পরানবায়ু | মাহীন হক

চোখ দুইটা ঘোলাটে, আধবোজা ও নিজের স্যান্ডেলজোড়ার উপর থিতু, যদিও আদৌ কিছু দেখতেছে কিনা কে জানে। সেই চোখে বাইরের কেউ প্রশান্তি কিংবা অবশতা, যেকোনোটাই কল্পনা কইরা বসায়ে নিতে পারতো।


সে যখন মারা যাইতেছিল তখনো তার গলায় একটা আধগাওয়া গান বেজে ছিল। ম্যায় দুনিয়া ভুলা দুঙ্গা তুমহারি চাহাত মে। এতটুকু গাইতেই আচানক তার গলা আটকায়ে গেল। গানটা শেষ করা হইল না। দেহ থেকে প্রাণ বাইর হওয়ার পথরোধ কইরা সুরখানা কোনো এক কারণে গলার মাঝখানেই জেদ ধইরা বইসা পড়লো। দুই কাঁধ ধইসা পড়লো আঙটায় ঝোলানো শার্টের মতন। কেবল কণ্ঠের ভেতর তখনো সেই অগাওয়া গানটা রইয়া যাওয়ায় পুরাপুরি ভূপাতিত হইতে পারলো না। সমস্ত অস্তিত্বসমেত তার শরীর কতক সুরের অবলম্বনে ঝুইলা রইল।

সবাই তারে দেইখা এক নজরেই বুইঝা গেল, যে সে মারা গেছে, কিংবা মরার মতই। কোনো হার্টবিট নাই, পালস নাই, কেবল গলার কাছে একটা মৃদু স্ট্যাটিক আওয়াজ। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি এই দোদুল দশায় সে কষ্ট পাইতেছিল কিনা তার কোনো স্পষ্ট ইশারা তার চোখে-মুখে ভাইসা ওঠে নাই। দুই ঠোঁট হাল্কা ফাঁক হয়া ছিল, হাত-মাথা ঝুইলা ছিল এমন বেওয়ারিশভাবে যে, কোনো সন্দেহই ছিল না যে সেইসব থেকে সবটুকু মালিকানা ততক্ষণে সে ফিরায়ে নিছে। চোখ দুইটা ঘোলাটে, আধবোজা ও নিজের স্যান্ডেলজোড়ার উপর থিতু, যদিও আদৌ কিছু দেখতেছে কিনা কে জানে। সেই চোখে বাইরের কেউ প্রশান্তি কিংবা অবশতা, যেকোনোটাই কল্পনা কইরা বসায়ে নিতে পারতো। এবং তারা সবাই ছিল বাইরের কেউ, যেহেতু সেইখানকার কেউই জানত না ঠিক কীরকম লাগে এরকম অবস্থায়। সেইখানে যারা জ্যান্ত, তারা পুরাপুরিই জ্যান্ত ছিল, আর যত মৃতজনের সাথে তাদের এর আগে দেখা হইছিল, তাদেরকেও মৃত্যু এক সম্পূর্ণ দ্ব্যর্থহীন লোকমায় গ্রাস করছিল।

তবুও এই অভিজ্ঞতা সুখকর হওয়ার তো কথা না—কোনোদিন মরণের প্যাঁক-কাদায় অর্ধেক ফাঁইসা না গিয়াও এতটুকু অনুমান কইরা নেয়াই যায়। তার মেয়ে, যার সাথে সে থাকত, সে ব্যস্ত হয়া পড়ল এই সঙ্কট থেকে উদ্ধার করতে—বাপের গলা থেকে গানটারে, কিংবা গানের কবল থেকে বাপটারে। গলায় মাছের কাঁটা-ফাটা আটকাইলে বিড়ালের পায়ে পড়া যায়। কিন্তু কণ্ঠে একটা চিটচিটে ধ্বনি গাঁইথা থাকলে কার পায়ে ধরা যায়? কোনো গাতকের? লিপি বুইঝা উঠতে পারে না কিছু। তবু কতখানি ভাত দলা পাকায়ে কোনোরকম মুখের ভেতর ঢুকায়ে দেয় বাপের, যদি তাতে লাভ হয় কোনো। ভাতের দলা কোনো বাধা পায় না, অনায়াসে নাইমা যায় পেটে। আর গানটাও নিজের জায়গায় থাইকা যায় বহাল তবিয়তে। একটা গান, কতখানি বায়ুর কাঁপুনি, তারে ভাত স্পর্শ করে না। কী করবে সে? ডান হাতের সব আঙুল ভাঁজ কইরা জোরসে ডলা দেয়ার চেষ্টা করে সে, যেনবা গ্যাস, একটু চাপ দিলেই ঢেঁকুরের সাথে বাইর হয়া আসবে—কিন্তু পারে না ঠিকমত। কী এক আবল্য যে পায়া বসে তারে। তার হাত, বাহু, সর্বাঙ্গ শুধু পিতৃশোকে অবসন্ন হইতে চায়।


