাবে, যেন তার আদতে কোন প্রয়োজন নেই ফুলের। এমনিতেই সে এসে দাঁড়িয়েছে এই ফুলের দোকানের সামনে, আর ফুলের দোকানে এসে হাজির হলে ফুল কেনাই দস্তুর, তাই সে হ্যাঁ বলেছে। এ নিয়ে তার কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না।

“শিওর স্যার। কোন অনুষ্ঠানের জন্য? তবে এই ফ্লাওয়ার বুকেগুলো দেখতে পারেন। ছোট-বড়-মাঝারি নানান সাইজের আছে।” মেয়েটা তাকে সাজিয়ে রাখা কিছু ফুলের তোড়া দেখায়। “নামিয়ে দেখাব স্যার?”

তাক থেকে নামাতে উদ্যত হলে আফসার বাঁধা দেয় তাকে।

“আপনি কি নির্দিষ্ট কোন ফুল খুঁজছেন?” আফসারের তরফ থেকে বাঁধা পেয়ে মেয়েটাকে একটু কনফিউজড লাগে। “আমাদের এই চন্দ্রমল্লিকা ফুলগুলো দেখতে পারেন। বাকি ফুলগুলো সকালের। এগুলো মাত্রই এসেছে। একদম তাজা।”

আফসার তাকিয়ে তাকিয়ে চন্দ্রমল্লিকা ফুল দেখে। গোলাপি, লাল, হলুদ, কমলা, সাদা – এই পাঁচ রঙের চন্দ্রমল্লিকা একটা ঝুড়ির মধ্যে সাজিয়ে রাখা। তাদের তাজা ভাব ফুটিয়ে তোলার জন্যেই ওপরে হালকা করে পানি ছিটানো। ওদিকে মেয়েটা ফুলের ফিরিস্তি দিয়েই চলেছে ক্রমাগত। জানা গেলো, তার সংগ্রহে আরও আছে গোলাপ, অর্কিড, লিলি, দোলনচাপা।

“ফুল কেন নেবেন স্যার? গায়ে হলুদের জন্য?”

মেয়েটার আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ায় আফসার কিছুটা বিরক্ত হয়। শুধু গায়ে হলুদের জন্যই ফুল কিনতে হবে কেন? কেউ কি এমনি এমনি ফুল কিনতে পারে না? নাকি মেয়েটার বিবেচনায় আফসার এমনি এমনি ফুল কেনার বয়স পার করে এসেছে?      

“গোলাপ চাই আমার,” মেয়েটার ছুঁড়ে দেয়া বিবিধ প্রশ্নের মাঝে আফসার কেবল সেই প্রশ্নটাকেই উত্তর দেবার জন্য বেছে নেয়, যা তার কাছে সমীচীন মনে হয়। তারপর সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

“কয়টা গোলাপ নেবেন, স্যার?”

মেয়েটা এবারে আকর্ণবিস্তৃত হাসিতে একদম ঝলমলিয়ে ওঠে। তারপর সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অর্ধেক পানিভর্তি বালতিতে ডুবিয়ে রাখা গোলাপ ফুলগুলো আগপিছ করে তাদের সংখ্যা গুনে দেখায়। আফসার এবারেও সরাসরি তার প্রশ্নের উত্তর দেয় না। ভাবে, মেয়েটা এখন আর কেন জিজ্ঞেস করছে না যে সে গোলাপ কেন চায়? এতক্ষণ ধরে কেবল – ‘কি কারনে ফুল চাই? কি কারনে ফুল চাই?’ জিজ্ঞেস করে করে আফসারের মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিল। এখন যখন সে বললই যে তার গোলাপ ফুল চাই, তখন আর গোলাপ ফুল কেন চাই, বা গোলাপ দিয়ে তার কি দরকার, অথবা সে কাকে গোলাপ দেবে – এসমস্ত প্রশ্ন না করে গোলাপ ফুলের সংখ্যা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু কেন? আফসারের বয়সী একটা লোক এসে যদি বেইলি রোডে গোলাপ ফুল কিনতে চায়, সেটা কি আর কোন কৌতূহল – উদ্দীপক ঘটনা নয়? আফসার কি আর পারে না, গোলাপ ফুল হাতে বেইলি রোডে দাঁড়িয়ে থাকতে? 

“কি কালারের গোলাপ নেবেন, স্যার? আর কয়টা গোলাপ লাগবে, তাও তো বললেন না।” মেয়েটা এতক্ষণে সব রঙের গোলাপ মোটামুটি সাজিয়ে আলাদা আলাদা করে ফেলেছে।

“আমার একশোটা গোলাপ লাগবে,” ফস করে উত্তর দিয়ে আফসার চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। যেন তার বরাবর একশোটা গোলাপই কেনার কথা ছিল। যেন সে ফুলের দোকানে এলে সবসময় একশোটা গোলাপই কেনে। যেন মেয়েটা তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এতোগুলো প্রশ্ন করার বদলে সরাসরি ‘কয়টা গোলাপ লাগবে?’ – এই প্রশ্নটি করলেই পারতো।

“ওহ!” মেয়েটা একটা অস্ফুট শব্দ করে অন্যমনস্ক ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলেও মেয়েটার দিক থেকে কোন সারাশব্দ না এলে আফসার একটু নড়েচড়ে ওঠে। এই মেয়েটিরও কি একশো গোলাপ সংক্রান্ত কোন স্মৃতি আছে? সে কি কারো কাছ থেকে একশোটি গোলাপ পেয়েছিল কখনো? নাকি সে আশা করেছিল কারো কাছ থেকে পাওয়ার, কিন্তু পায় নি?

“দুঃখিত স্যার, আমাদের ভিন্ন ভিন্ন কালারের যতগুলো গোলাপ আছে, তার সবগুলো মিলিয়েও এ মুহূর্তে ১০০টা গোলাপ হবে না।” মেয়েটার খানিক কাঁচুমাচু ভঙ্গীতে দেয়া উত্তরে আফসারের মোহভঙ্গ হয়।

“কি কি কালারের কয়টা গোলাপ আছে আপনার কাছে এ মুহূর্তে?”

