সহোদরা ও প্রেমিকার মৃত্যু
যে বাতাসে ভেসে তোমাদের দেশে আসি
কিছু মদ আর বিষাদ জমিয়ে রাখি
বাতাস ঝড় হবে না বলে আমাকে ভাসায়
আমি উদ্ভ্রান্ত দিনের পেটে ঘুমিয়ে থাকি
কাঁথার ভিতর জেগে থাকে রোদের পাথর
তার উত্তরে ছিলো দীর্ঘ রাতের নিশ্বাস
তোমাদের দরোজায় ডাকে শাদা রাজহাঁস
এই ভেবে আমি জেগেছিলাম চারশোবছর
ঘুম ভেঙে গেলে বুকে রেখে ফুল ও ছুরি
সহোদরা ও প্রেমিকার মৃত্যু কামনা করি
দৃশ্যখাদক
আমি বিষাদিত এবং অবশেষে ধৃত
মাছ যেইরূপে মৎস্যে পরিণত
ফাতনায় দোলে হংসমান লোভ
আমি বিষাদিত
স্যাকারিন সন্ধ্যায়
আমি এবং আমার চোখ
আমরা দুজন অনায়াসে তিনজন
বড়শি ঝুলে আছে অগভীর জলে
অদূরে জঙ্গলের কোলাহল শোনা যায়
আর আমি মৎস্য
আমি বিষাদিত নিষ্পলক মৃত্যু
দৃশ্যখাদকের চোখে ভাঁজ করা ঘুম
বটফুল
কোথাকার কোন সরোবরে উদ্ভিন্নসংবাহন
স্বপ্নে দেখা বটফুল
উজ্জীবিত দিনের পদভারে নত স›ধ্যার দেহ
মোমের ভদ্র গম্ভীর সলতে
তার জ্বলতে থাকা কোমল অহঙ্কার
প্রভাবিত করে কারো অনন্তর পিছিয়ে পড়া
সে হয়তো উত্তীর্ণ হতে পারে অথবা
পতন নিশ্চিত জেনেই
ভাবনাতাড়িত ব্যঞ্জনাকে ধরে
মোমের সলতে হয়ে যায় শূন্যতার সংবাহে
একদা সে বটফুল স্বপ্নে দেখেছিলো
উরুমূলে প্রাণ সঁপে রক্ত
সে সারাদিন স্তন পান করে রাতভর ঝিমায়
ভোরবেলা স্নান করে আড়াই ঘন্টা নয় মিনিট
কেঁচো আর কাঁকনের জোড়হাতে পরে ঢেউ
খানিক জিরিয়ে নিয়ে সাঁতার ভুলে দাঁড়ায়
দুধঘুম চোখে জড়িয়ে বামহাতে ছাইপাশ
তার চাতালের নাম নেই জানা যাবে শেষে
সুগন্ধিধ শ্যাম্পুর বিলাস চুলের খেলায় ঝিকি
তার শরীর নিমের ডাল ছুঁয়ে পরিক্রান্ত সুখ
প্রেতিনী মৃতের সকল নৈঃশব্দ্য ভেঙে দেয়
প্রেতিনী শাদা আর কালো পূর্বপশ্চিম
আমি তার উরুমূলে প্রাণ সঁপে রক্তপান করি
লেবুপাতায় ফুরিয়ে যায়
আঙুলে বেঁধা পতঙ্গ ভাস্কর্যের দিকে তাকায়
অডিকোলনের গন্ধে ভেসে যায় ঘরের বাতাস
ভাঙা জানলায় বসে দুখানি চড়–ইপাখি
কিছু মদ জমে আছে পানির বোতলে
জলের তৃষ্ণা আজ আকাশের চিল
এখানে রোদের আঙুল মোমের মতো গলে
পতঙ্গ শুকনোপাতা
এখানে গুনে গুনে ডুবে যায় হলুদপাখি ও পাপ
আর লেবুপাতায় ফুরিয়ে যায় দিনের উত্তাপ
জলতেষ্টা
তীরে যেতে যেতে পূর্বের সকল বিস্বাদ
ফেলে আসি জলতেষ্টার পেছনে
উজ্জ্বল সপ্তকের মায়া ঘুম ফেলে দুলে সূর্য
হরিণের ছায়া ক্রমে চক্রমিত প্রগাঢ় প্রমোদ