নবজাতকের কানের কাছে আজান দেয়ার মত কইরা তার কানের কুহরে নামায়ে দেয়া হইতে থাকে একটা সুরের আল, ম্যায় দুনিয়া ভুলা দুঙ্গা…


কিন্তু এলাকার বিটলাবুদ্ধিপ্রবণ পোলাপান যারা হাজির ছিল, তারা ঘটনার আকস্মিকতায় বিলকুল না ঘাবড়ায়ে বাইর করে আরেক বুদ্ধি। পালাক্রমে তারা তার কানের কাছে গাইতে থাকে গানটা। নবজাতকের কানের কাছে আজান দেয়ার মত কইরা তার কানের কুহরে নামায়ে দেয়া হইতে থাকে একটা সুরের আল, ম্যায় দুনিয়া ভুলা দুঙ্গা…। যেন তাতে গাঁইথা বাইর হইয়া আসে বাকিটুকু। পালাক্রমে গাইতে থাকে তারা। ওদিকে লিপি তার ক্লান্ত হাতে সাধ্যমত ডলতেই থাকে। দর্শক যারা ছিল, তারা এই ঘটনায় একটা মেকি দুঃশ্চিন্তা বুনতে শুরু করে।

আল্লাহ মাফ করো, কেউ কেউ বলে, মরার কালে কই আল্লার নাম নিয়া মরবো, তা না, মরার কালেও গান লইসে। জীবনডাও গেল এইসব গান-বাজনায়, অহন মরণের কালেও এই।
কেউ স্মরণ করায়ে দেয়, এইসব পাগলামির লাইগাই তো বউডা ছাইড়া গেলগা। নিজের জীবন তো পুড়াইলোই, পোলা-মাইয়ার জীবনডাও এমনে নষ্ট করলো। গানে গানে হালায় নিজেরে ফুরায়া ফালাইল।

এত বলাবলির চোটে বাতাস ভারি হয়া ওঠে। লিপির হাত চলতে থাকে। কখনো ডান হাতে, কখনো বাম হাতে সে বাপের শিরদাঁড়া হতে ঠেলে কোনো একটা কিছুরে পরিণতির দিকে নিয়া যাইতে চায়। এত আয়োজনও কারো নজর এড়ায় না। কেন তার এত তাড়াহুড়া? কেন সে নিজের বাপের মরণের ক্ষণ এত কাছায়ে আনতে চায়? সারাটা জীবন একা হাতে মানুষ করলো যেই মেয়েরে, সেই মেয়ে আজ এরকম করতেছে? কী এমন সম্পত্তিই বা আছে তার? জমিজমা তো দৌড়ায়ে যাইতেছে না কোথাও। নাকি কোনো গোপন নাগরের সাথে শলা-পরামর্শ কইরা লিপি নিজেই ঘটাইল এইসব? হইতেই পারে। তলে তলে একটা নাগর জুটাইলে তো অবাক হওয়ারও কিছু নাই। তাই বইলা সারাটা জীবন বাপে একহাতে মানুষ করছে যেই মেয়েরে, সেই মেয়ে এমন করবে? এখনো সবাইর মনে আছে, এক হাতে মাইয়ারে কোলে নিয়া দোকান সামলাইত ইবরাহিম তালুকদার। কোলের উপর মেয়ে ঘুমায়া আছে, সে একহাতে একটা একটা কইরা আলু ঢালতেছে পলিথিনে, ওদিকে পলিথিনের মুখও বুইজা আসতেছে একটু পরপর, এরকম কত হইছে! তারা নিজেরাই তো এমনে দাঁড়ায়া থাকতে থাকতে অধৈর্য, ত্যক্ত হইছে কতবার। কোনবার এই মাইয়ারই স্কুলের ভর্তি ফি দিতে গিয়া বাপের আমলের জানের প্রিয় ক্যাসেট প্লেয়ারটা বিক্রি কইরা দিল। সেই মাইয়া আইজ…। সত্যিই, বয়স হইলে মানুষ হয়া পড়ে ন্যাকড়ারও অধম। কেউ কেউ নিজেদের পোলাপানের দিকে কড়া নজর ফালায়া জিজ্ঞেস করে, কী, আমরা বুড়া হইলে আমাগোরেও খেদানোর লইগা এমনে উতলা হইয়া পড়বি নাকি? পোলাপানগুলা ফ্যালফ্যাল কইরা তাকায়ে থাকে, বুইঝা উঠতে পারে না কোন দোষে তাদের সামনে বাপ-মা না থাকার এই নির্দয় সম্ভাবনা মেইলা ধরা হইল। আর তারপর, সমস্ত বলাবলির উপাদান, পোলাপানের উদ্যম ও লোকজনের কৌতূহল ফিকে হইয়া যাওয়ার পর সবাই চইলা গেলেও লিপি থাইকা যায়।