“বিকেল বেলা তো স্যার,” মেয়েটা বলে। “বেশীরভাগ গোলাপ বিক্রি হয়ে গেছে। লাল – হলুদ, এই দুই কালার মিলায়ে চল্লিশটা হবে সর্বমোট।”

 


আফসার অবাক হয়ে আবিষ্কার করে যে, তার কান গরম হয়ে উঠছে। সে ব্লাশ করছে। হিরো? সুন্দর? লালটু? টাকার বদলে গোলাপ? আফসার কি এখনো আগের মতোই আকর্ষণীয়?

 

আফসার টাকা পরিশোধ করার সময় গুনে দেখে, ফুলের সংখ্যা আদতে আরও তিনটা কম। বেশীর ভাগই হলদে গোলাপ, লাল গোলাপের সংখ্যা বেশ কম। প্রায় পাঁচভাগের একভাগ। এতো লাল গোলাপ কেন কেনে মানুষ? হলুদ গোলাপে কি ভালোবাসা ঠিকভাবে প্রকাশ পায় না?

একটা তোড়া হিসেবে ফুলগুলো যখন আফসারের হাতে তুলে দেয়া হল, সবমিলিয়ে বেশ সুন্দরই লাগলো তার। সাজানোটা সুন্দর হয়েছে। বেশ কিছু হলদে গোলাপের ফাঁকে ফাঁকে লাল গোলাপ ঢুকিয়ে দিয়ে ভালো একটা নকশা তৈরি করা হয়েছে। তোড়াটা বেশ বড়, দু’হাতে মুঠ করে ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে তার। গোলাপগুলো সাইজেও বেশ বড়। তবে অবশ্য সকালবেলার জিনিস বলে শুকিয়ে গেছে। ক্রমাগত পানি দিয়ে তাজা রাখার চেষ্টায় কোন ত্রুটি করা হয় নি যদিও। ফুল হাতে আফসার হাঁটা শুরু করে বেইলি রোড মহিলা সমিতি পার হয়ে ভিকারুন্ননিসা – সিদ্ধেশ্বরী কলেজের দিকে। রাস্তা জুড়ে ছুটে চলা মানুষের ভিড়। স্কুল – কলেজ ফেরত মেয়েদের শরীরে সারাদিন সেঁটে থাকা ইউনিফর্মে ঘামের গন্ধ। আফসারের অন্যরকম লাগে। মিশ্র, অপরিচিত এক অনুভূতি। আফসার হাঁটতে হাঁটতে ইতিউতি চায় সেসব টিনএজ মেয়েদের দিকে। তার ভেতরে কাজ করে পাপবোধ, একই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পর্দার আড়ালে অবগুণ্ঠিত এক জীবনে উঁকি মারবার উত্তেজনা। আফসার আস্তে আস্তে হাঁটার গতি বাড়ায়। পাকা ফুটবলারের মতো পথচারীদের ড্রিবল করতে করতে এগিয়ে চলে সে। তারপর, হঠাৎ ধাক্কা খায়  প্রায় তার মাথার সমান উচ্চতার সালোয়ার – কামিজ পরিহিত এক মহিলার সঙ্গে। তবে মহিলাদের শরীরে যে পেলব কোমল কমনীয়তার কথা গল্প উপন্যাসে লেখা থাকে, তার বদলে হাড় ঠনঠনে শরীরের ধাক্কায় আফসারের শরীর ঝনঝনিয়ে ওঠে। আফসারের চোখ তুলে চাওয়া লাগে না, উঁচুতানে বাঁধা মহিলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরই স্পষ্ট করে দেয়, ভুল বোঝাবুঝিটা কোথায় হয়েছে।

“অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁই হিরোওওওওওও  !!!”

আফসারের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, তার বা তাদের মুখোমুখি হতে কেউ চায়না কখনো। বিশেষ করে আজ, এই মুহূর্তে আফসার তো একেবারেই চায় নি কোন তৃতীয় লিঙ্গের মুখোমুখি হতে। চাওয়া – পাওয়া খাপে খাপে মিলে যাবার ঘটনা অবশ্য আফসারের জীবনে ঘটে না সচরাচর।

“দাও দাও। দশটা টেকা দাও।”

আফসার এবার ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকায় তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকা হিজড়ার দিকে। আফসারকে থিতু হবার সুযোগ না দিয়ে সে আবারো বলে, “ওরে আমার হিরো রে! কি সুন্দর দেখতে গো তুমি! এতোগুলি গোলাপ নিয়া কই যাও? দাও, দশটা টেকা দাও।”

শেষ বাক্যটির ওপর জোর কিছুটা কমে এলো দ্বিতীয়বারে। আফসার অবাক হয়ে দেখে, হিজড়াটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আঙ্গুলের ডগায় চুল জড়িয়ে নখরা দেখাচ্ছে।

সে কি তাকে সুন্দর বলল? আফসার উত্তর দেয়ার ভাষা খুঁজে পায় না।

“আরে আমার লালটুরে, টাকা না দিতে চাইলে না দিবা, গোলাপও তো দিতে পারো একটা।”

এই বলে সে খাবলা মেরে একটার বদলে চারটা গোলাপ তুলে নেয় আফসারের তোড়া থেকে। খাবলা দিতে গিয়ে তার হাতে গোলাপের কাঁটা বিঁধে যায় এবং সে সঙ্গে সঙ্গে আউ আউ করে লাফিয়ে ওঠে। এই পুরো কার্যক্রম এবং উচ্চিংড়ের মতো লম্ফনে বিন্দুমাত্র রমণীয়তা নেই, তবুও সে হিজড়ে নারীত্বের সমস্ত বিষবেদনা সহকারে কাঁটা ফোঁটা আঙ্গুলটা মুখে পুরে দেয়, এবং ভ্রু নাচিয়ে আড়ে আড়ে চায় আফসারের দিকে। তারপরে সে ঝাপ করে লাফিয়ে উঠে টুকুস করে চুমু খায় আফসারের গালে। সবকিছু এতো দ্রুতগতিতে ঘটে যায় যে আফসার প্রতিক্রিয়া দেখানোরও সময় পায় না। আফসারকে বিদায় জানাতে সে হিজড়া খাতিয়া বারলুস্কনির পিয়ানো বাজানোর আদলে আঙ্গুল পিলপিল করে সঞ্চালন করে। তারপর ছুটে চলে যায় সামনে।

আফসার অবাক হয়ে আবিষ্কার করে যে, তার কান গরম হয়ে উঠছে। সে ব্লাশ করছে।

হিরো? সুন্দর? লালটু? টাকার বদলে গোলাপ? আফসার কি এখনো আগের মতোই আকর্ষণীয়?