ভোরবেলা ঠান্ডাদেয়াল জাগে
সন্তরণের বাহুতে রহিত শক্তিসুর
নিক্বণমৃত রোদের নূপুর
আমি যাবো পথ করে দাও
জলতেষ্টা আছে আমার কাছে
উল্কি উড়ে যাচ্ছে
কে এঁকে দিয়েছিলো
ঘাড়ের দুইইঞ্চি নিচে আকুপাঙ্চার
এখন আল্ট্রামেরিন উড়ে যাচ্ছে উল্কি
নিঃশ্বাসের অমরতা
কে এঁকে দেয় হেমন্ত
এলএসডি ভোর জ্বলে উঠে ছাই
শুধু চিনাবাদাম আছে ড্রয়ারে
পূর্ণ করেছে একপাশ
স্তনে তিল আর চিবুকে কাটাদাগ
কে এঁকে দেয় পুষ্পক
একটা সুই আঙুলের ফাঁকে বেকার
এচিং প্লেট ক্ষয়ে গেছে তালার ওপারে
কে এঁকে দেয় আকুপাঙ্চার
উল্কি উড়ে যাচ্ছে কারো চোখ
বিভেদ
পরস্পরের আঙুল ছেড়ে যাচ্ছে নখ ও নখর
করতলে বপন করছি উৎসবের জীবাশ্ম
বপন করছি সূর্যাস্তের ক্লেদ আর কদাকারমেঘ
মৃতঘাসের ছায়ায় মাটি আর পিঁপড়া চক্রমন
উত্তরের দেয়ালে কলেপড়াইঁদুরের ত্বকের রঙ
হাওয়ায় কর্পূরের শাদাশাদা ঘ্রাণ ক্রমে বর্ণহীন
আমাদের পাঁজর একই দেয়ালের জারজ
আমরা বিভেদ হচ্ছি ট্রাপিজিয়ামের রেখা ধরে
নিঃশব্দ ট্রেন
কেনো বসে থাকি এই নিস্তাপ টেবিলে
চোখের ছুরিতে দৃশ্যগুলি চিরে দেখি
ডানপাশের হাওয়া ভেঙে বাঁপাশে সাজাই
কুকুরের চোখে বিহ্বল তন্দ্রা নামে
বিড়ালের চোখে বিহ্বল তন্দ্রা নামে
ছায়ারা প্রলম্বিত হয়ে ক্রমে লুট করে রাস্তা
এই কাক এই উপবন বিস্তারিত বর্জ্য
ঘুমঘুম ঘ্রাণ ছিঁড়ে যেতে চাই
কে গন্ধের উৎস সন্ধান করে
কে বসে থাকে এই নিস্তাপ টেবিলে
দূরে বসে বিলাপিত বয়েসী মাতাল
প্লাটফর্ম ছেড়ে চুপিচাপ নেমে পড়ি
বুকপকেটে দুপাটি রেললাইন নিয়ে ফিরি
আমার নিঃশব্দ ট্রেন আসবে
আমার নিঃশব্দ ট্রেন আসবে
কখনো সে
কখনো সে জেগে উঠে রাতভর রাতভর
কখনো সে চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে নামে
কখনো সমুদ্রে ঢেউ ফোটে শঙ্খপ্রহর
রাত্রিবাসে সুগন্ধি মাখানোর কথা ছিলো
ওখানকার সুগন্ধির নাম শুনেছি বেশ
গতকাল সন্ধ্যায় সে আমাকে খুঁজে ফিরেছে
আমি বুনোসুর আর শরসহ লুকিয়ে ছিলাম
যেখানে স্বপ্ন সত্যি হতে হতে ঘুম ভেঙে পড়ে
গর্ভহীন নারীর চোখের খোঁপে নড়ে উঠে ফুল
কখনো সে নুয়ে পড়ে একটি তিলের ভারে
কখনো তার লালজামা আকাশের পাড়ে
কখনো সে কাঁপে উত্তরে এলোমেলো ভুল
কূয়াতলার ছায়া
একদিন ভোর ভেঙে যাবে। রাস্তার মাদিকুকুর তাকাবে আড়চোখে। শাড়ির ভাঁজে ফুরিয়ে যাবে উষ্ণতা। চায়ের কাঁপে ডুবে যাবে মাছি আর মহাকাল। তোমাদের কূয়াতলার ছায়া নিয়ে আমি ফিরে যাবো। বনের পাড়ে একটি ঘর। মৃগয়ায় স্যাঁতা পড়ে আছে। আমি দিন গুনবো অভিজ্ঞানের কামনায়।