প্রায় যন্ত্রের মত তার হাত চলতেই থাকে। সে জানে না আর কী করার আছে তার। একটা উদ্ভট অবস্থা টপ কইরা ফালানো হইছে তার পাতে, এইটারে কোনোভাবে হটাইতে হবে, এদ্দুর পর্যন্তই ভাইবা রাখছিল সে। একটা কিছু কইরা সারার দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য তাড়নাই তারে দিয়া করাইতেছিল যা কিছু করার। এই কইরা সারার ওইপারে কী আছে, সেইটা ভাববার ফুরসতও সে এতক্ষণ পায় নাই। এইমাত্রই, গা-টা একটু ছাইড়া দেয়ামাত্র তার মাথায় খেললো যে, গানটা তার গলা থেকে বাইর করে ফেলা মানে হয়তো মৃত্যু। এখন সে কী করবে? এত দিশাহারা লাগে তার নিজেরে। যেন কোনো বদমেজাজি পাওনাদারের সামনে তার পার্স থেকে ফসকায়ে হাজারো কয়েন ঝনঝন করে গড়ায়ে পড়তেছে চারদিকে, ব্যাঙের মত লাফায়ে লাফায়ে তারা ছড়ায়ে যাইতেছে পৃথিবীর নানান কোণাকাঞ্চিতে, আর সে কোনটার পিছে যাবে সেটা বুইঝাই উঠতে পারতেছে না কোনোমতে। কারে সে জিজ্ঞেস করবে? এইরকম ধন্ধের মুখে পড়লে এমনিতে তো সে বাপের কাছেই যাইত। কিন্তু এখন? জীবনে প্রথমবারের মত তার ভয়ানক রাগ ওঠে নিজের বাপের উপর। কেন এমন অথর্ব বানায়ে বড় করলো লোকটা তারে? কেন নিজের মত কইরা কোনোদিন কিছু করতে দিল না? লোকটা জানে দুপুরবেলা দোকান দেখতে ফালায়ে গেলে পর কতরকমের জ্বালাতন সহ্য করতে হয় একটা মাইয়ার? না। ভাত খাইয়া গান ছাইড়া সেই যে ঘুমটা দিত, একেকদিন সন্ধ্যারও পরে ফিরত সে। এইসব তো চায় নাই লিপি। পড়াশোনাটা শেষ করতে চাইছিল, নিজের মত আলাদা কইরা থিতু হইতে চাইছিল। ভাইরে তো ঠিকই নিজের মত ব্যবসা করতে দিল, ঢাকায় চইলা যাইতে দিল সব তার ঘাড়ে ফালায়া। কিন্তু তার বেলা? কোনো খেয়াল ছিল লোকটার?

খুব আস্তে আস্তে উদরের ভিতর থেকে কান্নার বলক উঠতে থাকে লিপির। নিজের মা, যার কোনো স্পষ্ট স্মৃতি তার মনে নাই, তার সাথে এক আবছা একাত্মতা টের পায় বুকের মধ্যে। মায়ের যেই কাজটা এতদিনে কিছুতেই বুইঝা উঠতে পারে নাই, তা আচানক খুবই সহজবোধ্য ঠেকে। খুবই বেমক্কা এক স্বাভাবিকতায় সে নিজের ডান হাতের পেশি চাপতে চাপতে বাপরে রাইখা উইঠা চইলা যায় পাশের ঘরে। খুব রাতে এই ঘর থেকে একটা ঘর্ঘর ধ্বনি মিহিভাবে ছড়ায়ে যায় সারা বাড়িতে।

 



                                                                     লেখক পরিচিতি:

কৈশোরের শেষদিকে পছন্দের ভিন্নভাষী কবিদেরকে একটু একটু করে নিজের ভাষায় রূপান্তর করার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের দুনিয়ায় প্রবেশ করেন মাহীন হক। ভালোবাসেন ভাষা, সঙ্গীত, ও হিউমর। সাহিত্যের ছাত্র। অনুবাদে নাম করছেন, কয়েকটা বইও প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা ও গদ্য লিখেন।

শেয়ার