কিছুক্ষণ পর, আফসারকে দেখা যায় সিদ্ধেশ্বরী কলেজ পার হয়ে যে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে, সে রাস্তার পাশে বসে থাকতে। আফসারের পাশে অদূরেই একটি মেয়ে বসা। তার শরীরে আস্ঠেপৃষ্ঠে টাইট করে জড়ানো একরঙা এক লাল সুতি শাড়ি। শাড়ির নীচে কালো স্লিভলেস ব্লাউজ। গলায়, কানে হালকা কিছু অলঙ্কার। হাতের ধাতব বালাটায় শেষ বিকেলের সূর্যের আভার প্রতিবিম্ব। আফসার তার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। ধুলোবালি, খাপছাড়া কিছু নুড়িপাথর, ইতস্তত এখানে ওখানে পড়ে থাকা বেনসনের একটা চিঁড়েচ্যাপটা প্যাকেট, দুটো আধখাওয়া সিগারেট, এগুলো অতিক্রম করার পর মেয়েটার পা জোড়া। শাড়ির ফাঁক দিয়ে অল্প করে বেরিয়ে আছে তার কালো পেটিকোট। কালো পেটিকোটের ফিতে হয় কোন রঙের? লাল? শাড়ি, পেটিকোটেরও নীচে, লালরঙা হিলজুতোর স্ট্রাপে জড়ানো তার পা। ঝলমলে সে জুতোর গায়ে ইংরেজি হরফে বড়বড় করে লেখা – ‘জুসি’। জুসি মানে রসালো। জুতোর ওপর জুসি লেখার অর্থ কি? কোন জিনিসটা রসালো, এখানে? জুতোর সামনে বেরিয়ে আছে ডান পায়ের পাঁচটি আঙ্গুল। পেডিকিওর করা ধবধবে সাদা পা। দারুণ আঙ্গিকে কেটে রাখা পায়ের নখের ওপর টুকটুকে লাল নেইলপলিশ।                           

মেয়েটা মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে সেলফি তোলার চেষ্টা করে, ঠোঁটজোড়া হাঁসের মতো সরু করে। একে সম্ভবত পাউট করা বলে, আফসার ফেসবুকে দেখেছে এই স্টাইল, আর এই নাম। প্রথমে মোবাইলটা ডানহাতে উঁচু করে ধরে, বাম হাতে পুরো শরীরের ভর এনে, শরীর পেছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে, মাথা বাম কাত করে সে কয়েকটা ক্লিক করে। তারপর সে দু’হাতে ফোনটা পাকড়ে সামনে ঝুঁকে আসে, ওর আঁচল বুকের ওপর থেকে আলগোছে খসে যায়, গালে দুর্দান্ত টোল ফেলে কয়েকটা ক্লিক করা মাত্রই সে টের পায়, আফসার ঠায় তাকিয়ে আছে তার দিকে।

“আপনার হাতের গোলাপগুলো সুন্দর,” মেয়েটা তার চোখে চোখ রেখে বলে। আফসার চোখ সরানোর সময় পায় না। ২২ গজের ক্রিকেটে সরাসরি কট অ্যান্ড বোল্ড হবার অবস্থা।

“এতোগুলো গোলাপ দিয়ে আপনি করবেন কি?”

“সাইত্রিশটা,” আফসার সঙ্গে সঙ্গে গোলাপের সংখ্যা তাকে বাতলে দেয়, যেন ফুলের সঠিক সংখ্যাটি তাকে জানিয়ে দেয়া আফসারের নৈতিক দায়িত্ব। পরক্ষনেই তার মনে পড়ে, একটু আগেই এক হিজড়া এসে তার কাছ থেকে ছোঁ মেরে চারটা গোলাপ নিয়ে গেছে। “তেত্রিশটা, আসলে গোলাপ আছে তেত্রিশটা, এখানে,”

“কেন, তেত্রিশটা কেন? মাত্রই না বললেন সাইত্রিশটা?” মেয়েটার কণ্ঠে অল্পবিস্তর বিস্ময়। “আই মিন সাইত্রিশটাই বা কেন? অড একটা নাম্বার।”

 


উত্তর দিতে গিয়ে সে আরও একবার মেয়েটার দিকে তাকায়, তার শরীরের বাঁকগুলোর ওপর চোখ গিয়ে পড়ে তার, এবং সে পুনরায় বাকরহিত হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে কেবল সেনিটাইজারের কৌটাটা উঁচু করে ধরতে পারে সে, মেয়েটার চোখ বরাবর। বিপরীতে মেয়েটা ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে রাখে।

 

আফসার চিন্তা করে, পুরো ফিরিস্তিটা সে দেবে কিনা। খুলে বলবে কিনা, কীভাবে গোলাপের সংখ্যা একশো থেকে চল্লিশ, চল্লিশ থেকে সাইত্রিশ, এবং সবশেষে সাইত্রিশ থেকে তেত্রিশে এসে ঠেকল। গল্পটা অবশ্য তেমন ইন্টারেস্টিং না, আর বেধড়ক লম্বা।   