পাতার উঠান
আমার সূক্ষ্মলতা অলসতা, আমার সুচতুর বাজারের ব্যাগ, অপরিচয়ের যন্ত্রণা, সুতোর আড়ত, সস্তা সুখাবলি, সেলাইকল, কাঁচুলির স্ট্রিপ, সমুদ্রের ফেনা, দানাদার এলাচির বন, স্বপ্নে দেখা ঘোড়া, আরো আরো বিস্তারিত জনপদ, সব ফেলে চলে আসি পাতার উঠানে। পাতা আমাকে নিদ্রা দেবে ঘুম। বাতাস এসো, পাতার কাঁপন থামাও।
ডাকঘর বাড়ি গেছে
একদিন ভুলে গেলাম ফেরিঅলার নিবেদন। ধেয়ে আসছে মরুভূমি। অপর পিঠে নগ্ন প্লাবন। ডাকঘর বাড়ি গেছে বহুকাল। তোমাদের ঘুম ভাঙবে না! চিরুনিতে ঘষাদাগ, দাঁতের ফাঁকে বৃদ্ধকুন্তল। সে কবে কাকই ছিলো! তোমরা ভুলে গেছো। ভুলে গেছো ওঙ্কার। ইচ্ছে ঘুমে মৃত্যুকে নাও তাড়াতাড়ি, মরুভূমি আসছে। তোমাদের চোখ তুলে নেবে বালির ভাঁজে। ডাকঘর বাড়ি গেছে বহুকাল।
আমার জ্বর আসছে
আমার জ্বর আসছে, গন্ধর্ব। আঁচলের ভাঁজ ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে রাত্রিজাগা অরণ্য। একটি সুখফলা পাতা আমাকে না বলে ঝরে পড়ছে বনে। তোমার উরুর ভিতর রঙহীন পাথর আমাকে মুছে দিতে বলে সে¡দের উত্তাপ। নৌকো যেমন, মাছ যেমন করাত হয়ে চিরে চলে নদী…। গন্ধর্ব, তুমি কবন্ধ ঘুম হয়ে কেবল উড়ে বেড়াও। চাঁদ ধসে পড়ে, চাঁদের বোঁটায় জামের গন্ধ, জোছনা গাঢ় বেগুনি ও বিকৃত। থেতলে যাওয়া বুকে ফাটলের চিহ্ন অবশেষ। আমার শাদা শাড়িতে লেপে আছে একফোঁটা রামধনু। আমার শাদাসিঁথি খালিপায়ে হেঁটে চলে যাবে দিগন্তের দিকে…। গন্ধর্ব, আমার জ্বর আসছে, জ্বর।
ভস্ম গান
কার চঞ্চুতে রোদ লেগে ছাই হয়ে গেলো গান! ও পাখি, তুমি সূর্যের আত্মীয় নাকি? কোনোদিন ঘুমের অনাচারে জেগে দেখি ভোর এসে জানলার ফাঁক গলে মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছে। ভোর সেও এক পাখি—আমার মেঝেতে এসে ডানা ভেঙে পড়ে থাকে। তোমাদের শহরে আমার রাতগুলি ভস্মগানের সুর ধরে প্রলম্বিত হয় রাস্তায়, আর আমার গায়ে ধানের গন্ধ। প্রতিরাতে রাস্তায় হেডলাইটের তীব্র আলো খুলে নিতে চায় আমার চোখ, আমি বামহাতে আলো মুছে তাকাই ধীরে, পাশ কেটে চলে যায় নিঃশব্দ অ্যাম্বুলেন্স—পেটের ভিতর তোমার মৃতদেহ।
হলুদ ছুরি