“এক হিজড়া চারটা ফুল নিয়ে গেছে,” আফসার সংক্ষেপে বলে।

“হিজড়ে এসে নিয়ে গেছে!” মেয়েটা দুলে দুলে হাসতে থাকে আফসারের কথা শুনে। হাসি তার থামতেই চায় না। আফসার প্রথম প্রথম চেষ্টা করে ওর হাসির সঙ্গে মিলিয়ে নিজেও খানিকটা হেসে নেবার। কিন্তু সত্যি সত্যি হাসি না এলে আফসার হাসতে পারে না। কাজেই, একপর্যায়ে সে চুপচাপ বসে থাকে।

“একি, আপনার গাল আর কান লাল হয়ে উঠছে কেন!” মেয়েটা হাসতে হাসতে পেছনে হেলে পড়ে অনেকখানি। “আপনি নিজেই প্রপোজ করতে গিয়েছিলেন নাকি ওকে?” বলে আবারো একপসলা হাসি। মোবাইল আঁকড়ে ধরা ডান হাতটা মুখের কাছে তুলে এনে মুখ চাপা দেয়ার চেষ্টা করা মাত্র তার পেটের কাছটায় শাড়ি সরে যায় অনেকখানি। শাড়ির নীচে চাপা পড়া আবছা আঁধারেও সে মসৃণ ত্বকের ঔজ্জ্বল্য ঠিকরে বেরোয় একশো ওয়াটের বাল্বের মতো। আফসার চেষ্টা করেও তার চোখ সরাতে পারে না, এবং এক পর্যায়ে সে টের পায়, আবারো সে কট অ্যান্ড বোল্ড হয়ে গিয়েছে মেয়েটির চোখে। লজ্জায় যে চোখ নামিয়ে ফেলবে, তার ভেতরে সে শক্তিটুকুও কাজ করে না। আজ এমন সব কাজ সে একের পর এক করে চলেছে – যা সে জীবনে শেষ কবে করেছে, তার মনে নেই। এসমস্ত কাজে সে পটুও নয়। তবুও, চলছে গাড়ি যাত্রাবাড়ি। আফসারকে বিস্ময়াভিভূত করে দিয়ে মেয়েটি শাড়ির পাড় টেনে শরীর ঢেকে ফেলে না। তার চেহারায় কোন ক্ষুব্ধতা বা অপমানের চিহ্নও নেই। বরং তার ঠোঁটের কোনে ঝুলে আছে কৌতুক মাখা হাসি।

“দেখুন তো ব্যাপারটা,” মেয়েটা হাসিমুখেই বলে, “এতক্ষণ আমরা বসে আছি পাশাপাশি, অথচ আপনার ব্যাপারে কিছুই জানা হোল না আমার।”

“না না, একদম ঠিক আছে,” আফসার লজ্জাবনত কণ্ঠে বলে। “আমি নিজেও তো আপনার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করি নি এখনো,”

“তা আলাপ যে আপনাকেই শুরু করতে হবে, এমন কসম তো আপনি খান নি আমার সাথে, তাই না?” আফসার অবাক হয়ে খেয়াল করে, মেয়েটা হাসলে তার গালের টোলটা আসলেই খুব সুন্দর লাগে। “একজন নারী আর একজন পুরুষের মধ্যকার আলাপ সবসময় একজন পুরুষেরই শুরু করা লাগবে, এটা একটা পিউরিটান অ্যাপ্রোচ। সেকেলে চিন্তা। আজকাল চলে না এসব।” তারপর, একটু থেমে সে বলে, “অন্তত আমি তা মানি না।”

সে পুনরায় তার দুটো হাত সাইড ওয়াকের ওপর রেখে শরীর পেছন দিকে এলিয়ে দিলে শাড়ি ভেদ করে তার বুক উঁচু হয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসে। আফসারের একবার মনে হয়, তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া জরুরী যে, এখনো করোনার প্রভাবমুক্ত হয় নি গোটা পৃথিবী। হাত এভাবে সড়কের ওপর রেখে এঁটো করা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু একবার মেয়েটার শরীরের বাঁকগুলোর ওপর নজর পড়লে মুখ দিয়ে আফসারের আর কোন শব্দ বেরোয় না। আবারো একবার মেয়েটার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলে আফসার তড়িঘড়ি করে তার পকেট থেকে হ্যান্ড সেনিটাইজার বের করে এগিয়ে ধরে তার দিকে। মেয়েটা মিষ্টি করে হেসে খানিকটা সেনিটাইজার হাতে ঘষে নিয়ে নাকের কাছে ঠেকিয়ে ধরে হাতজোড়া।

“মিষ্টি ঘ্রাণ। কোন সেনিটাইজার ব্যবহার করেন আপনি?” সে প্রশ্ন করে।

আফসার তার সেনিটাইজারের ব্র্যান্ডের নাম জানে না। পকেট থেকে আলগোছে বের করে দেখে, কোন পরিচিত ব্র্যান্ডও নয়। স্যানজেল। উত্তর দিতে গিয়ে সে আরও একবার মেয়েটার দিকে তাকায়, তার শরীরের বাঁকগুলোর ওপর চোখ গিয়ে পড়ে তার, এবং সে পুনরায় বাকরহিত হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে কেবল সেনিটাইজারের কৌটাটা উঁচু করে ধরতে পারে সে, মেয়েটার চোখ বরাবর। বিপরীতে মেয়েটা ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে রাখে। সে এমন এক হাসি – যা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, মেয়েটা আফসারের ভেতর বাহির আদ্যোপান্ত পড়তে পারছে। 

“আমি আপনার ক্রাইসিসটা বোঝার চেষ্টা করছি,” সে ভ্রূ কুঁচকে খুব চিন্তিত ভঙ্গীতে কথাটা বলে। “আপনি মিডলাইফ পার করছেন। ফিল করছেন যে লাইফ সবদিক থেকে আটকে গেছে। কাজেই আপনি খুব ডেস্পারেটলি চেষ্টা করছেন মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার। মানুষের কাছে এখনো আপনার ভ্যালু আছে – নিজের কাছে তা প্রমাণ করবার, আর আজকের দিনটা আপনার সেসমস্ত প্রচেষ্টারই  কন্টিনিউয়েশন,” মুখ জুড়ে বিজয়ীর হাসি ছড়িয়ে দিয়ে সে বলে, “কি, ঠিক বলেছি না?”

জবাবে আফসার কিছু বলে না। চুপ করে বসে থাকে।

“আপনি বিবাহিত, তাই তো? বাচ্চা? বাচ্চাও আছে?” আলগোছে চোখা প্রশ্নগুলো ধারালো ছুরির মতো আফসারের সামনে সাজিয়ে রাখে সে। 

আফসার এবার মাথা নাড়ে কেবল। উপরে নীচে।

“ঘরে বৌ – বাচ্চা ফেলে আজ আপনি বেরিয়ে পড়েছেন চিট করতে, তাইতো? আপনার ফুরিয়ে যাওয়া, বুড়িয়ে যাওয়া ফ্র্যাজাইল মেইল ইগোকে তাগড়া রাখতে এখন আপনার প্রয়োজন কচি মেয়েদের অ্যাটেনশন?”

জবাবে এবারেও আফসার কিছু বলে না। কিন্তু তার পেটের মধ্যে গুড়গুড়িয়ে একটা প্রশ্ন জেগে ওঠে। একবারের জন্য তার ইচ্ছে করে মেয়েটাকে এ প্রশ্ন করতে যে, সে সত্যিসত্যিই নিজেকে কচি মনে করে কিনা।

“এই যে আমি নিজে থেকে এতো কথা বলছি আপনার সাথে, আপনাকে অ্যাটেনশন দিচ্ছি, আপনার ভালো লাগছে না?”

আফসার মৃদু হাসে।

“আচ্ছা যন্ত্রণা বাবা!” মেয়েটা অবাক হয়, বা অবাক হবার ভান করে। “যেচে কথা বলছি বটে, তাই বলে আপনি এভাবে মুখে ছিপি এঁটে বসে থাকলে তো আমার পক্ষে একা আলাপ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।”

আফসার একটু গলা খাঁকড়ি দেয়, “আসলে এভাবে…” এই পর্যন্ত বলার পর তার কণ্ঠস্বর চীরে আসে খড়খড়ে গলা বেয়ে। সে দু’বার গলা খাঁকড়ি দিয়ে আবারো শুরু করে, “আসলে এভাবে, মানে এরকম পরিবেশে বসে কথা বলার অভ্যাস নেই আজ অনেক দিন হল,”

“তাই নিজে থেকে কিছু বলতে পারছেন না, তাই তো?”

জবাবে আফসার মাথা নাড়ে।

“আচ্ছা, তাহলে এক কাজ করা যাক,” মেয়েটা ভ্রূ কুঁচকে গভীরভাবে চিন্তা করার ভঙ্গীতে থাকে কিছুক্ষণ। “তাহলে কথা আমিই বলি, আপনি কেবল আমার কথাগুলোর শেষে ট্যাগ কোশ্চেন যুক্ত করতে থাকবেন, যাতে আমি আমার বকবক সামনে টেনে নিয়ে যেতে পারি।”

এই বলে মেয়েটা জিজ্ঞাসু চোখে আফসারের দিকে তাকায়।

“কই, শুরু করুন!” মেয়েটা হুড়ো লাগায় আফসারকে, ত্রিশ সেকেন্ড চুপ করে বসে থাকার পর। “প্রশ্ন করুন। বলুন – ঠিক আছে, এটাই তাহলে নিয়ম?”

আফসার প্রায় তোতাপাখির মতো পুনরাবৃত্তি করে, “ঠিক আছে, এটাই তাহলে নিয়ম?”

“হ্যাঁ,” মেয়েটার উচ্ছল হাসি কাঁচের মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছিটিয়ে পড়ে রাস্তায়। তারপর রোদ হয়ে মিশে যায় পীচ ঢালা পথের শরীরে। “এটাই নিয়ম।” তারপর রহস্যময়ী দৃষ্টিতে আফসারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “আমি আজ এখানে, এই সময়ে, সেজেগুজে বসে আছি কেন, জানেন?”

আফসার কনফিউজড দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটার দিকে। তাকে অর্ডার করা হয়েছে বাক্যের শেষে ট্যাগ কোশ্চেন বানানোর। এই বাক্যের ট্যাগ কোশ্চেন কীভাবে বানানো যায়?

“আরে, আপনি তো দেখছি পুরো মাছি মারা কেরানী!” মেয়েটা চোখ কপালে তুলে বলে। “প্রত্যেক বাক্যকে ট্যাগ কোশ্চেন তো বানানো যাবে না। নতুন নিয়ম – ইয়েস নো, অথবা ডব্লিউ এইচ কোশ্চেনস করলে আপনাকে উত্তর দিতে হবে। ঠিক আছে?”

“ইয়েস!” আফসার সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে।

আফসারের ইংরেজিতে দেয়া উত্তর শুনে মেয়েটা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।

 


মেয়েটা ঝুঁকে আসে আফসারের দিকে। ঘেঁষে বসে খানিকটা, আফসারের শরীরের সঙ্গে। সিগারেটের শেষ মাথা আগুনের প্রান্তে ধরে লম্বা একটা টান দেয়। গ্রিবার রগ টানটান হয়ে ওঠে, শাড়ির ফাঁক গলে ফিনফিনে ব্লাউজে ঢাকা একটা স্তন প্রায় উন্মোচিত হয়ে যায়।

 

“শুনুন, আমিও আপনার মতো একটা সম্পর্কে আছি,” হাতের নেইল পলিশ চোখের খুব সামনে এনে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলে সে। “আপনার মতো বলতে, বিবাহিত নই, তবে একটা স্টেডি রিলেশন আছে অনেকদিনের। আমিও আপনার মতো বোরড হয়ে চিট করতে বেরিয়ে পড়েছি আজ।”

“চিট করতে?”