একটা হলুদ ছুরি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটা হলুদ ছুরি শার্টের চোরা পকেটে পড়ে আছে দুইশোবছর। আদর্শলিপি ফেরাতে পারেনি আমাকে। স্মৃতিতে কেবল হলুদের শাদাফুল— শিশিরের অশ্রু নিয়ে ঝাপসা কুয়াশা হয়ে গেছে, বাড়ির পাড়ে ছিলো মাঠের শোলক। ওগো রামধনু সাত, তোমার ভয়ে বৃষ্টি আটকে গেছে মেঘের করাতে। আমার হাতেও শাঁখ, পকেটে রং। এই রং ধনেশের চঞ্চু রাঙিয়ে ফিরেছে গোপন ধাতবে। আমার পরিত্রাণ তোমাতেও নেই জেনে ক্লান্তিহীন ফিরে গেছি বারংবার নিজেরই নিঃশ্বাসের ভিতর। এই ক্ষণজন্ম পতঙ্গের ভার নিয়ে গেলে আকাশের বিদ্যুৎ— আমি ছুরিকারহিত রং দুহাতে মেখে ফিরে যাবো; ফিরে যাবো আদর্শলিপিতে।
অংকলেখা
একটা মাছ পাখিকে দেখে। একটা পাখি দেখে মাছ নি®পলক। আমি তোমাদের পাড়ার সমস্ত বালিশ গুনে ফেলি। বালিশ গুনে করি মানুষের গণিত। যারা একই বালিশে দুইজন—তাদের হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়, যাদের বালিশ নেই তাদেরও। মাছের বল্কলে গণিত লিখি। পাখি পড়ে ফেলে অংকের নকশা; সে গণিত বুঝে কম তাই জানতে পারে না মানুষ ক্রমহ্রাসমান। বনের শূন্যতা নিতে পারে না পাড়ের প্রান্তর। প্রান্তরেরও নিজস্ব শূন্যতা থাকে ভিন্ন। পাখিরা ফুরিয়ে গেলে নেই ছায়াগুলি কম্পমান। মাছেরও বিলুপ্তি আছে লাবণ্য ও রঙে। মূলত মাছ, পাখি আর মানুষ একই কচুপাতার বুকে টলোমল করে চিরদিন। মাঝখানের ঘটাই যে গণিত তা আলাপেরও নামান্তর। তারপরও একটা মাছ পাখিকে দেখে; একটা পাখি দেখে মাছ নি®পলক। কী অসহায়!
তৃষ্ণার গন্ধ
আমার আঙুলে কার নখ বড় হয়? বড় হতে হতে উল্টো হয়ে হাতের তালু কেটে বেরিয়ে গেছে পথের দিকে! পথের পায়ে আঁচড় কেটে ফিরে আসছে পুনর্বার আমার আঙুলে। আমি তোমার সহোদর, তোমার মতো ভিন্ন আমাকে করো না। ছিন্ন করোটি নিয়ে নিজেই দাঁড়িয়েছি। উত্তরের বাতাসে এখনো তৃষ্ণার গন্ধ। ধিকিধিক থেমে গেছে বিভ্রমের কোরাস। ওখানে রং আছে। আলোর উৎসারে লুকিয়ে আছে অন্ধকার। আর বাকি সব দৃশ্য পুড়ে গেছে।
শাদাফুল
ভুলে গেছি মাইল মাইল দীর্ঘশ্বাস, শাদাফুলের নৈসঙ্গ আর স্তব্ধতার সুর। কেউ ভায়োলিন এর সবচে’ কনিষ্ঠ তারটি ছিঁড়ে আমার হাতে দিয়েছিলো। এই তারেই উঠতো মিহিন কান্নার মীড়। এই তার এখনো যতœ করে রেখেছি। একদিন কোনোদিন গলায় পেছিয়ে দেবো দিগন্তের সমান এক টান। কান্না তখন মৃত্যুর প্রতিবেশী বোন। আকাশের বাকলে লেগে থাকবে চিলের লালা। সুদিন আসবে জানি, বাসনার শ্যাওলা-রং শাড়ি ভেঙে ঝিকিঝিক রেলগাড়ি উড়ে চলে যাবে শীত শেষে, বটের ফলে আঁকা থাকবে জরাসন্ধের নিয়তি।