আফসারের ট্যাগ কোশ্চেনের সঠিক ব্যবহারে বিনোদিত মেয়েটি পুনরায় প্রাণোচ্ছল হাসিতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে।

“ঠিক শুনেছেন, চিট করতে।”  

একটু বিরতি নিয়ে সে আবারো বলে, “আমার স্টেডি বয়ফ্রেন্ড ইদানীং দেখা করতে চাইলে কাজের চাপের হাইকোর্ট দেখাচ্ছে। কাজেই আমিও ওকে হাইকোর্ট দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। বেরিয়ে পড়ছি এরওর সাথে নতুন অ্যাডভেঞ্চারে।”

“আজকের বেরিয়ে পড়াটাও তবে সেই অ্যাডভেঞ্চারেরই অংশ?”

“আরে বাহ! নিজে থেকে প্রশ্ন তৈরি করছেন! ইম্প্রেসিভ উন্নতি!” মেয়েটা চোখ মটকে বলে। “আজকে যার সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চার, সে এই চলে এলো বলে।”

আফসার আস্তে করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। আর ঠিক এমন সময়ে মেয়েটার ফোন বেজে ওঠে মিষ্টি করে।

“হ্যাঁ, আমি সিদ্ধেশ্বরী কলেজের পাশে বসা,” ফোন কানে ঠেকিয়ে কণ্ঠ ঘন করে বলে সে। “বেইলি স্টারের দিকে এগোবো? ঠিক আছে, আসছি।”

ফোনটা রেখে দিয়ে মেয়েটা তার পার্স থেকে একটা সুদৃশ্য ধাতব কৌটার ভেতর থেকে খুব সরু এবং লম্বা একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটের কোনে ঝোলায়। তারপর কিছু একটার খোঁজে তার সম্পূর্ণ পার্স তোলপাড় করে ফেলে। আফসার বোঝে, সে কিসের খোঁজে আছে। শফিকদের সঙ্গে অফিসে বসে বহুদিন পর আজ সিগারেট খাওয়ার সুবাদে দেশলাইয়ের বাক্স তার পকেটেই রয়ে যাবার কথা। নাকি সে ফেরত দিয়ে দিয়েছিল ওটা? আফসার ব্যস্তসমস্ত হয়ে তার পকেট থাবড়ায়। কি সৌভাগ্য, বুক পকেটেই পাওয়া যায় সেটা। মেয়েটার হাত তখন তার পার্স বাদ দিয়ে ভেনিটি ব্যাগ তোলপাড় করে চলছে। ঠিক এমন সময় আফসার তার দিকে ম্যাচের বাক্স বাড়িয়ে ধরে। মেয়েটা তার চোখ দুটো তুলে কেবল তাকায় বাক্সটার দিকে। মিষ্টি করে হাসে। ঠোঁটের কোনা থেকে সরু ধুম্রশলাক্তি তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে নেয় তারপর সে আফসারের দিকে তাকিয়ে কাঁধ শ্রাগ করে,

“সিগারেট ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে অপেক্ষমাণ কোন তরুণীর দিকে কখনো গোটা দেশলাইয়ের বাক্স এগিয়ে দিতে হয় না, এটা জানেন না?”

আফসার উত্তর না দিয়ে দেশলাইয়ের কাঠী ঠুকে আগুন ধরায়। মেয়েটা ঝুঁকে আসে আফসারের দিকে। ঘেঁষে বসে খানিকটা, আফসারের শরীরের সঙ্গে। সিগারেটের শেষ মাথা আগুনের প্রান্তে ধরে লম্বা একটা টান দেয়। গ্রিবার রগ টানটান হয়ে ওঠে, শাড়ির ফাঁক গলে ফিনফিনে ব্লাউজে ঢাকা একটা স্তন প্রায় উন্মোচিত হয়ে যায়। কিন্তু তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ দেখা যায় না। সুন্দর একটা পারফিউমের ঘ্রাণে চারপাশ বুঁদ হয়ে থাকে কিছুক্ষণের জন্য। মেয়েটা ডানদিকে মাথা হেলিয়ে হাতের ওপর ভর রেখে তাকিয়ে থাকে আফসারের দিকে। ওর গলায় একটা চেইন। স্বর্ণেরই বোধয়। সেটা ঢুকে গেছে ওর বুকের বিপদজনক চড়াই উৎরাইয়ের মাঝে।

“আপনি মেলেনা সিনেমাটা দেখেন নাই?”

মেয়েটার প্রশ্নে সংবিৎ ফেরে আফসারের। মুভিটার নাম তার পরিচিত লাগে, কিন্তু সে নিশ্চিতভাবে মনে করতে পারে না যে এটা কোন মুভি।

“দেখেন নি!” মেয়েটা আফসারের নীরবতায় কোনক্রমেই নিজের বিস্ময় লুকাতে পারে না। “আমি মেয়ে হয়েও তো এ মুভিতে মনিকা বেলুচ্চির শরীর থেকে চোখ ফেরাতে পারি না। আর আপনি দেখেনই নি এটা?”

“দেখেছি,” আফসার ছোট করে উত্তর দেয়। মনিকা বেলুচ্চির কথায় তার স্মরণ এসেছে মুভিটার স্মৃতি।

 


অদূরে দাঁড়ানো ছেলেটাকে মেয়েটা প্রায় ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। তারপর দু’জন হাত ধরাধরি করে হারিয়ে যায় সিদ্ধেশ্বরী কলেজের দুই দালানের মাঝের রাস্তাটা ধরে। কিছুক্ষণ ওদের হারিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আফসার। এরই মাঝে ঘনিয়ে এসেছে সাঁঝের আঁধার।

 

“মুভিটা দেখেও আপনি দেশলাইয়ের বাক্সটা স্রেফ এগিয়ে দিলেন আমার দিকে! সিগারেট ধরিয়ে দিলেন না নিজ থেকে। আমি এটাকে ব্যক্তি আক্রমণ হিসেবে নিলাম…” মেয়েটার ঠোঁটের ফাঁক থেকে নির্গত ধোঁয়া তার চারদিক আচ্ছন্ন করে ফেলে। ঠিক একই সময়ে তার মোবাইলটা আবারো বেজে ওঠে।

“কোথায়? সেকি? চলে এসেছ এর মাঝেই? আমি তো পাশেই বসে ছিলাম, আমাকে…”

এর ফাঁকে অদূরে একটা ছেলেকে হেঁটে আসতে দেখা যায়। ঢ্যাঙ্গামতন, লম্বা, মুখে ঘন দাঁড়ির জঙ্গল। হেঁটে আসছে দূর থেকে। মেয়েটা পুরো শরীর দুলিয়ে ওর দিকে চেয়ে হাত নাড়ে।

“এই ফুলগুলো নিয়ে যান,” আফসার তার তেত্রিশটা গোলাপ এগিয়ে দেয় মেয়েটার দিকে। “ওনাকে অবাক করে দিন।”

মেয়েটার চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে যায়। পরক্ষনেই আবারো হেসে উঠে আলগোছে ফুলের তোড়াটা তুলে নেয় আফসারের হাত থেকে। তারপর, সে ফুলের তোড়ার পেছনে নিজের চেহারা আড়াল করে আফসারকে মৃদু স্বরে বলে, “সত্যি বলতে, আজ যার সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়েছি, ওকে গিফট দিতে চাইলে পট করার স্টিকের কোন তুলনা নেই। নিয়ে আসি নি, কারন পট করার পর ও আর ইহজাগতিক প্রাণী থাকে না, মহাজাগতিক ঠাকুরদাদা হয়ে যায়। মুখ দিয়ে কেবল আধ্যাত্মিক বানী নিঃসৃত হয়।”

ছেলেটা ততক্ষণে আরও একটু এগিয়ে এসেছে।

মেয়েটা ফুলের তোড়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “তবুও, ওকে ভালোই একটা সারপ্রাইজ দেয়া যাবে আজ।” তারপর, কেমন যেন একটা কৈফিয়তের সুরে মেয়েটা বলে ওঠে, “কবি ও, বুঝলেন।”

এরপর মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। শাড়ির পেছনের দিকটা থেকে ধুলোবালি ঝাড়ে। তারপর শাড়ি আবার আগের মতো আস্ঠেপৃষ্ঠে জড়াতে জড়াতে আফসারের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।

“বাড়ি গিয়ে আপনার বৌকে একটা প্রশ্ন করবেন।”

আফসার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।

“আপনার বৌকে প্রশ্ন করবেন, মেয়েরা প্রেম করে কবিদের সঙ্গে, কিন্তু বিয়ে করে বেনিয়া, বা কেরানীদের। এর কারনটা কি?”

অদূরে দাঁড়ানো ছেলেটাকে মেয়েটা প্রায় ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। তারপর দু’জন হাত ধরাধরি করে হারিয়ে যায় সিদ্ধেশ্বরী কলেজের দুই দালানের মাঝের রাস্তাটা ধরে। কিছুক্ষণ ওদের হারিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আফসার। এরই মাঝে ঘনিয়ে এসেছে সাঁঝের আঁধার। অফিসার্স ক্লাবের কাছাকাছি কোন মসজিদ থেকে ভেসে আসা সান্ধ্যকালীন আযানের ধ্বনি পুরো দিনটাকেই সমাপ্তির চাদরে মুড়ে নেয়। আফসার উঠে দাঁড়ায়। প্যান্টের পেছনের ধুলো ঝাড়ে। পকেট থেকে হ্যান্ড সেনিটাইজার বের করে হাত জীবাণুমুক্ত করে। তারপর পকেটে দু’হাত ভরে ফেলে হাঁটা শুরু করে।

 


কতোকিছু ঘটে গেলো আজকের দিনটায়। মোটেই আফসারের গতানুগতিক দিনগুলোর একটা নয়, আজ। তার জীবনের সাধারণ দিবসগুলোতে সে প্রতিটি ঘটনার প্রবাহকে শক্ত করে শেকল দিয়ে বেঁধে টেনে সুশৃঙ্খল করে রাখার চেষ্টা করে আপ্রাণ।

          

হাঁটতে হাঁটতে সে পেরিয়ে আসে ভিকারুন্নিসা, বেইলি রোড মহিলা সমিতি, শাড়ির দোকানগুলো, বেইলিস্টার মার্কেট, সুইস বেকারি। শান্তিনগর মোড়ের কাছাকাছি এসে এক চা বিক্রেতার সামনে এসে সে থামে। চা ওয়ালা তার হাতে ওয়ান টাইম কাপে চা তুলে দিলে সে তাতে দু’বার ফুঁ দিয়ে চুমুক দেয়। সামনে ব্যস্ত সড়ক স্থবির হয়ে আছে জ্যামে। একমুখো রাস্তা, তবুও ডান – বাম দিয়ে কিছু রিকশা চেষ্টা করছে উজান ঠেলে সামনে এগুবার, উল্টো দিক দিয়ে। হট্টগোলে কান পাতা দায়। রাস্তার অপরপাশে কিছুক্ষণ আগের সেই হিজড়েটাকে আবারো দেখা গেলো। ফুটপাথের ওপর বসে আফসারের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া ফুলগুলো সে নাকের কাছে ধরে শুঁকছে। আফসার একনজর দেখেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। এর মাঝেই দুটো কিশোর কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি শুরু করে দেয়। পেছন থেকে সমবয়সী আরও কয়েকজন তাদের টেনে সরাতে চাইলেও পারছিল না। এই কিশোরদের হইহল্লার পেছনে, এক টিনএজ মেয়ে চোখে রাজ্যের অবজ্ঞা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেয়াল ঘেঁষে। কিছু পর বোঝা গেলো, এই মেয়েটির প্রণয়প্রার্থী দুই কিশোর। মেয়েটিকে নিয়েই বিবাদের শুরু। কিন্তু মেয়েটার হাবেভাবে তাকে নিয়ে সংঘটিত  এই খণ্ডপ্রলয়ে ছিটেফোঁটা পরিমাণ আগ্রহ আছে বলেও মনে হচ্ছিল না। তার বয়সটাই এখন এমন, যখন শত শত কিশোর তরুণ যুবা মাড়িয়ে যাওয়ার জন্য তাদের হৃদয় বিছিয়ে দেবে তার পায়ের নীচে। সে হিসেবে এই ছোট্ট একটা লড়াই তো তার ভ্রুকুটিরও যোগ্য নয়।