শাদা কাগজ
কাগজ ভেঙে দিলাম—নৌকো হলো। কোন নদীতে ভাসাবো নৌকোখানি? ডোবায় ভরে আছে পৃথিবীর প্রান্তর। একটা নদী বানাই আসো, আমি প্রান্তরের বুক চিরে দিলে আড়াআড়ি— তুমি অশ্রু দিও তাতে। আরো একটা কাগজ শাদা আছে আমার বুকের ভাঁজে; তোমাকে দেবো।
কবি ও প্রেতিনী
এই ক্ষত শুকোবে না নিকানো উঠানে। এই ক্ষত কবি ও প্রেতিনী মিলে খুঁড়ে গেছে সন্ধ্যাবধি। কালীসন্ধ্যায় কাপালিকের চোখে জ্বলে জ্বলে ক্ষয় বাসনাপাথর। রাতগুলি সকরুণ কাকাতুয়া হয়ে উড়ে যায় লাল। বট ফলের গন্ধে মন কেমন করে চরাচর। যে পাহাড় উপড়ে আনে হনুমান—তার গাছ-বৃক্ষ-তৃণ কিছুই বনষ্পতি নয়। অদূরে মেঘনাদ পুড়ে যায় চিরদিন, সমুদ্রের নুনে।
অবিদ্যালয়
আমাকে পাওয়া গিয়েছিলো হরিণের চোখের ভিতর, ভয়ার্ত। জ্যোতিশ্চক্র শুদ্ধতায় উপড়ে আসে শীত। খুব দ্রুত এবং খামারের পাশের খড়ের গাদায় কাঁপন। সৌকর্যের অবিদ্যালয়। তারা এসেছিলো। তারা এসেছিলো জ্বরের ঘনক। আমি দন্ডায়মান ভূমির সরোজ, কখনো পদ্মপাতায় টলোমল। কেউ গোর ভাঙছে, ঘুম ছিঁড়ছে কিংবা অন্ধকারে চুষে খাচ্ছে আপন ঠোঁটের ক্ষয়। বিকলাঙ্গ বাসনা ঝরে পড়ছে ঝড়ের ফাঁক গলে, ঘনায়মান জ্বর। এই ডুবোজ্বর বানালো আমার শরীর। তারা বাইশটি করাত দাঁতহীন করে একটি অরণ্যের কাছে পুজো দিলে আমি নিশ্চুপ আরতি। ছুরিগুলি ধীরে মুঠোর ভিতর ভস্ম-হিমালয়। আঁখিঠার কাঙাল কুহু, শার্টের পকেটে শুকিয়ে যাওয়া তিনটি দোয়েল, ঘ্রাণবহ। নির্জন স্বরমন্ডলে ডুবে যাওয়া আঙুল ভুলিয়ে দিলে নারী ও মদ—কাউকে খুঁজি না গীতবিতানে। কেউ ঘুরছে। খুলে দিচ্ছে সর্বোচ্চ গীতবিতান। আমাকে পাওয়া গিয়েছিলো বুড়ি পিথিয়ার ভাঁজপড়া চোখের কোলে, নিষ্পলক। আমি আনন্দিত— অ্যাপোলোর অহম ও অবিমৃষ্য খেলা। আমি কাজল নই, তারপরও কেউ আকাশ ঘেটে তছনছ করে আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস। তারা রক্তের রং পাল্টে ধুয়ে দিচ্ছে স্বপ্নের বর্জ্য এবং লালা।
বহুভাষাবিদ