এইসব ভাবতে ভাবতে আফসার একপর্যায়ে খেয়াল করে, লড়াকু মোরগের মতো কিশোর দুটির একটি অপরটির নাক ঘুষি দিয়ে ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। অন্যান্য দিন হলে সে হয়তো নিজেই এগিয়ে গিয়ে তাদের লড়াই থামানোর চেষ্টা করতো। আজ এক অজানা কারনে তার সে ইচ্ছেটুকু জাগে না। সে থেমে থেমে চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে। মেয়েটার প্রশ্নটা বরং তার মনে ঘাই দিয়ে যায় – মেয়েরা কবির সঙ্গে প্রেম করতে চায়, কিন্তু বিয়ে করে একজন বেনিয়া, কিংবা কেরানীকেই, তার কারন কি? কারনের মধ্যে খুব গভীর কোন জটিলতা নেই। বড় ব্যবসায়ী, বা সরকারি চাকুরের সঙ্গে জীবন নিশ্চিন্ত, এতোটুকুই। তবে মেয়েটা যেটা জানে না, তা হল, পৃথিবীর সব কেরানীই জীবনে কখনো না কখনো কবি ছিল। পৃথিবীর সব ব্যবসায়ীই কখনো না কখনো মনের ভুলে হলেও দুটো লাইন লিখেছে কারো জন্য। সুতো কাটা ঘুড়ির মতো সে কবিতা বা কবিতার পঙক্তি কোন ঠিকানা খুঁজে না পেয়ে হারিয়ে গেছে দূর আকাশে। কোন বেনিয়া বা কেরানী স্বামীর মনের মাঝে সে ঘুমন্ত কবিসত্তাকে জাগিয়ে তুলবে, মর্ত্যের পৃথিবীতে এমন মহৎপ্রাণ, উদারমনা বিবাহিত স্ত্রীর দেখা মেলে না।      

কতোকিছু ঘটে গেলো আজকের দিনটায়। মোটেই আফসারের গতানুগতিক দিনগুলোর একটা নয়, আজ। তার জীবনের সাধারণ দিবসগুলোতে সে প্রতিটি ঘটনার প্রবাহকে শক্ত করে শেকল দিয়ে বেঁধে টেনে সুশৃঙ্খল করে রাখার চেষ্টা করে আপ্রাণ। পত্রিকা অফিসের কলিগদের সাথে সম্পর্ক থাকে ফরমাল, সময় মতো অফিসের কাজ শেষ করে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়, ঘড়ির কাঁটা ধরে সন্তানদের নিয়ে আসে প্রাইভেট টিউটরের কোচিং থেকে, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে পেপারটা নিয়ে বসে ড্রয়িংরুমে, রাতে খাবার টেবিলে বসে সীমার সঙ্গে সারাদিনের খুঁটিনাটি নিয়ে আলাপ হয় সামান্য, তারপর পরিবারের সবাই মিলে কিছুক্ষন টিভি দেখার পরেই ঘুম। এভাবেই তার জীবন কেটে যাচ্ছিল ঢিমে তালে, কোন তেহাই ছাড়া। এভাবে হয়তো কেটে যাবে বাকি জীবনটুকুও, যেমন কাটে মধ্যবয়সের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরুষের। এরমাঝে আজকের দিনটা ব্যতিক্রম হয়ে রইলো তার দিনান্তের রোজনামচায়, রুলটানা কাগজে সুন্দর একঘেয়ে হাতের লেখার মাঝে বিচ্ছিরি কাটাকুটির মতো করে।

আজ দিনটা ব্যতিক্রম, কারন আজ শেষরাতে ঘুমের মাঝে একঘেয়ে আফসার স্বপ্নে ফিরে গিয়েছিল তার কলেজ জীবনে। স্বপ্নে দেখেছে সে তার জীবনের প্রথম প্রেমিকাকে।


    সাজিদ উল হক আবির

সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক পরিচয়ে। প্রকাশিত উপন্যাস – শহরনামা (মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), গল্পগ্রন্থ – শেষ বসন্তের গল্প (শব্দশিল্প, ২০১৪), আয়াজ আলীর ডানা (শব্দশিল্প, ২০১৬), কোমা ও অন্যান্য গল্প (শব্দশিল্প, ২০১৮), কাঁচের দেয়াল (চমন প্রকাশ, ২০১৯), নির্বাচিত দেবদূত (অনুবাদ প্রকাশন, ২০২৪), কাব্যগ্রন্থ – হেমন্তের মর্সিয়া (শব্দশিল্প, ২০১৮), অনুবাদ – উপন্যাস ‘মিসিং পারসন’ – প্যাট্রিক মোদিয়ানো (চমন প্রকাশ, ২০২০), মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ প্রকাশন, ২০২৩), উপন্যাস ‘দ্য ফরটি রুলস অফ লাভ’ / দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন –  এলিফ শাফাক (ঐতিহ্য, ২০২৪)।

জন্ম পুরনো ঢাকার আইজিগেইট, ফরিদাবাদে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। শিক্ষকতা করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে। বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে (পূর্ণকালীন) এবং জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু ইন্সটিটিউট অফ কম্পারেটিভ লিটারেচার অ্যান্ড কালচারে (খণ্ডকালীন)।           

শেয়ার