ভাষা ছিলো নিঃসীম রাতের অভিকর্ষ উদ্ভিদ। উদ্ভিদের ফনায় উগরে ওঠে অরণ্যের সুধা। এই সুধা ঢেউভাঙা বালকের আঙুল বিদীর্ণ করে, পর্বতের চূড়ায় আটকে থাকে—ঘননীল মেঘ। এই সুধা আমাকে দেয় ঝড়ের একশো তিনটা নাম। আর অযাচিত মুগ্ধতার কলুষ। কে ঢেউ ভাঙে, কে ভাঙে আঙুল? কার চুলের কাঁটাতারে বিঁধে থাকে এলাচের সুতীব্র ঘ্রাণ, চুলের আড়ে জোড়া জোড়া সূর্যফল? আমার ভাষা সূর্যের পায়ের তলায় মলিন রোদ হয়ে ফুরিয়ে গেছে। তুমি হাতের মুঠোয় নক্ষত্র বানাও, এই নক্ষত্র সূর্য হলেই আমি বহুভাষাবিদ।
অশ্রুর ক্ষত
যাতনার শেষে যাও। অইটুকু গোপন ছিলো, অশ্রুর ক্ষত। সহজেই তুমি ফুরিয়ে গেলে আমি পরান্মুখ পথের পায়ে বেঁধে দিই আয়ু। ফুল শেষ হয়, চোখ শেষ হয়—থাকে কচুপাতার বন। ওগো বন, একবার ধরে রাখো ভোরের অশ্রু। এই ভোর যাতনাকে চেনে। কালি মাখে চোখের কোলে নির্ঘুম যাতনা, প্রতিদিন দাঁড়ায় ভোরের পাড়ে। ডানপাশে ঘুম, বাঁপাশে হাওয়া, ডানা ভেঙে পড়ে, ডানার নাম অশ্রু।
মেঘনাদ বিষাদ
উজ্জ্বল, তুমি খসে পড়া বাতাসের গায়ে খুলে রেখেছো দুধশাদা দাঁত। পাতার কামড়ে গাছ মরে গেলে তুমি হাসো দাঁতহীন। তোমার দাঁত তখন ধূলির গাড়ি। কাঠের চাকায় তার উপছে পড়ে প্রাণ। ভিনদেশী গাড়োয়ান দুপায়ে বয়ে নিয়ে গেলো রাবণের রথ। এই রথ, এই পু®পক বাহক কোনোদিন মেঘনাদ বিষাদে হারিয়েছে বর্ণিল ডানা। উজ্জ্বল, তুমি এ চক্রে বানাতে পারো মৃন্ময় ছুরি, চির বৃত্তাকার। বাহির টেনে নিয়ে গেলো তোমার কনিষ্ঠ আঙুল। তুমি চক্রমনে ভেঙে দিয়ে দিশা পরমায়ুর ঝাড়ে বেঁধে দাও জানলা। এ আমারই জানলা, গরাদরহিত। তোমার দাঁত গলে যায় বাতাসের পরিত্যক্ত করতলে। তুমি দাঁতহীন হাসো রাজহাঁস, আমার নির্জন জানলার ওপারে।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। জন্ম: ২৪ আগস্ট ১৯৮১, চকরিয়া, কক্সবাজার। পড়াশোনা: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রকলা।
প্রকাশিত বই
পাখি ও পাপ (২০১১, কবিতা); শোনো, এইখানে বর্ষাকালে বৃষ্টি হয় (২০১১, মুক্তগদ্য); ডুবোজ্বর (২০১২, গল্প); কাপালিকের চোখের রং (২০১৩, কবিতা); পুরুষপাখি (২০১৪, মুক্তগদ্য); আরজ আলী : আলো-আঁধারির পরিব্রাজক (২০১৫, প্রবন্ধ); মহিষের হাসি (২০১৫, কবিতা); রাজহাঁস যেভাবে মাছ হয় (২০১৬, গল্প); আকাশ ফুরিয়ে যায় (২০১৭, মুক্তগদ্য); হুহুপাখি আমার প্রাণরাক্ষস (২০১৭, কবিতা)
সম্পাদিত বই
ওঙ্কারসমগ্র : বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রুতিলিপি (২০১৭)
সম্পাদিত ছোটকাগজ
মুক্তগদ্য
যোগাযোগ : nirzhar24@gmail.com